আয়শার রাত-দিন

আয়শা সকাল থেকে বিকেল বা রাত পর্যন্ত যা যা করে তা নিয়ে তার নিজের কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও এলাকার মানুষের মাথা যথেষ্ট ব্যথা করে, তাদের মাথা টনটন করে, চোখ লাল হয়ে যায়, গোখরো সাপের মতো কেউ কেউ ফোঁস ফোঁস করে ওঠে; কারণ সমাজে তার জন্য নাকি অনেকের মানসম্মান নষ্ট হয়। প্রায়শ এরকম হয় আর তাই তারা কখনো কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়শার ওপর; তাকে নিয়ে হইচই করে, জটলা করে, কানাঘুষো করে, মনে হয় তাদের আর কোনো কাজ নেই। আর আয়শা কোনো কিছু গায়ে মাখে না, গায়ে না মাখার অসীম ক্ষমতা সে অর্জন করে, গুনগুন করে গান গায়, তা শুনে লোকজনের গা কিলবিল করে ওঠে। তবে সে বিবাদে যায় না, তাকে যারা আশকারা দেয় বা তার ভাবে ভাবে চলে, তাদের সঙ্গে সে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে, ভাঙা বট, অশ^ত্থ বা শিমুল গাছের বড় গুঁড়ির ওপর বসে সে পা নাচায় আর গান গায় (ওকি কাজল ভ্রমরা রে, একদিন আসিয়া বন্ধু কয়া কয়া যাও রে … প্রভৃতি গান); তার সঙ্গী-সাথিরাও গান গায়, তবে তার সঙ্গে পেরে ওঠে না, সে ওস্তাদ সাজে না, তবে কীভাবে যেন গানের সঠিক সুর-তাল রপ্ত করে ফেলে। এবং নতুন নতুন গান রপ্ত করে আর বিকেলে অনুশীলন করে তার দলবল নিয়ে। সমস্যা তো গান নিয়ে নয়, গানে একটাই সমস্যা তা হলো, তারা আসরের ওয়াক্তে হয়তো গান শুরু করলো আর খানিক বিরতি দিয়ে হয়তো চালালো মাগরিব পর্যন্ত, আর তখন বয়স্ক চার-পাঁচজন ভেজা দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মসজিদের দিকে হাঁটা শুরু করল। সবচেয়ে কঠিন এবং নিয়মিত মসজিদে যাওয়া নামাজি খয়বর আলী  চাচা হয়তো বলল, তোদের না যাওয়ার সুময় দেকলাম গান করিতিচি আবার এখন মগরিবের আজান পড়ি গেল তাও গান গাতিচিছ, বিপারটা তো ভালো ঠেকতিছে না, মুসলমানের দেশে এসব কতকাল চলবে? আয়শা কোনো উত্তর দেয় না, আনিস উত্তর দেয় না, রহিম বা জহির উত্তর দেয় না, প্রফুল্লও উত্তর দেয় না। শুধু আয়শা পা নাচানো বাদ রাখে খয়বার আলী চাচাকে সম্মান দেখানোর জন্য। তাতে পরিবেশ একটু শান্ত হয়, খয়বার আলী চাচা মুখ বিড়বিড় করে হাঁটতে থাকলে তার দাঁড়ি থেকে পানির ছিঁটেফোঁটা মাটিতে পড়ে, সে হাত নেড়ে নেড়ে হাঁটতে থাকে, মাজাটা ঈষৎ কাত করে হাঁটাই তার জন্য মানানসই, সে সেটাই করে, তবে কী কথা বলে তার বিন্দু বিসর্গ তারা বুঝতে পারে না। পাড়ার জনাপাঁচেক পুরুষ ও মহিলা কুকুর এতক্ষণে এদের গানের আসরের একটু দূরে বসে লেজ নাড়াচ্ছিল। তাদের ধারণা ছিল, এখানে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে আর ভোজন শেষে তারা কিছু উচ্ছিষ্ট পাবে, তবে খয়বার আলী চাচা যাওয়ার পরে তারা কী বুঝে বলা যাবে না একযোগে তাদের একমাত্র জানা ডাক ঘেউ ঘেউ করতে করতে সেøা স্পিডে উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করল। জহির যে একটু বয়সে বড়, মানে সে আয়শারও কয়েক বছরের বড়, সে হঠাৎ ফোড়ন কাটে প্রফুল্লকে নিয়ে : তোর বাপ তো তোকে বে দেল না, বে হবার আগেই তো  তোর বাপ অক্কা পাবে, আমার মন কতিচে। গান বন্ধ হওয়ার পর কোনো কাজ না থাকায় সে হঠাৎ বোমা ফাটায় তা বোধহয় না, সে নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই এ-কথা পেড়েছে। প্রফুল্ল কোনো উত্তর দেয় না, সে গোঁফে পাক দেয়, তার গোঁফ বেশ ভালো সাইজের, নাকের ভেতর আঙুল দিয়ে সে লম্বা চুল ছিঁড়তে থাকে, যেন বহুদিন এগুলি জমে আছে এবং তা ছিঁড়ে ফেলার মোক্ষম সময় মিলল এখন। এটা যে রাগে রাগে করে সেটা বোকা রহিমও বোঝে। সে তোতলাতে তোতলাতে বলে, কা-কা-র বি-বি-য়ে হবে, ক-খ-খ-ন হবে তা-তা-তোর কী? আয়শা থামায়, বুঝতে পারে দুজন এখন মহাঝগড়া শুরু করবে। কেন জানি দুজনের বনিবনা হয় না, একজন চালাক, একজন হাবা, তবু দুজনের বাধে। আয়শা বলে, তোরা এখন যে যার মতো বাড়ি যা, আমিও বাড়ি যাবো। আনিস ওর মুখের দিকে তাকায়, মুখটা শুকনো শুকনো লাগে। স্কুলের সহপাঠীকে সে যে খুব চেনে তাও না, তবে তার জীবনের বিচিত্র গতিপথের খানিকটা সে জানে। প্রাইমারির পরেই তো তারা আলাদা হয়ে যায়। আয়শার বিয়ে হয়। ধীরস্থির মুখগোমড়া হাফিজের সঙ্গে। হাফিজ তখন তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করে পড়াশোনা শিকেয় তুলেছে। তারপর যুদ্ধ, হাফিজ যুদ্ধে গেল, ফিরেও এলো। তবে আয়শাকে আর বউ হিসেবে নিল না। কেন নিল না সে ধূম্রজাল ভাড়ুখালি গ্রামের বাতাসে বাতাসে ঘুরে বেড়ালেও আনিস সবটা জানে না, জানে না রহিম, কিংবা প্রফুল্ল। আনিস একটা কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়, সদাহাস্য মুখে থাকা আয়শা মাঝে মাঝে ম্রিয়মাণ হয়ে যায়, কেন যায় তারা ঠিক জানে না। বাপ মারা যাওয়ার পরে তার এ-অবস্থা হয়েছে বলে আনিসের ধারণা, তবে বিষয়টা সঠিক নাও হতে পারে। আয়শা ‘যাইরে, আবার দেকা হবে’ বলে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার শেষ আয়োজনে ব্যস্ত, নবিউল্লার বাঁশঝাড়ে অজস্র পাখি চিৎকার শুরু করে, হালকা ঠান্ডা বাতাস আসে দাঁতভাঙার বিল থেকে। ওরা চারজন তাকিয়ে থাকে তাদের বন্ধু আয়শার দিকে, এই প্রথম তাদের মনে হলো, আয়শা বুঝি এতদিনে দুঃখকে দুঃখ হিসেবে অনুভব করতে পারছে।

জইলেশ দাদিই বিয়ের কিছুদিন পর আয়শাকে বলেছিল, ভিদ ভিদে নাঙে ঘরদোর ভাঙে। আয়শা এই পদের মানে ঠিক বুঝতে পারেনি। জইলেশ দাদি হাফিজকে খুব চিনতো না, একই গ্রামের ছেলে হলেও ওদের বাড়ির গ্রামের পশ্চিম সীমান্তে, মাইল তিনেক দূর তো হবেই। বিয়ের পর যখন এ-বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কয়েকবার এসেছে তখন জইলেশ দাদি তার সঙ্গে কথা বলে যতটুকু চিনেছে। দাদির কথার কি অর্থ তা সে জিজ্ঞেস করেনি, প্রয়োজন মনে করেনি।  সে তখন মনোযোগ দিয়ে সংসার করে, রান্নাবান্না করে, পুকুর থেকে কাঁখে করে পানি আনে, শাড়ি পরে সাঁতার কাটতে গিয়ে বিপদে পড়ে, গোসল করে ভেজা শাড়িতে বাড়ি ফেরে, পুরুষ লোক দেখলে দাঁত দিয়ে শাড়ি আঁকড়ে ধরে মুখ আড়াল করে, সব খেলাধুলা বাদ দিয়ে হাফিজ যা বলে তাই শোনে, তার সঙ্গে মাঠে যায়, ছাগল চরায়, গাই দোয়, গরুর জন্য খড়বিচালি কাটে, ছাগলের ছোট বাচ্চাটাকে মা বাচ্চার বাঁট থেকে দুধ নিয়ে ঝিনুকে করে খাওয়ায়, বড় জা’র ছোট ছেলেটার মুখ টিপে দিয়ে তার ফোকলা দাঁতের হাসির সঙ্গে পাল্লা দেয়, রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে, লবণ ঠিক করতে না পেরে শ^শুরের বকা খায়, শাশুড়ির চুলের উকুন বাছে আর রাত হলে ভাত খেয়ে হাফিজের পাশে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়তে পড়তে একদিন তার যথানিয়মে একটা বাচ্চা হয়, তবে বাচ্চাটা হয় মরা, শাশুড়ি তাকে শাপশাপান্ত করে,  বাচ্চা পেটে করে সে নাকি টো-টো পাড়া ঘুরে জিন-ভূতের আছর লাগিয়ে বাচ্চা মেরে ফেলেছে, অলক্ষ্মী বউ কোয়ানগের। শ্বশুর তেমন কিছু বলে না। হাফিজ তো কথা বলার মানুষ না, সে কেমন চোখ চিকন করে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে; অর্থ হলো, সে যেন জানে না কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, তারও সন্দেহ তার মায়ের কাছাকাছি। শাশুড়ি রাগে গরগর করে বলে, ‘তোর প্যাটে বাচ্চা আর তুই পতে পতে ঘুরিস, রাতবিরেত গাছপালা-বনবাদাড়-পুকুর-জঙ্গল ভূত-প্রেত মানিস নে, ক্যান? বাপ-মা তোর কি কিচু শিকাইনি, তোকে আমরা রাকপো না।’ আয়শা তখন কী বলবে ভেবে পায়নি। তার মুখ ভালোই চলে, তবে সে বিয়ের পর মুখ ভালোই বন্ধ রেখেছিল বাপের কথামতো। তবে সে বুঝে উঠতে পারেনি যে সন্তান নিয়ে তার কষ্টই সবচেয়ে বেশি, সে কি কষ্ট করেই না সন্তান এতদিন বড় করেছে আর কি কষ্টই না পেল সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়। দাই তার মৃত সন্তান যখন বের করল পেট থেকে তখন তো তারও মরণাপন্ন অবস্থা, অথচ তার দিকে এরা তীর ছুড়ছে সন্তান মেরে ফেলার অপরাধে। সেই থেকে তার স্বামীর প্রতি যা বা একটু আস্থা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেল। আর যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তো তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো শ^শুর-শাশুড়ি কলঙ্ক দিয়ে, হাফিজকে তারা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, প্রয়োজনও মনে করেনি। আর সে অবোধের মতো বাপ-মার সিদ্ধান্ত বলবৎ রাখলো, আয়শার কথা একবারও ভাবল না।  সে হাফিজের সামনে যায়নি একবারের জন্যও। মনে করেছিল প্রতিবাদ করবে, তবে যেখানে ভালোবাসা নেই,  সেখানে প্রতিবাদ করে লাভ কী।

বাপ মারা যাওয়ার বছর চারেক পর মাও বাপের পথ ধরে; ভাইবোনগুলি যে যার মতো ছিল, শুধু ছোট বোনটা তার জন্য কান্না করত, বুঝে, নাকি না-বুঝে, সে ঠিক বুঝতে পারে না। বাপের জরাজীর্ণ আটচালা টালির ঘরটায় কেউ থাকতে চাইতো না বলে সেটা আয়শার দখলে থাকল আর দখলে থাকল দাদি জইলেশ। তার নানা ব্যামো থাকলেও চলতে-ফিরতে পারে, লাকড়ি চুলো ঠিক থাকলে দুটো ভাত ফুটাতে পারে, তবে আয়শাকে কেন জানি সে ভালোবাসে সবার চেয়ে, ঠিক ওর বাপ হামিদালির মতো। হামিদালি যতদিন ছিল ততদিন আয়শার প্রাণে শক্তি ছিল সবার চাইতে বেশি, সে দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা, মারামারি যা করত সবটাতে বাপের সায় ছিল, বাপ কেন এই  মেয়েটাকে এত লাই দিত তার কারণ মা রমিছাও জানতো না। যা হোক, আয়শা এখন ছোট একটা চৌকির ওপর  শুয়ে তার জীবনের আদ্যোপান্ত একবার ঘুরে আসে, ধূসর রঙিন কালো-ধলো চিকন জংধরা কত রকম ছবি। বড় ভাই গফুর তাকে খুব মারত বাপের আড়ালে, বলত, তোর জন্যি আমাদের মানসম্মান সব নষ্ট হতিচে, বাপ না থাকলে তোকে আমি কুপাইয়া খালে ভাসাইয়া দিতাম। হয়তো দিত, তবে বাগে পায়নি। সেও জানতো, আয়শার গায়ে পুরুষের চাইতে শক্তি বেশি, আর তার বন্ধুরা সব পুরুষ, মেয়েবন্ধু তার নেই। তবে বিয়ের পর হাফিজকে সে কীভাবে সহ্য করেছিল তাই ভেবে গফুর কূল-কিনারা পায় না। এই হোদল কুতকুতের বাচ্চার সঙ্গে সে কীভাবে সংসার করল, কেন করল? আয়শা ভাঙা টালির ভেতর দিয়ে সন্ধ্যার আকাশ দেখে, অজস্র তারা ঝিলমিল করছে রাতের আকাশে, পাখি ডাকছে নবিউল্লার বাঁশবাগানে, পোষা কুকুরটা পাড়া বেড়িয়ে পায়ের কাছে এসে বসে আছে, মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সে ভ্রুক্ষেপ করে না। বাঁশবাগানের ধার দিয়ে মিলিটারিরা রাতের বেলা ঘোরাঘুরি করত, শেফালিকে তো তারা ধরে নিয়ে গেল বলতে গেলে তার সামনেই, তাকে ধরতে পারেনি। একদিন সে বাঁশবাগানের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় আজমল তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, আয়শা আমি তোকে খুব পছন্দ করি। সে রাগত চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকলে আজমল পালিয়েছিল। সে বুঝে পারে না, শাশুড়ি তাকে যে খারাপ মেয়ে ভাবে, তার কারণটা আসলে কী? আজমলকে সে পছন্দ করত, এটা ঠিক; তবে কোনোদিন তো সে তাকে বলেনি আর তার সহপাঠীরা তো তাকে পুরুষবন্ধুই মনে করে। এখন একটু একটু বুঝতে পারে, তারা তাকে পুরুষ মনে করে, তবে গ্রামের লোক তো তা মনে নাও করতে পারে। হাজি দাদা তাকে পথে একদিন ধরে, ‘এই ছুড়ি, সারাদিন টো-টো করে পুরুষ মানুষের সঙ্গে ঘুরিস ক্যান, শুনলাম বিলে একসঙ্গে মাছ ধরতিও যাস, তোর লজ্জা-শরম নেই বুজলাম, তা বলে গ্রামের তো সম্মান বলে একটা কতা আছে।’ আয়শা বলে, ‘ওরা পুরুষ মানুষ হবে ক্যান, ওরা তো স্কুলের বন্ধু।’ হাজি দাদা খ্যাক খ্যাক করে ওঠে : ‘ওরে আমার বন্ধু, পুরুষ মানুষ হলো তোর বন্ধু। দাঁড়া, আমি এর ব্যবস্থা করতিচি।’ হাজি দাদা আয়শার বাপের কাছে নালিশ দিলে আয়শার বাপ হাজিকে কীসব বলে বুঝিয়ে ফেলে। তবে বিয়ের সময় সবাই ভেবেছিল, হাফিজের বাপ আয়শার এইসব কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আয়শা আশ্চর্য হয়েছিল, কেউ কোনো কথা বলেনি। কোনটা নিয়ম, কোনটা অনিয়ম, কোনটা সমাজ, কোনটা ধর্ম আয়শা ঠিক কখনো বুঝতে পারেনি। ফাইভ ক্লাস লেখাপড়ার বিদ্যে দিয়েও সে কিছুই অনুমান করতে পারে না। তবে তার কৃষক বাপ তাকে মাঝে মাঝে নানা কথা বলত। যেমন পুকুরে বাপের কাঁধে সাঁতার শেখার সময় বাপ প্রায়শ বলত, ‘এই যে তুই সাঁতার শিখলি, এইটা একটা বিদ্যে, পানির ওপর তুই ভাসতে পারিস নৌকার মতো, সবাই পারে না, তুই তোর প্রাণের কথা শুনতে পাস, এটা তোর বিদ্যে, আর নিজের শক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনা নিয়ে যদি মজা করে বাঁচতে পারিস, তাহলেই আনন্দ। আমরা তো চাষবাস আর ফসল বিক্রি করেই একঘেয়ে জীবন পার করে দিলাম, ছোটবেলায় কিছু বোঝার আগেই সংসারের জোয়ালে গেঁথে গেলাম। আর চিন্তা করার সুযোগ নেই, আনন্দ করে কিছু করার নেই।’ আয়শা তাকিয়ে থাকে বাপের দিকে, তার হযরত স্যার এইরকম কথা তাদের বলেছিলেন অনেকবার। বাপ কি ছোটকালে হযরত স্যারের কাছে পড়েছিল? ওর সন্দেহ হয়। হযরত স্যার বলতেন, ‘জীবন যাপনে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে নিতে হবে, তোমার যা ভালো লাগে তাই তোমার লক্ষ্য, তাই তোমার মোক্ষ, তাহলে আনন্দ ধরা দেবে তোমার জীবনে, সেই আনন্দময় জীবনকে অনেকে সহ্য করতে পারে না, তারা বাঁধাধরা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায় কলুর বলদের মতো।’ বাপ তার সঙ্গে প্রায় কথা বলত – পুকুরে গোসলের সময়, হাটে যাওয়ার সময়, মাঠে যাওয়ার সময়, ধান লাগানোর সময়, কুমড়োর ফুল তোলার সময়, গাছ থেকে সজনে পাড়ার সময়, মাছ ধরার সময়, দুজন মিলে সেউতি দিয়ে সবজি ক্ষেতে পানি দেওয়ার সময়। সব কথা তার মনে নেই, যেমন মনে নেই বাপের নাকের ফোলা অংশের ওপর ছোট্ট লাল জড়ুলের কথা যেটা মাঝে মাঝে চুলকাত, আর চুলকানোর সময় বাপ ব্যবহার করত পাচুনির ওপরের চিকন অংশ কিংবা মুলার ল্যাজের দিকের সরু অংশ। নখ বা আঙুল দিয়ে বাপ কখনো জড়ুল চুলকাত না। সেই  জড়ুলের কথা আয়শার মনে নেই, মনে নেই মানে নাকের কোন পাশে ছিল তা মনে নেই।

জইলেশ দাদি ডাক দিতেই সে আসমান অথবা বাপের কাছ থেকে ফিরে আসে। জইলেশ দাদির এখন একটাই কাজ – খেয়ে-দেয়ে ঘুমানো। আয়শা তো কোনো রান্নাবান্না করেনি, যায়নি চুলার কাছে। জইলেশ বেশ মোলায়েম সুরে বলে, ‘তা আজগি খাবাদাবা কিছু হবে না, নাকি উপোস?’ আশি বছর পার হলেও তার হজমের কোনো সমস্যা নেই; লোকজন বলে, ‘এই জন্যিই সে টিকি আছে।’ টিকে আছে বলা যায়, হাড়ের সঙ্গে মাংস নেই, হাড় দেখা যায়, চামড়া দুমড়ে-মুচড়ে গেছে, দাঁত আছে গোটা চারেক, একটা গান্ধীমার্কা চশমা আছে নাকের ডগায়; ছেলে কিনে দিয়েছিল। এখনো তা কার্যকর। আয়শা সোজা হয়ে বসে। দাদির দিকে তাকায়। অন্ধকারে দুজনের চোখাচোখি হলেও কেউ কাউকে ঠিকমতো দেখতে পায় না, অন্ধকার হঠাৎ করেই বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে আর বাড়িতে কোনো টেমি জ্বালায়নি আয়শা। বাড়ির সামনের বেগুন গাছ থেকে গোটা তিনেক বেগুন নিয়ে আসে আয়শা, চাল ধোয়, তার মধ্যে বেগুনগুলি ধুয়ে চুলা ধরিয়ে বসে, দাদিও লাঠি নিয়ে বসে ওর পাশে একটা পিঁড়ির ওপর। আয়শা লাকড়ি ঠেলে মাঝে মাঝে। প্রায় ষাট বছর ব্যবধানের দুই নারী এক বাড়িতে থাকে, ঘরকন্না করে, পাশেই রক্তের মানুষজন থাকে, কেউ খবর রাখে না। সে নিয়ে আয়শা বা দাদির কোনো

হা-পিত্যেশ আছে বলে মনে হয় না। দুটো পেট চলে যায়, রাতের পর দিন, দিনের পর রাত। দাদি হঠাৎ বলে, ‘আচ্ছা, আয়শা, তুই কি আর বে-শাদি করবি না, যদি করিস তালি বল, আমি এট্টা ব্যবস্থা করতি পারি কি না দেকি?’ আয়শা নিরুত্তর থাকে দেখে জইলেশ আবার বলে, ‘তোর ব্যাগাত্যা করি, একটা বে কর, হাফিজ তো ঠিকই বে-শাদি করে ছেলেপুলে নে ভালোই আছে, তালি তোর সমস্যা কী? না, কতা হতিচে, আমি তো আজকালের মধ্যে যাবো নে, আর তোর ভাইবোনরাও তোর দিকে চোক তুলে দেখে না, তাইলে আমি যাবার পর তোর কী হবে? তোর তো ভয় লাগবে, নাকি?’ আয়শার মনে মনে হাসি পায়, তাকে ভয়ের কথা বলে দাদি। কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, সত্যি তো একা সে থাকবে কী করে? দাদির ভয়ের কথা শুনে তার জামশেদের কথা মনে পড়ে। শুধু আজমল, না জামশেদও তার পিছু নিয়েছিল অনেকদিন। সন্ধেবেলা তারা বাঁশবাগানে প্রাতঃকর্ম সারতে গেলে ভয়ে একটু গা ছমছম করত, মেজবোন জমিলা বা পাড়ার জমিরন থাকত, তবু নবিউল্লার ঘন বাঁশবাগানে তাদের ভয় লাগত। এখন তার মনে হয়, জামশেদ বোধহয় এমনি এমনি যেত না ও-পথ দিয়ে, তার সঙ্গে কথা বলতে বা গল্প করার জন্যই বুঝি যেত। সে তো পড়ত দু-ক্লাস ওপরে। সে ছড়া কাটত : কে রে বাগানে হাগে সন্ধের আগেভাগে, গাঢ়ুটা আগে রেখে মশাদে খাওয়ায়। আয়শা দুষ্টু যুবকের কথার কোনো কথার উত্তর দিত না, এমনিতে এই কাজের মধ্যে কারো সঙ্গে উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। তবে জমিরন উত্তর দেয় পদ মিলিয়ে, ওর পদ মেলানোর ক্ষমতা ছিল : ‘হাগি বাগানে হাগি, তাতে তোর বাপের কী/ আমার পাছার ডাকে মশারা পালায়।’ জামশেদ তখন একটা মশার ছড়া বাঁধে : ‘আয় রে মশা তাই রে মশা, মশার পায়ে পরাব বেড়ি, সকল মশা উড়ে গেল গাফফারের মার বাড়ি, গাফফারের মার ভাঙা ঢোল, কাইত করে মশা তোল।’ আমরা তার কথায় আর কিছু বলি না। সে চলে যায় তবে তো সে তক্কে তক্কে থাকে। দাঁতভাঙার বিল থেকে বালুই পাখি মেরে জাল টোনা ঘাড়ে করে সবাই ফেরার পথে জামশেদ একটু পিছিয়ে থাকা আয়শাকে পলাশফুলের একটা তোড়া দেয়। প্রফুল্ল কীভাবে বুঝতে পারে, সে দৌড়ে এসে জামশেদকে ধরে, এই শালা, এইটা কী করিস, তোর ঘাড় মটকে দেব। আনিসও আসে। আয়শার হাতে গোটা ছয়েক পলাশফুল, সে ফেলে দেবে না ধরে রাখবে বুঝতে পারে না, অন্ধকার তেমন না, তবু কারো মুখ খুব ভালো করে বোঝা যায় না, মুখের ভাব বোঝা যায় না, তবু জহির জামশেদকে বলে, ও, মুখ তো কাঁচুমাচু করে আছ না, কিচ্ছু বোঝ না, আয়শার পিছন লাগিছ ক্যান? জামশেদ কোনো কথা না বলে ওর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে, তবু জহির তাকে শালা বলে গালি দেয়। সে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়। আয়শা মনে করতে পারে সন্ধের আবির রাঙা সময়ে জামশেদ তাকে গভীর কথা বলতে এসেছিল। জামশেদ আর দু-একবার তাকে পথ আটকেছিল, তবে বিশেষ কোনো কথা  হয়নি কখনো। তখন বাপ ছিল, বাপকে সে ভয় পেত না, তবে সমীহ করত। তার সহপাঠীরা তাকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বস্তুত জামশেদ রয়ে গিয়েছিল এক স্থির ছবি হয়ে অনেকদিন। এই বোধহয় ভালোবাসা, সে ভালোবাসা কি জিনিস জানে না, তবে তার হৃদয় উতলা হয়েছিল সত্য। আজ আয়শার মনে পড়ে জামশেদের কথা। তার সহপাঠী বন্ধুরা কখনো তার চেহারা শরীর নিয়ে কথা বলেনি, সেদিকে তাদের কোনো নজর ছিল না। তবে আয়শার  পুরুষালি দোহারা চেহারা হলেও মেয়েলি লাবণ্য কম ছিল না। বাপ প্রায়ই বলত, তোর চেহারা হয়েছে আমার মার মতো। জইলেশ দাদির প্রসঙ্গ টেনে বাপ বলত, তুই তো দাদিকে যৌবনকালে দেখিসনি, আমি খানিক দেখেছি, আমি তার একমাত্র সন্তান। তো মাকে সবাই খুব পছন্দ করত তার চেহারা গায়ের রঙের কারণে। অনেকে বলত, কৃষক পরিবারে এরকম চেহারা হয় না। আয়শা জানে, বাপের কথায় আবেগ থাকলেও সত্যতা আছে। জইলেশ দাদি যে খুব সুন্দরী ছিল তা এখনো বোঝা যায়। আর তাকে নিয়ে বাবা হয়তো একটু বাড়িয়ে বলে। তার চেহারা কেমন, কেমন করলে সুন্দর দেখায়, তা নিয়ে সে কখনো ভাবেনি, সে বাপের  দেওয়া স্বাধীনতা নিয়ে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে চেয়েছে। তবু সে যখন নিজেকে নিয়ে আর একটু গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিল তখন তো বাপ তাকে অনেকটা জোর করে বিয়ে দিলো হাফিজের সঙ্গে। বাপকে সে দোষ দেয় না। এদেশের বাপদের এটা করা ছাড়া আর উপায় কি? মেয়েরা অল্প বয়সে জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে দিতে হয়। সেটাই দস্তুর।

দাদিকে বেগুনভর্তা দিয়ে ভাত দিয়ে নিজেও একটা মাটির শানকিতে ভাত নিয়ে টেমির আলোয় দুজন অমৃত খেতে বসে। এই সব আজকাল খাওয়া হয় নিয়মিত। বাবা থাকলে কখনো এসব খেত না। বাবা কোনোদিন খারাপ খেতে পারত না,  তাই নিয়ে মার সঙ্গে প্রায় লাগত। কখনো বাবা রাগে খাওয়া বাদ দিত। গরম মাছ ভাত-তরকারি না হলে বাবা খাবে না। পুকুরভর্তি মাছ থাকত, যখন খুশি বাবা মাছ ধরত। একবার তো রাতের বেলা মাছ ধরা নিয়ে কী তুলকালাম। মা বলে, রাতে মাছ ধরতে হয় না। মাছেরা রাতে বিশ্রাম নেয়, বাবা শোনেনি মার কথা। মা বলে, তুমি কি আতিয়ার দফাদার হইচ? রাতের বেলা মুরগি ধরে রান্না করবা? তখন আতিয়ার চাচার গল্প সারাগ্রামে চাউর হয়ে গেছে। সে কলকাতা থেকে কলের গান আর রেকর্ড নিয়ে এসেছে। বাপের জমি বিক্রি করে আর যা খুশি করে। তো সে ভর সন্ধেবেলা মাইকে কলের গান বাজায় : বড়লোকের বিটি লো লাম্বা লাম্বা চুল, কিংবা বলি ও ননদি আর দু-মুঠো চাল ছেড়ে দে হাঁড়িতে, ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে। গান বাজানো খাওয়া-দাওয়া করা তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। শীতকালে যখন মাওলানাদের ওয়াজের মৌসুম শুরু হয়, মাওলানাদের আনাগোনা শুরু হয়, রাত জেগে সবাই মাওলানাদের ওয়াজ শোনে তখন আতিয়ার দফাদার তার আসর বসায়। গ্রামের সবচেয়ে সুরেলা বাগ্মী আর জনপ্রিয় মাওলানা যে কি না বহুদূরে দাওয়াত পায়, যে আসর শুরু করে গ্রাম থেকে, সে একদিন সরাসরি আতিয়ার দফাদারকে অভিযোগ করে বসে। তো কাজের কাজ কিছু হয় না, আর আতিয়ার দফাদার একরোখা তা সবাই জানে। গ্রামের যুবক লোকও তার সঙ্গে আছে। ইমাম সাহেব শুধু তাকে খানিক নরম সুরে বলে, তুমি বাপু যুবক মানুষদের কুপথে নিতেচ। তার জবাব আতিয়ার দফাদার যা দিয়েছিল তা আয়শার মনে আছে; তারা তখন চাচার উঠানে মাদুরের ওপর বসে গান শুনছিল, একটা পুরনো কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে চাচা বসেছিল। তো আতিয়ার চাচা বলে, তোমার কাজে তো আমি বাধা দেই না, আমার কাজে বাধা দেও কেন? দাদি তো জানে আয়শার বাপ সেরকম তো কখনো ছিল না।

আয়শা মনে করে বাপ মাকে বকাঝকা করলেও সম্মান করত, কারণ কখনো বড় ধরনের বিবাদ বাবা করেনি মার সঙ্গে। তার মনে হয়, আজ দাদি যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা আসলে বাপের প্রস্তাব। সে আশ্চর্য হয়ে যায় মা তাকে কখনো আবার বিয়ের কথা বলেনি; যুদ্ধের পর সব যখন টালমাটাল, বাপ মারা গেল, মা কেমন স্থির হয়ে গেল, দুই ভাই কোনো কথা বলে না, তারা বাপের কাছ থেকে পাওনা দিয়ে সন্তর হয়ে গেছে, বাকি দুই বোন শ^শুরবাড়ি। মা শাশুড়ি আর আয়শাকে নিয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। এই চুপচাপের কারণ এখন বেশ আন্দাজ করতে পারে আয়শা। সে জীবন, সংসার, সম্পর্ক, চারপাশ নিয়ে কখনো ভেবেছে বলে মনে হয় না। যা মনে হয়েছে তাই করেছে আর বাপ তাকে বাধা দেয়নি বলে এসব করতে পেরেছে। আজ যখন দাদি তাকে নতুন করে বে-শাদির কথা বলে, তখন তার জামশেদের কথা মনে পড়ে, স্বামীর কথা খুব মনে আসে না, তার ছবি ঘৃণামিশ্রিত হয়ে মনে পড়ার কথা, তবু আসে না। হাফিজের সংসার সে করেছে, দেহমিলনে লিপ্ত হয়েছে, সন্তান হয়েছে, সন্তান মারা গেছে, রান্নাবান্না করে সবাইকে তিনবেলা খাইয়েছে, তবু কোনো বন্ধন নেই, কোথাও কোনো মায়া নেই। একটা শিথিল শুষ্ক গতানুগতিক সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে যার কোনো নাম সে দিতে পারে না। শরীরের চাহিদা নিয়ে তার আলাদা কোনো টান নেই বলে সে হয়তো এসব নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবে না। সে ভেবে আশ্চর্য হয়, শরীর কখনো তাকে অহেতুক উত্তেজিত করেনি। হাফিজের সঙ্গে যে জীবন যাপন করেছে তাতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েনি, নিয়ম রক্ষা করে চলেছে। তাই সেই জীবনের জন্য কোনো টান সে অনুভব করে না। একাকিত্ব যদি তার বুকে ভর করে তখন সে কী করবে? কথা বলার একটা অপছন্দের মানুষ হলেও তো দরকার। সে কি মানসিকভাবে শূন্য হয়ে যাবে? ভাইয়েরা আসবে তাকে সাহায্য করতে, যে ভাইয়েরা বিয়ের আগে তার সঙ্গে কত নিবিড় ছিল, যারা সামান্য স্বার্থের জন্যে তাকে ছেড়ে গেছে। তবে বিপদে নাকি কাছের মানুষ ঠিকই চলে আসে, অবশ্য আয়শার অভিজ্ঞতা তা বলে না। জইলেশ দাদি ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবার আয়শাকে ডাকে। আয়শাও ঘুমাবে তবে ঘুমের ভাব না এলে সে ঘুমাতে যায় না। আয়শা বসে দাদির গায়ে হাত দিয়ে। দাদি বলে : আচ্ছা শোন, যুদ্ধের পরে হাফিজ পাল্টে গেল, কিন্তু আমার তো মনে হয় যুদ্ধ তাকে আরো ভালো করার কথা। এত কিছু করল, জীবন বাজি রেখে সে যা করল তা কজন করতে পারে? আমিনুল, রহমতকে আমি একদিন বলিছিলাম, তোরা এত শক্তি কোথায় পালি? আমিনুল আমাকে বলে, দাদি, মায়ের দুধের শক্তি গো, মায়ের দুধের শক্তি, সেই শক্তি না থাকলি যুদ্ধ করা যায় না। আমি বলিছিলাম, সেই শিশু বয়সের দুধের শক্তি এখনো আছে? সে বলে, আছে, সব সময় থাকে, মার ছবি থাকে, স্মৃতি থাকে, আদেশ থাকে, মার শক্তি দিয়ে আমরা লড়াই করি।

আয়শা জানে এক জায়গায় হাফিজ এগিয়ে আছে, তাই সে কোনো প্রতিবাদ না করে চলে এসেছিল, মা-বাবাকে সুখী রাখতে সে আয়শাকে হারাতে রাজি, আমিনুল যা বলেছিল হাফিজও তাই বলত। দাদি তাকে আসলে হাফিজের কথা বলতে চায়, কেন চায় সে বুঝতে পারে না। দাদি তার সারা গায়ে হাত বোলাতে থাকে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে। আয়শা শুনতে পায় না।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়শা দেখে দাদি চৌকিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে,  যেভাবে সে কখনো শুয়ে থাকে না। সে  চৌকি থেকে নামে, স্থিরভাবে তাকায় দাদির মুখের দিকে। চিকন বাঁশের শলার জানালা দিয়ে ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। আকাশটা আলোময়। নতুন একটা দিনের শুরু হচ্ছে। আর একটা জীবন তার যাত্রা শেষ করছে। স্মিত হাসিমুখে দাদি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো পাথরের মতো শক্ত।

আয়শা দাঁড়িয়ে থাকে আটচালা বাড়ির মাঝখানের বড় ঘরটাতে। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এই ঘরে। তবু সে ঘরটাকে চিনতে পারে না। ওর নিশ^াস বন্ধ হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে, একটু পরে সবাই হুড়মুড় করে ছুটে আসবে, ভাইবোনেরা আসবে, তার বন্ধুরা আসবে, পাড়া-প্রতিবেশীরা আসবে। তাকে অনেক উপদেশ দেবে, কেউ হয়তো কেঁদেও ফেলবে। ঘরে বসে একদল কোরান শরিফ পড়বে, মুর্দাফরাশ আসবে, সৎকার হবে। তবে তার কী হবে? সে-কথা কেউ বলতে পারবে না।

জইলেশ দাদি মারা যেত যে-কোনো দিন, তবে সে কীভাবে সামনের দিনগুলি কাটাবে তার কোনো প্রস্তুতি ছিল না, এখন নতুনভাবে দিন-রাত যাপন করবে আয়শা, একা। তবে সেই যাপন কেমন হবে সে জানে না।