কবির বঙ্গবন্ধু, কবিতায় বঙ্গবন্ধু

কামাল চৌধুরী শুধু একজন সুখ্যাত কবিই নন, তাঁর সম্পাদনা-দক্ষতাও অনন্য। মহাকালের তর্জনী গ্রন্থের ভূমিকা থেকে শুরু করে কবিতা নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্রই তাঁর সেই নৈপুণ্যের ছাপ সুস্পষ্ট। বইটির ভূমিকায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাচর্চার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন। এই বইটি পড়ে অনেকেই হয়তো প্রথম জানবেন – বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাচর্চার সূচনা হয়েছে পঞ্চাশের দশকে। কথাসাহিত্যিক বনফুলের আড়ালে কবি বনফুলও অনেকের অচেনা। তিনি কবিতা লিখেছেন খুব বেশি নয়। তাঁর কবিতা ‘সহস্র সেলাম’ দিয়ে মহাকালের তর্জনীর শুভসূচনা। সংকলনের সমাপ্তি ঘটেছে মোস্তাক আহমেদ দীনের লেখা ‘তোমার কণ্ঠস্বর’ দিয়ে। মোট কবিতার সংখ্যা ১৫০টি। ভূমিকায় কামাল চৌধুরী লিখেছেন – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে বর্তমান কবিতা সংকলনটি করতে গিয়ে আমাকে অনেক বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হয়েছে। কবিতাগুলো রাজনৈতিক কবিতারও অন্তর্ভুক্ত। তাই নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কবিতাগুলোর বাছাই কাজ করেছি : ১। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে লেখা প্রতিবাদ ও শোকের কবিতাগুলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বিধায় নান্দনিকতা ও উৎকর্ষ বিচারের পাশাপাশি প্রকাশের তারিখ ও সময়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; ২। কবিতার স্মরণযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে; ৩। সকল কবিকে সংকলনভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ’৯০ দশক পর্যন্ত কবিদের কবিতাকে এ সংকলনে স্থান দেওয়া হয়েছে; ৪। অন্য ভাষার কবিরাও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তবে এ সংকলনে তাদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শুধু বাংলা ভাষার কবিদের কবিতা নেওয়া হয়েছে।

সংকলনভুক্ত কবিতাগুলি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন, সংগ্রাম ও বীরত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকটি কবিতার পাঠ-বিশ্লেষণ করা যাক। ফখরুল ইসলাম রচির লেখা ‘কে যায় এই পথে’। কবিতাটির স্বতন্ত্র স্বর আছে। মিছিলের অনেক মুখের মধ্যে ব্যতিক্রম একটি মুখ। কবি বলেছেন, শেখ মুজিব এমন একজন মানুষ যাঁর পদভারে রাজপথ কাঁপে, চোখে জ্বলে ওঠে আগুনের মতো বিদ্রোহী তারা। কবির ভাষ্য –

কে যায় ওই পথে, ছায়াপথে পায়ে দলে হেঁটে চলে

শত শত বেড়াজাল, শোষণ-তোষণ

ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলে

জীবনের সব দুঃখ-জরা-শোকে। শোনো তাঁর নাম বলি 

                                                 দ্বিধাহীন

বাংলার মুজিবুর, প্রাণ মৃত্যুহীন হেঁটে চলে ছায়াপথে

গড়ে তোলে সুকঠিন মানবমন্দির।

কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম বাংলাদেশে, বেড়ে ওঠা ভারতে। জন্মভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অগাধ। বাংলাদেশের সাফল্যে তিনি গৌরব বোধ করতেন, দুর্দিনে হতেন ব্যথিত। তাঁর কবিতায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু
শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় উপস্থাপিত। আলোচ্য সংকলনে তাঁর ‘মুজিবুর রহমানের স্মৃতিতে’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কবিতাটি স্বল্পকায়, কিন্তু ভাবে-গাম্ভীর্যে অসাধারণ। তিনি লিখেছেন –

সবচেয়ে বড় সাহসের নাম স্বপ্ন দেখার সাহস

কম্বুকণ্ঠে সেই সাহসের ডাক দিয়েছিলে তুমি

শুভ এক ফাল্গুনে

মহাস্বপ্নের দিকে।

দশ মাস পরে – কী আশ্চর্য – আমার জন্মভূমি

নবরূপ ধরে জন্ম নিয়েছে – অযুত মৃত্যু পাশে।

শতবর্ষের উৎসবে আজ জেগে থাক তাঁরও নাম –

জন্মমৃত্যু একাসনে বসে দিক তাঁকে সম্মান।

‘এ-সভা প্রস্তাব করছে’ কবিতায় হুমায়ুন আজাদ বলেছেন কবি ও কবিতাময় বাংলাদেশের কথা। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে কবি ছাড়া আর কেউ ভালোভাবে জানে না। তাই কবিরাই বাংলার শাসনতন্ত্র, অর্থনীতি, গণপরিষদ সামলাবে। কবি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব করছেন –

কবিতা ছাড়া বাংলাদেশ আর কোনো তন্ত্রমন্ত্র জানে না

এ-সভা আনন্দিত মুজিবর ঘন ঘন রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেন

এ-সভা প্রস্তাব করছে বিপন্ন রবীন্দ্রনাথকে যারা রক্তমাংসে

                                            রেখেছে বাঁচিয়ে

তিনি যেন মাঝে মাঝে সেই সব তরুণ কবিদেরও উদ্ধৃত

                                                     করেন।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর আগমনে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আনন্দ পূর্ণতা পায়। মহানায়কের প্রত্যাবর্তন নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতা লিখেছেন হাসান আল আব্দুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে পদার্পণের দৃশ্য কবি বর্ণনা করেছেন এভাবে –

অতঃপর সদ্য ফোটা গোলাপের মতো বাংলাদেশ

হাতে করে তরতর বিমানের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন মুজিব।

১৯৭৫ বাঙালির জাতীয় জীবনের কালো অধ্যায়। ঘাতকরা সূর্যের আলো কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু তারা জানে না আদর্শ হচ্ছে সূর্যের মতো দীপ্যমান। নেভানো যায় না। মোছা যায় না। এমনই অমোচনীয় নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের জীবনে বারবার আসবে এই নাম। জাফর ওয়াজেদ যথার্থই লিখেছেন ‘ঘরে ঘরে শেখ মুজিব’ কবিতায় –

আমাদের ঘরে ঘরে আজও ছড়ানো শেখ মুজিবের রক্তের       

                                                        দাগ

আজো বুকের ক্ষতে দাউদাউ জ্বলে ওঠে বীভৎস কালো

                                                     রাত

করুণ বিনাশে অপচয়ের ক্লান্ত ইতিহাস ভাঙে ক্রন্দন

                                                      ক্ষোভ

আমাদের জীবনের সব সংগ্রামে ভাসে সাহসী মুজিবের

                                                       মুখ।

এ-কথা সত্যি, বাংলাদেশকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে এদেশের স্থপতিকে। জানতে হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। মিহির মুসাকী লিখেছেন – ‘গৌতম বুদ্ধ নির্বাণে গেছেন/ বাংলাদেশের শিখা কখনো যাবে না নির্বাণে।’ তাঁর মতে, স্বাধীনতা বুঝতে হলে ৭ই মার্চের ভাষণ বুঝতে পারা জরুরি। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের শিখা অনির্বাণ থাকবে।

গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলি বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে ধারণ করে আছে। কোনো কোনো কবিতা বীরত্বগাথায় পূর্ণ। যেমন –

আমার তোমার নয়, চাও তুমি বাংলার জয়

তারই লাগি মৃত্যুমুখে আগাইয়া গিয়াছ নির্ভয়

তোমার বিরাট সত্তা আজি তাই হিমাদ্রি-সমান

বাঙালির সর্ব গর্ব তোমাতেই আজি দ্যুতিমান।

(‘সহস্র সেলাম’/ বনফুল)

বঙ্গবন্ধু, তুমি আছ বলে –

বিভীষিকাময় অন্ধকারের শব ঠেলে ঠেলে

প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে

আমরা এগিয়ে চলি উদয়াচলের পথে,

তপ্ত শোণিতের প্রস্রবণে ধুয়ে দেই,

মায়ের মুখের মলিনতা নিজের হাতে।

(‘বঙ্গবন্ধু তুমি আছ বলে’, হাবীবুর রহমান)

কোনো কোনো কবিতা বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনাকে ধারণ করে আছে। কিছু কবিতায় স্বদেশ প্রকৃতি ও বঙ্গবন্ধু একাকার হয়ে আছেন। যেমন –

বাঙালির বসন্ত মানেই স্বাধীনতা, স্বাধীনতা মানেই শেখ

                                                      মুজিব

শেখ মুজিব মানেই আমাদের ভালোবাসা, আমাদের বসন্ত

                                                     উৎসব।

(‘মুজিব মানেই বসন্ত-উৎসব’, নূহ-উল-আলম লেনিন)

পাখির ঠোঁটের কাছে কান পেতে শুনেছিল

ওরা তাঁর নাম

ফুলের হাসির কাছে জেনেছিল তাঁর পরিচয়

নদীর স্রোতের কাছে শিখেছিল প্রবাহের গতি তাঁর

বৃষ্টির সুরে সুরে বুঝেছিল তাঁর ভালোবাসা

রাত্রির গল্পেতে জেনেছিল কেমন শপথ তাঁর।

(‘স্মৃতি জাদুঘর’, কাজী রোজী)

আমরাও অতন্দ্র প্রহরী

আপনার স্বপ্ন-সুষমা দিয়ে অবিশ্রান্ত বুনে চলেছি একটি

                                     অনন্য নকশিকাঁথা

দেখবেন একদিন অনিন্দ্যসুন্দর এক নকশিকাঁথায় ছেয়ে 

 যাবে বাংলার সব মাঠ।

(‘বঙ্গবন্ধুর নকশিকাঁথার মাঠ’, জরিনা আখতার)