কবি-জায়া প্রমীলার কাব্যচর্চা

কবি গৃহিণীদের কাব্যচর্চার উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে কম। সামান্য যে-কয়টি উদাহরণ আমাদের নজরে পড়ে সাহিত্য বা কাব্যের ইতিহাসে সেগুলি যে প্রাপ্য স্থান বা মর্যাদা পেয়েছে সে-কথা বলাও খুব মুশকিল। তবু সাধারণত যে নামগুলি সাধারণভাবে মনে পড়ে তার মধ্যে অবশ্যই আছেন নরেন্দ্র দেব-রাধারাণী, বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসু প্রমুখ কয়েকজন। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে, একালে কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ও বিজয়া মুখোপাধ্যায়ই সাম্প্রতিককালে এই পর্যায়ের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে হয়েও কবিতা নির্মাণে আজো সক্রিয়।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের কথা। নজরুলপত্নী প্রমীলাও কবিতাচর্চা করতেন। তাঁর কবিতা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতো। সকলেই জানেন প্রমীলার ডাকনাম ছিল দুলি বা দোলেনা। বিয়ের আগে দুলির ভালো নাম ছিল আশালতা। বিয়ের পর কবি তাঁর নাম রাখেন আশালতার বদলে প্রমীলা।

একদা সেনগুপ্ত পরিবারে নজরুলের উপস্থিতি ছিল নিতান্তই আকস্মিক একটি ঘটনা। ১৯২১ সালের ৪ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবার কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় সেনগুপ্ত পরিবারে গিয়ে হঠাৎ হাজির হয়েছিলেন। তিনি সেবার ছিলেন দৌলতপুর নিবাসী নবলব্ধ সঙ্গী আলী আকবর খানের সঙ্গে সফররত অতিথি। তাই দিনকয়েক পরেই তিনি দৌলতপুরে রওনা হন। সেখানে তিনি এরপর মোট ৭১ দিন একটানা কাটান। অর্থাৎ প্রায় মাসদুয়েক কালেরও বেশি। কিন্তু প্রথমবারই কবির সঙ্গে পরিচয় ঘটে কান্দিরপাড় সেনগুপ্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য বসন্তকুমার সেনগুপ্তের কন্যা কিশোরী আশালতার (জন্ম : ১০ মে ১৯০৮) সঙ্গে। জননী গিরিবালা দেবী ছিলেন বসন্তকুমারের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী অকালে প্রয়াত হন। গিরিবালাকে তারপর বসন্তকুমার বিবাহ করেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র বছরদেড়েক পরে বসন্তকুমারও প্রয়াত হয়েছিলেন। নজরুলের সঙ্গে যখন আশালতার পরিচয় ঘটে, তখন তার বয়স মাত্র বছর তেরো-চোদ্দো।

আমায় মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছিলেন যে, দুুলিকে ওই বয়সেই যুবতী মেয়ের মতো লাগত। তার দেহের গড়ন ছিল বড়োসড়ো। যৌবনের লক্ষণ তার দেহাবয়বে তখনই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মাসদুই পরে ১৮ জুন ১৯২১ দৌলতপুর থেকে ভাঙা মন নিয়ে বিয়ে অসমাপ্ত রেখে কবি সেনগুপ্ত পরিবারের রাঙাদা অর্থাৎ বীরেনের সঙ্গে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে কান্দিরপাড়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তারিখটি স্মরণীয়। কেননা আগের দিন প্রথম রাত্রেই নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন ভেঙে যাওয়ার পর গোপনে কবি কান্দিরপাড়ে রওনা হয়েছিলেন। ৭ জুলাই তারিখ পর্যন্ত কবি নিঃস্ব অবস্থায় সেনগুপ্ত পরিবারের আশ্রিত হয়ে কাটাতে বাধ্য হন। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে কবির সুহৃদ মুজফ্ফর আহমদ অর্থ সংগ্রহ করে নজরুলকে ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে সঙ্গে করে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন।

কিন্তু মাসতিনেক বাদেই কুমিল্লায় নজরুলের দ্বিতীয়বার হঠাৎ পদার্পণ ঘটেছিল। নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে তিনি সেনগুপ্ত পরিবারে উপস্থিত হন। আকস্মিক একাকী সেই সফরকালের মেয়াদ ছিল মাসখানেক। ইংলন্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ১৭ নভেম্বর ভারত আগমন উপলক্ষে কংগ্রেসের ডাকে প্রতিবাদস্বরূপ সারা ভারতজুড়ে ১৭ নভেম্বর হরতালের ডাক দেওয়া হয়। কুমিল্লা শহরে এই উপলক্ষে ২১ নভেম্বর হরতাল পালনের আয়োজন হলো। কুমিল্লায় হাজির হয়ে স্বয়ং নজরুলও তাতে শামিল হলেন। নজরুলের উপস্থিতিতে কুমিল্লার তরুণ সম্প্রদায় সেই বিক্ষোভ মিছিলে মেতে উঠেছিল। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্রের সচিব আফতাবুল ইসলাম এ-উপলক্ষে একটি গান লিখে দিতে অনুরোধ করলে কবি তা লিখেও দেন। মিছিলে গানটি যথারীতি নজরুলের সুরারোপনে গাওয়া হয়। তাতে নেতৃত্ব দান করেন স্বয়ং নজরুল। সেবার নজরুলের লেখা নতুন নতুন গান মিটিং-মিছিলে কুমিল্লার যুবক ও যুবতীরা নিয়মিত গাইতেন। এমনকি, সেনগুপ্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও তাতে প্রায়ই অংশ নিতেন। সেসব গানের মধ্যে ছিল – ‘আজি রক্ত নিশি ভোরে একী’ (বন্দী-বন্দনা), ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল’ (পাগল পথিক), ‘এস এস এস ওগো মরণ’ (মরণ বরণ) এবং ‘ঘরের বাহির হয়ো না আর’ (জাগরণী) ইত্যাদি। এই উপলক্ষে যুবরাজের আগমনকে ধিক্কার জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেন গান –

ভিক্ষা দাও হে পুরবাসী

সন্তান দ্বারে উপবাসী,

দাও মানবতা ভিক্ষা দাও।

ইন্দ্রকুমার ও তাঁর পরিবারের সকলেই ছিলেন রীতিমতো সংস্কৃতিমনা। রোজই প্রায় সে-সময় কান্দিরপাড়ে বসন্ত মজুমদারের বৈঠকখানায় বসত গানের আসর। কুমিল্লার স্থানীয়

গায়ক-গায়িকার দল সেখানে নিয়মিত এসে তাতে যোগ দিত। বিশেষত নজরুল কুমিল্লায় এলে সে-আসর পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। এরই মাধ্যমে কুমিল্লার সর্বত্র নজরুলের নাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশেষ করে আসরে মৌলভীপাড়ার জানে আলম চৌধুরী, ত্রিপুরা মহারাজের পৌত্র কুমার শচীন দেববর্মন, দারোগাবাড়ির মোহাম্মদ হোসেন খসরু, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, কলেজপড়–য়া সুলতান মাহমুদ মজুমদার ও স্থানীয় সংগীত সমাজের নিয়মিত উপস্থিতি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কুমিল্লার সংগীত সমাজের অবদান বলতে তখন বোঝাত শিল্পী জ্ঞান দত্ত, সত্য বক্সী, উস্তাদ মহম্মদ হোসেন খাঁ, শচীন্দ্রনাথ দত্ত (হিমাংশু দত্তের বড়োভাই ও সংগীত শিক্ষাগুরু), সুরেন্দ্রনারায়ণ দাস, সুরেশ চক্রবর্তী, শ্যামাচরণ দত্ত ও মায়া সেনগুপ্তের মতো শিল্পীবৃন্দ। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাঙাদা শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। পরে সাংবাদিকতার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ রচনার পর সেই দেশানুরাগ সেনগুপ্ত পরিবারকে অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা জোগাতে অবশ্যই সাহায্য করেছিল।

সেনগুপ্ত বাড়িতে বসন্তকুমারের কন্যা আশালতা বা দোলেনাই কিশোরীদের মধ্যে বড়ো। তিনি গান ভালোবাসেন। গোপনে কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ নজরুলকে পেয়ে আরো প্রশ্রয় পেতে থাকেন। কবির সেনগুপ্ত পরিবারে থাকাকালে দেখাশোনা ও ফাইফরমাশ খাটার ভার তাই নিঃশব্দে তিনি নিজের হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। দৌলতপুর থেকে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত কবি বিয়ের আসর ছেড়ে নিঃশব্দে যেদিন গোপনে দীর্ঘপথ রাঙাদার সঙ্গে হেঁটে কান্দিরপাড়ে ফিরে এসেছিলেন তখন তিনি দুর্বল, অসুস্থ। সে-সময় তাঁর দেখভাল ও সেবা-শুশ্রƒষার সব দায়িত্ব স্বেচ্ছার নিজের হাতে আপন স্বভাবের গুণে দোলেনাই তুলে নিয়েছিলেন। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অসহায় নজরুল তখন অলক্ষে কিশোরী দুলির ওপর সেবাযতেœর ব্যাপারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সে-সময় দুলিও মন-প্রাণ দিয়ে সেবা-শুশ্রƒষা করে অসহায় কবির পাশে নিজেকে অলক্ষে-অজান্তে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ওই সময় আশালতার ছোট দুই বোন (খুরতুতো) কমলা (বাচ্চু) ও অঞ্জলি (জয়ু) ছিল তার সঙ্গী। তাদের দাদা রাঙাদা তখন ছিলেন বাড়ির অতিথি নজরুলের স্থানীয় অভিভাবকের মতো। সভায়-সম্মেলনে নজরুল ছিলেন তাঁরই ওপর নির্ভরশীল। গোড়ায় রাঙাদা ছিলেন কবির গাইড। গোপন বিপ্লবী দলের সঙ্গে তাঁর ছিল যোগাযোগ।

কিন্তু ওই পর্বেই নজরুল যেসব কবিতা, গান বা অন্যান্য রচনা সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রথম ও গোপন পাঠক ছিলেন স্বয়ং সেই কিশোরী দুলি। বলতে গেলে সেসব নতুন কবিতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করত। কবিকে না জানিয়ে আশালতা তাই প্রায়ই নিজে আপনমনে কবিতা মক্শো করতেন। বাড়িতে অনেকেই তা গোড়ায় টের পায়নি। নজরুলের কবিতার প্রতি নিবিড় অনুরাগ তাঁর মনে তখন প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। গোপনে কাব্যচর্চা সম্ভবত তাঁর সেই অনুরাগজনিত প্রবণতার ফল। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে রচিত ঐতিহাসিক কবিতা ‘বিদ্রোহী’ কিশোরী দুলির মনেও পুবের দেশ কুমিল্লায় প্রবল ঢেউ তুলতে সমর্থ হয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ রচনার মাসখানেক পরে ফেব্রুয়ারি (১৯২২) মাসের গোড়ায় কুমিল্লায় পুনরায় পদার্পণ ঘটল নজরুলের। সেবারই কুমিল্লায় একটানা প্রায় মাসচারেক কবি সেনগুপ্ত পরিবারে কাটিয়েছিলেন। জুন মাসে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। দীর্ঘ এ-সময় কবির অবস্থানের ফলে কিশোরী আশালতাও কবির নিবিড় সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চা কবির অনুমোদনে প্রেরণা লাভ করে। কবিও আশালতাকে মনে রেখে কুমিল্লার খ্যাতি ধরে রাখেন তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায়। এর আগেই কুমিল্লায় কবি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রলয়োল্লাস’। ‘বিজয়িনী’ কবিতাটি গান হিসেবে মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় (পৌষ ১৩৩২)। ‘বিজয়িনী’র রচনাকাল অগ্রহায়ণ ১৩২৮, কুমিল্লা।

চতুর্থবার কবি গোপনে ফের কুমিল্লায় পাড়ি দেন। তারিখটি ছিল ২২ নভেম্বর, ১৯২২। তখন কবি ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক। নিজস্ব মালিকানাধীন প্রথম পত্রিকা নজরুলের ধূমকেতুর প্রকাশকাল ১২ আগস্ট, ১৯২২। কুমিল্লায় সেবার অবশ্য নজরুলের আগমনের কারণ সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে ধূমকেতু অফিসে পুলিশের অকস্মাৎ হানা (৮ নভেম্বর)। কুমিল্লা থেকেই পুলিশ অবশেষে ২৩ নভেম্বর, ১৯২২ সম্পাদক কবি নজরুলকে গ্রেফতার করে। ২৪ নভেম্বর কবিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।

নজরুলের শেষ সফর কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর (১৫ ডিসেম্বর) তিনি নিঃশব্দে ১৮ ডিসেম্বর কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে শেষবার কুমিল্লায় রওনা হন। সেবারও কুমিল্লায় গমন ও সেনগুপ্ত পরিবারে অবস্থানের কারণ আগে বা পরে কবি কখনো ব্যাখ্যাও করেননি। তাঁর সেই গোপন অভিসারপর্ব শেষ পর্যন্ত অন্তরালে রয়ে গেছে। কোনো এক অকথিত দুর্নিবার আকর্ষণই সম্ভবত এই আত্মগোপনের কেন্দ্রবিন্দু। অনেকের ধারণা, কবির তৃতীয়বার কুমিল্লা সফরের অভিজ্ঞতা (ফেব্রুয়ারি ১৯২২) মোটেই সুখকর হয়নি। একটানা চার মাস তৃতীয়বার সফরকালে কান্দিরপাড়ে সেনগুপ্ত পরিবারে অবস্থান এবং পরিবারের কারো সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠতা অনেকেরই মনঃপুত ছিল না। অনিচ্ছায় তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে নিঃশব্দে কলকাতায় ফিরে যেতে হয়েছিল। যন্ত্রণাবিদ্ধ কবি তারপর আর কুমিল্লামুখো হননি।

কুমিল্লায় বসে লেখা নজরুলের সে-সময়ের বিচারে ভিন্ন ধরনের কবিতা ‘বিজয়িনী’র রচনাকাল অগ্রহায়ণ ১৩২৮, অর্থাৎ

নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের কোনো এক সময়ে। সে-বছর পৌষ (১৩২৮) মাসে কবিতা মোসলেম ভারতে ছাপা হয়েছিল। পরে তা কবির ছায়ানট কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। এই কবিতায় তাঁর মনের ভূগোলটি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘ওগো জীবন-দেখি!/ আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,/ আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল।’

বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল যে সত্যি টলমল হয়েছিল তা তিনি সেই কবিতায় স্বীকারও করেছিলেন। কলকাতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কেউ কেউ তাঁর কবিতার মধ্যে মনের গোপন বার্তার সুর টের পেয়েছিলেন। কুমিল্লার চেনা গ্রাম্য কিশোরীর চোখে কবির বিস্ময় আর মুগ্ধতার ঝিলিক ক্রমশ আবিষ্কার করতে সেদিন দেরি হয়নি। বেদনা, নিঃসঙ্গতা আর গোপন ভালোবাসার ইঙ্গিত যেন উভয়েই অনুভব করতে সেইপর্বে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘বিজয়িনী’তে তারই ছায়াপাত প্রত্যক্ষ হয়ে ধরা দিয়েছিল।

কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও কাব্যিক মুগ্ধতা সেদিন আশালতাকে যে ক্রমশ প্রভাবিত করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। হৃদয়ের গোপন উচ্ছ্বাস প্রকাশ্যে ধরা না দিলেও ভালোবাসার গোপন বিরহ সংবাদটুকু ধরা দিচ্ছিল তাঁর একান্তে সৃষ্ট গানে ও কবিতায়। একাধিকবার কবির কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে অবস্থান পর্বগুলি আশালতার কিশোরী মনে যে কত গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সেসব নৈঃশব্দ্যের কবিতা ও তার গোপন অনুশীলন পর্ব।

প্রসঙ্গত, ওই পর্বে রচিত আশালতার (দোলেনা) বেশকিছু রচনা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ দুটি কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়। এই দুটি কবিতা সেকালে দ্বিমাসিক সাহিত্য পত্রিকা সাম্যবাদীতে যথাক্রমে বৈশাখ সংখ্যা ১৩৩২ ও আষাঢ় ১৩৩২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবিতাদুটি হলো :

 

শঙ্কিতা

আশালতা সেনগুপ্ত

 

কেন আজি প্রাণ মম বেদনায় বিহ্বল

কেন আজি অকারণে চোখে আসে জল ॥

 

সন্ধ্যার সমীরণ হু হু করে বয়ে যায়

বয়ে যায় মোর মন করে কেন হায় হায়।

কেন বেদনায় মম বুক আজি কম্পিত

কে জানে গো হিয়া মাঝে কত ব্যথা সঞ্চিত ॥

 

বেলা শেষে নীলিমায় চেয়ে আছে অনিমিখ্

কে ছড়ালো বিদায়ের সিন্দুর চারিদিক।

 

কিছুই বুঝি না হায় কেন প্রাণ ভারাতুর

কে দিল হৃদয়ে বেঁধে মল্লার-রাগসুর।

মনে হয়, এ নিখিলে কেহ নাই, নাই মোর

তুমি বলো কি সন্ধ্যা, কেহ নাই, নাই তোর ॥

(সাম্যবাদী, বৈশাখ ১৩৩২)

করুণা

আশালতা সেনগুপ্ত

 

সেই ভালো তুমি যাও ফিরে যাও

মোর সুখ নিশি হয়েছে ভোর

সেধে সেধে কেঁদে থাকি পায়ে বেঁধে

ভেসেছে সে ভুল ছিঁড়িলি ডোর ॥

 

জনমের মতো ভুলে যাও মোরে

সহিত নীরবে যাও দূরে সরে

করুণা করিয়া দাঁড়ায়োনা দোরে

পাষাণ এ হিয়া বাঁধিব গো ॥

 

চিরদিন আমি থাকিব তোমার

কাঁদিবে বেহাগ কণ্ঠে আমার

আপনি একলা কত স্মৃতিহার

গাঁথিব ছিঁড়িব কাঁদিব গো ॥

 

প্রাণ নাহি চায় দায়ে ঠেকে আসা

একটু আদর কিছু ভালবাসা

চাইনাকো আমি ঘুমের কুয়াশা

থাকুক জড়ায়ে নয়নে মোর ॥

 

দোষ করে থাকি ক্ষম মোরে ক্ষম

সুখী হও তুমি প্রার্থনা মম

চাহিনাকো সুখ, ভিখারীর সম

সেই ভালো তুমি হও কঠোর ॥

(সাম্যবাদী, আষাঢ় ১৩৩২)

তাঁর সমস্ত লেখাই সেই পর্বে আশালতা সেনগুপ্ত নামে প্রকাশিত হতো। পরিবার ও পরিজনদের কাছে তিনি ‘দোলেনা’ ও ‘দুলি’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরাও সাধারণত তাঁকে দুলি নামেই সম্বোধন করতেন।

১৯২২ সালের আগস্ট মাসে ধূমকেতু পত্রিকা (সপ্তাহে দুবার) প্রকাশের পর প্রিয়ম্বদা দেবী, প্রভাময়ী দেবী, অমিয়বালা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিন্দুবাসিনী রায় বা মিসেস আর এস হোসেন প্রমুখ মহিলা কবি বা লেখকের রচনা নজরুল নিয়মিত ছাপালেও প্রমীলা বা আশালতার রচনা তখনো তাতে ছাপা হয়নি। যদিও ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসেই কবির কান্দিরপাড়ে প্রথম যাতায়াত ও অবস্থান শুরু হয়েছিল। ব্যতিক্রম কেবল বিরজা সুন্দরী দেবী অর্থাৎ প্রমীলার কাকিমা, যিনি ছিলেন বাড়ির প্রধান ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী। তিনি ধূমকেতু পত্রিকায় ‘নারী কল্যাণ’ নামে একটি দীর্ঘ রচনা প্রকাশ করেছিলেন (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ১১ আগস্ট ১৯২২)। অবশ্য কিশোরী দুলির বয়স ছিল তখন মাত্র চোদ্দো বছর।