এলেম নতুন দেশে

‘এলেম নতুন দেশে/ তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে/’

… নতুন দেশে আসাই বটে। ‘স্ট্যাচু অব লিবার্র্টি’র সেই হাতে মশাল ধরা শুভ্রা নারীমূর্তি হাতছানি দিয়ে দূরাগত পৃথিবীর সবাইকে ডাকে : ‘এসো। ইন গড উই ট্রাস্ট লেখা কাগজটিকে তোমরা প্রত্যেকেই খুব ভালোবাসো না? তবে এসো!’

হ্যাঁ, সেই ডাকেই বিমানে উঠে বসেছিল তুষার শুভ্র অধিকারী। দীর্ঘ উড়ানযাত্রায় বিমানের জানালা থেকে দেখা যায় নিচে নীল অতলান্তিকের বিপুলা জলরাশি। হাতে মশাল ধরা সেই নারী প্রতিমার সামনে গিয়ে পড়লেই কি দেখা যাবে বিজ্ঞান বইয়ে আপেল গাছের নিচে বসে থাকা নিউটনের ছবির মতো ডলারের গাছ? তারা কি ঝরঝর করে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের অভিঘাতে পড়বে তুষার শুভ্র অধিকারীর মাথায়? আর কিছু না হোক,  মেজদিদির দড়িতে ঝুলন্ত লাশটিকে যদি পুনরুজ্জীবিত করা যেত! বোকা মেয়ে – না, যে-বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানুষ মরে অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে – সেসব কিছুই না। মেজদিদি গলায় দড়ি দিয়েছিল গান শিখতে না পারায় বা বাসায় গানের শিক্ষক রাখার খরচ জোগাতে বাবার ক্রমাগত ব্যর্থতায়। ওহ্ – সে কত লম্বা কাহিনি! গান যে খুব ভালোবাসতো তার মেজদিদি! কিন্তু বাবারই বা কী করার ছিল? তারা চারটা ভাই আর দুটো বোনের (বড়দিদির শুধু ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছিল) পড়াশোনার খরচ, ঘরে-বাইরে দুটো দুটো চারটা জামা আর সরকারি বাংলা স্কুলের অত কম-বেতনেও খাতা-কলম-পেনসিল-জ্যামিতি বক্স-স্কুল ড্রেসের খরচ জোগানোই কি কম? তিন দাদার পর বড় আর মেজদিদি। তারপর সে এবং সবার শেষে ছোট বোনটা।

অথচ বেঁচে থাকার মতো কিছুই কি ছিল না মেজদিদির? তার মেজদিদি – বীণাপাণি অধিকারী। না, বীণাপাণিকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মরতে হয়নি। অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা বা নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হওয়ার অপরাধেও নয়। সে ম্যাট্রিকে দুটো লেটারসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। উজ্জ¦ল শ্যাম বীণার একমাথা কোঁকড়া চুলে দেখাতো ভারি মিষ্টি। তার পছন্দের ছেলে অসিতদা বলেছিল যে, চাকরি পেলেই দিদিকে বিয়ে করে সবার আগে ভালো গানের টিচার রাখবে, দামি হারমোনিয়াম কিনে দেবে।

‘আমার বাঁচতি ইচ্ছা করে না।’

‘কেন? ম্যাট্রিকে দুটো লেটার নিয়ি ফার্স্ট ডিভিশন পায়িছো –

দেখতি-শুনতি ভালো। আমার অনার্স চলছে। তোমার ইন্টারমিডিয়েট। আর একটা বছর – আমাকে তো চাকরির জন্য একটা ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি থেকে সাধতিছে। বাবা বলে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাতি হলি কোনো চাকরি করা চলবে না। একটু ধৈর্য ধরো, লক্ষ্মী সোনা! আমার তো অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস আছে। ফার্স্ট ক্লাস বলিই কোম্পানি থেকে সাধতিছে। কিন্তু বাবা যে রাজি না?’

‘সবার সব হবি – শুধু আমার গান হবি না -’

বীণাপাণি তার লম্বাটে আঙুলগুলি দিয়ে দুই চোখের অসংখ্য মুক্তোদানার মতো গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটা মুছে বলেছিল, ‘পরপর তিন বছর স্কুলে গানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কিন্তু চারটা বছর হয় কারো কাছে শিকতি পারি না – ঘরে প্রতি মাসে পাঁচ-ছয়বার অতিথি খাওয়াতি বাবার টাকা যায় না – আমার আর টুনটুনির গানের মাস্টারের জন্য মাসে একশ টাকা দিলিই কি বাবার টাকা ফুরোবে? ঠিকই গতবার আর এবার ওই আরজুই জিতলো। সে বড় উকিলের মেইয়ে। দুজন ক্লাসিক্যাল, একজন নজরুল আর একজন উচ্চাঙ্গ সংগীতের টিচার আছে তার!’

অনেকটাই পথের পাঁচালীর অপুর মতো শুভ্র দেখে ফেলেছিল তার বোন বীণাপাণি ওরফে বুলবুলির মৃত্যুর কয়েক বিকেল আগের ছবিটি।

‘ড্যাড!’ ড্রয়িংরুমের পর্দা ঠেলে এসে দাঁড়ায় মেয়ে ত্রপা। ত্রপা ডাকনাম। মার্কিনিরা ‘বাংলা’ নাম ভালো উচ্চারণ করতে পারে না বলে তাকে মার্কিনিদের উচ্চারণে সহজে ডাকা যায় এমন একটি নাম দেওয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজে তার নাম ‘টিউলিপ অধিকারী’।

যে-ভয় পাচ্ছিল শুভ্র, তার দুহিতা টিউলিপ সেই কথাই ব্যক্ত করে এবং জানায়, আজ ছুটির দিনটা সে বাংলা গানের ক্লাসে যেতে পারবে না।

‘বাট ক্যান আই নো হোয়াই? ইউ নো মাই ফাদার হ্যাড নট ইভেন সাফিশিয়েন্ট মানি টু পে ফর মাই এল্ডার সিস্টার্স মিউজিক ক্লাসেস? শি ইউজড টু লাভ মিউজিক উইথ অল হার হার্ট অ্যান্ড সৌল … অ্যান্ড আল্টিমেটলি শি কমিটেড সুইসাইড!’

‘ড্যাড -’

তার ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে বোনের পক্ষে।

‘ইজ ইট নট ফানি ড্যাড দ্যাট ইউ অলওয়েজ টেল দিস সেইম ওল্ড স্টোর অব ইওর এল্ডার সিস্টার্স সুইসাইড টু কমপেল হার? কমপেল হার টু লার্ন সংস ইন সাম ল্যাঙ্গুয়েজ হুইচ উই ডোন ইভেন আন্ডারস্ট্যান্ড! শি লাভস ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ অ্যান্ড স্প্যানিশ সংস – লেট হার লার্ন অ্যান্ড সিং দৌজ!’

ভীত স্ত্রীর ঘামে নেয়ে ওঠা কপাল দেখা যায়। মাত্রই সে রান্না শেষ করেছে।

‘ওরা বাংলা গান শিখতে চায় না। তুমি-আমি কী করবো, বলো?’

‘নাহ্ – আমি কী আর করব? সব পেয়ে এরা বোঝে না। আমার মেজদিদিটা ইন্টারে পড়ার সময় গান শিখতে না পারার দুঃখে আত্মহত্যা করলো।’

‘ওহ – দ্যাট শেইম ওল্ড স্টোরি!’ বিরক্ত ছেলে কাঁধ ঝাঁকায়।

‘মাম – প্লিজ টেল হিম টু স্টপ অল দিজ সেন্টিমেন্টাল ড্রামা! মাম – লেট মি শো!’ তারস্বরে বলে টিউলিপ।

টিউলিপ তার গানের খাতা নিয়ে আসে। বাংলা গানের ক্লাসের সব গান তার খাতায় রোমান হরফে লেখা। বাসায় খানিকটা বাংলা বলতে পারলেও বর্ণমালা শেখা হয়নি ওদের ভাইবোন কারও।

‘মাম – জাস্ট সি – আই থিঙ্ক আই ক্যান্ট ইভেন আটার দিজ ওয়ার্ডস অর ইভেন আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য মিনিং -’

প্রচুর রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুলগীতির বাণী তোলা।

‘মাম – আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিজরেসপেক্ট ইউ অর ড্যাড – অর আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিজৌন মাই কালচার! আই অ্যাম ট্রায়িং টু লাভ দিজ সংস – বাট আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড অ্যানি মিনিং – দৌজ আর অল টু হার্ড! হোয়াট ডাজ ইট মিন?’

Sakhir Hridoy Kusum Komol O/ Kar anadar e Aji Jhore Jai,

উত্তরে বিন্দু খানিকক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে এবং খানিকক্ষণ শুভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেড়ে দাও। মেয়ে ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চ গান ভালোবাসে যখন, সেই গানের ক্লাসেই যখন যেতে চাইছে – তখন সেটাই যেতে দাও। জোর করে কিছু হয় না!’

‘শোন – শোন – বীণা – এত অধৈর্য হয় না! গান গান করি পাগল না হইয়ি -’

‘গানের জন্যি পাগল না হইয়ি কি করব? ওই যে রেবেকা আপাকে বিয়ির পর বর গান বন্ধ করি দেওয়ায় তিন বাচ্চা সামলাতি সামলাতি মাথা এখন

আধ-পাগল, অমনটি হবো?’

‘তুমি একটা বছর পড়ো না – তোমার রেজাল্ট তো ভালো!’

‘আমাকে তোমার উপদেশ দিতি হবে না!’ বলে জেদি বীণাপাণি পুকুরপাড় থেকে উঠে এসে বসেছিল। তার আগে চার বছরের ব্রেকের পর এক মাসের জন্য বাসায় এক সংগীত শিক্ষক আসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে অফিসের মামলাটা – নাহ্, অনেক ছোটবেলায় ছ-ছজন ভাইবোনের সংসার হলেও তেমন অভাব ছিল না। কিছুটা টানাপড়েন থাকতোই, তবু মেজদিদির নয়ে আর ছোটটার পাঁচ বছর বয়সেই বাবা শখ করে বেশ দাম দিয়ে হারমোনিয়াম  আনালেন। শুভ্রর বয়স তখন সাত। ছোট বোন পুষ্পাঞ্জলি বা টুনটুনি সেই বয়সেই খেয়ালের তান গাইতে পারতো বড়দের মতো। মুশকিল হলো, শুভ্রর বয়স যখন দশ আর মেজদিদির বারো এবং টুনটুনির আট, তখন একদিন – দাদারা সব ঢাকায় পড়াশোনায় ব্যস্ত – এক সকালে বাবার অফিসের লোকরাই সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসার নিয়ে এসে তাদেরই কোয়ার্টারের দুটো রুমে জোরে ধাক্কা দিয়ে তালা লাগিয়ে তাদের পাশের দু-রুমে থাকতে বললো। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা সবাই হতভম্ব।

‘আপনি শ্রী কিশোর কুমার অধিকারী – আপনি কি ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলনে জড়িত?’

‘কী বলছেন আপনারা? এতদিন ধরে দেখছেন – আপনারা কি আমাকে চেনেন না?’

‘তিনদিন আগে বিনয় কুমার ভদ্র নামে যে এক চির অকৃতদার মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে আপনাকে রূপসা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় হাওয়া খেতে দেখা গেছে, আজ তো তাঁর নাম সব দৈনিকে এসেছে।’

‘কেন? বিনয় বহুদিন হয় কলকাতা প্রবাসী। সে প্রায় কুড়ি বছর পর খুলনা এসে আমাকে ফোন দিয়িচিল। তাই দেখা করিচি। পার্টিশনে ওদের ফ্যামিলির অনেক ওলটপালট হয়ি হতভাগাটা সারা জীবনে আর বিয়িই করতি পারলো না। তাই ওকে বলিচিলাম যে কষ্ট হলিও দেশে থাকো।’

‘আর দেশপ্রেমের দরকার নেই। আজকের পেপার এখনো দেইখি না থাকলি এই যে -।’

পুলিশ কর্মকর্তা সেদিনের একটি দৈনিক মেলে ধরেন।

‘আপনাকে আমরা সবাই ভালো সরকারি কর্মকর্তা বলেই জানতাম। এখানে প্রধান শিরোনামে কী আছে চোখ বোলান!’

স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের পরিকল্পনা ফাঁস

১৪/০২/১৯৮৫।

একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কিছু অদেশপ্রেমিক, দূরভিসন্ধি বিশিষ্ট মানুষ প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় বৃহত্তর

খুলনা-যশোর-মাগুরা-নড়াইল-ফরিদপুর ও বরিশালের সংখ্যালঘু প্রধান এলাকাগুলোয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলছে বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে।

এদেরই একজন ‘নেতা’ যিনি পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেশছাড়া হয়েছিলেন, বহু বছর পর দেশে ফিরে এসে নিজ জন্মশহরের বিশিষ্ট সব সংখ্যালঘু সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় আছেন বলে খবরে প্রকাশ।

সংবাদের প্রথম প্যারার নিচে তিনদিন আগে রূপসা ব্রিজে বাবা আর বিনয় কাকুর সঙ্গে ফ্রক পরা হাসিমুখ টুনটুনির ছবিও এসেছে। শুভ্রকে না নিয়ে টুনটুনিকে বাবা সেদিন হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়ায় শুভ্রর সেই রাতে খুব রাগ উঠেছিল।

‘এটি একটি সাম্প্রদায়িক পত্রিকা সবাই জানে। আর বিনয় কী করতে এসেছে আমি জানি না। তবে সে আমার বাল্যবন্ধু – কিন্তু আমার সঙ্গে সেই সন্ধ্যায় সাধারণ কথাবার্তাই হয়েছে। আমি একজন সরকারি কর্মচারী। আমি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে থাকতেই পারি না।’

‘এই পত্রিকা সাম্প্রদায়িক আর আপনি বুঝি খুব অসাম্প্রদায়িক?’

ঠিক এ-সময়েই বাবার এক অধস্তন কর্মকর্তা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ‘স্যার’ সম্বোধন করেই খুব নিরুত্তেজিত গলায় বললেন, ‘স্যার – যেভাবেই হোক, একটি অভিযোগ যখন এসেই গেছে, আপনি এখন আমাদের অফিসের বিভাগীয় তদন্তের আওতাধীন। আপনার বন্ধু বিনয় ভদ্রের জিনিসপত্র তল্লাশি করে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলনের প্রচুর প্রচারপত্রসহ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক পুস্তিকা পাওয়া গেছে। এমন রিস্কি মানুষের সঙ্গে সরলভাবেও যদি আপনি দেখা করে থাকেন, তবু আপনার সমস্যায় পড়ে যেতে হলো আর কী!’

‘এসব আপনি কী বলছেন নাজিম উদ্দিন সাহেব? আপনারা আমাকে চেনেন না?’

‘স্যার, আপনার চাকরি এখনি যাবে না, তবে মাসিক বেতন হয়তো পঞ্চাশ শতাংশে নেমে আসবে। এসব ভেবেই আপনার কোয়ার্টারের দুটো রুমে তালা দেওয়া হলো। তবে জিনিসপত্র এখনি কিছু সরিয়ে নিতে পারেন। আমরা স্যরি, স্যার! তবে যতদিন তদন্ত চলবে – আপনি চাইলে এর অ্যাগেইনস্টে মামলাও করতে পারেন। যতদিন মামলায় আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ইতিবাচক বা নেতিবাচক একটি নিষ্পত্তি হয়, ততদিন এমনটাই চলবে।’

সেই শুরু হলো অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ। চার রুমের হাত-পা ছড়ানো কোয়ার্টার ছেড়ে দু-রুমের কোয়ার্টারে এসে ওঠা। ঘরে সবারই প্রায় দুধ-ডিম বন্ধ হয়ে গেলেও মেজদিদি আর শুভ্রর ‘খারাপ খাবার’ খেতে না পারায় প্রতিমাসেই বাবার ধার-দেনা করে হলেও ওদের দুজনের জন্য দুধ-ডিম-ছানা-পেঁপে-খাসির কলিজা কেনা। ছোট্ট টুনটুনিটাই বরং খুব বুঝদার ছিল। কাঁচকলা সেদ্ধ দিয়েও চুপ করে ভাত খেত। মাতৃত্ব নিয়ে যে বড় সব কথা বলা হয় তা যে সত্য নয় তার প্রমাণ হচ্ছে মেজদিদির অবুঝপনা সত্ত্বেও মা সবসময় চেষ্টা করত তাকেই দুধটা-ডিমটা যেন দেওয়া যায়। টুনটুনির কোনো বায়না নেই বলে সে কাঁচকলা সেদ্ধর পর বাড়তে থাকার বয়সটায় একটু করলাভাজি বেশি চাইলেও মা খুব বিশ্রী ধমক দেয়। সবটাই সেই ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ তত্ত্ব। টুনটুনিটা তাই মাথায় বাড়লো না। দশ বছর বয়সের পর আর লম্বাই হলো না। সে আর মেজদিদি কিন্তু মোটামুটি ‘পহেলা দর্শনধারী’ হওয়ার মতো লম্বা হলো। অথচ শুরুতে টুনটুনিই কি না ভাইবোনদের ভেতর মাথায় সবচেয়ে ধাই ধাই করে বাড়ছিল। শুভ্র বা বড়দির স্কুলে সব সাবজেক্টের সঙ্গেই হোমওয়ার্ক ও ক্লাসওয়ার্কের খাতা আছে। ভীরু আর বুঝদার টুনটুনি একটি একটি দুটো নিউজপ্রিন্টের খাতায় চলেছে। ক্লাসে গিয়ে মিথ্যে করে বলতো নির্দিষ্ট সাবজেক্টের খাতা আনতে ভুলে গেছে। এ-কথা বহু বহু দিন পর আর হেসে-কেঁদে টুনটুনি তার কাছে স্বীকার করেছে যখন সে অনার্সে প্রথম দু-হাজার টাকার পার্টটাইম জবে বেতন পেয়ে একসঙ্গে তিনটা নতুন জামা বানিয়ে আবারো মায়ের বকা শুনেছিল। শুভ্র আর মেজদিদির সায়েন্সের চারটা সাবজেক্টেই টিচার লাগবে। টুনটুনি বাবার টাকা বাঁচাতে আর্টস নিল – সেইসঙ্গে অঙ্কেও সে খুব ভালো ছিল না। এই করতে করতে বছর চারেক পর বাবার বিরুদ্ধে আনা মামলা একশ ভাগ মিথ্যে প্রমাণিত হলো, চার বছর অর্ধেক করে পাওয়া বেতন সব আবার হাতে এলো ঠিকই, কিন্তু গত কয়েক বছরের বিপুল দেনা? এছাড়া বাবা তখন রিটায়ারমেন্টে চলে যাচ্ছেন। ভাগ্যিস বড় দুই দাদা তখন বিদেশ গিয়ে থিতু হচ্ছে আর ছোটদেরও দেখা শুরু করেছে। তবু গত কয়েক বছরের দেনা? আর এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ষোড়শী মেজদির গান শিখতে না পারার আক্ষেপ। এত অভাবের ভেতরেও বাবার পাগলাটে প্রকৃতির অতিথিপরায়ণতায় চূড়ান্ত অমিতব্যয়িতাও ছিল। অথচ টুনটুনি একটি নিউজপ্রিন্টের খাতা নিয়ে ক্লাসে যেত-আসত। বুঝদার টুনটুনি অবশ্য … সেটা মেজদির মৃত্যুর পর … আর্টস বিভাগেই স্কুলের পরীক্ষায় সাতশোর বেশি নম্বর আসায় টিচাররা বলেছিল যে, বোর্ডে স্ট্যান্ড করা তার জন্য কোনো বিষয়ই নয়। শুধু অঙ্ক আর ইংরেজিতে গৃহশিক্ষক লাগবে। টুনটুনি সেটাও নিজেই বাতিল করে দিলো। দরকার নেই। সে নিজেই পড়বে। তাতে ফার্স্ট ডিভিশন বা লেটার হলেও স্ট্যান্ড আর হয়নি। টুনটুনি কি সেই বয়সেই বড়দাদাদের দায়িত্ব বাড়াতে চায়নি? কিন্তু মেজদিদির জেদ যদি একটু কম হতো!

‘মানুষের বাড়ির মেয়েরা তো দেখি আজ এ-বাড়ি কাল ও-বাড়ি গিয়েও গান শেখে’ – মা বলতে এলেই মেজদি ঝাঁঝিয়ে উঠতো, ‘অনেক শুনিচি এক লেকচার। কত দিন একটা নতুন স্বরলিপি পাই না, নতুন গান পাই না! এক স্বরলিপি, এক গান কত আর করা যায়?’

বুলবুলি টুনটুনি বা বীণাপাণি পুষ্পাঞ্জলির সংগীত শিক্ষক শেষবারের মতো এসে বলেছিলেন, ‘আপনার মেজো মেয়ে নজরুলগীতিতে বেশি ভালো করবে। আর ছোট মেয়েটা – ও তো প্রতিটা শব্দ ওর প্রাণ থেকে গায়। আর তো আসা হবে না মা – আপনার ছোট মেয়েটাকে একবার ডাকেন তো?’

টুনটুনি এসেছিল – বরাবরের মতো কুণ্ঠিত, লাজুক ও ত্রস্ত পায়ে। বীণাপাণির মতো দীর্ঘকায়া, সারা পৃথিবীকে জানান দেওয়া জেদে নয়, সে যেন আশপাশের প্রতিটি মানুষের ধাক্কায় আর প্রতিটি মানুষের কনুইয়ের গুঁতোয় আরো সরে যেতে যেতে পুরনো, একঘেয়ে হয়ে আসা স্বরলিপি ও গানের বাণীতেই বাঁচতে চেষ্টা করতো,

‘পরানের সাজি সাজাই আপন ফুলে,

জানি না কখন নিজে বেছে নাও তুলে।

অলখ আলোকে-প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে।

বেঁচে থাকো, টুনটুনি! আপনার ছোট মেয়েটা যখন গানে বসে, ওর পাশে আগুন লাগলেও ও টের পাবে না। ও বাঁচবে কি না জানি না – তবে ওকে আপনি একটু দেখবেন! আপনাদের ঘরে প্রতিমাসেই তো প্রচুর অতিথিও আসে।’

মা মাথায় ঘোমটা টেনে বলেন, ‘ওদের বাবার ওই এক নেশা। নিজের ছেলেমেইয়ের খাবারের ঠিক নাই,

স্কুল-কলেজের খাতা কিনতি টানাটানি অথচ ওনার অতিথিপরায়ণতা – আর তার ওপর শত্রুতা তো ছিলই। সেই তো মামলায় কিছু প্রমাণ হলোই না অথচ আমাদের কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল -’

‘আসলে আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে প্রফেশনাল জেলাসি থেকেই বোধহয় এই শত্রুতা করা হয়েছে। আসি মা – টুনটুনি – বিরক্ত লাগলেও পুরনো লেসনগুলিই করো – বুলবুলি – আসি?’

না – পৃথিবীতে কারো কাছে কিছুতে হারতে চাওয়া মেয়ে বীণাপাণি অধিকারী ওরফে বুলবুলি শহরের নামী অ্যাডভোকেট রেজাউল কাইয়ুমের মেয়ে আরজু কাইয়ুমের কাছে ইন্টারের দুই বছরে পরপর দুবার গানে চ্যাম্পিয়ন বা এমনকি রানার্সআপও না হয়ে তৃতীয় হওয়ার দুঃখ নিতে পারেনি। সেটুকু পরাজয়ও তার কাছে পাহাড়ের মতো ভারী মনে হয়েছিল। কতই বা বয়স ছিল মেজদিদির? মাত্র সতেরো! ইন্টার দেবে দেবে।

‘তুমি না হয় পুরানো লেসনই কি একটু বেশি বেশি করি দেখতা, মা?’

মায়ের মুখের ওপর ঝাঁজিয়ে উঠেছিল বীণাপাণি, ‘আরজুর ক্ল্যাসিক্যালে এক টিচার, নজরুলে একজন, তবলায় একজন। আমি কতদিন কাউকে পাই না। এভাবে হয়?’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তবে মৃত্যুর আগের দিন কেন যেন বীণাপাণি অনেকক্ষণ গান করেছিল। তারপর রাতে সে শান্তমতো ভাত খেয়েছিল। পরদিন সকালে টুনটুনির ভয়ার্ত চেঁচামেচিতে তাদের সবার ঘুম ভাঙে, ‘মা – মেজদি আর নাই! ওমা -’

বড্ড বোকা মেয়ে বীণাপাণি আত্মহত্যার চিঠিতে লিখেছিল যে, গান শিখতে ও গাইতে না পারলে এই জীবনটাই তার বৃথা। ভালো রেজাল্ট বা ভালো বিয়েতেও সে যে আসলে অন্তত একজন ভালো শিক্ষকের কাছে মাসে মাত্র একশ টাকা বেতনে গান শিখতে পারছে না, তার গলা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নতুন লেসনের অভাবে – এটা সে আর মানতে পারছে না। বাবার ওপর অভিমান ছত্রে ছত্রে ঝরেছিল সেই চিঠিতে। আসলে ওই বয়সটাই অমন। ছোট পিসির ছোট মেয়ে ঝুমা – তার শৈশব থেকেই একটু বুদ্ধি কম – মাথায় পাঁচ তিন লম্বা; কিন্তু ক্লাস ফোরের দেয়ালও টপকাতে পারেনি। যদিও ছোট পিসির বরের প্রচুর জমিজমা ও ভালো অবস্থা। পিসির বড় মেয়েগুলি নানা কূট-কচালি, পড়াশোনা আর প্রেম-বিয়েতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ঝুমার আঠারো হলেও সে নিজের মতো পিসের বিশাল বাড়ির এক কোণে হাঁস-মুরগি নিয়ে অমলিন আনন্দে একা একা দিন কাটাতো। এমন না যে ঝুমা বোবা বা কথা বলতে পারতো না। তবে ওর মানসিক বয়স সাত-আটের বেশি বাড়েনি। শরীর বাড়লেও সবার কথায় সে শিশুর মতো হাসতো আর ওই এক হাঁস-মুরগি নিয়ে থাকতো। লেখাপড়া না করা মেয়ের কম বয়সে তবু যদি একটি বিয়ে দেওয়া যায় – এই আশায় পিসি একদিন মেয়েকে খুব বকে, নীল শাড়ি পরিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে পাঠালেন। ঝুমা তাদের কাছে নতুন হাঁস কেনার টাকা চেয়ে বসলো আর বললো যে, বাসায় তাকে নতুন হাঁস কেনার টাকা দেওয়া হচ্ছে না। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া পাত্রপক্ষ মিষ্টি খেতে খেতেই, কোনোমতে হাসি থামিয়ে উঠে গেল এবং ‘যত সুন্দরী হোক, পাগল মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা’র অভিযোগে পাত্রীপক্ষের নামে তল্লাটে বদনাম ছড়ালো। পিসি খুব বকলো এক সন্ধ্যায় ঝুমাকে। ঝুমা ‘বিয়ে ভেঙে যাওয়া’র কিছুই না বুঝে উল্টো তাকে নতুন হাঁস কেনার টাকা না দেওয়ায় খুব কান্নাকাটি করলো। এতে পিসি আরো ক্ষেপে গিয়ে আরো বকাঝকা করেছিল। কীভাবে কীভাবে বুদ্ধিহীন মেয়েটি সে-রাতেই ইঁদুর মারার বিষ ঠিকই খেয়েছিল। এমনটাই এই বয়স। মানুষ গান শিখতে না পারার দুঃখে গলায় দড়ি দেয়, নতুন হাঁস কেনার টাকা না পেয়ে গলায় দড়ি দেয়। ঝুমার সঙ্গে শুভ্র কত খেলেছে ছোটবেলায়! শুভ্র বড় হলো, তার বয়স আঠারো পার হয়েছে সেই কবে অথচ ঝুমার বয়স থেমে থাকলো সেই আঠারোতেই। আজ শুভ্রর নিজের মেয়ের বয়সই আঠারো। আচ্ছা – টিউলিপকেও কি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বললে ও যদি জেদ করে ভয়ানক কিছু করে বসে?

‘ওকে – টিউলিপ – ইফ ইউ রিয়েলি ডোন্ট এনজয় অর ক্যান্ট রিলেট টু বেঙ্গলি সংস দেন ইউ ক্যান লার্ন ইংলিশ অর ফ্রেঞ্চ সংস। আই ওন্ট ফোর্স ইউ অ্যানি মোর।’

একটা দীর্ঘশ^াস পড়ে শুভ্রর। মানুষ একবার যে ভূখণ্ড আর যে মানুষদের ছেড়ে যায়, তাদের কাছে বোধ করি আর কখনো ফিরতে পারে না। কখনো কখনো দেশে গেলেও সে যেন অতিথির মতো যাওয়া। খুব তো ভেবেছিল শুভ্র যে, নিউটনের মাথায় যেমন আপেল এসে পড়েছিল,  ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র দেশে তোমার মাথায়ও আলোকের ঝরনাধারার মতো ঝরে পড়বে ডলার আর সেই ডলার দিয়ে একটি বিশাল টাইম মেশিন বানিয়ে তুমি চলে যাবে জেদি মেজদিদির কাছে : ‘এই নে – তোর আগামী দশ বছরের গান শেখার টাকা – তিনটা-চারটা করে টিচার রাখ, স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম, তানপুরা – যা যা লাগে কিনে নে।’ তারপর টাইম মেশিনে ঝুমার কাছে গিয়ে বলবে, ‘তুই আর বড় হলি না, না? তোকে একশটা হাঁস কিনে দিচ্ছি, গাধা!’ আর সবশেষে চির বুঝদার ও আশৈশব অভিযোগহীন টুনটুনি বা পুষ্পাঞ্জলিকে বলবে, ‘তুই সবার ছোট হয়েও কখনো দুধ-ডিম-সব সাবজেক্টের জন্য আলাদা খাতা কিচ্ছু চাসনি। গান না শেখার দুঃখ তো তোরও ছিল। টিচার ছাড়াই ম্যাট্রিক-ইন্টার দিলি। রবীন্দ্রসংগীত তো তোর প্রিয়, না? এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো কে শেখায় রবীন্দ্রসংগীত?’

না – কাউকেই কিছু বলা হলো না তো। মেজদিদি আর ঝুমা আগেই পাট চুকিয়েছে। চির কনুইয়ের গুঁতোয় একপাশে সরতে থাকা টুনটুনির বিয়ের কিছুদিন পরই এক রোড অ্যাকসিডেন্টে বর আর গর্ভের সন্তান – দুজনেই গেছে। চাইলে আবার বিয়ে করতে পারতো। ও বোধ করি চায়ও না। বড়দিদির সংসারে থাকে। কিছুদিন চাকরি করে। বেশ বড় বড় চাকরি পায়। কনুইয়ের গুঁতোয় অস্থির হয়ে মাঝে মাঝে জায়গা ছেড়ে দেয়। আর চাকরির টাকাতেই ভেতরে বহুদিনের ঠান্ডার সমস্যা সেরে উঠে গান শেখে। মাঝে মাঝে ই-মেইলে বা ফেসবুকে ওর গানের লিঙ্ক পাঠালেও স্ত্রী-কন্যা-পুত্র নিয়ে ব্যস্ত শুভ্রর বুঝি সেসব শোনারও সময় হয়েছে? বয়স অনেক হয়েছে না টুনটুনির? আর কি পারবে?

Je n’ai pas voulu t’en 

                         parler

les écrans de fumée m’ont jamais trompée

দুই ভাইবোন মিলে দরজা আটকে জোর ফরাসি গান শুনছে, যা তেমন কিছুই বোঝে না শুভ্র। এই তো সেদিন জন্মালো ছেলেমেয়ে দুটো। যমজ ভাইবোন। দুজনই সতেরো পার হয়ে আঠারোতে পড়বে সামনে।

স্মার্টফোনে একটি মেসেজ আসে। টুনটুনির মেসেজ। শুভ্রর ধারণা হয়েছিল শৈশবের সেই ধারালো অথচ মসৃণ গলা বোধ করি আজ আর নেই টুনটুনির। তেমন ভেবেই ওর কোনো গানই শোনা হয়নি। একটা বয়সের পর পুরুষ মানুষ নিজের বোনের গান আর শোনেই বা কই? বরং পাবে গিয়ে কলগার্লদের পেছনে হলেও পয়সা খরচ করে। আজ তবু হতাশ ও আত্মজ-আত্মজার কাছে খানিকটা পরাজিত শুভ্র টুনটুনির মেসেজ খুললো। প্রথম লিঙ্কটি ক্লিক করতেই ওর একক গান :

এই যে তোমার প্রেম ওগো, হৃদয়হরণ!

আহ্ – আবার তো সেই শৈশবের মায়াবী গলা ফিরে পেয়েছে টুনটুনি? দেশ থেকে বড়দি জানায় যে, চাকরির পর বাকি সময়টা টুনটুনি শুধু রেওয়াজই করে।

‘ও আর বিয়ে করবে না?’

‘করতে চায় না তো! মনে হয় গানেই সময় দিতে চায়।’

‘এই বয়সে গানে সময় দিয়ে কী করবে?’

শুভ্রর সব ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে টুনটুনির গলা দেখা গেল আগের চেয়েও আরো ধারালো ও মায়াবী হয়েছে। অস্থির শুভ্র দেশে ফোন দিলো :

‘তোর গানগুলি আগে দেখি নাই। আবার কতদিন নতুন করে শিখছিস?’

‘কম না। তাও প্রায় দশ বছর হয়ে এলো। দ্বিতীয় গানটা শুনেছো, ছোটদা?’

‘কোন গান?’

‘লিঙ্ক খুলেই দ্যাখো।

‘তুই কোনো সাহায্য না পেয়ে আবার নিজের চেষ্টায় গান করছিস আর আমার মেয়ের পেছনে আমি এত এত ডলার খরচ করলাম।’
‘ছোটদা Ñ টিউলিপের গান আমি শুনেছি। ওর গলা খুবই ভালো। কিন্তু ও যে আমাদের ভাষাটাই বোঝে না। রবীন্দ্র, নজরুল কি পঞ্চকবির গান ভাষা বুঝেই সব বোঝা যায় না। আর ছোটবেলা থেকে বাইরে মানুষ বাচ্চারা রোমানে লেখা বাংলা পড়ে কি বুঝবে? আবেগ আসবে তাদের? আবেগ না এলে, গলা যত ভালো হোক, গান তো হবে না।’
‘তবে?’
‘দুঃখ করো না। দ্যাখো Ñ ওর ‘এরিয়া অফ ইন্টারেস্ট’ কি?’
‘হুম Ñ ঠিক আছে। রাখলাম।’
আরে Ñ বড়দিদির মেয়েও দেখি বাংলায় গান গাইছে তার ছোট মাসির সঙ্গে। বাংলা ভাষার সেই সব অনির্বচনীয় শব্দরাজি যা পুষ্পাঞ্জলি বা বড়দিদির মেয়ে সায়ন্তিকা এখনো ধরে রেখেছে Ñ বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে ওরা
হর্ষিত-বিমর্ষ হয়ে উঠছে। হাসছে বা কান্নায় আর্ত রূপ ফুটে উঠছে ওদের চোখে-মুখে। কিন্তু টিউলিপের কাছে তো বাংলা গানের কোনো অর্থ নেই। বড়দিদির মেয়ের সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলির ততটাই পার্থক্য, যতটা পুষ্পাঞ্জলির তার নিজের বড়দিদির সঙ্গেও আছে। দেখলো ওদের দুজনকে মাসি-ভাগ্নির বদলে বড় বোন-ছোট বোনের মতো লাগছে। তবে দুজনে মিলে এক ফেলে আসা ভূখ-ের ততোধিক পরিত্যক্ত ভাষার সংগীত গাইতে থাকে হৃদয়ের সব আবেগ উজাড় করে :
অচিন মনের ভাষা শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা,
বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের ডাল,
বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল
নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে।
এলেম নতুন দেশে।