একটি খুঁজে পাওয়া আংটি

নাদিন গর্ডিমার

অনুবাদ : সম্পদ বড়ুয়া

 

সব গোল্লায় যাক!

মেয়েদের ব্যাপারে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ায় কিছুদিন সে একা থাকাই শ্রেয় মনে করল। ভালোবাসার জন্যে দু-দুবার বিয়ে করেছিল। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী চলে যাওয়ার সময় তাঁদের যৌথভাবে কেনা প্রিয় জিনিসগুলো যেমন চিত্রকর্ম, দুর্লভ কাচের সামগ্রী এমনকি ভাঁড় থেকে তোলা দামি মদ – সব তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যেসব জিনিস সে নিতে পারেনি, লোকটি সেগুলোও বিদায় করে বাড়িটাকে সাফ-সুতরো করে রাখল। বইগুলো ছুড়ে ফেলে দিলো, যেগুলোর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রথম স্ত্রী অনুরাগের সঙ্গে তার নাম লিখেছিল। ছুটির দিনগুলোতে কোনো নারীসঙ্গ ছাড়াই সে সময় কাটাতে শুরু করল। এই প্রথম বুঝতে পারল – যেসব ভবঘুরে প্রমোদবালাকে সে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিল, তারা সবাই স্ত্রীদের মতো একে একে অবিশ্বাসের পর্যায়ে চলে গেছে।

সমুদ্রের ধারে একটা হোটেলে উঠল সে, যেখানে খসখসে পাখার মতো পাথরগুলোকে যেন সাগরের দিকে সজোরে ছুড়ে মারা হয়েছে। সাঁতার কাটার জন্য এই জলমগ্ন স্থানে জোয়ারের পানি হিস-হিস শব্দে ছুটে আসে, আবার একসময় তা নেমে যায়। কোনো বালু নেই সেখানে।  সেদ্ধ মোরববার মতো উন্মোচিত ডোরাকাটা রঙিন দাগের পাথরের ওপর মানুষেরা বিশেষ করে মহিলারা নোনা বিবর্ণ জাজিমে শুয়ে থাকে আর শরীরে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ দিতে থাকে। মাথার চুলকে জড়ো করে কৃত্রিম ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখে। জল থেকে যখন মহিলারা উঠে আসে, তখন তাদের চুল থেকে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা নেমে এসে মসৃণ শরীরে বিচ্ছুরিত আলোর প্রতিফলন ঘটায় – একেবারে গিলটি করা হাতের তালু থেকে কানের চক্রাকার বলয় পর্যন্ত সামনে-পেছনে আলোর চমকানি। তাদের স্তন উন্মুক্ত। তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে তারা অধোমুখ-ত্রিভুজাকৃতির উজ্জ্বল কাপড় পরে। দুই নিতম্বের মাঝখান দিয়ে টানা একটা সুতো ওপরদিকে এসে কাপড়টাকে ধরে রাখে, যা নাভি আর ঊরুর ওপর দিয়ে গোলাকারভাবে আসা দুটো সুতোর সঙ্গে শেষ পর্যায়ে মিলিত হয়েছে। লোকটির দৃষ্টি যতদূর যায় – মহিলারা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বলে তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন বলেই তার মনে হচ্ছে। আবার তারা যখন জল থেকে উঠে আসছে আর খুশিতে ঘন ঘন নিশ্বাস টানছে। তার শুধু চোখে পড়ে, তাদের স্তনগুলো নাচছে। মহিলারা একটু আনত হলে স্তন নিচের দিকে ঝুলে থাকে। তারা হাসছে। তোয়ালে, চিরুনি আর তৈলাক্ত বস্ত্তর খোঁজ করছে। কারো কারো শরীর যোজক-রঞ্জিত কাপড়ের মতো, উন্মোচিত; সাদা বা লাল টুকরো কাপড়ের পোশাক সূর্যের অগ্নিময় তেজ থেকে তাদের রুচিহীন অবস্থাকে সামলে রেখেছে। কারো কারো স্তনাগ্র স্ট্রবেরির মতো কাঁচা, টসটসে। দূর থেকে ভালো করে তাকালে দেখা যায়, তারা সেখানে সুরভিপ্রলেপ খুব একটা মাখেনি। পুরুষও রয়েছে সেখানে। তবে সে তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে সে সমুদ্রের গর্জন শুনতে চেষ্টা করল। তার নাকে এসে লাগল নারীর ঘ্রাণ – সুগন্ধি তেল।

জমকালো পালে বিদ্ধ বাতাসতাড়িত শৈলশ্রেণির ওপর আছড়ে পড়া সফেন তরঙ্গপুঞ্জের মাঝখানে অনেকদূর বিস্তৃত শান্ত ও উপসাগরে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটল সে। শুভ্র জলরাশির নিচে বালুচরে তার মাথা মাড়িয়ে যাচ্ছে। কমবয়সী মায়েরা শিশু সন্তানদের নিয়ে অগভীর জলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। গালে নরম টোল পড়া ন্যাংটো শিশুরা তাদের মায়ের শরীরে লেপ্টে থাকে। মাঝেমধ্যে তারা আলাদা হলেও মনে হয় এসব শিশু মহিলাদের শরীরের অংশ যারা তার মতো পুরুষের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। নিজের শরীর শুকানোর জন্য সে পাথরের ওপর সটান শুয়ে থাকে। কনুই দিয়ে পাথর সরাতে তার ভালো লাগে, শরীরের হাড়গোড় পাথরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেকে অস্থিরভাবে নাড়াচাড়া করে। দেহের বাঁকগুলো প্রতিরোধের পরিবর্তে মানিয়ে নেওয়া পর্যন্ত শরীরটাকে  ধীরে ধীরে মোচরাতে থাকে। একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে উঠে দেখে, তার মাথার পাশ দিয়ে মহিলারা হেঁটে যাচ্ছে, তাদের পাগুলো শেভ করা, মৃসণ। তাদের ভেজা চুলের পানি তার কাঁধে এসে গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে সে লক্ষ করেছে, পানিতে মহিলাদের অনেক নিচে সে সাঁতার কাটছে। তার শক্ত চামড়ার শরীর হাঙরের মতো জলকে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

সৈকতে একা থাকলে মানুষ যা করে ঠিক সেভাবেই সে সাগরের বুকে পাথর ছুড়ে মারে। পানির ওপর হালকাভাবে স্পর্শ করে পাথর লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটানোর কৌশল পুনঃ-আয়ত্তে আছে কিনা বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করে। মুখ নিচে রেখে একসময় সে শুয়ে পড়ে, হাতের মুঠোয় থাকা সমুদ্র-ধোয়া পাথর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। বয়স্কদের মতো নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে হাত গুটিয়ে একটু তাকায়। শিশুরা যেভাবে একটা ফুল বা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে সেভাবেই একটা পাথরের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ হলো। পাথরটার রয়েছে পলিমাটিজাত আড়াআড়ি দাগ, এর ক্ষুদ্রাংশের রহস্যপূর্ণ রং, লুকানো অভ্রর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অংশ। সে অনুভব করল এর ডিমটি; সমুদ্রের তৈলাক্ত মসৃণ হাতে গড়া কাচের মতো সমতলবিশিষ্ট হীরকের মতো বিষমকোণী চতুর্ভুজ।

সব পাথর কিন্তু আসল পাথর নয়। সেগুলো অনেকটা চ্যাপ্টা কিংবা গোলাকার স্বচ্ছ হলুদাভ রত্ন কাটার বাদামি পাথর, যা ভাঙা বিয়ার বোতলের রঙের মতো মনে হবে। সেখানে রয়েছে নীল আর  সবুজ কাচের বোতল (আরো কিছু নিমজ্জিত বোতল আছে), যা নীলাভ সবুজ মুক্তো আর পান্নার মতো দেখতে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো তাদের টুপি বা ঝুড়িতে সংগ্রহ করছে। চারদিকের এতসব ঐশ্বর্যের সমারোহ আর কার্গো জাহাজের ভেতর থেকে ভার লাঘবের উদ্দেশ্যে ফেলে দেওয়া মালামালের অংশ পুনঃ-ভেসে ওঠার মধ্যে একদিন বিকেলে সৈকতে একটি সত্যিকারের পাথর তার হাতে এসে ধরা দিলো। এ যেন ভিক্ষুর জপমালার মতো অনেকগুলো পাথরের মধ্যে একটি খুঁজে পাওয়া। রঙিন কাচের টুকরোর মধ্যে ডায়মন্ডের একটি নীলকান্তমণি আংটি। পাথুরে সৈকতের উপরিভাগে এটির অবস্থান ছিল না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, সেদিন কোনো মহিলার হাত থেকে আংটিটি খুলে পড়েনি। এমন হতে পারে, কোনো ধনীর দুলালি, বড়লোকের আয়েশি স্ত্রী কোনো হালকা নৌ-প্রতিযোগিতায় ডুব দিতে গেয়ে ফ্যাশনের ছলে শরীরের অন্যান্য আবৃত অংশ ছুড়ে ফেলার সময় আংটিটি হাতের আঙুল থেকে হয়তো পিছলে পড়ে গেছে। হয়তো তখনই টের পেয়েছিল কিংবা টেরই পায়নি। কূলে ফিরে এসে বুঝল ওটা হারিয়ে গেছে। এর পরপরই হয়তোবা ছুটে গেছে ইন্স্যুরেন্স নীতিতে কী আছে তা খুঁজে বের করতে। আর এদিকে আংটিটি সাগরের তলে গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করেছে। এ-বিষয়ে একসময় হয়তো আংটির মালিক উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধীরে ধীরে আংটিটি মাটির ভেতর প্রোথিত হতে থাকে। এটি সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর আংটি। এর নীলমণি বড় আয়তক্ষেত্রসদৃশ যার চারদিকে গোলাকার হীরক, যা এই চমৎকার স্তূপের প্রত্যেক পার্শ্বে আনুভূমিকভাবে বসানো হয়েছে এবং চারদিকে খোদাই কাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আংটিটি যদিও প্রায় ছয় ইঞ্চি মাটির নিচ থেকে এলোপাতাড়ি আঙুলের খোঁচায় তুলে আনা হয়েছে। সে এটার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন ওটার মালিক তার ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

মহিলারা তাদের শরীরে তৈল মাখছে, বাচ্চাদের শরীর তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। ছোট আয়নায় তাকিয়ে তাদের চোখের ভ্রু ঠিক করে নিচ্ছে। তারা পা গুটিয়ে বসে থাকে আর তাদের উবু হয়ে থাকা স্তনগুলো টেবিলের ওপর বের হয়ে থাকে, যেখানে হোটেলের ওয়েটাররা সালাদ আর সাদা মদের বোতল পরিবেশন করছে। সে আংটিটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসে যদি কেউ কিছু হারিয়েছে বলে ইতোমধ্যেই রিপোর্ট করে থাকে। রেস্টুরেন্টের তত্ত্বাবধায়ক মহিলা ছুটে এলেন। তিনি সম্ভবত প্রায়ই কোনো পক্ষ থেকে হারানো মালের বিষয়ে অভিযোগ বা প্রস্তাব পেয়েছে থাকেন। ‘এটা খুব দামি জিনিস। পুলিশের হেফাজতে রাখাই উত্তম হবে।’

সন্দেহ সচেতনতা বাড়ায়। বিশেষ করে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে সন্দেহ করার কিছু কারণ থাকতে পারে। পুলিশের কাজে তো বটেই। কেউ যদি আংটির দাবিদার না থাকে সেক্ষেত্রে স্থানীয়           যে-কেউ ওটা পকেটস্থ করতে পারে। তাহলে আর তফাৎ কী থাকল। সে আংটিটি নিজের পকেটে বিশেষ করে তাঁর কাঁধের ব্যাগে রাখল যেখানে টাকা-পয়সা, ক্রেডিট কার্ড, গাড়ির চাবি, সানগ্লাস থাকে। সে আবার সৈকতে ফিরে গেল। মহিলাদের মাঝখানে পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল। রাজ্যের যত ভাবনা তার মাথায়।

স্থানীয় পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিলো সে। বুধবার ব্লু হরাইজন সৈকতে একটি আংটি পাওয়া গেছে। সঙ্গে টেলিফোন নম্বর আর হোটেলের রুম নম্বর। তত্ত্বাবধায়ক ঠিকই বলেছিলেন। প্রচুর ফোন আসতে শুরু করল। এদের মধ্যে কিছু পুরুষের ফোন এলো যাদের স্ত্রী, মা, মেয়ে বান্ধবীরা সৈকতে আংটি হারিয়েছে। সে যখন তাদের হারানো আংটির বর্ণনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে, তারা তখন একটা কৌশল অবলম্বন করে। বলে একটি হীরার আংটি। আরো বিষদভাবে ব্যাখ্যা করতে বললে তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যখন কোনো মহিলার কণ্ঠে চাটুকারি কথা বা মন ভোলানো স্বর ঝরে পড়ে (তাদের কারো কারো কণ্ঠে কান্নার সুর) কিংবা এরা মধ্যবয়সী বলে অনুমান করা যায়, সেক্ষেত্রে মহিলারা তাদের আংটির বর্ণনা দিতে শুরু করলে সে ফোনের লাইনটা কেটে দেয়। মহিলার কণ্ঠস্বর যদি আকর্ষণীয় হয় আর যখন স্পষ্ট হয় কমবয়সী মেয়ের গলা, তখন সে তাকে আংটি শনাক্ত করার জন্য হোটেলে আসার অনুরোধ জানায়।

‘আংটির বর্ণনা দিন’।

খোলা ব্যালকনিতে আরাম করে বসিয়ে সে প্রশ্ন করে। সমুদ্র থেকে আসা আলোও যেন তাদের মুখে প্রশ্নবাণ ছুড়ে দেয়। একজন শুধু তাকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে, সত্যিই তার একটি আংটি হারানো গেছে। মহিলা তার হারানো আংটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল। যাওয়ার সময় তাকে অহেতুক কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। অন্যরা অনেকেই সুশ্রী, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব রকমের সুন্দরী। তাদের পোশাকও মনোহরণকারী। তারা এসেছে আংটি সম্পর্কে তাদের সাজানো গল্প কাজে না লাগলেও যাতে অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। তারা ধরে নিয়েছে আংটিটি যদি মূল্যবান হয়ে থাকে তাহলে এর মধ্যে অবশ্যই হীরক থাকবে।     দু-একজন উদ্ভাবনী কৌশলের দ্বারস্থ হয়ে বলে, আংটির সঙ্গে আরো কিছু মূল্যবান পাথর ছিল তবে যেহেতু এটি উত্তরাধিকারসূত্রে (মাতামহী, চাচি) প্রাপ্ত তাই এগুলোর নাম তাদের জানা নেই।

: ঠিক আছে। তাদের রং, আকৃতি কেমন বলুন?

তারা এমন ভাব দেখায় যেন এ-ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে তাদেরকে ইচ্ছে করে অপমান করা হচ্ছে। কিংবা তারা ধরা পড়া অপরাধীর মতো ফিক-ফিক করে হেসে জানায়, নেহাত কৌতুকছলে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে তারা এখানে এসেছে। শিষ্টাচার থেকে বেরিয়ে আসা এদের পক্ষে সত্যিই কঠিন ছিল।

একসময় একদিন একজনের ফোন এলো যার কণ্ঠস্বর অন্য সবার চেয়ে একেবারে আলাদা। কোনো গায়িকা বা অভিনেত্রীর যেন নিয়ন্ত্রিত গলার স্বর। কণ্ঠে কিছুটা সংশয়ের ভাব রয়েছে – ‘আমি আশা ছেড়েই দিয়েছি। আমার আংটিটা খুঁজে…।’ বিজ্ঞাপনটি তিনি দেখেছেন। ভাবলেন – না, না, এটা হওয়ার নয়। তবে লাখের মধ্যে যদি একটা লেগে যায়…! এই ভেবেই তিনি হোটেলে এসেছেন।

মহিলার বয়স নিশ্চিত চল্লিশের কোঠায়। সে একজন জাত সুন্দরী। স্থির ধূসর সবুজনয়না। তার চুল ময়ূর-কালো। গোল কপালের ওপর পাখির চঞ্চুর উচ্চতায় তা গজিয়েছে আর মাথায় চাঁদির ওপর কুন্ডলী আকারে তা নেমে এসেছে; নরম পালকের মতো মসৃণ। তাঁর স্তনদ্বয় যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে কোনো ভাঁজের চিহ্ন নেই। চুলের মতো গলার নিচেও যথেষ্ট খোলা জায়গা রয়েছে। তার হাত দুটো যেন আংটি পরার জন্য তৈরি হয়ে আছে। মহিলা হাতের তালু উল্টে আঙুলগুলো মেলে ধরলেন। লোকটি ক্ষণিকের জন্য যেন জলের মধ্যে মৃদু আলো প্রত্যক্ষ করল।

: ‘আংটির বর্ণনা দিন।’

মহিলা সরাসরি তার দিকে তাকালেন। মাথা ঘুরালেন যাতে চোখ দুটো সরে আসে। এবার বর্ণনা দিতে শুরু করলেন বিস্তারিতভাবে। মহিলা বললেন ‘প্লাটিনাম আর স্বর্ণ…। আপনি জানেন কোনো জিনিস সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য, যখন তা একজন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছে অথচ তাকে কখনো ভালোভাবে লক্ষ্য করেনি। একটা বড় হীরা… অনেকগুলো পান্না, রঙিন পাথর… লালমণি চুনি; তবে আমার মনে হয় সেগুলোর অনেককিছুই ঝরে গেছে আগেই…।’

হোটেলের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের কাছে এগিয়ে গেল লোকটা। ড্রয়ারের ভেতর অনেকগুলো ফোল্ডার – রেস্টুন্টের বর্ণনা, ক্যাবল টিভি প্রোগাম, রুম সার্ভিস – এগুলোর ভেতর থেকে সে একটি খাম তুলে নিল – ‘এখানেই আপনার আংটি রয়েছে।’

মহিলার চোখ নড়ল না। লোকটি খামটি তার সামনে ধরল। মহিলার হাত আলতোভাবে তার দিকে প্রসারিত হলো, যেন পানির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। মহিলা আংটিটি তুলে নিয়ে ডান হাতের মধ্যম আঙুলে পরতে শুরু করলেন। ওই আঙুলে জুতসই না হওয়ায় সে সঙ্গে সঙ্গে জাদুকরের হাত-সাফাইয়ের মতো সংশোধন করে আংটিটি তৃতীয় আঙুলে প্রবেশ করিয়ে দিলো।

মহিলাকে সে রাতের খাবারে আমন্ত্রণ জানাল; উপলক্ষ কী তা বলেনি। বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর মহিলা শেষ পর্যন্ত তার তৃতীয় স্ত্রী হলো। অন্য কারো চেয়ে বেশি অব্যক্ত কথা আর থাকল না তাদের দাম্পত্য জীবনে।

 

নাদিন গর্ডিমার

[১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিংসে জন্ম বর্ণবাদবিরোধী কালজয়ী এ মহিলা ঔপন্যাসিকের। ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল কমিটি তাঁকে ‘মহৎ একজন মহাকাব্যিক উপন্যাস-রচয়িতা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এর আগে ১৯৭৪ সালে The Conservationist উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে Burger’s Daughter, July’s People, A Sport of Nature, My Son’s Story উল্লেখযোগ্য। ছোট গল্পগ্রন্থের মধ্যে A Soldier’s Embrace, Something out There, Jump and Other Stories অন্যতম। বিষয়বৈচিত্র, কল্পনার সুসংহত বিস্তার, বর্ণনার চমৎকারিত্ব তাঁর রচনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন এ-লেখিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ আমলের সেন্সরশিপ ব্যবস্থায় তাঁর তিনটি বই নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার। শেষ বয়সে গর্ডিমার আফ্রিকার এইচআইভ/এইডস নির্মূলে কাজ করেছেন। গত ১৩ জুলাই, ২০১৪ তারিখে ৯০ বছর বয়সে গর্ডিমার মারা যান। ‘একটি খুঁজে পাওয়া আংটি’ গল্পটি তাঁর Jump and Other Stories গ্রন্থের ‘A Find’ গল্পের অনুবাদ।]