বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : আনিসুজ্জামানের চোখে

আনিসুজ্জামান আমাদের কালের একজন অসাধারণ সাহিত্যবোদ্ধা। সাহিত্যরুচির দিক থেকে তিনি যেমন নমস্য, তাঁর পঠনের ব্যাপ্তিও বিস্ময়কর। প্রাচীন-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে একেবারে সাম্প্রতিক গ্রন্থ পর্যন্ত ছিল তাঁর পঠনের আওতায়। বোধের গভীরতা ও তীক্ষè বিশ্লেষণশক্তি তাঁর রুচি ও পঠনের প্রসারতাকে নিয়ে গেছে এক উচ্চতর মাত্রায়। বিদেশি সাহিত্য এবং অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কেও তাঁর পঠন যথেষ্ট ঋদ্ধ। কিন্তু এই ব্যাপক পঠন-পাঠন এবং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণশক্তি সত্ত্বেও আনিসুজ্জামান নিরেট সাহিত্য-সমালোচনায় মগ্ন হননি। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতিকে এক সুতোয় গাঁথা। ফলে যতটা তিনি সাহিত্যের প্রেমিক, ততটাই ইতিহাসের পথিক। কেননা, আজকের সমাজ-রাজনীতিই তো আগামী দিনে গ্রন্থের স্থিত অক্ষরে জায়গা করে নেয় ইতিহাস নামে।

সাহিত্য ও সমাজ-ইতিহাসের প্রতি আনিসুজ্জামানের এই যুগপৎ ভালোবাসার মেধাবী প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-বিষয়ক ভাবনা ও রচনাবলিতে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অধিকাংশ রচনাই ইতিহাসের বৃহত্তর ক্যানভাসের ওপর আঁকা। এর প্রথম বড় ধরনের প্রকাশ তাঁর পিএইচ.ডি. গবেষণা-অভিসন্দর্ভে, যা পরে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪) গ্রন্থে রূপান্তরিত হয়। এই গ্রন্থের প্রথম ভাগ ‘দেশ ও কাল’, যাতে ১৭৫৭ থেকে ১৯১৮ সাল পর্বের বাংলার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনায় মূর্ত হয়েছে সে-সময়ের রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, নানা সামাজিক টানাপড়েন, ধর্মীয় সংঘাত, আধুনিক শিক্ষার বিকাশ, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যের একটি অভিসন্দর্ভ রচনা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসকে কতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন তা অনুধাবন করা যায় তাঁর নিম্নোক্ত মন্তব্যে [আনিসুজ্জামান ১৯৭১ : ৪] :

… বর্তমান গ্রন্থে সামাজিক পশ্চাৎপটের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যকর্মের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। …

… একালের মুসলিম-রচিত বাংলা সাহিত্যের আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধান অসুবিধা সামাজিক ইতিহাসের অভাব। … বিভিন্ন সূত্র থেকে মালমশলা সংগ্রহ করে আমি এই দুরূহ কর্মের একটি খসড়া তৈরি করতে চেয়েছি এই গ্রন্থের প্রথম ভাগে। ইতিহাসের রূপরেখা স্পষ্ট করে তোলার জন্য কখনো অনেকখানি জায়গা নিয়েছি।

বস্তুতপক্ষে গ্রন্থের ৮৮ পাতায় পলাশীর যুদ্ধ থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি – এই ১৬২ বছরের বাংলার যে-ইতিহাস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা যে-কোনো ঐতিহাসিকের জন্যও শ্লাঘার বিষয়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবু ইমাম একবার এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন যে, প্রথম পর্বটি আর একটু বড় করে লিখলে আনিসুজ্জামানকে ইতিহাসেই পিএইচ.ডি. দেওয়া যেত। ইতিহাসের প্রতি আনিসুজ্জামানের ওই অনুরাগ দেখা যায় মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯) সংকলনে, ‘স্বরূপের সন্ধানে’ (১৯৭৪) প্রবন্ধে চর্যার সমকালীন সমাজ ইতিহাস উন্মোচনে, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বাংলার বিভিন্ন কুঠি থেকে পাঠানো চিঠিপত্র সংকলনে (দ্র. Factory correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Record, লন্ডন ১৯৮১)।

দুই

সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি এই সমান্তরাল অনুরাগ আনিসুজ্জামানকে নিয়ে যায় সাহিত্যের ইতিহাস-ভাবনার পথে। এর প্রথম বড় উপস্থাপন ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমিতে পুরোনো বাংলা গদ্যের ওপর তিনটি দীর্ঘ বক্তৃতা, যা পরে পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বাংলা গদ্যের ইতিহাস রচনায় আনিসুজ্জামান প্রথম পথিক নন। এর আগে সুকুমার সেন, সজনীকান্ত দাস, মনোমোহন ঘোষ প্রমুখ বাংলা গদ্যের ইতিহাস নিয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই তিনজনের বাইরেও বহু পণ্ডিত-গবেষক বাংলা গদ্যের নানা নমুনার সংকলন করেছেন, বিশেষত চিঠি ও দলিল-দস্তাবেজের। কিন্তু অন্যদের ‘পুরোনো’র সঙ্গে আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো’র বড় পার্থক্য আছে। ওই বক্তৃতাতেই তিনি বলছেন [আনিসুজ্জামান ১৯৮৪ : ১৮-১৯] :

… প্রাক্-উনিশ শতকী বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠতে পারেনি।

পুরোনো বাংলা গদ্যের জ্ঞাত নমুনার সঙ্গে উনিশ শতকের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের কিছু অজ্ঞাতপূর্ব উপকরণ সাম্প্রতিককালে আমাদের হাতে এসেছে। এ থেকে সাহস করে বলা যায় যে, ষোড়শ শতাব্দী থেকে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে বাংলা গদ্যের – কাজের গদ্যের এবং ভাবের গদ্যের – নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। এই সময় থেকে এমন নিদর্শন পাওয়ার একাধিক ঐতিহাসিক কারণ আছে।

দেখা যাচ্ছে যে, আনিসুজ্জামান সাহিত্য-উপকরণের পরবর্তী ধাপে যে-কোনো উত্তরণের জন্য পূর্ববর্তী স্তরে সাহিত্যের পরিণতি ও সমাজের অগ্রযাত্রার একটি বিন্দুতে মিলন অপরিহার্য মনে করেন, অংক বা জ্যামিতির ভাষায় যাকে বলা হয় সমকেন্দ্রিকতা (convergence)। পুরোনো গদ্য বা বাংলা ভাষায় গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লিখিত মন্তব্য আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন [আনিসুজ্জামান ১৯৮৪ : ২০] :

গদ্যবিকাশের এই রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ যেমন ছিল, তেমনি তার জন্য ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রেও একটা অনুকূল পরিবেশ  গড়ে উঠেছিল। … গদ্যের বিকাশের জন্য এটা ছিল পূর্বশর্তস্বরূপ।

গদ্যের উদ্ভবের ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান যেমন নতুন সৃষ্টির জন্য সাহিত্য ও ইতিহাসের যুগলমিলনকে প্রাধান্য দিয়েছেন, বিকাশের ক্ষেত্রেও তেমন। হঠাৎ করে কোনো দিনে কোনো ক্ষণে একটি নতুন যুগ শুরু হয় না, তাঁর এই ধারণা গ্রহণ ছিল সম্ভবত মার্কসীয় জ্ঞান থেকে। পলাশীর মাঠেই বাংলার মধ্যযুগের অবসান, যদুনাথ সরকারের এমন মন্তব্য তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। ‘সেকশুভোদয়া’ বা ‘শূন্যপুরাণের’ কালে গদ্যের সম্ভাবনাকে তিনি তাই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে [আনিসুজ্জামান ১৯৮৪ : ৪৯-৫১] :

পয়ারের মধ্যে গদ্যের যেমন লুকিয়ে থাকার সুযোগ ছিল। তেমনি আবার গদ্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ছন্দের অবগুণ্ঠনে। …

… আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। যেখানে পদ্যের কাঠামো ভেঙে গেলেও তার রেশ রয়ে যাচ্ছে। আবার গদ্যের কাঠামো গড়ে না উঠলেও তার আভাস সূচিত হচ্ছে।

ওই বক্তৃতায় এরপরই বাংলা গদ্যের ইতিহাসের আমূল পরিবর্তনের দিশা দেন আনিসুজ্জামান। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা বাংলা গদ্যে যুগান্তর ঘটিয়ে ‘নতুন দিন’ আনেন; কিন্তু সেই নতুন দিনই ‘প্রথম দিন’ নয়। তাঁর ভাষায় [আনিসুজ্জামান ১৯৮৪ : ৬৯ এবং ৭৩] :

ক. … এর আগে কখনো বাংলা গদ্য লেখা হয়েছিল কেরী এবং তাঁর সহকর্মী ও মুনশিরা তা জানতেন না। পূর্ববর্তী ধারা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত তাঁরা বাংলা গদ্যের যে রূপ নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তারা মনে করেছিলেন এবং আমরাও মেনে নিয়েছিলাম যে, বাংলা গদ্য তাঁদের হাতেই প্রকটিত হলো।

খ. ষোলো থেকে আঠারো শতক অবধি বাংলা গদ্যের নিদর্শন প্রধানত চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজে আবদ্ধ, এই প্রচলিত ধারণা এখন সংশোধনের যোগ্য।

ওই উভয় মন্তব্যের বিবেচনাতেই আনিসুজ্জামান প্রচলিত ধারণা চূর্ণকারী (iconoclast); গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া ভক্ত (idolator) নন।

গত চার দশকে গবেষকদের প্রচেষ্টায় প্রাক্-উনিশ শতকীয় বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত অনেকটা বদলে গেছে, পাওয়া গেছে অনেক নতুন উপকরণ। কেউ কেউ অবশ্য পর্তুগাল ও চিনে এখনো উদ্ধার করা হয়নি বাংলা ভাষার এমন উপকরণের কথা বলছেন। এসব ক্ষেত্রেও আনিসুজ্জামানকে দিশারী বলা যেতে পারে।

তিন

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রচলিত যুগবিভাগ নিয়ে আনিসুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা করেছেন। এর একটি বড় প্রকাশ দেখা যায় ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র-আয়োজিত তাঁর বক্তৃতা ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা’য়। সভার সভাপতি ছিলেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক। উপস্থাপিত

বক্তৃতাটি পরে সাহিত্য-সাময়িকী সুন্দরমে কিছু সংযোজনসহ প্রকাশিত হয়।

ওই বক্তৃতার শুরুতেই আনিসুজ্জামান স্পষ্ট করে নেন যে, “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রচলিত কিছু ধারণা পুনরায় পরীক্ষা’র প্রয়াস ওই বক্তৃতার উদ্দেশ্য। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত যুগবিভাগের ধারাটিকে “কৃত্রিম” বলে তাঁর যুক্তিজাল বিস্তারের সূচনা করেন [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৭৬]।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেন দীনেশচন্দ্র সেন। তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১৮৯৬) নামক মহাগ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সেন আদি যুগ থেকে এদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের মধ্যবর্তী সময়ের বাংলা সাহিত্যকে মূলত পাঁচটি পর্ব বা অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। সে-বিন্যাস নিম্নরূপ [দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৯১ : (৫৯)-(৬১)] :

১.    হিন্দু-বৌদ্ধযুগ : শূণ্যপুরাণ, নাথগীতিকা, গোরক্ষবিজয়

     প্রভৃতি।

২. গৌড়ীয় যুগ : কৃত্তিবাসীসহ বিভিন্ন রামায়ণ : সঞ্জয়

  ও কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারত; বিজয় গুপ্ত ও

     অন্যদের মনসামঙ্গল, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলী,

    প্রভৃতি।

৩. চৈতন্যসাহিত্য : পদাবলী, চৈতন্যচরিত, প্রভৃতি।

৪. সংস্কার  যুগ  :  মনসামঙ্গল,  চণ্ডীমঙ্গল,  ধর্মমঙ্গল,

    প্রভৃতি।

৫. কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ : পদ্মাবতী, অন্নদামঙ্গল, রামপ্রসাদী

    গান ও অন্যান্য গীতিকবিতা, প্রভৃতি।

দীনেশচন্দ্র সেন এই ইতিহাস-বর্ণনার প্রতিটি পর্বে বাংলা লোকসাহিত্যের উপকরণকে মর্যাদার সঙ্গে স্থান দিয়েছেন। যেমন প্রথম অধ্যায়ে রূপকথা, ব্রতকথা ও ডাক-খনার বচন, অথবা দ্বিতীয় পর্বে লৌকিক ধর্মাশ্রিত কাহিনি, বিভিন্ন ছড়া ও পাঁচালী। তাঁর জীবিতকালে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-এর ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়; এর তিনটি সম্ভবত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘চর্যাপদ’ প্রকাশের পরে। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান দেননি বললেই চলে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ওই পর্বে চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের মূল নিদর্শন হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর বাংলা সাহিত্যের কথার (১৯৫৩) প্রাচীন যুগ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে চর্যাপদ ছাড়াও ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরাণ, ডাক-খনার বচন

প্রভৃতি। তবে আনিসুজ্জামান তাঁর বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ নিয়ে আলোচনায় দীনেশচন্দ্র সেন ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র যুগ বা পর্ব-বিভাগের উপকরণ-সংক্রান্ত ধারণাকে গ্রহণ করেননি।

বাংলা সাহিত্যের তিন পার্বিক ইতিহাসের ছক দৃঢ় হয়েছিল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা (১৯৩২)গ্রন্থের মাধ্যমে। আনিসুজ্জামানের বিবেচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, গোপাল হালদার, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আহমদ শরীফ প্রমুখ সুনীতিকুমারের যুগবিভাগকে অনুসরণ করেছেন; আর সুকুমার সেন, মুহম্মদ এনামুল হক, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সে-ছক অনুসরণ করেননি। এই উভয় পক্ষের মতামত বিশ্লেষণ করে আনিসুজ্জামানের মনে হয়েছে যে [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৭৬-৭৭] :

… বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রচলিত বিভাজনরীতি অনুসরণ করেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যুগবিভাগ করা হয়েছে। …

… বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে যেভাবে এবং যে-কালপরিধিতে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে ভাগ করে দেখা হয়, তার যৌক্তিকতা নতুন করে ভেবে দেখা দরকার।

আদি চর্যাগুলোর রচনাকাল অথবা চর্যা-রচনার সূচনাকাল বাংলা সাহিত্যের সূচনাকালের সমার্থক। এটি দশম না সপ্তম-অষ্টম শতক তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে পণ্ডিতদের মধ্যে। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান সাহিত্যের উপকরণের পাশাপাশি ইতিহাসের বাস্তবতাকে মিলিয়ে দেখার পক্ষপাতী। তাঁর ভাষায় [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮০] :

… বাঙালি জীবনের অন্যান্য ধারার বিকাশের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভবের বিষয়টি মিলিয়ে দেখা দরকার। ইতিহাসের যে-পর্বে বাঙালির লৌকিক বৈশিষ্ট্য বৃহত্তর পরিণতি লাভ করে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ সেই পর্বের ফল বলে গণ্য হলে এই বিকাশের কারণ ও তাৎপর্য দুই-ই বোধগম্য হয়ে উঠবে।

আনিসুজ্জামান  ওই  বক্তৃতায়  ফিরে  তাকান  বাংলাদেশ ও পূর্ব-ভারতীয় ইতিহাসের দিকে। নীহাররঞ্জন রায়ের ইতিহাসের বরাত দিয়ে তিনিও মনে করেন যে, “চতুর্থ শতাব্দীর আগে বাংলায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য যা ছিল, গুপ্ত পর্বে তা গ্রাস করে নেয় ‘সর্বভারতীয় আদর্শ’। আবার ‘সপ্তম শতাব্দী থেকে ওই পট বদলাতে থাকে। … সর্বভারতীয় আদর্শের জায়গায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে থাকে। … বাংলার সৃজনশীলতা এই সময়েই আত্মপ্রকাশ করতে থাকে” [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮০]। এরপর তিনি এর ফসল সন্ধান করেন ভাষা-সাহিত্যের মধ্যে [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮১] :

… এই পরিপ্রেক্ষিতে যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বর্ণমালার বিকাশ ঘটবে, তা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়। … যদি আমরা এ কথা মনে রাখি যে, বাঙালি

সংস্কৃতির আত্মবিকাশের প্রধান অবলম্বন সাহিত্য ও সংগীত, তাহলে এমন ধারণা করা অসংগত হবে না যে, সাহিত্য ও সংগীতের ক্ষেত্রে বাঙালির স্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তির জন্য দশম শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করার ঐতিহাসিক কারণ ছিল বলে মনে হয় না। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতেও তা হতে পারত।

এভাবে আনিসুজ্জামান প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্যের সূচনাকে সপ্তম-অষ্টম শতক বলে মেনে নেন।

অনেক পণ্ডিতের মতে, দ্বাদশ শতকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের অবসান হয়েছে। ফলে মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্য-নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে দেড়-দুশো বছরের ব্যবধানকে যুক্তিসংগত করার জন্য তাঁরা অন্ধকার যুগের তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তবে ‘নব চর্যাপদে’র ধারাবাহিক আবিষ্কার এবং সংস্কৃত ও প্রাকৃত রচনার নানা নিদর্শনের সন্ধান অন্ধকার যুগ তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সুকুমার সেন শুরুতে আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ধারাবাহিকভাবে বিবেচনার পক্ষপাতী ছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করলেও মুহম্মদ এনামুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা  বিভাগ  আয়োজিত  ভাষা  ও  সাহিত্য  সপ্তাহের (১৯৬৩) বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগ বলে কোনো কিছু তিনি স্বীকার করেন না [মুহম্মদ আবদুল হাই ১৩৭১ : ৪০]।

নব চর্যাপদের চর্চায় আনিসুজ্জামান একজন পথিকৃৎ। সেই বিশ্লেষণ থেকে তিনি স্পষ্ট করে বলেন [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮২] :

… দ্বাদশ শতাব্দীতে ইতিহাসের যুগান্তরের রেখা টানতে গিয়ে পরবর্তী চর্যাগীতিকে উপেক্ষা করা ঐতিহাসিক বিচারে সংগত হয় না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আদিপর্বের সীমা যদি টানতেই হয়, তা হলে তা চোদ্দ শতকেই এসে পড়বে। … আর যদি মুদ্রণযন্ত্র-প্রবর্তনের পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্যকে অখণ্ডভাবে, একটি পর্বের অন্তর্গত করে, দেখা হয়, তা হলে বিদারণ-রেখার প্রশ্ন ওঠে না, …।

চার

১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পাঁচ খণ্ডে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। দু-বছর পর আনিসুজ্জামান এই গ্রন্থমালার প্রধান সম্পাদক নির্বাচিত হন। গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ডের কাল চতুর্দশ শতক পর্যন্ত; দ্বিতীয় খণ্ড পনেরো ও ষোলো শতক; তৃতীয় সতেরো-আঠারো শতক, চতুর্থ উনিশ এবং শেষ খণ্ড বিশ শতক। লক্ষণীয় যে, প্রথম খণ্ডের যুগবিভাগ আনিসুজ্জামানের ভাবনায় উল্লিখিত যুগবিভাগের সংগতিপূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডের শুরু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন দিয়ে এবং প্রস্তাবিত তৃতীয় খণ্ডের সমাপ্তি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ও দোভাষী পুথি দিয়ে। ধরে নেওয়া যায় যে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড মিলিয়ে প্রচলিত ধারণার মধ্যযুগের ইতিহাস সন্নিবেশিত   হবে। তবে দুই খণ্ডে বিন্যস্ত হওয়ার ফলে মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, পদাবলি, প্রণয়কাহিনি – শতক ধরে দু-খণ্ডে ভাগ হয়ে যাবে। সম্ভবত  গ্রন্থের কলেবরের কথা ভেবেই চার শতকের ইতিহাসকে দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড নিয়ে অবশ্য সমস্যা নেই; এটি আধুনিককালের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং এখানে বিভিন্ন ধারার চেয়ে ব্যক্তি-রচয়িতার প্রসঙ্গ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

এই কাল-বিভাজন বা পর্ব-বিভাগ যে বাংলা একাডেমির বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের খণ্ডবিন্যাসের সময় আনিসুজ্জামানের মনে ছিল, তার সাক্ষ্য রয়েছে দ্বিতীয় খণ্ডের নিবেদনে, যদিও তা প্রথম খণ্ডেই বেশি মানানসই হতো [আনিসুজ্জামান ২০০৮খ : ছয়] :

… আমাদের দেশের ও সাহিত্যের ইতিহাসে অনুসৃত তিন পর্বের ধারণা সম্পর্কে, অর্থাৎ এই ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে বিভক্ত করে দেখার বিষয়ে, আমার কিছু সংশয় আছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের মধ্যে যে ভেদরেখা অঙ্কন করা হতো, নবচর্যাগীতি আবিষ্কারের পরে তা নিরর্থক হয়ে গেছে। সূচনা থেকে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের একটিমাত্র পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করায় কোনো বাধা আর এখন নেই। … একথা বোধ হয় মিথ্যে নয় যে, পৃথিবীর এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসকে ইউরোপকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার ফলে ওই তিন পার্বিক ইতিহাস রচনার শুরু হয়, পরে তা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসেও বিস্তৃত হয়।

এই কারণে বর্তমান গ্রন্থে, মধ্যযুগ কথাটা আমরা যথাসাধ্য পরিহার করার চেষ্টা করেছি। … তবে ভাষার ইতিহাসের ক্ষেত্রে তিন পর্বের ধারণা রয়ে গেল যদিও সে বিভাজন যতটা বৈশিষ্ট্যগত ততটা কালগত নয়।

পাঁচ

বাংলা একাডেমির বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ডের নিবেদনে প্রধান সম্পাদক আনিসুজ্জামান তাঁর ইতিহাসবোধের পূর্ব আলোচিত চেতনার কথা আবার নতুন করে উপস্থাপন করেছেন [আনিসুজ্জামান ২০০৮ক : সাত-আট] :

প্রস্তুত গ্রন্থে আমরা বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকায় সাহিত্যের বিকাশ লক্ষ করবার চেষ্টা করেছি। … তাতে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির সর্বতোমুখী বিকাশের সঙ্গে, বাঙালি মনীষার জাগরণের সঙ্গে, বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আমরা আশা করি।

এই পটভূমিকায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ডের নয়টি অধ্যায়ের মধ্যে তিনটি মাত্র ভাষা, লিপি ও সাহিত্য নিয়ে। বাকি ছয়টি অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে বাংলার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মজীবন ও শিল্পকলার পরিচয়। একটি অধ্যায়ের বিষয় ‘বাংলা ব্যতীত অপরাপর ভাষায় সাহিত্যচর্চা’। দ্বিতীয় খণ্ডের ছয়টি অধ্যায়ে আছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি, ধর্মজীবন ও শিল্পকলা। একটি অধ্যায়ে সংযুক্ত হয়েছে ‘বহির্বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ’।

কিন্তু পটভূমির ওপর এত গুরুত্ব আরোপ যে পণ্ডিতমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রথম খণ্ডের ২১ বছর পর প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডের নিবেদনে। তবে তাতে হতাশ বা বিরক্ত না হয়ে আনিসুজ্জামান আবার তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করেন এভাবে [আনিসুজ্জামান ২০০৮খ : পাঁচ-ছয়] :

… সমসাময়িক দেশীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে বিচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি গভীরভাবে উপলব্ধি করা সম্ভবপর নয়। আমরা সুলতানী আমলের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলবো অথচ সুলতানদের পরম্পরা সম্পর্কে অনবহিত থাকবো, এটি অসংগত। মুঘল আমলে যে সেই পৃষ্ঠপোষকতার অবসান হলো, তার কারণ বুঝতে তখনকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা আবশ্যক। লৌকিক দেবদেবীর উদ্ভবের বৃত্তান্ত না জেনে কি মঙ্গলকাব্যগুলো বোঝা যাবে? বৈষ্ণব সাহিত্য পড়বো অথচ বৈষ্ণব ধর্মান্দোলন সম্পর্কে জানবো না, এটা কেমন কথা? বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে কিছু না জেনে কি নবি-রসুলের জীবনী-রচনার পশ্চাৎপট উপলব্ধি করা সম্ভব? আবার, এসব ধর্মান্দোলন কেবল সাহিত্যক্ষেত্র নয়, সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রও আলোড়িত করেছিল। সে-সম্পর্কে ধারণা থাকলে সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র স্থাপনের জরুরি কাজটি করা যায়। তেমনি বহির্বাংলার সঙ্গে যোগাযোগের পটভূমিতে প্রণয়কাহিনী বা যুদ্ধবিষয়ক কাব্যের বিকাশের বাতাবরণ চিহ্নিত করা যাবে। মোটকথা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির সর্বতোমুখী বিকাশের সঙ্গে, বাঙালির সৃজনশীলতার ক্রমবিকাশের পটে, সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করতে পারলে বাঙালির জীবন ও চিন্তাধারার সঙ্গে তার মর্মগত যোগ আমরা উপলব্ধি করতে পারবো।

সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের এই যোগের কথা আনিসুজ্জামানের সাহিত্যের ইতিহাস-ভাবনার মূলসূত্রের উন্মোচক। ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, কিশোর ও যৌবন বয়সে আনিসুজ্জামান মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরে সাংগঠনিকভাবে এই বন্ধনটি চলমান না থাকলেও পঠন-পাঠনে তিনি মার্কসীয় ধ্যান-ধারণা থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। আনিসুজ্জামানের ভাবনার জগতে তাই সারাজীবনই সঙ্গোপনে প্রভাব ফেলেছে ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী চিন্তাধারা। এক্ষেত্রে আমরা গোপাল হালদারের দু-খণ্ডের বাংলা সাহিত্যের রূপরেখার (১৯৫৪) কথা স্মরণ করতে পারি।

ছয়

আরো একটি চিত্তাকর্ষক সাহিত্য-সমালোচনা সূত্রের অবতারণা করেছেন আনিসুজ্জামান যা বাংলা সাহিত্য-সমালোচনায় খুব প্রচলিত নয়। তিনি মনে করেন যে, সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা অনুধাবন করতে পারলে সাহিত্য-বিশ্লেষণ সহজ হয়। এর কিছু উদাহরণ তাঁর আলোচনায় পাওয়া যায়। যেমন [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৫] :

ক. পূর্ববঙ্গ গীতিকাগুলোতে নরনারীর প্রেমাবেগের

        যে-গভীর প্রকাশ, প্রণয়োপাখ্যান ও বৈষ্ণব পদাবলীর

      পটভূমি ছাড়া তা ব্যাখ্যা করা সহজ  নয়।

খ.   ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এর ইতিহাসবোধ, মুকুন্দ

  রামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর আত্মকাহিনির ইতিহাস-

     বোধের অস্ফুট প্রকাশের পরই সম্ভব।

গ. কবিগানে রাধা-কৃষ্ণ প্রণয়লীলার যে অমার্জিত

  উপস্থাপন, তা রাধা-কৃষ্ণ বা হর-গৌরী বিষয়ে

     কাব্যকথার ধর্মীয় বাতাবরণ ত্যাগের দীর্ঘ ভ্রমণ ছাড়া

     সম্ভব নয়।

ঘ. সমাজ-সংসারের কঠোর প্রহরা অগ্রাহ্য করে রাধার

 অভিসারে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের স্পর্শ আছে, যা

  গীতিকবিতার ব্যক্তিমানস প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত

    হতে পারে।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বহুল প্রচলিত কিছু প্রপঞ্চ সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন আনিসুজ্জামান। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সাহিত্য সম্পর্কে সাধারণভাবে বলা হয় যে, এর মূল উপকরণগুলো “ধর্মভিত্তিক ও আধিদৈবিক এবং সমষ্টিগত চেতনানির্ভর অর্থাৎ ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যশূন্য”। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের সন্দেহ, “… এমন লক্ষণ তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃতিযোগ্য, তবে তথ্য হিসেবে যে সম্পূর্ণ সত্য, তা বোধ হয় বলা যায় না” [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮২]। তাঁর আরো বড় আপত্তি, প্রাক্-আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার লক্ষণগুলো বিবেচনায় আমরা আধুনিক যুগের প্রতিতুলনার মধ্যে আটকে গেছি। এক্ষেত্রে ফোকলোরের Terminus Post Quem তত্ত্বের কথা মনে করা যেতে পারে। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, পরবর্তীকালে প্রচলিত কোনো ধারণা বা তত্ত্ব দিয়ে পূর্ববর্তী কোনো উপকরণের পরিবর্তন করলে বা বিবেচনা করলে তা হবে বহিরারোপিত। আনিসুজ্জামানের বিবেচনায় কিছু “ধারণা আমাদের মনে বাসা বেঁধে …” আছে; তাই যখনই মধ্যযুগ বলে পরিচিত সাহিত্য-উপকরণের বিষয় বা রূপ সেই বাসা-বাঁধা ধারণার সঙ্গে মিলছে না, তখনই হয় তা ব্যতিক্রম বলে চিহ্নিত করেছি, নয়তো তুচ্ছ বলে অগ্রাহ্য করেছি [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৩]।

বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আরো কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন আনিসুজ্জামান। বাংলা সাহিত্যের ওপর সংস্কৃত ও ফারসি সাহিত্যের গভীর প্রভাবের কথা সকল ইতিহাসবেত্তাই স্বীকার করেন। আনিসুজ্জামানের বিবেচনায় ওই উভয় সাহিত্যেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ইহলোকমুখী রচনার অভাব ছিল না। কিন্তু ওই বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারেনি! সাহিত্যের ইতিহাসে এর একটা “সন্তোষজনক ব্যাখ্যা” থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৩]।

ফারসি ঐতিহ্য থেকে হিন্দি-আওধি হয়ে আসা প্রণয়োপাখ্যানগুলোর ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তারা এর বিষয়বস্তুতে “তত্ত্বচেতনার রূপকাশ্রিত প্রকাশ”-এর ওপরই বেশি জোর দিয়েছেন। কিন্তু লায়লী মজনু, সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী এবং পদ্মাবতীর উদাহরণ দিয়ে আনিসুজ্জামান মনে করেন যে, “এসব কাব্যের আবেদন আধ্যাত্মিক তত্ত্ববোধে নয়, মানবীয় প্রণয়ের করুণমধুর অভিব্যক্তিতে” [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৪]।

বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, রামায়ণ-মহাভারতের বাংলা পাঠ সম্পর্কেও তিনি নতুন করে ভেবেছেন [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৪] :

… রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদাবলি রচনার ও উপভোগের কারণ ধর্মতত্ত্ব নয়, তার সর্বগ্রাহ্য মানবীয় আবেদন। শাক্ত পদাবলির জোর কতটা তার তত্ত্বে, আর কতটা তার সংসার জীবনের চিত্রে ও সরল ভালোবাসার প্রকাশে, সে-সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। এমন কী, এ কথাও মনে করার কারণ আছে যে,  রামায়ণ-মহাভারত-এর নৈতিকতা বা ধর্মোপদেশের চাইতে তার মানবীয়তা ও গল্পরস বেশি মূল্যবান বিবেচিত হয়েছিল বলেই হয়তো পাঠান সুলতান বা তাঁর মুসলমান কর্মকর্তা সাগ্রহে এসব বাংলা অনুবাদ করিয়েছিলেন।

মঙ্গলকাব্যগুলোকে শুধু ধর্মসাহিত্য রূপে বিবেচনা আনিসুজ্জামানের পছন্দ হয়নি। এক্ষেত্রে তিনি হুমায়ুন কবীরের বাংলার কাব্যের (১৩৪৯) অনুসারী। আনিসুজ্জামানের মতে, ধর্মের চেয়ে মানবতা এসব কাব্যের মূলসু; তাই “অনূদিত প্রণয়োপাখ্যানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে মঙ্গলকাব্যের ইহলৌকিকতা অধিক মূল্যবান বলে স্বীকৃত হবে” [আনিসুজ্জামান ২০১৮ : ৮৫] বলে তাঁর বিশ্বাস।

সাত

আনিসুজ্জামানকে আমরা অনেকেই অনুরোধ করেছিলাম ক্ষুদ্র কলেবরে হলেও বাংলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস লিখতে। সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তবে ২০০৪ সালে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি Bangladesh : National Culture and Heritage

 শীর্ষক যে পাঠ্যগ্রন্থ তৈরি করে তার ‘Bengali Language and Literature’ অধ্যায়টি আনিসুজ্জামানের রচনা। প্রায় ১৪০০০ শব্দের এই নিবন্ধে আনিসুজ্জামান আদি থেকে বিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন, যাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-চর্চার কাঠামো রূপে দেখা যেতে পারে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধটিকে তিনি সাতটি পর্বে ভাগ করেছেন :

১. বাংলা ভাষার পরিচয়,

২. চর্যাপদ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সাহিত্য,

৩. উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের বিশের দশক পর্যন্ত, যাতে উনিশ শতকের সাহিত্যধারা ও তার অনুবৃত্তির পরিচয় আছে,

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলি,

৫. রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক সাহিত্যের পরিচয়, দেশভাগ পর্যন্ত,

৬. বিভাগোত্তর পশ্চিম বাংলার সাহিত্য,

৭. বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশের সাহিত্য।

আনিসুজ্জামান অন্য কয়েকজন ইতিহাসবেত্তার মতো মনে করেন যে, আঠারো শতক পর্যন্ত সাহিত্যের বাহন পদ্য হওয়াই স্বাভাবিক, তবে তার মধ্যেই ধীরে ধীরে গদ্যের সৃষ্টি হচ্ছিল। আনুষ্ঠানিক এবং লৌকিক – দুই ধারার ধর্মই বাংলা সাহিত্যের উপকরণ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। তবে ওই যুগের সাহিত্যে ইহজাগতিক ও ধর্মীয় সমন্বয়বাদের অবদানও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ-এ নবির তালিকায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও হরির অন্তর্ভুক্তি এবং কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল-এ দক্ষিণ রায় ও বড় গাজী খাঁর বিরোধ থামাতে অর্ধকৃষ্ণ-অর্ধনবিরূপী অলৌকিক ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। বৈষ্ণব-সাহিত্যের দিকে তিনি পৃথকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে, বৈষ্ণব পদাবলিতেই প্রথম সত্যিকারের দেশীয় গানের উদ্ভব হয়েছিল আর চৈতন্যজীবনীর মাধ্যমে সাহিত্যে প্রথমবারের মতো বাস্তব মানুষের জীবনী রচনা শুরু হয়েছে। বাঙালি না হলেও ব্রজবুলি-সাহিত্যের প্রেরণাদায়ী হিসেবে বিদ্যাপতিকে তিনি বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। বাউল গানের উৎস সম্পর্কে তাঁর মত, ওই গানের ভাব তান্ত্রিক বৌদ্ধমত, সহজিয়া বৈষ্ণব, মুসলিম সুফিভাব ও শাক্ত-শৈব বিশ্বাসের সমন্বয়ে তৈরি। দীনেশচন্দ্র সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের মতকে গ্রহণ না করে আনিসুজ্জামান মনে করেন যে – ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’গুলো আঠারো শতকের শেষদিকের রচনা। নাথসাহিত্য ও ধর্মমঙ্গলের কোনো রচনাকেই তিনি ষোড়শ শতকের পূর্ববর্তী বলে মনে করেন না। সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যে তিনি কয়েকজন কবির মূল্যায়ন করেছেন এভাবে – মুকুন্দরাম ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি, আলাওল সতেরো শতকের উজ্জ্বলতম কবি, ভারতচন্দ্র মঙ্গলকাব্য-ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি।

তৃতীয় অধ্যায়ে আনিসুজ্জামান রামমোহন রায়কে কৃতিত্ব দিয়েছেন বাংলা গদ্যসাহিত্যকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিয়ে আসার জন্য। বিদ্যাসাগরের গদ্যের মাধ্যমে বাংলা গদ্যে শৃঙ্খলা, ধ্বনিময়তা, ছন্দ ও ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন বিশেষভাবে। বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসের প্রসঙ্গে বলেছেন যে, বঙ্কিম প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন; তবে ব্যক্তি সবসময় এসব মূল্যবোধ মেনে চলতে পারবে, তা বাস্তব মনে করেননি। তাঁর মতে, মধুসূদন সংস্কৃত, গ্রিক ও ইংরেজি থেকে উপকরণ নিয়েছেন। কিন্তু সংস্কৃত নাট্যতত্ত্বকে বর্জন করেছেন। কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের মন্তব্য কৌতূহল-উদ্দীপক। তিনি মনে করেন যে, মধুসূদন গ্রিক ট্র্যাজেডির অনুকরণে এই নাটক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডির প্রভাবই বেশি। তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য (১৮৬০) ক্ষুদ্র আকারের হলেও আনিসুজ্জামানের মতে, এ-কাব্য বাংলা কাব্যধারায় “বিপ্লব” নিয়ে আসে। তাঁর মতে, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য ইউরোপীয় মহাকাব্যের চরিত্রায়ন, ঘটনা-বর্ণনা ও অলংকারের ছায়ায় নির্মিত; কিন্তু ভারতীয় কাব্যশাস্ত্র তাতে বর্জিত হয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই। পরের দশকে বিহারীলাল এবং আরো পরে দেবেন্দ্রনাথ সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অক্ষয়কুমার বড়াল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কামিনী রায় প্রমুখ বাংলা গীতিকবিতার যে-শক্ত ভিত তৈরি করেন, তাতে মধুসূদনের ব্যর্থ অনুকারীদের ছদ্মমহাকাব্যের ধারার বিলুপ্তি ঘটে বলে তিনি মনে করেন, অন্যদিকে মীর মশাররফ হোসেন বাঙালি মুসলমানদের দোভাষী পুথির জগৎ থেকে উদ্ধার করেন। আনিসুজ্জামানের মতে, বিষাদসিন্ধুর (১৮৮৫-৯০) ঘটনাবলি দোভাষী পুথি-প্রভাবিত হলেও এর মধ্যে সর্বব্যাপী নিয়তি এবং পুরুষের অনিয়ন্ত্রিত নারীলিপ্সা প্রভৃতি অঙ্কনের ক্ষেত্রে মশাররফ মধুসূদন ও বঙ্কিম-রচনা দ্বারা প্রভাবিত।

রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত চতুর্থ অধ্যায়ে আনিসুজ্জামান কবির ওপর বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করে জানান যে, বিহারীলালের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারায় দেখা যায় না। বলাকা কাব্যে ‘পৎবধঃরাব বাড়ষঁঃরড়হ’ সম্পর্কে কবির বক্তব্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন আনিসুজ্জামান। তাঁর ধারণা, এক্ষেত্রে কবি আংশিকভাবে হলেও ফরাসি দার্শনিক হেনরি লুইস র্বাগসন (১৮৫৯-১৯৫১) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পুনশ্চ-এর মুক্তছন্দ বা গদ্যকবিতা প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান মনে করেন যে, কবি এতে ইংরেজি ভৎবব াবৎংব-এর পাশাপাশ ফরাসি creative evolution দ্বারাও প্রভাবিত। নোবেল পুরস্কার পেলেও ইংরেজি গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্যে “বাংলার মরমী কবি” বলে ভুল উপস্থাপন করেছে বলে মত তাঁর। উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিক রোমান্স দিয়ে ভুলপথে যাত্রা শুরু করেছিলেন; পরে বঙ্কিমের ধারায় সামাজিক ইতিহাসের পথে এসে বাংলা উপন্যাসকে উচ্চতর মাত্রায় উন্নীত করেন। কবির প্রবন্ধাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য বিশ্বজনীনতা; এর ভাষা বৈচিত্র্যময়; কেননা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধের ভাষা বিষয়ের উপযুক্ত করে ব্যবহার করেছেন।

পঞ্চম অধ্যায়ে রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলতে গিয়ে বেশ কিছু কৌতূহল-উদ্দীপক মন্তব্য করেছেন আনিসুজ্জামান। মোহিতলাল মজুমদার সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত দ্বারা প্রভাবিত হলেও আনিসুজ্জামানের মতে, তাঁর চিন্তাধারা কবি ওমর খইয়াম ও দার্শনিক শোপেনহাওয়ার দ্বারা বেশি প্রভাবিত। প্রমথ চৌধুরীর চার-ইয়ারি-কথা (১৯১৬) রস ও রূপ বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন। শরৎচন্দ্র শুধু বাঙালির নয়, সারাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের একজন। কাজী নজরুল ইসলাম এমন একজন কবি যিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লিখেছেন; কিন্তু তাঁর রচনা সময়কে অতিক্রম করে সর্বসময়ের  চরিত্র  অর্জন  করেছে।  তাঁর  আর  একটি  বড়  কৃতিত্ব,  যে-গান মুসলমান সমাজে প্রায় নিষিদ্ধ বস্তু ছিল, নজরুলের গান সে-সমাজেই প্রবেশাধিকার ও  জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া নজরুলের হিন্দু ও মুসলিম মিথ বা ঐতিহ্যের ব্যবহার এমন সময়ে হচ্ছিল যখন বাংলায় হিন্দু-মুসলমান  বিভেদ ও দাঙ্গা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে – নজরুল মূল্যায়নে একথা মনে রাখা জরুরি। তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশকে সবচেয়ে প্রভাবশালী মনে করেন আনিসুজ্জামান এবং পরবর্তী কবিরা তাঁকেই মূলত অনুসরণ করেছেন। আবার জীবনানন্দ দাশের ওপর ইউরোপীয় চিত্রকল্পবাদী, প্রতীকবাদী ও পরাবাস্তববাদী প্রভাবের কথাও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ মনে করেন। তাঁর মতে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্প বেশি শিল্পনিপুণ।

দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের মন্তব্য [Salahuddin Ahmed 2004 : 378-79]

Between the two world wars appeared a new trend in Bengali Literature that was marked by realism after the European fashion and, perhaps, latent influence of Marx and Freud. On the one hand, it portrayed the life of the downtrodden – the slum-dwellers, the industrial workers, the daily wage earners, the beggars and the kind, and, on the other, it reflected the sexual desire of man and woman – a subject that was socially forbidden for public discussions. Also noticeable was the tendency to decry or, at least, circumvent Rabindranath and his tradition became the order of the day in Bengali Literature.

এই পর্বের সাহিত্যে তিনি কল্লোল গোষ্ঠী ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আনিসুজ্জামান তাঁর বিবরণে সাহিত্য-সমালোচক ও সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শিশু-কিশোর সাহিত্যকেও তিনি এই আলোচনায় এনেছেন এবং এক্ষেত্রে সুকুমার রায়কে বলেছেন ‘ওস্তাদ’ (master)।

দেশভাগ-পরবর্তী পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের ইতিহাসে আনিসুজ্জামান বিভাগ-পূর্বকালের সাহিত্যিকদের অব্যাহত রচনা ধারার কথা বলেছেন। বিট-কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রভাবে সমীর-মলয় রায়চৌধুরীর হাঙ্গরি জেনারেশন (১৯৬২) পত্রিকার অবদান ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, শিবরাম চক্রবর্তীর হাস্যরসের গল্প, মহাশ্বেতা দেবীর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গল্প-উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসে, তাঁর বিবেচনায়, বিমল মিত্রের উপন্যাসের পরিণতি পাওয়া যায়। রবীন্দ্র-রচনার দার্শনিক ব্যাখ্যায় আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রশংসা করেছেন। কমলকুমার মজুমদারের ভিন্ন ধরনের ভাষা-ব্যবহার এবং নীরেন্দ্রনাথ রায়ের  মার্কসীয়  দৃষ্টিতে  বাংলা  সাহিত্যের  নতুন  ব্যাখ্যার  কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। কলকাতার নাটকে নবতর বিষয় এবং পরীক্ষামূলক রূপ সংযোজনের কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে।

সপ্তম অধ্যায়ে আনিসুজ্জামান বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলা এবং বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। শুরুতেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান-আন্দোলনের সাফল্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতো সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য ক্ষেত্রেও ‘ইসলাম’-এর নামে একটা রমরমা ভাব আনার  প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। কিন্তু তাঁর মতে, মুসলিম-ঐতিহ্য নিয়ে চর্চাকারী সাহিত্যসেবীদের মধ্যে ফররুখ আহমদ ছাড়া আর কেউ কাব্যবিচারে সফল হননি; আর ফররুখ আহমদের বোধ শুধু “পাকিস্তান” ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার সাহিত্য বিকশিত হয়েছিল বরং এর বিপরীত ধারায়, বিশেষত ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনের পরে। আনিসুজ্জামান এই বিপরীত ধারার কুশীলবদের চিহ্নিত করেছেন “সংস্কারমুক্ত মানবতাবাদী” যার নেতৃত্বে ছিলেন “বাম প্রবণতা”র ও “আধুনিকমনস্ক”রা। এ-পর্বে তিনি পাঁচজন কবির উল্লেখ করেছেন – আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক ও সিকান্দার আবু জাফর। তবে অন্য অনেকের মতো আনিসুজ্জামানও মনে করেন যে, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলাদেশের “শিল্পীত কণ্ঠস্বর” কবি শামসুর রাহমান। এর কারণ হিসেবে তিনি কবির ভাষাদক্ষতা, গভীর ভাবনা, মানুষের জন্য আবেগময় ভালোবাসা এবং পরিপার্শ্বের ঘটনা সম্পর্কে সচেতনতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন যে, আল মাহমুদ একদিকে সরে গেছেন আঞ্চলিক শব্দ থেকে ফারসি-আরবি শব্দের দিকে; অন্যদিকে সরে গেছেন তৃণমূলের জীবনভাবনা থেকে আধ্যাত্মিকতার দিকে। আনিসুজ্জামানের মতে, হাসান হাফিজুর রহমান ও শহীদ কাদরীর কবিতার মূলে রয়েছে যুক্তি-আশ্রয়ী বুদ্ধিবাদ।

কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘stream of consciousness technique’ ব্যবহারের জন্য আনিসুজ্জামান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। মার্কসীয় বাতাবরণে পূর্ব বাংলায় উপন্যাস রচনার জন্য শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার ও সত্যেন সেনের কথা বলেছেন; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কৃতিত্ব দিয়েছেন বাংলা ভাষায় “জাদুবাস্তবতা” নিয়ে আসার জন্য। আনিসুজ্জামানের মতে, জহির রায়হান বাংলাদেশে ‘ক্ষুদ্র উপন্যাস’কে পরিচিত করান। প্রথম যুগের নাট্যকারদের মধ্যে মুনীর চৌধুরীকে ঘটনা-কল্পনা, রসঘন সংলাপ এবং সামাজিক-অঙ্গীকারের জন্য স্মরণীয় মনে করেছেন আনিসুজ্জামান। পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশ পর্বেও আনিসুজ্জামান সাহিত্য-গবেষক ও ইতিহাসবেত্তাদের তাঁর আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মুহম্মদ এনামুল হককে অগ্রণী মনে করেন। প্রবন্ধের জগতে রণেশ দাশগুপ্তকে তিনি মার্কসীয় সাহিত্য-সমালোচনায় অগ্রপথিক আখ্যা দিয়েছেন। বিকল্প রীতির প্রবন্ধের জন্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর এবং বিষয়ের বিস্তার, দক্ষ শৈলী ও ধরে রাখার মতো ভাষায় সামাজিক বিষয়কে সাহিত্যের সঙ্গে যুগলমিলনে প্রকাশ করার ক্ষমতার জন্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রশংসা করেছেন।

ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলা সহিত্যের প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস বলতে গিয়েও আনিসুজ্জামান একেবারে সাম্প্রতিকদেরও স্থান দিতে কুণ্ঠিত হননি। ২০০২ সালে লেখা এই ইতিবৃত্তে কবিতায় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মানুষের প্রতি সঞ্জীবিত অনুরাগ, হুমায়ূন আহমেদের হাতে বাংলা উপন্যাসের নতুন ধরন তৈরি এবং তসলিমা নাসরীনের সংবাদপত্র কলামের পাঠকপ্রিয়তার উল্লেখ করেছেন।

চর্যাপদ থেকে শুরু করে রুদ্র-তসলিমা পর্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এই ইতিবৃত্ত বর্ণনায় আনিসুজ্জামান তাঁর বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের সকল উল্লেখযোগ্য লেখকদের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা উপস্থাপন করেছেন। বর্তমান আলোচনায় আমরা শুধু তাঁর ব্যতিক্রমী কৌতূহল-উদ্দীপক ভাবনা বা বিশেষ উল্লেখযোগ্য মন্তব্যগুলোই উপস্থাপন করেছি। তাতে যাঁদের কথা এ-উপস্থাপনায় বলা হলো, তাঁদের সমপর্যায়ের বা তাঁদের চেয়ে উঁচুদরের সাহিত্যসেবীরা অনুল্লেখিত হতে পারেন; কিন্তু আনিসুজ্জামানের ইতিবৃত্তে তাঁদের সকলেই উল্লেখিত।

গ্রন্থপঞ্জি

আনিসুজ্জামান : ১৯৭১ (১৯৬৪)

মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, কলকাতা : মুক্তধারা।  

১৯৮৪

পুরোনো বাংলা গদ্য, ঢাকা : বাংলা একাডেমি।

২০০৮ক (১৯৮৭)

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ঢাকা : বাংলা একাডেমি।

২০০৮খ

পূর্বোক্ত, দ্বিতীয় খণ্ড।

২০১৮

শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, ঢাকা : কথাপ্রকাশ।

দীনেশচন্দ্র সেন :

১৯৯১ (১৮৯৬)

বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।

মুহম্মদ আবদুল হাই

(সন) ১৩৭১

ভাষা ও সাহিত্য সন্ধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। Salahuddin Ahmed (et.cl) 2008.