ঔপনিবেশিক শিক্ষা-প্রশাসন ও বিদ্যাসাগরের যুদ্ধ

বিশ্বজিৎ ঘোষ

উপনিবেশিত বাংলাদেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবনসাধনা এবং মৃত্যু। হুগলির অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিলেও তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী শহর কলকাতায়। তাঁর কর্মস্থল প্রধানত ছিল কলকাতা, চাকরি করতেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম (১৭৮১) এবং সংস্কৃত কলেজে (১৮২৪), চাকরি-সূত্রে সম্পর্কিত ছিলেন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে। ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে চাকরি করতে হয়েছে স্বাধীনচেতা জেদি একরোখা বিদ্যাসাগরকে। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সময়সতর্ক, কর্তব্যসচেতন, ন্যায়নিষ্ঠ এবং উদার মানবতাবাদী। চরিত্রের এই দ্বিমাত্রিক অথচ আপাত বিপ্রতীপ বৈশিষ্ট্যের কারণে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ছিল মধুর সম্পর্ক, কারো সঙ্গে সম্পর্কে ছিল অম্ল-মধুর বৈরিতা। তিনি চলতে চেয়েছেন নিজের ইচ্ছায়, – কখনো ঊর্ধ্বতন প্রশাসকদের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রত্যাশিত আনুকূল্য, আবার কখনো-বা তাঁকে পড়তে হয়েছে দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ-অর্ণবে। কিন্তু সর্বত্রই লক্ষ করা যাবে, ঔপনিবেশিক প্রশাসকের কাছে ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে তিনি কখনো নতি স্বীকার করেননি, নিজের জাগতিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন অটল, নিজস্ব বিবেচনায় ছিলেন সুস্থির। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের এই খতিয়ান সন্ধানই বর্তমান নিবন্ধের অন্বিষ্ট বিষয়।

ব্যক্ত হয়েছে যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন জেদি একরোখা স্বাধীনচেতা মানুষ। কারো অধীনস্থ থাকা ছিল তাঁর স্বভাববিরোধী – মানতে পারতেন না, কখনো কখনো, অন্যের উপদেশ-আদেশ-নির্দেশ। ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হোক, হোক ঔপনিবেশিক প্রশাসক – কারো কর্তৃত্বই তাঁকে শৃঙ্খলিত করতে পারেনি – বীরসিংহ গ্রামের সিংহপুরুষ বিদ্যাসাগর সবসময় আচরণ-উচ্চারণ করেছেন সিংহের মতোই। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় বিদ্যাসাগরের মানসচারিত্র্য সম্পর্কে বিনয় ঘোষের এই ব্যাখ্যা : ‘বিদ্যাসাগরের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এই যে জীবনের অধিকাংশ কাজই তিনি একটা প্রচণ্ড জিদের বশবর্তী হয়ে আরম্ভ করতেন এবং তার চূড়ান্ত ফলাফল না দেখা পর্যন্ত তা ছাড়তেন না। আশৈশব চরিত্রের এই জিদটাই ছিল তাঁর সমস্ত কর্মশক্তির উৎস এবং অনেক সময় তাঁর পরবর্তী ব্যর্থতা ও হতাশার কারণ’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২২৬)। সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে মুহূর্তেই বিদ্যাসাগর কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন। উত্তরকালে ঔপনিবেশিক অনেক সুশাসকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি বলে বিদ্যাসাগর মুহূর্তেই, একাধিক ক্ষেত্রে, নিজস্ব সিদ্ধান্তে পদত্যাগ বা কর্মত্যাগ করেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন, ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের সংঘাত নয়, এ-সংঘাত হচ্ছে আদর্শের সংঘাত। আদর্শের সংঘাত বলে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আর দ্বৈরথে বিদ্যাসাগর অন্তিম কোনো মীমাংসায় পৌঁছতে পারেননি; কেননা স্বার্থের সংঘাতের পরিসমাপ্তি আছে, আদর্শের সংঘাতের কোনো সমাপ্তি নেই। বিদ্যাসাগর ছিলেন আদর্শের সংঘাতের অন্তহীন শেষহীন যোদ্ধা ও অভিযাত্রী।

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগলাভে বিদ্যাসাগর অনেকটা জেদ ধরেছিলেন ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে। ১৮৫০ সালের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-৫৮) জজ-পণ্ডিতের চাকরি নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যান। ফলে পদটি শূন্য হয়। বাংলার শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েট ওই শূন্য পদে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়োগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নিয়োগের কথা বিদ্যাসাগরকে জানালে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, কেবল চাকরির জন্য সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদে যোগদান করতে তিনি রাজি নন। যদি সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও মৌলিক পরিবর্তন করার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়, কেবল তাহলেই তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগদান করতে রাজি আছেন। শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েট প্রথমে অনাগ্রহী থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরেরই জয় হলো। আপাতত তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগদান করলেন বটে, তবে সুযোগ এলেই তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে – এই শর্তে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগদান করলেন। বিদ্যাসাগরের এই শর্তারোপ সংস্কৃত কলেজের নিছক অধ্যক্ষ হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের কোনো প্রচেষ্টা ছিল না; তিনি মূলত চেয়েছিলেন কর্তৃত্ব। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব না থাকলে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজের উন্নতি করা যাবে না। বাংলা সরকার একজন বাঙালি পণ্ডিতের কাছে কলেজ পরিচালনার মূল দায়িত্ব দিতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেদি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে শিক্ষা সংসদ সরকারের কাছে যে-রিপোর্ট পাঠাল, সে-সম্পর্কে গবেষক ঋষি দাস জানাচ্ছেন এই কথা :

শিক্ষা সংসদ সরকারকে জানালেন যে,… বিদ্যাসাগর সংস্কৃতে যেমন অসাধারণ পণ্ডিত, ইংরেজিতেও তেমনি কৃতবিদ্য। তিনি বিদ্যোৎসাহী, দৃঢ়চেতা ও কর্মিষ্ঠ। তাই সংসদ বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি মনে করে। (ঋষি দাস, ১৯৭১ : ৩২)

– বাংলা সরকারের কাছে শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েটের এই রিপোর্ট বিদ্যাসাগরের জেদ এবং একরোখা স্বভাবের কারণেই সম্ভব হয়েছে এবং এখানেই ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রাথমিক বিজয় সূচিত  হলো।

১৮৫১ সালের ২২শে জানুয়ারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এবার সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধনে তিনি উদ্যোগী হলেন। আধুনিক জ্ঞানের বিস্তার এবং বাংলা ভাষার উন্নতি সাধন – এই মৌল উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যাসাগর একটি বিশদ পরিকল্পনা রচনা করলেন। সংস্কৃত কলেজের উন্নতির জন্য ১৮৫২ সালের ১২ই এপ্রিল ‘Notes on the Sanscrit College’ শিরোনামে বিদ্যাসাগর তাঁর পরিকল্পনা শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েটের কাছে উপস্থাপন করেন। ২৬ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট ওই পরিকল্পনার প্রথম অনুচ্ছেদেই বিদ্যাসাগর লেখেন : ‘The creation of an enlightened Bengali Literature should be the first object of those who are entrusted with the superintendence of education in Bengal’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ :৫১৬)। পাঠক্রম, পঠিতব্য বিষয়, কলেজের অর্থ-ব্যবস্থাপনা – ইত্যাদি বিষয় বিশদ উল্লেখ করে বিদ্যাসাগর তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনা শেষ করেন এভাবে : ‘It appears to me that unless the Sanscrit College is remodeled according to the principles now stated, there exists no prospect of material improvement or of fully carrying out the objects of the institution.’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ৫২০)। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার বিদ্যাসাগরের এই পরিকল্পনা প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য বেনারস সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ জে.আর. ব্যালেন্টাইনের কাছে প্রেরণ করেন। একথা জেনে বিদ্যাসাগর ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি ভাবলেন, তাঁর পরিকল্পনা মূল্যায়নের জন্য একজন ইংরেজকে দেওয়া হলো মূলত ইংরেজ-শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন, একজন ভারতীয় বলে ডক্টর ব্যালেন্টাইন তাঁর রিপোর্টের ওপর নেতিবাচক মন্তব্য করবেন। বাস্তবে ঘটলও তা-ই। ১৮৫৩ সালের আগস্ট মাসে ডক্টর ব্যালেন্টাইন বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনার ওপর যে রিপোর্ট প্রদান করেন, গবেষক তা তুলে ধরেছেন নিম্নোক্তভাবে :

Dr.  Ballantyne in his report of August 1853 raised many objections regarding Vidyasagar’s projects especially regarding philosophy. Amongst others he criticized the following points. He basically doubted that students would be able to study to the same time Indian and European philosophies. They would not be able to connect the content of philosophy read in one language with the considerations and thoughts read in another language, so that they would come to the conclusion that truth is double, be argued. Ballantyne instead wanted to demonstrate that ‘our English Sciences are really developments and expansions of truths, the germs of which the Sanscrit systems contain’ and that these valued germs are not ignored in or opposed to English Science but ‘might easily be shown to be involved in it’. Students of the Sanscrit College should be able to understand both the learned of India and the learned of Europe, and to interpret between the two … by showing that European science recognizes all those elementary truths that had been reached by Hindu Speculation.’ (Hiltrud Rustau,1993 : 145)

ডক্টর ব্যালেন্টাইনের প্রতিবেদনে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে বাঙালি পণ্ডিতের চেয়ে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদের আত্মম্ভরিতা। ব্যালেন্টাইনের অভিমতের বিরুদ্ধাচরণ করে বিদ্যাসাগর তীব্র কটাক্ষ করেন এবং পুনরায় তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। ১৮৫৩ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েটের কাছে লেখা এক চিঠির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর ব্যালেন্টাইনের রিপোর্ট খণ্ডন করেন এবং নিজের অভিমত জোরের সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করেন। ব্যালেন্টাইনের অভিমতের অসারতা ব্যাখ্যা করে নিজস্ব অভিমতের সুফল সম্পর্কে বিদ্যাসাগর লেখেন :

In conclusion I beg most respectfully to state that if I may be so fortunate as to be permitted to carry out the system introduced, I can assure the Council with great confidence that the Sanscrit College will become a seat of pure and profound Sanscrit learning and at the same time a nursery of improved vernacular literature, and of teachers thoroughly qualified to disseminate that literature amongst the masses of their fellow countrymen. (D×…Z : webq †Nvl, 2011 : 530) (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ৫৩০)

বিদ্যাসাগর ইউরোপীয় পণ্ডিত কিংবা ঔপনিবেশিক প্রকাশক – কারো কাছে নতি  স্বীকার করেননি। তাঁর এই জেদি মানসিকতার কথা বলতে গিয়ে সমালোচক লিখেছেন : ‘Vidyasager rejected most of all Ballantyne’s method of searching for correspondence beween ancient Indian philosophy and European Science in order to make modern science more acceptable for Indian Pandits : ‘They are a body of men whose longstanding prejudices are unshakable.’ Instead of looking for the traditional learned of India the masses had to be educated, and the task the Sanscrit College was confronted with should be the training of capable teachers for this purpose.’ (Hiltrud Rustau, 1993 : 146)। সমকালীন বাঙালি সমাজপতিরা যেখানে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দয়া-দাক্ষিণ্য লাভের আশায় তাদের গুণকীর্তনে মুখর, বিদ্যাসাগর সেখানে যুগ্ম-বৈপরীত্যের (binary opposition) তত্ত্বকাঠামো অস্বীকার করে নিজস্ব অভিমত প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।

ডক্টর ব্যালেন্টাইন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রিপোর্টদ্বয় পর্যালোচনা করে শিক্ষা সংসদ যে মন্তব্য করে, তাতে ব্যালেন্টাইনের প্রতি গভীর পক্ষপাত পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা সংসদ রিপোর্টে উল্লেখ করে : ‘ড. ব্যালেন্টাইন সংস্কৃত কলেজের বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি ও উন্নতি সম্বন্ধে এমন সব আশাপ্রদ অভিমত প্রকাশ করেছেন যা দেখে আমরা সত্যই আনন্দিত হয়েছি। কলেজের অধ্যক্ষের জ্ঞাতার্থে আমরা জানাচ্ছি যে, তিনি বর্তমানের শিক্ষণীয় বিষয় ও শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকুন। তবে এই শিক্ষার সাফল্য নির্ভর করবে অনেকটা তাঁর নিজের চেষ্টার উপর। যেসব শিক্ষক ইংরেজিতে এবং সংস্কৃতিতেও, দর্শনশাস্ত্রের মতো উচ্চ বিষয় পড়াবেন, তাঁদেরও যদি যথেষ্ট যোগ্যতা না থাকে তাহলে এ শিক্ষার সফলতার সম্ভাবনা কম। অধ্যক্ষের নিজের উদ্যোগ ও ক্ষমতা সম্বন্ধে সংসদের গভীর বিশ্বাস আছে এবং তাঁরা আশা করেন তিনি ড. ব্যালেন্টাইনের লেখা বইগুলি শিক্ষার কাজে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করার জন্য কুণ্ঠিত হবেন না। তাঁর নিজের শিক্ষার কাজে এবং তাঁর অন্যান্য শিক্ষকদের শিক্ষার ব্যাপারে ব্যালেন্টাইনের বইগুলি খুবই কাজের হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ব্যালেন্টাইনের বইগুলি পাঠ করে ছাত্ররা যে উপকৃত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অধ্যক্ষ মহাশয় ড. ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে তাঁর ক্লাসের ছাত্রদের লেখাপড়ার উন্নতি সম্পর্কে লিখে ভাবের আদানপ্রদান করবেন। সংসদের একান্ত ইচ্ছা, বারানসী ও কলকাতার এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মধ্যে শিক্ষাসংক্রান্ত প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মতামতের আদানপ্রদান হোক এবং তার ফলে উভয়ের ক্রমোন্নতি হোক। ইংরেজি থেকে সংস্কৃতে এবং সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে দার্শনিক বিষয় অনুবাদ করার সময় শব্দনির্বাচন ও প্রয়োগ যাতে নির্ভুল ও ভাবসম্মত হয় সেদিকে উভয়কেই নজর দিতে হবে’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮০-১৮১)। শিক্ষা সংসদের এই মন্তব্যে বিদ্যাসাগর স্বভাবতই বিচলিত, ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি মনে করলেন, শিক্ষা সংসদ ইউরোপীয় পণ্ডিত ড. ব্যালেন্টাইনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছে এবং তাঁর কল্পিত শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি কিছুটা হলেও অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ১৮৫৩ সালের ৫ই অক্টোবর শিক্ষা সংসদের সেক্রেটারি এফ.জে. ময়েটের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। চিঠিতে বিদ্যাসাগর লেখেন :

ড. ব্যালেন্টাইনের রিপোর্ট সম্পর্কে শিক্ষা সংসদের নির্দেশ আমি ধীরভাবে বিবেচনা করে দেখেছি, যদি এই নির্দেশগুলি আমাকে বর্ণে-বর্ণে পালন করতে হয়, তা হলে সংসদের সম্মতিক্রমে সম্প্রতি আমি নিজের যে পাঠ্যসূচি কলেজে চালু করেছি, তাতে হস্তক্ষেপ করা হবে বলে আমার ধারণা। তার ফলে কলেজে আমার নিজের মর্যাদাই যে ক্ষুণ্ন হবে তা নয়, আমার শিক্ষার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতাও অনেকখানি কমে যাবে।…

আমার বক্তব্য হল, আমাদের সংস্কৃত শিক্ষা দিতে দিন, প্রধানত বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য। তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান আয়ত্ত করার সুযোগ দিন। এই সুযোগ পেলে আমি নিশ্চিত হয়ে আপনাকে বলতে পারি যে সংসদের উৎসাহ ও সমর্থন থাকলে, আমি কয়েক বছরের মধ্যে এমন একদল শিক্ষিত যুবক তৈরি করে দিতে পারব, যারা নিজেদের রচনা ও শিক্ষার দ্বারা দেশের জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানবিদ্যার প্রসারে, আপনাদের প্রাচ্য-বিদ্যার অথবা শুধু ইংরেজি-বিদ্যার পণ্ডিতদের চেয়ে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে। এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে – আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম উদ্দেশ্য – আমাকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ-স্বাধীনতা দিতে হবে, কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা চলবে না (রূঢ় কথার জন্য মার্জনা করবেন)। ড. ব্যালেন্টাইনের যে-সব বই বা সারগ্রন্থ আমি ভালো বিবেচনা করব, Novum Organum গ্রন্থের চমৎকার ইংরেজি সংস্করণ, তা আমি নিশ্চয়ই সাগ্রহে বিদ্যালয়ে পাঠ্য করব। কিন্তু তাঁর সংকলন বা রচনা পাঠ্য হওয়ার যোগ্য কি না, বিশেষ করে আমার অনুসৃত শিক্ষানীতির সঙ্গে সেগুলি খাপ খাওয়ানো সম্ভব হবে কি না, তা বিচার করার এবং বিচারান্তে সাব্যস্ত করার সম্পূর্ণ অধিকার কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে আমার থাকবে। তা যদি না থাকে তা হলে আমার অধ্যক্ষতার প্রয়োজন কি? তাছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি অনুযায়ী চললে আমার পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করা সম্ভব হবে না। (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮১-১৮২)।

শিক্ষা সংসদের সচিব এফ.জে. ময়েটকে লেখা বিদ্যাসাগরের এই চিঠির মধ্যেও ধরা পড়ে তাঁর জেদি স্বভাব আর স্বাধিকারপ্রমত্ত মানসিকতা। সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যাসাগর যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যে-পাঠক্রম রচনা করেছেন – সর্বত্রই তার মূল দর্শন ছিল সমন্বয়, পাশ্চাত্যবিদ্যার সঙ্গে ভারতবিদ্যার সমন্বয়। শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার উন্নতি। এ-ব্যাপারে কখনোই তিনি আপস করেননি। ড. ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধের এটাই ছিল মূল কারণ। দুই ভিন্নধর্মী বিদ্যার মধ্যে ভেজাল দিয়ে তিনি একটি কিম্ভুতকিমাকার পাণ্ডিত্যের পিণ্ড পাকিয়ে বাঙালি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে চাননি। ড. ব্যালেন্টাইনের প্রস্তাব সেরকমই ছিল বলে তা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি এবং গ্রহণ করার পক্ষে সংসদের যুক্তি ও অনুরোধ দুই-ই অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শিক্ষা সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা ও দর্শন ছিল বলেই বিদ্যাসাগর ড. ব্যালেন্টাইন এবং শিক্ষা সংসদের প্রস্তাব ও যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। একরোখা জেদি মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরেরই জয় হলো। শিক্ষা সংসদ বিদ্যাসাগরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিয়ে সংস্কৃত কলেজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর সংস্কার প্রস্তাব ও কারিকুলামকেই স্বীকার করে নিয়েছে।

পরবর্তী সময়েও শিক্ষা বিভাগের পরিচালক গর্ডন ইয়ংয়ের সঙ্গে সংস্কৃত কলেজের একাধিক বিষয় নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ ঘটে। এক্ষেত্রে প্রধানত  দুটো বিষয়ের কথা বলা যায় – প্রথমত, সংস্কৃত কলেজে শিক্ষক নিয়োগ এবং দ্বিতীয়ত, পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ। এ-বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। একরোখা বিদ্যাসাগর এতটাই স্বাধীনচেতা ছিলেন যে, অনেক সময় নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে যৌক্তিক নিয়ম-কানুনকেও তিনি উপেক্ষা করেছেন। বিদ্যাসাগর স্বাধীনভাবে চলতে চেয়েছেন, ভোগ করতে চেয়েছেন সর্বময় ক্ষমতা। সংস্কৃত কলেজে বিজ্ঞাপন না দিয়েই নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী তিনি শিক্ষক নির্বাচন করেছেন। ১৮৫৭ সালে সাহিত্যের অধ্যাপক প্রসন্ন কুমার সর্বাধিকারী, গণিতের অধ্যাপক মোহিনীমোহন রায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জুনিয়র শিক্ষক তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় ও প্রসন্নচন্দ্র রায় – এই চারজনের নিয়োগ বিদ্যাসাগর নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রদান করেছেন। এ-বিষয়ে শিক্ষা বিভাগের পরিচালক গর্ডন ইয়ংয়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ ঘটে। গর্ডন ইয়ং বিদ্যাসাগরের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি পছন্দ করেননি, বিদ্যাসাগরও এ-ব্যাপারে মানতে রাজি হননি গর্ডন ইয়ংয়ের নির্দেশ। নিজস্ব বিবেচনা অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজে যোগ্য শিক্ষককেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, একথা জানানোর পর ইয়ং বিদ্যাসাগরকে লেখেন :

Upon the present occasion and on your reiterated recommendation, I have no objection to sanction the following oppointment, but I would wish you to bear in mind that in future, before such recommendations are made, full publicity should be given to the fact of the vacancies … and the rules referred to in my letter no 119 dated 26th ultimo should not be overlooked. (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮৪)

গর্ডন ইয়ংয়ের চিঠি থেকে বোঝা যায়, শিক্ষক নিয়োগের জন্য সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করতে শিক্ষা বিভাগ বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেছিল। নিয়মানুযায়ী কোনো শিক্ষকের পদ শূন্য হলে বিজ্ঞাপন দিয়ে উপযুক্ত লোক নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু বিদ্যাসাগর মনে করেছেন, এভাবে যোগ্য শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই প্রচলিত নিয়ম উপেক্ষা করে তিনি নিজস্ব বিবেচনায় শিক্ষক নির্বাচন করেন এবং তা অনুমোদনের জন্য গর্ডন ইয়ংয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। বিদ্যাসাগরের জেদি আর একরোখা স্বভাবের কথা ইয়ংয়ের অজানা ছিল না। তাই বিদ্যাসাগরের চিঠির উত্তরে ১৮৫৭ সালের ১৬ই মে গর্ডন ইয়ং তাঁকে লেখেন এই কথা :

আমি স্বীকার করছি যে আপনি যে-সব লোক বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে ‘যোগ্য’ ব্যক্তি, কিন্তু তার জন্য একথা মানতে আমি রাজি নই যে তাঁরাই যোগ্যতম ব্যক্তি। কর্ম খালির বিজ্ঞাপন না দিলে কোনো পদে যোগ্যতম ব্যক্তি নিয়োগ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। আপনি এই পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করেননি বলে সত্যিই আমি দুঃখিত। তবে তার জন্য আমি আপনার উপর কোনো দোষারোপ করি না। আমি বুঝতে পারছি না, আপনি এখনও এই পদ্ধতিতে কাজ করতে কেন সম্মত নন। আপনি যখন এই নিয়মের ঘোর বিরোধী এবং নিয়ম মেনে চললে আপনার কাজকর্মের অসুবিধা হবে জানিয়েছেন, তখন এই বিষয়ে আর কোনো অপ্রীতিকর তর্কবিতর্ক না করে আমি আপনার সিদ্ধান্তই মেনে নেব ঠিক করেছি এবং চাকরির ব্যাপারে আপনার পাত্র-নির্বাচনও অনুমোদন করব। এবারেও তাই করলাম। (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮৪)

শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেল, চূড়ান্ত পরিণতিতে বিদ্যাসাগরের কাছে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের শিক্ষা বিভাগকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। তবে তাদের যুক্তি যথার্থই ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন, নিয়মানুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিতে গেলে প্রশাসন কৌশলে তাদের লোক ঢুকিয়ে দেবে, তাহলে পরিকল্পনামাফিক সংস্কৃত কলেজের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না। বিদ্যাসাগরের সম্ভাব্য এই চিন্তা বিনয় ঘোষের ভাষায় ধরা দিয়েছে এভাবে : ‘… যে-কোনো ক্ষেত্রেই হোক তিনি নিজের মতামতটাকেই সবসময় সবচেয়ে বড় বলে মনে করতেন এবং নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও খেয়াল-খুশিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিতেন। … শিক্ষক-অধ্যাপক নিয়োগের ব্যাপারেও তিনি যে পূর্ণ কর্তৃত্ব দাবি করেছেন, তার কারণ মনে হয়, শিক্ষা বিভাগের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁর মনে সন্দেহ ছিল। তিনি জানতেন, তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজে কাজ করার পথে অন্তরায় অনেক। তার উপর তাঁর সহযোগীদের মধ্যে শিক্ষা বিভাগের কর্তারা যদি প্রকাশ্য মনোনয়নের সুযোগ নিয়ে নিজেদের তাঁবের লোক দু-চারজন ঢুকিয়ে দিতে পারেন, তা হলে পদে-পদে নানা রকমের বাধা পেয়ে একেবারেই কোনো কাজ করা সম্ভব হবে না। এই জন্যই মনে হয় সংস্কৃত কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের কোনোরকম হস্তক্ষেপ তিনি পছন্দ করতেন না’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮৪-১৮৫)।

শিক্ষা বিভাগের পরিচালক গর্ডন ইয়ংয়ের সঙ্গে আগে কিছু বিষয় নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতান্তর ঘটে। এক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। গর্ডন ইয়ং চেয়েছিলেন সরকারি তত্ত্বাবধানে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করা হোক। ১৮৫৭ সালের ১৩ই এপ্রিল এক চিঠির মাধ্যমে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র তত্ত্বাবধানে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেন গর্ডন ইয়ং। এ-সময় বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা এবং প্রকাশক। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এবং বিদ্যাসাগরের যৌথ প্রচেষ্টায় সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছিল। বিনয় ঘোষ মনে করেন, পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অখণ্ড প্রভাব খানিকটা খণ্ডন করার জন্যই হয়তো গর্ডন ইয়ং সরকারি তত্ত্বাবধানে বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের কথা ভেবেছেন। গর্ডন ইয়ং যুক্তি দিয়েছিলেন, পাঠ্যপুস্তকের লেখকেরা বই লিখে অনেক অর্থ আয় করেন, বাইরের গ্রাহকরাও মুনাফার জন্যই বই প্রকাশ করেন। অতএব শিক্ষা প্রসারের জন্য সুলভ মূল্যের বই প্রকাশ করতে হলে স্কুল বুক সোসাইটিকে দিয়েই তা করতে হবে। গর্ডন ইয়ংয়ের এই অভিমতে বিদ্যাসাগরের প্রতি পরোক্ষ একটা নেতিবাচক ইঙ্গিত ছিল। বিদ্যাসাগরের স্বাধীন বৃত্তির সাফল্য ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা ভালো চোখে দেখেননি। জনশিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নে ইয়ংয়ের প্রস্তাব ইতিবাচক হলেও বিদ্যাসাগর তা সমর্থন করতে পারেননি। লেখক ও প্রকাশকের স্বাধীন বৃত্তিতে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রস্তাব কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি বিদ্যাসাগর। অন্যদিকে, পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং প্রকাশে নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষুণ্ন হবে – এমন আশঙ্কাও করেছিলেন বিদ্যাসাগর। ইয়ংকে নিজের অসম্মতির কথা জানিয়ে ১৮৫৭ সালের ২রা মে বিদ্যাসাগর একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন এই কথা : ‘… I am compelled to observe that it contains a very insufficient answer to the requisitions…’ (উদ্ধৃত : খন্দকার রেজাউল করিম, ২০১৬ : ৪৭)। বিদ্যাসাগরের চিঠির ভাষা থেকে সহজেই বোঝা যায়, ইয়ংয়ের প্রস্তাবে কোনো গুরুত্বই দেননি বিদ্যাসাগর। যে কারণে বিদ্যাসাগরের ওপর গর্ডন ইয়ং রীতিমতো ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। ফলে বাংলা পাঠ্যপুস্তকসমূহ স্কুল বুক সোসাইটি নয়, বিদ্যাসাগরের ইচ্ছানুযায়ী বেসরকারি মালিকানাধীন ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হতে থাকল।

গর্ডন ইয়ংসহ সরকারি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিদ্যাসাগরের এই মতদ্বৈধতার সময়খণ্ডেই ভারতবর্ষে দানাবলের মতো জ্বলে ওঠে সিপাহী বিদ্রোহ তথা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুন। ব্রিটিশ শাসকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, নিরাপত্তার জন্য কলকাতা শহরে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে সরকার, দখল করতে থাকে একের পর এক বৃহৎ অট্টালিকা। এসব অট্টালিকায় সৈন্যদের থাকার এবং অস্ত্রশস্ত্র রাখার ব্যবস্থা হলো। সংস্কৃত কলেজ এবং হিন্দু কলেজেরও বৃহৎ অট্টালিকা তারা দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিদ্যাসাগর মেনে নেননি। চিঠি লিখে তিনি সরকারকে তাঁর অসম্মতির কথা জানিয়ে দেন। তাঁর চিঠির উত্তরে বাংলা সরকারের সচিব ১৮৫৭ সালের ১৭ই আগস্ট বিদ্যাসাগরের কাছে নিম্নোক্ত পত্র প্রেরণ করেন :

আপনার ১১ তারিখের চিঠির উত্তরে আমি ভারত সরকারের সামরিক বিভাগের সেক্রেটারির একখানি চিঠির কপি আপনাকে পাঠাচ্ছি। সেই চিঠিতে আপনি দেখতে পাবেন, হিন্দু ও মাদ্রাসা কলেজের অট্টালিকা দুটি সৈন্যদের বাসের জন্য গবর্নমেন্ট সাময়িকভাবে দখল করবেন মনস্থ করেছেন। কলকাতায় শীঘ্র যে সৈন্যসামন্ত আসবে তাদের এই স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। আপনাকে তাই অনুরোধ করছি যে আপনি আর  বিলম্ব না করে এখনই গ্যারিসান-কমান্ডারের হাতে আপনার বিদ্যালয়গৃহ ছেড়ে দেবার বন্দোবস্ত করবেন। (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮৬)

পরবর্তী দিন, ১৮ই আগস্ট গর্ডন ইয়ং বিদ্যাসাগরকে এক চিঠিতে লেখেন : ‘সৈন্যরা আপনার বিদ্যালয়গৃহ দখল করলে আপনি আপনার ছাত্রদের শিক্ষা সমস্যার এবং ক্লাসের সমস্যার কিভাবে সমাধান করবেন, সে সম্বন্ধে চিন্তা করে যতশীঘ্র সম্ভব পত্রোত্তরে আমাদের জানাবেন’ (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ১৮৬)। বিদ্যাসাগর বুঝতে পারলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত তিনি কিছুতেই ঠেকাতে পারবেন না। অগত্যা শিক্ষা বিভাগের প্রস্তাব মেনে নিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বহুবাজারের ৯২ এবং ১১০ নম্বর বাড়ি কলেজের জন্য তিনি ভাড়া নেন। ভাড়া যথাক্রমে ৩০&  এবং ৭৫ & টাকা। ভবনদ্বয়ে কলেজের মোট আটটি ক্লাস হতো।

শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে নানা বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই মতদ্বৈধতা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দৃঢ়চেতা জেদি পুরুষকার ঋদ্ধ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ পদ পরিত্যাগ করার  সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ-সময় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এবং দক্ষিণবঙ্গের স্কুল-পরিদর্শক – এই দুই পদে চাকরিসূত্রে বিদ্যাসাগর মাসে ৫০০ টাকা বেতন পেতেন। বন্ধুমহলের অনুরোধ, নিশ্চিত চাকরি, উচ্চ বেতন – কোনো কিছুই বিদ্যাসাগরকে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সফল হলো না। ১৮৫৮ সালের ৫ই আগস্ট শিক্ষা বিভাগের পরিচালকের কাছে বিদ্যাসাগর তাঁর পদত্যাগপত্র উপস্থাপন করেন। পদত্যাগপত্রে বিদ্যাসাগর লেখেন :

অসুস্থতা আমার পদত্যাগের একটি প্রধান কারণ বটে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। তা যদি হতো তাহলে দীর্ঘদিনের জন্যে বিশ্রাম নিয়ে আমি স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে সরকারি চাকরি করা নানা কারণে আমার কাছে অপ্রীতিকর হয়ে উঠেছে। যে পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলা শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা চলছে, আমার ধারণা তাতে শুধু অর্থের অপব্যয়ই হচ্ছে, আসল কাজ বিশেষ কিছু হচ্ছে না। এ কথা আপনাকে বহুবার বলেছি। আপনি জানেন কতবার কাজে আমি বাধা পেয়েছি। তাছাড়া ভবিষ্যতে কাজের দিক থেকেও আমার পদোন্নতির কোনো সম্ভাবনাই নেই। অতএব, আমার দিক থেকে পদত্যাগ করার যে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, আশা করি আপনি তা স্বীকার কবেন। (উদ্ধৃত : খন্দকার রেজাউল করিম, ২০১৬ : ৪৯)।

অবশেষে ১৮৫৮ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর বাংলা সরকার বিদ্যাসাগরের পদত্যাগপত্র মঞ্জুর করেন। কিন্তু যে-ভাষায় ঔপনিবেশিক প্রশাসক বিদ্যাসাগরের পদত্যাগপত্র মঞ্জুর করেন, তাতে তাঁর প্রতি খানিকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যই প্রকাশিত হয়েছে :

পণ্ডিত মশায় শেষপর্যন্ত খানিকটা অশোভনভাবে অবসর গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত করলেন, এটা খুবই দুঃখের বিষয়। বিশেষ করে তাঁর যখন অসন্তোষের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। যাই হোক আপনি অনুগ্রহ করে তাঁকে জানাবেন, এদেশের জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘকাল উৎসাহের সঙ্গে যে কাজ করেছেন তার জন্য সরকার তাঁর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। (উদ্ধৃত : খন্দকার রেজাউল করিম, ২০১৬ : ৪৯)।

১৮৫৫ সালের ১লা মে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ছোটলাট হ্যালিডের একান্ত ইচ্ছায় এবং ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন চার্লস উডের সম্মতিতে বাংলা সরকার দক্ষিণ বাংলার মডেল স্কুলসমূহের সহকারী ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ প্রদান করে। অতিরিক্ত এই দায়িত্ব পালনের জন্য বিদ্যাসাগরকে মাসিক ২০০ টাকা সম্মানী প্রদান করা হতো। সহকারী ইনস্ট্রাক্টর পদে নিযুক্তি লাভের পর বিপুল উৎসাহে মডেল স্কুলসমূহের মান উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করেন বিদ্যাসাগর। এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কাজ ছিল মডেল স্কুলসমূহের জন্য যোগ্য শিক্ষা নির্বাচন এবং সামূহিক তত্ত্বাবধান করা। মডেল স্কুলগুলোর প্রত্যাশিত উন্নতির জন্য তিনি যোগ্য শিক্ষকের অভাব উপলব্ধি করলেন। মডেল স্কুলে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একটি পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে দারুণ হতাশ হন তিনি। নিজের প্রত্যাশামতো যোগ্য শিক্ষক না পেয়ে বিদ্যাসাগর শিক্ষকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ স্কুল বা নর্মাল স্কুল স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ১৮৫৫ সালের ২রা জুলাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপনের লক্ষ্যে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন চার্লস উডের কাছে জরুরি  চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগর। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন :

নর্মাল স্কুল হলে, আমার ইচ্ছা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সর্বজনখ্যাত সম্পাদক বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত তার প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রথম শ্রেণীর বাংলা লেখক খুব অল্পই আছেন। যে দু-একজন উৎকৃষ্ট লেখক আছেন, অক্ষয় কুমার তাঁদের অন্যতম। ইংরেজিতে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে এবং সাধারণ জ্ঞানের তথ্যাদিও তাঁর আয়ত্তে। শিক্ষকতার কাজেও তিনি দক্ষ। আমার ধারণা, তাঁর চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি বর্তমানে পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। … দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে আমি পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতির নাম উল্লেখ করছি। (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২০৮)

– বিদ্যাসাগরের এই চিঠি পেয়ে বাংলা সরকার এবং ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বিদ্যাসাগর-প্রস্তাবিত নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করেন। ১৮৫৫ সালের ১৭ই জুলাই বিদ্যাসাগরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কলকাতায় একটি নর্মাল স্কুল বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই সময় বিদ্যাসাগর দক্ষিণ বাংলার বিদ্যালয়ের স্পেশাল ইনস্ট্রাক্টর পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কঠোর পরিশ্রম এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানের কারণে মডেল স্কুল এবং নর্মাল স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থায় দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন আনতে সমর্থ হলেন বিদ্যাসাগর। মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর স্কুলগুলোর সার্বিক অবস্থা ও অবদানের কথা উল্লেখ করে বিদ্যাসাগর লেখেন : ‘বাংলাদেশের মডেল স্কুলগুলো প্রায় তিন বছর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে স্কুলের বেশ আশাপ্রদ উন্নতি হয়েছে। ছাত্ররা সব বাংলা পাঠ্যপুস্তক পাঠ করেছে। বাংলাভাষায় তাদের বেশ দখল দেখেছি। প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে তারা বেশ জ্ঞান লাভ করেছে। যখন এই কাজ আরম্ভ করা হয় তখন অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, গ্রামের লোকেরা মডেল স্কুলের মর্ম বুঝতে পারবে না। কিন্তু স্কুলের সাফল্য সেই সন্দেহ দূর করেছে। যেসব গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেইসব গ্রামের ও তার আশপাশের গ্রামবাসী স্কুলগুলিকে আশীর্বাদ বলে মনে করে এবং তার জন্য তারা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। স্কুলগুলির যে যথেষ্ট সমাদর হয়েছে, ছাত্রসংখ্যা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২০৯)।

১৮৫৪ সালে ফ্রেডারিক হ্যালিডে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাট হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে শিক্ষানবিশ থাকার সময় হ্যালিডে পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সান্নিধ্যের সেই সূত্র ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিদ্যাসাগরের কর্মনিষ্ঠা এবং পাণ্ডিত্যকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন হ্যালিডে। তিনি বিদ্যাসাগরের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করলেন। হ্যালিডের প্রস্তাব পেয়ে বিদ্যাসাগর সানন্দে তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। নদীয়া, হুগলি, বর্ধমান ও মেদিনীপুর – এই চার জেলার স্কুলসমূহের সার্বিক উন্নতির জন্য কাজ করতে থাকেন বিদ্যাসাগর। এই কাজে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর লাভ করেছিলেন প্রভূত সহযোগ। মডেল স্কুল এবং নর্মাল স্কুলগুলো ভালোভাবে চলছে দেখে এবার বিদ্যাসাগর মনোযোগী হলেন উপর্যুক্ত চার জেলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজে।

১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই ইংল্যান্ডের বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট চার্লস উড ভারতীয়দের শিক্ষাসংক্রান্ত ডেসপ্যাচ এদেশে পাঠান, যা ‘উউ ডেসপ্যাচ’ নামে বিশেষভাবে খ্যাত। উডের ওই ডেসপ্যাচে ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ-কাজেও ছোটলাট হ্যালিডে সহযোগিতা চাইলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। বিদ্যাসাগর তো এ-সময় নারীশিক্ষা প্রসারের কথা নিজেই ভাবছিলেন। তাই হ্যালিডের প্রস্তাবে তিনি বিশেষ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ইতোমধ্যে কলকাতা এবং দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আদর্শ স্কুল ও নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা ও তত্ত্বাবধান করে বিদ্যাসাগর বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাই নারীশিক্ষা প্রসারের সুযোগের কথা ভেবে হ্যালিডের সহায়তা প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন বিদ্যাসাগর। সরকারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরামর্শক্রমে স্থির হলো যে, সরকার সেসব বালিকা বিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যয় বহন করবে যেগুলোর স্কুলগৃহ গ্রামবাসীরা নিজেদের অর্থে নির্মাণ করে দেবেন। হুগলি, নদীয়, বর্ধমান ও মেদিনীপুর – এই চার জেলায় বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস – এই সাত মাসে উপর্যুক্ত চার জেলায় মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন বিদ্যাসাগর। এই ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়ে ১৮৫৮ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত শিক্ষকবৃন্দের বেতন বাবদ মোট খরচ হয় ৩৪৩৯.৫০ টাকা। কিন্তু ছাত্রীদের কাছ থেকে কোনো বেতন না নেওয়ার কারণে স্কুলসমূহের আর্থিক সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করে। আর্থিক সংকট দূর করার অনুরোধ জানিয়ে বাংলার ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে-র কাছে এক চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগর। এই আবেদনের সূত্র ধরে উইলিয়ম গ্রে ভারত সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পাঠান। রিপোর্টে উইলিয়ম গ্রে ভারত সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ১৮৫৬ সালের ১লা অক্টোবর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জানায় যে, বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা ব্যয় কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। কাজেই বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত স্কুলসমূহের ব্যয়ভার সরকারের বহন করা উচিত। বালিকা বিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন বিদ্যাসাগর। এ অবস্থায় ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনকে একটি চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগর। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া এবং মেদিনীপুর জেলায় অনেকগুলি গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। বিশ্বাস ছিল, সরকার হইতে মঞ্জুরী পাওয়া যাইবে। স্থানীয় অধিবাসীরা স্কুলগৃহ তৈয়ারি করাইয়া দিলে সরকার খরচপত্র চালাইবেন। ভারত সরকার কিছু শর্তে সাহায্য করিতে নারাজ, কাজেই স্কুলগুলি তুলিয়া দিতে হইবে। কিন্তু শিক্ষকগণ গোড়া হইতে মাহিনা নেন নাই, তাঁদের প্রাপ্য মিটাইয়া দেওয়া দরকার। আশা করি সরকার এই ব্যয় মঞ্জুর করিবেন’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৫৫ : ৭০) এই চিঠি পেয়ে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বাংলা সরকারের কাছে বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে নিম্নোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন :

পণ্ডিতের [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর] পত্রের সহিত সংযুক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি; কেননা, স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে এই কর্মচারীর স্বেচ্ছাকৃত এবং অনাড়ম্বর পরিশ্রমের কথা সরকারের না জানাই সম্ভব। দূরবর্তী স্থানের অন্যবিধ কর্তব্যের গুরুভার যাহার উপর ন্যস্ত, কর্তৃত্বের বিশেষ উচ্চপদেও যিনি অবস্থিত নন, এমন এক ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের বিশেষ সাহায্য ও সহানুভূতি ব্যতীতও গ্রামসমূহে যদি এতটা করিয়া থাকিতে পারেন, সরকারের অনুমোদন ও সাহায্য পাইলে সেই দিকে কতটাই না তিনি করিতে পারিতেন? আর যদি আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইহাতে সেই কর্মচারীর অপমান ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে স্ত্রীশিক্ষার প্রচারে কি নিরুৎসাহের ভাবই না আসিয়া পড়িবে!’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৫৫ : ৭১)।

হ্যালিডের পরামর্শে ও উৎসাহে প্রাণিত হয়ে বালিকা বিদ্যালয়সমূহ সম্পর্কে কোনো সরকারি আদেশ সংগ্রহ করেননি বিদ্যাসাগর। কারণ, নারীশিক্ষার ব্যাপারে তিনি যে সরকারি সমর্থন ও সাহায্য পাবেন না, তা বিদ্যাসাগর কল্পনায়ও ভাবেননি। শিক্ষা বিভাগের পরিচালক উডের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। অন্যদিকে বালিকা বিদ্যালয়গুলোর অর্থসাহায্য নিয়েও দেখা দিলো ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের নানামাত্রিক নেতিবাচক পদক্ষেপ। বালিকা বিদ্যালয়গুলোকে অর্থসাহায্য দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর হ্যালিডের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন। বিদ্যাসাগরের কথা শুনে হ্যালিডে বললেন : ‘সুপ্রীম সরকার ভারতবর্ষে শিক্ষা বিষয়ে ব্যয় কমাতে বলেছেন। তাই সরকার বালিকা বিদ্যালয়ে টাকা দিতে সম্মত নন। আমি আপনাকে মৌখিক আদেশ দিয়েছিলাম সত্য, কিন্তু বালিকা বিদ্যালয়গুলির জন্যে সরকারিভাবে অর্থব্যয় এখন অসম্ভব। বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের কয়েক মাসের বেতন বাকী আছে। এ সম্পর্কে আপনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আবেদন করুন। আবেদন করলেই আমি টাকা দিয়ে দেব’ (উদ্ধৃত : ঋষি দাস, ১৯৭১ : ৪১)। এ-কথা শোনার পর বিদ্যাসাগর হ্যালিডেকে বলেন : ‘আমি কখনও কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করিনি, করতেও পারব না। আমি ঐ টাকা নিজে ঋণ করে পরিশোধ করব’ (উদ্ধৃত : ঋষি দাস, ১৯৭১ : ৪১)। একথা বলে বিরক্ত বিদ্যাসাগর হ্যালিডের কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েন।

ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যয় পরিশোধের জন্য ভারত সরকারকে পৌনঃপুনিক অনুরোধ করতে থাকেন। অবশেষে ১৮৫৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর ভারত সরকার তাদের সিদ্ধান্ত একটি পরিপত্রের মাধ্যমে ছোটলাট উইলিয়ম গ্রেকে জানিয়ে দেন। ওই পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় :

দেখা যাইতেছে, পণ্ডিত [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর] আন্তরিক বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়াই এ কাজ করিয়াছেন, এবং এ কাজ করিতে উচ্চতম কর্মচারীদের উৎসাহ ও সম্মতিও তিনি পাইয়াছেন। এই সকল কথা বিবেচনা করিয়া, এই বিদ্যালয়গুলিতে যে ৩৪৩৯.৫০ টাকা প্রকৃতপক্ষে ব্যয় হইয়াছে সেই টাকার দায় হইতে সপারিষদ বড়োলাট তাঁহাকে মুক্ত করিতেছেন। সরকার এ টাকা দিবেন, ইহাই তাঁহার আদেশ। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির অথবা সেগুলির পরিবর্তে সরকারি বিদ্যালয়গুলির ব্যয় নির্বাহার্থ কোনো স্থায়ী অর্থসাহায্য করিতে কাউন্সিলের সভাপতি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক। (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৫৫ : ৭২)

সময়ের এ-পর্বেই সমগ্র ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সিপাহী বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সরকার সিপাহী বিদ্রোহ দমনে তৎপর হয়ে ওঠে। এ-সময় চরম আর্থিক সংকটে নিপতিত হয় ব্রিটিশ সরকার। ফলে বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলোর জন্য অর্থসাহায্যে অপারগতা প্রকাশ করে সরকার। তবে অবস্থা অনুকূল হলে অর্থসাহায্যের ব্যাপারে সরকার ভাববেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। (জয়ন্তী মণ্ডল, ২০১৪ : ৭৫)। কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রশাসনের নানামাত্রিক ব্যবহারে ক্ষুব্ধ বিদ্যাসাগর সরকারি প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। এসব কারণে এবং সমূহ বিরূপতায় ১৮৫৮ সালের ৩রা নভেম্বর সরকারি চাকরি পরিত্যাগ করেন বিদ্যাসাগর। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং সে-প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর-জীবনীকার হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন এই কথা : ‘বিতর্ক দু’জনের [বিদ্যাসাগর ও ইয়ং] সম্পর্কটাকে এতো বেশি তিক্ত করে দিল যে, বিদ্যাসাগর তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে অত্যন্ত অসুবিধাবোধ করতে লাগলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মচারী হিসেবে ইয়ং-এর স্থানটি ছিল সুবিধাজনক এবং তিনি যা করতে লাগলেন তাতে মনের তৃপ্তি হয় এমনভাবে নিজের কাজগুলি করে যাওয়া বিদ্যাসাগরের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠল। স্বভাবতই কাজে তাঁর আর উৎসাহ রইল না, এবং তিনি পদত্যাগ করবেন স্থির করলেন। তাঁর পদত্যাগপত্রে পদত্যাগের এমন কতকগুলি কারণের উল্লেখ ছিল, যাতে দুর্ভাগ্যবশত স্বয়ং লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সঙ্গেও তাঁকে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হতে হয়। এই ব্যাপারেও এই আশ্চর্য মানুষটির মনের ভিতরকার সদ্গুণগুলি খুব স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেল। দেশের প্রশাসনের একেবারে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিটিকে খুশি করবার জন্যেও তিনি নিজের নীতিবোধ থেকে উদ্ভূত মতবাদ ছাড়তে রাজী হলেন না’ (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৪ : ৩২৫-৩২৬)। অন্য অনেকের মতো বিদ্যাসাগর ব্যক্তিস্বার্থের চাপে আদর্শ ও নীতিবোধ কখনো জলাঞ্জলি দেননি, কখনো মেনে নেননি আত্মবিশ্বাসের পরাভব। ঔপনিবেশিক প্রশাসন কিংবা স্বদেশবাসীর সঙ্গে এখানেই বিদ্যাসাগরের ব্যতিক্রমিতা। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিম্নোক্ত অভিমত :

বিদ্যাসাগর স্বভাবতই সম্পূর্ণ স্বাধীনতন্ত্রের লোক ছিলেন, অব্যাহতভাবে আপন ইচ্ছা চালনা করিতে পাইলে তবে তিনি কাজ করিতে পারিতেন, উপরিতল কর্তৃপক্ষের মতের দ্বারা কোনোরূপ প্রতিঘাত প্রাপ্ত হইলে তদনুসারে আপন সংকল্পের প্রবাহ তিলমাত্র পরিবর্তন করিতে পারিতেন না। কর্মনীতির নিয়মে ইহা তাঁহার পক্ষে প্রশংসনীয় ছিল না। কিন্তু বিধাতা তাঁকে একাধিপত্য করিবার জন্য পাঠাইয়াছিলেন, অধীনে কাজ চালাইবার গুণগুলি তাঁহাকে দেন নাই। উপযুক্ত অধীনস্থ কর্মচারী বাংলাদেশে যথেষ্ট আছে; বিদ্যাসাগরকে দিয়া তাহাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করা বিধাতা অনাবশ্যক ও অসংগত বোধ করিয়াছিলেন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৪০২ : ৭৭৬)

ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে মিস মেরি কার্পেন্টার ১৮৬৬  সালে ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসেন। তৎকালীন ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন মি. অ্যাটকিনসনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর ও মেরি কার্পেন্টারের সাক্ষাৎ হয়। মেরি কার্পেন্টারকে নারীশিক্ষা বিষয়ে বিদ্যাসাগর নানা ধরনের পরামর্শ দিতেন, একসঙ্গে পরিদর্শনে যেতেন বিভিন্ন অঞ্চলের বালিকা বিদ্যালয়। নারীশিক্ষা বিস্তারে দুজনের সহযোগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বেথুন গার্লস স্কুলের একটা অংশে শিক্ষয়িত্রী প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল খোলা নিয়ে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ ঘটে। ফলে মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে আর যেতেন না বিদ্যাসাগর। বেথুন গার্লস স্কুলের একটা অংশে নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বিদ্যাসাগর।

কিন্তু শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে  সুসম্পর্ক থাকার কারণে মেরি কার্পেন্টারের জয় হলো, উপেক্ষিত হলো বিদ্যাসাগরের অভিমত। বেথুন গার্লস স্কুলভবনেই নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মি. অ্যাটকিনসন গার্লস স্কুল পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন এবং স্কুল পরিচালনার ভার দেন স্কুল ইন্সপেক্টর মি. উড্রোর ওপর। মি. উড্রোর সঙ্গে মেরি কার্পেন্টারের ছিল গভীর সম্পর্ক। দুজনের কৌশল হলো কীভাবে বিদ্যাসাগরকে স্কুল পরিচালনার সংশ্লিষ্টতা থেকে বাদ দেওয়া যায়। এ-উদ্দেশ্যেই মি. উড্রো পূর্বতন কমিটির স্থলে নতুন একটা পরামর্শ সভা গঠনের উদ্যোগ নিলেন। উড্রোর পরামর্শে অ্যাটকিনসন ভূতপূর্ব পরিচালনা কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান, প্রস্তাবিত পরামর্শ সভার সদস্য হিসেবে তাঁরা কাজ করতে সম্মত আছেন কি না? ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অসৎ উদ্দেশ্য অনুধাবন করে অ্যাটকিনসনের প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে বেথুন গার্লস স্কুলের পরামর্শ সভায় থাকতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন বিদ্যাসাগর। এই প্রেক্ষাপটে ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন স্কুল পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন বিদ্যাসাগর। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে মতাদর্শগত বিরোধের কারণে বেথুন গার্লস স্কুলের সঙ্গে সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করেন তিনি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ভালোবাসতেন গভীরভাবে। স্কুলটির কোনো ধরনের ক্ষতি বা অবমূল্যায়ন কল্পনাও করতে পারেননি বিদ্যাসাগর।

মেরি কার্পেন্টার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছোটলাট উইলিয়ম গ্রে বেথুন গার্লস স্কুলের একাংশে নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে গোটা স্কুলটিকেই শিক্ষয়িত্রী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরের চিন্তা করেন। কেননা, ঔপনিবেশিক প্রশাসন মনে করতেন, স্কুলটির জন্য সরকার যে-পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, সে-অনুপাতে ফল লাভ সন্তোষজনক নয় (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : ৪২)। উইলিয়ম গ্রে এ-বিষয়ে বিদ্যাসাগরের অভিমত জানতে চান। গ্রে-র চিঠির উত্তরে বিদ্যাসাগর তাঁর অভিমত চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন। কার্পেন্টার বা গ্রে-র প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর তাঁর চিঠিতে লেখেন : ‘শিক্ষয়িত্রীদের জন্যে একটি ট্রেনিং স্কুল থাকা উচিত, মেরি কার্পেন্টারের এই অভিমত নীতিগতভাবে ঠিক, কিন্তু বাস্তবতার দিক দিয়ে অকেজো। এর কারণ হলো, অল্পসংখ্যক সহায়-সম্বলহীন বিধবা ভিন্ন এই প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক বয়ঃপ্রাপ্তা স্ত্রীলোক পাওয়া যাবে না, যেহেতু জনমত স্ত্রীলোকদের এই উপজীবিকা অবলম্বনের বিরোধী। … আপনাকে এই আশ্বাস দেওয়া বাহুল্য যে, স্ত্রীলোক শিক্ষার্থী স্ত্রীলোকদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করবেন, এটাই যে আবশ্যক এবং বাঞ্ছনীয় তা আমি পরিপূর্ণভাবেই উপলব্ধি করি, কিন্তু সমাজজীবন সম্বন্ধে আমার স্বদেশবাসীদের কতগুলি ভ্রান্ত ধারণা এ বিষয়ে অনতিক্রমণীয় বাধা স্বরূপ। তা যদি না হতো, আমি সকলের আগে এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করতাম, এবং সর্বান্তঃকরণে, তাকে তার লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর করে দেবার কাজে সহযোগিতা করতাম।’ (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১ : ৪২-৪৩)। চিঠিতে তিনি আরো লেখেন – বেথুন স্কুল সম্পর্কে অভিমত দেওয়ার অধিকার আছে বলেই মেরি কার্পেন্টার বা উইলিয়ম গ্রে-র অভিমতের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এই স্কুলটি নারীশিক্ষা বিস্তারে পালন করে আসছে ঐতিহাসিক ভূমিকা – তাই স্কুলটিকে কিছুতেই বিলুপ্ত করা যাবে না। এভাবে সেদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঔপনিবেশিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সেদিন যদি বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুল রক্ষার পক্ষে না দাঁড়াতেন, তবে গোটা এশিয়াতেই নারীশিক্ষার প্রাথমিক একটি উদ্যোগের অকালমৃত্যু হতো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একরোখা জেদি স্বভাবের কথা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অজানা ছিল না। বাংলার ছোটলাট হ্যালিডে পাবলিক ইনস্ট্রাকশনকে অনুরোধ করেন, অন্তত গোড়ার দিকে অস্থায়ীভাবে হলেও বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বিদ্যাসাগরের সাহায্য নেওয়া হোক। ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনকে এক পত্রে হ্যালিডে লেখেন : ‘শিক্ষাবিভাগের নূতন ব্যবস্থা সত্ত্বেও, অন্তত কিছুদিনের জন্য পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো একজন গুণী ব্যক্তিকে বাংলাশিক্ষা পরিদর্শনের কাজে নিযুক্ত করা উচিত বলে ছোটলাট মনে করেন’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২০৬)। হ্যালিডের এই পত্রের উত্তরে ডিপিআই প্রস্তাব করেন যে, স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তা মি. প্র্যাটকে না পাওয়া পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে স্কুলপরিদর্শক পদে নিযুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু ডিপিআইয়ের এই প্রস্তাব ছোটলাট হ্যালিডের পছন্দ হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি লেখেন, ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে অস্থায়ীভাবে কাজে নিযুক্ত করে কোনো লাভ নেই। তিনি একজন অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি, সেইজন বাংলাশিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর কতগুলি দৃঢ় মতামতও আছে। যদি তাঁকে তাঁর নিজের মতামত অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, তবেই তিনি উৎসাহ নিয়ে কাজ করবেন, এবং নিজের বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যে পরিণত করতে। তিন মাস বা তিন সপ্তাহ পরে মি. প্র্যাট যখনই আসবেন তখনই তাঁকে বিদায় নিতে হবে, এরকম কোনো শর্তে তাঁকে নিযুক্ত করলে তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না’ (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২০৬)। এক্ষেত্রে হ্যালিডে বিদ্যাসাগরকে যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তাই তিনি বিদ্যাসাগরকে অস্থায়ী কোনো পদে না দিয়ে স্থায়ীভাবে স্কুলপরিদর্শকের কাজে নিযুক্ত করার সুপারিশ করেন। তাঁর সুপারিশপত্রের প্রাসঙ্গিক অংশ ছিল এরকম :

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের মতো একজন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে ছোটলাট কোনো অস্থায়ী পদে নিযুক্ত করার বিরোধী। বাংলাশিক্ষার ক্ষেত্রে এত অল্পদিনের মধ্যে পণ্ডিত কিছু কাজ করে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাঁর চরিত্র ও গুণ বিচার করে এইভাবে তাঁকে কাজে নিয়োগ করাও অন্যায় হবে। যে-কোনো মুহূর্তেই তাঁকে বিদায় করে দেওয়া যেতে পারে, এরকম শর্তে তাঁকে নিয়োগ করলে তাঁর প্রতি সরকারের অবিচার করা হবে। সেইজন্য ছোটলাটের মত এই যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্মাকে এখনই যেন অনুমোদিত ব্যবস্থা অনুসারে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করে, কলকাতা শহরের কাছাকাছি  তিন-চারটি জেলা তাঁর কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে দেওয়া হোক। তাতে এই সময় অন্তত পণ্ডিতের কলেজের কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হবে না। … সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের বেতন ছাড়া পণ্ডিত মহাশয়কে এই কাজের জন্য মাসিক ২০০ টাকা বেতন ও  যাতায়াতের খরচ দেওয়া হোক। (বিনয় ঘোষ, ২০১১ : ২০৭) 

– ছোটলাট হ্যালিডের এই অভিমত জানতে পেরে ডিপিআই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে দক্ষিণ বাংলার বিদ্যালয়সমূহের সহকারী-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগদান করেন।

এভাবে দেখা যায় দ্বন্দ্ব ও সহযোগের মধ্য দিয়ে উপনিবেশিত সমাজে বিদ্যাসাগরকে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ করতে হয়েছে। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে ক্রমাগত বিরোধের মধ্য দিয়ে তাঁকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এই দ্বৈরথে বিদ্যাসাগর কখনো আপস করেননি – নিজের স্বার্থের কাছে পরাভব মেনে কখনো আপন নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। ইউরোপীয় পোশাক পরিধান, নিজস্ব চটি জুতা ব্যবহার – ইত্যাদি বিষয় নিয়েও ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন বিদ্যাসাগর এবং সর্বত্রই তিনি রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন আপন স্বকীয়তা। উপনিবেশিত সমাজে, এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন স্বাধীন মানুষ, ব্যতিক্রমী এক শিক্ষাচিন্তক।

সহায়ক-সূত্র

১. ঋষি দাস, ১৯৭১। বিদ্যাসাগর, কলকাতা : অশোক প্রকাশন।

২. খন্দকার রেজাউল করিম, ২০১৬। বিদ্যাসাগর, ঢাকা : মুক্তধারা।

৩. বিনয় ঘোষ, ২০১১। বিদ্যাসাগর বাঙালী সমাজ, কলকাতা : ওরিয়েন্ট ব্লাকসোয়ান।

৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৫৫। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (সাহিত্য-সাধন চরিতমালা – দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ।

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৪০২। চারিত্রপূজা, রবীন্দ্র-রচনাবলী – দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ।

৬. হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭১। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নয়াদিল্লি : সাহিত্য অকাদেমি। ৭. Hiltrud Rustau, 1993. ‘Iswarchandra Vidyasagar and the Nation of Intercultural Philosophy’ in The Golden Book of Vidyasagar (Editor : Manik Mukhopadhyay), Calcutta : All Bengal Vidyasagar Death Centenary Committee.