কবিতায় স্মৃতি-বিস্মৃতির সুর

আলতাফ শাহনেওয়াজের কাব্যগ্রন্থ গ্রামের লোকেরা যা বলে হাতে নিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম কবিতাগুলি গ্রামীণ মিথ নিয়ে হবে। গ্রাম ও গ্রামীণতার অভিজ্ঞতায় বয়ে চলা হাজার বছরের আলেখ্যের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে কবির নিজস্ব কাব্যচেতনা। কবির এলাকার মিথের সঙ্গে তাঁর কবিতা ও জীবনবোধের মিথ যুক্ত হয়ে যা পাব, তাই হবে এই গ্রন্থের কবিতাগুলির মূল সুর; কিন্তু শাহনেওয়াজ তা হতে দেন না। কবি হিসেবে তিনি পাঠকের প্রাক-ধারণাকে প্রথমেই ভিন্নপথে চালিত করেন। ফলে পাঠক আরো উৎসাহী হয়ে কবিতার গভীরে প্রবেশ করেন। পাঠকের এই পূর্বধারণাকে বদলে দেওয়াটাও একজন কবির স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে।

কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে দেখি, কবি গ্রাম থেকে উঠে আসা এক কবির নাগরিক হয়ে-ওঠার পর, তাঁর ভেতরে থেকে যাওয়া গ্রামীণ সত্তার বীজগুলি কীভাবে নতুন করে অঙ্কুরিত হয়, কীভাবে নিয়ত সেই সত্তা তাঁর চেতনার ভেতরে প্রবাহিত হয়, কীভাবে শহুরে বাতাসেও তাঁর বুকের ভেতরে তা জীবন্ত থাকে, কীভাবে আলো-ঝলমলে চমকের মধ্যে থেকেও বুকের ভেতরে তা লকলকিয়ে ওঠে, সময় থেকে সময়ান্তরে অনুরণন তোলে আপাত নাগরিক কবির মনে – এসবই কবিতাগুলিতে শৈল্পিক দ্যোতনা পেয়েছে।

এক কথায় আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতার মূল সুর এক জায়গায় বর্ণিত হয় না, তা ছড়িয়ে পড়ে সকল কবিতায়। ডালপালা, সত্তা ও বস্তুর মিথস্ক্রিয়ায় সেখানে সংশ্লেষিত হতে দেখা যায় অনেক ভিন্ন প্রপঞ্চ। যেমন ‘উৎসর্গ’ কবিতার প্রথম চরণে পাই ‘সন্ধ্যার আলো নিজেই শব্দ, চুপ হয়ে থাকার মতন;/ আলোর মতন শব্দ বাজছে,।’ আলো কী? অস্পৃশ্য বস্তু  অথবা কণা (বিজ্ঞান এখনো একমত নয় যে, আলো আসলে বস্তু, নাকি কণা, নাকি তরঙ্গ) – তাকে শব্দের রূপে দেখানো হচ্ছে, একই সঙ্গে চুপ হয়ে থাকার মতো উপমা দিয়ে শব্দ-দ্যোতনাকে পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আলো – যাকে আমরা বিভিন্ন বিষয়ের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করি, তাকে এই প্রথম একজন কবি দেখাচ্ছেন ‘শব্দ’ হিসেবে। এই যে দেখা এবং দেখানো, এই যে অনুভূত সত্তা ও উপলব্ধি, এই যে শব্দের রূপ ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন এবং এই প্রয়াসের ভেতরে দৃশ্যকল্পের অবতারণা করছেন কবি, তা কোনো সাধারণ সম্ভাবনার কথা বলে না। কবিতার শব্দ ও ধ্বনি নিয়ে আমরা যে অপার সম্ভাবনার কথা বলি, যে খোলা প্রান্তের কথা বলি, শব্দ তার শাব্দিক অর্থকে অতিক্রম করে অন্যতর, ভিন্নতর ও গভীরতর অর্থের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার কথা বলি – আলতাফ শাহনেওয়াজের এই প্রয়াস তারই সফল উদাহরণের ইঙ্গিত বহন করে।

প্রথম কবিতা ‘অনেক পুরোনো দিন’। পড়া শুরু করার পর চলতে থাকে গতিময়। সাম্প্রতিক কবিতার একটি বড় দোষ এর প্রবহমানতার অভাব। শাহনেওয়াজের কবিতা পড়লে প্রবহমানতাজনিত সমস্যায় পড়তে হয় না। কারণ হচ্ছে এর গতিময় শব্দ, চরণ, দৃশ্য পরম্পরা। কবি এখানে পুরনো দিন বলতে বোঝাচ্ছেন তাঁর শৈশবকে। শৈশব কোনো প্রচলিত বাস্তবতা নয়। শৈশব মানে এক কুহকী জগৎ। মূর্ত-বিমূর্তের মাঝামাঝি, স্মৃতি-বিস্মৃতি আর স্বপ্ন-কল্পনার মাঝখানের এক কুহেলীমালা। ‘অন্ধকারে সে নাকি অন্ধের চোখে গভীর পতন!’ (‘অনেক পুরোনো দিন’)।

‘আবার বছর ঘুরে’ কবিতা থেকে ‘ক্ষীয়মাণ রাত্রিকাল ধসে, সাইকেল হাঁকিয়ে আসবে/ বন্ধুদের যত প্রেম-দুধের সমান শাদা হয়ে গেছে তারা/ আর সুদূরেরও;/ মুখ দেখে চেনা যায়?’ গতিময় এক কবিতা। দ্বন্দ্বময়। সংযোগী, আন্তঃপরম্পরাময়ও। আজকাল অনেকেই কবিতায় বিচ্ছুরণের খেলা খেলতে গিয়ে মূল কেন্দ্র থেকে এতটাই দূরে সরে যান যে, বিচ্ছুরিত অংশের সঙ্গে মূলের সংযোগ স্থাপনই দুষ্কর হয়ে পড়ে। আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতা এ-ধরনের প্রয়াসের ক্ষেত্রেও সংযোগী। দেখা যায় তাঁর কবিতাও মূল কেন্দ্র থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে, বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে আরো ব্যাপকতর চিত্র ও চিত্রকল্পের ধারণা পাচ্ছে; কিন্তু তা মূল থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না।

আলতাফ শাহনেওয়াজ যখন বলেন, ‘স্পর্শ করি অন্ধকার, ঠোঁটের ওপরে/ জেগে থাকা মগ্ন কালো রাত, ডুবে যাই/ ডুবে যাই …/ বারান্দায় মেলে দেওয়া ভেজা কাপড়ের তারগুলো/ এমনি এমনি কখনো দোলে না!’ (‘শান্ত অঙ্কুরে’) – তখন দেখা যায় তিনি ভেঙে ফেলছেন এতদিনকার প্রচল। আলোর বিপরীত এই অস্পৃশ্য প্রপঞ্চকে তো ফিজিক্যালি স্পর্শ করা যায় না। কবি স্পর্শ করেন, করতে পারেন। কারণ তাঁর ঠোঁটের ওপরে জেগে থাকে মগ্ন কালো রাত।

‘শেষে আসে মিশুক দাহ্যবাগান/ পাশে পাশে শৃঙ্গার শৃঙ্গার ভেঙে খানখান/ কাঁদে …/ চাঁদ তখন অচেনা দেহে/ আলো ফেলেছিল চাঁদে!’ (‘গান্ধর্ব’) কী অদ্ভুত টুইস্ট। বাংলা কবিতার প্রাণ যে লিরিক তা নতুন করে বলার নেই। সেই গীতলতা এই গ্রন্থের কবিতার অন্তরে, অন্দরে আর অভ্যন্তরে। তা কখনো ছন্দের শাসনে, কখনো গদ্য গীতলতায়, কখনো তা স্বভাব-স্বাচ্ছন্দ্যে।

কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের অন্যতম গুণ হলো তিনি এমন কবিতা লেখেন যা পড়া যায়। শুরু করা যায় এবং শেষও করা যায়। সাম্প্রতিক কবিতার পাঠকের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এর পেছনের কারণ হলো কবিতাগুলি পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। কবিতাগুলি সংযোগী, গতিময় এবং পরম্পরা যুক্ত। ফলে পড়া যায়। সুখপাঠ্য বলেও একটা কথা আছে।

আলতাফ শাহনেওয়াজ দুই দশকের অধিক সময় ধরে লিখছেন। তাঁর কাব্যযাত্রায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি গ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশেরও পেরিয়ে গেছে এক দশক। সে-গ্রন্থে নানা ধরনের কবিতা থাকলেও তিনি ধীরে ধীরে বেছে নিয়েছেন তাঁর পথ।

ফলে তাঁর পরবর্তী গ্রন্থগুলিতে ভিন্নমাত্রার সন্ধান পাওয়া যায়। চর্চায় রত থেকে থেকে তিনি এভাবে আমাদের এমন একটি গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন যা তাঁর প্রথম গ্রন্থের কবিতা থেকে ব্যাপকভাবে পৃথক। পৃথক ভাবে, প্রকরণে, উচ্চারণে, উপস্থাপনায়, ভঙ্গিতে, ঢঙে। এভাবে শিল্পযাত্রায় শিল্পের রস নিঙড়ে নিঙড়ে তিনি হয়ে উঠছেন হাজার বছরের কাব্যযাত্রার এক সারথি। গ্রামের লোকেরা যা বলে গ্রন্থখানি সে-যাত্রারই এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।