অলকমেঘের বৃত্তান্ত

এক

ঘাড়ে টোকা খেয়ে হাঁটুর ওপর ভর রেখে শূন্যে বসে থাকা আমি টালমাটাল নড়ে উঠি। হাতের রাইটিং প্যাডও নড়ে যায়, নতুন ইকোনো কলমটা হাত থেকে পড়ে রাস্তার ধুলায় গড়াগড়ি খায়। ফুটপাতে জায়গা নেই বলে সভাপতির আসনের খানিক দূরে নোটপ্যাডে রিপোর্টের কিছু পরিকল্পনা লিখে রাখছিলাম। একটু পরে এখানে সভা শুরু হবে। ঢাকায় তো বটেই, সারাদেশে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে। পরপর দুই দিন দুই নেত্রীর দুটো সভা। এখান থেকে শেষ করেই ছুটবো কালকের প্রস্তুতি নিতে। পত্রিকার রাজনৈতিক রিপোর্টারের কাজ যেমন বিশ্লেষণ, তেমনি নিজ চোখে দেখাও বটে।

কলমটা হাতে নিয়ে ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে পেছনে ফিরে তাকাই। আমার পত্রিকার সম্পাদক, ববিভাই দাঁড়িয়ে। চমকে উঠে যেই কিছু বলতে যাব, তার আগেই তিনি বলেন, ‘এই, তুই অফিসে যা তাড়াতাড়ি।’ ববিভাইকে ওখানে দেখে বিস্মিত যতটা হই তার চেয়ে বেশি হই বিরক্ত। নেত্রীর গাড়ি যে-কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে, তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলবেন তিনি, এরকম সময়ে ববিভাই কি না আমাকে অফিসে চলে যেতে বলছেন! কী এমন দরকার পড়তে পারে?

বিস্ময় চেপে বলি, ‘কী যে বলেন না, ববিভাই, আমি এখন যাব কোন দুঃখে? এখনই জরুরি আলাপ শুরু হবে। কোন সকাল থেইকা একের পর এক জ¦ালাময়ী বক্তৃতা চলতেছে। কালকে দেইখেন কেমন ধারালো একটা রিপোর্ট লিখি। এই সরকার আজ না হয় কাল পড়বেই। আপনে যান তো, এইখানে কী করতে আসছেন?’

‘আরে ব্যাটা তোরে যেইটা বলি সেইটা শোন। অফিস যা। গিয়া বেতনটা তুইলা নিয়া আবার চট কইরা চইলা আয়।’

‘চাইর দিক দিয়া মিছিল আসতেছে, সেইটা দেখছেন? মিলেঝিলে সচিবালয়ের দিকে যাবে। এর মধ্যে অফিস গিয়া ফিরত আসতে পারব? পরে যাবো। এখন যান তো আপনি এইখান থেইকা!’ তারপর ব্যাগ থেকে আরেকটা নোটবুক বের করতে করতে খেয়াল হয়, এইরকম একটা সময়ে কেউ বেতনের জন্য তোড়জোড় করে? এই লোক জোর করে বেতন দিতে চায় কেন? ববিভাই মনে হয় আমার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন বুঝে ফেলেন। বলেন, ‘বোকা কোনখানকার, আমার কাছে খবর আছে, লম্বা হরতাল দিতেছে। পরে রাস্তাঘাটের অবস্থা এমন হবে যে তুই বেতন নিতেও আসতে পারবি না। না খাইয়া মরবি। যা জলদি।’

‘মরলে মরবো। আজকের আন্দোলন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এখন এইখান থেইকা নড়তে পারব না।’

‘শুনবি না তুই আমার কথা?’ বলে ববি ভাই হাত ছুড়ে আমার হাতের নোটবুক ছোঁ মেরে নেন, বলেন, ‘যা তুই, দৌড় দে। ততক্ষণ আমি নোট নিতেছি।’

‘পাগল নাকি! আমি যেইভাবে নোট নিব আপনি সেইভাবে পারবেন?’

‘ওই, এডিটর আমি না তুই?’

‘আপনি। সেই জন্যেই তো বলতেছি। আপনি পলিটিক্যাল রিপোর্টার না। আমার চোখ আর আপনার চোখ এক না। আপনি যান, আমি রিপোর্ট লিখলে পরে এডিট কইরেন। আর শোনেন, লিডে তিন কলাম ফাঁকা রাইখেন।’

লিড হবে আমি বরাবর জানি, বিষয় বলে দিই না, শুধু বলে দিই লিড হবে, এই নিয়ে অবশ্য অফিসের অন্যরা বাঁকা চোখে তাকায়। পরে যখন সত্যিই তাই হয় তখন তারা চুপসে যায়। ববিভাইকে

মোদ্দাকথাটা বলে নিয়ে তাই আমি পাল্টা তার হাত থেকে নোটবুক ছিনিয়ে নিই।

বক্তৃতায় মনোযোগ দিই। পেছনে আর তাকাই না। সামনে স্বনামধন্য ছাত্রনেতা বক্তৃতা করছেন। এদিক-ওদিক থেকে একেকটা মিছিল এসে শ্রোতার সারিতে মিলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তুমুল করতালিতে বাতাস ভরে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো পয়েন্ট বাদ পড়ে গেল নাকি, এই আশঙ্কায় ববি ভাইয়ের ওপরে আরো বেশি বিরক্ত হই। পেছন থেকে আর কোনো টোকা বা কথা আসে না দেখে মাথা ঘোরাই – ববি ভাই নেই। কখন যেন নিঃশব্দে চলে গেছেন। যাক, বাঁচা গেল।

করতালি আর সেøাগানের প্রতিধ্বনিতে বক্তৃতার দিকে কান পাতা কখনো কঠিন মনে হয়। তবে সবাই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা বলেন। আজ যেহেতু সচিবালয় অবরোধের ঘোষণা আগেই দেওয়া ছিল তাই যে-কোনো মুহূর্তে হঠাৎ সচিবালয়ের দিকে হাঁটার ঘোষণা আসতে পারে। আমি হাতে ধরা নোটবুক আর কলমটা ছাড়া দরকারি সবকিছু ঘাড়ের ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। জাদুঘরের সামনের এলাকাটা তখন জনসমুদ্র, কেউ কাউকে চেনে না, তবু এক উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামায় যেন তাদের আত্মীয়তা হয়ে গিয়েছে। ধাক্কাধাক্কি নেই, বরং কিছু মানুষ সুন্দর পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে নজরদারি করছে। তার মধ্যেও কখনো পেছন থেকে ছোট ঢেউয়ের মতো দুলুনি আসে, আমি তখন হাত দিয়ে ঘাড়ের ব্যাগের অবস্থানটা নেড়েচেড়ে ঠিক করে রাখি।

এই সবকিছুর মধ্যে দশটা প্রায় বাজে। মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসায় সচিবালয়ের দিকে পা বাড়াতে যাব, দেখি আবার পেছন থেকে আমার শার্টের কলার টেনে ধরেছেন ববিভাই। আমি এবারে আর বিরক্তি চেপে রাখি না, ‘ভাই, আপনি এখনো এইখানে কী করেন? যান নাই?’

‘গেছি তো! গেলাম আবার আইসা পড়লাম।’

ববি ভাই হাসি হাসিমুখে পাশে দাঁড়িয়ে। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোড়ানো টাকা বের করে দিয়ে বলেন, ‘হিমেল, এই নে, রিকশায় করে গিয়ে তোর বেতনটা এনে দিলাম। কে জানে কালকে কী হয়, যা এখন কাজ কর।’

আমি টাকাটা হাতে নিয়ে থমকে থাকলাম। যখন থেকে তাঁর পত্রিকায় চাকরি করি, বেতন যত তাড়াতাড়ি পারেন, দিয়েছেন। সরকারি ছুটি হলে আগের দিন পকেটে বেতন চলে এসেছে। ববি ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তিনি পেছনে ঘুরলেন। তারপর দেখতে না দেখতেই ভিড়ের মধ্যে উধাও। ততক্ষণে রাস্তায় আর ফুটপাতে বসে থাকা মানুষেরা একযোগে হাঁটা শুরু করেছে। উত্তাল রাস্তা, মানুষজনের হাতগুলি ওপরের দিকে বলিষ্ঠ মুঠিতে উঠছে আর বাতাসে কোথায় যেন আঘাত করে আবার নিচের দিকে নামছে। নিচে নামতেই আবারো ওপরে ওঠার জন্য মুঠিটা আরো শক্ত হচ্ছে। একসঙ্গে অসংখ্য পায়ের ধপধপ কিংবা ঘষাঘষ শব্দ সেøাগানের বাইরে একমাত্র শব্দ সেখানে। আকাশ-বাতাসে নাড়া লাগিয়ে সবার ঠোঁটে – ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক। গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শোনা যাচ্ছে।

আমিও তাদের পাশে পাশে হাঁটা শুরু করি। অনুভূতির সমুদ্রে ঝড় তোলার মতো একটা সময় হলেও হাঁটতে হাঁটতে ববি ভাইয়ের কথা ভাবি, লোকটা কি মানুষ! আমার মতো সাধারণ একজন রিপোর্টার হরতালে না খেয়ে কষ্ট পাবে দেখে তিনি  অফিসে ফিরে গিয়ে বেতনটা এনে হাতে তুলে দিলেন। চাকরি করব না করব না করেও আমি লোকটার কাছে নানা কারণে টিকেই থাকলাম। অবশ্য কাজের স্বাধীনতা আছে বলেই হয়তো। আমি যা লিখি তাই তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপেন। যদিও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরুটা এত মসৃণ ছিল না। ববি ভাইয়ের কথা ভাবতে গেলে ভাবতে হয় নিজের কথাই।

দুই

বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই স্বপ্ন দেখতাম দেশে বিপ্লব আনার। সেখান থেকে বেরিয়েও স্বপ্ন থেকে বেরোইনি। আবেগী মানুষ হয়তো স্বপ্নের মধ্যেই বাস করে, কোন বাস্তবতার সাধ্য তাকে স্বপ্ন থেকে বের করবে! সকাল-সন্ধ্যা ছাপোষা চাকরি আমাকে লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দেবে, তাই চাকরির ধারেকাছে ঘেঁষার কথা না আমার। সেভাবেই চলছিল। আমি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার আশায় এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। এর-ওর সঙ্গে আলাপ করতাম – কী করা যায়, কী করা উচিত। মোটামুটি একটা নিয়মিত আয়ের রাস্তা করে রেখে দিতে পারলে রাজনীতিতে পুরোপুরি মন দেওয়া যেত। সে-কারণে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে টুকটাক ব্যবসা করার চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু মূলধন ছাড়া ব্যবসা হয়? দিনগুলি বলতে গেলে একরকম আড্ডায় কাটত, গঠনমূলক আড্ডা, তবে জীবন ধারণের জন্য টাকা জোগাত লিপি। বিয়ে করা বউ আমাকে চালিয়ে নিচ্ছে, আমি কেবল বিপ্লবের রাস্তা খুঁজছি আর অতি সাধারণ কারো মতো চাকরি করে সময়টা বরবাদ করতে চাচ্ছি না – এ-কারণে যে আমার খুব একটা অনুতাপ হতো, তা-ও নয়। বরং আমার মনে হতো, এটাই ঠিক চলছে। আমি যা করতে চাই, যা আমাকে দিয়ে সম্ভব, তেমন একটা সুযোগ না পেলে আমি ওসব চাকরির বন্ধনে বাঁধা পড়ব কেন?

লিপি দিনের পর দিন তার সামান্য বেতনে কী করে সংসার চালাত, বাড়ি ভাড়া দিত, এসব নিয়েও আমার তেমন মাথাব্যথা ছিল না। ফুরফুরে মেজাজে ঘুরতাম। তলে তলে লিপির আর আমার পিতৃপ্রদত্ত গয়নাগাটি বিকোচ্ছিল। খানিকটা আন্দাজ করলেও আমার গায়ে লাগত না। ওসব গয়নাগাটির প্রয়োজনীয়তা কি জ্ঞানের আর বিপ্লবের জন্য উৎসর্গ করা আমার ধ্যানের মতো জীবনের চেয়ে বড়? যাচ্ছে যাক। লিপির মতো বিপ্লবের সহচরও ওসব গয়নাগাটির ধার ধারে না।  তারপর একদিন দেখি সে আমার বাগদত্তা হওয়ার চিহ্ন আঙুল থেকে খুলে হাতের মুঠিতে চেপে বসে আছে। আমি আলাভোলা হয়ে জানতে চাইলাম, ‘এটা হাতে ধরে বসে আছ কেন?’ লিপি ছলছল চোখে বলল, ‘বিক্রি করার যে আর কিছুই নেই।’ 

আমার শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল। বিস্ফারিত চোখে আমি তার খোলা তালুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চেনা রুবিতে সোনার বাঁধুনি। কতদিন বাইরে থেকে এসে প্রথমেই লিপির হাতের দিকে নজর দিয়েছি, আংটিটা হাতে আছে তো? ওটাই যেন লিপির মনের ভেতরে আমার অবস্থানের প্রমাণ, আমার প্রাণভোমরা! ওই একটা আংটিই আমি তাকে কিনে দিয়েছিলাম বিয়ের সময়ে। অতি কষ্টে নিজের জোগাড় করা টাকায়। এমন না যে একবার দিয়েছি বলে আবার দিতে পারব না। কিন্তু আমাদের আত্মার সম্পর্কটা যে ওই আংটি দিয়েই বাঁধা পড়ল, একে অস্বীকার করি কী করে! এই আংটি আমাকে বাঁচাতেই হবে, যে-কোনো মূল্যে। লিপির তালু থেকে আংটিটা নিয়ে সেই আগের মতো ওকে পরিয়ে দিলাম, বললাম, ‘আমাকে দুটো দিন সময় দাও। কিংবা ধরো, একটা দিন। তোমাকে এটা বিক্রি করতে হবে না।’ লিপি আমার কথা শুনে মাথা নাড়ল ঠিকই, তবে খুব একটা বিশ^াস করল বলে মনে হলো না।

রাজনীতি-সচেতনতা আর জ্ঞানের ভাণ্ডারের অস্তিত্বের খবর পেয়ে অনেকেই আমাকে চাকরির প্রস্তাব দিত। আমি শুনেও না শোনার ভান করে কাটিয়ে দিতাম। আর তখন মনে করতে চেষ্টা করলাম ইদানীং চাকরিবাকরির খবর দিয়েছিল কে। হুট করে মনে পড়ল কিছুদিন আগে একজন বলেছিল নতুন একটা পত্রিকা শুরুর কথা, মুক্তচিন্তার পত্রিকা। এই একনায়কতন্ত্রের দুর্দিনে মুক্তচিন্তা! নিজের মনে হাসলাম। চাকরির খবরটা যিনি দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন, ‘যাও, ওখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।’ আমি তখনো হেসেছিলাম। সারাদেশই যখন জেলখানায় আছে তখন স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রলোভনে আমার মতো মানুষ বিশ^াস করবে?

ভাবতে ভাবতে লিপির দিকে তাকালাম। সে অন্যমনস্কভাবে আংটির রুবিটা পলিশ করার মতো করে অন্য হাতের আঙুল চালাচ্ছে। তার থমকে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ঠিক আছে, যাই, পত্রিকায় চাকরি করি। চারদিকে কী ঘটছে তার কিছুটা হলেও যদি মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারি, সে-ও তো এক কাজই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, পরদিন পত্রিকা অফিসটার ঠিকানা জেনে রওনা দিলাম।

একতলা অফিসটার খাঁচার মতো গ্রিলওলা বারান্দার সামনে পৌঁছে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করব বলতেই দরজা খুলে গেল। সামনে লম্বা করিডোর। করিডোরের শেষ মাথায় কয়েকজন লোকের আলাপ বা হাসিঠাট্টা শোনা যাচ্ছিল। করিডোরের শেষ লক্ষ্য দরজাটা পেরোতেই ভেতর থেকে একজন হইহই করে উঠলেন, ‘অ্যাই, স্যান্ডেল বাইরে স্যান্ডেল বাইরে!’ থেমে নিয়ে নিজের স্যান্ডেলের দিকে তাকালাম। কী আশ্চর্য! অফিসে এসে স্যান্ডেল বাইরে রেখে ঢুকতে হবে কেন, এটা কি মসজিদ?

অনিচ্ছাকৃতভাবে পেছনে ঘুরতে যাচ্ছি, টেবিলের ওপার থেকে একই কণ্ঠ বলে উঠলেন, ‘এই তুই বাইরে একগাদা স্যান্ডেল দেখতে পাচ্ছিস না? এখানে স্যান্ডেল খুলে ঢুকতে হবে, এটা তো বোঝা যাচ্ছে, নাকি?’

ঘরটার এমাথা-ওমাথা লাল রঙের কার্পেট মোড়ানো। মাঝ বরাবর পেছনের দিকে একটা টেবিল-চেয়ার। লোকটা মেয়েদের শাড়ির মতো দেখতে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সেখানে বসে আছে। বুকের ওপরে বোতাম লাগানোর পট্টিটা শাড়ির পাড়, আমি নিশ্চিত। তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি আমাকে তুই করে বলছেন কেন? আপনার সঙ্গে আমার কি পরিচয় আছে?’

‘আমি তো সবাইরেই তুই বলি। তোর সমস্যা কী? এইখানে কী চাস?’

‘আমি রিপোর্টারের চাকরির কথা শুনে আসছি। আপনি সম্পাদক এই পত্রিকার? কিন্তু আপনি তুই করে বললে আর এই স্যান্ডেল যদি বাইরে খুলতে হয় …  তাইলে থাক।’

আমি পেছন ফিরে হাঁটা দিতেই ঘরের আরেক দিক থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি, সম্পাদকের টেবিলের পাশে দেয়াল ঘেঁষে কয়েকজন লোক খুব নিচু সোফায় বসে আছে। দেখলে মনে হয় তারা যেন মেঝেতে বসে আছে। আজব কাজকারবার এই অফিসের। অফিস নাকি অন্য কিছু। ভাবসাব পছন্দ হলো না বলে আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সম্পাদক সাহেব পেছন থেকে হুঙ্কার দিয়ে ডাকলেন, ‘ওই তুই যাবি না, এইখানে দাঁড়া।’

‘দেখেন, টেবিলের নিচ দিয়া দেখতেছি আপনি স্যান্ডেল পরে আছেন। তাইলে আমি কেন স্যান্ডেল খুলে আসব? আপনার কার্পেট ময়লা হবে? কার্পেট সরান, তারপর আসবো।’

আমি আর দাঁড়াইনি। কিন্তু পেছন থেকে শুনতে পেলাম, ‘ওই যাবি না। আমি বুচ্ছি তুই কে, ছাত্রনেতা আছিলি, দেখছি মনে হয় আগে। আমি পলিটিক্যাল রিপোর্টার খুঁজতেছি। তোরে আমার দরকার।’

‘কিন্তু আমি এইখানে চাকরি করব না। আপনি আবার আমাকে তুই করে বলতেছেন!’

‘আরে বাবা, আমি তো সবাইরেই তুই বলি। তোর কেন সমস্যা হইতেছে?’ বলে নিয়ে তিনি পাশ ফিরে কাউকে খুঁজলেন, তারপর আগের মতোই জোরে বললেন, ‘এই যে সহকারী সম্পাদক, এরে যাইতে দিও না। এর তেজ আছে, ভর্তি কইরা লও। ওই তুই কাজ বুইঝা নিয়া তারপর যাবি।’

শেষের কথাটা তিনি আমাকে বলেছেন, সন্দেহ নেই। মেঝের কাছাকাছি সোফায় বসে থাকা লোকগুলি আরেক প্রস্থ হেসে উঠল। আমার ভীষণ অপমানিত মনে হচ্ছিল নিজেকে। লোকগুলির মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাই, আসেন আমার সঙ্গে, এই যে এইদিকে।’ মনে হচ্ছিল ছিটকে বেরিয়ে যাই, কিন্তু লিপির আংটি বিক্রিটা ঠেকাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম, চোখকান বন্ধ করে মাসখানেক কাজ করলে দোষ কী! এর মধ্যে আরেকটা চাকরি জোগাড় করে নেব। তাছাড়া, এই খারাপ সময়ে মাসচারেক হলো পত্রিকাটা শুরু হয়েছে, কয়দিন টেকে তাই-বা কে জানে!

সম্পাদকের ঘর বাদে বাকি অফিসটা আমার বেশ পছন্দ হলো। নিজের কাজের জায়গাটাও। আর সহকারী সম্পাদকের ব্যবহার ভালো, অন্তত ওরকম তুই-তোকারি নেই, সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানেন। তবে সপ্তাহখানেকেই বুঝলাম, অ্যাপ্রেন্টিস রিপোর্টারের সাময়িক চাকরি হলেও যা ছাপতে চাই, তা লিখে দিলেই হয়ে যায়। আমার জানামতে লেখায় যুক্তি থাকলেই তো আর পত্রিকারা ছাপে না, পত্রিকার লোকদের সাহসও থাকতে হয়। দেখলাম, এই সম্পাদকের সাহস আছে। উত্তাল সময়টাতে বিশ^বিদ্যালয়ের পরিচিতদের সূত্র ধরে আমি শহরের এমাথা-ওমাথা ঘুরি, আটকে যাই যখন যেখানে আন্দোলন দানা বাঁধে। একের পর এক জ¦ালাময়ী রিপোর্ট লিখি। কয়েকদিনের মাথায় আমার রিপোর্ট ভেতরের পাতা থেকে সামনের পাতায় উঠে আসে, টানা তিনদিন লিড হয়ে অফিসে আর অফিসের বাইরেও হইচই পড়ে যায়।

সম্পাদক ববি ভাইয়ের ঘরে না ডাকলে যাই না। ওইসব স্যান্ডেল খোলার ঝামেলায় কে পড়ে, তারপর আবার প্রাগৈতিহাসিক সামন্তরাজের মতো তিনি চেয়ারে বসে থাকবেন আর বাকিদের বসতে হবে প্রায় মেঝেতে। পারতপক্ষে ওই ঘরে আমাকে না ডাকলেই ভালো। তবে তাঁর সঙ্গে দু-একবার যা দেখা হয়েছে, কেন যেন মনে হয়েছে, যে সুরে তিনি কথা বলেন, তাতে ‘তুই’ সম্বোধনটা বেশ মানিয়েই যায়। তাই প্রথমদিনের মতো অস্বস্তি পরে আর লাগেনি।

একদিন অফিসের প্রত্যেকের বাধ্যতামূলক মিটিংয়ে ববিভাই হঠাৎ সহকারী সম্পাদককে লিড রিপোর্টগুলির জন্য ধন্যবাদ দিতে লাগলেন। বললেন, এরকম সংযত ভাষায় যা ঘটছে তার বিবরণ লেখা হচ্ছে বলেই তা উনি নির্বিঘ্নে ছাপতে পারছেন। আমি চুপ করেই ছিলাম, কিন্তু আমার উপস্থিতিতে সহকারী সম্পাদকের সৌজন্যবোধে লাগল। তিনি মেঝের কাছাকাছি থেকে উঠে বললেন, ‘এসব রিপোর্ট তো আমি লিখিনি, ববিভাই, ওই যে ও লিখছে।’ সহকারী সম্পাদকের তাক করা আঙুল অনুসরণ করে ববিভাই আমার দিকে চমকে তাকালেন, ‘ও? ও লিখছে এইগুলা? এই সব লিড ও লিখছে? অ্যাপ্রেন্টিস রিপোর্টার?’

‘জি, ববিভাই,’ সহকারী সম্পাদককে আকস্মিক খুব বিনয়ী মনে হলো। আমি সামনে না থাকলে ববিভাইয়ের এই প্রশংসার জবাব হয়তো অন্যরকমও হতে পারত। আমার ভাবনার ফাঁকে ববিভাই আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘ওই তুই বলবি না যে তুই এইগুলা লিখতাছস? আজব কথা তো! অ্যাপ্রেন্টিস রিপোর্টারের রিপোর্ট দিয়া একের পর এক লিড? ওই তোর বেতন কত? এইখানে তো এখন ওপরেরগুলার বেতন কমাইয়া তোরটা বাড়ানোর কাম।’

আমি যথারীতি চুপ করে থাকলাম। ববিভাই হুঙ্কার দিলেন, ‘ব্লাডি সোয়াইন…’

আমি ততদিনে জেনেছি অফিসের অ্যাকাউন্ট্যান্টকে তিনি ওভাবে ডাকেন। বিষয়টা প্রথম প্রথম আমার যাচ্ছেতাই বাজে লেগেছিল। লোকটার সভ্যতা সম্পর্কে আমি আগেই সন্দিহান ছিলাম, ওই ডাক শোনার পরে তাঁকে নিশ্চিত অভদ্র ধরে নিয়েছিলাম। পরে জেনেছি, ওই অ্যাকাউন্ট্যান্ট তাঁর আপন শ্যালক। বিয়ে করার পর থেকেই নাকি শ্যালককে ওভাবে ডাকছেন তিনি।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট নোটবুক আর কলম হাতে উপস্থিত হলো। ববিভাই আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওর বেতন বাড়াইয়া দাও, ফিফটি পারসেন্ট। আর এদের সবার … না থাক।’ ঘরে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা ছিল, তিনি ‘না থাক’ বলাতে প্রত্যেকে নড়েচড়ে বসল। তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন, বললেন, ‘কই থাকস তুই?’

আমি বললাম, ‘শেওড়াপাড়া।’

‘মিরপুর? সেইটা তো দূর।’

‘জি।’

‘আইজ অফিস শেষ হইলে আমি তোরে বাড়িতে নামাইয়া দিবো।’

অফিস শেষের পরে আমি অফিসের পার্কিংয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সম্পাদক এতগুলি লোকের সামনে আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, চট করে চলে যেতে পারি না। আবার মন কিছুতেই তাঁর সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে সায় দেয় না। অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে পরের দিনের পাতা ছাড়া শেষে রাত সাড়ে দশটার দিকে ববিভাইয়ের ঘরের বাতি নিবল। তিনি বেরিয়ে এসে পার্কিংয়ে দাঁড়ালেন, ‘ওই তুই আছিস? খুব ভালো করছিস।’

‘আপনি বলছেন তাই আছি আমি, কিন্তু ববিভাই আমি আপনার সঙ্গে যাব না।’

‘ক্যান?’

‘শেওড়াপাড়া তো দূর, ওইদিকে যাওয়ার নাম কইরা আপনি যদি আমারে ফার্মগেটে নামাইয়া দিয়া গুলশানের দিকে চইলা যান? তাইলে রাস্তার সবাই দেখবে যে আমি দামি গাড়ি থেইকা নাইমা আইসা বাসে চড়তেছি। ওইটা খুব খারাপ হবে।’

ববিভাই হো-হো করে হাসলেন, ‘ওই তুই কথা কম ক’,  যা, ফার্মগেটে নামাবো না। নে ওঠ এবার গাড়িতে।’

পুরো রাস্তায় ববিভাই সম্পাদক হিসেবে  তাঁর সংগ্রামের কথা বলতে থাকলেন। কত রকমের সরকারি, বেসরকারি, এমনকি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থাকতে হয়। প্রায়ই মনে হয় কালকেই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আবার কোনো না কোনো কৌশলে সমস্যা উতরেও যান। আমার মতো লোক আশেপাশে থাকলে তাঁর বিপদ মোকাবিলা করা সহজ হবে – এইসব নানান কথা। আমার বেতন বাড়াতে পেরে তিনি খুব খুশি। আমার কাজেও তিনি যারপরনাই আনন্দিত। কথায় কথায় শেষে যখন শেওড়াপাড়ায় এসে আমার বাড়ির গলির মুখে গাড়ি থামাতে বলি, তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুই এতদূর

আসা-যাওয়া করিস ক্যামনে?’

আমি বললাম, ‘কেন, অফিসের টেম্পোতে?’

‘ওই, তুই আমার টেম্পোর এত্ত তেল খরচ করিস? সবই তো খাইয়া ফালাইতেছিস দেখি!’

আমি তাঁকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অন্ধকার সরু গলিটাতে ঘাপটি মারার মতো ঢুকে পড়ি। দ্রুত পা চালাই। পেছনে ফিরে দেখি রাস্তার বাতির নিচে দাঁড়ানো বড়োসড়ো সাদা গাড়িটা ইউ টার্ন করার জন্য ডানদিকে বেঁকে যাচ্ছে।

টেম্পোর তেল খরচের দুঃখ ভোলাতে আমি দিনকয়েক ববিভাইয়ের সামনে পড়ি না। তবে আমার রিপোর্ট লিড হয়ে একইরকমের হইচই ফেলাতে সেই মাসে পরপর তিনবার আমার বেতন বাড়ে। ববি ভাই প্রতিবারই মিটিংয়ের মাঝখানে ডাক দেন, ‘ব্লাডি সোয়াইন …’ রুমের অন্যেরা অস্বস্তি বোধ করে, আমি বুঝতে পারি। তারপর ববিভাইয়ের মুখে ‘না থাক’ শুনলে তারা নড়েচড়ে বসে। ওই মাসের শেষে আমার বেতন দ্বিগুণের বেশি হয়। লিপি খুশি। আমরা শেওড়াপাড়ার অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে মোহাম্মদপুরের দিকে ছোট্ট একটা আলোময় বাসায় এসে উঠি।

ববিভাই মাঝেমধ্যে অবসর সময়ে আমাকে রুমে ডাকেন। দেশের অবস্থা, আন্দোলন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করেন। বাসা বদলানোর কথা শুনে খুশি হন, অনেকদিন বাদে তার টেম্পোর তেলের কথা মনে পড়ে, ‘যাক, তুই এখন কম তেল পুড়াইবি, এইটা ভালো।’

আমি তার কথায় হাসি। হুট করে জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা, ববিভাই, আপনি সবসময় শাড়ির মতো দেখতে পাঞ্জাবি পরেন কেন? এইগুলা কই পান?’

ববিভাই হাসেন, ধরা পড়ে যাওয়ার মতো মুখে খানিকটা লজ্জাও এসে পড়ে তাঁর, বলেন, ‘কাউরে বলিস না, বউয়ের শাড়ি কাইটা পাঞ্জাবি বানাই। হইছে কী, ওরে শাড়ি দিলে একবার পইরা নিয়াই বোনগুলারে দিয়া দেয়। আমার এইটা ভাল্লাগে না। তাই একবার পরার পরেই শাড়িটা মাঝখান দিয়া কাইটা ফেলি।’

ওই প্রথম ববিভাইয়ের সামনে বসে আমি জোরে জোরে হাসি আর তিনি বিব্রত মুখে বসে থাকেন।

তিন

শাহবাগের দিক থেকে বিশাল মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমি পল্টনের দিকে যেতে থাকি। পুলিশের গাড়ি মিছিলের পেছনে ধীরে ধীরে এগোয়। কিছু পুলিশ হাতে অস্ত্র বা লাঠি নিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে পেছনে পেছনে হাঁটে। মিছিলের মধ্যেও মানুষজনের হাতে লাঠি বা সরু বাঁশ থাকে। সেসব শূন্যে তুলে ধরে তারা সেøাগান আওড়ায়। আমরা এগোতে থাকলে অলিগলি থেকে প্রতিবাদী মানুষের ছোট ছোট দল মিছিলের সঙ্গে ভিড়ে যায়। যেন সরু খাল আর নালা এসে মিশছে বড় নদীতে। বড় নদীটাতে তখন উথালপাথাল স্রোত।

আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ধাক্কাধাক্কির পরে আবারো লাইন সোজা করে এগোতে চেষ্টা করি। মিছিলের মধ্যেই বিশ^বিদ্যালয় জীবনের পরিচিত বা কমরেড কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হাতে হাত মেলাই। কেউ চমকে বলে, ‘আরে ভাই আপনি! কই আছিলেন এত দিন?’ কেউ বলে, ‘রাজনীতিটা ছাইড়া দিলেন? ভাবছিলাম আপনারে সক্রিয় রাজনীতিতে দেখব।’ কেউ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, ‘ফির‌্যা আইলেন মনে হয়!’ ঢেউয়ের মতো ধাক্কা আসে মুহুর্মুহু, সামলে নিয়ে আবারো চলতে শুরু করি সবাই মিলে।     

নয়াপল্টনে গিয়ে দেখি পল্টন থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিশ-পঁচিশজনের একটা মিছিল আসে আর যায়। অন্তত দুবার আমাদের চোখের সামনে দিয়ে রাস্তার আরেকদিক দিয়ে মিছিলটা যাওয়া-আসা করে। পুরো রাস্তাই মিছিলগুলির দখলে, গাড়ি নেই। ছোট মিছিলটায় একটা ছেলের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ে যার বুকে ও পিঠে সেøাগান লেখা। গায়ে কাপড় নেই, একেবারে সরাসরি চামড়ার ওপরে সাদা রং দিয়ে সে ভুল বানানে পিঠে লিখেছে, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আর বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক।’ সকালের কুয়াশা কেটে কটকটে রোদ ওঠাতে সাদা রঙে তার বুক-পিঠ ঝলমল করে। মিছিলের পদচারণা আর সেøাগানের তালে তালে লেখাসমেত তার অস্থির শরীরটা দুলে উঠতে দেখে আমি শিউরে উঠি। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ নয়াপল্টনের সন্ধানী পত্রিকার অফিসের সামনে গোলাগুলির আওয়াজ পাই। মনে হয় মিছিলটাকে দুই দিক থেকে পুলিশ ঘিরে ধরছে।

হুড়মুড় করে যে যেদিকে পারে দৌড় লাগায়। আমি ভাবি সন্ধানী অফিসে গিয়ে ঢুকবো; কিন্তু সেদিকে এগোতেই টিয়ার গ্যাসে জায়গাটা অদৃশ্য হয়ে যায়। চোখের জ¦ালায় নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ মনে হয়। কোনো এক অচেনা দেয়াল ধরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকি। সামনের গ্যাসের ধোঁয়াশা সামান্য কমলে অস্পষ্ট নজরে মনে হয় সন্ধানী অফিসের গেট বন্ধ। ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। কে যে কোন দিকে দৌড় দিচ্ছে কিছু বুঝতে পারি না। আমিও কারো কারো সঙ্গে অন্ধের মতো দৌড়াতে থাকি। কে যেন কাকে বলে, ‘ওই যে কবির হোটেলের দিকে যান।’ আমিও তাদের অনুসরণ করে হোটেলে ঢুকে পড়ি। তাতে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া থেকে বাঁচা যায় অন্তত। চোখ কচলে বাইরের দিকে দেখতে থাকি। একবার কয়েকজন মানুষ দৌড়ে যায়, তারপর আবার হাতে অস্ত্র তাক করা দু-একজন পুলিশ। রাস্তায় আধলা ইট আর লাঠিতে সয়লাব। যুদ্ধের ময়দানের মতো এক দল আরেক দলকে পর্যায়ক্রমে আক্রমণ করতে থাকে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আমি কাঁধের ঝোলা ব্যাগে সবকিছু দেখে নিই। নোটবুক, কলম, সব ঠিকঠাক আছে তো? হঠাৎ করে নিজের কাছে কেমন যেন ছোট হয়ে যাই। দুদিন আগেও ছাত্র ঐক্যের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে আধলা ইট তুলে আমি পুলিশের গাড়ি লক্ষ করে ছুড়েছি। পুলিশকে উত্ত্যক্ত করে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় মিছিলের প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছি আর এখন কি না লুকিয়ে আছি একটা নিরাপদ জায়গায়! বিয়ে করে আর তা বাঁচাতে গিয়ে একটা চাকরি ধরে আমার জীবনের মূল্য কি এতটাই বেড়ে গেল?

আমার ভাবনা শেষও হতে পারে না, তার আগেই একদল পুলিশ হোটেলটার ভেতর ঢুকে পড়ে। অনেকে চেয়ার-টেবিলের নিচে আত্মগোপন করে। আমি কেন যেন লুকানোর চেষ্টা করি না। পুলিশ টেবিলের নিচ থেকে কয়েকজনকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে চড়থাপ্পড় লাগাতে থাকে। আমি একদিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি। আমার দিকে তেড়ে এলে হাত দিয়ে ঠেকাই। হঠাৎ কোন দিক থেকে যেন কয়েকটা ছররা গুলি এসে আমার হাতে লাগে। পুলিশটার গায়েও লাগে হয়তো। সে আমার সামনে থেকে দ্রুত সরে যায়। খানিক অপেক্ষা করে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি, সব দিক শান্ত। একটু আগের হই-হট্টগোল সবকিছুই যেন জাদুর বলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কোথায় মারমুখী মানুষ আর কোথায় পুলিশের গাড়ি! ধোঁয়া বা গুলির আওয়াজও নেই। বরং সে-জায়গায় বাঁশের কঞ্চিতে লাল পতাকা উড়ছে। বামপন্থী দলগুলির মিছিল চলে যাচ্ছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। কবির হোটেল থেকে বেরিয়ে আসি।

দু-তিনবার পল্টন-সচিবালয়-জিপিওর দিকে চক্কর দিই। হঠাৎ দেখি সচিবালয়ের দিকে একটা জিপ এগিয়ে যাচ্ছে। জিপকে ঘিরে বড় মিছিল। সামান্য এগোতেই দেখি গাড়িটাতে নেত্রী শেখ হাসিনা বসে আছেন। তখনো সকাল এগারোটা বাজেনি। এগারোটায় ঘেরাওয়ের কথা হয়েছিল। পুলিশ বক্সের কাছে নেত্রীর গাড়ি থামে। গাড়ির ছাদ সরিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। তারপর হ্যান্ড মাইকে আহ্বান জানাতে থাকেন। সচিবালয় আর বীমা অফিস থেকে সবাইকে বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নিতে অনুরোধ করেন তিনি। সেদিকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ দেখি জিপের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ওই ছেলেটি, শরীরে যার কোনো কাপড় নেই, শুধু বুকে-পিঠে প্রতিবাদী দুটো বাক্য লেখা। তখন তাকে পেছন থেকে দেখেছিলাম, এবারে দেখা যাচ্ছে সামনে থেকে। নেত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে সে মুঠি করা হাত তুলে সমর্থন জানাচ্ছে। পুলিশ নেত্রীর গাড়ি আর মিছিল থেকে বেশ দূরে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কেন যেন তখন হঠাৎ উদোম গায়ের ছেলেটার জন্য বুক কেঁপে ওঠে। পুলিশ যদি ওকে সামনে পেয়ে যায়? হঠাৎ লক্ষ করি, নেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য শেষ করে হ্যান্ড মাইক সরিয়ে ছেলেটার দিকে ঝুঁকে যান। কী যেন বলেন তাকে। এদিক থেকে শোনা যায় না। তবে কেন যেন মনে হয় নেত্রীও কি আমার মনের কথাই বললেন? তাকে হয়তো গায়ে শার্ট চড়াতে বলতে পারেন। মনে করিয়ে দিতে পারেন যে, পুলিশ তাকে ওই অবস্থায় দেখলে কিছুতেই ছাড়বে না।

নেত্রীর জিপ সামনে এগোয়। মিছিলের খানিকটা অংশ তার সঙ্গে এগিয়ে চলে। যারা থাকে তারা পল্টন এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় জটলা করে সেøাগান দেয়, বক্তৃতা করে আর গণসংগীত গাইতে থাকে। আঙুলে ছররা গুলি লাগার কারণে আমি ঠিকমতো নোট নিতে পারি না। আঙুল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর মিছিলমুখর পরিবেশ নতুন করে তৈরি হতে না হতেই আবারো গোলাগুলির শব্দ পাই। জায়গাটা সঙ্গে সঙ্গে খালি হয়ে যায়। অনেকের সঙ্গে আমিও দৌড় লাগাই। দৌড়াতে দৌড়াতে যায়যায়দিন পত্রিকার অফিসে ঢুকে পড়ি। সেখানে গিয়েও আমাদের দৌড় থামে না। সোজা উঠে পড়ি দোতলায়। গোলাগুলিও থামে না। গুলি জানালার চৌকাঠে এসে লাগে, দেয়ালের চুনসুরকি খসেৃ আমার ঘাড়ে পড়ে ঝুরঝুর করে। শরীরে কেমন শীতল একটা অনুভূতি খেলে যায়। সেখানে কেউ বেশিক্ষণ থাকে না। গোলাগুলি থামতেই বেরিয়ে পড়ে। চড়া দুপুর তখন, তবু শীত শীত লাগে। সকালের কুয়াশার রেশ অনেক আগেই চলে গেছে, তখন সামনে বিস্তৃত শূন্য রাস্তা। কেউ কেউ হাঁটতে শুরু করে শাহবাগের দিকে। সচিবালয়ের দিকটায় পুলিশ ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। আমিও তাই শাহবাগের দিকে হাঁটি। এরপর কখন যেন পুলিশের গাড়ি পেছনে এসে থামে। টুপটাপ রাস্তা থেকে মানুষ তুলতে থাকে। ঘাড়ের পেছনে বলিষ্ঠ হাত অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে গলায় চেপে বসে। আমি সুড়সুড় করে বাক্সটাতে উঠতে বাধ্য হই। মনে মনে ভাবি, ঠিক আছে দেখি কী করে! যতক্ষণ তিল পরিমাণ জায়গা থাকে ততক্ষণ মানুষ ওঠানো চলে। ভেতর থেকে মনে হয় চলমান কোনো গুহায় ঢুকে পড়েছি।

চলতে চলতে একসময় গুহার মুখ খোলে। দেখি শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুম। ঘাড়ের দিকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য একটা হাত এগিয়ে আসে। আমি সেটা ঠেকাই, বলি, ‘আমি সাংবাদিক।’

‘তাই নাকি? কোন পত্রিকা? কার্ড দেখান’, গম্ভীর গলাটা বলে।

বুকপকেটে হাতড়াতে গিয়ে দেখি শার্টের শরীর থেকে পকেট কখন ছিঁড়ে উবে গেছে বুঝতেও পারিনি। বুকে হাতড়ে নিয়ে বলি, ‘এই যে সেলাইয়ের দাগ আর ছেঁড়া সুতো দেখা যাচ্ছে, এখানেই পকেট ছিল, আর তার মধ্যে কার্ড।’

পুলিশটা ভীষণ রেগে যায়, ‘ফাইজলামি করস?’ হাতের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার ঘাড়ে আঘাত করে। অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার বেরিয়ে আসে আমার মুখ থেকে। নিচু হতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ করি বারান্দায় তালগোল পাকিয়ে লাশের মতো পড়ে আছে সেই ছেলেটা, যার শরীরে সাদা রঙে প্রতিবাদের ভাষা লেখা। পিঠের দিকটা দেখা যাচ্ছে, কচ্ছপের খোলসের মতো উঁচু হয়ে আছে। মুক্তি শব্দটার ওপর দিয়ে একটা সরু রক্তের ধারা বয়ে গেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, পিঠটা নড়ে উঠল! আমি ফিসফিস করে কাছের কাউকে বললাম, ‘ও বেঁচে আছে এখনো।’ তারপর যে পুলিশটা আমাকে মারল তাকেই বললাম, ‘ও কিন্তু বেঁচে আছে এখনো। হাসপাতালে নিন না …’

পুলিশটা কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড়ের আরেক দিকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। আমি সোজা মেঝেতে পড়ে যাই এবার। পেছনের একজন আমাকে ধরে ওঠায়। ফিসফিস করে কানের কাছে বলে, ‘ওর গায়ে গুলি কখন লাগছে কে জানে, কিন্তু গোলাপ শাহের মাজারের কাছে থেইকা ধইরা আনছে। আমি দেখছি, গুলি লাগা শরীরটা অচেতনের মতো রিকশায় কোনোরকমে টিক্যা আছিল। কেউ মনে হয় হাসপাতালে নিতেছিল। সেইখান থেইকা ছিনাইয়া আনছে।’

‘বলেন কী!’ আমার গলা চড়ে গেলে পেছনের লোকটা আমার মুখ চেপে ধরে, বলে, ‘আস্তে বলেন, ভাই। ওরে তো মনে হয় মাইরাই ফেলছে, চিল্লাইলে আপনারেও রাখবে না।’ লোকটার কথায় আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও খানিক বাদে আর চুপ থাকতে পারি না। কাছে একজন পুলিশ পেয়ে ছেলেটার কথা জানতে চাই। এই পুলিশ আগের পুলিশের মতো আমাকে মারে না। বলে, ‘ও তো মইরা গেছে গা। গুলি লাগছে।’ মানুষজনের ভিড়ে আমি মাথা উঠিয়ে বারান্দার দিকে উঁকি দিতে চাই।

 কিছু দেখা যায় না। কিংবা তখন ছেলেটার লাশ আর সেখানে নেই। হঠাৎ শরীর অবশ অবশ লাগে। গায়ে উলকির মতো সেøাগান আঁকা জলজ্যান্ত ছেলেটাকে সকালের দিকে দুবার দেখার স্মৃতি মনে পড়ে। টগবগে, প্রাণবন্ত আর সংকল্পবদ্ধ। পুলিশের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের মতো করেই সে নিজেকে সাজিয়েছিল বটে।

পুলিশকে অনেকবার বলি, ‘আমাকে ছেড়ে দেন, আমি পত্রিকায় কাজ করি। কালকের জন্য রিপোর্ট লিখব।’  কে শোনে কার কথা। তারপর ধীরে ধীরে বিকেল গড়িয়ে রাত নামে। মনে মনে নিজের ওপরে বিরক্ত হই। আঙুলের ব্যথায় লিখতেও পারব না, না হলে ওখানেই মেঝেতে বসে রিপোর্টটা লিখতাম। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই ছেলেটা, আহা … ও ইতিহাসের অংশ হবে, আমি জানি।

আমার ভাবনার মাঝখানে দুজন পুলিশ আসে। একজন আরেকজনকে বলে, ‘এদেরকে জেলহাজতে পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।’ শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আর ঠিক তখনই দেখি থানার দরজা দিয়ে ঢুকছেন ববিভাই।

চার

ববিভাই সোজা শিকের সামনে চলে আসেন। আমি শিক ধরে দাঁড়াই, ‘ববিভাই, আসছেন! এরা তো বলতেছে হাজতে পাঠায়ে দিবে।’

‘তুই এইখানে কেমনে ঢুকলি? ছাগল কোথাকার! ভাগ্যিস একজন দেইখা গিয়া আমারে বলছে।’

‘কী করব, এরা তো একটা ফোনও করতে দিতেছে না।’

‘আরে তোর আইডি দেখাইবি না?’

‘ধস্তাধস্তির মধ্যে আইডি কোথায় গেছে ভাই কইতে পারি না। আর এরা কি সত্যি কথা শোনার মানুষ!’

‘আচ্ছা, দাঁড়া দেখি কী করা যায়।’

দূর থেকে ববিভাইয়ের পাঞ্জাবির ঝুলে থাকা অংশের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। চেয়ারে বসে কারো সঙ্গে কথা বলছেন মনে হয়। শাড়ির আঁচলের শেষ প্রান্ত, তাই আঁচলের মতো সেটা ফ্যানের বাতাসে ওড়ে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভরসা পাই। ববিভাই নিশ্চয় আমাকে ফেলে যাবেন না। ভাবতে ভাবতেই ববিভাই একটা কাগজ হাতে সামনে এসে দাঁড়ান। একজন শিকের দরজাটা খুলে দেয়। ববিভাই হাসেন, ‘চল। তুই নাকি পুলিশরে মারছস?’

‘কে বলল? আমারে মারতে আসলে আমি ঠেকাব না? ওরা এমনেই যারে সামনে পাইছে তারেই উঠাইছে।’

‘চল এখন। মাইরটা দেখাইতে হবে পত্রিকার পাতায়। এইসবের মধ্যে তুই যাস কেন? ছাত্রজীবনের অভ্যাস ছাড়তে পারস না? দূর থেইকা দেখবি।’

ববিভাইয়ের এই কথার অবশ্য উত্তর নেই আমার কাছে। রিপোর্ট লেখার জন্য মিছিলের মাঝখানে গিয়ে সেøাগান দেওয়ার দরকার ছিল না। আমি তখন ভুলে গেছিলাম কী কারণে মিছিলটাকে অনুসরণ করছি। তারপর অনুসরণ করতে করতে কখন গিয়ে পৌঁছেছি মিছিলের মধ্যভাগে, এরও কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এসব ভেবে লজ্জা লাগে, চুপ করে থাকি। ববিভাই গাড়িতে বসলে তাঁর পাশে বসি। অফিসে নেমে নিজের ডেস্কের দিকে যেতে থাকলে ববিভাই গম্ভীর মুখে বলে, ‘আইডি ছাড়া তুই এখন এইসমস্ত জায়গায় একদম যাবি না। আগে একটা বানায়ে নে। আর রিপোর্ট লেখা হইলে সোজা বাসায় যাবি, ঠিক আছে? রাস্তায় বিপ্লবী হওয়ার দরকার নাই তোর।’

আমি ওপর-নিচে মাথা নাড়াই।

রাত সাড়ে দশটা প্রায়। পরের দিনের পত্রিকার নানান সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মিটিং শেষ করে রিপোর্টে মনোযোগ দিতে যাব, জুনিয়র মৃদুল এসে পাশে দাঁড়ায়। কাজ করতে করতে মৃদুলের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হতো। তাকে দেখে মনে হলো আমাকে কিছু বলতে চায়। চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসে। তারপর গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে, ‘ভাই, যে-ছেলেটারে দেখছেন বললেন, তার বিষয়ে আমার কাছে কিছু তথ্য আছে।’

‘কোন ছেলে?’

‘ওই যে একটু আগে ডেইলি মিটিংয়ে বলতেছিলেন, গায়ের মধ্যে উলকির মতো আঁইকা সে …’

‘হুম। মারা গেছে বেচারা।’

‘ভাই, ছেলেটার নাম নূর হোসেন।’

‘তাই নাকি? তুমি কীভাবে জানলা? ওরে চিনতা?’

‘না। আমাদের পাড়ায় একটা সাইনবোর্ড পেইন্টিং করার দোকান আছে। সেইখানে এক ছেলে কাজ করে, নাম ইমরান। আমি তারে চিনতাম।’

‘মানে?’

‘ওই ইমরানই নূর হোসেনের গায়ে ওইসব লিখছে, ভাই।’

আমি রিপোর্ট শুরু করতে পারি না। থমকে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে থাকি।

‘বলো কী! খুব সাহসের কাজ করছে। কিন্তু আসলে সময়টা, মানে, এইটা ওইভাবে ঠিক এখনই না করলে …’

‘আসলে হইছে কী, ভাই, নূর হোসেনই তাকে ওইসব লিখতে বাধ্য করছে। বলতে বলতে সে হাউমাউ কইরা কানতেছিল। সে ভাবতেছে তার জন্যই ছেলেটা মারা গেল। সে যদি ওর কথা শুইনা না লিখত গায়ে তাইলে হয়তো …’

‘তাইলে লিখছে ক্যান?’

‘ওই যে বললাম, নূর হোসেন আইসা তারে জোর করছে।’

মৃদুল বলে আর আমি অবাক হয়ে শুনি। নূর হোসেন নিজেই এই কৌশল আবিষ্কার করেছে। ইমরান তার পরিচিত ছিল। তাই ইমরানের কাছে এসে বলেছে, ‘ভাই আজকে আপনাকে এমন জায়গায় লিখতে হবে, যেখানে আগে কখনো লেখেন নাই।’ ইমরান অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে, ‘সেইটা কোন জায়গা?’ নূর হোসেন এক টান দিয়ে গায়ের শার্ট খুলে ফেলেছে। তারপর দুটো লাইন লেখা একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরে বলেছে, ‘এই যে, এই লাইনটা পিঠে আর এই লাইনটা বুকে লিখে দেন।’ ইমরান ভয় পেয়েছে দেখে, লিখতে চায়নি। কিন্তু লিখবে না বলাতে নূর হোসেন তাকে একটা গল্প শুনিয়েছে, তা হলো, আজকে সচিবালয় ঘেরাও মিছিলে অন্তত একশজন মানুষ এই কথাগুলি বুকে-পিঠে লিখে নিয়ে উপস্থিত হবে। রাস্তায় এই পরিস্থিতি দেখলে ঘরের মানুষ জাগতে বাধ্য। বলতে বলতে নূর হোসেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, ‘আপনি বুঝতাছেন, ইমরানভাই? এইটা মানুষের গায়ে গায়ে লিখলে কিন্তু পুরা বিষয়টাই অন্যরকম হইয়া যায়। স্বৈরাচারী সরকার এইবার পড়বেই পড়বে দেইখেন।’ ইমরান লেখার জন্য রাজি হতেই সে আব্দার করে যে, এত সুন্দর করে লিখতে হবে যেন একশজনের গায়ে একই কথা লেখা থাকলেও তারটা অন্য সবার থেকে আলাদা হয়। দেখলেই যেন পার্থক্য বোঝা যায়। ইমরান তাই ভুল বানানে লেখা বাক্যদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে এক ফন্দি আঁটে। তার মন বলে, নূর হোসেনের লেখা বাক্যগুলিতে যে ভুল বানান আছে, ঠিক সেভাবেই যদি লেখা হয়, তাহলেই তো অন্যদের থেকে আলাদা হলো!

ইমরান তখন নূর হোসেনের হাতে ধরা কাগজটা দেখে দেখে ঠিক সেভাবেই তার বুকে আর পিঠে লিখতে থাকে, নিপাত কে নীপাত, গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র।

‘যাই হউক, ভাই, তখন তো ঠিকই লিখ্যা ফেলছে কিন্তু এখন একদিকে অপরাধবোধে ভুগতেছে, আরেকদিকে পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে পালাইয়া বেড়াইতেছে। আমার সঙ্গে যখন দেখা তখন ঢাকা ছাড়ার জন্য দৌড়ায়ে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছে। অন্য একজনরে এই কাহিনি বলার সময়ে আমি শুইনা ফালাইছি দেইখা আমার পায়ে পইড়া সে কী কান্না!’

‘কেন?’

‘সেইটাই তো। আমি কইলাম কী হইল? সে কয় আপনে তো পত্রিকার লোক, আমার নামটা ছাপবেন না, ভাই। পুলিশ তাইলে আমারেও নূর হোসেনের মতো গুলি কইরা মারবে।’

‘হুম … ঠিক আছে, মৃদুল, আমি কালকের লেখাটা ছাড়বো। এখন তাইলে কাজ করি।’

মৃদুল চলে গেলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। এই তো দুপুরেও তরতাজা ছেলেটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল! ওর লাশ নিয়ে যেন মিছিল না হয় তাই হয়তো পুলিশ  আধামরা অবস্থায় তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। পুলিশ ঠান্ডা মাথায় তাকে মরতে দিয়েছে। রিপোর্টে এই দিকটায় নজর দিতে হবে। শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে সে, গুলি এবং বিনা চিকিৎসায়। পেইন্টার ইমরান নিশ্চয় এতক্ষণে ঢাকা থেকে অনেক দূরে কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছে। মৃদুলের কাছে করা তার অনুরোধ আমি রাখবো, রিপোর্টে তার কথা লিখব না।

ঘটনার আকস্মিকতায় আর হরতালে কয়েকদিনের থমকে থাকা শহরে ধীরে ধীরে আবারো প্রাণ আসে। মানুষজন বাইরে বেরোতে শুরু করে। আমাদের পত্রিকার কাজও চলে পুরোদমে। জীবন স্বাভাবিক হতে থাকে। রাতের শুরুতে ববি ভাইয়ের ঘরে মিটিং বসে। আমার রিপোর্টের প্রশংসা হয়, ববি ভাই কখনো একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলেন। তখন তাঁর মুখে ‘তুই’ শুনতে ভালোই লাগে। অন্যরা হিংসায় জ¦লে কখনো, দেখেও না দেখার ভান করি, মজা পাই।

দিন যায়। রাস্তাঘাটে যেমন দমবন্ধ পরিস্থিতি, আন্দোলন-সংগ্রামেও তাই। দানা বেঁধে ওঠে ওঠে আবার ওঠে না। আঘাত আসে অনেককিছুর ওপরে।

কোথাও কোনো একদিন শোনা যায় কোনো পত্রিকার গলা টিপে ধরার কথা, আবার গুমোট পরিস্থিতিতে নতুন পত্রিকাও চালু হয় টুকটাক। একইরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করতে করতে মনে হয়, দীর্ঘ ঝড়ের মধ্যে বসে আছি। শুধু ভিজে যাওয়া আর শুকানোর পালা চলছে।

একদিন অফিসে কানাঘুষা শুনি, দলে দলে পত্রিকার লোকেরা অন্য পত্রিকায় গিয়ে যোগ দিচ্ছে। এক রাজাকার বড় পত্রিকা করেছে, শুরুতেই মোটা বেতন। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে লোকেরা ছুটে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তার ছাতার তলে। ঝড়ের সময়ে এরকম বড় আর মজবুত ছাতাই তো চাই! অফিসের ছাব্বিশ জন সাংবাদিক একসঙ্গে একই দিনে ইস্তফা দেয়। তারা হাসিমুখে অফিস ত্যাগ করে, যেন কোনো রাজ্যজয়ের খবর এসেছে। মনে মনে ভাবি, এমন তো হতেই হবে। বিশ^জুড়ে যখন বড় পুঁজি আর বেশি আয়ের প্রতিযোগিতার জোয়ার, তখন এরাইবা পিছিয়ে থাকবে কেন!

ববিভাইয়ের স্বভাবসুলভ হাসি মিলিয়ে যায়। নিজের ঘরের উঁচু টেবিলের উঁচু চেয়ারে গালে হাত দিয়ে থম মেরে বসে থাকেন। সামন্ত প্রভুর নিরুপদ্রব ঘরটাতে মাথার ওপরে সাই সাই করে ফ্যান চলে। শাড়ির আঁচলের মতো ববিভাইয়ের পাঞ্জাবির কোণ উড়তে থাকে। না ডাকতেই তাঁর পাশের নিচুমতো সোফায় গিয়ে বসে থাকি। ববিভাই দেখেও দেখেন না। তারপর একসময় মুখের তেলতেলে চামড়ায় হাতের তালু বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ‘কী হইল দেখলা মিয়া?’

আমি ওপর-নিচে মাথা নাড়ি। বিব্রতবোধে বা শোকে আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘তুই’ থেকে তিনি ‘তুমি’তে উঠে যান। আমি সেদিকে নজর না দিয়ে বলি, ‘দেখলাম, ভাই। কী আর করা, নতুন লোকের কি অভাব পড়ছে?’

ববিভাই একটা দীর্ঘনিশ^াস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর পানি থেকে ওঠা হাঁসের মতো গা ঝাড়া দিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, খবর বল, কোথায় কী হইতেছে? লিড কোনটা করব, দেখি?’ তাঁর কথা শুনে বুঝি ববিভাই সব বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসতে চান। পরের দিনের পত্রিকা বিষয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নিয়ে বলেন, ‘লোকজনের খোঁজ লাগাই তাইলে। কী আর করা, পত্রিকা তো বাইর করতে হবে।’ আমি দ্রুত বলি, ‘জি, ভাই। জি, ভাই।’

পত্রিকা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। মুখ গোমড়া করে বসে আমি রিপোর্ট লিখি। ইচ্ছেমতো অফিসের ডেস্ক থেকে উঠে বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি। সিগারেটে দুটো টান দিয়ে আবারো অফিসে এসে বসি। ববিভাইয়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ভিড় দেখি কখনো, তবে আগের মতো

হাসি-তামাশা কম। ক্রমাগত শাড়ি-কাটা পাঞ্জাবি গায়ে থাকা ছাড়া ববিভাইয়ের ব্যবহার অনেকটাই বদলে যায়।

দেখতে দেখতে একদিন আমিও একটা আবেদন নিয়ে ববিভাইয়ের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কাগজটা হাতে দিতেই তিনি চোখ বোলান। তারপর চশমাটা নাকের ওপর থেকে নামিয়ে বলেন, ‘তুইও! ওই রাজাকার তোরে কত দিলো?’

‘কী বলেন আপনি! আমি যাইতেছি অন্য একটা নতুন পত্রিকায়। বড়ই হইব মনে হয়। রাজাকার না, একজন সৎ সাংবাদিকের পত্রিকায়, আপনার মতোই।’

‘তাইলে এইখানে কী সমস্যা?’

‘দেখেন, ভাই, আপনিও জানেন, পত্রিকা একটা কালেকটিভ কাজ। এইভাবে একা একা করার কাজ নাকি এইটা? একটা দল লাগে। এইখানে দল ভাইঙা গেছে, ব্যস।’

ববিভাই আর কোনো কথা না বলে খসখস শব্দে আমার আবেদনে স্বাক্ষর করে দেন। আমি সেটা উনার হাত থেকে নিয়ে বলি, ‘ভালো থাকেন, ভাই।’

ববিভাই মুখে তার কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা দোলান শুধু। দুই হাতের আঙুলগুলি একের ভেতর আরেকটা ঢুকিয়ে কনুই টেবিলে ঠেকান। তারপর থুতনিটা বাঁধনে বাঁধা আঙুলের ওপরে রেখে হাসিমুখ করে আমার দিকে তাকান। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে স্যান্ডেলের বেল্ট লাগাই। তাঁর দিকে আর তাকাই না।