একটি মেধাদীপ্ত প্রগাঢ় বন্ধুত্বের বৃত্তান্ত ও অজানা কথামুখ

ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য তথা সাংস্কৃতিক জগতে গিরিশ রঘুনাথ কারনাড (১৯৩৮-২০১৯) অতিপরিচিত একটি নাম। তবে থিয়েটার বা সিনেমার কল্যাণে তিনি যতখানি পরিচিতি লাভ করেছেন, তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা তথা সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের খবর আমাদের অনেকের কাছে ঠিক ততখানি অজ্ঞাত। অন্যদিকে প্রখ্যাত কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী আত্তিপেট কৃষ্ণস্বামী রামানুজনকে আমরা খুব কম পাঠকই জানি। প্রথমত, তিনি তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ কাটিয়েছেন বিদেশে। দ্বিতীয়ত, সিনেমা-থিয়েটারের উজ্জ্বল আলোকবৃত্তের মানুষ তিনি নন। এই দুজন অশেষ মেধাবী, প্রাজ্ঞ, শাণিতবুদ্ধি, সৃষ্টিশীল অসমবয়সী মানুষের আজীবন বন্ধুত্বের আখ্যান আমাদের যে কৌতূহলী করে তুলবে, এতে আর আশ্চর্য কী! তাই পরবাস পত্রিকায় প্রকাশিত অধ্যাপক অঞ্জলি নেরলেকারকৃত গিরিশ কারনাডের একটি সাক্ষাৎকার পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়ে হাতে এলে স্বভাবতই আমাদের আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে, বিশেষত যখন দেখতে পাই, এই ছোট্ট গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন অপর এক প্রতিভাবান মানুষ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, সাক্ষাৎকারটি মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন অংকুর সাহা, অনুবাদকর্মে যাঁর দক্ষতা সুবিদিত।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ মুখবন্ধটি গিরিশ কারনাড এবং এ কে রামানুজনের মেধাদীপ্ত সম্পর্কের এক নিবিড় সালতামামি। তবে তিনি এখানে মূলত তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের আলোকে গিরিশ কারনাডের নাট্যসাধনার বিশেষ পরিচিতি তুলে ধরেছেন। এই সাক্ষাৎকার যাঁর, সেই গিরিশ কারনাড সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ উপস্থাপন এই গ্রন্থটিকে মহিমান্বিত করেছে। ব্যক্তিগত পরিচিতির সুবাদে কেবল নয়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্বভাবসুলভ মেধা আর প্রজ্ঞার ছাপ রেখেছেন এই দীর্ঘ লেখায়। পাঠক হিসেবে সেটা আমাদের এক উপরিপ্রাপ্তি। গিরিশ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যাকে আপাতবিচ্ছিন্ন মনে হলেও তা আমাদের সমৃদ্ধ করে। এরই পাশাপাশি আধুনিক ভারতীয় নাট্যকলায় গিরিশ কারনাডের উজ্জ্বল উপস্থিতিকে তিনি তাঁর নিবিড় অবলোকনে প্রাণবন্ত করে তোলেন।

মনে রাখা দরকার, সাহিত্যে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ’ প্রাপ্ত গিরিশ কারনাড শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, তিনি একই সঙ্গে একজন দক্ষ চলচ্চিত্র-পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও একজন প্রখ্যাত অভিনেতাও ছিলেন। ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও তিনি পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ পুরস্কার। সংখ্যাতত্ত্বে স্নাতক হয়ে তিনি রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। চাকরি করেছেন বিদেশের একাধিক প্রকাশনা সংস্থায়। অন্যদিকে এ কে রামানুজন ছিলেন একজন কবি এবং ভারতীয় সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ববিদ। তিনি শিকাগো বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। দার্শনিক, লোকসাহিত্যিক, অনুবাদক ও নাট্যকার হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। পদ্মশ্রী ছাড়া তিনি মরণোত্তর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন। শিক্ষকতার জীবন দেশে শুরু হলেও তিনি তাঁর জীবনের একটা বড় সময় মূলত হার্ভার্ডসহ কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন। এই আলোকসামান্য মানুষটির সঙ্গে আজীবন এক বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন গিরিশ কারনাড। এই সাক্ষাৎকারের মূল প্রতিপাদ্য দুজন জ্ঞানতাপসের সখ্য, যা গিরিশের বয়ানে পাঠক অবগত হয়েছেন।

মনে রাখা দরকার, সাক্ষাৎকার ব্যাপারটা ঘটে প্রশ্নকারী এবং উত্তরদাতার পারস্পরিক সমঝোতা ও হৃদ্যতায়, যা এই গ্রন্থে বিদ্যমান। তাই নান্দীমুখ হিসেবে অনুবাদকের ছোট্ট ভাষ্যের খানিকটা এখানে উল্লেখ করছি আগ্রহী পাঠকদের সুবিধার্থে। ‘… গিরিশ কারনাড রামানুজনের সঙ্গে সমানতালে পা ফেলে এগিয়েছেন দ্বিভাষিক সৃজনশীলতায়, ভারতের অতীত ইতিহাস ও পুরাণ থেকে কাহিনি সংগ্রহে, উদারপন্থী সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে এবং ঈশ্বর ও ধর্মের অবিশ্বাস। … লোককথায়, ভক্তিগীতিতে, গ্রাম্য শ্রুতিকথনে এমনকি টিপু সুলতানের বিষয়ে তাঁর অসীম উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে …। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি অল্প কয়েকজন মানুষের একজন, যিনি রামানুজনকে ভারতবর্ষ ও আমেরিকা দুদেশেই কাজ করতে দেখেছেন এবং তাঁরই মতো কন্নড় এবং ইংরেজি দুই ভাষার শক্তিমান লেখক।’ (পৃ ২৯-৩০)  

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই গিরিশ অকপটে ঋণস্বীকার করেছেন। রামানুজন যে শুধু তাঁর বন্ধু ছিলেন, তা নয়, ছিলেন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। সেই অর্থে তাঁর লেখার অনেক ‘আইডিয়া’ তিনি যে তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছেন সে-কথা স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন গিরিশ। তিনি জানিয়েছেন, ‘… আদতে তিনি ছিলেন শিক্ষক। তিনি বলে যেতেন, আমি মন দিয়ে শুনতাম। শুনতে শুনতে আসে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, আমি নিজেকে বলি, চমৎকার আইডিয়া! আমি এইভাবে তাকে কাজে লাগাতে পারি।’ (পৃ ৩১)

১৯৫৫-তে যে-সম্পর্কের সূচনা, তা প্রায় চার দশক অর্থাৎ রামানুজনের মৃত্যুকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও তার প্রকাশে দ্বিধাহীনতা সত্যিই লক্ষ করার মতো। পরবর্তীকালে অর্জিত খ্যাতি-বিত্ত তথা জনপ্রিয়তায় তা কখনো একটুও ম্লান হয়নি। তাই এই সাক্ষাৎকারে গিরিশ কারনাড অত্যন্ত অকপটচিত্তে তাঁর বন্ধু ও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবনত থেকেছেন। মূল্যায়ন করেছেন তাঁর জীবন ও কর্মের। আপন গুরুর প্রতি এই বিনম্র নিবেদনে গিরিশের শুধু মেধা নয়, ঔদার্যেরও একটা পরিচয় পাই আমরা। তবে এটা ঠিক, আলাপচারিতায় যেমন হয় – কথাপ্রসঙ্গে এসে যায় অনেক কথা, যা হয়তো মনে হবে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু কথার পিঠে কথা দিয়ে গড়া এসব কথোপকথনের এটাও একটা দিক। তাই গিরিশ যখন তাঁর নিজস্ব অনুভবের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় নাটক প্রসঙ্গে বাদল সরকার অবধি এসে যান তখন একান্ত সংস্কারবশত আমাদের মনে হতেই পারে, কেন প্রশ্নকারী এবং উত্তরদাতার মনে একবারও এলো না রবীন্দ্রনাথের কথা। আর কিছু না হোক তাঁর ডাকঘর নাটকটির কথা আসতেই পারত। ১৯১১-তে রবীন্দ্রনাথ নাটকটি রচনা করেছিলেন। অক্সফোর্ডের ছাত্র দেবব্রত মুখোপাধ্যায় তা অনুবাদ করে লেডি গ্রেগরির সহায়তায় আবে থিয়েটারে মঞ্চস্থ করেন। জোড়াসাঁকোতে অভিনীত হয় মূল ভাষায় ১৯১৭ সালে, অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের বছরে। আদ্রেঁ জিদ অনুবাদ করেন ফরাসি ভাষায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ফরাসি বেতারে তার পাঠ-প্রচার হয় নাজিদের পারী দখলের আগের রাতে। আমরা জানি, এই নাটকের শতাধিক প্রযোজনা ঘটেছে জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। জানুস করজাক, এক পোলিশ ইহুদি, ওয়ারশতে এর অভিনয় করান ইহুদি শিশুদের দিয়ে। মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন মৃত্যুভয়কে জয় করার এ এক অসাধারণ পন্থা। সপ্তাহখানেক পরেই নির্দেশকসহ ওই শিশুরা স্থানান্তরিত হন ত্রেবলিঙ্কা ক্যাম্পে এবং মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যান। এ-কথাগুলো বইটিতে কোথাও আসেনি। গিরিশ কারনাড বা অঞ্জলি নেরলেকার এসব তথ্য অবগত নন, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

তবে একটা গ্রন্থে কী নেই, সেটা না খুঁজে যা আছে তা-ই মূল বিচার্য হওয়া উচিত। তাই গিরিশ কারনাডের দেওয়া এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এ কে রামানুজনের মতো ব্যক্তিত্ব, যাঁর সম্পর্কে আমরা সত্যি খুব কম জানি। ধন্যবাদ জানাতে হয় প্রশ্নকারী নেরলেকারকে। আর মুখবন্ধের লেখক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ ভূমিকা গ্রন্থটিকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। পুরো সাক্ষাৎকারটি পরম যত্নে অনুবাদ করে দিয়েছেন যে মানুষটি সেই অংকুর সাহাও অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। অনুবাদকর্মে তাঁর দক্ষতার কথা সুবিদিত। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সর্বোপরি প্রকাশনার ব্যাপারে পরবাস-এর এই উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাব – বাঙালি পাঠকদের এমন এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্যে।

পরিশেষে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উক্তি এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ‘এই দুজন বন্ধুই আজ আমাদের বড়ো প্রয়োজন ছিল। যে অন্তর্দৃষ্টিতে নারীর ধর্মে, ভক্তির কর্মে রামানুজন পেয়েছিলেন পৌরুষের উদ্ধত অশালীন হিংসা ও দাপটের মুখে মানব ধর্ম; যে-দুঃসাহসে ১৯৮৯ সালে নেহরু শতাব্দী স্মারক নাট্যোৎসবে সংগীত নাটক অকাদেমীর সভাপতিপদে অধিষ্ঠিত গিরিশ কারনাড উদ্বোধনী নাটক হিসেবে উৎপল দত্ত-পরিচালিত কল্লোল নাটক অভিনয়ে সরকারি ইতিহাস পাঠের প্রতিবাদী পাঠকে মান্যতা দেন, কিংবা অসুস্থ অবস্থায়, অক্সিজেন-নলের সহায়তায় শ্বাস নিতে নিতেও তরুণ প্রতিবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে পোস্টার হাতে নিজেকে ‘আর্বান নকশাল’ বলে ঘোষণা করেন, সেই ভাষার পুনরুচ্চারণের দায়ই আজ আমাদের স্মৃতির উত্তরাধিকার।’ (পৃ ২৬-২৭)

এই দৃপ্ত উচ্চারণই ওই সাক্ষাৎকারের মূল কথা। একটি মেধাবী বন্ধুত্বের বৃত্তান্ত রচনার রূপকল্পে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই দীর্ঘ কথোপকথন বাংলা গ্রন্থভাণ্ডারে উজ্জ্বল সংযোজন হিসেবে গৃহীত হবে আশা করি।