ওয়ারিশ

ফারুক মঈনউদ্দীন

একদিন রুবিনা অফিসে আসে না দেখে কিছুটা মন খারাপ নিয়ে দিনটা শুরু হয় আমার। ওর পাশে বসতো শেলি, মানে শেলি হক। অফিসিয়াল নাম ইমরানা হক, ডাক নাম শেলি বলে সে নিজের নামকে আধুনিকায়ন করে বলতো শেলি হক। ওর ঠাঁটবাটে মনে হতো যেন কোনো সেক্রেটারি কিংবা নিদেনপক্ষে কোনো শিল্পপতির মেয়ে। পরে জানা যায়, ওর বাবা ছিলেন অবসরের আগে প্রমোশন পেয়ে গ্রেড ওয়ান হওয়া এক সরকারি অফিসার। বরং রুবিনার বাবা অবসরে যাওয়া এক সিএসপি অফিসার, অথচ ওর চলাফেরায় মনে হতো যেন শেলির বাবার মতো কোনো এক সাধারণ সরকারি কর্মচারীর মেয়ে ও।

সেদিন শেলি রোজকার মতো ওর চেয়ারে বসে, ওর পাশের শূন্য চেয়ারটা উলটোপাশ থেকে ভেংচি কাটার মতো আমার দিকে তাকিয়েছিল। অফিসে দেরি করে কেউ আসতেই পারে, তাই অপেক্ষা করছিলাম শেলির পাশের চেয়ারটার শূন্যতা পূর্ণ হয় কি না দেখার জন্য। সামনের ফাইলপত্রের ওপর শূন্যদৃষ্টিতে চোখ বুলাই আমি, চেম্বারের কাচের দেয়ালের ওপাশে বসা তওফিকভাই পাছে কোনো ঝামেলা না করে। একটু উদাস হলেই তওফিকভাই বলেন, ভাই এমুন কবি কবি ভাব নিয়া ব্যাংকে কাজ করণ যায় না। এইগুলা পত্রিকার চাকরিতে মানায়। ব্যাংকের চাকরি অইল গিয়া এক পাও অফিসে আর এক পাও জেলে, এইখানে আনমাইন্ডফুল হইলেই বিপদ। তওফিকভাই এমনই কাজপাগল, অফিসের কাজ ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। আড়ালে-আবডালে ডিপার্টমেন্টের সবাই বলে কাজ জানে আর এরকম ওয়ার্কহোলিক বলে প্রমোশন পেয়ে এতদূর উঠে এসেছে। দুপুর পার হওয়ার পরও সেই শূন্য চেয়ারটা পূর্ণ হয় না দেখে আমি শেলিকে বলি, কী ব্যাপার, আজ রুবিনা এলো না কেন? শেলি বলে, ও তো কাল রাতেই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে, তুমি জানো না?

আমি অবাক হয়ে বলি, না তো! হঠাৎ হাসপাতালে কেন?

শেলি বলে, কাল বিকেল থেকেই বলছিল ওর বাঁ-হাতে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা না কমায় রাতে ডাক্তার হাসপাতালে রেফার করেছে। হাসপাতাল থেকে বলছে হার্টের সমস্যা। অবশ্য ওর হাজবেন্ড নাকি শুনেই বলেছিল, বাঁ-হাতে এরকম ব্যথা এনজাইনার লক্ষণ।  

আমার ভেতর থেকে একটা ধাক্কা এসে লাগে। তবু বিষয়টাকে হালকা করার জন্য বলি, আরে ধুর, স্টুডেন্ট লাইফ থেকে হার্টের কারবারে সাকসেসফুল হয়ে এতদূর এসেছে, তার আবার হার্টের সমস্যা!

রুবিনা প্রেম করেই বিয়েটা করেছিল বলেই জানতাম। এই গল্পও ওর মুখ থেকে শোনা, সে-কারণেই কথাটা বলি।

শেলি একটা মেয়েলি মুখঝামটা দিয়ে বলে, বেচারী হার্টের সমস্যা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে, তোমার সবকিছুতেই ঠাট্টা!

আমি বলি, হার্টের সমস্যা ওর হতেই পারে না। ডাক্তাররা মাঝে মাঝে এরকম উলটাপালটা ডায়াগনোসিস করে। দুদিন পরই রিলিজ করে দেবে, বলবে তেমন কিছুই নয়, ওটা স্পন্ডেলাইটিস থেকে রেডিয়েট করা ব্যথা। 

কিন্তু দুদিন গিয়ে চারদিন পার হলেও রুবিনাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় না, কারণ সমস্যাটা হার্টের বলেই ডাক্তাররা কনফার্ম করেছে।

মফস্বল শহর থেকে হেড অফিসে বদলি হয়ে আসার পর যেখানে আমার পোস্টিং হয়, রুবিনা সেখানেই ছিল। জানতাম হেড অফিসে নতুন যারা আসে তাদের মুরগি বানানো হয়, আমিও মনে মনে সেরকম প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলাম। কিন্তু রুবিনা কেন জানি না প্রথম থেকেই আমাকে আগলে রেখেছিল। ও প্রকাশ্যেই ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েদের বলে, শোনো, ওর সঙ্গে কোনো ঝামেলা করবা না, বেচারা হেড অফিসে আসছে নিজের ইচ্ছায় না। এখন তোমরা যদি ওরে জ্বালাও ও যাবে কোথায়? এরকম অকাট্য যুক্তির সামনে টিকতে না পেরে ওরা ‘জি আপা’ বলে সামনে থেকে সরে গিয়েছিল।

আমাকে এরকম ডানার নিচে আগলে রাখার মতো করে রক্ষা করার জন্য ওর চেষ্টা আমার আঁতে লাগে, একদিন লাঞ্চরুমে একা পেয়ে বলি, এখানে বদলি হয়ে এলে প্রথম মাসের মাইনে থেকে খাওয়ানোর একটা রেওয়াজ আছে শুনেছি। আমার বেলায় ওটা বাদ যাবে কেন? ওরা একবেলা খেতেই তো চায়, বাধা দিচ্ছেন কেন?

রুবিনা একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,

 তোমাকে কসমোপলিটন বানানো অসম্ভব। বেশি ভালমানুষী দেখানোর দরকার নাই। খাওয়ানোর অফারটা তুমিই দেবে দুমাস পর, কিন্তু ওরা জোর করে আদায় করে নেওয়া মানে তোমাকে মুরগি বানানো। সেটা কেন হবে? সেজন্যেই ঠেকিয়ে রেখেছি। কারো কাছ থেকে জোর করে খাওয়া আদায় করে নেওয়ার মধ্যে একটা আজাইরা স্মার্টনেস থাকে, ওদের সেটা দেখানোর সুযোগ দিবা ক্যান? বুঝলা গুডি-গুডি বয়?

আমি বলি, এত কিছু বুঝি না। তাহলে আপনিই বলবেন কখন খাওয়াতে হবে। আমার পক্ষ হয়ে অফারটা আপনিই দেবেন ওদের।

রুবিনা বলে, না, তুমিই অফার দেবে, সময় হলে আমি তোমাকে বলবো।

নানান বিষয়ে নজর রেখে রুবিনা এভাবেই খবরদারি করতো আমার ওপর। 

একবার শেলি আমাকে ডেকে একটা ফাইল নিয়ে যেতে বলে ওর কাছে। ফাইল নিয়ে ওর টেবিলের সামনে যাই। সামনের চেয়ারে একটা মেয়ে বসা, মেয়েটিকে পাশ থেকে এক ঝলক দেখে বলি, আমি পরে আসি তাহলে। শেলি হাতের ইশারায় বসতে বলে ফাইলটার কয়েক পাতা একটু উলটে-পালটে দেখে বন্ধ করে রাখে। তারপর বলে, ও আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দিই, এ হচ্ছে আমার কাজিন, ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে, সোশিওলজি। মাঝে মাঝেই হল থেকে চলে আসে আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে বলে।

মেয়েটির মুখভাব দেখতে পাই না। ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য বলি, আরে কী আশ্চর্য! আমি যখন মহসীন হলে থাকি, মাসের শেষে পকেটে টাকা না থাকলে বাসে চড়ে এই মতিঝিলেই আমার এক মামাতো ভাইয়ের অফিসে চলে আসতাম লাঞ্চ খাওয়ার জন্য।

শেলি বলে, না না, ও সে-কারণে আসে না, এমনিতেই চলে আসে। ও তো তোমার মতো উড়নচণ্ডী নয় যে মাসের শেষে লাঞ্চ খাওয়ার টাকা থাকবে না।

– আচ্ছা বুঝলাম। যাই, এখানে বসে আছি দেখলে তওফিকভাই বলবেন, অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি।

শেলি বলে, আজ তুমিও আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাবে। তিনজনের জন্য খাবার আনতে বলে দিয়েছি। আমি, ‘না না, আমার জন্য দরকার ছিল না’ বলে আপত্তি করলে শেলি বলে, তোমাকে অত ভদ্রতা করতে হবে না।

লাঞ্চ আওয়ারে শেলি ডেকে পাঠালে অফিসের ছোট ডাইনিং রুমে কাজিনকে পাশে নিয়ে ওকে বসে থাকতে দেখি, উলটোদিকের চেয়ারে রুবিনা। আমাকে রুবিনার পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বলে শেলি। বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে প্লেটে ঢালতে ঢালতে শেলি বলে, আমরা শেয়ার করে খেতে পারবো, এরা অনেকখানি খাবার দেয়।

রুবিনা ওর বাসা থেকে আনা খাবার বের করতে করতে বলে, না রে, আমি বাইরের খাবার অ্যাভয়েড করি। তোমরা খাও। রুবিনার কণ্ঠ কিছুটা গম্ভীর মনে হয়। আমার ভুলও হতে পারে ভেবে বলি, ইস্, শেলি খাওয়াবে জানলে রুবিনা আজ বাসা থেকে খাবার আনতো না।

রুবিনা কেবল বলে, আগে জানলেও বাসা থেকেই আনতাম।

শেলি বলে, কেন, তুমি বুঝি আগে কখনোই বাইরের খাবার খাওনি?

রুবিনা মাথা না তুলে বলে, আগে খেতাম, আজকাল আর খাই না।

আমি শেলির মুখভাব দেখতে গেলে ওর কাজিনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। মেয়েটা মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকে চোখ নিচু করে। শেলি কেবল অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে খাওয়ায় মন দেয়। শেলির ইউনিভার্সিটিতে পড়া ঝকঝকে কাজিনটির রমণীয় উপস্থিতি সত্ত্বেও ঘরের আবহাওয়াটা একটু গুমোট হয়ে যায় যেন।

কয়েকদিন পর রুবিনা আমাকে একা পেয়ে বলে, অ্যাই, আজ আমার সঙ্গে বইমেলায় যাবে তুমি।

আমি বলি, জো হুকুম, কী সৌভাগ্য আমার। আপনার নতুন গাড়িটাতে চড়ার সুযোগ পাবো আজ।

রুবিনা গলা নামিয়ে বলে, জি না, আজ গাড়ি আসতে পারবে না। রিকশাতেই যেতে হবে।

– ও, সেজন্যই আমাকে বডিগার্ড হতে হবে?

রুবিনা বলে, হ্যাঁ, তুমি হইবা বডিগার্ড! তুমি তো ঢাকা শহর ভালো করে চিনই না। বেশি কথা না, যেতে পারবা তো?

– না পারার কোনো কারণ নাই, আমি তো প্রায় রোজই একা একা ঘুরি মেলায়। আপনার সঙ্গে গেলে আর একা লাগবে না।

রুবিনা চোখ পাকিয়ে বলে, হইসে, বেশি কথা বলো তুমি।

সেদিন অফিসশেষে রুবিনার পরামর্শে ওর আগে নিচে নেমে যেতে হয়, একটু পরে নামবে ও। দুজনে একসঙ্গে যাচ্ছি এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে। রিকশায় ওঠার পর রুবিনা ফেটে পড়ে আমার ওপর, বিরিয়ানি জীবনে খাও নাই তুমি?

আমি এরকম আচমকা আক্রমণের পূর্বাপর না বুঝে বলি, খাবো না কেন? ঘটনা কী কন তো?

– বিরিয়ানি খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে শেলি যে তোমাকে কনে দেখিয়ে দিলো, বুঝতে পারো নাই?

তখন মনে পড়ে ফাইল দেখার নাম করে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া, কাজিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, একসঙ্গে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা, মুখোমুখি বসার ব্যবস্থা – সবই শেলির পরিকল্পনামাফিক হয়েছিল। আমার মাথায় অতকিছু আসেনি। রুবিনা ঠিকই ধরে ফেলেছে। মেয়েরা কীভাবে যে অন্য মেয়েদের বিষয়গুলো এত সহজে বুঝে ফেলে! আমি বিষয়টাকে হালকা করার জন্য বলি, ভালোই তো, বাজারে আমার যে দাম আছে, তার পরীক্ষা হয়ে গেল। কনেপক্ষের মনে হয় আমাকে পছন্দ হয়নি। তা না হলে এতদিনে শেলি কিছু তো বলতো।

রুবিনা ওর কনুই দিয়ে খোঁচা দেয় আমাকে, বলবে দেখো, তুমি এখানে আসার আগে, আরো কয়েকজনকে দেখিয়েছে মেয়েটাকে। জানি না কেন আর এগোয়নি ব্যাপারটা।

– কেন, মেয়েটাকে দেখতে তো ভালোই মনে হলো।

– তোমার চোখে এখন সব মেয়েকেই দেখতে ভালো লাগবে। এটা হচ্ছে ভালো লাগার বয়স, মেয়েদেরও সুন্দর লাগার বয়স। তাই বুঝতে পারোনি, মেয়েটার সবকিছুই আলাদা আলাদা সুন্দর, কিন্তু সব একসঙ্গে ধরলে কেন জানি সুন্দর মনে হয় না। শেলি তোমাকে কনফার্ম বলবে দেখো। ও অনেক চাল্লু, সঙ্গে সঙ্গে বললে কেমন দেখাবে, তাই খুব সাবধানে একদিন কথাটা তুলবে দেখে নিও। আর এমন কায়দা করে কথাটা তুলবে যে তুমি টেরই পাবে না। শোনো, তোমার সঙ্গে কথাটা পাড়লে বলবে, তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছে পরিবার থেকে, তোমারও পছন্দ আছে ওখানে। মনে থাকবে তো? তুমি যেরকম ক্যাবলা, গলে যেও না আবার।

আমি হেসে ফেলি, আরে আমার এখন এসবের কিছুই মাথায় নেই।

রুবিনা বলে, মাথায় থাকলেও শেলির কাজিনের সঙ্গে ঝুলে পড়বা না তুমি, বলে রাখলাম।

আশপাশের অফিস ভাঙা ভিড়ের জ্যামের কোলাহল আর ওর শরীর থেকে বাসি পারফিউমের ঘ্রাণ ছাড়িয়ে উঠে আসে ওর কণ্ঠের বিতৃষ্ণা। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করি রুবিনা কী কারণে এরকম খাপ্পা হয়ে আছে। আর আমি কোন মেয়েকে বিয়ে করবো এটা নিয়ে ওর এত মাথাব্যথা কেন? শেলির সঙ্গে গলায় গলায় ভাব দেখে কে বলবে ভেতরে ভেতরে এরকম অবস্থা। দুজনে প্ল্যান করে একই দর্জি থেকে নতুন ফ্যাশনের হাই কাট কামিজ-সালোয়ার বানানো থেকে শুরু করে একসঙ্গে মিরপুরের বেনারসি পল্লি থেকে শাড়ি কেনা – কোনো কিছুই তো বাদ যায় না। ভেবে কোনো কারণ খুঁজে পাই না আমি। আমি কিছু বলছি না দেখে ও বলে, কিছু বলছো না যে? তুমি আসলে মিচকা শয়তান একটা।

আমি হেসে ফেলি, আরে বাবা, আপনার অত না ভাবলেও চলবে। আমি জানি আমাকে কী বলতে হবে। ঢাকার ছেলেদের মতো চালু না হলেও জীবনের অনেক কিছুই শেখা আছে আমাদের। রুবিনা গম্ভীর গলায় বলে, কথাটা মনে থাকে যেন। 

দোয়েল চত্বরের কাছে রিকশা ছেড়ে দিতে হয়। ভিড় বাঁচিয়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে রুবিনা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকানগুলোর কোনোটির সামনে থেমে এটা-ওটা দেখে দেখে এগোয়। আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি, বিরক্তি লাগে না। কোনো তাড়া নেই আমার। রুবিনারও যে বইমেলায় ঢোকার খুব ইচ্ছে আছে মনে হয় না। যেন বৈশাখি মেলায় এসেছে ও। সেদিন বইমেলায় যাওয়ার জন্যই যাওয়া ছিল, কেনা দূরে থাক, কোথাও একটা বইও দেখা হয় না। মেলার ভিড়ের মধ্যে গা বাঁচিয়ে হাঁটতে গিয়ে মাঝে মাঝেই রুবিনার শরীরের আলতো ছোঁয়া লাগছিল বলে জনসমাগমকে বিরক্তিকর মনে হয় না আমার। মেলা মাঠের একপাশে রুপালি পাতের মতো সটান উঠে যাওয়া স্তম্ভটার পা ডোবানো জলের প্রান্ত ঘিরে নিচু পাঁচিলের ওপর বসার এক চিলতে জায়গা নেই দেখে রুবিনা বলে, কোথায় নিয়ে এলে, এখানে তো মাছি-পড়া ভিড়। যেন দোষটা আমার, এভাবে ধমক দিয়ে বলে, চলো বের হয়ে যাই, খুব হয়েছে বইমেলা দেখা।   

অফিসে ওর শূন্য চেয়ারটা দেখে এসব কথা মাথায় ভিড় করতে থাকে আমার। পুরো সপ্তাহ কেটে গেলেও রুবিনা অফিসে আসে না। তাই এক ছুটির দিনে দুপুর বেলায় ওকে দেখতে হাসপাতালে যাই। ছুটির সেই ভরদুপুরে কেউ নেই ওর কাছে। কেবিনে একা শুয়ে ছিল ও। বেডের মাথার দিকে ওপরে লাগানো মনিটরের পর্দায় সবুজ পথ এঁকে এগিয়ে চলেছে ওর হৃদস্পন্দন, পথে পথে রেখে যাচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী খাড়া সরু পাহাড়ের মিছিল। আমাকে দেখে রুবিনা বলে, এতদিন পর মনে হলো? আমি বলি, আরে প্রথমদিকে আমি শুনে তো পাত্তাই দিইনি, হার্টের কারবার করে এতদূর আসতে পেরেছেন, এ-কথা বলেছি বলে শেলির কাছ থেকে বকা খেতে হলো মাঝখানে। ওর মুখে মৃদু হাসির মধ্যে কষ্টের ছায়া ফোটে, দুই চোখে ঘরের বাতির বিন্দুগুলো নড়াচড়া করে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখে কান্না সামলায় ও।

আমি বলি, আরে অত চিন্তা কইরেন না তো, দেখবেন ভালো হয়ে যাবেন আপনি, অত দুশ্চিন্তা করলে হার্টের আরো ক্ষতি হবে।

ও আমার হাত চেপে ধরে নিজের কান্নাকে ঢেকে রেখে বলে, আমার ছেলেটা এখনো অনেক ছোট, আমি মারা গেলে ওর কী হবে? আমার নিজের চোখেও অশ্রু স্ফীত হয়ে ওঠে টের পাই।

ও বলে, অফিস থেকে তুমিই প্রথম এলে, আর কেউ আসেনি।

আমি ওর হাত ধরে রাখি, এরকম রোগে ভিজিটর যত কম আসে ততই ভালো, এরকম সময় আবেগ পেশেন্টের জন্য ক্ষতিকর।

এত কষ্টের মধ্যেও একটু হাসির চেষ্টা করে ও বলে, থাক, তোমার অত ডাক্তারি ফলাতে হবে না। তাহলে তুমি এলে কেন? তোমাকে দেখলেও যে ইমোশনাল হতে পারি, এটা ভাবোনি তুমি?

‘তাহলে আমি চলে যাই’ বলে ওঠার উপক্রম করলে ও কিছু না বলে আমার হাত চেপে ধরে রাখে, সে-হাত খুব অস্পষ্টভাবে মৃদু কাঁপে। তারপর একসময় চরম আশ্লেষ শেষের শিথিলতার মতো হাতটা নেতিয়ে পড়ে যেন। আমি নিজের হাতটা টেনে নিয়ে বলি, কী হলো, খারাপ লাগছে? ও মাথা নাড়ে, ওর চোখের কোণ থেকে কয়েকটা বিন্দু শার্সির বাইরের শরীর থেকে নেমে যাওয়া বৃষ্টির জলের ফোঁটার মতো দ্রুত নেমে যায়।

এ-সময় নার্স ঢুকে এটা-ওটা দেখে, তারপর ওকে জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে আজ? রুবিনা সামান্য হেসে বলে, জানি না কেমন লাগছে। আমি মনিটরের দিকে তাকাই, কিছুক্ষণ পরপর লাফিয়ে উঠে অবিরত বয়ে চলা রেখাটা একইভাবে চলছে, একপাশে হার্ট রেট, ব্লাড প্রেশার আর টেম্পারেচার দেখানো সংখ্যাগুলো নানান রঙের আলোতে নির্জীব জ্বলে থাকে। নার্সটি থাকতে থাকতেই বলি, আমি আজ যাই, কাল আসবো আবার। ও মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছিল, আমি ঠোঁটে তর্জনী ছুঁইয়ে ওকে নিরস্ত করি। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে হেলেপড়া উৎকট রোদের মধ্যে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে কী যেন একটা ভাঙচুর হচ্ছে বুঝতে পারি, ধরতে পারি না। মুখে ওকে অভয় দিলেও নিজের ভেতরের শঙ্কা দূর হয় না।

যাবো বলে এলেও পরদিন আমার আর যাওয়া হয় না। তার পরের দিন রুবিনাকে দেখতে যাবো এই কথা বলে একটু আগে বের হওয়ার জন্য তওফিকভাইয়ের কাছে গেলে তিনি একটু গাঁইগুঁই করে বলেন, কোনো কাজ পেন্ডিং রাইখা দাও নাই তো? কিছু পেন্ডিং নেই শুনে বলেন, ঠিক আছে, যাও, তুমি একলা মানুষ, আমরা চাইলেই তো যাইতে পারতাছি না। আজ এমডি সায়েব জিগাইলেন, আমরা ওর খোঁজখবর রাখতাছি কি না। কইলাম আমাগোর তরফ থেইকা রেগুলার যাইতাছ তুমি ।

হাসপাতালে যখন পৌঁছাই, তখন সন্ধ্যাকে ছোঁয়ার জন্য বিকেলের ছায়াগুলো তাদের দীর্ঘ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুবিনার কেবিনের সামনে গেলে বাইরে ছোট একটা জটলা দেখতে পেয়ে একটা অদৃশ্য মুঠি আমার বুকের মধ্যে খামচে ধরে, জটলার কাউকেই চিনতে পারি না। ভেতরে উঁকি দিয়ে নাজমুলভাইকে দেখতে পাই। আমার চোখাচোখি হলে তিনি হতাশার ভঙ্গিতে খুব আবছা মাথা নাড়েন। আমি কোনো কথা না বলে বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। নাজমুলভাই অস্ফুটস্বরে বলেন, ডাক্তার এসে এতক্ষণ বুকে পাম্প করে গেছে। খুব আশা নেই। আমি কোনো কথা না বলে মনিটরের দিকে চোখ তুলে তাকাই, ওখানে সচল রেখাটা সোজা চলতে চলতে কিছুক্ষণের বিরতিতে লাফিয়ে উঠছে, জ্বলজ্বল করা সংখ্যাগুলো কাউন্টডাউনের মতো নিচে নেমে যাচ্ছে, রেখাটা এভাবে টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে ক্লান্তভাবে শুয়ে পড়ে একটা সরল রেখা হয়ে যায়, লাফিয়ে ওঠার শক্তি পায় না যেন। নাজমুলভাই কেঁদে ওঠেন, আমি কান্না চাপতে বাইরে চলে আসি। রুবিনার বাচ্চাটাকে একজন ‘মামা তুমি আমার সঙ্গে আসো’ বলে নিজের সঙ্গে সেঁটে নিয়ে দীর্ঘ করিডর ধরে দূরে নিয়ে যায়, ছেলেটি ওর এলোমেলো অশক্ত পায়ে মামার সঙ্গে অনিচ্ছুক পায়ে হাঁটে। পেছনে একটা কান্নার রোল উঠলে ছেলেটিকে নিয়ে দ্রুত পা চালায় যুবক। আমিও দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি, যাতে কান্নার করুণ কোরাস আমাকে ছুঁতে না পারে। নিচে নেমে ছেলেটার সরু কণ্ঠ শুনতে পাই ‘আমি মার কাছে যাবো’। যুবকটি ওকে কিছু একটা বলে সান্ত্বনা দেয়, আমি শুনতে পাই না। উদ্গত কান্না আটকানোর জন্য একটা ফাঁকা জায়গার খোঁজ করি আমি। এদিক-সেদিক অনেক লোকের দেখা মেলে, অথচ  জায়গাটা কবরখানার মতো নির্জন মনে হয়।

সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে ভূতগ্রস্তের মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়াই আমি, সেদিন বের হয়ে আসার সময় কী বলতে চেয়েছিল ও, আর কখনোই শোনা হবে না ভেবে একটা প্রবল হাহাকার আমার ভেতর জোরালো হাওয়ার মতো বয়ে যায়। ওর কথাটা না শুনে বের হয়ে এসেছিলাম বলে একটা অপরাধবোধ আমাকে চিড়ে ফেলতে চায়। এখন কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা নেই আমার, তাই অপরাধী যেমন নিজের অজান্তে অকুস্থলের দিকে যায়, আমিও তেমনি এদিক-সেদিক উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে হাসপাতালে চলে আসি আবার। কেবিনের সামনে কয়েকজন মহিলা নিচুস্বরে গুনগুন করে কাঁদছিল, নাজমুলভাই বোবার মতো দাঁড়িয়ে। কয়েকজনকে খুব তৎপর দেখা যায়, বডি কীভাবে নিয়ে যাবে, ডেথ সার্টিফিকেট দিতে কত সময় লাগবে – এসব নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এরা রুবিনার ভাই হতে পারে, কিংবা নিকটাত্মীয়। আমি আস্তে আস্তে নাজমুলভাইয়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াই, ওঁর স্ত্রীর পরিবারের লোকজনই সবকিছু করছে, নাজমুলভাইয়ের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করার দরকার মনে করছে না।

আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করি, এখন কোথায় নেবেন ওকে?

নাজমুলভাই ধরা গলায় বলেন, ওর ভাইয়েরা বলছে ওদের বাসাতেই নিয়ে যাবে, আমার কোনো কথা শুনছে না কেউ।

আমি বলি, ছেড়ে দেন তো, যেখানেই নিয়ে যাক, ফাইনালি তো এক জায়গাতেই নিতে হবে, মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য কোথায় নিয়ে রাখলো তাতে কী আসে-যায়?

নাজমুলভাই বলেন, এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন, কিন্তু আমার কথা কেউ শুনছে না।

আমি বলি, থাক, আপনি এটা নিয়ে আর কথা বলবেন না। আপনার বউ হলে কী হবে, ওদেরও তো কারো বোন কিংবা খালা।

নাজমুলভাই চুপ করে রুমালে চোখ মোছেন। তারপর বলেন, আমার বাচ্চাটাকে কে যে কোথায় নিয়ে গেল।

– একজন ওকে ওর মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে দেখলাম, মামা বলেই তো ডাকলো শুনলাম। ভালোই করেছে, সবাই যেভাবে কাঁদতে শুরু করেছিল, ও ভয় পেয়ে যেতো। তারপর বলি, আমি তো আপনার শ্বশুরবাড়ি চিনি না, তাহলে আপনার সঙ্গেই যাবো আমি। নাজমুলভাই মাথা নাড়েন, তারপর বলেন, এখন আমার সঙ্গেই থাকো তুমি, এত লোকের মাঝখানেও লোনলি লাগছে খুব।

সব আনুষ্ঠানিকতা সারতে ঘণ্টাদুয়েকের মতো লাগে। আমি নাজমুলভাইয়ের সঙ্গে সেঁটে থাকি। এর মধ্যে রুবিনার ভাইদের একজন ডিউটি ডাক্তারকে বলে, আর কোনো ফর্মালিটি বাকি আছে? এখন কি বডি আমরা নিয়ে যেতে পারি? ফ্রিজার ভ্যানও রেডি।

নাজমুলভাই আমার দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন, দেখো, মারা গেছে দুই ঘণ্টাও হয়নি এখনো, এর মধ্যেই রুবিনা হয়ে গেছে বডি। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকি।

এর মধ্যে এক এক করে আত্মীয়স্বজন হাসপাতাল ছাড়ছে। লম্বাচওড়া একজন নাজমুলভাইয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলে যান, নাজমুল আমাদের বাসায় চইলা আসো। সেখান থেইকা সকালে দাফনের জন্য নেওয়া সাব্যস্ত হইছে। নাজমুলভাই ‘জি আচ্ছা’ বলে সায় দেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বলেন, রুবিনাদের সবার বড় ভাই। আমি বলি, এখন যাবো আমরা? নাজমুলভাই বলেন, না, রুবিনাকে নিয়ে যখন রওনা হবে, তখন। ওকে এখানে ফেলে কীভাবে যাই?

নাজমুলভাইয়ের সঙ্গে যখন রুবিনার বাবার বাড়ি পৌঁছাই, তখন রাত প্রায় আটটা। ফ্রিজার ভ্যান থেকে ওকে নামিয়ে খাটিয়ায় রাখা হয়েছে গোসল দেওয়ার জন্য। সাদা চাদরে ঢাকা খাটিয়াটা গাড়ি রাখার শেডের নিচে করুণভাবে শুয়ে আছে। বহু লোকজনের আনাগোনায় হট্টগোলের মতো পরিবেশ। অফিসের কয়েকজনকেও দেখা যায় এক জায়গায়। আমি ওদের দেখেও এগিয়ে যাই না, কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার। কাছের মাদ্রাসা থেকে কয়েকজন ছাত্র সিপারা নিয়ে এসেছে দেখলাম, রাতভর তেলাওয়াত করবে ওরা। চেনা-অচেনা এই ভিড়ের মধ্যে রুবিনার ছেলেটা একা একা ঘুরছিল, আমি ওকে ডেকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুমি এখানে কী করো? তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে খাটিয়াটার কাছে যাই। ও খুব শিশুসুলভ কৌতূহলে বলে, আমার মাকে এখানে শুইয়ে রেখেছে কেন? আমি কোনো জবাব দিতে পারি না, এই সরল প্রশ্নটি আমার ভেতরে প্রবল তোলপাড় করে ওঠে। যে-কান্না এতক্ষণ ধরে চেপে রেখেছিলাম সেটি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারি না আমি।

দুই

রুবিনা চলে যাওয়ার পর ওর জায়গায় এখনো কেউ আসেনি, এত জলদি আসার কথাও নয়। শেলি বলে, কে যে আসবে এখানে কে জানে। যে-ই আসুক ওর মতো কি আর হবে?

কেউ ওর কথার জবাব দেয় না, রুবিনার শূন্য চেয়ারটাও কেবল অলক্ষে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যেন। এর মধ্যে একদিন নাজমুলভাই এসে হাজির, কিছুটা উস্কোখুস্কো বিভ্রান্ত চেহারা। সবাই ওকে দেখে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর আগে রুবিনাকে নিয়ে যেতে দুয়েকবার অফিস ছুটির আগে এসেছিলেন অফিসে। তিনি এলে বেশ একটা হাসিঠাট্টার পরিবেশ তৈরি হয়ে যেতো। আজ তার চেহারায় সেরকম কিছুর চিহ্ন নেই, থাকার কথাও নয়। তাঁকে দেখে কেউ বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঘিরে থাকে সবাইকে।

নাজমুলভাই বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকেন। কেউ একজন নীরবতা ভাঙার জন্য বলে, চা-কফি কি খাবেন ভাইয়া? নাজমুলভাই মাথা নেড়ে বলেন, কিছুই লাগবে না, শুধু পানি দিতে বলেন এক গ্লাস। কাউকে কিছু বলতে হয় না। অফিসের পিয়নটা ছুটে যায় পানি আনতে। খবর পেয়ে তওফিকভাই তার চেম্বার থেকে বের হয়ে আসেন। নাজমুলভাইকে ঘিরে ছড়ানো-ছিটানো আমাদের দেখে কিছুই বলেন না তিনি। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে নাজমুলভাইয়ের কাছে গিয়ে বসেন। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে থেকে একসময় যেন কথা কথা খুঁজে পান, আপনারে কওনের মতন কিছু খুঁইজা পাইতেছি না ভাই। আমরা কেউ ভাববারও পারি নাই ওর এমুন মৃত্যু অইব। ধৈর্য ধরেন ভাই, সব সইয়া যাইব এক সময়। এইদিকে কুনো কাজে, নাকি এমনিতেই?

নাজমুলভাই বলেন, হ্যাঁ কাজ ছিল আপনাদের ব্রাঞ্চেই। আপনারা হয়তো জানেন, ওর বেশ কয়েকটা এফডিআর ছিল, সব আপনাদের মেইন ব্রাঞ্চে। আলমারিতে সব একসঙ্গে পাওয়া গেল। আমার জানাই ছিল না, এত টাকার এফডিআর করে ফেলেছিল ও। সংসারে ওর ইনকামটা তো আসলে প্রয়োজন হতো না, আমিও কখনো জিজ্ঞাসা করিনি বেতনের টাকাটা কী করে ও। নিজের ইচ্ছেমতো ঘরের এটা-সেটা কিনে আনতো। আমার আর ছেলের জন্য অদরকারি দামি জামাকাপড় কিনে ফেলতো। ওর বাবার বাড়ির কাউকেও খরচ দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। আর আমরা যে-অবস্থায় বিয়ে করেছি, লাগলেও ওর টাকা নিতো না ওরা। এখন বুঝতে পারছি বেঁচে যাওয়া টাকাগুলো সব এফডিআর করে রাখতো ওর নামে।

এটুকু বলে নাজমুলভাই কয়েক ঢোক পানি খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর যেন কথার খেই ধরার মতো বলেন, বিভিন্ন ডেটের কয়েকটা এফডিআর মিলে চোদ্দো-পনেরো লাখ টাকার মতো হবে। ও যেহেতু মারা গেছে ম্যাচিওরিটির পর এগুলোর এনক্যাশমেন্ট কীভাবে হবে জানতে গিয়েছিলাম আপনাদের ব্রাঞ্চে। আমার জানামতে এগুলোর নমিনি আমি। কিন্তু ব্রাঞ্চ থেকে যা বলা হলো, আমি শুনে তাজ্জব।

কেউ একজন বলে, কী বললো?

– ওরা জানালো, আমি নমিনি ঠিকই, কিন্তু ও মারা যাওয়ার পরদিনই ওর ভাই এসে একটা দরখাস্ত দিয়ে গেছে, যাতে রুবিনার কোনো অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য কাউকে দেওয়া না হয়। সাকসেশন সার্টিফিকেট অনুযায়ী যার যা প্রাপ্য সেভাবেই পেমেন্ট করতে হবে।

তওফিকভাই প্রায় লাফ দিয়ে ওঠেন, মারা যাওনের পরদিনই! এইগুলা কি মানুষ? কুলখানি তক সবুর করল না অরা?

নাজমুলভাই বলেন, ওর গাড়িটাও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, ভাগ্যিস ড্রাইভার চাবি দিতে রাজি হয়নি। ও বুদ্ধি করে বলেছিল, লোন নিয়ে কেনা বলে গাড়ি ব্যাংকের নামে।  

তওফিকভাইকে বেশ উত্তেজিত মনে হয়, ভাই অগো নামে একটা জিডি কইরা রাখেন, এরা সাংঘাতিক মানুষ, কহন আবার জোর কইরা গাড়ি নিয়া যায়।

নাজমুলভাই ম্লান হাসেন, না অতদূর হয়তো করবে না, গাড়ির কাগজপত্র ব্যাংকের নামে শুনে বুঝে নিয়েছে, ও গাড়ি হজম করতে পারবে না ওরা। কিন্তু এফডিআরগুলো ঠিকই আটকে দিয়েছে, নমিনির ব্যাপারটা ওরা আমলেই নিচ্ছে না। আপনাদের ব্রাঞ্চও দেখলাম কনফিউশনে আছে।

তওফিকভাইকে কিছুটা চিন্তিত মনে হয়, নমিনি থাকলে আবার সাকসেশন সার্টিফিকেট লাগবো ক্যান? নমিনিরই তো পাওনের কথা। এর লাইগাই অ্যাকাউন্ট খোলনের সময় নমিনি মাস্ট থাকন লাগে। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলেন, অ্যাই, একজন এক্ষুনি এইচআর থেইকা খবর লও তো রুবিনার পিএফ, গ্র্যাচুইটির নমিনি কারে করা আছে?   

নাজমুলভাই আরেক ঢোক পানি খান, আমারও সেই কথা। রুবিনা মাঝে মাঝে কাগজপত্রে আমার সই নিতো, কিছু জিজ্ঞেস করিনি কখনো। ও নিজে থেকেই বলতো নমিনির সই ছবি এসব লাগে। আমি বলতাম, যা ভালো বোঝ, আমি এতকিছু বুঝি না।

তওফিকভাই জিজ্ঞেস করেন, আমাগো ব্রাঞ্চ থেইকা কী কইলো অরা?

– ওরা বলছে, নমিনিরই পাওয়ার কথা, কিন্তু অন্য ওয়ারিশরা লিখিত আপত্তি করেছে বলে এটার জন্য লিগ্যাল ওপিনিয়ন নিতে হবে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে কখন নাকি এক রায়ে বলা হয়েছে, নমিনি ওয়ারিশ নয়, তারা কেবল ট্রাস্টি। তাদের কাজ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে টাকাটা ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়া।

তওফিকভাই মাথা নাড়েন, না না, অরা ঠিক জানে না, আইন অনুযায়ী নমিনিই পায়। রুবিনার ভাইয়েরা তো অহনতরি কোনো মামলা করে নাই, না কি কইরা দিছে।  আমি ত জানতাম এই রায় স্টে কইরা দিছে আপার কোর্ট। এহনকার পোলাপান ম্যানেজার অইয়া বইয়া রইসে, কোনো আপটুডেট খবর রাহে না। আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না ভাই। আমরা দেখতাছি।

নাজমুলভাই ম্লান হেসে বলেন, টাকাগুলোর ব্যাপারে আমার মোটেই কোনো আগ্রহ নেই। আমার প্রশ্ন ওরা এতখানি নিচে নামল কীভাবে? বোনটা মারা যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ওর রেখে যাওয়া অ্যাসেট নিয়ে ওরা যা শুরু করেছে, তাতে আমার জেদ চেপে যাচ্ছে, এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এখন বলছে আমার ছেলেটাকে আমার কাছে দেবে না, ওর মামি বা খালাদের কারো কাছে রাখবে।

তওফিকভাই উঠতে উঠতে বলেন, অ্যাই উনাকে চা-কফি কিছুই দিলা না এহনো? তারপর নাজমুলভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, আপনি একদম বেফিকির থাকেন ভাই, সব ধরনের হেল্প পাইবেন আমাগোর কাছ থেইকা।

তখন একজন জানায় এইচআর থেকে কনফার্ম করেছে ওখানে নমিনি নাজমুলভাইকেই করা আছে। তওফিকভাই বলেন, যাক, এইখানে ওয়ারিশরা সুবিধা করতে পারবো না।

নাজমুলভাই উঠে পড়লে আমরা কজন লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিই ওঁকে। কিছুক্ষণ পর তওফিকভাই আমাদের ওর রুমে ডাকেন, বলেন, অই মিয়ারা দেখ, আইনে কী আছে। পড়াশোনা তো করো না কেউ। তারপর একটা কাগজ তুলে নিয়ে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের লেটেস্ট ভার্সন আর সেন্ট্রাল ব্যাংক সার্কুলারে স্পষ্ট বলা আছে কোনো অ্যাকাউন্টহোল্ডার মারা গেলে অ্যাকাউন্টের টাকা পাইবো নমিনি। সেই টাকার মালিকানা নিয়া যদি কোনো ডিসপিউট থাকে সেইটা কোর্টে সেটেল হইতে পারে, কিন্তু আইন বলে নমিনি পাইবো।

তারপর বলেন, কেউ একজন নাজমুল সাহেবরে ফোন কইরা আবার একটু আইতে কও তো। বেশি দূরে যায় নাই এখনো।

ফোন পেয়ে নাজমুলভাই কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে তওফিকভাইয়ের রুমে ঢুকলে তিনি বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, এই দেখেন, আইন বাইর কইরা দেখলাম, ডিপোজিটের হকদার নমিনি। অরা এখনো তো মামলা করে নাই। মামলা কইরা দিলে পুরা জিনিসটা ঝুইলা যাইবো। একটা কাজ করতে পারেন, এফডিআরগুলা প্রিম্যাচিওরড এনক্যাশ কইরা ফালান, অগো আর কিছু করণের থাকবো না। তবে কিছু ইন্টারেস্ট মাইর যাইবো।

নাজমুলভাই বলেন, না, ইন্টারেস্ট নিয়ে ভাবছি না আমি। কেস করলে করুক, দেখতে চাই ওয়ারিশ কে আর আমি কে। রুবিনা যখন সবার অমতে আমাকে বিয়ে করলো, তখন ওয়ারিশরা ওর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিল আমরা দুজন ছাড়া কেউ জানে না। আপনাদের এটা নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবে না। আইন আইনের জায়গায়, ওয়ারিশরা ওদের জায়গায়, আর আমি আমার জায়গায় থাকি। দেখা যাক ওয়ারিশ কে? এটুকু বলে কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে যান নাজমুলভাই। আগে রুবিনাকে সঙ্গে নিয়ে যে-লোকটি বের হতেন, আজ তাকে কিছুইতেই খুঁজে পাওয়া যায় না।