এ ঢাক নিয়ে রাজবিহারী এখন কী করবে…

না, শিবানন্দের মা, আর বুঝি পারলাম না। বুক-ভরা যন্ত্রণা নিয়ে মধুবালার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল রাজবিহারী। আর পারছি না শিবানন্দের মা, আর পারছি না।

– আবার কী হলো? এ-কথা বলে স্বামীর দিকে কৌতূহলী চোখে তাকালো মধুবালা।

– কী আর হবে? তোমার সুপুত্র বলে দিয়েছে ও আর কোনোদিন ঢাক ধরবে না – বাজাবে না আর সাত-পুরুষের এই বাদ্যযন্ত্র। ওর কথা শুনে বুকটা আমার ফেটে যাচ্ছে গো! আর তো পারছি না।

– তুমি শান্ত হও। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলে শিবুকে আমি সব বুঝিয়ে বলব। তুমি একটু বিশ্রাম কর। আমি রান্নাটা সেরে নিই।

মধুবালা ভিতরে চলে যেতেই বারান্দায় বসে পড়ল রাজবিহারী। মাঘ মাস। উঠানে রোদে শুকাতে দিয়েছে তিনটা ঢাক। মাথার উপর নীল আকাশ, নিচে কড়া রোদ। ঢাক-তিনটার দিকে তাকিয়ে আছে রাজবিহারী। বড় ঢাকটা রাজবিহারী পেয়েছে বাবা কুঞ্জবিহারীর কাছ থেকে। বাকি দুটা নিজেই বানিয়েছে রাজবিহারী। ঢাকটা ছেলেকে বুঝিয়ে দিতে দিতে কুঞ্জবিহারী বলেছিল – সাত-পুরুষের ঢাকটা তোমার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি মুক্তি পেলাম। সময় এলে তুমিও এটা তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে দিও। সাত-পুরুষের পেশা ঢাক বাজানো। দুর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ, বিয়ে, শিশুর জন্ম  –  এসব উৎসবে ঢাক বাজানো তাদের পেশা। পেশাটা এমনভাবে তাদের জীবনে গেঁথে গেছে যে, বহু বছর আগে থেকেই তাদের পদবিটা হয়ে উঠেছে ঢাকি। আগে কী ছিল, কে জানে!

প্রতিদিন সকালে উঠেই ঢাকগুলোর যত্ন নেয় রাজবিহারী – ঢাকের পিঠে চামড়ার গুণে তেল মাখে, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে বোল ঠিক করে, কড়া রোদে শুকাতে দেয়। ঢাকগুলোই রাজবিহারীর জীবিকার একমাত্র উপায়। বাবাকেও প্রতিদিন ঢাকের যত্ন নিতে দেখেছে সে। নিজ হাতেই কুঞ্জবিহারী ঢাকের যত্ন নিত। এ কারণে মধুবালা কখনো সাহায্য করতে চাইলে রাজবিহারী রাজি হতো না। রাজবিহারী বলে – তোমার কাজ তুমি করো। চাকের যত্ন নিতে তুমি পারবে না। স্বামীর এমন কথা শুনে চুপ হয়ে যেত মধুবালা।

এবার মাঘে শীতটা জেঁকে বসেছে। দূরের এক গঞ্জে দুদিন আগে যাত্রা উৎসব ছিল। যাত্রা উৎসবে ঢাক বাজাতে গিয়েছিল রাজবিহারী। তার ঢাকের তালে তালে নর্তকীদের সে কি উন্মাতাল নাচ। যাত্রা উৎসব থেকে ভালো উপার্জন নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রাজবিহারী। আসার সময় শিবানন্দের জন্য একটা জামা এনেছে রাজবিহারী; কিন্তু বাবার দেওয়া জামাটা পছন্দ হয়নি শিবানন্দের। সে এখন গঞ্জের কলেজে পড়ালেখা করে পোশাকে-আশাকে আধুনিক হয়ে উঠেছে। বাবার দেওয়া জামা যে তার পছন্দ হয়নি, এ-কথা রাজবিহারীকে জানাতে কোনো সংকোচ বোধ করেনি শিবানন্দ। ছেলের আচরণে দুঃখ পেয়েছিল রাজবিহারী। মধুবালাকে ডেকে বলেছে – জামাটা তোমার যাকে খুশি তাকে দিয়ে দিও, নয়তো পুকুরে ডুবিয়ে দিও। স্বামীর মনের দুঃখ বুঝতে পেরে আর কোনো কথা বলেনি মধুবালা।

সূর্যটা মাথার উপরে। রাজবিহারী উঠানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ দিকের নিমগাছটায় একটা কাক কর্কশ সুরে কা-কা করছে। মনে পড়ে সেই কবে উঠানের দক্ষিণ কোণে নিমগাছটা লাগিয়েছিল কুঞ্জবিহারী। এতদিনে ডাল-পালা মেলে বিশাল আকার ধারণ করেছে। বাবা বলেছে, উঠানে নিমগাছ থাকা না-কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। চর্মরোগ হয় না। তাই বাবার লাগানো নিমগাছটা কখনো কেটে ফেলতে চায়নি রাজবিহারী। নিম কাঠ কোনো কাজে লাগে না, ফলও খাওয়া যায় না। তবু গাছটাকে বেড়ে উঠতে দিয়েছে রাজবিহারী। গাছটার দিকে চোখ পড়লেই বাবার কথা মনে পড়ে রাজবিহারীর। মধুবালা দু-একবার বলেছে গাছটা তো কোনো কাজে আসে না। কেটে লাকড়ি কর, অনেকদিন চুলা জ¦ালাতে পারব। কিন্তু রাজবিহারী গাছটা কাটতে কিছুতেই রাজি হয়নি। দুপুরের কাঠফাটা রোদে নিমগাছের ডালে বসে কাকটা একটানা ডেকেই চলেছে। রাজবিহারীর হঠাৎ মনে পড়লো বাবার কথা। ভাবলো বাবাই কি তাকে ডাকছে। কাকটার জন্য মায়া হলো রাজবিহারীর। মধুবালাকে ডেকে বলল, দেখ তো, কাকটাকে এক মুঠ ভাত দিতে পারো কি-না। রান্নাঘর থেকেই কাকের মতো কর্কশ গলায় মধুবালা বলল – পেটে ভাত জোটে না, কাকের জন্য আবার মায়া। চুপ করে গেল রাজবিহারী। সত্যিই তো, সংসার চালাতে এখন তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। ঢাকির কদর কমে গেছে। আগের মতো আয়-রোজগার নেই। এখন চলে মাইক, কলের গান, আধুনিক সব বাদ্যযন্ত্র। শুধু দুর্গাপূজার সময়ই তাদের খোঁজ করে পূজারীরা। একটা নিশ্বাস ফেলে নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো রাজবিহারী।

বাবা কুঞ্জবিহারী ছিল খুব পরিশ্রমী মানুষ। দিন-রাত পরিশ্রম করে সংসারটাকে সাজিয়ে তুলেছে কুঞ্জবিহারী। মায়ের কথা মনে নেই রাজবিহারীর। ওর বয়স যখন দুই বছর, তখন মা হিরণ্ময়ী মারা যায়। সেই থেকে কুঞ্জবিহারী এক হাতে সামাল দিয়েছে সংসারটাকে। রাজবিহারীকে কখনো বুঝতে দেয়নি মায়ের অভাব। তবে সংসারে যত সমস্যাই আসুক না কেন, ঢাকের প্রতি কোনো অযত্ন করেনি কুঞ্জবিহারী। বাবার এই গুণটাই আগাগোড়া পেয়েছে রাজবিহারী। কিন্তু শিবুটার হলো কী? ঢাকের প্রতি ওর ভালোবাসা জাগাতে পারলাম না। বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। মনটা খারাপ হয়ে গেল রাজবিহারীর। আবার বাবার কথা মনে পড়লো। বিক্রমপুর ছেড়ে কীভাবে কটিয়াদীতে আবাস গড়ে তুলেছে বাবা সে-কথা মনে পড়লো রাজবিহারীর। তাদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুর পরগনায়। পদ্মার তীর ঘেঁষে ছিল তাদের কাঠের ঘর। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী পুড়িয়ে দেয় তাদের বাড়িঘর। ছেলে রাজবিহারীকে নিয়ে কুঞ্জবিহারী পালিয়ে গিয়েছিল ভারতে। সল্টলেকের সেই দুঃসহ শরণার্থী জীবনের কথা মনে পড়ল রাজবিহারীর। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে বিক্রমপুর ছেড়ে কুঞ্জবিহারী চলে গিয়েছিল কটিয়াদী। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসতো কুঞ্জবিহারী। সঙ্গে নিয়ে আসতো কিশোর রাজবিহারীকেও। রাজবিহারীর বয়স  তখন পনেরো বছর। পড়ালেখা হয়নি। তাই বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। ক্রমে শিখে নিয়েছে ঢাক বাজানোর কৌশল। এভাবে এক সময় রাজবিহারী হয়ে ওঠে ওস্তাদ ঢাকি।

ঢাক বাজানোর কৌশল শিক্ষার পাশাপাশি কটিয়াদীর ঢাকের হাট সম্পর্কেও অনেক কথা জেনেছে রাজবিহারী। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলছে ঢাকের হাট। দুর্গাপূজার আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকিরা হাজির হয় কটিয়াদীর ঢাকের হাটে। বাদ্য শুনে পূজারীরা ঢাকি নির্বাচন করে। ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত পূজারীর বাড়িতে দুর্গা মন্দিরে অর্থের বিনিময়ে ঢাকিরা ঢাক বাজায়। কটিয়াদীর ঢাকের হাট এক জমজমাট ব্যাপার। ঢাকের হাটে কেবল হিন্দু পূজারীরা নয়, অন্য ধর্মের লোকজনও আসে বাদ্য শোনার জন্য। বাবা বলতো – ঢাকের হাট এ-অঞ্চলের  একটা উৎসব। বাবার কাছ থেকেই রাজবিহারী জেনেছে নামে ঢাকের হাট হলেও এখানে কোনো ঢাক বেচা-কেনা হয় না। ঢাকের বাদ্য শুনে পূজারীরা ঢাকিদের নির্বাচন করে মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধের পর একবার কটিয়াদীর ঢাকের হাটে গিয়ে হাটের ইতিহাস জেনেছে রাজবিহারী। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই ঢাকের হাট। সেবার হাটের এক কোণে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে একটা সভায় উপস্থিত হয়েছিল রাজবিহারী।

অল্প-বয়সের লম্বা চুলের এক যুবক বক্তৃতা করেছিল সে-সভায়। ঢাকের হাট চালু করেছেন কটিয়াদীর সামন্তরাজা নবরঙ্গ রায়। ষোলো শতকের শুরুতে তিনি প্রবর্তন করেন এই ঢাকের হাট। রাজপ্রসাদে দুর্গাপূজার উৎসবে ঢাকি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রবর্তন করেন এই ঢাকের হাট। সেরা ঢাকির সন্ধানে তিনি বিভিন্ন পরগনায় বার্তা পাঠাতেন। বিক্রমপুর পরগনা থেকে অনেক ঢাকি কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসতো। যুবকের বক্তৃতা শুনে এসব ইতিহাস জানা হয় রাজবিহারীর। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে এখানে আসতে আসতে জায়গাটা ভালো লেগে যায় কুঞ্জবিহারীর।

মুক্তিযুদ্ধের পরে বিক্রমপুর ফিরে এসে পোড়া ঘর দেখে প্রথমেই তার মনে পড়ে কটিয়াদীর কথা। সেই থেকে এখানেই আছে তারা। কুঞ্জবিহারীর দেখাদেখি আরো কয়েক ঘর ঢাকি বিক্রমপুর ছেড়ে কটিয়াদীতে আবাস স্থাপন করে।

কটিয়াদীর নতুন পরিবেশে সংসার চালাতে বেগ পেতে হয়েছে কুঞ্জবিহারীর। বাবা আর ছেলের সংসার। কুঞ্জবিহারীকে আবার বিয়ে করার জন্য অনেক স্বজন পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু ছেলে রাজবিহারীর কথা চিন্তা করে সে-পথে আর যায়নি কুঞ্জবিহারী। বরং অল্প বয়সেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে মধুবালাকে ঘরে এনেছে কুঞ্জবিহারী। সেই থেকে মধুবালাই সংসার দেখছে –
বাপ-ছেলে আছে ঢাক নিয়ে।

– রান্না হয়ে গেছে। স্নান সেরে আসো। রাজবিহারীর সামনে এসে চড়া সুরে কথাগুলো বললো মধুবালা। বউয়ের কথা শুনে সম্বিত ফিরে এলো রাজবিহারীর। তাড়াতাড়ি উঠে পুকুরের দিকে গেল সে। পুকুরের পাশে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল শিবু কলেজের পোশাকে বাড়ি ফিরছে। পিঠে ব্যাগ, হাতে মোবাইল ফোন। দৃশ্যটা মোটেই ভালো লাগলো না রাজবিহারীর। এবার নিজের সঙ্গে নিজেই যেন কথা বলছে রাজবিহারী :

– তোমার চোখে ছবিটা ভালো লাগলো না কেন রাজবিহারী?

– ঢাকির ছেলের ওটা পোশাক হলো নাকি!

– তাতে কী? শিবু তো কলেজে পড়ে।

– ঢাকির ছেলের কলেজে পড়ার দরকার কী? সাত-পুরুষের পেশা পরিত্যাগ করা তো আত্মহত্যা।

– এ তুমি কী বলছো রাজবিহারী? ছেলে শিক্ষিত হবে, ভালো চাকরি করবে। এটা তুমি চাও না রাজবিহারী?

– না, আমি চাই না। আমি চাই, ঢাকির ছেলে ঢাকি হবে। তা না হলে আকাশ থেকে ওনারা যে অভিশাপ দেবে।

পুকুরে নেমে গলাজলে দাঁড়িয়ে রাজবিহারী। একটা ডুব দিলো। দুহাত আকাশের দিকে জোর করে প্রণাম করলো রাজবিহারী। মনে মনে বললো, ভগবান, তুমি শিবুর মনটা ঠিক করে দাও। দুর্গাপূজায় দেবীর উদ্দেশে আমি পাঁঠা বলি দেবো। পৈতৃক ঢাক আমি ওর হাতে যেন দিতে পারি ভগবান। তারপর তুমি আমাকে মুক্তি দিও।

খেতে বসে শিবানন্দকে ডাকলো রাজবিহারী। শিবানন্দের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। মধুবালা শিবানন্দের ঘরে যায়। দরজা বন্ধ। ডাক দিলে শিবানন্দ দরজা খুলে দেয় – কিন্তু মায়ের সঙ্গে কোনো কথা বললো না। মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে শিবানন্দ। ফোন কেটে মাকে বলল, এখন খাবে না। মধুবালা এসে রাজবিহারীকে বললো – শিবু পরে খাবে। তুমি খেয়ে বিশ্রাম করো। কাল তো আবার তোমার বায়না আছে। আসার সময় নেত্রকোনা থেকে একটা বালিশ মিষ্টি নিয়ে এসো। কত শুনেছি বালিশ মিষ্টির কথা, কখনো খাইনি। আচ্ছা, আনবো তোমার বালিশ – এই বলে উঠে যাচ্ছিল রাজবিহারী। হঠাৎ আবার বসে পড়লো। আচ্ছা, শিবুর মা, শিবুকে বিয়ে দিলে কেমন হয়?

– ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? কলেজে পড়ালেখা করছে।

– এই বয়সে আমিও তো তোমাকে বিয়ে করেছি। মুচকি হাসলো মধুবালা। তারপর বলল, আচ্ছা, রাতে আমি শিবুর সঙ্গে
এ-বিষয়ে কথা বলব। দেখি কী করা যায়।

শিবানন্দ আছে ভিন্ন জগতে। ঢাকি পদবিটা তার একদম অপছন্দ। সহপাঠীরা তাকে ঢাকি বলে টিপ্পনী কাটে, হাসাহাসি করে। মালতীও জানিয়ে দিয়েছে ওই পদবিটা পাল্টাতে হবে। শিবানন্দও অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। কলেজের খাতায় শিবানন্দ ঢাকি থাকলেও ও এখন নিজেকে পরিচয় দেয় শিবানন্দ দাস বলে। পদবিটা পাল্টে জাতে ওঠার চেষ্টা করে শিবানন্দ। সহপাঠী মালতীকে ভালো লাগে শিবানন্দের – শিবানন্দকেও খুব পছন্দ করে মালতী। দুজনের মনেই উঁকি দেয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। শিবানন্দ চায় পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবে সে। চাকরি নিয়ে চলে যাবে নেত্রকোনা কি কিশোরগঞ্জে। তারপর একদিন মালতীকে ঘরে আনবে। বিয়েতে কোনো ঢাকি আনবে না শিবানন্দ দাস – আনবে কর্নেট আর সানাই – মাইকে বাজবে আধুনিক গান কিংবা ব্যান্ড-সংগীত। মালতীর কাছে একদিন কথাটা বলে শিবানন্দ। মালতী তো হেসেই খুন। শেষে বলল – গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল বাগধারাটার অর্থ তোমার জানা আছে শিবানন্দ? কথাটা শোনার পর থেকে মনটা ভারী হয়ে আছে শিবানন্দর – তবু ওর ভাবনায় সব সময়ই আছে মালতী।

রাতে শিবানন্দকে নিয়ে খেতে বসেছে রাজবিহারী ও মধুবালা। খেতে-খেতে শিবানন্দকে লক্ষ করে মধুবালা বলল – বাবা, আমার বয়স হলো। ঘর-সংসার আর সেভাবে সামাল দিতে পারছি না। এবার তোর বিয়ে দিতে চাই রে বাবা।

– আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে মা? এসব কী ভাবছো তোমরা।

– বয়স হয়েছে না-তো কী? তোর বাবাও তো এই বয়সে বিয়ে করেছে।

– বাবা আর আমি কি এক হলাম না-কি? বাবা তো কখনো কলেজে পড়েনি।

কথাটা শুনে থমকে যায় মধুবালা। রাজবিহারীর গলায় ভাত আটকে যায়। জোরে একটা কাশি দেয় সে। মুখে কিছুই বলে না। নিজেকে সামলে নিয়ে মধুবালা বললো –

– শোন শিবু, ও পাড়ার ঘনশ্যাম ঢাকির মেয়ে ফুলরানিকে আমার খুব পছন্দ। ফুলরানির সঙ্গে তোর বিয়ের কথা ভাবছি আমি। তোর বাবাকে ফুলরানির কথা এখনো বলিনি। তবে তোর বাবাও তোকে এখন বিয়ে দিতে চায়।

– মা, এসব কথা বাদ দাও। সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। তোমরা এ-সময় কী সব আরম্ভ করলে?

– না রে বাবা, আমাদের তো বয়স হয়েছে। আর কত দিনই বা আছি। বিয়ে করে সংসারটা তোরা বুঝে নে বাবা।

– এসব কথা বাদ দাও মা।

– তুই ফুলারানিকে দেখেছিস? বড় সুন্দর মেয়েটা।

কাজে-কর্মেও লক্ষ্মী।

– বাদ দাও। আমি তোমারে আরো সুন্দর বউ এনে দিব। তুমি যদি মালতীতে দেখতে…

কথাটা বলেই থেমে গেল শিবানন্দ। কিন্তু যা বোঝার তা বুঝে গেল মধুবালা। সে-রাতের পর এ-বিষয়ে আর কোনো কথা বলেনি মধুবালা। রাজবিহারীও একেবারে চুপ হয়ে গেছে।

চৈত্র মাসের দোল পূর্ণিমা। কটিয়াদীর ঢাকপল্লিতে উৎসবের আমেজ। সকাল থেকে বাড়িতে বাড়িতে ঢাক-ঢোল বাজছে। মেয়েরা নতুন শাড়িতে সেজে উঠেছে। সধবারা কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরেছে। লাল টকটকে – যেন সাঁঝের বেলার সূর্য। যুবতী মেয়েরা নানা রঙে সেজেছে, সেজেছে ফুলরানিও। শিবানন্দ আজ বাড়িতেই আছে। মেয়েদের আবির খেলা দেখতে বেরিয়েছে সবাই। শিবানন্দ দেখতে পেল শিবমন্দিরের পাশে মা কথা বলছে ফুলরানির সঙ্গে। মন্দ নয় ফুলানির চেহারা। কিন্তু মালতী অনেক সুন্দর, শিক্ষিত। ফুলরানির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল শিবানন্দ। মন্দিরের সামনে ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে – বাদকদলে রাজবিহারীও আছে। ঢাক বাজাতে বাজাতেই ফুলরানিকে এক নজর দেখে নিল রাজবিহারী। শিবুর মা তো ঠিকই বলেছে ফুলরানি অনেক সুন্দর। বড় মিষ্টি মেয়েটি, চোখে কী মায়া। আমাদের শিবুর সঙ্গে খুব মানাবে। বাড়িতে গিয়ে আজ কথাটা বলতে হবে শিবুকে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। এ-কথা ভেবে মধুবালাকে কাছে ডাকলো রাজবিহারী। ফুলরানিকে নিয়েই মধুবালা আসলো রাজবিহারীর সামনে। রাজবিহারীকে প্রণাম করতে বলল মধুবালা। ফুলরানি রাজবিহারীকে প্রণাম করলো, প্রণাম করলো মধুবালাকে। প্রণাম করলো ঢাকটাকেও।

দূর থেকে এসব কাণ্ড দেখছিল শিবানন্দ দাস। বুঝতে পারলো মা-বাবার মনোভাব। ব্যাপারটাকে আর বেশিদূর এগোতে দেওয়া যায় না। আজ রাতেই মা-বাবাকে কথাটা বলতে হবে। রাতে খেতে বসে শিবানন্দ জানিয়ে দিলো তার সিদ্ধান্ত। ফুলরানি ঢাকিতে সে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে করবে মালতী বর্মণকে। বর্মণরা তো অন্য গোত্রের – চিৎকার করে উঠলো রাজবিহারী। ওদের সঙ্গে ঢাকির বিয়ে হয় না। এমন বিয়ে হলে ঈশ্বরের অভিশাপ লাগবে – সাত পুরুষ স্বর্গ থেকে আমাদের শাপ দেবে। শিবানন্দ রাগে গজগজ করতে লাগলো। মুখে কোনো কথা না বলে ভাত রেখে উঠে গেল। মধুবালা ছেলেকে অনেক বোঝানোর  চেষ্টা করলো, কিন্তু শিবানন্দের এক কথা – কোনো ঢাকির মেয়েকে সে বিয়ে করবে না।

ঢাকির ছেলে হয়ে ঢাকির মেয়েকে বিয়ে করবে না – শিবুর মুখে এমন কথা শুনে রাগে-দুঃখে বিমর্ষ হয়ে পড়ে রাজবিহারী। মনে মনে ভাবে – ছেলের মুখে এমন কথা শোনার আগে মৃত্যু হয়নি কেন আমার। কী হবে এমন কুলাঙ্গার ছেলেকে দিয়ে। আঁতুড়ঘরে ও মরলো না কেন? কেন ওকে স্কুলে পাঠিয়েছিলাম? ক্রমে বিষিয়ে ওঠে রাজবিহারীর জীবন। বিকেল হলে এখন আর পাড়ায় হাঁটতে যায় না সে – গল্প করে না সমবয়সী ঢাকিদের সঙ্গে। বিষণ্নতায় পেয়ে বসে রাজবিহারীকে। বাবার কথা মনে পড়ে তার। বাবার ঢাক বাজানোর তামিল কীভাবে সে আয়ত্ত করেছে, তা মনে পড়ে রাজবিহারীর। অথচ শিবানন্দের বেলায় এ কী ঘটলো? মধুবালা সব বোঝে – সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে রাজবিহারীকে। শিবু ঠিক হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা  করো না। এক সময় ঘুমাতে যায় রাজবিহারী, ঘুমাতে যায় মধুবালা। ঘুমের মাঝে শোনা যায় মধুবালার নাকের ডাক। কিন্তু রাজবিহারীর চোখে ঘুম নেই। চোখ বুজতেই শুনতে পায় শিবানন্দ বলছে – কোনো ঢাকির মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। ঢাকির ছেলে হয়ে ঢাকি জাতটাকে কেউ এভাবে অবজ্ঞা করতে পারে? এ কেমন ছেলে হলো আমার। উপরের দিকে দুহাত তুলে ঈশ^রকে প্রশ্ন করছে রাজবিহারী – এ তুমি কী করলে ভগবান?

শিবানন্দের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। কিছুদিন পরে ফল বেরোবে। এখন পড়ালেখা নেই। রাজবিহারী ভাবলো শিবুকে নিয়ে গৌরীপুর যাবে। সেখানে মজুমদার বাড়িতে রয়ানি হবে। মনসামঙ্গল কাব্যপাঠের সঙ্গে ঢাক বাজাতে হবে। রাজবিহারীর শরীরটা ভেঙে গেছে। এখন আর আগের মতো ঢাক গলায় ঝুলিয়ে বেশি সময় বাজাতে পারে না রাজবিহারী। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাই শিবু যদি কিছুটা সাহায্য করে এই ভাবনায় ওকেও নিয়ে যেতে চায় গৌরীপুর। কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তেলে-বেগুনে ফস্ করে উঠলো শিবানন্দ। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি কি ঢাক বাজানোর জন্য। তোমরা কী ভেবেছ আমাকে? মা মধুবালা ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বলে, আরে বাবা, যা না বাবার সঙ্গে। তোর বাবার শরীরটা তো ভালো না।

– শরীর ভালো না তো কবিরাজ ডাকো।

– বাবা, কথাটা শোন।

– না, আমার পক্ষে ঢাক বাজানো সম্ভব নয়। ঢাককে আমি ঘৃণা করি।

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মা-বাবা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মধুবালা, তাকিয়ে থাকে রাজবিহারী। অস্ফুটকণ্ঠে রাজবিহারী বলল – ভগবান, এ কি শুনলাম শিবুর মুখে? এ-কথা শোনার আগে তুমি আমাকে নিয়ে যাওনি কেন? মধুবালা শান্ত করার চেষ্টা করে রাজবিহারীকে, বোঝানোর চেষ্টা করে শিবানন্দকে। শিবানন্দ গট্গট্ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ওর মনে পড়ে মালতীর কথা। মালতী বলে দিয়েছে ঢাক বাজালে শিবানন্দের সঙ্গে আর কথা বলবে না সে। ওটা নাকি সেকেলে পেশা। তাই ঢাকি পদবিটা বদলে ফেলতে বলেছে মালতী, বারণ করেছে ঢাক বাজাতে। শিবানন্দ দাস কি ঢাক বাজাতে পারে? শহরে গিয়ে চাকরি করবে সে। ব্যবস্থা করে দিয়েছে মালতীই। কিশোরগঞ্জ শহরে মামার একটা ফার্মে অফিস সহকারীর চাকরি পাইয়ে দিয়েছে মালতী। ওই চাকরিতেই যোগ দেবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া শিবানন্দ দাস।

মধুবালা ছেলের মুখে আকাশ ভেঙে-পড়া কথাটা শুনল। তিন দিন পর শিবানন্দ বাড়ি ছেড়ে কিশোরগঞ্জ শহরে যাবে চাকরি করতে। সাত-পুরুষের জীবনে এমন অলক্ষুণে কথা কখনো শোনেনি মধুবালা, শোনেনি রাজবিহারী। ওরা বুঝতে পারলো শিবুকে আর ফেরানো যাবে না। কী আর করা? যা হবার তা তো হবেই। শিবুর মঙ্গল করো ভগবান, শিবুর মঙ্গল করো – মনে মনে ছেলেকে আশীর্বাদ করে আকাশের দিকে দুহাত তুলে প্রণাম করলো মধুবালা। কথাটা শোনার পর থেকে একেবারে নির্বাক হয়ে গেল রাজবিহারী।

শরীরটা আরও দুর্বল হয়ে গেছে রাজবিহারীর। এখন আর ঢাকের যত্ন নিতে পারে না সে। শুয়ে শুয়েই কেটে যায় তার সারাটা দিন। গলায় ঢাক ঝুলিয়ে এখন আর ঢাক বাজাতে পারে না রাজবিহারী। তবু বাবার দেওয়া ঢাকটার যত্ন নিতে প্রতি সকালেই ইচ্ছা হয় তার। মধুবালাকে ডেকে বলে – ঢাকগুলো রোদে দাও, ন্যাকড়া দিয়ে ওগুলো মুছে দাও। মনে মনে ভাবে রাজবিহারী, পৈতৃক ঢাকটা বুঝি এবার শেষ হয়ে যাবে। চোখের কোণে জল আসে রাজবিহারীর। শুয়ে শুয়ে ভাবছে তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা, মধুবালার কথা। নিমগাছে কাকটা বুঝি আবার কা-কা করে ডেকে উঠল। ওই বুঝি মধুবালা এক মুঠো ভাত দিচ্ছে ক্ষুধার্ত কাকটাকে। বাবা কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রাজবিহারীর! কটিয়াদীর ঢাকের হাটে মাতাল তালে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কী ঢাক বাজাচ্ছে রাজবিহারী ঢাকি! তন্দ্রার ঘোরেই মধুবালাকে ডেকে রাজবিহারী চিৎকার করে বলে উঠল – এই ঢাক নিয়ে আমি এখন কী করবো?

উঠানের নিমগাছটাকে কাঁপিয়ে সারাটা বাড়ি থেকে ভিন্নভাবে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠলো – এ ঢাকা নিয়ে রাজবিহারী এখন কী করবে…