করোনাকালের মঞ্চকথা : অনুস্বর প্রযোজনায় ঢাকায় পুনশ্চ মিলার

করোনাকাল আমাদের জন্য ছিল (বা এখনো তেমনই আছে) কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি অনিচ্ছুক অপিচ বাধ্যতামূলক এক লড়াই-পর্ব। ইতোমধ্যে সাতান্ন লাখেরও অধিক মানুষ মরণশীলতাকে অনিবার্য সত্য কবুল করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, অস্ফুট স্বরে এই উচ্চারণে, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ বাধানিষেধ বা নিষেধাজ্ঞার মতো ভারি শব্দ থাকলেও আ-মরি বাংলা ভাষায় লকডাউন বলে একটা শব্দ সবিক্রমে অনুপ্রবেশ করেছে; কারো সহায়তা ছাড়া আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই তার মানে জানেন, তা তিনি ওইসব আদেশ মানুন বা না মানুন। বিবাহ উৎসবের বিশালাকার বা ক্ষুদ্রকায় মিলনায়তন বন্ধ, প্রেক্ষাগৃহ এমনকি বিভিন্ন ক্লাবের দরজার তালায় মরচে পড়ে গেছে। অতএব থিয়েটারপাড়াও যে নাট্যকর্মীদের উপস্থিতি বা মঞ্চের সংলাপে সরব হয়ে উঠতে পারেনি, সে-কথা বলা বাহুল্য। কত শিল্পীকে, বিশেষত নেপথ্যের কলাকুশলীদের কৃচ্ছ্রসাধনের প্রক্রিয়ায় গ্লানিকর জীবনযাপনের কষ্টভারাক্রান্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, বোধ করি তা নিয়ে অনতিদূর ভবিষ্যতে নাটক লেখা হবে বা মঞ্চায়িত হবে। নাটক ও বিনোদন জগতের এমন দুর্ভিক্ষ এমন করে এর আগে কখনো দেখেনি পৃথিবী।

বাংলাদেশে অবশ্য এখনো পেশাদারি থিয়েটার গড়ে ওঠেনি। এখানকার বিভিন্ন নাট্যদলের যাঁরা নেতৃত্ব দান করেন, এমনকি অভিনেতারা নাট্যচর্চা করতে গিয়ে বুনো মহিষ তাড়ানোর কাজটা করলেও এই করোনার সময় তাঁদের বাড়িতে হয়তো খাবারের জোগান ঠিক রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠার মতো টানাটানি পড়েনি। কিন্তু যাঁরা মঞ্চের সেট বানান, আলো বা রূপসজ্জার কাজ করেন বা অভিনেতাদের পোশাক তৈরি করেন, সেসব অপ্রত্যক্ষ নাট্যকর্মীর জন্য, এমনকি আমার জানামতে, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চস্তরে পড়াশোনা করেন এমন শিক্ষার্থী আছেন, তাঁদের জীবনযাপনকে সত্যিই একটা পরীক্ষা হিসেবে হাজির করেছে করোনা। এমন মন খারাপ করা দুঃখ-কথায় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে নিই মঞ্চের উজ্জ্বল সব মানুষ, প্রয়াত আলী যাকের, আবদুল কাদের, মোহাম্মদ মহসীন ও মান্নান হীরাসহ আরো অনেককে। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা সম্মিলিত হতেও পারিনি। কী কষ্ট!

করোনার প্রসঙ্গটা যে-কারণে তুলেছিলাম, সেই সূত্রটা থেকে একটু দূরে সরে গেছি, কিন্তু এমন এক শব্দস্রোতে ভেসে গেছি অনিবার্যভাবেই। বাংলাদেশ থিয়েটারকর্মীদের খেয়ালিপনার মূর্ত প্রতীক বলে চিহ্নিত, বিশেষায়িত বা অবাক-হওয়া তারিফ করেছিলেন আমার এক ইউরোপীয় বন্ধু। বোধ হয়, তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন আমরা এদেশের নাট্যকর্মীরা এক নেশাগ্রস্ত জনসমষ্টি। কিন্তু আমাদের নেশার ঘোর কাটে না। স্বাধীনতার এই সগৌরব সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে তো বলতে পারি, ‘মোদের নেশার ঘুর এখ্খনো কাট্টেনি গো।’ করোনার উৎপাত বাড়ছে-কমছে, আমরা বাধ্যতামূলক সামাজিক দূরত্ব মানতে নিমরাজি, তারই মধ্যে সদাজাগ্রত নাট্যনেশাপ্রমত্ত কতিপয় তরুণ মঞ্চায়নের ঢাকবাদ্যি বাজিয়ে দিলো। ‘থাকবো নাকো বদ্ধঘরে’ এমন দুরন্ত সেøাগান শোনা গেল। সব্বাই পারেনি, কেউ কেউ পেরেছে, তাদের গলায় অদৃশ্য পদক পরিয়ে দিতেই হবে আমাদের। এমনই এক স্বল্পোচ্চবাক দলের নাম অনুস্বর। নিজের আলাদা করে স্বর নেই, অন্যের সঙ্গে যূথবদ্ধ হয়ে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের নিচের তলার বাসিন্দা অনুস্বর কিন্তু বেশ শ্রুতিসুগম সুন্দর অন্তর-ছোঁয়া শব্দ সৃজন করতে পারে, সে তো সবার জানা। অক্ষর হিসেবে নিম্নমার্গের হলেও এর যে অন্যতর লিখিত রূপ আছে, তা কিন্তু বেশ তাৎপর্যবহ অর্থ বহন করে। থিয়েটারের জন্য তা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। নাট্যনির্মিতিতে অনুকরণ, অনুসরণ ইত্যাদির মৌলিক যোগ আছে। স্মরণ করতে পারি আদিগুরু অ্যারিস্টটলের কথা, – invitation of an action। সংলাপের মাধ্যমে নাট্যবিষয়কে পরিবেশন করার ক্ষেত্রে শব্দস্বরকে অনুসরণ করার অনুশীলনও অন্তর্ভুক্ত। সেই বিচারে অনুস্বরের একটা স্বতন্ত্র অর্থ খুঁজে নেওয়া যায়। 

নাটকপাগল ‘তরুণ কতিপয়’ (এই শব্দযুগল তৈরি করলাম এই দলের এক প্রধান সদস্যের একটি গ্রন্থের শিরোনাম অনুকরণে) কোনো বাদানুবাদ ছাড়াই সিদ্ধিপ্রাপ্ত একটা দল থেকে স্বেচ্ছা-অব্যাহতি নিয়ে নিজেদের প্রকাশ করার জন্য আলাদা একটা নাট্যগোষ্ঠী গড়লো, ভাঙনের শব্দটাকে উচ্চকিত হওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই। জন্মক্ষণে অবশ্য এই ভয়ংকর সত্য হয়তো তারা বুঝতে পারেনি যে, ধেয়ে আসছে করোনার সুনামি। অনুস্বর নাট্যগোষ্ঠী ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন ২৫শে জুলাই ২০১৯। দল বাঁধতে যতটা সময় না লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশি লাগে গান বাঁধতে (এই ষাট/ সত্তর বছর আগেও গ্রামীণ নাট্যাভিনয়কে ‘গান’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। আটঘাট বাঁধতে হয়, তবেই না সুরসংগত করা যায়। দুনিয়ার দূর পুব থেকেই মাসতিনেক আগে ডাইনি করোনাবুড়ির উৎপাতের শব্দস্রোত বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধ্বনিত হলেও তার ভয়-জাগানো সত্যিকারের সংহারী ঢেউ বাংলাদেশের জনপদ-তটে আছড়ে পড়ে ২০২০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। নতুন একটা দল তখনো শ্রবণ-আকর্ষণীয় স্বরসৃজনের জন্য মালমশলা তেমন সংগ্রহ করতে পারেনি। কিন্তু এর মধ্যেই তো দেশে-বিদেশে রটে গেল সামাজিক দূরত্ব মান্য করার অত্যাবশ্যকীয় বার্তা। মিলনায়তনের আসনে যতই কালবৈশাখির প্রক্ষিপ্ত ধুলা পড়ুক, শ্রাবণ-ভাদ্রের বর্ষণে বদ্ধঘরের দেয়াল যতই কি না স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠুক, করোনার এই ভ্রষ্টলগ্নে ‘লাটক তো হবার লয়’। সব কথার শেষ কথা।

কিন্তু, এবং এটা বেশ আঁখি ডাগর হয়ে ওঠার মতো কিন্তু, বাংলাদেশের নাট্যজগতে নবজাতক এই অনুস্বর নাট্যদলের সরব উপস্থিতি আবার জানান দিলো থিয়েটারকর্মীদের নেশামোহন হয়ে ওঠার সংবাদ। ঢাকার মঞ্চে নতুন কী আসছে – আমার তো এমন হাজারো আগ্রহী দর্শকের কাছে যা একটু না, অনেকটাই অন্যরকম ঠেকেছিল, তা হলো, যখন সামাজিক কথোপকথনে, এমনকি মধ্যরাতের টিভি অনুষ্ঠানের প্রাত্যহিক বাক্-প্রদর্শনী সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ^ব্যবস্থা ইত্যাকার বিষয়ে প্রবলভাবে সরব এবং এমন সমসাময়িকতার প্রাধান্যে সয়লাব হয়ে আছে, তখন নবীন এই নাট্যগোষ্ঠী সাহিত্যের পাতায় বিধৃত কিছু ধ্রুপদী কাহিনির অন্তর্লোকের বাস্তবতাকে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করার শিল্পদায় গ্রহণ করেছে। এই লেখায় অনেক শব্দের একটা ভিড়ভাট্টা ইতোমধ্যেই সৃষ্টি করেছি যদিবা, আমি কিন্তু প্রধানত এই অনুস্বর নাট্যদলের তৃতীয় প্রযোজনা মূল্য অমূল্য বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য কলমের খাপটা খুলেছিলাম।

তবে করোনাকাল, নতুন নাটকের আগমনী, তায় অন্য ধরনের স্বাদ পরিবেশনের প্রচেষ্টা, এসবই বর্তমান নাট্য-পর্যালোচনার জন্য অপ্রাসঙ্গিক নয়। বুঝতে পারি, করোনার চোখ রাঙানিকে চোখে চোখে রেখে অনুস্বরের সজাগ সদস্যরা নাটকের মহড়া শুরু করেছিলেন। ঠারে-ঠোরে সে-সংবাদ আমরা পাচ্ছিলাম। দলের জ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ সদস্য মোহাম্মদ বারী বুদ্ধদেব বসুর কাহিনি নিয়ে নাট্যনির্মাণের মাধ্যমে বেশ সাহস দেখালেন। এখানে অন্য একটা কথা তুলতে প্ররোচিত বোধ করছি। এদেশে এই সমকালে বুদ্ধদেব বসুর রচনা বহুলপঠিত নয়; কিন্তু তাঁর কাহিনিকে অনুস্বর নাট্যদল প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে এনেছিল ২০২০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর। তারও আগে এ-দলেরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেক সদস্য অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সী সাইফ সুমন একাধিক নাট্যদলের সদস্যদের সমন্বয়ে আপ স্টেজ (Up stage) নামে একটা দলের ব্যানারে বুদ্ধদেব বসুর রাত ভরে বৃষ্টি ঔপন্যাসিকার মঞ্চায়ন করেছিল মাত্র কয়েক মাস পূর্বে। আমার মতো প্রবীণ অনেকেই মনে করতে পারবেন প্রকাশনা-উত্তরকালে এই গ্রন্থ নিয়ে বিতর্ক হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কয়েক বছর আগে অবশ্য ঢাকায় বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিনী মঞ্চায়িত হয়েছিল এবং তা বেশ সাফল্যও অর্জন করেছিল। কিন্তু সাধারণভাবে বুদ্ধদেব বসুর নামের সঙ্গে নাটক ব্যাপারটা তেমন যায় না। কিন্তু মোটামুটি কাছাকাছি সময়ের দূরত্বে এই সাহিত্যিকের রচনা দু-দুবার ঢাকায় মঞ্চায়িত হলো। আবার এ-কথা মানতে হবে, এ-বিষয়ে মঞ্চদর্শকদের তেমন চাহিদাও ছিল না। তবে দর্শক প্রতিক্রিয়া থেকে অনুমান করা যায়, এখনো মঞ্চের নির্দিষ্ট আয়তনিক ক্ষেত্রে নানা কলাকৌশলের দক্ষ প্রদর্শনীর বিপরীতে কাহিনিকথনের একটা আকর্ষণ রয়ে গেছে নাট্যকর্মীদের মধ্যে, এমনকি বাঙালি দর্শকদের মধ্যেও। এ-বিষয়ে একটা বড় শিল্পবিতর্ক তোলা যেতে পারে, কিন্তু সে-কথা এখন তোলা থাক।

অনুস্বর এবং তাদের একটা মন-জুড়ানো ও চিন্তা-জাগানিয়া প্রযোজনা মূল্য অমূল্য নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া জানানোর মূল অভিপ্রায় শব্দবদ্ধ করার আগে অনেক কথা জুড়ে দিলাম। কিন্তু কথাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জন্ম নিয়েছে। করোনাকালের মধ্যে এ-নাটক মঞ্চে এসেছে, এটা তো উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসার্হ একটা উদ্যোগ। কিন্তু এই নাটকের টিকিট ও অনুষ্ঠানপত্রের ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে তিনটে সংখ্যাবাচক তথ্য পড়ে মনের মধ্যে যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময় সৃষ্টি হয়। জানা যাচ্ছে, মূল্য অমূল্য হলো এই দলের তৃতীয় প্রযোজনা, যার উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২০ সালের ৬ই নভেম্বর এবং ‘দলের কথা’ পড়তে গিয়ে জানা যায় – ‘আমাদের নাট্য অভিযাত্রায় মানুষই মুখ্য’ – এমন ঘোষণাপ্রদায়ী দলটা আত্মপ্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালের ২৫শে জুলাই। [পুনরুল্লেখের জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।] যাই হোক, অঙ্ক কষার পর যা দাঁড়াল, ১৫ মাসের চেয়ে কয়েকদিন বেশি সময়ের মধ্যে অনুস্বর তাদের তৃতীয় প্রযোজনা মঞ্চে নামাতে পেরেছে। এবং করোনার ফুঁসে ফুঁসে ওঠা এই ভয়াবহ সময়ের মধ্যে। সমসময়ের মঞ্চ ইতিহাসে একটা দলের এমন সঞ্জীবনী শক্তিকে টুপিখোলা অভিনন্দন জানাতেই হবে। এবং পাঠকরা বোধ করি জানেন, তবে এই লেখায় অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, অনুস্বর তাদের চতুর্থ প্রযোজনাও মঞ্চে এনেছে, এবং আবারো করোনাকালের হুমকিকে ‘থোড়াই কেয়ার’ করে, তিনকড়ি। দেশের উত্তরাঞ্চলের কথ্য ইতিহাসের এক সত্য ঘটনা আশ্রয় করে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িতকাবিরোধী নাটক। আর একবার হাততালি।

মূল্য অমূল্য বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণে ফিরে আসি। অনুষ্ঠানপত্রে মুদ্রিত কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই। নামকরণটা খুবই তাৎপর্যবহ হয়েছে। সাধারণত অধিকাংশ বাংলা শব্দের শুরুতে ‘অ’ স্বরবর্ণ বসিয়ে দিলে বিপরীতার্থক দ্যোতনা সৃষ্টি করে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আবার তা মূল শব্দটার অর্থটাকে গভীরতা প্রদান করে। মূল্য তেমনই একটা শব্দ। অনুস্বরের প্রযোজনাটি অবশ্যই মূল্যবান। কাহিনি জানার পরও অপলক চোখ ও সুস্থির মনোসংযোগ নিয়ে দেখেছি এই নাটক। কাহিনিটা ধার করা। তাতে এই প্রযোজনার মূল্য বেড়েছে বই কমেনি। আদি নাট্যকার হলেন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থার মিলার। সারা দুনিয়ায় তাঁর মতো ব্যাপকভাবে সমাদৃত আধুনিক নাট্যকার একেবারে হাতেগোনা। Death of a Salesman লিখে শুধু আমেরিকার নয়, ধনতন্ত্র-নির্মিত গোটা দুনিয়ার ভোগবাদী লাভ-লোভ রসায়নজাত সমাজের অন্তর্লীন শূন্যতাকে দর্শকদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই নাটক নিয়ে নির্মিত ছবি আলোড়ন তুলেছিল বিশে^। নাটকের প্রধান চরিত্র Willy Loman-এর ভূমিকায় অভিনয় করে ডাস্টিন হফমান তাঁর খ্যাতির ঝুড়িটাকে আরো ভারবাহী করে তুলেছিলেন; কিন্তু অনুস্বরের প্রকাশিত অনুষ্ঠানপত্র পড়ে আরেকটা জটলার মুখোমুখি হই। মূল নাটকের রচয়িতা হিসেবে আর্থার মিলারকে উল্লেখ করার পরপরই ভাবানুবাদকারী হিসেবে মুদ্রিত হয়েছে অসিত মুখোপাধ্যায়ের নাম, কলকাতার নাট্যজগতের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি, প্রয়াত হয়েছেন কিছুকাল আগে। মিলারের মূল নাটকের নাম ঞযব চৎরপব। তার মোক্ষম বাংলা প্রতিশব্দ আছে। অনুষ্ঠানপত্র থেকে জেনে যাই, অসিত মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাবানুবাদে আদি ইংরেজি শিরোনাম ‘দ্য প্রাইস’ বহাল রেখেছিলেন; কিন্তু এখানে আরো অর্থবহভাবে ভিন্ন একটা বাংলা নাম (মূল্য অমূল্য) দেওয়া হয়েছে। 

এ-নিয়ে দু-একটা বাক্য আগে লিখেছি। নাটকের নামের পরপরই দেখা যাচ্ছে, অনুস্বরের এই প্রযোজনার জন্য কাহিনি পুনরায় রূপান্তর করেছেন নাটকটির নির্দেশক মোহাম্মদ বারী। সুতরাং দর্শকরা যা উপভোগ করছেন, তা তিন হাত ঘুরে (পুনঃ) নির্মিত একটি শিল্পকর্ম। কৃতজ্ঞতার তালিকায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিচে দেখা যাচ্ছে কলকাতার তিনজন ব্যক্তির নাম। তাঁদের একজন খ্যাতনাম্নী অভিনেত্রী সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়। এঁরা তিনজন এই প্রযোজনায় কী সহায়তা করেছেন জানি না; কিন্তু নাটক দেখে আলাদা করে সে-কথা বোঝার অবকাশ নেই। সে যাই হোক, মোহাম্মদ বারী, প্রশান্ত হালদার এবং সাইফ সুমন ও ফরিদা লিমা মিলে সত্যিকার উৎসাহব্যঞ্জক একটা মঞ্চনাট্য পরিবেশন করেছেন।

মূল নাট্যকার আর্থার মিলারের পরিচয় দিতে গেলে আমি আবার কথার স্রোতে হারিয়ে যেতে পারি। মানবজীবনের অস্তিত্ব বা অর্থের সন্ধানে আধুনিককালের নাট্যকারদের মধ্যে তাঁর নামের সঙ্গে শুধুই হ্যারল্ড পিন্টার বা এডওয়ার্ড এলবির কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর সর্বাপেক্ষা আলোচিত নাটক Death of a Salesman বাংলাদেশে অভিনীত হয়েছে মাত্র একবার; কিন্তু সেটা বাংলাদেশের কোনো নাট্যদলের প্রযোজনা ছিল না।* সেজন্যে নাটক হিসেবে তা দর্শকদের মধ্যে কোনো বড় আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক এবং অ্যাকাডেমিক কাজের অংশ হিসেবে মিলারের Death of a Salesman মঞ্চায়িত হয়েছিল ২০১২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, প্রযোজনার জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল খ্যাতিমান অভিনেতা ফতেহ লোহানীর বাংলা অনুবাদ। প্রযোজনাটির নির্দেশকের দায়িত্বে ছিলেন বিভাগীয় শিক্ষক মো. জিয়াউল হক। কিন্তু মিলারের আরো দুটি নামকরা নাটকের চমৎকার প্রযোজনা দেখেছি ঢাকার মঞ্চে। জামালউদ্দিন হোসেনের পরিচালনায় All My Sons; যেটাকে বলা যায় অটুট অক্ষুণ্ন মিলার এবং তাঁর জীবনবীক্ষা, তা শনাক্ত করতে পেরেছিলাম বেশ ক-বছর আগের ওই প্রযোজনায়। মনে পড়ে, মুগ্ধ একটা নিরীক্ষাও লিখেছিলাম। মিলারের আরেকটা সাড়াজাগানো নাটক The Crucible মঞ্চায়িত হয়েছিল ঢাকায়, সেও অনেক আগে। সেটি ছিল নাট্যকেন্দ্রের প্রযোজনা। কোনো একটা উপলক্ষে নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্দেশনা দিয়েছিলেন তারিক আনাম খান। প্রযোজনায় খুবই দক্ষতা ও গভীর ঐতিহাসিক বোধের ছাপ ছিল। মনে হয়, সংখ্যায় খুব কম প্রদর্শনী হয়েছিল এ-নাটকের। The Crucible-এর মতো এমন এক বার্তাপ্রদায়ী নাটক এই সমকালের জন্য বড় বেশি প্রাসঙ্গিক।

মিলনায়তনে বসে অনুস্বরের মূল্য অমূল্য দেখার আগে তাদের দেওয়া অনুষ্ঠানপত্রটা পড়িনি। নাটক দেখার আগে কর্মকর্তাদের প্রদত্ত জবানি এবং কে কী করেছে তার তালিকা পড়ে নিলে প্রদর্শনীর মধ্যে ওইসবের খোঁজ নেওয়ার একটা উৎসাহ তৈরি হয়, উপভোগের জন্য তা অনুকূল নয়। আর্থার মিলারের The Price নাট্যগ্রন্থের (প্রথম প্রকাশকাল ১৯৬৮) ‘মূল’ রচনা ও মঞ্চায়নের অর্ধশতকেরও বেশিকাল পরে বাংলায় এটির নবনাট্য নির্মাতা এবং নির্দেশক মোহাম্মদ বারী নিজের একটা বয়ান পেশ করেছেন ওই অনুষ্ঠানপত্রে। যা এখন পড়তে গিয়ে বুঝলাম, স্থানিক বিন্যাস, যাকে নাটকের শ্রেণিকক্ষে আমরা contextualization বলি, তার ব্যাখ্যা হাজির করার প্রয়াসে তিনি যেন আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছুটা যুক্তি বিস্তার করেছেন। এটা তাঁর সততার পরিচয়। তবে আমার বিচারে এর তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। নির্দেশক নিজে অথবা দল একটি প্রযোজনায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবেন, এটাই প্রত্যাশিত।

আর্থার মিলার জীবনের আটপৌরে বা সুগভীর লক্ষ্য বিস্তার বা পূরণে ব্যক্তিসম্পর্কের দায়দেনার ভাগকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন এক্কেবারে সহজ ‘Price’ শব্দ বা এই নাট্যগ্রন্থের মাধ্যমে, সেই সত্য কোনো ভূগোল বা কালনির্ভর নয়। বেঁচে থাকার সেই টানাপড়েন সর্বদাই সর্বত্রই অস্তিত্বমান, ধ্রুপদী গ্রিক নাটক থেকে এই বর্তমানের মূল্য অমূল্য প্রযোজনায়। মিলারের Esther বা এই প্রযোজনার এশা চরিত্র যে অন্যদের তুলনায় নিত্যদিনের বাস্তবতাসংলগ্ন চাওয়া-পাওয়ার কথা বেশি করে বলে, সে-ই কিন্তু সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাহীন ব্যক্তি এবং নারী এবং আরেক নারী আত্মহননে নিজেকে নিঃশেষিত করেছে, সে এখন অশরীরী শক্তি দিয়ে পিতাকে (পুরুষকে) ভীতিতাড়িত করে। মিলারের নাটকে তাকে মঞ্চে দেখা যায় না। কিন্তু অনুস্বর-প্রযোজনায় তাকে মঞ্চে আনা হয়েছে প্রতীকী অবয়বে। তার বাবা খোদাবক্স আরেকটু বাড়তি লাভের আশায় (ধনতন্ত্রের ওইটাই মূলমন্ত্র) টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাবে সদামগ্ন থেকেও জীবনকে উপভোগের প্রকল্পে পৌষালি সকালের খড়পোড়ানো আগুনের উত্তাপটুকুও পেল না, মিলারের সেই বার্তা মোহাম্মদ বারীর অনুস্বর বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে পরিবেশন করেছে।

আমাদের সমাজে তুলসী-ধোয়া পুলিশ কর্মকর্তা অন্তত এই এখন একেবারেই দুর্লভ, তাই মঞ্জু বা মিলারের Victor-কে এই শতকের বাংলাদেশের দর্শকের কাছে হেঁয়ালির মতো ঠেকতে পারে, কিন্তু প্রশান্ত হালদার বেশ দক্ষতার সঙ্গে চরিত্রটাকে দেশের সীমানা পার করে ফুটিয়ে তুলেছেন। সাইফ সুমন Walter বা রঞ্জু চরিত্রের পাওনা দাবি মিটিয়েছেন। কিন্তু আমার দেখাটা এমন যে, নিজের অবিবেকী পরিচয়টাকে বেশি সবাক করে তুলতে গিয়ে কণ্ঠের জোর দু-এক জায়গায় তার-ছেঁড়া পর্যায়ে চলে গেছে। তবে সাইফ সুমনের জন্যই চ্যালেঞ্জটা বেশি। রঞ্জুর অতীতে প্রত্যাবর্তন এবং বর্তমানের পেশাগত ব্যস্ততা ও বিবাহবিচ্ছেদ তার জন্য আগামীকাল কোনো মঙ্গলবার্তা বয়ে আনতে পারে না, এমন এক বোধ তাকে বিদীর্ণ করে। সেই দ্বন্দ্ব রূপায়ণে নির্দেশক বোধ করি বাড়তি গতি আরোপ করেছেন তাঁর চরিত্রায়ণে।

ভূমাণ্ডলিক বিচারে বিগত পঞ্চাশ বছরে এই গ্রহ নিশ্চয়ই আরো অমানবিক হয়ে উঠেছে, বসনিয়া, ইরাক যুদ্ধ, জঙ্গি মৌলবাদের সম্প্রসারণ, সহিংস সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বেড়েছে, কিন্তু ব্যক্তিক-পারিবারিক বৃত্তের কাহিনিতে তার প্রভাবে মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। লোভের প্রকরণভেদ ঘটেছে। মূল্য অমূল্য এই বাস্তবতাকেই পরিবেশন করেছে বিশ^স্ততার সঙ্গে। আবার করোনার মতো সাম্প্রতিক বিষয় অথবা সংলাপের ব্যবহারে কৌতুক সৃজনের মাধ্যমে (খোদা+বক্স অথবা psycho+logical) কাহিনিকে দর্শকদের আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। রূপান্তর করতে গিয়ে মূল নাট্যকারের ভাবনাভাষ্যকে অটুট রেখেও দর্শক মনোরঞ্জনে এমন অভিযোজন কিন্তু শুধুই রস সৃষ্টি করে না, অর্থবহতাকেও এগিয়ে নিয়ে যায়। নির্দেশক মোহাম্মদ বারী নিজে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার সবটুকু উজাড় করে। অনুষ্ঠানপত্রে উল্লেখ আছে, আমাদের আর একজন গুণী অভিনেতা এই চরিত্রে মঞ্চে আবির্ভূত হতে পারেন; নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আবুল হায়াত। তিনিও যে ঝড়ষড়সড়হ বা খোদাবক্স চরিত্রের রূপায়ণে বিশিষ্টতা দান করবেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

মূল্য অমূল্য প্রযোজনা আর্থার মিলারের নাটকের নিউইয়র্ককে যথার্থভাবেই ঢাকায় প্রতিস্থাপন করেছে। বাস্তবধর্মিতাকে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সংস্থাপনের প্রয়াসে নির্দেশক সবিশেষ মনোযোগী ছিলেন। সাধারণ মঞ্চসজ্জা, ডিভান, ভারী চেয়ার, পুরনো দিনের আসবাব – অতীত যেন প্রবলভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে; সেকালের হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোনে (আমার মতো বৃদ্ধের তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ে গিয়েছিল, সেদিনের বিজ্ঞাপন, ‘সুখী গৃহকোণ, শোনে গ্রামোফোন’।) নজরুলের ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়’ পরিবেশনা খুবই নান্দনিক ভাবনা। আধুনিক ক্ষুদ্রায়তন আবাসে ধ্রুপদী আসবাবের স্থান নেই, ব্যবহার করো আর বর্জ্য (disposable) উৎপাদন করো, এসবই মিলারের বার্তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এই নাটকে এইসবের প্রয়োগ প্রযোজনাকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে। Solomon বা খোদাবক্স দর্শকদের থেকে একটা নিরপেক্ষ বিন্দুতে অবস্থান করেন, কিন্তু তার সংলাপে পশ্চিম বাংলার সুনির্দিষ্ট টান এবং সেইসঙ্গে দেশভাগের করুণ পরিণতিতে অভিবাসনের বাস্তবতা – এসবই সুচিন্তিতভাবে জুড়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ বারী এবং সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে তা জীবন্ত করে তুলেছেন। দুই ভাইয়ের কাহিনির মধ্যবিন্দুতেই তো তিনি, লোভ-লাভ বস্তুতন্ত্রের প্রতিনিধি।

নাট্যপ্রযোজনার অন্যান্য বিষয়েও অনুস্বর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আমি যে-প্রদর্শনীর দিন উপস্থিত ছিলাম, সেই সন্ধ্যায় আলোক প্রক্ষেপণে সামান্য বিচ্যুতি ঘটেছিল, কিন্তু তা অবশ্যই মার্জনাযোগ্য। গ্রামোফোনে গানের কথা আগে বলেছি, আবহসংগীতের যতটুকু অবকাশ ছিল (খুব বেশি ছিল না) তার সদ্ব্যবহার করা হয়েছে, প্রতিধ্বনি শুনেছি একবার, তা ছিল নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পোশাকের ক্ষেত্রে এশা বা এস্থারের শাড়ির রংটা বেমানান নয়, কিন্তু পুলিশের নির্ধারিত রঙের ইউনিফর্ম, রঞ্জুর জ্যাকেট ও সাদা শার্টের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা আর একটু ভাবা যেত। এসব কথা নিন্দা নয়, পর্যবেক্ষণ মাত্র।

অনুস্বর যে-শক্তিতে বিকশিত হয়ে উঠেছে, তা আমাদের মঞ্চনাটককে আরো সবল করে তুলবে, এই আমার বিশ^াস।

* প্রবন্ধকার হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন অথবা অবহিত নন যে, ২০০৩ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ঢাকার বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে চট্টগ্রামের গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় আর্থার মিলারের উবধঃয ড়ভ ধ ঝধষবংসধহ নাটকটির ম. সাইফুল আলম চৌধুরী কৃত রূপান্তর-নাটক এই ঘর এই বসতি মঞ্চস্থ হয়। নাটকটির পরিচালক ছিলেন কুন্তল চৌধুরী। এতে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন রণজিৎ রক্ষিত ও শুভ্রা বিশ^াস।

– সম্পাদক, কালি ও কলম

ছবি : নিবন্ধকারের সৌজন্যে