কিংবদন্তির সুলতান

দেবদূত পরিবেষ্টিত বিশালকায় পেশিবহুল এক মানব বসে রয়েছে মাটির ওপর, দৃঢ় দুই হাতের মাঝে ছোট্ট একটি চারাগাছ, রোপণের অপেক্ষায় – যেন শ্যামল-সুন্দর পৃথিবী গড়ার মানসে। এই শিল্পের কারিগর এস এম সুলতান। অবশ্য নামটি তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নয়, তাঁর আসল নাম লাল মিয়া। বাবা জমিদারের রাজমিস্ত্রি – ভবন নির্মাণশিল্পী। যিনি ইটের পরে ইটের গাঁথুনি দিয়ে আর পলেস্তারার বুকে ফুটিয়ে তোলেন নানা রকম নকশার কারুকাজ, যা বোধহয় শিশু লাল মিয়ার মনে ছবি আঁকার প্রতি গভীর অনুরাগ সৃষ্টি করেছিল। কাঠকয়লা, হলুদ আর পুঁইয়ের বিচির লাল রসে রাঙিয়ে তোলেন ছবির জমিন। ছবি আঁকার এই নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। অষ্টম শ্রেণির পড়া সাঙ্গ না করে পাড়ি জমান কলকাতায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যথাযথ সনদ না থাকলেও বিখ্যাত শিল্প-সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে। লাল মিয়া পরিচিত হন শেখ মোহাম্মদ সুলতান বা সংক্ষেপে এস এম সুলতান নামে। কলকাতা আর্ট স্কুলের পড়াশোনা সমাপ্ত না করেই বেরিয়ে পড়েন ভারত-ভ্রমণে। তিনি ঘুরেছেন পৃথিবীর নানা দেশ, নানা প্রান্তের শিল্পের ভুবন ও শিল্পবোদ্ধাদের সংস্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছেন প্রতিনিয়ত। প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন ভুবনখ্যাত শিল্পী পিকাসো, ব্রাক, সেজান, ভ্যান গঘের সঙ্গে, যা তাঁকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি।

বহু পথ ও মত পাড়ি দিয়ে, শিল্প ও জীবনাভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট হয়ে থিতু হন শৈশবের নড়াইলে, চিত্রাপাড়ের নিভৃত গ্রাম মাছিমদিয়ায়। বোহিমিয়ান আর রহস্যে মোড়া সুলতানকে আমরা নানাভাবে আবিষ্কার করি নাসির আলী মামুন-সম্পাদিত এস এম সুলতান : জীবন দর্শন ও শিল্প বইয়ে। আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের ক্যামেরার আলোর ছটায় আলোকিত হয়ে আছেন দেশ-বিদেশের আলোকপ্রাপ্ত মানুষেরা। তিনি শুধু সফল আলোকচিত্রীই নন, একজন সংগ্রাহক, গড়েছেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ফটোজিয়াম’। বৈচিত্র্যময় ও প্রথাবিরোধী জীবনের অধিকারী সুলতানকে তিনি শুধু ফ্রেমবন্দিই করেননি, তাঁর এই বইয়ে সমাবেশ ঘটিয়েছেন বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক, কবি, সাহিত্যিক-শিল্পসমালোচকদের রচনা। যাঁদের সৃষ্টিশীল লেখা বহুমুখী বিশ্লেষণে সুলতানকে নতুন করে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে, সুলতানকে নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে।

লাল মিয়ার ছবি লাল রঙের মতোই তেজস্বী, প্রাণময়তায় ভরপুর। তাঁর ছবি পল্লিজীবনসংশ্লিষ্ট। কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থা তাঁর ছবির মূল বিষয়। আমাদের জাতীয় সত্তা এবং আত্মপরিচয়ের মূল যে গ্রামীণজীবনের মধ্যে তথা কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থার মধ্যে প্রোথিত তা সুলতান গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। ফলে তাঁর ক্যানভাসজুড়ে বিধৃত হয়েছে গ্রামের ভূমিলগ্ন খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার কাহিনি।

তবে তাঁর চিত্রের কৃষক জীর্ণ-শীর্ণ নয়, অতিকায় বলিষ্ঠ, তারা যেন প্রাণশক্তির প্রতীক। শিল্পী এখানে মূলত কৃষকের অন্তরের শক্তিমত্তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর ছবির কৃষক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি আঁকতে চেয়েছি যারা আবহমানকাল থেকে মাটির সাথে সংগ্রাম করছে, প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। এসব মানুষকে দুর্বল দেখালেও ভেতরে ভেতরে তাদের অনেক শক্তি। সেই শক্তিই পেশিতে, দেহের বলিষ্ঠ বিন্যাসে দেখাতে চেয়েছি। যুগে যুগে শাসকরা তাদের শোষণ করেছে। কিন্তু ওরা টিকে আছে। শক্তিধর বলেই পেরেছে।’ (পৃ ৮০)

সুলতানের কৃষক সম্পর্কে আহমদ ছফার মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী-সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাক্সক্ষা এবং স্বপ্ন আজ ও আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গেছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয়।’ (পৃ ২৯)

সুলতানের চিত্রের কৃষক সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আধুনিককালে শিল্পী সুলতান তাঁর শিল্পকর্মে কৃষকদের সপক্ষে রেখাঙ্কিত উচ্চারণ সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, শস্য বপনের মধ্য দিয়ে একজন কৃষক একটি প্রত্যয়ের জন্ম দেয়, একটি বিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং জীবনের জয়যাত্রার একটি অহঙ্কারের জন্ম দেয়। সুতরাং বাস্তবের প্রতিচিত্রণ না করে তিনি একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াশ পেয়েছেন। … তিনি জীবনসৃষ্টির সহায়করূপে কৃষকদের দেখেছেন তাই তাঁর কৃষককুল পেশিবহুল, বলিষ্ঠ এবং প্রত্যয়ী।’ (পৃ ৯৪)  পেশিবহুল তাই সুলতানের চিত্রকর্মকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা।

শিল্পী সুলতানের চিত্রকর্মের বিষয় সম্পর্কে রবিউল হুসাইন তাঁর ‘এস এম সুলতানের লৌকিক কাজ’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেন – ‘তার প্রধান গুণ দেশজতা। তার ছবির মানুষজন, জীবজন্তু এদেশেরই। বিষয় তার একটিই – সেটি হচ্ছে গ্রামবাংলা ও তার মানুষ। এই গ্রামবাংলার মানুষ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী পেশিবহুল আদিম যুগের, যারা জীবনযাপন করে, চাষাবাদ করে, মাছ ধরে। এই সব মানুষের সঙ্গে পোষ্য জীবজন্তু এবং অবারিত প্রকৃতির সহাবস্থান বিদ্যমান। ঘরকন্না, সংসারকর্ম, সন্তানপালন, মাঠে ফসল ফলানো, বিলে মাছ ধরা, বাজার, হাট, গাছ লাগানো অর্থাৎ গ্রামভিত্তিক জীবনের সম্পূর্ণ ছবি সুলতানের বিষয় এবং অবশ্যই তা মানুষকেন্দ্রিক।’ (পৃ ১১২)

নির্লোভ, নিরহংকারী এস এম সুলতানের গ্রামীণ ব্রাত্য মানুষের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ, অসামান্য সহানুভূতি এবং সীমাহীন ভালোবাসার অনুভূতি। তাঁর নিত্য চলাচল ছিল নিম্নবর্গের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-দলিত-পতিত শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, আর্ট স্কুলে পড়া অসমাপ্ত রেখে সুলতান পাড়ি জমান বন্ধনহীন, ছন্নছাড়া জীবনের পথে। তিনি পা রাখেন উড়িষ্যার নীলাচলে। সেখানে দিন কাটান জেলে সর্দার কুষ্ঠরোগী লক্ষিয়ার সঙ্গে, মৎস্যজীবীদের সঙ্গে, বৈষ্ণবদের খোল-কীর্তনের মধ্যে, আবার আজমির শরিফের পাশের কারিগরপল্লিতে। শেষ জীবনে এসেও কেটেছে তাঁর সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির সঙ্গে। সুলতানের নিজের ভাষায়, ‘আমার বেড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে লোকাল আইডেনটিটির খুব গোপন সূক্ষ্ম রেশ।’ (পৃ ৮১)

বৈষ্ণব-বাউল-সুফি মতবাদের সন্নিবেশ ঘটেছে শিল্পী সুলতানের জীবনাচরণে। বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত করতেন নিজেকে। তিনি পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন সন্ন্যাসীর বেশে। প্রকৃতি আর মানুষকে প্রত্যক্ষ করেছেন অতি নিকট থেকে। তিনি হিন্দু ও বৌদ্ধদের তান্ত্রিক সাধনা করেছেন বলে জানা যায়।

রফিকুল আলমের ‘সুলতানের স্মৃতি’ শীর্ষক লেখা থেকে জানা যায় যে, ‘সুলতানকে প্রশ্ন করা হয় শিল্পকলা, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। তিনি স্বীকার করেন তাঁর মাঝে আধ্যাত্মিকতা না থাকলেও মরমিবাদ (Mysticism)-এর সমাবেশ ঘটেছে।’ (পৃ ৩০৩)

সুলতানের মরমিবাদ প্রসঙ্গে মইনুদ্দীন খালেদের ‘সুলতান : প্রত্নবাংলার স্বাপ্নিক’ শীর্ষক লেখা থেকে উল্লেখ করা যায় যে, ‘বাঙালির মূল ধর্ম অসাম্প্রদায়িকতা। আর এ ধর্ম সে পালন করে আসছে অনাদিকাল থেকে। মানবতার এক অখণ্ড বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট রচনা করার জন্য তিনি কখনো সাজলেন যিশু, কখনো শাড়ি পরে রাধা, আবার কখনো মগ্ন রইলেন বংশী বাদনে। শিল্পীর মন নিগূঢ় রহস্যের আধার। তাই একটি বিশেষ অভিধায় সুলতানের মানসলোক চিহ্নিত করা অসমীচীন।’ (পৃ ৪৪)

অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাকে ধারণ করেই বাঙালিরা রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের মতো এক মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সুলতানকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে, সাহসী আর আশাবাদী করে তোলে বাংলার গ্রামীণ মানুষদের নিয়ে। বাঙালি জাতির শক্তি, সাহস, লড়াইয়ের মানসিকতা আর চেতনার দৃঢ়তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। বাঙালি কৃষকদের সেই অন্তরের শক্তিমত্তাকেই শিল্পী আঁকতে চেয়েছেন প্রতিনিয়ত। তাই তো তিনি বলেন – ‘বাঙালিদের স্পিরিট দেখাতে হলে এ রকম ফিগারই আঁকতে হয়। তাই এঁকেছি। বাঙালি দুর্বল না, বাইরে যতই জীর্ণশীর্ণ দেখাক। … পাঠান, মোগল, ইংরেজ সবাই বাঙালিকে শোষণ করেছে। কিন্তু তারা যুদ্ধ করেই বেঁচে ছিল এই উপলব্ধি আমাদের বেশি করে হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর। বাঙালির ভেতরের স্পিরিট দেখানোর এই তো সময়। আগে দেখালে বিশ্বাস করত না লোকে।’ (পৃ ১৬২)

সুলতান বাঙালি জাতিকে শক্তিমত্তার প্রতীক হিসেবে দর্শকের সামনে মেলে ধরার প্রয়াস পান ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। বাংলার কৃষকসমাজকে নতুন করে মেলে ধরেন সুলতান। তাঁর ক্যানভাসে দর্শক যেন নয়নভরে উপভোগ করেন সবুজের সমারোহ, পাখির কল-কাকলি, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে কৃষকের কর্মতৎপরতা তথা গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের আখ্যান।

শিল্পী সুলতান শুধু কৃষকদের নিয়েই ভাবেননি, ভেবেছেন তাদের শিশুসন্তানদের নিয়েও। শিশুদের বিষয়ে তিনি অনেক বেশি স্নেহশীল ছিলেন, ফলে তাদের জন্য গড়ে তোলেন ‘নন্দন কানন’, ‘শিশুস্বর্গ’র মতো প্রতিষ্ঠান। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার মানসেই তাঁর এই প্রচেষ্টা। শিল্পীর নিজের ভাষায় – ‘আমার স্বপ্নের সাধ এই শিশুস্বর্গ। এখানে আসবে সব দেবশিশু। যারা নিষ্পাপ, যারা সুন্দর, যারা সত্যিকার ছবির মতো। … আমি দেশের সব শিশুকে আমার ছবির মানুষের মতো হৃষ্টপুষ্ট দেখতে চাই।’

(পৃ ২৯৬)

‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ – এ-কথার মর্মবাণী বোধহয় সুলতান গভীরভাবে অনুধাবন করেন।
সে-কারণেই বোধহয় তিনি পরিবেষ্টিত থাকতেন বিড়াল, কুকুর, হাঁস, মুরগি, বেজি, বিষধর সাপ, খরগোশসহ নানা জীবজন্তু দ্বারা। পশুপাখির প্রতি এই অনুরাগ তাঁর জীবনদর্শনে অনন্যমাত্রার সৃষ্টি করে।

সুলতানের শিল্প ও জীবনদর্শন পাঠ করে আমরা বিষয়টি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সুলতানের শিল্পকর্মের ভাষা একদিকে যেমন সহজ, অন্যদিকে তাঁর জীবনের গূঢ়রহস্য অনুধাবন করা ততটাই জটিল। সহজ-সরলভাবে জীবন ধারণ করলেও তাঁর জীবনটা ছিল গভীর রহস্যে মোড়া, সুলতান যেন পরিণত হয়েছেন এক কিংবদন্তিতে। আর এই বিষয়গুলোই আমরা প্রত্যক্ষ করি নাসির আলী মামুনের এ-বইটিতে। বইটির প্রচ্ছদেও যেন এক ধরনের রহস্যময়তা লক্ষ করা যায়। প্রচ্ছদের জমিনজুড়ে কালো বা আঁধারের উপস্থিতি, দুই হাতের মাঝে ধরে রাখা তুলি। মুখচ্ছবি না থাকলেও আঁধারের মাঝে কালো আলখাল্লার আভা এবং শিল্পদক্ষতায় পরিপুষ্ট দুই হাতের মাঝে ধরে রাখা তুলিতে যেন এস এম সুলতানের উপস্থিতিই জানান দেয় সুস্পষ্টভাবে। শিল্পের বিচারে নান্দনিক উৎকর্ষে সমৃদ্ধ এই বইয়ের প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদের মুনশিয়ানায় এবং বিষয়ের গভীরতায় বইটি সার্থকতামণ্ডিত।