গালিব আহসান খান দর্শনের আলোকে কবিতা-ভাবনার দিগ্বদিক

তর্কটা বহু পুরানো – সেই প্লেটোর সময় থেকেই। কবিতা ও দর্শনের সম্পর্ক ও অবস্থান নিয়ে দার্শনিকেরা স্বভাবতই দর্শনকে সর্বোচ্চ স্থান দেন আর কবিতাকে রাখেন নিচের স্তরে। দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক গালিব আহসান খান ওই প্রতর্কসূত্রেই লিখেছেন তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিতে কাব্য-ভাবনা (২০১৩) গ্রন্থটি। দর্শনতত্ত্ব ও কবিতায় পারস্পরিক প্রতিফলন পর্যবেক্ষণে গালিবের শুধু দর্শনশাস্ত্রের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যই প্রমাণ হয়নি, সেসঙ্গে কাব্যভাবনার ও পঠনপাঠনের গভীরতাও উন্মোচিত হয়েছে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কাব্যকৃতি বিশ্লেষণে সেই বোধের সম্প্রকাশ ঘটেছে টেক্সটচুয়াল রীতিমাফিক। গ্রন্থে সর্বমোট ছয়টি প্রবন্ধ সংকলিত, আর রয়েছে পরিশিষ্টরূপে তাঁর লিখিত কয়েকটি কবিতা। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ – এই প্রবাদপ্রতিম বাক্য স্মরণে রেখেই গালিব জীবনের নানা পর্যায়ে কবিতাগুলি লিখেছিলেন।

তাঁর প্রথম পর্যবেক্ষণ ‘কবিতার সংক্রমণ’ কী করে ঘটে। তাঁর মতে, কবিতা দৈবিক ও মনোবিদ্যক অবস্থার ছন্দিত প্রকাশ। তা স্বতঃফূর্ত, অনিয়ন্ত্রিত উৎসারণ। আমাদের আদি কবিতা চর্যাপদের দিকে যদি তাকাই তবে দেখি সেগুলো অনিয়ন্ত্রিত নয়, নয় নিছক স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ, বরং তা চিন্তাভ, সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত প্রকাশ। অথচ চর্যাপদের যে তত্ত্বময়তা, সাধন-সংগীতের গূঢ় রহস্যময়তা, রূপকের ভাষান্বয় তার সূত্রে আছে সাইকো সোমাটিক তন্ত্রমন্ত্র। অর্থাৎ মনোদৈহিকতার পরিচর্যাও চিন্তাময় প্রকাশ হতে পারে। সব কবিতাই (নিছক পদ্য নয়) ছন্দময় চিন্তা ও বোধের মিথস্ক্রিয়া এবং তার সঞ্চারণও পাঠকের ভাবনার-বৃত্তিকেই সংক্রমিত করে থাকে। গালিবের ধারণায়, মনোদৈহিক সংক্রমণ হেতু কবিতা প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি, দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে দর্শনবিদ্যা। এখানে জীবনের উন্নত স্তর প্রকাশিত হয়। আর তা হলো – যুক্তি, তথ্য, অনুশীলন, বিজ্ঞান ইত্যাদি। এখানে প্রশ্ন ওঠে, কল্পনা ব্যতীত যা কবিতার উপাদান ও শক্তি, সেটি কী দ্বিতীয় স্তরের যুক্তি, তথ্যানুশীলনে নেই? লেখকের মতে, এই প্রথম স্তরটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ‘এটাই জীবনের অত্যাবশ্যক ভিত্তি’ উন্নততর অবস্থায় উত্তরণের ধাপ। কবিতার উদ্ভবকে প্রাথমিক আর উৎকর্ষকে দ্বিতীয়, উন্নত স্তরের বিষয় বলে সাব্যস্ত করে তিনি বোধ ও আবেগের সঙ্গে যুক্তির পার্থক্য তুলে ধরেন। বোধ জীবনের ‘স্তর-নিঃসৃত ব্যঞ্জনা’ – এই ব্যঞ্জনা কবিতার অবলম্বন। কিন্তু দর্শনের অবলম্বন হচ্ছে পরিকল্পিত প্রশ্ন ও তার উত্তর সন্ধিৎসা।

আরো চিহ্নিত করেন কবিতা আর প্রকৃতির ধর্ম একই। প্রকৃতিতে যে সামঞ্জস্য আছে তেমনি কাব্যছন্দ, শব্দভাষা, অলংকার ইত্যাদিও প্রাকৃতিকতার বেশি সন্নিকট। আজকের উত্তরাধুনিক সময়ে কবিতায় যে প্রাকৃতায়নের ঘোষণাপত্র এসেছে তা অনেকটাই পরিবেশবাদী বিজ্ঞানভাবনা থেকেই নিঃসৃত। তাহলে তো বলাই যায়, বিজ্ঞান দ্বারা কবিতাও সংক্রমিত হয়। প্রযুক্তির উপাদান তো আমরা বর্তমানে অহরহ দেখছি কবিতায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কাজেই গালিবের দৃষ্টিকোণে যে-সমাজ বেশি মাত্রায় কবিতাপ্রবণ সেখানে বিজ্ঞান-দর্শন চর্চা কম, এটি প্রশ্নসাপেক্ষ। গালিবের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক জগৎ কবিতা ও বিজ্ঞান – উভয়ের অবলম্বন হলেও দার্শনিক জন লকের মতানুযায়ী, কবিতা বস্তুর গৌণ গুণ ও বিজ্ঞান বস্তুর মুখ্য গুণের অভ্যন্তর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে। অর্থাৎ কবিতা অবভাস আর বিজ্ঞান মৌলিক গুণের চর্চা করে। কিন্তু কবিদের কেউ কি অবভাস ছাড়িয়ে অভ্যন্তর গুণ প্রকাশ করেননি? জীবনানন্দের কবিতাই ধরা যাক, অবভাস তথা ফেনোমেনাকে ভেঙে দিয়ে তিনি অন্যতর জগৎকে নির্দেশ করেন বলেই লেখেন – ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ বা ‘নগ্ন নির্জন হাত’। অবশ্য গৌণ গুণের ব্যতিক্রমের কথা গালিবও স্বীকার করেন : ‘এই ব্যতিক্রমের পর্যায়ে এমন সব কবিতাও আমরা পাই যা জীবনের দ্বিতীয় স্তরের বিষয় (চিন্তাস্তর) কেবল নয়, বরং সেই সাথে যা আবেগ-অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে শুদ্ধ চিন্তার এমনই রূপ ধারণ করে, যার স্থান বিজ্ঞানের যৌক্তিক চিন্তারও অনেক ওপরে। বৈজ্ঞানিক চিন্তা উচ্চরূপ লাভ করলে এক সময় তা দার্শনিক চিন্তায় রূপ নেয়। অনেক বড়ো বৈজ্ঞানিক চিন্তাই এভাবে একটা পর্যায়ে এসে দার্শনিক চিন্তার রূপ নেয়।’ অর্থাৎ তিনি স্বীকার করেন যে, ‘কবিদের মহৎ রচনা অবশ্যই জীবনের দ্বিতীয় স্তরেই কেবল নয়,  বরং দ্বিতীয় স্তরের ঊর্ধ্বতলে অবস্থান করে।’ এভাবে অভিমত তুলে ধরা আসলে কবিতার প্রতি তাঁর পক্ষপাতকেই ইশারা করে। তাঁর এইসব মতামতের পশ্চাতে দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ বা হেগেলের চিন্তার প্রভাব আছে। তাঁরাও নান্দনিকতার উচ্চতর স্তরকে আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমাদের বৈষ্ণব পদাবলি এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

এরপর তিনি কবিতার প্রাকৃতিক প্রতিবেশ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন। আমাদের প্রকৃতিতে এমন কী আছে যা আমাদের কাব্যপ্রবণ করে? বিপুলভাবে কবিতার – যা জীবনের প্রথম স্তর, তার সংক্রমণকে তিনি ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন। কারণ জাতি হিসেবে আবেগপ্রবণতার চেয়ে চিন্তাশীল বিজ্ঞান-ভাবনাই অধিক কাম্য। কেননা দর্শনের যুক্তিবিদ্যা অনুযায়ী কবিতা বেড়ে গেলে চিন্তাজগৎ কমে যাবে। কবিতা যেহেতু সংস্কৃতির অংশ, তাই সংস্কৃতিমান হতে গেলে তো কবিতাচর্চা করাই দরকার, অধিক হারেই করা  দরকার। এ-সূত্রে গালিব স্যাপির-ওর্ফ প্রকল্পকে (Sapir-Whorf Hypothesis) কবিতার সংক্রমণগুণ বিশ্লেষণে কাজে লাগান। প্রকল্পটি হচ্ছে ভাষাগত। একই ভাষা বিবিধ প্রকাশভঙ্গির কারণে বিচিত্র রূপ নেয়; ভাষার মধ্য দিয়ে এই বিচিত্রতা নির্ধারিতও হয়। এ-অর্থে বলা যায়, কবিতার ভাষা গদ্যের ভাষা থেকে পৃথক, সাহিত্যের ভাষা বিজ্ঞান বা দর্শনের ভাষা থেকে আলাদা। প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতার এই অভিমত বহু আগেই অ্যারিস্টটল বলে গেছেন, তাঁর পোয়েটিকস্ গ্রন্থে। আবার, বিষয়গত সূত্রেও ভাষা ভিন্নতর হয়, কবিতায়ই রাজনীতি বা স্বদেশচেতনার প্রকাশ ভিন্নতর ভাষায় হবে। রাজনীতির ভাষাও বক্তৃতায় একরকম, কবিতায় আরেক রকম হবে। রাজনীতির ভাষা যেহেতু সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্গত, তাই তা হবে বিজ্ঞানের যৌক্তিক ভাষা। অতএব আবেগ ও যুক্তির ভাষা পারস্পরিকভাবে অপ্রতিসম। গালিব গণিত বা গানের সুরের ভাষা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেননি। এ-দুটোই ভাষার বিশুদ্ধ ও মৌলিক রূপ প্রকাশ করে।

এটি সত্য যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞানের পরিবর্তে কবিতার বেশি কাছাকাছি হচ্ছে রাজনীতি। এর কারণ, তাঁর মতে, আমাদের এখানে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশের অভাব, যা এখানে ঘটেনি। এটি জাতিগত দুর্বলতা। এই দুর্বলতার অভাব পূরণে কবিতার সহায়ক ভূমিকা খুবই কার্যকর। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে এই কাব্যিক বোধ ও আবেগই যদি মূখ্য হয়ে ওঠে, তবে এর রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক দিকটি দুর্বল হয়ে পড়ে বলেই গালিবের ধারণা। কথাটি তর্কসাপেক্ষ। আমাদের এসব দুর্বলতার মূল কারণ কবিতার প্রাচুর্য না, রাষ্ট্রীয় জীবনের সংকট-সমস্যাজাত কাঠামোগত অব্যবস্থা। বাংলা ভাষার প্রতি শুধুই আবেগ কাজ করেনি, সুচিন্তিত আন্দোলন ও রাজনীতিও কাজ করেছিল ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যে-আন্দোলনের চূড়ান্ত পথচলা ও পরিণতি একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্র্জন। জ্ঞানের প্রসার অবশ্যকাম্য, কিন্তু কবিতার প্রসারকে বাদ দিয়ে নয়। স্বাধীনতা-সংগ্রাম ইত্যাদি সক্রিয় সংঘটনার প্রধান প্রেরণা ছিল অবশ্যই কেবল আবেগ নয়, বরং force of life – জীবনশক্তির মৌলিকতা। কাজেই পরবর্তীকালে জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটেনি বলে যে-আক্ষেপ তার দায় কবিতার নয়, জ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের ব্যর্থতাই সেজন্যে দায়ী। রাজনীতি কবিতা দ্বারা বেশি সংক্রমিত হওয়ার পেছনেও রয়েছে কবিতা ও জ্ঞানদর্শনের সমস্তরিক বিকাশের অভাব। একথা কি মান্য যে, আগামী উন্নততর জীবনে আমরা প্রবেশ করলে কবিতার চাহিদা বা লেখালেখি কমে যাবে? নাকি কবিতাও আরো উন্নত হবে। গালিবের বিশ্বাস, উন্নতই হবে। তা আরো মননশীল হবে। সৃজন ও মননের মিথস্ক্রিয়া ঘটবে; গুণগত মান বেড়ে যাবে।

দুই

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই গ্রন্থে মোট তিনটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ রয়েছে, যেখানে লেখকের রবীন্দ্রপাঠ ও দার্শনিকতার মিথস্ক্রিয়া সংসাধিত হয়েছে। প্রবন্ধত্রয় হচ্ছে যথাক্রমে – ‘ক্ষতচিহ্নিত লাঞ্ছিত জীবন বিভক্ত সত্তা ও অসমন্বিত একাত্মবোধ’, ‘দার্শনিক দ্বান্দ্বিকতা ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ এবং ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি।’ প্রথম প্রবন্ধটিতে লেখকের অভিপ্রায় হচ্ছে, রবীন্দ্রজীবনকে ক্ষতচিহ্নের মধ্যে দেখা এবং তাঁর অসমন্বিত বিভক্ত সত্তাকে ঐক্যের সূত্রে অবলোকন করা। শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসায় ভরপুর ঈর্ষণীয় রবীন্দ্রজীবনকে কবি নিজেই বলেছেন, ‘ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত জীবন।’

কবিতার মধ্যে কবিসত্তার একটা সত্তার প্রতিফলন ঘটে, বাকিটুকু থাকে কবিতার পারসোনার হাতে। কবিতার আমি আর কবি-আমি – এই দুইয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান, এমনকি বৈপরীত্যও থাকতে পারে। যে-তিনটি আত্মজীবনী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ – ছেলেবেলা, জীবনস্মৃতি ও আত্মপরিচয় – সেসবে তাঁর কাব্যজীবনই মুখ্য হয়ে উঠেছে, বিশেষত আত্মপরিচয় গ্রন্থে। গালিব তাঁর লেখায় এই কাব্যজীবনেই সন্ধান করেছেন ক্ষতচিহ্নকে। আমাদের অস্তিত্বধারার মধ্যে যে-সত্তাটি প্রবাহিত হতে-হতে বিশিষ্ট রূপ নেয় তার পরিচয় জানতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১) কাব্যে মুখোমুখি হয়েছিলেন উত্তরহীনতার – কে তুমি, মেলেনি উত্তর। কবিসত্তার এই অজানা পরিচয়কে গালিব দর্শনের সত্তাসূত্র দিয়ে অনুধাবন করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, জগতের সঙ্গে, অন্য সত্তার সঙ্গে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের সংঘাত কিংবা সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিসত্তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে। কিংবা ‘অসমন্বিত একাত্মবোধে’ জড়িয়ে থাকে। দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্রের Being and Nothingness গ্রন্থের ব্যাখ্যার আলোকে তিনি দেখান যে, চেতন-সত্তা পূর্ণ নয়, তা সর্বদাই অপূর্ণ ও শূন্যতার শিকার। এর হাত থেকে পলায়ন করতে চায় সত্তা এবং পেতে চায় অন্যকিছু। এ হচ্ছে বাসনা, যা অন্য সত্তা বা জড় সত্তা বা বিমূর্ত সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়। এই প্রয়াসেই সত্তা একাত্মবোধে উত্তীর্ণ হয় এবং অন্য সত্তার সঙ্গে বিশোধিত হয় (absorbed)। নানা সত্তার সঙ্গে বিশোধিত হয়ে-হয়ে সত্তা নিজ চেতনায় ঐক্যবোধ গড়ে তোলে। কখনো এই ডিসকোর্সে ব্যক্তিসত্তাকে, বিশেষত কবিসত্তাকে রূপকের পর রূপক, রূপক থেকে নানা রূপকে যেতে হয়। যেমনটা রবীন্দ্রনাথের ‘ঈশ্বর’-রূপক রচনায় দেখা যায়। ঈশ্বর তাঁর কাছে কখনো প্রভু, কখনো পিতা বা সখা-প্রেমিক। গীতাঞ্জলিতে এইসব রূপক-প্রতিমার ছড়াছড়ি। এভাবে একাত্মবোধের রূপক-রচনার মধ্যে কবিসত্তা বিশ্বজনীনতা সৃষ্টি করে। জাগতিক ও অধিবিদ্যক জগতের মধ্যে দিয়ে নিত্যতায় অনুপম হয়ে ওঠে।

গালিব এই বিভক্ত সত্তার ঐকাত্ম্য থাকার প্রত্যয়কে চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রকবিতার নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এবং দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ কখনো বলছেন ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ (‘প্রাণ’ কবিতা), কখনো বা ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যামসমান’ (ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী) বলে মৃত্যুকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। তরুলতা, নদী, আকাশ বা ঈশ্বর – যে কিছুর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আকুলতা নানাভাবে বিভক্তিকৃত হয় বলেই গালিবের অভিমত। আমরা বলব, শিল্পের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে একাত্মবোধের আহ্বান জানানো, কবিরা তাতে সাড়া দিয়ে বাসনার পূর্ণতাসাধনকল্পে রূপকাদি বিনির্মাণ করেন। এখানে শূন্যতার নিরসনকল্পে আসলে কবি ঐকাত্ম্যই হন, বিভক্ত হন না, empathetic হন। লেখক ওই বিভক্ত-সত্তাকে দেখেন অসমন্বিত ও ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের কারণ হিসেবে। বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। কেননা রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচয় গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, ‘বিশ্বের মধ্য দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারা’ তাঁর ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডতাকে ঐক্যদান ও তাৎপর্যদান করছে ‘জীবনদেবতা’ নামক সত্তা। ‘জীবনদেবতা’ আসলে কবিরই অন্তর্নিহিত সৃজনী শক্তি।

বস্তুত গালিবের সত্তার বহু খণ্ডায়ন প্রসঙ্গটি কেবল দার্শনিক দৃষ্টিরই অন্তর্গত নয়, তার কাঠামো বা গঠনে থাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসমাজব্যবস্থারও ভূমিকা। তাছাড়া এসবেরও দর্শন আছে, যা গালিব আলোচনায় আনেননি। ফলে তাঁর ব্যাখ্যা আংশিক ও একপার্শ্বিক। তবে এটি সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের সত্তা নানা রূপে বিভক্ত হলেও তা একাত্মবোধে গ্রথিত। এই একাত্মবোধকে বহুলাংশে অসমন্বিত বলে গালিব যথার্থই সাব্যস্ত করেছেন, যদিও ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোতে বসবাসকারী কবির এই অসমন্বয় অবশ্যম্ভাবী। গালিব কবির বিশ্ববোধকে কেন ব্যর্থতা বলছেন? রবীন্দ্রনাথের ক্ষতচিহ্নিত ও লাঞ্ছিত জীবনের কারণটি তাই কেবল তাঁর ভালোবাসার ব্যর্থতা নয়, সেটি দ্বান্দ্বিক সমাজ ও বিশ্বের, শুভ ও অশুভের সঙ্গে একাত্মবোধেরও উৎসসঞ্জাত – যেটি ‘পৃথিবী’ কবিতায় বলা হয়েছে। দুঃখ-শোক-ব্যর্থতাকে স্বীকার করেই রবীন্দ্রনাথের সত্তা সুখ-প্রেম-সফলতাকে বরণ করে নিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের আরেকটি ডিসকোর্স ছিল, তা হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মবোধ গড়ে তোলা। নিজেই বলেন যে, প্রকৃতি তাঁর জীবনের অধিষ্ঠাতা আবেগ। ঔপনিবেশিক সমাজের খণ্ডতা-ক্ষুদ্রতা-অসুন্দরতা-প্রতাপ-শাসন-শোষণ – সবই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন আবহমান সৌন্দর্যময় প্রকৃতিকে আশ্রয় করে, ভালোবেসে। এই প্রেম-ভালোবাসা থেকেই আনন্দের উৎসারণ ঘটে, যা কবির প্রধান ডিসকোর্স। এসব ভাবনা গালিবের দার্শনিক আলোকে গভীরভাবে ধরা পড়েনি। তবু অসমন্বিত কবিসত্তাকে ক্ষতলাঞ্ছিত চিহ্নের সূত্রে গালিব যেভাবে তুলে ধরেছেন তা আমাদের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।

দুই. ক

‘দার্শনিক দ্বান্দ্বিকতা ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা’ শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধটি উপরিউক্ত ধারণাকে আংশিকভাবে অতিক্রম করে যায়। এখানে গালিব ভাববাদ ও বস্তুবাদের দর্শন দিয়ে রবীন্দ্রকবিতাকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। বৈপরীত্য দ্বন্দ্ববাদের একটি সূত্র যা আমাদের জীবনেও রয়েছে, সাহিত্যেও রয়েছে। বৈপরীত্য অস্তিত্ববিষয়ক আবার একই সঙ্গে বক্তব্যবিষয়ক। গালিবের মতে, অস্তিত্ববিষয়ক বৈপরীত্য হচ্ছে ‘আছে’ এবং ‘নেই’ – এই দুয়ের মধ্যে। সুখ থাকলে দুঃখ থাকে না, এই থাকা-না-থাকার বৈপরীত্যই হচ্ছে অস্তিত্ববিষয়ক। আর ‘সত্য এবং মিথ্যা’, কিংবা ‘প্রেমের নাম বেদনা’ – এরকম বৈপরীত্য হচ্ছে বক্তব্যবিষয়ক। অতএব গালিব দ্বন্দ্ববাদ বলতে বোঝান মূলত বৈপরীত্যের সহাবস্থানকে – ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ – দুইয়ের অস্তিত্বকে। এর তিনটি ধারা – জগৎপ্রেক্ষিতমূলক, জীবনবোধমূলক ও সমাজচেতনামূলক বৈপরীত্য। রবীন্দ্রকাব্যচেতনার এই তিন প্রকার বৈপরীত্যকেই গালিব ব্যাখ্যা করেছেন, ‘বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিকতা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যচেতনার শুরু এবং শেষ’ – গালিবের আলোচনার মূলসূত্র এটাই। সন্ধ্যাসংগীত কাব্য থেকে শুরু করে প্রাসঙ্গিক কবিতার আলোকে পত্রপুট পর্যন্ত তিনি সন্ধান করেন রবীন্দ্রনাথের বৈপরীত্যমূলক দ্বন্দ্ববাদের প্রসঙ্গ। প্রথমে জীবনবোধমূলক বৈপরীত্যে গাঁথা রবীন্দ্রকবিতার আলোচনা, যেমন সুখ ও দুঃখের অবস্থান, প্রেম ও বেদনার বা না-পাওয়ার বর্ণনাচিত্রে বৈপরীত্য চিহ্নিত হয়। আছে জীবন ও মৃত্যুর দ্বন্দ্ববাদও। এইসব জীবনবোধমূলক বোধের সঙ্গেই জুড়ে আছে সমাজবোধ – দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে জগৎবোধ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ববোধে ঐক্যের সমন্বয়ও ঘটেছে। ঘটেছে বাস্তব ও কবিতায় বাস্তবের দ্বন্দ্বাত্মক সমন্বয় – যেমন, ‘সোনার তরী’ কবিতা। এ-সূত্রে গালিব যে ভাববাদ ও বাস্তববাদকে তুলে ধরেন তাতে ভারতীয় দর্শনের শংকর ও রামানুজের মতাদর্শের বৈপরীত্য ধরা পড়ে বলে গালিব জানিয়ে দেন। উল্লেখ করেন মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধরন, যেমন ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায়। যেখানে শ্রেণিবৈষম্যজাত বৈপরীত্য রয়েছে। ‘ছবি’ কবিতায় ‘আছে’ এবং ‘নেই’ – এর বৈপরীত্যমূলক দ্বন্দ্ব নয়, সহাবস্থান আছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রকবিতায় শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্ববাদ বৈপরীত্য সত্ত্বেও সহাবস্থানে, কখনো বা ঐকাত্ম্যবোধে নিয়মিত হয়।

কেবলই সুখের, মঙ্গলের, আনন্দের কথাই রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, তা সত্য নয়। সমগ্রভাবে দেখলে তাঁর কবিতায় বিপরীত দিকগুলোও সমানভাবে আছে, তা-ই গালিবের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তিনি এটা স্পষ্ট করেন না যে, দ্বান্দ্বিতার যে তিনটি পর্যায় আছে – থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিনথেসিস – সেটি কীভাবে রবীন্দ্রকবিতায় বিন্যস্ত হয়ে আছে। বিশেষ করে সিনথেসিস বা সমন্বয় নতুন কোনো সত্য তুলে ধরে কি না, তা বলা হয়নি।

দুই. খ

‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’ – প্রবন্ধটিতে গালিব প্রথমে সীমা ও  অসীমের দার্শনিক তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। এবং এর পরিচয় ভাববাদী হলেও তাতে যে বাস্তববাদও আছে, শেষে সেটি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমেই গালিব দার্শনিক স্পিনোজার মতানুযায়ী সমীম ও অসীম প্রসঙ্গে যে-কথাটা বলতে চাইছেন তা হলো, অসীম সর্বদাই সীমার মাঝে বিরাজ করে। এ-অর্থে অসীম অন্তর্নিহিত (immanent) হয়ে আছে। এই অসীম হচ্ছেন স্রষ্টা। স্রষ্টা অসীম সত্তা, দ্বন্দ্ব-কালের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি সর্বব্যাপী যা-কিছু সসীম সবই এই অসীমে বিরাজমান ও তাঁর অংশ। সসীম সত্তা অন্য একটি সত্তা দ্বারা সসীম; কিন্তু অসীম এরূপভাবে সীমাবদ্ধ নয়। প্রশ্ন ওঠে, সসীম তাহলে কীভাবে অস্তিত্বশীল হয়, যেহেতু তা অসীমের মধ্যে বিরাজিত! স্পিনোজার যুক্তি হচ্ছে, সসীম সত্তাগুলো ঈশ্বরের সঙ্গে নয়, বরং ঈশ্বরের মধ্যে বিরাজমান সত্তার সঙ্গে একীভূত থাকে। অসীম সত্তা সকল কিছুকে নিজের অংশ হিসেবে ধারণ করে। এটাই সর্বেশ্বরবাদ, এটা এরকম বলেই সীমার মাঝে থাকে। স্পিনোজার এই সর্বেশ্বরবাদ ভারতীয় দর্শনেও আছে। উপনিষদকে ভিত্তি করে বেদান্ত দর্শনে যে-ব্রহ্মসত্তা গড়ে উঠেছে সেখানেও ঈশ্বরকে অসীম ও সর্বব্যাপী বলা হয়েছে বলেই গালিব অভিমত দেন।

শংকরের ভাষ্যানুযায়ী, ব্রহ্ম একমাত্র সত্তা; কিন্তু দার্শনিক রামানুজের মতে, এই জগৎ যেহেতু ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, তাই ‘এই সৃষ্ট জগৎ ঈশ্বরের মতোই বাস্তব’। একই সঙ্গে ঈশ্বর ও জগতের বাস্তবতাকে গ্রহণ করার কারণে দ্বৈতবাদ গড়ে ওঠে এবং ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতা বাস্তবতা দিয়ে বিচ্যুত হয়। তবু ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টা হিসেবে গ্রহণ করায় রামানুজের তত্ত্বকে বলা হয়েছে বিশিষ্ট দ্বৈতবাদ। এইসব আলোকেই গালিব রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রতিফলিত সর্বেশ্বরবাদী দিকগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।

তাঁর মতে, সীমা-অসীমের তত্ত্ব ভাববাদী নয়, এক ধরনের বাস্তবতা এই অর্থে যে, এমন ভাববাদকে আমরা বাস্তবে অস্বীকার করতে পারি না। ‘সীমার প্রকাশ’ নামে রবীন্দ্রকবিতাটি তুলে ধরে যে, যে-মানুষ জগতের বর্ণগন্ধরঙের সঙ্গে যুক্ত, সে ব্যক্তি হিসেবে ঈশ্বরের অসীম সত্তারই একধরনের প্রকাশ। গীতাঞ্জলিতে তা আমরা আরো ভালোভাবে পাই। গালিব নানা দৃষ্টান্ত দেখিয়ে রবীন্দ্রকবিতায় এটি যে-অর্থে বিবেচনা করেছেন তার মূল কথাটা হলো, মানুষকে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি-আমি ও বিশ্ব-আমি – দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ব্যক্তি-আমি কবিতা লেখে, সুন্দরকে সুন্দর বলে, ভালোবাসার কথা বলে, আর বিশ্ব-আমি ‘কবিত্বহীন বিধাতা’। বিশ্ব-আমি ব্যক্তি-আমিকে দিয়ে সব করিয়ে নেয়। মানুষের সীমানায় এসে অসীমের সাধনা সত্য হয়। সীমার মাঝে এভাবেই অসীমের সাধনা ও সর্বব্যাপিতা প্রকাশ পায়। এভাবেই গালিব সীমা-অসীমের দর্শনকে ভাববাদ থেকে যুক্তিবাদে নিয়ে গেছেন। এবং গুরুত্বসহ মতাদর্শ-হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। অসীম সত্তার সঙ্গে সম্পর্কের প্রেরণা মানুষকে সত্য ও সুন্দরের দিকে নিয়ে যায়। এবং তা নৈতিক শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ হয়। এখানে হেগেলের বা কিয়ের্কেগার্দের নন্দনতত্ত্ব আলোচিত হতে পারত উক্ত নৈতিকতা কীভাবে শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠে – এই পরিপ্রেক্ষিতে।

প্রশ্ন এই, সর্বেশ্বরবাদ বা সীমা-অসীম আধ্যাত্মিক ও মরমিবাদীদের কাছে সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নাস্তিকের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য কতটুকু? যে-সাহিত্য সসীম-অসীমের নান্দনিকতায় আনন্দময় হয়ে হয়ে ওঠে তা তো আস্তিক-নাস্তিক সকলকেই আনন্দিত করে। ধর্মে যাই হোক, একজন ব্যক্তি সাহিত্যের সঙ্গে অবশ্যই সমানুভূতিতে (empathetic) সম্পৃক্ত হন, সৌন্দর্যভোক্তা হন, নৈতিকতায় শুদ্ধ হন। এই শর্তেই রবীন্দ্রনাথের সসীম-অসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিশুকাল থেকেই মানুষ ছড়া-কবিতার মধ্য দিয়ে সাহিত্যমনা হতে থাকে এবং তা চলমান থাকে জীবনভর। রবীন্দ্রকাব্যে প্রতিফলিত এই বোধ ও তত্ত্ব নির্বিশেষে সকল মানবচিত্তকেই প্রভাবিত করে বলে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

তিন

গালিব জীবনানন্দপ্রেমিক, এই কবিকে নিয়ে তিনি আলোচ্য গ্রন্থে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন – ‘জীবনানন্দ-কাব্যে অস্তিত্ববাদ প্রসঙ্গ’ এবং ‘এক বিপন্ন বিস্ময়।’ ডিসকোর্স দুটি জীবনানন্দের কবিসত্তাকে বিশ্লেষণের আয়ুধ। গালিব এ-সূত্রে অস্তিত্ববাদী তত্ত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক সার্ত্রের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন প্রারম্ভিকায়। রূপরেখাধর্মী এই তত্ত্ব পর্যালোচনায় সার্ত্রের মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণের অস্তিত্ববাদী জীবনচেতনায় উন্মোচন ঘটেছে। মানুষের অস্তিত্ব সত্তার পুরোগামী এবং মানুষ নিজেই তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ব তৈরি করে। এ পর্যায়ে তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দায়িত্ববোধ জড়িত থাকে বলে সে হয় উৎকণ্ঠা, হতাশা, ভয় ও মনস্তাপের শিকার। এসবের ফলাফল হলো মানুষের আত্মনির্মাণের কর্মসূত্র, যা তার আত্মর্ব্যক্তিকতাকে যুক্ত করে দেয় অন্যের সঙ্গে – তাদেরও আত্মনির্মাণের ধারায়। এই ধারায় মানুষ স্বতন্ত্র হয়; কিন্তু অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। তাই তার কর্মকাণ্ড ও সম্পৃক্তি তাকে অপার সম্ভাবনার সম্মুখীন করে, সকলের হয়ে দায়িত্ব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই হচ্ছে সার্ত্রের মতে, মানুষের আন্তর্ব্যক্তিকতার রূপ গঠনের উপায় ও নিজেকে অতিক্রমের মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বে উত্তরণ এবং মানবতাবাদে উপনীত হওয়ার সূত্র। এটাই সার্ত্রের ‘অস্তিত্ববাদী মানবতাবাদ।’ গালিবের এ-বিষয়ক রূপরেখাটি প্রাঞ্জল ও যথেষ্ট স্বচ্ছ স্পষ্ট।

জীবনানন্দের কবিতায় কীভাবে অস্তিত্ববাদী বোধ, নিগূঢ় চেতনা, উৎকণ্ঠা, ভয় ইত্যাদি সক্রিয় থেকেছে, সেসবের টেক্সচুয়াল বিশ্লেষণ করেছেন, যাকে বলা যেতে পারে নিবিড় পাঠ। আরো এসেছে ‘ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বকেন্দ্রিক জীবন পরিক্রমা, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বনির্বাচিত সিদ্ধান্ত সাধন এবং তাদের তদ্যোৎসারিত দায়িত্বের ও দায়ী হবার বোধ’ ইত্যাদি। এসবের ঊর্ধ্বে রয়েছে ‘ব্যক্তি মানুষের আত্মব্যক্তিকতা থেকে আন্তর্ব্যক্তিসত্তায় উত্তরণের এবং অবশেষে আত্ম-উত্তরণের কথা।’ জীবনানন্দের উৎকণ্ঠিত প্রেম সর্বদাই বিষণ্নতার শিকার এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত জীবনের বিবর্তনের অনুভূতিতে বিমূঢ়। ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ত জীবনের প্রতীকায়নে তাঁর কবিতা সুনিবিড়, ক্ষয়িষ্ণু জীবনচিত্রচ্ছবি বারংবার রূপান্বিত হয় প্রকৃতির ও নারীর শোভাভূমিকায়। এসবই ঠিক কথা, তবে গালিব এসবের পশ্চাতে যে সমাজকাঠামো, ঔপনিবেশিক ক্ষয়বোধ আর ব্যর্থতার সত্য লুকানো, তা অনুসন্ধান করেন না। তাঁর উদ্দিষ্ট হচ্ছে শুধু অস্তিÍত্ববাদকে দার্শনিক দৃষ্টিতে অবলোকন করা। এতে আংশিকতার দোষ থাকলেও বিষয়ের নির্দিষ্টতা উদ্দিষ্টকেই ধারণ করে আছে। বিভিন্ন কবিতা ধরে-ধরে গালিব বয়ান করে গেছেন তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়কে। জীবন-জিজ্ঞাসা, নারীপ্রেম, সৌন্দর্য, মৃত্যু, বিনিদ্রা, আত্মহত্যার ঘেরাটোপ – ইত্যাকার ডিসকোর্স জীবনানন্দকে অস্তিত্ববাদী হিসেবে হয়তোবা নির্দিষ্ট করে সত্য; কিন্তু এছাড়াও এই কবি যে নীলিমামগ্ন, আকাশের ওপারে আকাশকে আবিষ্কার, তথা ফেনোমেনলজিকে ভাঙেন সে-কথা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রত্নবাংলায় রূপপ্রতিমায় আবিষ্ট হয়ে চিত্ররূপময় কাব্যচর্চা করে গেছেন, তা অনুপস্থিত থাকে গালিবের আলোচনায়, কেননা এসব চিত্ররূপময় জীবনকাব্য জীবনানন্দের আনন্দবাদকেই প্রমাণ করে। শুধু ভয়, হতাশা, ক্ষয় ও উৎকণ্ঠাই তাঁর একমাত্র পরিচায়ক নয়, তাঁর বোধ-বোধি-প্রজ্ঞা, ভরপঃরড়হধষরংঃ ংবষভ-কে নিয়ে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি রচনা, পাঠককে বিস্ময়রসে, মোহসঞ্চারে আবিষ্ট করে রাখে। কবিতা সংক্রমণ-চারিত্র্য তাঁর কাব্যেই সবচেয়ে বেশি। তাই প্রবন্ধের উপসংহারে গালিব স্বীকার করেন যে, ‘কোন বিশেষ তত্ত্বপরিসরে জীবনানন্দ দাশকে সম্পূর্ণভাবে শনাক্ত করা অসম্ভব।’ তবে কোনো একটি তত্ত্বও যে কবিকে প্রোজ্জ্বল করে তুলতে পারে তার দৃষ্টান্ত গালিবের আলোচ্য প্রবন্ধটি।

তিন. ক.

জীবনানন্দ-বিষয়ক দ্বিতীয় প্রবন্ধটি – ‘এক বিপন্ন বিস্ময়’ – অপেক্ষাকৃত সামগ্রিক জীবনানন্দকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছে। এতে গালিব স্বীকার করেছেন যে, ব্যক্তির সংকট, অনেকটাই সমাজসৃষ্ট, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতই মানুষের জীবনকে তাড়িত করে আত্মহত্যাপ্রবণ, পলায়নপর ও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। প্রসঙ্গত, গালিব বিখ্যাত কবিতা ‘আট বছর আগের একদিন’কে নিয়ে দীর্ঘ বয়ান উপস্থাপন করেন। এতে বিশেষ করে আত্মহত্যা করার প্রবণতাকে সমাজ-দার্শনিকতায় দীর্ঘ ব্যাখ্যার আলোকে তুলে ধরেছেন। জীবনানন্দের নিজের কী কোনো আত্মঘাতী প্রবণতা ছিল?

তাঁর ট্রামের তলায় পড়ে যে মৃত্যু, তাও কী স্বেচ্ছাকৃত? মৃত্যুচেতনা প্রায় কবিদেরই কাব্যরস সৃষ্টির বিষয়, জীবনানন্দের মৃত্যুচেতনাও সমস্ত সৌরমণ্ডল ও প্রাণ-প্রকৃতিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। পরিশ্রান্তি, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনালগ্ন, অবসন্নতাও এর অনুষঙ্গ; কিন্তু কবিতার বিষয় আর কবি-নিজে এক কথা নয়। বিষয়টি হচ্ছে রূপকীকৃত প্রতীকীত, আর কবি-আমি হচ্ছেন আন্তর্ব্যক্তিক মানুষ – যিনি দুঃখবোধ দ্বারা, মৃত্যুচেতনা দ্বারা গ্রস্ত হতেও পারেন। আমরা যদি ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটির রূপক উন্মোচন করি তবে বলতেও পারি, এই আত্মহত্যা হচ্ছে কবিতা-পারসোনার বোধিলাভের, প্রজ্ঞা অর্জনের পন্থা। অশত্থ গাছে বুদ্ধের বোধিলাভের অনুষঙ্গ কি মনে উঁকি দেয় না? কবিতার পারসোনাও জাগতিক যাবতীয় সুখবৈভবকে অতিক্রম করে বোধিতে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছে। আত্মহত্যা এই অর্থেই, কারণ জীবন তখনো প্রচুর ভাঁড়ার নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্যে। আর সে-জীবন সকলের সঙ্গে সম্পৃক্তির আহ্বান জানায়। একাকিত্ব, বিষণ্নতা, নিস্তব্ধতা, আত্মহত্যা ইত্যাকার অবস্থা, যা ধ্যানেরই নানা রূপকত্ব, সেসব অতিক্রম করে জীবনরূপকের সমুজ্জ্বল উপস্থিতি, সমবেত জীবনধ্বনিই কবিতাটির ডিসকোর্স। গালিবও স্বীকার করেছেন যে, পৃথিবী ব্যথা-বিহ্বল হলেও শেষাবধি ‘শত শত/ শত জলঝর্ণার ধ্বনিই আশা-শুশ্রƒষায় অপরিমেয় আনন্দের ভাঁড়ার। তাই বিপন্ন বিস্ময় শেষাবধি আলোর বলয়ে আবর্তিত হতে থাকে। সেখানে ইতিহাস এসে কথা কয়। গল্পের পাণ্ডুলিপি রচনার একান্ত আয়োজন ঘটে।

চার

পরিশিষ্ট অংশে গালিব তাঁর রচিত কবিতাগুলি সন্নিবিষ্ট করেছেন। জীবনের নানা পর্যায়ে, নানা উপলক্ষে এগুলি রচিত। কোনো নিঃসঙ্গ মুহূর্ত, প্রেম, স্রষ্টার মতো আমি-সত্তার আত্মবয়ানই বিষয়-আশায়। বোঝা যায়, তাঁর একটি মৃদু কবিসত্তা ছিল, যা হয়তো চাপা পড়ে গেছে পাণ্ডিত্য আর অধ্যাপনার চাপে। কবিতাগুলি সরল, ভাষার চাল উনিশ শতকী কাব্যভাষার মতো। এগুলো তিনি স্মৃতিকণা হিসেবেই বইটিতে রেখে দিয়েছেন। লোকান্তরিত গালিবের কবিমনটি এই কয়টি কবিতায় প্রচ্ছন্নীভূত।

গ্রন্থটি গালিবের শাশ্বত জীবনবোধ ও দর্শনের প্রজ্ঞামণ্ডিত জ্ঞানচর্চার যৌগপদ্য। তাঁর মৃদু, নম্র অথচ প্রাঞ্জল স্বভাবের অনেক বৈশিষ্ট্যই এই কাব্যভাবনার মধ্যে দিয়ে স্ফূর্তি লাভ করেছে। পাঠকের প্রাপ্তি হচ্ছে, কাব্যভাবনাই কেবল নয়, দর্শনের অনেক তত্ত্ব সম্পর্কে সহজ ভাষ্যের মুখোমুখি হতে পারার অভিজ্ঞতালাভ এবং কবিতা ও দর্শনের দ্বৈততাকে একীভূত রূপে দেখতে পারার তুষ্টি। এই গ্রন্থের বহুল পঠন পাঠকদের জন্যে আনন্দদায়ক ও জরুরিও বটে।