বিজনের নির্জনে  

চাঁদের গাড়িটি কাইকুই করে থামলে ঝিমুনি ভেঙে চোখ কচলে দেখি, চারধারে ধূসর আরুশি। আজকের মতো শুকতারার আলো মিশে গেল ভোরের আলোয়। মরা চাঁদ ঢলে পড়েছে পুব আকাশে, আর ফ্যাকাসে ভোর উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ের ফাঁকে। ভেজা হাওয়া ও নিশিভ্রমণের ক্লান্তিতে কাকঘুমে এলিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। মনে পড়ে, মাঝরাতে ঢাকা থেকে নাইট কোচে চড়ে রওনা দিয়েছিলাম চাটগাঁর উদ্দেশে। শেষরাতে সাতকানিয়ায় নেমে ঘুম ঘুম চোখে লেগুনায় চড়েছিলাম বান্দরবানের লামার উদ্দেশে। স্টিলবডির এই লেগুনার প্রচলিত নাম চাঁদের গাড়ি। সারাটা রাত ছিচকাঁদুনে আকাশ কেঁদেছে মিহিলয়ে।  মোলায়েম বাতাসে যেন নহবতের আলাপ। চিত্রল লতাপাতা এঁকেবেঁকে উঁচু উঁচু গাছকে জড়িয়ে ধরেছে গভীর মায়ায়। এতক্ষণ আমাদের ভাঙাচোরা যান চলছিল পিচঢালা বন্ধুর পথে। এদিকটা বেশ নির্জন, একদম বুনো। চারদিকে পাহাড়ি অরণ্য। পরজীবী লতার বেষ্টনীতে ফুটে আছে নানান কিসিমের ফুল। বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দের অতি প্রিয় ভাঁট ঝোপ বেড়ে উঠেছে অনাদরে-অবহেলায়। এখন ভাদ্রমাস, এই ফুলের সিজন আসতে ঢের দেরি। ছায়াদায়িনী বাদাম বৃক্ষের মাথাজুড়ে বিস্তৃত পত্রসম্ভার। এক চিলতে নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পেয়ারা গাছ। দুষ্ট কাঠবিড়ালির দল লাফিয়ে বেড়ায় এ-ডাল থেকে ও-ডালে। আমাদের উপস্থিতিতে এসব  প্রাণী যেন কিছুটা বিরক্তই হলো। চিহি চিহি করে মোটা লেজ নাড়িয়ে এরা পালিয়ে গেল ঘন বনে। ঘুমভাঙা কাঠঠোকরা ডানা ঝাপটে বের হয়ে ডেকে উঠল আপনমনে। তরুপল্লবের আড়াল থেকে পাখিরাও গেয়ে উঠল সপ্তসুরে। দূরে কোথাও ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। লেপটানো তাল পড়ে আছে ঘাসের বুকে – হলদেটে মলের মতো দেখায়। স্বাস্থ্যবান নীল মাছিরা জড়ো হয়েছে তালের গন্ধে। এদিকটা নিচু উপত্যকার মতো। কুতকুতে চোখের রক্তচোষা গিরগিটি বসে আছে স্থবির হয়ে। এর মসৃণ ত্বকের রং বদলে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। শৈশবের ভয়কাতুরে স্মৃতি এসে আমার নিউরনে উঁকি দেয়। লোহিতবরন এই সরীসৃপ দেখলে গলা শুকিয়ে আসত। অগ্রজ লুলু বলত, এই দুষ্ট প্রাণী নাকি দূর থেকেই মানুষের রক্ত খেয়ে ফেলে। নিজের মনেই হাসি পায় এসব ভাবলে। জানি, এসব একান্তই কুসংস্কার-চরম অবৈজ্ঞানিক কথা। ভয়ের কুহেলিকা সন্তর্পণে ঘুমিয়ে রয়েছে স্বর্ণালি কৈশোরে, ঘিন ঘিন স্মৃতিকাতরতা আজো জেগে আছে মনের গহিনে। আমার গা বুঝি গুলিয়ে আসছে! মূল কারণ – সারা রাতের জার্নি ও অঘুমের রোগ। বিবমিষা-উপক্রমের আরেকটা নিগূঢ় হেতু হলো, রুক্ষ চুলের হেলপারের চোখে পিচুটি  জমেছে – বিশ্রী ঘিয়ে রঙের। লেগুনার হেলপার ছেলেটি ঊরু চুলকাতে চুলকাতে যাত্রীদের নামার তাড়া দেয় চাটগেঁয়ে ভাষায়। চাটগাঁয়ের দ্রুতলয়ী ভাষা পুরো বুঝতে অসুবিধা হয়। অন্যদের দেখাদেখি নেমে পড়লাম পাহাড়ের কন্দরে। লম্বা দম নিলাম – আহ, বিশুদ্ধ বাতাস – কী অনাবিল প্রশান্তি!  হিজিবিজি জঙ্গলের বুক চিরে রচিত হয়েছে কাঁকর বিছানো পরিপাটি পথ। দু-ধারে সতেজ কলাবন, বাঁশের ঝাড় বা বুনোলতার প্রতাপ। মরচেধরা লোহার দ্বার ঘেঁষে লতাগুল্মের জঞ্জাল। তোরণের পাশে উঁচু উঁচু বাঁশ মাথা নাড়ছে এদিক-সেদিক – যেন অভ্যাগতদের স্বাগত জানায় লাজুক ঢংয়ে। 

আমিও মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলি। অভ্যর্থনায় দায়িত্বরত রয়েছে সেবকের দল। সুস্মিত তরুণ-তরুণীর  আন্তরিক সহায়তায় নিবন্ধন সারলাম। নিয়মমাফিক সকল ফোন-ইলেকট্রনিক আইটেম জমা রাখতে হলো এখানে। এর মানে – এই কয়দিন নো গেজেট, নো ফোন, আর অবশ্যিকভাবেই নো বাতচিত। জানতে পারলাম, আগতদের জন্য খাবার-দাবার, আলোচনা-শ্রবণ, ধ্যান ও বিশ্রামসহ সবকিছুর শিডিউল ঠিক করা আছে ঘড়ির কাঁটা ধরে। একান্তই কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে সাদা কাগজে লিখে দিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকগণ সহযোগিতা করবে। খানিকটা শঙ্কাও হলো – ঠিক বুঝতে পারছি না, আসলেই কী এই কয়দিন একদম কথা না বলে নিশ্চুপ থাকতে হবে? পুরোপুরি নিঃশব্দ? কীভাবে সম্ভব? বলে রাখি, আমরা এসেছি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের লামা কোয়ান্টামে – মৌনব্রত সাধনায়। ব্যাপারটা এই রকম, এই বিজনের নির্জনে তিন দিন-তিন রাত একদম চুপচাপ থেকে কোনো রকম বাতচিত না করে মৌনতায় মগ্ন হতে হবে। একজন আলোচক কিছু সংক্ষিপ্ত কথা বলবেন মৌনতা-মগ্নতা বিষয়ে। অস্বীকার করব না, কী করে এই কয়দিন বিশুদ্ধ স্তব্ধতায় লীন থাকবো – সেজন্য খানিকটা ভয়বিহ্বলও হয়ে পড়েছিলাম। দ্বিধার ভাব কাটানোর আগেই এক বিনীত কিশোর পথ অনুসরণের ইঙ্গিত দেখিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, আবাসে চলুন।

সকালবেলার হাওয়া বেশ নরম। কোমল বাতাস গায়ে মেখে হাঁটতে বেশ লাগছিল। আবার প্রত্যুষে চোখে-মুখে লাগল কী মিহি জলের ছিটা? বৃষ্টির ক্ষুদে কণা ঝরে পড়ছে ফুলের রেণুর মতো। বৃষ্টিভেজা পথের রং লালচে। পথনির্দেশক পাথরটি রাতের বর্ষণে ভিজে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। ছোট ছোট গাছের ঝোপ পেরিয়ে এগোতেই দেখা মিলল সন্নিহিত অবতল মাঠ – যেন সবুজের সমুদ্র। গাদাগাদি করে জেগে আছে কয়েকটা লম্বা চালাঘর, এদের ছাদে লোহিত প্রলেপ। খেজুর বাগানের পাশের ইটের রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। খানিকটা কী অন্যমনস্কও হয়ে পড়েছি। সুরভিত ভোরে আদিবাসী ছেলেটিকে অনুসরণ করে হাঁটি জোরসে কদমে। তার চোখের দৃষ্টি ম্রিয়মাণ কিন্তু  মুখের হাসি ঝলমলে। এক ফাঁকে অসহায়ের মতো পেছনে তাকিয়ে দেখি, অরণ্যের ফাঁকে সূর্যদেবও হাসছেন আপনমনে, হয়তো আমার আসন্ন দুরবস্থার কথা ভেবে। ভিজে ভিজে নরম আলো গলে গলে পড়ছে পাহাড়ের সানুদেশে।

এদিকটা খানিকটা চড়াই-উতরাই। পথের পাশে গজিয়ে গেছে কত কিসিমের লতাগুল্ম। টকটকে মাকালে ঠোকর দিচ্ছে ছোঁচা পক্ষী। উজ্জ্বল লালচে ফলের আবরণ দেখতে অপরূপ, কিন্তু ভেতরটা কালচে – খেতে  নাকি ভয়ানক তিতা। স্কুলের পণ্ডিত মশাই ফিটফাট আমাদের গাল পাড়তেন এভাবে, দূর হ, মাকাল ফল। তেলকুচার লতা নিবিড় হয়ে এগিয়ে গেছে জংলার দিকে। তেঁতুলের ছায়া বেশ ঘন হয়ে এসেছে এদিকটায়। পণ্ডিত স্যারের কাছেই শিশুকালে শুনেছি, তেঁতুলের ছায়া মাড়ালেও নাকি বুদ্ধি কমে। মহাকবি কালিদাস ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। তাঁর উচ্চ মার্গের কাব্য বুঝতে সাধারণ মানুষজনের বেশ মুশকিল হতো। সেজন্য নাকি কবিবর তাঁর জটিল ভাবনাকে সহজে প্রকাশ করার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে তেঁতুল বনে চালা বেঁধে জিরিয়ে আসতেন! পরে বড় হয়ে পড়েছি – তেঁতুলের বিচির গুঁড়ো জলে গুলিয়ে খেলে নাকি যৌন উদ্দীপনা বাড়ে! এই আয়ুর্বেদিক ভোজবাজির তথ্য আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। অবশ্য, অস্থির মানবমন নাকি আবোলতাবোল বিষয়েই ভাবে বেশি। বসে থাকা নির্ভার পাখিটি বসেছিল নিমগাছে। খেয়ালি পাখি আচমকা পুরীষ ত্যাগ করে উড়াল দিলো সামনের দিকে। এদিকে বাহারি ফার্ন বন আর মুসেন্দা ঝাড়। অনেক বছর পর সুনিবিড় ঢেঁকিশাক দেখলাম এই পাহাড়ি পথে। কত কিসিমের যে বাঁশগাছ রয়েছে এই তপোবনে।  আকার, প্রকার বা রঙে-ঢঙে সব প্রজাতি অনন্য। শিরোশিমা নামে বেঁটে গোছের বাঁশঝাড় দেখে মনে হলো, এটি সৌন্দর্যে যে-কোনো অপরূপ গুল্ম বা বর্ণিল পাতাবাহারকে হার মানাবে। সদ্য উত্থিত মেরুন মুকুটময় কচি বাঁশ দেখতে বেশ আদুরে। শুনেছি, পাহাড়িরা বনমোরগ আর বাঁশকোড়ল বা ব্যাম্বু শুট খায় – ঝাল ঝাল করে রেঁধে। এক প্রান্তে চিরল চিরল পাতার শিরীষ গাছ। বেশুমার বেতলতা আর কাঁটার রাজত্ব সীমান্তের ঝোপে। এই তো সফেদ কাণ্ডের বাঁকে বাঁকে ঝুলে আছে থোকা থোকা বেতফল। দেখতে অনেকটা টিকটিকির ডিমের মতো। মনে পড়ে, কিশোরবেলায় কাঁটার উৎপাত এড়িয়ে এই অমৃত ফল পাড়তে বেশ মুশকিল হতো। আমরা গেঁয়োভাষায় বলতাম বেথুন।  কষযুক্ত এই বিরল ফল খেতে হতো টুকটুকে খোসা ছড়িয়ে, লবণ-মরিচ মেখে। কী আশ্চর্য, এত বছর পর এই বয়সেও অজানিতেই জিবে জল চলে এলো। কী আর করা, সন্তর্পণে ঢোক গিললাম।

পথের পাশে নীরবে বইছে সরু ঝিরি। খানাখন্দেও কিছুটা জল জমেছে – সেখানে সুখের বসতি গড়েছে রক্তখেকো মশা  বা ক্ষুদে জলপোকা। একপাশের জলকাদায় বেড়ে উঠেছে অফুরান কচুরিপানা। ফুল ফুটেছে সবুজ পানায় – সফেদ-নীলাভ পাপড়িতে ফিকে হলুদ ছোপ আর মাঝে চোখের মতো একটুখানি কালচে ফোঁটা। জলের দিকে ঝুঁকে আছে জবুথবু বৃক্ষ, হয়তো আত্মমগ্ন গাছটির সব সময় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে ইচ্ছে করে। বুড়ো গাছটির যেন বয়সের গাছপাথর নেই, তবু এটি কামার্ত ওষ্ঠের মতো রাশি রাশি ঝুরি বাড়িয়ে দিয়েছে জলের বুকে। ফণা উঁচু করে জল পার হচ্ছে কুচকুচে সাপ। মাছের পোনা চরে বেড়ায় এই জলাশয়ে – মা-মৎস্য ঘাই দিলো ঘাপুত করে। কিনারায় সবুজ জলাবন আর প্রাণময় হোগলার বিস্তার। হঠাৎ করেই লেজ খসে পড়ল আদুরে ব্যাঙাচির। বিস্তৃত পাতার কচুগাছ, আগাছা, কলমি আর জলবিছুটি বেড়ে উঠেছে স্যাঁতসেঁতে পাড়ে। জলমগ্ন কচুবনে বাঁকানো ছোরার মতো তুলতুলে ফুল ফুটেছে – গাঢ় হলুদ। সোনালি রোদ ঝরে পড়ছে তেরছা হয়ে। ওপর থেকে বাসি কদম ঝরে পড়ল থকথকে কাদায়। ভেজা মাটিতে আগে থেকেই গেঁথে রয়েছে জীর্ণ পাতা, সাপের খোলস, ভাঙা পাতিল, পাখির হাড় ও ঝরা পালক। বাদাবনে টুকটুকে পায়ে টহল দেয় বিষণ্ন ডাহুক। জলমোরগের সাড়া পেয়ে জলজ তৃণে লাফিয়ে উঠেছে ঘাসফড়িং। একপাশে নিরন্তর রমণে ব্যস্ত রিরংসু চড়ুই। এক রত্তি পাখি, তবু একটুও যেন ক্লান্তি নেই – কী যে বেহায়া দম্পতি। সাধু বক বসে আছে কলমির আগায়। দুর্গন্ধের মতো কিছু যেন নাকে লাগল। মোড় ঘুরতেই দেখি গাছের শিকড়, ডালপালা আর পত্রপুষ্পে পাখির মলের প্রলেপ জমেছে। না, এবার পিছু হটি। বাতাসে উড়ে উড়ে যায় একটা-দুটো পাখির পালক।

এই সকালটা এখনো পাখির পালকের মতো মায়াময় ও স্নিগ্ধ। বেলা বাড়ছে ধীরলয়ে। বনপাহাড়ের গায়ে সিঁথির মতো নিটোল পথ। সর্পিল রাস্তা এগিয়ে গেছে পাহাড়ের শিরে। দুপাশে রয়েছে পরিকল্পিত  বাগান – ফুলের বা ফলের। বাতাসের ঝাপটায় ফুল পড়ে, পাতা ঝরে।  মায়াবী ঢঙে উড়ে বেড়ায় বিভিন্ন পাখির ঝাঁক। স্থানীয় বাসিন্দা বলে এসব মুক্তবিহঙ্গের যেন ডর-ভয় কম। সকালবেলাতেই পাখিরা মুখর হয়েছে মধুর তানে। দূরে কোথাও বায়স ডাকল কর্কশ স্বরে – কা, কা। বেশ হাহাকার জাগানিয়া এই ডাক। দূরাগত বাতাসের কান্না শুনি।  বিষণ্ন মেঘের নিচে বায়সকুল উড়ে চলে টুকরো টুকরো ছায়ার মতো। আকাশচারী পাখিরা ঠিক কুচকুচে কালো নয়, এদের মিহি পালকের রং কিছুটা ছাইচাপা। আমার দাদিজান বলতেন, এই দাঁড়কাক অনেক কিছুই আগেভাগে টের পায় – বিশেষত এই অতীন্দ্রিয় বিহঙ্গ নাকি বিপদের আভাস পেয়ে যায় সবার আগে। কী জানি! দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিই। কড়ইপাতা ঝরছে বাতাসের ঝাপটায়। কত কিসিমের যে বুনো ফুল ফুটে আছে বা ফুটি ফুটি করছে এই অরণ্যে। নাসারন্ধ্রে লাগল বিশ্রী গন্ধ। চেনা চেনা মনে হয়। হ্যাঁ, ওই যে, কুলগাছের সারা গায়ে ফুল ফুটে আছে ঝলমলে নাকফুলের মতো। নিচের নালায় জলকণার স্ফুরণ – ঠিক যেন ছোট ছোট হীরক চূর্ণ! জলের দিকে একটা বয়সী গাছ ঝুঁকে আছে বিমুগ্ধ প্রেমিকের মতো। এই বৃক্ষের কাণ্ড নিকষ কালো আর পাতা দেখতে অবিকল ঠোঙার মতো। পাতাবহুল ডালে এসে বসল কয়েকটা ময়নাপাখি। কেন যেন প্রশ্ন জাগল মনে – এই জায়গায় কী আগেও এসেছি। চিনলাম, এটি কৃষ্ণবট বৃক্ষ। আমাদের পাতকুয়োর পাড়ে ছিল একটা উবু গাছ। আমার দাদিজান বলতেন, কৃষ্ণঠাকুর এই গাছের পাতায় ননি লুকিয়ে রাখার উছিলায় রাধা ও সখিগণের সঙ্গে নানারকম রঙ্গ করতেন। কী রঙ্গ করতেন – এই প্রশ্নে কথক দাদি মিটিমিটি হাসতেন। শৈশবে ঠিক বুঝতাম না, কে এই বংশীবাদক কেষ্ট ঠাকুর বা দুঃখিনী রাধা, তবে শুনতে বেশ  লাগত। পরে বড় হয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়ে  ভেবেছি – তখন কী সহজ স্বাভাবিক নির্ভার প্রেমময় জীবন ছিল মানুষের। লিকলিকে শেকড়ের ঝিরিবট বা তমাল তরুও দেখলাম। মনে পড়ে, শিশুকালে বটবৃক্ষ আর পাকুড় গাছকেও গুলিয়ে ফেলতাম। তেড়াবেড়া গাছ থেকে টুপটুপ করে পাকা বট ঝরে পড়ছে জলের বুকে, ভেজা মৃত্তিকায় বা সাঁকোর পিঠে। এদিকে পাখির কিচিরমিচিরে কানপাতা দায়। ভালো করে নিরিখ করে দেখি, লোভী পাখিদের হল্লামুখর ঝগড়া বেঁধেছে কাঁচা-পাকা বট নিয়ে। মনে মনে ভাবি, এখানে তো খাবারের অভাব নেই, উৎপীড়নকারী নেই, তবু কেন এই চেঁচামেচি বিহঙ্গকুলের?

এদিককার মাটি চিরায়ত নিথর। রং পাংশুটে হলুদ বা লালচে। সতেজ তৃণ বড় হয়েছে মানুষের বুক অবধি। ঠিক নাম জানি না, একটা মহীরুহ যেন আকাশচুম্বী। এটিই কী বৈলাম বৃক্ষ? কৃষ্ণচূড়ার বন পেরিয়ে জংলি শিমুলগাছ, এর গায়ে বড়  বড় কাঁটা। অদূরে খেজুরগাছের সারি। এদের আগায় আগায় বাবুই পাখির বাসা। ঝুলে রয়েছে চটের থলের মতো নরম নীড় – কী অপরূপ শিল্পিত আবাস – বাতাস এসে দোলা দেয় পাখির ঘরে। এই পাখি এত শিল্পসম্মত আবাস গড়ে কী করে? হঠাৎ করেই বাবুই দম্পতি বের হলো ডানা মেলে। পাখির ছানারা চিঁহি চিঁহি করে বাবা-মাকে বিদায় জানায়। একটু পরেই পক্ষীমাতা ফিরে আসে মুখে খাবার নিয়ে। নীরবতার দেয়ালে নিজেকে বন্দি করে হাঁটছি এই পাহাড়ি বনে। উঁচু পাহাড় থেকে অবিরল জল পড়ছে উপলময় সর্পিল খাদে। প্রাকৃতিক জলের প্রবাহে কী অপরূপ পাহাড়ি ঝিরির সৃষ্টি হয়েছে এদিকে। চারপাশে হালকা বন। রক্তজবা ভেসে যাচ্ছে ক্ষীণতোয়া ধারায়। ঝুপ করে একটা কালো কচ্ছপ পানিতে নেমে ডুব দিলো, আর ওঠার নামগন্ধ নেই। কিছু শালিক এসে জড়ো হয়েছে জলের ধারে। কী জানি, ধূসর পাখিদের হয়তো তেষ্টা পেয়েছে। ওপরে চক্রাকারে ঘুরছে চার-পাঁচটি পাখি। সম্ভবত শঙ্খচিল। সোনালি ডানা ঝাপটে এরা বিকট চিৎকার করে মগডালে বসল। আশেপাশের ভয়ার্ত পাখিরা পড়িমরি করে পালিয়ে গেল। এই সুউচ্চ তালবীথির পাশেই স্বচ্ছ জলের কুণ্ড। এই নির্মল নির্ঝরিণীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। ফটিক জলে ভেসে বেড়ায় বেকুব পুঁটি। কোত্থেকে যে মাছরাঙা উড়ে এসে ঝুপ করে নামল নিথর জলে। এর নিশানা অব্যর্থ – লম্বা ঠোঁটে আটকে গেছে রুপালি মাছ। জলজ স্পাইডার ফুটে আছে পানির ওপর। সরোবরে মেঘের ছায়া পড়েছে। ওপরের আকাশটা কী ক্রমশ ধূসর হয়ে উঠেছে। বনের পাখিরা ডেকে উঠল কামাতুর স্বরে। নাকে লাগল তৃণময় ঘ্রাণ। বাতাসেও যেন অতীন্দ্রিয় সুরে আলাপ চলছে। বাতাসে ভর করে মেঘেরা সব কেটে গেল। পাহাড়ের আগায় জ্বলজ্বল করছে রোদের ঝিলিক। শৈলপাদমূলে ফুলের কুঞ্জ, চারাগাছের সারি। কারা যেন ঠেস দেওয়া কঞ্চিতে মাটির কলসি বেঁধে রেখেছে – হয়তো কুসংস্কার। ছোট ছোট টিলার গায়ে, কণ্টকময় জঙ্গল, লতাগুল্ম আর বিভিন্ন আকার-প্রকারের গাছপালা। পথের পাশে সতেজ আকন্দবন। এর ভারী পাতায় ছোপ ছোপ আস্তরণ – কে যেন চালের গুঁড়ো মেখে দিয়েছে! ঘাড় ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে কৌণিক দৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকাই। আহ, নীলকান্তমণির মতো উজ্জ্বল নভোমণ্ডল – ওপারের উত্তুঙ্গ পাহাড়চূড়াকে বেশ নিঃসঙ্গ দেখায়। উচ্ছল পাহাড় বুঝি লটকে আছে নীলাভ আকাশের  বুকে!

এদিকে পাহাড়ি অরণ্য বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। কিছু মনুষ্যসৃষ্ট স্থাপনাও চোখে পড়ে – দুয়েকটা ছোট-বড় ঘর। অনেক দূরে একটা ভগ্ন মন্দির – মিনিয়েচারের মতো লাগে। সামনে এগোই। টকটকে টিনের চালে টুকটুক পায়ে হেঁটে বেড়ায় মুক্ত কপোত। দেখতে অনেকটা জালালি কবুতরের মতো, তবে আকারে বড়সড়। আমি শিশুকালে শুনেছি, ইয়েমেনবাসী এক সাধক পুরুষ বাংলায় পৌঁছার পথে দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। দিল্লিবাসী নিজাম খুশি হয়ে ইয়েমেনি ঋষিকে কয়েক জোড়া কবুতর উপহার দেন। এই সুফি মানুষটি পরে সিলেটে এসে সাধন-ভজন-ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নাম হজরত শাহজালাল। পরবর্তীকালে এই নীল-সাদা পারাবত ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববাংলার আনাচে-কানাচে। রাজকীয় ভঙ্গির এই কবুতর এখনো বাসা বাঁধে পুরনো দালানে, গাছের কোটরে। এখনো সাধারণ মানুষজন এই জালালি কবুতরকে ভালোবাসে, এদের উৎপাত-গঞ্জনা নীরবে সহ্য করে। কী জানি, এই কবুতরের কাহিনি হয়তো ভালোবাসামাখা জনশ্রুতি, হয়তো নয়। কবুল করতে দ্বিধা নেই, ঋষি নিজামের এই ঐশী উপহারের শ্বাশত কাহিনি শুনতে আমার এখনো বেশ  লাগে। জংলি কবুতরের দল নিজেদের ঝগড়া থামিয়ে ঘাসের দানা খেয়ে বাংলোর চালে হাজির হয়। এরা দলবেঁধে লাল পায়ে হাঁটে।  টিনের চালে এদের হণ্টনজাত মিষ্টি ঝঙ্কার আর আনন্দময় বাকবাকুমের যুগলবন্দি বাজে। বাতাসের সুর এসে বাড়ি খায় ঘরের চালে – গরগর, গরগর শব্দতরঙ্গ বাজে। এই ব্যতিক্রমী আওয়াজ বাদে চারদিক এমনিতে ঝিম মেরে আছে। রোদ বাড়ছে চিড়চিড় করে। আচমকাই গাছের আড়াল থেকে তক্ষক ডাকল বিশ্রীস্বরে। মেঘের গুড়গুড় অনুনাদে অরণ্যের স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। উঁচু বৃক্ষ থেকে টুপ করে ভূপাতিত হয় বহেড়া ফল। সাদাকালো দোয়েল ঝিমিয়ে পড়েছে পাতার ফাঁকে। বাঁশির সুরের মতো কলতান বাজে, বাতাস লেগে কলাপাতায় পতপত শব্দ হয়। অদূরের বনে অহি-নকুলে যুদ্ধ লেগেছে। হিসহিস শব্দ শোনা যায়। হঠাৎ করেই বৃষ্টি এলো – পাহাড়ি মেঘবৃষ্টির মেজাজমর্জির ঠিক-ঠিকানা নেই। বৃষ্টির তোড়জোড় শুরু হলো হুড়মুড়িয়ে। সঙ্গে বজ্রনিনাদ। টানা দশ-পনেরো মিনিট চলল বৃষ্টির তাণ্ডব। আমি একটা চালার নিচে মাথা বাঁচিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রই – আহা, এই তো দুনিয়ার স্বর্গ! আমার সময় একদম স্থির হয়ে আসে।

এখন ঠিক জারুল ফুলের সময় নয়, তবু  গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল বৃষ্টিধোয়া মঞ্জুরি নিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে রাজকীয় ঢঙে। গাঢ় বেগুনি রঙের জারুল পুষ্পের অভিজাত ভঙ্গি। সেজন্যই এর ইংরেজি নাম কুইন্স ফ্লাওয়ার। বকের ডানার মতো সফেদ রঙের ফুল ফুটেছে জংলার দিকে – বেশ বড়সড় আকার। নরম বাতাসের ছোঁয়ায় এরা যেন কুঁকড়ে উঠল। বেঢপ গাছের গুঁড়িতে ব্যাঙের ছাতা জন্মেছে – রং শঙ্খশুভ্র। আমার জুতোর নিচে লেগে লজ্জাবতীর ঝাঁক বেশ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জাবতীর ঝাড়,  ফুল আর কাঁটা এড়িয়ে সামনের দিকে লম্ফ দিলাম। এবার পায়ের নিচে মচমচ করে বাজল বাঁশের খোল। এই বাঁশবনে ঘুঘু ডাকে আপনমনে। কিছু অচেনা গাছ বেশ বুড়িয়ে গেছে – এদের বয়সের যেন গাছপাথর নেই। এদের কালচে শিকড়ে মস গজিয়েছে, হালকা সবুজ বরণ। ঘনঝোপের গায়ে জমেছে ম্রিয়মাণ পাপড়ি, বাসি পাতা। লতানো পরজীবী ও  বর্ণিল অর্কিডের সমারোহ গাছে গাছে। লতাপাতা পচে এদিকে একাকার। কাঠের বেঞ্চিতেও জমেছে পাতার স্তূপ। পাতার জালিতে আটকা পড়েছে দুষ্ট মশা। পানের লতা বেড়ে উঠেছে লকলক করে।

কিছুটা পথ ঘুরে পার হলাম অশোক বন। নির্বাক আমি বন্ধুর পথ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবি, আসলে আমাদের এত বাচালতার প্রয়োজন কী? আমাদের আদিপুরুষগণ তো ছিলেন অরণ্যচারী গুহাবাসী। হয়তো তারা নিশ্চুপ থাকতেন বা ভাব প্রকাশ করতেন অস্ফুট শব্দে, আকার-ইঙ্গিতে। কালের পরিক্রমায় আমরা সারাক্ষণ কথা বলি, হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। কেউবা জন্মগতভাবে বাচালতার জিন নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মানব শিশুর ভাষা শিখতে লাগে দুই বছর। মানুষ একবার কথা বলা শুরু করলে আর থামতে শেখে না। কেউ অকারণ বকবক করে নিজেকে জাহির করতে। কেউবা কথায় তুবড়ি ছোটায় নিজের হীনমন্যতা ঢাকতে। স্মার্ট ফোনের কল্যাণে দূরালাপনির কথা হয়ে গেছে সহজলভ্য। ইউটিউবে বা টিকটকের বাচালতায় অনেকে আক্রান্ত। এখন আমি ইট-কাঠের শহরের বাসিন্দা। গ্রামে যাই কালেভদ্রে। সেখানেও  তো নগরের ছোঁয়া লেগেছে। গরম গুল্মের সবুজ মাঠে বসে মুক্ত বাতাসে নিশ^াস নেওয়ার সুযোগ কোথায়?

নগরে-বন্দরে-গাঁয়ে-গঞ্জে সবাই ইঁদুর-দৌড়ে ব্যস্ত, সকাল-দুপুর-রাত। ব্যস্ত আদমের নিজের দিকে তাকানোর ফুসরত কই? চারধারে খাই, খাই, নাই নাই। অধিকাংশই অস্থির কোলাহলে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি কপট ভোগবাদে – পণ্যদাসত্বে। ফলাফল অস্থিরতা, লক্ষ্যহীনতা, অবসাদ, উদ্যমহীনতা, হইচই, ক্ষোভ, দুঃখ আর হতাশা। আমাদের ঘরে-বাইরে সর্বত্রই  হইচই-চেঁচামেচি যেন স্বাভাবিক বিষয়। ইচ্ছে না থাকলেও খিস্তি-খেউর শোনা যায় অহরহ। অনেকেই সাহেব বনে গিয়েছি – গৃহসহায়কের সঙ্গে আচরণে বোঝা যায় আমরা ডিগ্রিপ্রাপ্ত মানুষজনও সাম্য, একতা ও মানবিক মূল্যবোধের কতটুকু অনুসারী। শহুরে মানুষজন থাকি আবদ্ধ ঘরে, পথ হাঁটি জুতোপায়ে পাকা রাস্তায়। সূর্যের দেখা মেলে না, মাটি ছোঁয়ার সুযোগ হয় না। মুক্ত বাতাসে চাঁদের আলোয় হাঁটার কথা বিস্মৃত হয়েছি কত আগেই। আমরা অনেকেই তো রাতজাগা পাখি – বিলম্বিত ডিনার খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে উত্তেজক টক শো দেখে আমাদের রাতগুলি হয়ে যায় আইবুড়ো। শয্যায় যেতেই হয়তো মাঝরাত পেরিয়ে যায়। আমাদের অনেকের তো নিত্যসঙ্গী অঘুমের ব্যামো। তবু এখনো ভোর আসে অগোচরে, চিরায়ত স্নিগ্ধরূপে – পাখির ডাকে, অপার্থিব আজানে। ভোরের মাহেন্দ্রক্ষণে অনেকেই হয়তো ঘুমিয়ে রই বেকুবের মতো। শারীরিক কসরত, দৌড়-ঝাঁপ দূরের কথা, নিয়মিত ভোরের আলো গায়ে মাখার সুযোগও কী আমাদের হয়?

অতৃপ্তি নিয়ে অনেক বেলা করে হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠতে হয় হয়তো অনিচ্ছায়, অরুচির নাশতা সেরে অফিসেও ছুটতে হয় অস্থির হয়ে। গাড়িঘোড়ার অকারণ হাঁকডাক, ধাবমান মানুষের শোরগোল, ট্রাফিক জট, হকারের উৎপাতের বিড়ম্বনায় পিষ্ট হয়ে অফিস-আদালতে পৌঁছতে পৌঁছতে মেজাজ হয় তিরিক্ষি। সেখানে কাজে-বেকাজে সময় কাটে, চলে দলাদলি, মোসাহেবি, তদবির বা পরচর্চা। নিরানন্দ কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাঁঝ গড়িয়ে যায়। একটু ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে একটু বিশ্রাম বা মোবাইল ফোন স্ক্রল করতে করতে মেজাজ যায় বিগড়ে।  ফলে প্রাত্যহিক আহার-বিহার- কাজকর্ম-বিনোদন হয়ে পড়ে একঘেয়ে ক্লান্তিকর বিড়ম্বনা।

স্মর্তব্য, নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, মন্দ কাজ ও বোকা বা দুষ্ট লোক থেকে দূরে থাকা। সুবর্ণ সুযোগ আসে নিজের দিকে তাকানোর। নিজের বোকামি, মূর্খতা, ছেলেমি, পাপতাপের দিকে নিরপেক্ষভাবে তাকানোর সুযোগ হয়। নির্জনে একাকী বসলে আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা ভালো হয় – হয় নগ্ন-আত্ম-উপলব্ধি। পাপতাপ, দুঃখ, হতাশাকে বিনাশ করে ওই দেহমনের কর্মকাঠামোকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার উপলব্ধি হয়। খুব সহজেই কাউকে ক্ষমাও করা যায়। নিজেকে মহাবিশে^র অংশ হয়, দুঃখকে আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা ও সৃজনশীল কাজের অনুপ্রেরণা হয়। সবচেয়ে বড় অনুধাবন হয় – যে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, অধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাকে মৃত মনে করে শুভকামনা করতে পারি – প্রতিজ্ঞা করতে পারি, আমি কখনো তার মতো প্রতারণা করব না, তার মতো হবো না। নিশ্চুপ থাকলে জিহ্বা দ্বারা কারো সমালোচনা করার সুযোগ নেই। কারো অর্থহীন বয়ানও শুনতে হয় না। বিজনে সুবর্ণ সুযোগ আসে নিজেকে দুর্ভেদ্য, সুরক্ষিত ও সৃজনশীল করার মোক্ষম অলৌকিক প্রশিক্ষণে। নৈঃশব্দ্যের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তা আমাদের অনভ্যস্ত কানে প্রথমে ধরা পড়ে না, কোলাহলমুখর পরিবেশে আমাদের অনেক অনুভূতিকে মৃতপ্রায় করে রাখে। এই বিজনে নিশ্বাস-প্রশ্বাস যেন কিছুটা ধীর ও প্রশান্ত হয়ে উঠেছে। মাটির ভাষা, গাছের ভাষা, পতঙ্গের কান্নার কী কোনো অর্থ আছে? মৌমাছির গুঞ্জন আর কাকের কর্কশ কান্নায় পার্থক্য কী? আকাশের দিকে তাকাই, কী মহান চিত্রকর কত সব রঙের খেলায় মগ্ন। মেঘনাদ যে কত রকমের হয়। আমাদের শরীরের ভেতরে এত সচল নাড়ি-রস-অঙ্গ – এদের কী নিজস্ব ভাষা বা সংকেত আছে? স্নায়ু, মেরুদণ্ড, মস্তক বা হাড়ের নিগূঢ় ভাষা কী? চাঁদ, সূর্য বা মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের যে নিয়ত সংযোগ – এসব তো প্রাকৃতিক ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে নিঃশব্দ যোগাযোগ। নিরীক্ষণ করলে আঁচ করা যায় কী অপরূপ বৈচিত্র্য লুকিয়ে রয়েছে এই তুচ্ছ নুড়ি, ভেজা মাটি, শুকনো পাতা, ফুলের পরাগ, ঝরা পালক, পরিত্যক্ত হাড়, জমে থাকা বৃষ্টির পানি, মেঘের সঞ্চরণ, গাছের শিকড়, হেলে পড়া এপিটাফ, বাতাসের ছোঁয়া, নেড়ি কুত্তা, মুক্ত খেচর, চঞ্চল ঝিরি, মায়াবী লতাগুল্ম বা দীঘল  মহীরুহে।  অক্সিজেন নিঃসরণ করলে আমরা নাক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রহণ করি, কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করি – প্রতি মুহূর্তের এই যে গাছ আর আমাদের মিথস্ক্রিয়া – এসব তাত্ত্বিকভাবে জানতাম।  তবে সচেতনভাবে অনুধাবনের চেষ্টা চলল এই মৌনতার ভুবনে। 

এবার মৌনতার অভিযাত্রার আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামের একটু খবর জানিয়ে দিই। আমাদের ক্লাস শুরু হতো সকাল সাড়ে ৯টায় – রিসোর্স পারসন অবসরজীবী অধ্যাপক। তিনি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন মৌনতার প্রশান্তি নিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি অমৃত বচন। তবে তা অল্প সময়ের জন্যই। আত্মনিমগ্ন হই – একের পর এক চলে গাইডেড মেডিটেশন। ঘন সবুজ পত্রকুঞ্জের আড়াল থেকে একটা পাখি একটানা ডেকে যাচ্ছিল। বটবীথির নিচে একটা উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। উচ্ছল মানুষটি হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানিয়ে আপনমনে তাকিয়েছিলেন দিগন্ত বা আসমানের দিকে। আত্মমগ্ন মানুষটি কী আনমনে দৈববাণী উচ্চারণ করছেন, নাকি আঙুলে গুনছেন জপমালা? বাতাসের ঢেউ এসে লাগে তাঁর চোখে-মুখে। সস্নেহ কথা বলেন গভীর স্বরে – গম গম শব্দ হয়। আগত অতিথিরা ধ্যানের বলয়ে প্রবেশ করেন। বেকুবের মতো একবার  চোখ মেলে দেখেছিলাম, মেঘেরাও ভেসে আসছে আকুল হয়ে। কী আনন্দ, এই বুঝি স্থির পাহাড়ও হয়ে উঠবে অস্থির জঙ্গম! ঘোষকের দরাজকণ্ঠ, মেঘনাদ, বৃষ্টির গান, ঝর্নার বয়ে চলা, বাতাসের ঝাপটা বা কাতর পাখির কান্না ছাপিয়ে ভেজা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। আমি যেন হারিয়ে যাই অন্য ভুবনে। খানিকক্ষণ আলোচনা শেষে আবার মগ্ন হই আত্মপর্যালোচনায়। নিমগ্ন হই ধ্যানের পর ধ্যানে। দুপুরে পৌনে এক ঘণ্টার বিরতি। ঠিক দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে আবার অপরাহ্ণের ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হয় ৪টা ৩০ মিনিটে। তখন শুরু হয় দীর্ঘ বিরতি – ফ্রেশ হওয়া, আহার, বিশ্রাম ও প্রার্থনার জন্য। শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে দেখি, ঘন ঝোপের দিকে দিনের বেলাতেও সবুজাভ অন্ধকার জমে আছে। বিস্তৃত আকাশের নিচে রাংচিতা ও বনচালতার ঝাড়। ওপাশে ইস্পাতের ফলার মতো পাহাড়ি জলধারা। একটা নিঃস্ব কাঁঠালগাছ যেন মুখভার করে আছে। মশহুর পরিব্রাজক  হিউয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে বগুড়ায় কাঁঠাল দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। হে বাংলার অতি প্রাচীন খানদানি গাছ – এই বাঙালির অভিবাদন গ্রহণ করো। আচমকাই নাসারন্ধ্রে লাগল মসলার ঘ্রাণ। এলাচবন, বনতুলসী ও মৌরীর জঙ্গলে এদিকটা ছেয়ে আছে। অপরাহ্ণের সোনালি আভায় শৈলশীর রাঙা হয়ে উঠেছে। আমি নতমুখ হয়ে তাকাই পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানে আলো-ছায়ার যুদ্ধ লেগেছে। কেমন যেন শূন্যতা বোধ করি। সমস্ত পাহাড়ি অরণ্যে নীরব রক্তগঙ্গা বইয়ে সূর্যদেব বিদায় নিলেন আজকের মতো। পাখিদের কিচিরমিচির-কোলাহলও একসময় থামল। একটানা বসে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ঝিম ধরে এলো। মৌন থাকলে চিন্তার গতি স্থির হয়ে যায়। ভাবনার গতি স্থির হলে সময় স্থির হয়ে যায়। একদম মৌন হলে জবান বন্ধ হয়, কিন্তু শুরু হলো মনে মনে কথা। কত

উদ্ভট-বিশ্রী-আনন্দময় ভাবনা এসে জড়ো হলো মনে।

বাঁদর-মনের এই এক সমস্যা – হয় অতীতের অনুশোচনা বা ভবিষ্যতের আশংকা। চাইছি মনকে একদম শূন্য করতে, কিন্তু আমি অপারগ। খানিকটা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। একবার জাপানে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম এক অদ্ভুত উপাসনালয় দেখতে। অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে বুদ্ধদেবের নামে একটা প্রার্থনাঘর আছে যা সম্পূর্ণ খালি। প্যাগোডার বহির্ভাগের মরচেপড়া পাতের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ। এই ধর্মশালার ভেতরে-বাইরে একটা বুদ্ধের মূর্তিও নেই। কিন্তু এটা বুদ্ধকে উৎসর্গকৃত কিয়াং হিসেবে পরিচিত। তেমন কোনো লোকজন দেখিনি সেখানে। আগত কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে জবাবও পাই না। মুণ্ডিত মস্তকের পুরোহিত ছিলেন মৌনব্রতে। আগত জাপানিরাও হয়তো চরম স্বল্পবাক বা ইংরেজিবিদ্বেষী। এই নৈঃশব্দের ভুবনে গিয়ে খানিকটা বোকা বনে গিয়েছিলাম বইকি। টোকিও জাইকা অফিসের প্রাজ্ঞ প্রশিক্ষক শুনিয়েছিলেন নিগূঢ় খবর। এই নীরব মন্দিরে এসে ভক্ত-দর্শনার্থীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে নাকি প্রশ্ন করেন, বুদ্ধ কোথায়? তাঁর নামেই তো এই পীঠস্থান? তখন মন্দিরের পুরোহিত মুচকি হেসে ঠোঁটে তর্জনী এঁটে নীরবতার ইঙ্গিত করে ফিসফিস করে বলেন, চুপ, চুপ। দিনের শেষে মৌনতা ভেঙে ধর্মবেত্তা  জানিয়ে দেন, এই শূন্যস্থান, এই নীরবতা … এই হলেন বুদ্ধ। পাথরের ভাস্কর্য মহামতির অবয়ব তুলে ধরতে পারে না, নিরেট পাথর তাঁকে ঠিক প্রকাশ করতে পারে না। বুদ্ধ প্রস্তরখণ্ড নন, নন কোনো খোদিত মূর্তি। বুদ্ধ একটা রূপ নন, বুদ্ধ মানে নিস্তব্ধতার সুরভি। প্রজ্ঞার সূত্রপাত হয় বিশুদ্ধ মৌনতায়।