এক বছরে আনিসুজ্জামান-চর্চা

বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য গবেষক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক আনিসুজ্জামানের (১৯৩৭-২০২০) জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে বিশদ গবেষণা ও চর্চার সূত্রপাত।

অকালপ্রয়াত মালিক সোবহানের  আনিসুজ্জামান : জীবন ও কর্ম (কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি, ২০১১)-এর মতো অ্যাকাডেমিক একটি গবেষণা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও প্রকাশিত হয় – পার্থসারথী রায়ের ঠিকানা/ আনিসুজ্জামান জীবন ও সাহিত্য (কমলিনী, কলকাতা ২০১৭)।

আনিসুজ্জামানকে নিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে দুটো সম্মাননা সংকলন প্রকাশিত হয় ২০০৫-এ। সে-বছরের জানুয়ারিতে বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করে আনিসুজ্জামান : বাঙালি মনীষার প্রতিকৃতি (সম্পাদক : সৌরেন বিশ্বাস, মহীবুল আজিজ ও মালিক সোবহান)। একই বছরের জুন মাসে মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদনায় প্রকাশ করে ‘আনিসুজ্জামান/ সংবর্ধনা-স্মারক। ২০০৭-এ মাওলা ব্রাদার্স ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদনায় আরো প্রকাশ করে আনিসুজ্জামানের সত্তর জয়ন্তীর নিবেদন সমাজ ও সংস্কৃতি।

২০১২-তে তাঁর পঁচাত্তর-জয়ন্তীতে চন্দ্রাবতী, একাডেমি, ঢাকা সেলিনা হোসেনের প্রধান সম্পাদকতায় প্রকাশ করে আনিসুজ্জামানের জীবনীভিত্তিক আলোকচিত্র সংকলন আলোয় ভুবন ভরা। পরের বছর ২০১৪-তে চন্দ্রাবতী একাডেমি মাহফুজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশ করে আরো একটি আলোকচিত্র সংকলন আকাশ আমার ভরলো আলোয়।

২০১৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’প্রাপ্তির পর বাংলা একাডেমি, ঢাকা শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায় প্রকাশ করে আনিসুজ্জামান : আমাদের সময়ের বাতিঘর নামে একটি সংবর্ধনা-স্মারকপত্র। ২০১৫-তে কবিতালাপ গোষ্ঠী, খুলনা মোহাম্মদ আবদুল মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশ করে আনিসুজ্জামান : বাঙালির শেকড়সন্ধানী শীর্ষক সংকলন। একই বছর অন্যপ্রকাশ, ঢাকা থেকে মাজহারুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ নাসেরের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় সাক্ষাৎকার-সংকলন আনিসুজ্জামান : দীপ্র মনীষা।

২০১৭-তে আনিসুজ্জামানের আশি বছর পূর্তিতে চন্দ্রাবতী একাডেমি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রধান সম্পাদকতায় প্রকাশ করে আনিসুজ্জামান সম্মাননাগ্রন্থ।

মোহিত কামাল-সম্পাদিত সাহিত্য-মাসিক শব্দঘর জানুয়ারি ২০১৮-তে প্রকাশ করে বাংলাদেশের শিক্ষক আনিসুজ্জামান শীর্ষক পূর্ণাঙ্গ আনিসুজ্জামান সংখ্যা।

দুই

২০২০ সালের ১৪ই মে প্রয়াণের পর করোনা    মহামারির    বিরুদ্ধ-বাস্তবেও    আনিসুজ্জামান-চর্চা থেমে থাকেনি। কালি ও কলম, উত্তরাধিকার, অন্যদিন, বাংলা একাডেমি বার্তাসহ বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদ ও সাময়িকপত্রে তাঁকে নিয়ে ক্রোড়পত্র কিংবা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।

তিন

নভেম্বর ২০২০-এ পরানকথা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাশরিক-ই-হাবিবের বই আমার স্মৃতিকথায় আনিসুজ্জামান। প্রিয় শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কাছ থেকে দেখার ও সহকর্মী হিসেবে  কাজ করার অভিজ্ঞতায় ভাস্বর এ-বই। ‘২০১৭ নং শ্রেণিকক্ষে আনিসুজ্জামান’-এর মতো স্মৃতিলেখন আর তাঁর সাক্ষাৎকার এ-বইয়ের কৌতূহলোদ্দীপক অংশ।

চার

আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা একাডেমির প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক এবং এই প্রতিষ্ঠানের আমৃত্যু সভাপতি। তাঁর সঙ্গে একাডেমির সুদীর্ঘ সংযোগকে স্মরণীয় করে রাখতে ডিসেম্বর ২০২০-এ বাংলা একাডেমির সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি ও আনিসুজ্জামান শীর্ষক সংকলন। এতে বাংলা একাডেমি ঘিরে তাঁর স্মৃতিকথা, একাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তৃতা, একাডেমির প্রথম বই লায়লী মজনু বিষয়ে তাঁর অগ্রন্থিত আলোচনা থেকে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা,  তাঁর  বর্ণাঢ্য  জীবৎকালের  একাডেমির  সভা-সেমিনারে তাঁর অংশগ্রহণপঞ্জি, একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের তথ্যাবলি স্থান পেয়েছে। বাংলা একাডেমির সভাপতি, মহাপরিচালক থেকে একাডেমিতে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালকের স্মৃতিচারণ সংকলনটিকে ব্যতিক্রমী মাত্রা দিয়েছে।

পাঁচ

প্রয়াণের পর আনিসুজ্জামানের প্রথম জন্মবার্ষিকী ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১; এটি তাঁর ৮৪তম জন্মবার্ষিকীও বটে। এ উপলক্ষে আগামী প্রকাশনী, ঢাকা থেকে এম আবদুল আলীমের সম্পাদনায় আনিসুজ্জামান : বক্তৃতাসম্ভার এবং স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা থেকে তাঁর রচিত  জীবনীগ্রন্থ আনিসুজ্জামান প্রকাশিত হয়। প্রথম সংকলনটিতে  আনিসুজ্জামানের সমকালীন সামাজিক-বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন ধরা আছে; এর পাঠ পাঠকের কাছে স্পষ্ট করে আনিসুজ্জামানের জনলগ্নতাও।

দ্বিতীয় বইটি অ্যাকাডেমিক ছকবদ্ধ। জন্ম ও বংশ-পরিচয়, শৈশব, শিক্ষা, কর্মজীবন, সংসার-জীবন, আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সাহিত্য-সাধনা ও গবেষণা, বক্তা আনিসুজ্জামান, কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সমকালের চোখে চিরকালের আনিসুজ্জামান, পুরস্কার-সম্মাননা,  শেষজীবন  ও  মৃত্যু, রচনা-নিদর্শন এবং আলোকচিত্র – এমনসব অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ-বইকে এর কিছু অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা  সত্ত্বেও  আনিসুজ্জামানের জীবনী রচনার প্রথম প্রয়াস বলা চলে।

ছয়

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা থেকে আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় তাঁর ৮৪তম জন্মবার্ষিকীতে ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ প্রকাশ করে আনিসুজ্জামান : স্মরণ শীর্ষক এক মহার্ঘ্য সংকলন। সংকলনটি শুরু হয়েছে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার অর্ঘ্যে :

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাশফুলের প্রহর এলেই/

আমার দিকে সুস্মিত তাকিয়ে/

চলে গেলেন আমার বন্ধু/

অ্যাকাডেমিক অনুসন্ধিৎসায়।

আলোচ্য সংকলনে আনিসুজ্জামানের পূর্বগামী, সমকালীন এবং উত্তরপ্রজন্ম তাঁর জীবন ও কৃতি বিষয়ে আলোচনা করেছেন, স্মৃতিপুষ্প নিবেদন করেছেন।

বাংলাদেশের আহমদ রফিক, রেহমান সোবহান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হামিদা হোসেন, হাসান আজিজুল হক, সনৎকুমার সাহা, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মতিউর রহমান, রামেন্দু মজুমদার, সেলিনা হোসেন, মালেকা বেগম, সুব্রত বড়ুয়া, আহরার আহমেদ, আবুল খায়ের, লুভা নাহিদ চৌধুরী, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গোলাম মুস্তাফা, আবুল আহসান চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মহীবুল আজিজ, আনন্দ জামান, পিয়াস মজিদ প্রমুখের পাশাপাশি এই সংকলনে আনিসুজ্জামানকে ঘিরে স্মৃতিবয়ান ও তাঁর কৃতি-বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রজন্মের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক; যেমন : অমিয় দেব, পবিত্র সরকার, সমরেশ মজুমদার, উত্তরা চক্রবর্তী, প্রসাদরঞ্জন রায়, দেবজ্যোতি দত্ত, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, চিন্ময় গুহ, বীথি চট্টোপাধ্যায়, অংশুমান ভৌমিক, অহনা পাণ্ডা।

প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠার এ সমীহ-জাগানিয়া  স্মারক-সংকলনে ভাষাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, মৌলিক চিন্তাচর্চা, ইহজাগতিকতা, নারী-প্রগতির গবেষণা, জনবুদ্ধিজীবিতা, দেশজাগর বিশ্ববোধের পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুজ্জামানের বিশ্বস্ত প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে যেন।

পরিশিষ্টে সংযুক্ত হয়েছে নির্বাচিত অভিভাষণ, বর্ণিল একগুচ্ছ আলোকচিত্র এবং মাহবুবুল হক-কৃত জীবনপঞ্জি।

এই সংকলনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সুহৃদ আনিসুজ্জামান’ লেখাটির মূলকথা যেন আনিসুজ্জামান সম্পর্কিত হাজার কথার সারকথা :

আনিসুজ্জামান ছিলেন একাধারে প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, অভিনিবিষ্ট গবেষক এবং অসাধারণ রকমের সংস্কৃতিসচেতন। এই তিন গুণের যে-কোনো একটিই একজন মানুষের জীবনকে চরিতার্থতা দেবার জন্য যথেষ্ট; তাদের একত্রযোগ তো একান্ত বিরল ঘটনা। আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে এই বিরল ঘটনাটাই ঘটেছে। একজন ভালো শিক্ষক যে উচ্চমানের গবেষক হবেন,  এমন কোনো নিয়ম নেই; আবার সার্থক গবেষকদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে তাঁরা দক্ষ শিক্ষক হন না; আর যারা শিক্ষকতা ও পাণ্ডিত্যের বলয়ে সন্তুষ্টচিত্ত থাকেন, তাঁরা যে সংস্কৃতি বিষয়ে সচেতন হবেন, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। আমাদের সময়ে আনিসুজ্জামানের মতো পরিপূর্ণ মানুষ কম ছিলেন। … সুহৃদ ছিলেন। আমরা যারা তাঁর কাছে ছিলাম তাদের তো অবশ্যই, যাদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না তাদেরও। অনাগতদেরও। আমাদের কালে তাঁর মতো আরেকজনকে পাওয়া দুষ্কর ছিল। আগামীতে অন্যরা আসবেন, কিন্তু তাঁর মতো কেউ যে আসবেন না, এটা নিশ্চিত।

সাত

আনিসুজ্জামানের জীবনসঙ্গী সিদ্দিকা জামান  কামরুন্নেসা  বালিকা  বিদ্যালয়ের  ছাত্রী থাকাকালে ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের মিছিলে কণ্ঠ শাণিত করেছেন, ১৯৫৭-তে গার্ল গাইডস ও গার্লস স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েলের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে ফিলিপিন্সের বিশ্ব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষে দীর্ঘ পেশাজীবন অতিবাহিত করেছেন ব্রিটিশ কাউন্সিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে।

এর আগেও তিনি লিখেছেন; বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত রশীদ হায়দার-সম্পাদিত স্মৃতি : ১৯৭১ বইতে। একুশের বইমেলা ২০২১ উপলক্ষে অন্যপ্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই আমার বিপুলা পৃথিবী। ১৯৬১ সালে যাঁর সঙ্গে তিনি যুগল-জীবনের পথচলা শুরু করেন, সেই আনিসুজ্জামান যখন তাঁদের দাম্পত্যজীবনের ছয় দশক পূর্তির কিছু আগে প্রয়াত হন, তখন সিদ্দিকার স্মৃতিসিক্ত কলম আমাদের উপহার দেয় এই বই।

নয় অধ্যায়ের এ-বইয়ের সূত্রপাত   প্রথম পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয় দিয়ে। তবে তাঁর দেখার সামগ্রিকতা বাড়িয়েছে লেখার প্রসন্নতা, তাই দুজনের গল্পে শুরু থেকেই ঘিরে থাকে আশপাশের অনেকে। এই যেমন বোন সিদ্দিকার আদরের ছোটভাইকে নিয়ে এমন স্মৃতি :

বিয়ের পরদিন সকালে সে যখন জানতে পারল দুলাভাই তার বোনকে নিয়ে চলে গেছে তখন সে পুলিশকে ফোন করতে উদ্যত হয় – বোনকে নিয়ে যাওয়ার অনুযোগে।

বিয়ের আট বছর পর আনিসুজ্জামানের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের খবর দিয়ে যে-দ্বিতীয় অধ্যায়বিন্যাস, তা পাঠককে যেন বলতে থাকে ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’। এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এসেছে নিপুণ বিবরণে;  ভারতে অবস্থানকালে দেশে আইনজীবী চাচা আব্দুল আহাদের শাহাদতের খবরে যেমন ভেঙে পড়েছেন তেমনি প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনিসুজ্জামানের সাহসী ভূমিকার কথা বর্ণনা করেছেন।

পরের অধ্যায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘নীপবন’ নামে ব্যতিক্রমী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প আমাদের মুগ্ধ করে। গবেষণাসূত্রে আনিসুজ্জামানের বিদেশযাত্রার স্মৃতিচারণের পাশাপাশি গবেষণাসূত্রে ক্লিনটন বি সিলির বাংলাদেশে আসা ও তাঁদের আবাসে অবস্থানকেও এমনভাবে স্মৃতিচিত্রিত করে রেখেছেন সিদ্দিকা :

১৯৮১ সালে আনিসুজ্জামান আলজিয়ার্সে যাবার আগে আমেরিকান অধ্যাপক ড. ক্লিনটন বি সিলি আমাদের বাসায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন। উনি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা আর কবিতা অনুবাদ করে খুব প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেবার এসেছেন গবেষণার উপকরণ সংগ্রহের জন্য। পরিকল্পনা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনমাস করে মোট ছয় মাস বাংলাদেশে থাকবেন। আনিসুজ্জামান আমায় বলল, ‘উনি আমাদের বাসায় থাকলে কোনো অসুবিধা হবে কিনা?’

না, অসুবিধা তো নয়, বরং আনিসুজ্জামান ও সিদ্দিকা জামান পরিবারের অনাড়ম্বর অথচ আন্তরিক আতিথেয়তায় ‘উনি একেবারেই বাঙালিদের মতো থাকতেন। লুঙ্গি, শার্ট ও ফতুয়া পরতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। সবসময় বাংলায় কথা বলতেন। ছেলেমেয়েরা তাঁকে ‘ক্লিন্ট চাচা’ ডাকত।’

পঞ্চম অধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন এবং বৃহত্তর জীবনের বিভায় স্নাত হওয়ার আখ্যান।  বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ায় বন্ধুবান্ধব ও  প্রতিবেশীদের সাহচর্যে তাঁদের জীবন কতটা আনন্দময় ছিল তা  কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার বলতেও তিনি অক্লান্ত। এখানে পাওয়া যাবে ব্যক্তি আনিসুজ্জামানের মানবিক দিকও :

একবার পাড়ার কোনো ভাবীর রুটির দরকার হলে আনিসুজ্জামান নিজে গিয়ে দোকান থেকে রুটি এনে দিল।

কিংবা আটাশির বন্যার্তদের সহায়তা প্রসঙ্গে :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন বন্যার্তদের জন্য খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করল। একদিন আনিসুজ্জামান মিটিং সেরে এসে বলল, ‘আগামীকাল থেকে প্রতিদিন সকাল ৯-১০টার মধ্যে এক কেজি আটার রুটি ও ভাজি দিতে হবে।’

সিদ্দিকা জামানের লেখার বড় গুণ তাঁর রসবোধ। আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধি-এর উৎসর্গবাক্যে লিখেছিলেন :

সাতপাঁচ ভেবে বেবীকেই (‘বেবী’ সিদ্দিকা জামানের ডাকনাম)।

এ-প্রসঙ্গে সপ্তম অধ্যায়ে লিখেছেন :

বন্ধুবান্ধবরা মজা করে বলল, আপনি জিজ্ঞেস করলেন না – কেন এত ভাবতে হলো?

আনন্দের ফোয়ারার সঙ্গে আছে বেদনারও ধারা। জামাতা সুমনের অকালমৃত্যুর ঘটনা যেমন তাঁদের স্তব্ধবাক করেছে তেমনি আনিসুজ্জামানের অসুস্থতায় পরিবার ও পরিপার্শ্বের উদ্বেগাকুল হৃদয় অশ্রুর অক্ষরে ধারণ করেছেন তিনি। ১৪ মে ২০২০ আনিসুজ্জামানের  বর্ণিল জীবনের সমাপনকে বাণীবদ্ধ করেছেন এভাবে :

বর্ণহীন হতে শুরু করল আমার বিপুলা পৃথিবী।

খ্যাতকীর্তি আনিসুজ্জামানকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে এবং  আরো হবে নিশ্চিতভাবে; কিন্তু মানুষ আনিসুজ্জামানের অজানা ভুবন উন্মোচনে এই বইটি বিশিষ্ট বলেই বিবেচিত হবে।

আট

একুশে বইমেলা ২০২১-এ বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত আনিসুজ্জামান বিষয়ক একটি ব্যতিক্রমী, গুরুত্বপূর্ণ  বই জালাল ফিরোজের সংবিধান ও আনিসুজ্জামান।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নিবিড় সংযোগ এবং তাঁর সংবিধান-ভাবনা, কোনো কোনো সংশোধনীজনিত খেদ এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয় নিয়ে  জালাল ফিরোজের এ- প্রামাণ্য বই অ্যাকাডেমিক দিক থেকে তাৎপর্যবাহী তো বটেই, একই সঙ্গে তা আনিসুজ্জামান-গবেষণায়ও যোগ করবে নতুন মাত্রা।

নয়

এবারের একুশে বইমেলায় শোভাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ধীমান গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর প্রবন্ধ-গবেষণার বই আনিসুজ্জামান কালের সমীক্ষা। ‘বাঙালি নারীর আলেখ্য’, ‘মনীষী-বীক্ষণের চালচিত্র’, ‘স্মৃতিকথনের পরম্পরা’, ‘ইহজাগতিকতা : স্বরূপ ও বাস্তবতা’ এই অধ্যায়-চতুষ্টয়ে।  লেখক ভূমিকায় তাঁর বিনয়বচনে বলেছেন :

যাঁরা আনিসুজ্জামানের একান্ত কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠজন – তাঁদের স্মৃতির ভাণ্ডার স্বভাবতই বিচিত্র ও সমৃদ্ধ। আমি তো সে-দলের লোক নই – অন্তরঙ্গ সম্পর্কের দাবিও করতে পারিনে – আমার মতো অল্প-পুঁজির লোকের পক্ষে এ-কথাই সত্য – ‘অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’।

স্থানিক দূরত্বে থাকলেও আবুল আহসান চৌধুরী যে আনিসুজ্জামানের প্রীতিনৈকট্য লাভ করেছিলেন তার সাক্ষ্য ধরা আছে বইয়ের পরিশিষ্টে সংযোজিত তাঁর দুটো বইয়ে প্রদত্ত আনিসুজ্জামানের ভূমিকা-লেখন এবং তাঁকে লেখা একটি চিঠির মধ্যে।

দশ

আনিসুজ্জামানের প্রিয় শিক্ষার্থী এবং নিষ্ঠাবান আনিসুজ্জামান-গবেষক ভূঁইয়া ইকবালের সংকলন-সম্পাদনায় জার্নিম্যান বুকস মার্চ, ২০২১-এ প্রকাশ করেছে আনিসুজ্জামানের অপ্রকাশিত পত্রাবলি। ১৯৭৩-২০১১ এই  কালপরিক্রমায় তাঁকে লেখা আনিসুজ্জামানের তেইশটি চিঠির সংকলন এটি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, লন্ডন, প্যারিস থেকে ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও গবেষণা-ব্যাপদেশে লেখা এইসব চিঠিতে ছাত্রহিতৈষী এক শিক্ষকের ছবিও ফুটে ওঠেছে। ভূঁইয়া ইকবাল তাঁর ভূমিকায় বলেছেন :

চিঠিপত্রে তাঁর নিজের গবেষণা ও প্রকাশনা ছাড়াও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রসঙ্গের কথা আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, গবেষণা পত্রিকা ‘পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পরিচয় ধৃত এসব চিঠিপত্রে।

শেষাংশে সংযোজিত প্রতিটি চিঠির পরিচিতি বইটিকে প্রামাণ্য পত্রসংকলনের মর্যাদা দিয়েছে।

এগারো

একুশে বইমেলা ২০২১-এ এ.এন.রাশেদার সম্পাদনায় শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শিক্ষাচিন্তা ও প্রগতিশীল ভাবনা শীর্ষক একটি ভিন্নধর্মী সংকলন। এটি মূলত মাসিক শিক্ষাবার্তা আয়োজিত সেমিনারে তাঁর বক্তৃতা এবং পত্রিকাটিতে প্রকাশিত লেখার সংকলন।

 ‘স্বাধীনতার রজতজয়ন্তকীতে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সম্মাননা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত সভায় সভাপতির ভাষণ’, ‘বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতির সংকট ও সুপারিশ শীর্ষক সেমিনার’-এ প্রদত্ত বক্তব্যের সংযোজন শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামানের পরিচয় তুলে ধরতে সহায়ক হয়।

বারো

আনিসুজ্জামানের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকী ১৪ মে ২০২১। তাঁর চির-প্রস্থানের এক বছরের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যে-চর্চা হয়েছে তাতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ভাগই বেশি। লেখক ও  গবেষক আনিসুজ্জামানের নির্মোহ মূল্যায়ন নিশ্চয়ই আরো সময় দাবি করে। তবে আশার কথা, এরই মধ্যে প্রকাশিত বই ও সংকলনগুচ্ছেও সে-ইঙ্গিত আছে।

তাঁকে ঘিরে আমাদের অনুভবের অতলতা যেন তাঁর অঙ্গীকারকেও সঙ্গে রাখে সবসময়; যে-কথা চিন্ময় গুহের লেখায় ধ্বনিত হয়েছে এভাবে : আমরা এক মৃত্যুলাঞ্ছিত অন্ধকারে নিজেদের খুঁজে চলেছি। আসল যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো আপন শিকড়ের প্রতি বিশ্বাস আর দায়বদ্ধতা। এবং ঘর আর বাহিরের মধ্যে অনিবার্য এক সেতু নির্মাণ। প্রথমটি না থাকলে দ্বিতীয়টি রূপকথার মতো অলীক হয়ে ওঠে। আনিসুজ্জামান সারাজীবন তাঁর প্রজ্ঞা, নম্রতা আর ভালোবাসা দিয়ে এই গভীর বার্তাটি আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। (‘আনিসুজ্জামান : এক মানবভাষার সন্ধানে’, আনিসুজ্জামান : স্মরণ, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ফেব্রুয়ারি ২০২১)