অন্য ভুবন

লাল আর ময়ূরকণ্ঠী রং-মেশানো বিরল বৈশিষ্ট্যের মোরগটার প্রতি এই তিন-চারদিনে দুর্নিবার এক আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে রোহানের। অফিসে বা ঘরে যেখানেই থাক, তার মন পড়ে থাকে বাড়ির চিলেকোঠায় মোরগটার কাছে। এই প্রাণীটার সূত্র ধরেই তার জীবনে অভাবনীয় এক পরিবর্তন আসবে, বৃহস্পতিবার বিকেল  থেকে মনে এমন একটা স্বপ্ন ও বোধ অঙ্কুরিত হয়েছে। সন্ধের চা শেষ করে সে অনেকটা উত্তেজনা আর অধীরতা নিয়ে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিল, স্ত্রীর সঙ্গে ব্যাপারটি মোটেই শেয়ার করার নয়। সিরিয়াল দেখার উদ্দেশ্যে সঞ্চিতা টিভির সামনে থিতু হয়ে বসলে রোহান ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলার ছাদে চলে যায়। সিঁড়ির সঙ্গেই চিলেকোঠায় পরিত্যক্ত আসবাব, কার্টন, রঙের কৌটা, তেলের খালি ড্রাম প্রভৃতি দিয়ে ঠাসা স্টোররুমের মতো টিন-ছাওয়া ছোট্ট একটা ঘর। চুরি যাওয়ার মতো তেমন কোনো মূল্যবান জিনিস নেই বলে ঘরটাতে তালা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি এতদিন। তবে লাল মোরগটা আনার পর থেকে রোহান দশ ফুট বাই দশ ফুটের এই কক্ষে রাতে একটা নতুন চকচকে তালা লাগিয়ে রাখে।

ছাদে মৃদুমন্দ বাতাস, টবের দুটো বেলি ফুলের গাছ থেকে মিষ্টি সুবাস আসছে। আকাশের উত্তর-পুব কোনায় ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে আধখানা চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করেছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে টিনের চালের নিচে খাঁচার ভেতরকার মোরগটা দুবার অনুচ্চ স্বরে ‘কক্ কক্’ করে ওঠে। পঁচিশ ওয়াটের বাল্বটার সুইচ অন করে রোহান খেয়াল করে মোরগটা যেন অস্থির হয়ে আছে। আড়াই হাত দৈর্ঘ্য আর দেড় হাত প্রস্থের খাঁচাটার ভেতর বিক্ষিপ্ত পায়চারি করছে। বন্দি করে রাখায় সে কি বিরক্ত? মুক্তি চাইছে? অভিশাপ দিচ্ছে আটককারীকে? কিন্তু খাঁচার বাইরে থাকাটা আপাতত ওর জন্যও তো নিরাপদ নয়। একা-একা কোথায় চলে যাবে, হয়তো বনবেড়াল কিংবা শেয়ালের খপ্পরে পড়বে। সেসব বাদ দিলেও মানুষেরই বা ভরসা কী, বাগে পেলে জবাই দিয়ে দিব্যি একটা ভোজসভা সেরে ফেলতে পারে। অন্যের মোরগ ধরে পিকনিক করা একসময় এদিককার অনেক তরুণের অভ্যাস ছিল। আচ্ছা দেখা যাক কটা দিন, তারপর বিকল্প ভাবা যাবে। একটু একটু করে ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে মোরগটা মোরগটা বাইরের প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলাতে পারে কি না। এভাবে ওকে একটানা আটকে রাখা ঠিক নয়, তাছাড়া ও তো নিতান্ত সাধারণ একটি কুক্কুটমাত্র নয়, এই অল্প সময়ে রোহান যেটুকু দেখেছে তাতে সে নিশ্চিত হয়েছে মোরগটার অসাধারণ কিছু গুণ আছে, সে অপেক্ষায় আছে ধীরে-ধীরে কখন কীভাবে সেই অসাধারণত্বের প্রকাশ ঘটে।

রোহানের ছোটবেলা থেকেই মনে হয় এ-মহাবিশ^ বিপুল রহস্যের আধার। আমরা ‘জাগতিক’ শব্দের সমার্থক বলি ‘লৌকিক’। অথচ রোহানের কিশোর বয়স থেকে জগৎটাকেই বরং অলৌকিক কিছু মনে হয়। এই মহাজগৎ কীভাবে সম্ভব হলো, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সে পায় না। বরং কোনোকিছু সৃষ্টি না-হওয়াটা, সবকিছু শূন্য থাকাটাই যেন স্বাভাবিক ছিল। রোহানের মনে এই বাসনাও থেকে থেকে উঁকি দেয়, যদি অনন্ত-অসীম মহাকাল আর মহাজীবনের অন্তত কিছু সত্য সে জানতে পেত! এর জন্য প্রয়োজনে দিনের পর দিন সে ধ্যান করতে কিংবা সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যেতেও প্রস্তুত আছে। অবশ্য সংসার-জীবন এখন রোহানকে অনেকটাই বেঁধে ফেলেছে।

পাখি গোত্রের এই অদ্ভুত-স্বভাব প্রাণীটাকে রোহান বাড়িতে এনে তুলেছে গত বৃহস্পতিবার, আর আজ হলো রোববার। সঞ্চিতার ফরমায়েশ মতো সে বাজারে গিয়ে প্রথমে দুটো ব্রয়লার মুরগির অর্ডার দিয়েছিল। অতঃপর অহেতুক পক্ষীমলের দুর্গন্ধের ভেতর দাঁড়িয়ে না-থেকে সবজির দোকানের কাজ সারতে মুরগিপট্টি থেকে বেরিয়ে যায়। মিনিট পনেরো পরে  পটোল-বেগুন-আলু-উচ্ছেভর্তি থলে হাতে ফিরে আসে। মুরগির পলিথিনটা হাতে নিয়ে দোকানিকে টাকা দিচ্ছে এমন সময় ডাক শুনতে পেল, ‘রোহান‌-রোহান!’ আশপাশের কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে সে তেমন কাউকে খুঁজে না-পেয়ে দোকানিকে টাকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই আবার সেই ডাক – ‘রোহান – রোহান, আমাকে বাঁচাও।’ এই আর্তকণ্ঠ শুনে রোহানের পক্ষে এবার আর নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব হয় না। সে দুই হাতে বাজারের দুটি ব্যাগ নিয়ে অনুসন্ধানী চোখে খুঁজতে থাকে ডাকের উৎস। প্রথমে চারদিকের মানুষগুলিকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে। কই না, এদের মধ্যে তো কোনো চেনা মুখ নেই যে তার নাম ধরে ডাকতে পারে। সতর্কদৃষ্টিতে দু-পা এগোতে-এগোতে মনে হলো, এটা ঠিক মানুষের ডাক নয়, ময়না বা কাকাতুয়া পাখি নতুন কথা শিখলে যেমন হয়, কণ্ঠটা অনেকটা সেরকম। আরো একবার কণ্ঠটা ভেসে এলো তার কানে – ‘রোহান,  রোহান – এদিকে এসো, সবুজ খাঁচাটার কাছে।’ এই নির্দেশনা পেয়ে সুবিধে হলো, সে খুঁজতে লাগল আশপাশে কোনো দোকানে সবুজ খাঁচা আছে কি না। ডানদিকে ভিড় ঠেলে কয়েক কদম এগিয়ে মনে হলো শব্দটা এদিক থেকে আসেনি। তখন সে বাঁদিকে এগোতে শুরু করল। তিন-চার গজ গিয়ে সামনে চোখ রাখতেই লোহার সবুজ খাঁচার ভেতর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল লাল-ময়ূরকণ্ঠী রঙের মোরগের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল। এই মোরগটিই কি ডাকছিল তাকে?  দোকানের সামনে দুজন ক্রেতা দাঁড়িয়ে আছে। রোহানকে দেখে দাড়িওয়ালা দোকানি বলে, ‘কী লাগবে ভাই, ভালো দেশি মুরগি আছে, আজকেই গ্রাম থেকে দিয়ে গিয়েছে।’

বিব্রত ও সতর্ক রোহান বলে, ‘একটু দেখি। বলছি।’

তখন আবার ডাকটা স্পষ্ট কানে আসে, ‘রোহান আমাকে বাঁচাও।’

খুব কাছে থাকায় এবার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না, লাল মোরগটাই আর্তকণ্ঠে ডাকছে তাকে। রোহান খাঁচাটার কাছে গিয়ে একটু ভালো করে মোরগটাকে নিরীক্ষণ করে। মোরগটা তার চোখে চোখ রেখে কী যেন বলতে চাইছে।

‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’ রোহান স্পষ্ট শুনতে পায়। সে দোকানি ও আশপাশের মানুষগুলিকে খেয়াল করে। সকলেই তো নির্বিকার, যে যার কাজ করে যাচ্ছে। তাহলে মোরগের এই ভাষা সে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল। এতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাতে বোধহয় দোকানি খানিকটা বিরক্ত। সে এবার বলে ওঠে, ‘কয় কেজি লাগবে ভাই?’ 

‘আমি এই মোরগটা নিতে চাচ্ছি।’

‘এইটার দাম কিন্তু বেশি।’

‘কেন বেশি কেন?’

‘এটা স্পেশাল মোরগ।’

‘কীভাবে?’ রোহানের সংশয় হয় মোরগটা যে কথা বলতে পারে তা কি জানে এই বিক্রেতা? তাহলে আবার কতগুণ দাম হাঁকায় কে জানে।

‘চেহারা দেখে বোঝেন না? এমন গ্লেসঅলা মোরগ আর আছে এই বাজারে?’

বিক্রেতার কথায় আশ^স্ত হয় রোহান, যাক অন্তত যা আশঙ্কা করেছিল সেরকম কিছু নয়।

সে শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আচ্ছা দেখেন তো ওজন দিয়ে, কত আসে।’

প্লাস্টিক-বাস্কেটের ভেতর রাখা মিটারে মোরগটা চাপিয়ে দোকানি বলে, ‘এক কেজি নয়শ গ্রাম, সাতশ ষাট টাকা হয়।’

‘আচ্ছা দিয়ে দেন।’

‘চামড়া থাকবে, না ফেলে দেব?’

‘না – না, জবাই দিতে হবে না। আমি ওকে এভাবেই নিয়ে যাব।’

দোকানি অভ্যস্ত হাতে একটা ডানার ভেতর আরেকটা ডানা পেঁচিয়ে বাঁধতে গেলে মোরগটা প্রতিবাদী সুরে দুবার  ডেকে ওঠে, ব্যাপারটা খেয়াল করে রোহান বলে, ‘বাঁধা লাগবে না। এমনিতে আমার হাতে দেন।’

‘দাঁড়ান দুই পায়ে রশি দিয়ে শুধু একটা প্যাঁচ দিয়ে দিই। না হলে একবার ছুটে গেলি আর পাবেন না। তখন দোষ  দেবেন আমার!’

দাম মিটিয়ে দিয়ে এক হাতে দুটো বাজারের ব্যাগ আর এক হাতে মোরগটা আলগোছে ধরে নিয়ে রিকশার সন্ধানে এগোতে শুরু করল রোহান। ভাদুরে ভ্যাপসা গরমটা আর সহ্য হচ্ছে না, কপালের নোনতা ঘাম গড়িয়ে চোখের ভেতর এসে চোখ পোড়াচ্ছে। তার ওপর বাজারের নোংরা দুর্গন্ধময় পরিবেশ। এদেশের মানুষ কবে যে একটু পরিচ্ছন্ন হবে! আসলে টাকাই সব – সম্ভবত দেশ ধনী হলে তবেই পরিচ্ছন্ন পরিপাটি হয়। ‘এই যাবে?’ বললে সামনের রিকশাওয়ালা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে দুহাত-জোড়া রোহান বেশ কষ্ট করেই রিকশায় উঠে বসে। ত্রিচক্রযান চলতে শুরু করার দু-এক মুহূর্তের মধ্যে চালকের ঘর্মাক্ত শরীরের তীব্র নোনা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারতে থাকলে রোহান পকেটে টিস্যু হাতড়াতে থাকে। 

কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দিয়ে রোহানকে দেখে সঞ্চিতা রীতিমতো অবাক। ‘এই ভরদুপুরে তুমি জ্যান্ত একটা  মোরগ এনে হাজির করেছ, এটা নিয়ে আমি এখন কী করব? মাজেদাও তো এইমাত্র চলে গেল।’

‘আগে ভেতরে আসতে দাও, বলছি। ব্যাগদুটো নিয়ে কিচেনে রাখো, গরমে গা জ্বলে যাচ্ছে।’

মোরগটা দক্ষিণের বারান্দায় রেখে এসে রোহান হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরুমে ফুলস্পিড ফ্যানের নিচে এসে বসে। সঞ্চিতা এসে জিজ্ঞেস করে, ‘চা খাবে, না লেবুর শরবত দেব?’

‘শরবতই দাও। কয়েক টুকরো আইস দিয়ে দিও।’

রোহানের গ্লাসের শরবত অর্ধেকটা শেষ হলে সঞ্চিতা বলে, ‘মোরগটা কী করবে?’

‘পুষব।’

‘বলো কী, ও তো সারা বাড়িঘর নোংরা করবে।’

‘ওকে চিলেকোঠায় একটা খাঁচার ভেতর রেখে দেব। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তোমার কোনো-রকম ঝামেলা হবে না।’ খানিক বাদে সে মোরগটাকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে পায়ে তিন হাত লম্বা একটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। ওর জন্য পাশে দুটো ছোট বাটিতে কিছু চাল আর পানি রেখে দিলে মোরগটা চালের বাটিতে ঠোকর দিতে শুরু করে।

আজ বৃহস্পতিবার হলেও কী-একটা কারণে ছুটি পড়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রোহান দিব্যি ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। জেগেই তার মনে পড়ে মোরগটার কথা। সে চিলেকোঠায় ছুটে গিয়ে মোরগটাকে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করল। সত্যিই এত সুশ্রী, চকচকে মোরগ সে আগে দেখেনি। রোহান তার স্মার্টফোনে মোরগটার কতক ছবি তুলল। কে জানে মোরগের এই ছবি একসময় সারা বিশে^ও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ও যখন কথা বলে সেগুলি ভিডিও করে নেটে ছাড়লে ভাইরাল হতে কতক্ষণ! তবে আপাতত রোহান ওই সস্তা পথে পা বাড়াবে না। তার ধারণা, মোরগটার কাছ থেকে আরো গভীরতর কিছু পাওয়ার আছে। সে ঘাড়ের কাছে হাত রেখে আদরের ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

মোরগটা জবাবে দু-বার অর্থহীন

‘ক্-ক্’ করল।

রোহান আবার বলল, ‘তুমি এর আগে কার বাড়িতে ছিলে?’

মোরগটা এবার নিশ্চুপ, যেন কিছুই শুনতে পায়নি।

ওকে যে-কারণে যত্ন করে বাড়িতে আনা সেই ব্যাপারটি যাচাই করার জন্য রোহান ভেতরে ভেতরে খুব উদ্বিগ্ন আর অস্থির হয়ে থাকলেও নিজেকে বুঝিয়েছে, এই প্রাণীটাকে নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করা যাবে না, পুরো ব্যাপারটি খুব স্পর্শকাতর, তাই ধীরেসুস্থে এগোতে হবে।

রোহান দেখেছে কাঠের আড়তগুলিতে মুরগির খোপ বিক্রি হয়। কিন্তু এই মোরগটাকে সে ওরকম অন্ধকার বন্দিশালায় রাখতে পারবে না। ওকে রাখতে হবে খোলামেলা একটা ঘরে, যার ভেতর যথেষ্ট পরিমাণ আলো-বাতাস চলাচল করে। সন্ধ্যায় কয়েকটা দোকান ঘুরে শেষ পর্যন্ত পাখি রাখার একটি বড় খাঁচা কিনে নিয়ে আসে সে।

তবে গত দুটো দিনে মোরগটার বিষয়ে সে বেশ খানিকটা হতাশ হতে শুরু করেছে। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগে। একবার এ-ও ভেবেছিল, এই প্রাণীটাকে বাড়িতে বয়ে আনা আদৌ ঠিক হলো কি না। খানিক বাদেই মনে হয়, কিন্তু বাজারে তো সে স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল মোরগটা কথা বলে, তার নাম ধরে স্পষ্ট করে ডেকেছে। ঘটনাটা কোনো স্বপ্ন বা ঘোরের মধ্যে ঘটেনি, ঘটেছে ঘটেছে ভরদুপুরে বহুলোকের ভিড়ে। অথচ এই তিন দিনে বলতে গেলে সে আর কোনো কথা বলেনি। গতকাল একবার যেন দুটো শব্দ তার কানে অস্পষ্ট বেজেছিল, তার কোনো মর্মোদ্ধার করা রোহানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখন আবার নতুন করে সংশয় হচ্ছে, মোরগটা কি আদৌ কথা বলেছিল, নাকি নিতান্তই রোহানের বিভ্রম? ওখানকার আর কেউ শুনল না, সে-ই একা শুনতে পাবে কেন? তাহলে এখন মোরগটা নিয়ে কী করা উচিত হবে? ওর মধ্যে কোনো প্রেতাত্মা ভর করে নেই তো? হয়তো সাধুবেশী একটা শয়তান! না হলে এখন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে কেন? আর যা-ই হোক, রোহান ওকে জবাই করার কথা ভাবতেও পারে না। কোনো ইতিবাচক ব্যাপার না থাকলে কিংবা প্রকৃতির বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট না-হলে একটা অবলা জীব মানবভাষা শিখবে কোত্থেকে? আচ্ছা, দেখাই যাক না কিছুদিন ধৈর্য ধরে।

এই স্টোররুমের উত্তর দিকে ছোট্ট একটা জানালা আছে বটে কিন্তু বহুদিন ধরে ওটা বন্ধ। রোহান ভাবে, জানালাটা এখন থেকে খুলে রাখা দরকার। তাতে  যেটুকু আলো-বাতাস প্রবেশ করবে এবং এক টুকরো আকাশ দৃশ্যমান হবে, তা মোরগটাকে হয়তো কিঞ্চিৎ স্বস্তি দেবে।  

রোহান খানিকক্ষণ মোরগটার দিকে  নির্বাক তাকিয়ে থেকে আশাহত মনে বের হয়ে যাচ্ছিল। ছিটকিনি লাগাবে বলে দরজার পাল্লাটা যে-ই টানতে গিয়েছে অমনি পেছন থেকে শুনতে পেল, ‘তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, তাই না?’

উত্তেজনায় এবং হয়তো সামান্য ভয়ে হঠাৎ ওর বুকের ভেতর একটু ধড়ফড়ানি শুরু হয়। পেছন ফিরে সে কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে, ‘তুমি কি আমাকে কিছু বললে?’

‘হ্যাঁ, এখানে আর তো কেউ নেই। এই যে আমি কথা বলতে শুরু করেছি। এবার তো আশ^স্ত হচ্ছো, নাকি?’

সেদিন যে-কণ্ঠে মোরগটা কথা বলেছিল আজকের কণ্ঠটা আরো বেশি মানবীয়, পাখিভাব অনেকটা কম। তবে গলার স্বর না-নারী, না-পুরুষের। রোহান কিঞ্চিৎ দ্বিধায় পড়ে যায় – মোরগটার কথার কী জবাব সে দেবে। ও তো মোটেই মিথ্যে বলেনি। সে স্পষ্টতই প্রাণীটার প্রতি হতাশ ও বিরক্ত হতে শুরু করেছিল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে মোরগটা এ-বাড়িতে এসে নির্বাক থাকলেও সবকিছুর ওপর তীক্ষè নজর রাখে, বিশেষত রোহানের ওপর। তাছাড়া প্রাণীটির বিশেষ বোধ ও চিন্তাশক্তি রয়েছে। হয়তো প্রজ্ঞা আর অলৌকিক ক্ষমতাও। ময়না কথা বলে, কথা বলে তোতা কিংবা শালিকও হয়তো। কিন্তু কুক্কুট জাতীয় একটি প্রাণীর মানবভাষা! তা-ও ময়নার মতো শেখানো বুলি নয় – বুঝেশুনে নিজের জ্ঞানে বাক্যবিনিময় – সেটা কিছুতেই স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না।                                                                                                                                           

রোহান এগিয়ে গিয়ে খাঁচার ছিটকিনিটা খুলে ছোট্ট দরজাটা মেলে ধরে। এই বিচক্ষণ মোরগকে আটকে রাখা এই মুহূর্তে অনাবশ্যক বলে মনে হয়। মোরগটা ধীরপায়ে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে বলে, ‘যাক, তাহলে আমার বুদ্ধির ওপর তোমার ভরসা জন্মাচ্ছে দেখি।’

‘আমি দুঃখিত। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আপনি কিছু মনে করবেন না। এই মুহূর্ত থেকে আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্ত – যা খুশি করতে পারেন।’ (প্রথমে প্রাণীটাকে ‘তুমি’ করে বললেও হয়তো রোহানের অবচেতনেই তা ‘আপনি’তে উন্নীত হয়।)

‘ধন্যবাদ তোমাকে, কিছুদিনের জন্য হলেও তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’

‘আচ্ছা বাজারে এত মানুষ থাকতে সেদিন আপনি কেন আমার নাম ধরেই ডাকলেন?’

‘কারণ আমি উপস্থিত মানুষগুলিকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তাদের মধ্যে একমাত্র তুমিই আমার ভাষা বুঝতে পারবে। চিন্তাশক্তিতে তুমি তো গড়পড়তা মানুষের মধ্যে পড়ো না।’

‘আপনি কি এই খোলা ছাদে আমার সঙ্গে হাঁটবেন, কিংবা চাইলে এ-বাড়ির বাইরেও চলে যেতে পারেন।’

‘না, বাইরে যাওয়া আপাতত ঠিক হবে না, তবে খোলা ছাদে হাঁটা যায়।’ বলে মোরগটা বাইরে বেরিয়ে এলে রোহান তার পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে আলাপ চালিয়ে যায়।

‘আমি সম্ভবত প্রায় দু-মাস তোমার এখানে থাকতে পারব। তবে যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু কথা বলে যেতে চাই।’

‘আমি নিশ্চিত ছিলাম – আপনি অসাধারণ, আপনি অনন্য। আমার বহু কৌতূহল আছে আপনাকে নিয়ে। আপনি কেন এই রূপে, কীভাবে মানুষের মতো কথা বলতে পারেন? কীভাবে একটা পাখির ক্ষুদ্র মাথায় এতটা জ্ঞান? কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করে অহেতুক আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার মনে হয় এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর কথা আমি আপনার কাছে পাব।’

‘তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান। আর আমার ভালো লাগছে এজন্য যে, আমি সঠিক মানুষটিকেই খুঁজে নিয়েছি। আচ্ছা তুমিই বলো – কোন গভীর জিজ্ঞাসায় তোমার কৌতূহল?’

‘আমি – আমি তো জানতে চাই আকাশের ওপারে আকাশের কথা, মহাশূন্যপ্রান্তের শেষ নক্ষত্র কী রঙের আলো ছড়ায়, আমার যে-বোনটি তিন বছর বয়সে জলে ডুবে মরে গিয়েছিল সে এখন কোন মেঘের ছায়ায় কিংবা সাগরবেলায় খেলে বেড়াচ্ছে? আমি জানতে চাই, আমার শরীরটি যখন মিশে যাবে পঞ্চভূতে কী করে আমি আমার প্রিয় দোলনচাঁপা ফুলের গন্ধ পাব?’

‘বাব্বাহ, তুমি সত্যিই গভীর মানুষ, যেন পাক্কা দার্শনিক। আবার কবিতা-টবিতা লেখো নাকি? যাই হোক, তোমার সব কথার জবাব আমারও জানা নেই। তবে কিছু তো আছেই। সে-সব ধীরে-সুস্থে দুজন মিলে আলাপ করা যাবে।’

জ্যোৎস্নার আলো এবং মৃদুমন্দ বাতাসের প্রবাহ দুটোই এতক্ষণে আরো উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। মোরগের সঙ্গে আলাপের সময় আমার কান খাড়া রাখতে হয় – সঞ্চিতা এসে আবার এই দৃশ্য না দেখে ফেলে; তাহলে নিশ্চিত আশঙ্কা করবে তার স্বামীকে বায়ুরোগে পেয়েছে। 

‘আজ এই মুহূর্তে যদি এগুলির যে-কোনো একটা বিষয় নিয়ে কিছু ইঙ্গিত দিতেন।’

‘ফুলের সৌরভ – সে তো পাওয়াই সম্ভব। অন্য আকাশে দোলনচাঁপার সুবাস আরো সূক্ষ্ম, আরো মিহি, আরো মর্মস্পর্শী; কিন্তু সেই সুগন্ধে মাদকতা নেই, আছে মোহনীয়তা। তোমার অন্তরা নামের বোনটি দিব্যি আছে অনন্য এক উদ্যানে। সেখানকার দৃশ্য, সেই সৌন্দর্য পৃথিবীর মানুষের ভাষায় তুলে ধরা এক কথায় অসম্ভব।’

মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে-দেখতে রোহান ডাইনিং টেবিলে খাবার খাচ্ছিল। বেগুন-ছোটমাছের চচ্চড়ি শেষ করে বাটি থেকে মাংস তুলে নিয়ে ভাত মাখিয়ে খেতে শুরু করেছে। তখন সঞ্চিতা এগিয়ে এসে বলে, ‘তোমাকে বলা হয়নি দুপুরে একবার ফোন দিয়েছিলাম তোমার ফোন কি ফ্লাইট মুডে ছিল – রিং ঢুকল না।’

‘হ্যাঁ, ঢাকা থেকে হঠাৎ ডিজি স্যার এসেছিলেন, মিটিং করলেন টানা তিন ঘণ্টা। কেন, বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছিল?’

‘না, দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ তারিন আর ওর বর এসে হাজির। তারিন কী-একটা টেস্ট করতে এখানকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসেছে। ওদের নতুন বিয়ে – তোমার চাচাতো বোন-বোনাই। না-খাইয়ে বিদায় দিই কী করে? তারিনের বর আবার গরু খায় না, আর ব্রয়লার দেওয়াও ঠিক নয়। ভাগ্যিস মাজেদা তখনো ছিল। দুজনে মিলে ধরে তোমার ছাদের ওই মোরগটা জবাই করতে হলো।’

সঞ্চিতার কথা শেষ না-হতেই চেয়ার ছেড়ে রোহান অদ্ভুত আওয়াজ করতে-করতে বেসিনের দিকে গিয়ে ছুটে যায়। গলার ভেতর আঙুল চালিয়ে পেটের যাবতীয় খাবার উগরে দেয়। ততক্ষণে সে ভীষণ ঘেমে উঠেছে, চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বেডরুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।

হতভম্ব সঞ্চিতা কিছুই বুঝে উঠতে না-পেরে স্বামীর পেছন পেছন যায়। চুলে-কপালে হাত বুলাতে-বুলাতে বলে, ‘হঠাৎ কী হলো তোমার, শরীর খারাপ লাগছে?’

‘তুমি এখান থেকে যাও।’

‘খাবারে কোনো সমস্যা? তোমার

 এমন কেন হলো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

রোহান উঠে বসে, ‘তুমি কত বড় সর্বনাশ করেছো জানো?’ বলতে-বলতে স্ত্রীর গালে একটা চড় কষে দিলে সঞ্চিতা বিস্ময়ে-ক্ষোভে বাকরুদ্ধ হয়ে এক মুহূর্ত বসে থাকে, তারপর স্থান ত্যাগ করে ড্রইংরুমের সোফায় শুয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। চার বছরের দাম্পত্য জীবন পার করে এই মুহূর্তে স্বামীকে সম্পূর্ণ অচেনা এক পুরুষ মনে হচ্ছে তার। সে মনে মনে ঠিক করে এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যদি রোহান করে তবে তাকে আর কোনো সুযোগ দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, চিরকালের জন্য।

এই প্রথম দুজনের রাত কাটে আলাদা কামরায়। পুরো একটা দিনের বেশি সময় জুড়ে দুটি মানুষের মধ্যে জমে-থাকা বরফ আরো শীতল হতে থাকে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর রোহান মুখ খোলে – ‘কালকের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই কাজটি কোনোভাবেই আমার চরিত্রের সঙ্গে যায় না।’

সঞ্চিতা কী যেন ভাবে। খানিক চুপ থেকে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘ঠিক আছে। কিন্তু বিষয়টির মাথামুণ্ডু এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। সামান্য একটা মোরগ -’

রোহানের চোখে পড়ে সঞ্চিতার বাম গালে এখনো চার আঙুলের দাগ বসে আছে।

‘আমি তোমার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। তবে আমার অতটা রিয়্যাক্ট করার কারণ কোনো একদিন বলব, যদিও জানি তুমি হয়তো বিশ^াসই করবে না।’

‘এখনই বলো, আমি শুনতে চাই। অবিশ^াস কেন করব – তুমি তো মিথ্যেবাদী নও।’

‘কথা দিচ্ছি বলব। তবে এখনই জোরাজুরি করো না প্লিজ, আমি যেন একটা গভীর গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার চারপাশের বাতাস এখনো স্বাভাবিক হয়নি। আচ্ছা মোরগের পালকগুলি কোথায় রাখা হয়েছিল?’

‘রাখা হয়নি কোথাও, ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

রোহান মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

খানিক পর সে ছাদের ওই ঘরটাতে গিয়ে মোরগের একটা পালক খুঁজে পায়। সেটাকে আদরের ভঙ্গি করে মনে মনে বলে, ‘তুমি ক্ষমা করে দিও আমাকে। আমার ভুলের জন্যই তোমার এই পরিণতি হলো। তোমার কাছে আর অন্য আকাশের খবর নেওয়া হবে না।’

 এ-রাতেও সঞ্চিতা অন্য ঘরে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলে রোহান নির্বিকার থাকে। বেডরুমে একা খুব অস্বস্তি লাগে রোহানের। বিছানায় গিয়ে একবার ভাবে, সঞ্চিতাকে ডেকে আনবে। কিন্তু মন সায় দেয় না, এই চার বছরে রোহান বুঝেছে – সঞ্চিতা বিশেষ সহজ ধাতুতে গড়া মেয়ে নয়। ওকে আরো খানিকটা সময় দেওয়া দরকার। আকাশ-পাতাল ভাবতে-ভাবতে রাত দেড়টার দিকে ঘুম আসে। কিন্তু ঘণ্টা-দেড়েক পরে ঘুমটা ভেঙে যায়। চোখ মেলে বুঝতে পারে এতক্ষণ তন্দ্রার ভেতর সে ওই লাল-ময়ূরকণ্ঠী মোরগটাকে নিয়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছে। লাল মোরগটা পাখা মেলে বাজপাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। রোহান তাকে বলে, ‘তুমি কীভাবে উড়তে পারো অত উঁচুতে? আমাকেও সঙ্গে নাও, মেঘেদের দেশে আমিও উড়তে চাই।’ অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও দু-চোখের পাতা আর এক করতে পারে না। ঘরের ভেতর কিছুক্ষণ পায়চারি করে। হঠাৎ কী ভেবে মোবাইল ফোনে তোলা মোরগের ছবিগুলি একে একে সব ডিলিট করে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ আবার কীসব ভাবতে-ভাবতে ডায়েরির ভেতর সযত্নে রাখা মোরগের পালকটি হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। গ্যাসের চুলো জে¦লে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে ওই পালক। পালকপোড়া গন্ধময় বাতাসের ভেতর দাঁড়িয়ে সে হয়তো ভাবে, ওটার বৃত্তান্ত এইভাবে থমকে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে। মোরগটাকে নিয়ে সে যা-কিছু শুরু করতে যাচ্ছিল তা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

নিস্তব্ধ বেডরুমে দেয়ালঘড়ির টিকটিক আওয়াজটাও বুকের ভেতর আশঙ্কার স্পন্দন ছড়ায়। নিজের ঘরে মিনিট পাঁচ-ছয় পায়চারি করে রোহান সসংকোচে সঞ্চিতার ঘরের দরজায় নক করে। বাইরে থেকে বোঝা গেল ঘরের ভেতর আলো জ¦লছে। ও একা বোধহয় ভয় পায়।

ভেতর থেকে জবাব আসে, ‘দরজা খোলা আছে।’ আজ ওর কণ্ঠটা যেন অন্যরকম।

রোহান ঘরের ভেতরে ঢুকে টের পায় সঞ্চিতা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই দৃশ্য অন্তত সে প্রত্যাশা করেনি। পাথরের মূর্তির মতো নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকে রোহান। সঞ্চিতাকে স্পর্শ করে মান ভাঙানোর সাহস হয় না। রোহান জানে, ব্যাপারটা কেবল ‘মান-অভিমান’ পর্যায়ে নেই, থাকার কথাও নয়। তাহলে এখন ক্ষমা পাওয়ার জন্য কি মোরগ-রহস্য বয়ান করবে সঞ্চিতার কাছে? ও বিশ^াস করবে সেসব?

বহুকথা ভেবে শেষে একটি বাক্য মনঃপূত হয় তার, ‘আমরা কি এভাবে আলাদা ঘরেই থাকব?’

সঞ্চিতা কান্নামিশ্রিত গলায় বলে, ‘তুমি জানো এই দুটো রাত আমি একটা সেকেন্ডের জন্য দুই চোখের পাতা বন্ধ করতে পারিনি?’

‘সরি, সরি – আমি আবারো ক্ষমা চাইছি। আমি যেন ওইরকম অমানুষ আর কোনো কুক্ষণে না হই।’

সঞ্চিতা দু-হাতে স্বামীকে আঁকড়ে ধরে বলে, ‘তুমি কী করে পারো এত কঠিন হতে!’

রোহান যখন সঞ্চিতার কপালের এলোমেলো রেশম-চুল সরিয়ে একটি স্নেহচুম্বন দেবে বলে ঠিক করেছে ঠিক তখনই কোথায় একটা মোরগ বাঁক দিয়ে ওঠে – ‘কুক্-কু-কুউ-উ-’।

ভোর হয়ে এলো নাকি! রোহান দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায় – দুটো পঞ্চাশ মিনিট। এখনো গভীর রাত। এতো রাতে তো – রোহান ভাবে। তখন আবার আওয়াজটা আসে – ‘কুক্-কু-কুউ-উ-’।

স্বামীকে হঠাৎ অন্যমনস্ক দেখে সঞ্চিতা বলে, ‘এই, কী হলো তোমার?’

‘একটা মোরগ বাঁক দিলো, শুনেছো? দু-বার ডেকেছে।’

‘কই আমি তো কিছু শুনতে পেলাম না।’

‘কী বলো, আমি যে শুনলাম!’ ওই তো আবার ডাকছে! 

রোহানের চোখের দিকে তাকিয়ে সঞ্চিতা হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, ওর এরকম ভয়ার্ত দৃষ্টি কখনো দেখেনি সে।