ওসিপ মান্দেলেশ্তাম : ভাগ্যের হাতে প্রতারিত এক রুশ কবি

ভাবানুবাদ : মনজুরুল হক
কে জানে ‘বিচ্ছেদ’ শব্দের ভেতরে
কোন সে হাহাকার থাকে অপেক্ষায় আমাদের,
কোন সে ভাগ্যের কথা বলে পাখির ডানা ঝাপটানো –
অ্যাক্রোপোল যখন পুড়ে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়

ওসিপ এমিলিয়েভিচ মান্দেলেশ্তামের জন্ম ১৮৯১ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ নগরীর এক ইহুদি পরিবারে। পোল্যান্ড তখন ছিল রুশ সাম্রাজ্যের অধীন। মান্দেলেশ্তামের জন্মের পর চামড়ার ব্যবসায়ী পিতা পোল্যান্ডের ব্যবসা গুটিয়ে রাশিয়ার সে-সময়ের রাজধানী পেত্রোগ্রাদে চলে আসেন। জার পিটারের তৈরি রাশিয়ার উত্তরের সেই আধুনিক নগরী ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত সাংকত পিওতরবুর্গ নামে পরিচিত ছিল। জার্মান ভাষায় বুর্গ হচ্ছে নগরী, রুশ ভাষায় যেটা হয়ে যায় গোরাদ বা গ্রাদ। জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ থেকে রাজধানীর জার্মান নামকরণ পরিবর্তন করে এর রুশ চেহারা নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা থেকেই পিটার দ্য গ্রেটের নগরী হয়ে উঠেছিল পেত্রোগ্রাদ। রুশ সংস্কৃতির কেন্দ্রে তখন ছিল সাংকত পিওতরবুর্গ এবং দেশের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তখন সেখানে বসবাস করছিলেন। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে অন্য দুই সমকালীন রুশ কবি বরিস পাসেত্মরনাক ও মারিনা ৎসভিতায়েভার মায়ের মতো মান্দেলেশ্তামের মাও ছিলেন পিয়ানোবাদিকা। ফলে পরিবারে শিল্প-সংস্কৃতির অনুকূল আবহাওয়া কবির বাল্যকাল থেকেই বিরাজমান ছিল।
পরিবার পেত্রোগ্রাদে চলে আসার পর শুরুতে মান্দেলেশ্তাম ভর্তি হয়েছিলেন রুশ রাজধানীর বনেদি বিদ্যাপীঠ তানিশিয়েভ স্কুলে। পরিবারের সামাজিক অবস্থানের পরিচয় এর মধ্য দিয়ে সহজেই পাওয়া যায়। স্কুল শেষ করে মান্দেলেশ্তাম ভর্তি হয়েছিলেন প্যারিসের সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও লেখাপড়া করেন। তবে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদি ছাত্রদের জন্য স্বল্পসংখ্যক কোটা নির্ধারিত
থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাংকত পিওতরবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হতে পারেননি। পরে অবশ্য কোটার বাধা এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে সেই প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে যেতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন।
যৌবনে কাব্য রচনা শুরু করার দিনগুলোতে তাঁর পরিচয় হয় নিকোলাই গুমিলিয়ভ ও সে-সময়ের অন্য কয়েকজন তরুণ কবির সঙ্গে, একসঙ্গে মিলে যাঁরা নিজেদের একটি কবিদের চক্র
গড়ে নিয়েছিলেন। এই দলটিই অল্প কিছুদিন পর আকমেইস্ট নামে আত্মপ্রকাশ করে। রুশ কাব্যের ধারায় সে-সময় চলছিল সিম্বলিস্টদের প্রাধান্য, যার নেতৃত্বে ছিলেন আলেক্সান্দর বস্নক। কাব্য রচনার বেলায় আকমেইস্টরা বক্তব্যের সংক্ষিপ্তকরণ, সুস্পষ্টতা এবং কাব্যিক দক্ষতার ওপর প্রাধান্য দিয়ে আসছিলেন। ১৯১৩ সালে মান্দেলেশ্তামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাথর প্রকাশিত হয়, যে-সংকলনের অনেক কবিতা ছিল স্থাপত্যশিল্পের প্রতি কবির অনুরাগের প্রকাশ।
কাব্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি প্রেমিক হিসেবেও মান্দেলেশ্তাম পেয়েছিলেন সাহিত্যজগতের একাধিক পরিচিত রমণীর ভালোবাসা। মারিনা ৎসভিতায়েভার প্রতি তাঁর
অনুরাগ বেশকিছু কবিতার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সে-সময়ের বিখ্যাত গায়িকা ওলগা ভাকসেল এবং কবি মারিয়া পেত্রোভিখের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে
নানারকম কথা বাজারে প্রচলিত ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ১৯২২ সালে কবি নাদিয়েঝদা খাজিনাকে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর নবদম্পতি মস্কো চলে গিয়ে সেখানে তাঁদের স্থায়ী আবাস গড়ে নিয়েছিলেন। সেই একই বছর মান্দেলেশ্তামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ত্রিস্তিয়ার প্রকাশ তাঁর কবিখ্যাতি আরো বিসত্মৃত করে দিয়েছিল।
রাশিয়ায় অবশ্য সে-সময়টা ছিল গৃহযুদ্ধ, ব্যাপক ধ্বংস ও অভাবের সময়। গৃহযুদ্ধের সূচনাতেই অন্যান্য পেশার মানুষের মতো রাশিয়ার কবি-সাহিত্যিকরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সাদা ও লালের যুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীদের তালিকায় গুমিলিয়েভের মতো আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন। পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিজয় ব্যক্তিস্বাধীনতা ভোগের সুযোগকে ক্রমশ সীমিত করে আনছিল এবং কমিউনিস্টদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনাও এর মধ্য দিয়ে ততদিনে হয়ে যায়। রুশ বিপস্ন­বের ঠিক পরপর কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা নানারকম পরীক্ষামূলক সৃষ্টির সুযোগ পেয়ে এলেও গৃহযুদ্ধের অবসানে তা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসতে শুরু করে। ফলে বিপস্ন­বের সূচনাকালেও বিপস্নবকে সমর্থন করে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগ করেন এবং ভস্নাদিমির মায়াকোভস্কি ও সের্গেই এসেনিনের মতো কবিদের দেখা যায় আতমহত্যার মধ্য দিয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকে মুক্তি পেতে। তবে শুদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা মান্দেলেশ্তাম তখন পর্যন্ত ছিলেন সেরকম প্রভাব থেকে মুক্ত, যদিও ভাগ্যের থাবা অজান্তেই এগিয়ে আসছিল তাঁর দিকে।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয় মান্দেলেশ্তামের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ কবিতা। জীবদ্দশায় এটাই ছিল তাঁর শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এর কয়েক বছর আগে থেকেই সৃজনশীলতাজনিত এক ধরনের সংকটে মান্দেলেশ্তাম ভুগছিলেন, যার ফলে কাব্য রচনা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। মূলত কবিতার অনুবাদ এবং সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনার মধ্যে সীমিত ছিল তাঁর সে-সময়ের লেখার বিসত্মৃতি। তবে ১৯৩০ সালে টানা কয়েক মাস আর্মেনিয়ায় কাটিয়ে আসার মধ্য দিয়ে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত মান্দেলেশ্তাম আবারো ফিরে গিয়েছিলেন কবিতার জগতে। তবে এই পর্যায়ে রাজনীতি ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে তাঁর কাব্যে, যে-রাজনীতি ছিল স্তালিনের কঠোর শাসনে অনেকটা দম বন্ধ হয়ে আসা পরিবেশের বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিবাদ। ১৯৩৩ সালে স্তালিনকে নিয়ে কৌতুক করে লেখা একটি কবিতা তিনি বন্ধুদের
আসরে পাঠ করার পর সেই সংবাদ ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল ক্রেমলিনের কর্তাদের কাছে এবং সে-বছরই তাঁকে গ্রেফতার করে উরাল পর্বত অঞ্চলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করার পর রাশিয়ার বড় শহরগুলোতে তাঁর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে মান্দেলেশ্তাম দম্পতি ভরোনেজ শহরকে থাকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। সে-সময়ে মান্দেলেশ্তামের লেখা বিভিন্ন কবিতা পরবর্তীকালে কবির মৃত্যুর পর কয়েক খ– প্রকাশিত ‘ভরোনেঝ নোটবু’কে স্থান পেয়েছে। রাশিয়ার দূরবর্তী এক মফস্বল শহরে বসবাস করা কসমোপলিটান হিসেবে পরিচিত কবির জন্য হয়ে উঠেছিল কষ্টকর ও বেদনাদায়ক এবং গোপনে তিনি কয়েকবার সাংকত পিওতরবুর্গ সফর করেন।
১৯৩৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো মান্দেলেশ্তাম গ্রেফতার হন এবং আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের দ- দিয়ে সাইবেরিয়ার বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেন। সাইবেরিয়ায় মান্দেলেশ্তামের সেই শেষের দিনগুলো ছিল খুবই করুণ। সাইবেরিয়ার বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে ভগ্ন শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একই বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে রুশ দূরপ্রাচ্যের ভস্নাদিভন্তকের কাছের একটি ট্রানজিট শিবিরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করেন।

পেত্রোপলের স্বচ্ছতায় আমাদের মৃত্যু হবে
রাজ্যের অধীশ্বর যেখানে সম্রাজ্ঞী পের্সেফোনা।
প্রতিটি নিশ্বাসে ধ্বংসের বাতাস আমরা নিচ্ছি টেনে,
প্রতিটি মুহূর্তে ভেসে আসে মৃত্যুর পরোয়ানা।

হে সমুদ্রের দেবী, পরাক্রমী আথেনা,
খুলে ফেলো তোমার ভয়-জাগানো পাথরের শিরস্ত্রাণ,
পেত্রোপলের স্বচ্ছতায় ভেসে আসে মৃত্যুর আহবান –
রাজ্যের অধীশ্বর সেখানে তুমি নও, সে যে পের্সেফোনা।

না, চাঁদ নয় – ঘুড়ির উজ্জ্বল মুখ
ছড়ায় ক্ষীণ আলো আমার দিকে। কী দোষ করেছি আমি
নিসেত্মজ এক তারাকে ছায়াপথ ভেবে নিয়ে?
আর আমি ঘৃণা করি বাত্যুশকভের সেই লাগামহীন ঔদ্ধত্য –
সময় এখন কতটা? কেউ শুধু এটুকুই জানতে চেয়েছিল –
আর উত্তরে তিনি বলেছেন অনন্তকাল!

আমার এই হাতের তালু থেকে নাও সূর্যের কিছুটা আলো তোমার জন্য আনন্দ এনে দিতে
আরো নাও অল্প কিছু মধু – এই নির্দেশ পেয়েছি আমরা
নিরুত্তাপ পের্সেফোনার মৌমাছির কাছ থেকে।

ছেড়ে দিতে নেই হাল নোঙর না করা জাহাজের,
নেই কোনো শব্দ পশম পেঁচানো ছায়ার,
নেই ভয়কে জয় করা জীবনের গভীর অরণ্যে।

কেবল চুম্বন এখন থেকে যায় আমাদের একমাত্র সম্বল
মৌচাক থেকে উড়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া
ছোট্ট মৌমাছির মতো লোমশ চুম্বন।

রাতের গভীরতার স্বচ্ছতায় ঘর্ষণের শব্দ তুলে এরা,
ঘর এদের তাইগার ঢালুর গভীর অরণ্যে,
খাদ্য এদের সময়ের সাথে নিখুঁত হয়ে আসা নিংড়ানো মধু।

তোমার আনন্দ তাই পেয়ে যায় আমার এই অসভ্য উপহার,
সেইসব মৃত মৌমাছির শুকনো আর সাদামাটা মালা
মধুকে যারা রূপান্তর করে নিয়েছে সূর্যের আলোতে।

ত্রিস্তিয়া

বিষণ্ণতার পাঠ শিখেছি আমি
রাতের খোলামেলা বিলাপ থেকে।
চোখ মেলে আছে ষাঁড় আর দীর্ঘায়ত হয় প্রতীক্ষার সময় –
চলে আসে রাত্রির শেষ প্রহর,
পথের সামান্য ভার তুলে নিতে
মনে পড়ে যায় মোরগ ডাকা রাতের কথা,
দূরে তাকিয়ে দেখে আমার এই অশ্রম্নভেজা চোখ
আর রমণীর কান্না মিশে যায় কাব্যলক্ষ্মীর গানে।

কে জানে ‘বিচ্ছেদ’ শব্দের ভেতরে
কোন সে-হাহাকার থাকে অপেক্ষায় আমাদের,
কোন সে ভাগ্যের কথা বলে পাখির ডানা ঝাপটানো –
অ্যাক্রোপোল যখন পুড়ে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়,
আর প্রভাতে আসে কোন সে-নবজীবন,
ষাঁড় যখন কাটে আলস্যের জাবর,
নতুন জীবনের জয়গান গাওয়া মোরগ
কেন ঝাপটায় ডানা নগরীর দেয়ালে?

প্রচলিত বুনুনি আমার পছন্দ :
ঘুরে যায় মাকু, চাকতিতে আবারো ওঠে গুঞ্জন।
দেখো, সামনে যেন মরালের শুভ্রতা নিয়ে
উড়ে আসে ডালিয়া!
জীবন আমাদের আবারো হয়ে ওঠে নিষ্প্রভ,
আনন্দের ভাষায় মিশে থাকে দারিদ্রে্যর ছোঁয়া!
সবটাই যেন পুরনো, সবকিছুর আবারো পুনরাবৃত্তি,
হঠাৎ বুঝে ওঠাতেই আছে কেবল তৃপ্তি।

তবে তাই হোক : আলোকভেদী এক মানবমূর্তি
শুয়ে আছে পরিষ্কার মাটির পাত্রে,
ছড়িয়ে থাকা খরগোশের চামড়ার মতো,
মোমের নিচে রেখে দৃষ্টি, দেখে নেয় বালিকা।
গ্রিসের এরবুস নিয়ে ভাবতে নেই আমাদের,
নারীর জন্য যা মোম, পুরুষের বেলায় সেটাই তাম্র।
ভাগ্য আমাদের দেখা দেয় রণাঙ্গনে,
আর ওদের বেলায় যা থাকে তা হলো দৈবমৃত্যু।

উঠানে রাতের অন্ধকার মেখে সেরে নিই স্নান।
কঠিন উজ্জ্বলতা ছড়ায় স্থূল তারা।
তারকার আলো – যেন কুঠারে এসে পড়া লবণ।
উপচেপড়া পিপা শীতল হয়ে আসে।

ফটক বন্ধ রাখা আছে তালা ঝুলিয়ে,
আর মাটির রুক্ষতা সহনীয়।
সামনে যেন সত্যিকার সজীব ক্যানভাস
যেখানে আবারো নতুন করে যায় আঁকা।

গলে পড়ে পিপায় লবণের মতো তারা,
পানি হয়ে যায় কালো,
মৃত্যু যেন আরো বিশুদ্ধ, দুর্ভাগ্য আরো বেশি লবণাক্ত,
আর এই মাটি আরো বেশি ভীতিকর, আরো বেশি স্পষ্টভাষী।

লেনিনগ্রাদ

ফিরে এসেছি নিজের শহরে, যে-শহর অশ্রম্নর মতো পরিচিত আমার,
পরিচিত ধমনির মতো, শৈশবের ফুলে যাওয়া গ্রন্থির মতো।

ফিরে এসেছ এখানে তুমি – গিলে নাও দ্রম্নত
লেনিনগ্রাদের নদীতীরের সড়কবাতির মাছের তেল।

চিনে নাও অল্পদিনে ডিসেম্বরের দিন,
ডিমের কুসুমে যেখানে মিশে থাকে পিচের ঘ্রাণ।

শোনো পিতারবুর্গ, আমি এখনো চাই না মরে যেতে :
তোমার কাছে জমা আছে আমার সব টেলিফোন নম্বর।

পিতারবুর্গ, আমার আছে এখনো ঠিকানা,
যেখানে আমি নিশ্চিত পেয়ে যাব মৃতদের কণ্ঠস্বর।

অন্ধকার সিঁড়িতে আমার বসবাস, আর কপালে আমার
আঘাত করে ছিঁড়ে নিয়েছে মাংস।

সারারাত আমি অপেক্ষায় থেকেছি আগের মতোই প্রিয় অতিথির আগমনের,
মোমের আলোয় সেঁটে নিয়ে দুয়ারের আংটা।

আমরা বেঁচে আছি, পায়ের তলায় দেশের কোনো অস্তিত্ব অনুভব না করে,
আমাদের মুখের কথা দশ কদম আগেও যায় না শোনা,
তবে সেইখানে চলে যায় এমনকি অর্ধেক কথাবার্তাও,
যেখানে এর অর্থ করে নেয় ক্রেমলিনের পর্বতবাসী।
তাঁর পুরু আঙুল, যেন নাদুস কোনো কীট,
আর কথা তাঁর ওজনের পাথর, ভারী,
তেলাপোকার গোঁফ তাঁর ঝুলে থাকে বাইরের দিকে,
জুতোর মাথা তাঁর চকচকে উজ্জ্বল।

চারিদিকে তাঁর ভিড় করে আছে ভীত সব কাঙাল যোদ্ধা,
সে খেলে এইসব অর্ধেক মানুষকে নিয়ে।
কেউ দেয় শিস, কেউ কাঁদে, কেউবা করে বিড়ালের ধ্বনি,
তবে একাই সে করে গর্জন, তুলে ধরে আঙুল,
ঘোড়ার খুরের মতো জারি করে সে নির্দেশ একের পর এক :
কাউকে কুঁচকিতে করে আঘাত, কারো বা কপালে কিংবা পিঠে।
যেন শাস্তি নয়, বরং আনন্দ অফুরান
বিশাল এক বুক আমাদের এই ওসেতিনের।

অলঙ্কারের সোনালি আভায় জ্বলছে
বনে বড়দিনের সজ্জিত গাছ;
ঝোপে আছে খেলনার নেকড়ে
তাকিয়ে ভয়ংকর চোখে।

হে, যাবতীয় এইসব দুঃখ আমার,
হে, আমার নীরব মুক্তি
অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ
যেন সদাহাস্যরত স্ফটিক!

আমাকে দেয়া হয়েছে এই শরীর – কী যে করি আমি এটাকে নিয়ে,
এতটা অনন্য আর সবটাই আমার?

এই সুখে নীরবে নিশ্বাস নিই আর বেঁচে থাকি
বলো, কাকে জানাতে হবে কৃতজ্ঞতা?

আমি মালি, আর আমিই যে ফুল,
অন্ধকার পৃথিবীতে নই আমি একা।

অনন্তের কাচে রেখে যাই আমি
নিশ্বাস আর দেহের উষ্ণতা।

এর ওপর আঁকা হয়ে যায় নকশা
অজানা এই সময়ের।

আসুক মুহূর্তের মেঘাচ্ছন্ন পতন –
সুন্দর এই নকশা যাবে না মুছে।

অনিদ্রা। হোমার। খোলা পাল।
পড়ি আমি জাহাজের তালিকা মাঝামাঝি পর্যন্ত :
এই দীর্ঘ বিষণ্ণতা, এই সারসের রেলগাড়ি
কোনো একসময় যা হেলাস থেকে উঠে গেছে আকাশের দিকে।

অজানা দেশের দিকে উড়ে যাওয়া সারসের গোঁজের মতো –
সম্রাটের মাথায় ঐশ্বরিক ফেনা –
কোথায় ভেসে যাও তুমি? হেলেনের খোঁজে,
ট্রয় কি তোমার একার, এচিয়ান পুরুষ?

এই সমুদ্র আর হোমার – সবকিছু আন্দোলিত ভালোবাসায়।
কার কথা শুনব আমি? এবার যে নীরব থেকে যায় হোমার,
কালো সাগর, কাছে আসে, করে কোলাহল
আর রূঢ় চিৎকারে ঢুকে যায় মাথায় আমার।

সহায় হও তুমি, প্রভু আমার, এই রাত করে দিতে পারো।
ভীত আমি জীবনের ভয়ে, গোলাম তোমার,
পিটারের শহরে বসবাস যেন হচ্ছে শুয়ে থাকা
সঙ্গে নিয়ে কবরের অন্ধকার। 

হোসে মার্তির দুটি কবিতা
অনুবাদ : আলম খোরশেদ

সাদা গোলাপের চাষ

আমি এক শ্বেত গোলাপের চাষ করি,
জুলাই কি জানুয়ারি যে-কোনো সময়,
সেই বান্ধবের জন্য – বিশ^স্ত, সদয়
প্রয়োজনে আমি যার হাতখানা ধরি।

আমাকে জোগায় যে বাঁচবার শ্বাসপ্রশ্বাস
যে-নির্দয় ভাঙে আমার সে সরল হৃদয়
তার জন্যও কদ্যপি কাঁটা কিংবা গুল্ম নয় :
আমি করি সেই একই সাদা গোলাপের চাষ।

আমি পৃথিবী ছাড়তে চাই

আমি পৃথিবী ছাড়তে চাই
তার নৈসর্গিক দরজা দিয়ে,
সবুজ পাতায় বোনা কবরে, আমাকে
নিয়ে যাবে তারা মৃত্যুবরণের জন্য।
বেইমানদের মতো বেঘোরে মরতে
অন্ধকারে রেখে দিও না আমাকে ভাই,
আমি ভালো, আর সব ভালোর মতোই
আমিও সূর্যের চোখে চোখ রেখে মারা যেতে চাই।

হোসে মার্তি (১৮৫৩-৯৫) : গোটা লাতিন আমেরিকায় সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিম-লে হোসে মার্তি একটি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও প্রেরণাসঞ্চারী নাম। আর তাঁর মাতৃভূমি কুবাতে তো তিনি রীতিমতো জাতীয় বীরের আসনে আসীন। কবি, গদ্যকার, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও যোদ্ধা হোসে মার্তি সারাজীবন কুবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগমন ও শৈল্পিক বিকাশের জন্য তাঁর বহুপ্রজ লেখনীর মাধ্যমে লড়াই করে গেছেন; যদিও জীবদ্দশায় মাত্র দুখানি কাব্যগ্রন্থ ছাড়া আর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি তাঁর। মৃত্যুর পর অবশ্য মোট পঞ্চাশ খ– তাঁর সমগ্র রচনাবলি প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালে মাত্র বিয়ালিস্নশ বছর বয়সে স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান হয়।