কাঁথা               

মাঝেমাঝে মনে হয় হাওয়ায় শব্দ ওড়ে। কারা যেন গান গায়। নৌকা ভাসায়। আবছা হয়ে যাওয়া নীল জলে, ভেসে থাকা সমুদ্রের ফেনার মতো পুরনো সেসব দিন ঘুরেফিরে আসে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে নিজের ভাবীকাল, অতীত, বর্তমান একাকার করে দেখা বড় বেদনার। কেন এই জন্ম, এখানে কী পাওয়ার আছে? সব হারানোর আগে কোথায় দাঁড়াবে সে? কোন মাটিতে? তখন বড় যন্ত্রণার মতো সেইসব বীভৎস গর্জন কানের পর্দায় ধাক্কা মারে।

আর বোজা চোখের পর্দায়, বিনা আয়াসেই ফুটে ওঠে কালো কালো ছবি। বড় বড় নেগেটিভের মতো সেসব ছবি চলমান মানুষের। তাদের দেহের চারপাশের রেখাগুলি স্পষ্ট, বাদবাকি সবটাই অন্ধকার। তারা নড়েচড়ে ওর চোখের সামনে, ক্রমশ ঘিরে ধরে ওকে। চোখ বুজলেও মিলিয়ে যায় না।

সুজাতা উঠে পড়ে। বই নিয়ে বসে। অন্ধকার কাটে ধীরে ধীরে। ও প্রার্থনা করে। মার্জনা চায় এ-জন্মের ঈশ্বরের কাছে, অবোধ ইচ্ছার, বাসনার, ঊর্ধ্বে ওঠা গেল না বলে।

এ বারান্দায় রোদ্দুর বড় খামখেয়ালে আসা-যাওয়া করে। বৃষ্টিও তাই। কখনো তীব্রতায় টের পাওয়া যায়। কখনো ছুঁয়ে যায় হালকা পালক হয়ে। এ-ঘরে, এ-নির্জনবাসে, কেউ কেউ টোকা দেয় অতীত স্মৃতির মতো। তাদের মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে না ও। থাক। সেসব প্রাপ্তিরও মূল্য আছে। যেসব জমা খরচের খাতা বন্ধ করে রেখেছে, মূল্যহীন হলে তা অনায়াসে খুলে রাখা যায়।

সামনের জানালাটা কাচের। সকাল হলেই খুলে দিলে চোখে পড়ে রোদ্দুরে উপত্যকাটা হেসে উঠেছে। তখনই ইমলি আসে। এক হাতে দুধ চায়ের কেতলি আর অন্য হাতে লিকারের ফ্লাস্ক। কাঁধের ব্যাগে থাকে বিস্কুটের রকমারি প্যাকেট।

‘মাইজি, লিকার লিবে? না দুধ চা দিব?’

হাসে ও। ‘আজ তবে দুধ চা দে।’

গাঢ় প্রায় খয়েরি চা কাপে ঢেলে, দুখানা বিস্কুট টেবিলে রাখা কাচের প্লেটে সাজিয়ে চলে যায় মেয়েটা। এখানে একদিন বাদে কাগজ পাওয়া যায়। বাংলা কাগজ। নানা সন্ত্রাসের গল্পে খবরের কাগজ গরম হয়ে আছে। কাগজ খুলেও পড়তে ইচ্ছে করে না ওর। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না, তা বড় অসহনীয়!

কাগজ হাতে ধরে ও ইমলির চলে যাওয়া দেখে। দরজা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে মেয়েটা। কোমরে ঘাঘরার ওপরে ছোট কুর্তি। মাথার চুল বেগুনি ক্লিপে টেনে বাঁধা। হাসিমুখে সরল টানা দুটি চোখ। ইমলির পায়ে মল আছে। ঝুমঝুম বাজে। ইমলি
এ-কটেজের মালিকের দূরসম্পর্কের নাতনি। মা-বাপ মারা যেতে ও নানির কাছে ছিল। এই দাদু ওকে কিছুদিন হলো নিয়ে এসেছে। এরা সবাই ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ইমলিকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো মনে হয় ওর। বারো কী তেরো বছর বয়স হবে। স্কুলে পড়ে। এখন স্কুল বন্ধ বলে এই হোমস্টেতে কাজ করতে এসেছে। না হলে ও কিছুটা দূরে ওর নানির বাড়িতে থাকে।

একদিন ইমলি জানতে চেয়েছিল, ‘ম্যাডাম আপকা ঘর কাঁহা হ্যায়?’

‘ঘর নেই।’

‘ঝুট।’ বলে হেসেছিল ও। ‘ঘর হ্যায়। সাচ্‌ মে হ্যায়।’

ইমলি চলে যাওয়ার পর ঘর নিয়ে ভেবেছিল ও। ওর ঘর আছে, না নেই? এ-প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্য অনেক সময় লাগবে তো। তাহলে কী ও মিথ্যে কথা বলছে, ভাবছিল সুজাতা। ভাবতে ভাবতেই কাগজ পড়ছিল, চা খাচ্ছিল।

একদম ছোটবেলায় হাসিরাশি বলে একটা বই এনে দিয়েছিলেন বাবা। বইটা হাতে ধরিয়ে একটা ছোট মেয়ের ছবি দেখিয়ে আদর করে গাল টিপে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা বইয়ের খুকুমণি। আর এটা আমার খুকুমণি।’ সেই খুকুমণি বড় হয়ে সুজাতা হলো।

ক্লাস সিক্সে ইতিহাস বইয়ের পাতায় প্রথম বুদ্ধদেব আর সুজাতার কথা পড়ে ও। ভারী অবাক হয়েছিল পড়ে। ও নিজে তো একজন সুজাতা। বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, বাবা কী তাহলে ওর নাম রাখার সময় ইতিহাস বইয়ের সুজাতার কথা ভেবেছিলেন?

বাবা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ মা। সুজাতা পরম শ্রদ্ধেয়। গৌতম বুদ্ধ বোধিলাভের আগে ওই সুজাতার হাতের পায়সান্ন খেয়েছিলেন। আমার ভাবা ছিল, মেয়ে হলে নাম রাখব সুজাতা।’

মাঝেমাঝে মনে হয় ওর জীবন বড় টুকরো হয়ে যাওয়া ধাঁধার মতো। ইচ্ছাধীন নয়। একদম ছোটতে ও ছিল একজন খুকুমণি। এখনো কী তাই রয়ে গেল?

আজ আবার কাঁথাটা রোদে দিয়েছে ও। এই কিছুদিন আগেও কাঁথাটা দু-হাতে ঝেড়ে রোদে দিয়েছিল। ঠাকুমার হাতে বানানো কাঁথাটা মায়ের তোরঙ্গে রাখা ছিল। মা দাদার কাছে দিল্লিতে বরাবরের মতো চলে যাওয়ার সময় ডেকে পাঠিয়েছিল ওকে। ওই তোরঙ্গটা তখনই হাট করে খোলে। ওদের কাছে ছোটবেলায় ওই তোরঙ্গ ছিল রহস্যের খনি। ঠাকুমা কোন নির্জন দুপুরে তোরঙ্গ খোলার সময় ঘর থেকে বার করে দিতেন ওদের। এতদিন পরে সে-তোরঙ্গের সব রহস্য ফাঁক! পুরনো কিছু চাদর, কাপড়, পেতলের ফুলদানি আর পাউডারের কৌটোর মাঝে ভাঁজ করে রাখা ছিল কাঁথাটা। ও হাতে তুলে নিয়েছিল। এখানেও ও এনেছে কাঁথাটা।

মা বলেছিল, ‘ভালো জিনিসই ধরলি তুই। ওটা আসলে তোর জন্মের পর মা বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অনেকদিন বাদে বংশে মেয়ে হলো। এই কাঁথাটা পেতে ওকে শুইয়ো।’ 

হালকা হলুদ কাপড়ের ওপর নীল, লাল, বেগুনি, সবুজ সুতোর কারুকাজ। ময়ূরপঙ্খি নাওয়ে বৈঠা হাতে বসে আছে এক কন্যা। কন্যার চুলের রং নীল দেখে ও হেসে বলেছিল, ‘ওমা, চুলের রং কালো হবে তো। নীল কেন?’

মা বলেছিল, ‘বোকা মেয়ে, কালো অশুভ। তাই কালো চুল নীল হয়েছে। তবে তোকে আমি এ-কাঁথায় তেমন শোয়াইনি। এত সুন্দর কাঁথা পেতে কি বাচ্চাকে শোওয়ানো যায়? তুই-ই বল? তুলে তুলে রেখেছিলাম বলেই তো এখনো এত সুন্দর আছে।’

কাঁথাটা ভালো করে দেখছিল ও। ঠাকুমা খুব সুন্দর ছবি আঁকতেন। আলপনা দিতেন। এমনকি একবার লক্ষ্মীপুজোর পট নিজের হাতে এঁকেছিলেন। কাঁথাটার ছবিও ওনার হাতেই আঁকা হবে। সারা জমিতে জলের ঢেউ ছোট ছোট সমান ফোঁড়ে তোলা। ছবির ময়ূরপঙ্খির গলার নীল রং, কন্যার বসে থাকার ভঙ্গি, সবই মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। যখনই ও খোলে কাঁথাটা, মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে। আর মনে মনে ভাবে, বিষের রং নীল। বিষ গলায় ধারণ করেই মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছেন। এ কন্যা কি তবে বিষই শিরোধার্য করেছে?

ঠাকুমা কী একথা জানতেন না? ঠাকুমা হয়তো সবই জানতেন। বাবার কাছে শুনেছে ও, স্বামীর কোনো অনাচারের প্রতিবাদে সচ্ছল শ^শুরবাড়ি ছেড়ে সন্তান কোলে বরাবরের মতো বাপের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। আর ফেরেননি।

দুঃখী বাবা-মায়ের সংসারে পাঠশালা খুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে, আচার-বড়ি বানিয়ে বিক্রি করে, সেলাই করে, নিজের আর ছেলের খরচ চালাতেন। কখনো কারো সাহায্য নেননি। হাজার অনুরোধেও শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ ডিঙোননি। স্বামীর মৃত্যুর পর শাঁখা-সিঁদুরের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছু ত্যাগ করেন। ছাড়তে পারেননি শুধু পান খাওয়ার নেশা। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর জর্দা দেওয়া এক খিলি পান খেতেন তিনি। মুখে ভুরভুর করত জর্দার গন্ধ।

নিজের বাড়িটাই ছিল বাবার মামার বাড়ির মতো, আদর-আবদারের জায়গা। ছুটিছাটায় ওই বাড়িতে গিয়ে পরিবারের  মানুষজনের সঙ্গে বাবা কাটিয়ে আসতেন বেশ কিছুদিন। সবটাই হতো তাঁর মায়ের সম্মতিতে। নিজে চলে এলেও বাবাকে নিজের পরিবারের মানুষজনের থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। নেহায়েতই ঘরোয়া মহিলা হয়েও এতটাই বুদ্ধি রাখতেন তিনি। 

শুধু কাঁথা নয়, ঠাকুমার হাতের আচার ছিল এক শিল্প। আমের সময় আর কুলের সময়, বড় বড় পাথরের থালা বেরোত সাবেকি সিন্দুক থেকে। তারপর সেসব ধুয়েমুছে বাইরের বড় তক্তপোশে সাজানো হতো সার সার। রান্নাঘরে দুপুরের ঢিমে আঁচে কাটা আমের খোলা ছাড়ানো টুকরো জ্বাল দেওয়া হতো গুড়ে। মাখামাখি হলে রসে জবজবে সেসব আম ঢেলে দেওয়া হতো পাথরের থালায়। তারপর মশলা ছড়িয়ে সেই থালা শুকোত রোদ্দুরে। পাশেই কাসুন্দির আম, ডাঁটার মিষ্টি আচার, এমনকি এঁচোড়ের আচারও সাজানো থাকত বড় বড় পাথরের সাদা-কালো বগি থালায়। কতদিন নির্জন দুপুরে ঠাকুমার ঢুলতে ঢুলতে ঘুমিয়ে পড়া পা ডিঙিয়ে ওরা আচার চুরি করেছে।

ঠাকুমা বলতেন, ‘আমার কাছে চাইলেই হয় তো। চুরি করা কেন?’

ও আর ছোড়দা চুরি করেই অর্ধেক আচার সাফ করে দিত। বড়দা গম্ভীর মুখে চশমা চোখে বই পড়তে পড়তে হাত পাতত, ‘আমাকে দিলি না? দে আমাকে। না হলে বলে দেব।’

তখন ও ছিল বাড়ির খুকুমণি। সুজাতা হয়েছিল তার অনেক পরে।

সেসময় দিন বড়-ছোট ছিল। ছোট ছোট পাখির মতো একেকটা দিন আসত আর ফুরুত করে উড়ে যেত। দেখতে দেখতে দিন ফুরোত, তারপরে রাত। মায়ের পাশ ঘেঁষে শুয়ে থাকতে থাকতে কবে যেন খুকুমণি থেকে দিদিমণি হয়ে গেল ও। স্কুল, পড়ানো, একঘর ছেলেমেয়ে নিয়ে আর একরকমের জীবনযাপন।

আসলে বরাবরের যাপনেই গড়ে ওঠে ভিত, নিজস্ব চিন্তাভাবনা। আর হাওয়ায় ওড়া রঙিন স্বপ্নেরা। ওই স্কুলে থাকতে থাকতেই এক বিকেলে দেখা হয়েছিল অরুণাভের সঙ্গে। অরুণাভ সেন। ব্যাংক অফিসার। একই প্ল্যাটফর্মে দুজনকেই এসে দাঁড়াতে হতো ওদের। তারপর ফেরার ট্রেন ধরত ওরা। ফিরত এক কামরায়। বেশ কিছুদিন একেবারে কাছাকাছি, পাশাপাশি। পরে ওর বারবার মনে হয়েছে, অরুণাভের সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হতো হয়তো। ওর জীবনের রংচঙে মলাটটা এভাবে ধূসর হয়ে যেত না তাহলে।

বুদ্ধদেবকে পায়সান্ন নিবেদন করা সুজাতার সম্পর্কেই বা কতটুকু জানে ও? ইতিহাস বইয়ের বাইরে সুজাতা বা বুদ্ধের স্ত্রী গোপা অজানাই থেকে গিয়েছে। মাঝেমাঝে সুজাতার একথাও মনে হয়, বুদ্ধদেবের জীবনীকাররা প্রতিটি অধ্যায় বুনেছেন খুব যত্ন নিয়ে। শুধু বুদ্ধদেবের জীবনের বিড়ম্বিত নারীচরিত্রটি আর একটু জায়গা পেত যদি। কাহিনিতে সুজাতার পায়সান্ন নিবেদনের বর্ণনায়ও যেটুকু যত্ন আছে, সেটুকুও প্রাপ্তি নেই পরিত্যক্ত গোপার কথায়। দাম্পত্য মুহূর্তগুলি এত মূল্যহীন হয়ে গেল কেন? এমনকি শিল্পীর তুলিতেও গোপার সঙ্গে পুত্র রাহুলের ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষার একমাত্র ছবিটিই বরাবরের দ্রষ্টব্য তো।

পরে ওর যখনই অরুণাভের সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হতো মনে হয়েছে, তখন আবার একথাও ভেবেছে, প্রতিটি ক্ষণের আলাদা মূল্য আছে। বাধা অতিক্রমের দৌড়ের মতো সারাজীবন সেগুলি টপকাতে টপকাতে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

কোথা থেকে কিসের একটা টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে। চোখ খোলে সুজাতা। চোখ খুলে, আয়েসের ঘুম ছিটকে গেল কেন – ভাবছিল ও। বুঝল তখুনি। ইমলি আসছে। ওর দু-হাতে দুপুরের খাবারের থালা। ঘণ্টা বাজছে ওর ভেড়ার গলায়। সেই আওয়াজেই হালকা ঘুম ভেঙেছে।

সাদা একগা লোমওলা ভেড়া। গলায় ঘণ্টি বাঁধা। ইমলির পিছু পিছু এসে বাইরের ঘাসজমিতে গলা নামিয়ে ঘাস খাচ্ছে।

‘ও ম্যাডাম, খানা আনলাম। গোসল হয়েছে?’

দোআঁশলা একটা বাংলা বলে ইমলি। বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের থেকে শিখেছে হয়তো। বাড়িতে হয়তো বাংলা বলেই না।

‘স্নান করতে পারিনি। ভীষণ শীত করছে। জ্বর এলো বোধহয়।’

‘বুখার নাই। বডি থোড়া গরম আছে।’

নিঃসংকোচে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছিল মেয়েটা। গলায় ওর হাত ঘুরছিল। চুপ করে বসে ছিল সুজাতা। ইমলির ঠান্ডা হাত গড়িয়ে গড়িয়ে ছুঁয়ে  দিচ্ছিল সুজাতার গাল, কপাল। ওর স্পর্শের মধ্যে ডুবে থাকা ভালোবাসাটা টের পাচ্ছিল ও।

এসব সময়েও সিনেমার নেগেটিভ দৃশ্যের মতো কালো কালো ছবি ফোটে ওর চোখের সামনে। প্রথম অঙ্ক, শেষ দৃশ্য। কিংবা শেষ অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য।

শাশুড়ি ছেলেকে বলছেন, ও শুনছে পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে – ‘শেষ পর্যন্ত একটা পাগল ধরে নিয়ে এলি? ওদের গুষ্টি পাগল। ওর ঠাকুমার কীর্তি আর জানতে বাকি নেই। আমার শ^শুরবাড়ির বংশটাই খারাপ করে দেবে।’

আর বাধ্য ছেলে, দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কথার কোনো প্রতিবাদ নেই।

এই  ‘হোমস্টে’র  চারপাশে বড় বড় গাছ। আর সামনে যতদূর চোখ যায় ঢালু উপত্যকার বিস্তার। শীত এলে বরফ পড়ে ওই উপত্যকাতে। কুচো কুচো বরফ। মাঠ নাকি সাদা হয়ে যায়। ইমলি বলছিল।

একা একা এখানে দিন কাটালেও কেমন যেন ভরাট লাগে সবকিছু। ওই উপত্যকার ঢালু হয়ে যাওয়া সবুজ ছড়ানো জমি, আকাশের মাথা নিচু করে ছুঁয়ে দেওয়া মাটি, এমনকি নিচু জমিতে জমে যাওয়া বর্ষার জলেও ও আর এক সুজাতার ঘোরাফেরা টের পায়। সবকিছু মিলিয়ে এক অচেনা সান্নিধ্য যেন। বর্ষার জলে কিছু মরশুমি ফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হয়েছিল। এখন সেসব গাছের বন হয়েছে। মাথা উঁচু করছে তারা। এতদিন জানা ছিল গাছপালা নিরীহ। এখানে এসে তাদের নিঃশব্দ জেদ অনুভব করতে পারছে।

বেশ কিছুদিন হলো একদম নিভে গিয়েছে সুজাতা। জ্বলা মোমবাতি নিভে যাওয়ার পর ধোঁয়া ওঠে। সামান্য ধোঁয়া। একটু পোড়া গন্ধ। বাতির মুখ পুড়ে কালো হয়ে যায়। ওর সেরকম হয়েছিল কি? শুধু মনে আছে ছোড়দা এসেছিল। ওর জিনিসপত্র তুলে নিয়েছিল নিজের গাড়িতে।

আর আঙুল তুলে শাসিয়েছিল, ‘একেবারে শেষ করে এনে খবর দিলেন। ডিভোর্সের মামলা করবেন না। আমি দেখব আপনাদের ছেলে যাতে কোনোদিন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আর একটা মেয়ের সর্বনাশ না করতে পারে। কথাটা মনে রাখবেন।’

ওর বাবার কথা মনে পড়ছিল। বাবা বলতেন, ‘প্রতিশোধ নেওয়ার কথা কখনো ভেবো না। একটাই জীবন। সৎবুদ্ধি আর শুভ লক্ষ রেখো। সব শোধবোধ তোমার হাতে নেই।’

ছোড়দা কি বাবার শেখানো কথা ভুলে গেল? ক্রোধে কি মানুষ হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলে?

ছোড়দা সংসার করেনি। কিছু পুষ্যি আছে ওর। তাদের খাওয়া-পরা এমনকি প্রতিষ্ঠা নেওয়ার দায় নিয়ে ও চলে। বড় চাকরির বিশাল মাইনের বেশিটাই যায়। বাকিটা লাগে আত্মীয়স্বজন-পাড়াপড়শির কাজে। আধা-সন্ন্যাসী সেই মানুষটার মুখে অমন কথা! অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ও!

সুজাতা নিজে কখনো প্রতিশোধের কথা ভাবেনি। শুধু প্রতিরোধ গড়েছে।

এই পাহাড়তলির নির্জন ঠিকানা ছোড়দার কাছেই ছিল। কাজের ফাঁকে অথবা কাজের দরকারে দিনরাত ঘুরে বেড়ায়। চেনা জায়গায় চেনা লোকেদের ভরসায় ওকে রেখে দিয়ে গিয়েছে। আবার আসবে। ওকে দেখে যাবে। ফিরে যাওয়ার আগে সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসা বেশ কিছু বই, একটা টুকটুকে লাল মলাটের ডায়েরি আর পেন দিয়ে গিয়েছে ওকে। বলেছে, ‘আগে তো লিখতিস, আবার শুরু কর। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখিস।’

বইয়ের পাতা উলটে দেখেছে ও। মন দিতে পারেনি। ডায়েরির প্রথম পাতাটায় লেখা আছে, ‘খোয়াইস হ্যায়, পর পঙ্খ‌ নেহি।’

কথাটা ভাবছিল ও। ‘স্বপ্ন অনেক ছিল, কিন্তু ওড়ার ডানা নেই।’

ভাবলে ইলাস্টিকের মতো যে-কথা বেড়ে যায়, এ সেরকম একটা কথা। তাই ভাবেনি আর।

জেগে থাকলেও অনেক সময় ও  চোখ বুজলে ছবি দেখতে পায়। নেগেটিভে দেখা ছবির বিষয়বস্তু যদিও আগের। একটা ছবি বারবার আসে। কয়েক মাস আগে ওরা টেনেহিঁচড়ে রুমেলাকে শিকলবন্দি করে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। ওই ছবিটা ও দেখতে চায় না একদম। তবু আসে।

ছবিটা সন্ধেবেলার। সন্ধে দেওয়ার জন্য গা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে ও প্রস্তুত হচ্ছিল তখন। আঁতকে উঠে ছুটেছিল তেতলার সিঁড়িতে। রুমেলার বিকট চিৎকারে ও দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। ওর নাকের ডগায় সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল রঞ্জন। ও বাড়ির ছোট কাকিমার ছেলে। রুমেলার বর।

দেখেছিল রঞ্জনের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে অরুণাভ। সেদিনও একটা কথা বলেনি ওর একান্ত কাছের মানুষটি।

এর আগে কী ঘটেছে জানে না ও। কিন্তু সেদিন ওর চোখের সামনেই ঘটেছিল সব, যা চিরকাল ওর কাছে ভয়াবহ স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।

ওর শ্বশুরবাড়িতে সন্ধে দিতে হয় নতুন বউকে। সকালে বাসি কাপড় ছেড়ে, ঠাকুরঘরে চন্দন বেটে, ফুল তুলে পুজো সেরে নতুন বউ সকালের প্রথম চা বানায়। কাচের কেতলিতে ঢেলে সুদৃশ্য কাপ-ডিশে সেই চা, বিস্কুট সহযোগে পরিবেশন করে বাড়ির সব গুরুজনকে। তারপর সে নিজের চা খেতে পারে। জুড়িয়ে জল হয়ে গেলে তখন গরম করে চুমুক দেওয়ার পালা। সংসারে শ্রী রাখতে কিছুই তো ফেলা যাবে না। এসব কথা ওকে বলেছিল ছোট খুড়শাশুড়ির ছেলের বউ রুমেলা। হেসে হেসে বলেছিল, ‘নতুন নতুন এসেছ। দু-একদিন যাক। এ-বাড়ির রাষ্ট্রপতির ফরমান জারি হয়নি এখনো। হবে, তোমাকেও শেখাবে।’

এখানে এসেও সেই কলরোলে ভরা  বাড়িটার কথা মাঝেমাঝেই মনে পড়ে ওর। অনেক লোক, উঁচু পাঁচিল দেওয়া বিশাল বাড়ি, গ্যারেজে খানচারেক গাড়ি, চাকর-বাকর। সবকিছু বড় বেশি ঝলমলে! নেহাতই শখে অরুণাভের চাকরি করা। শহরে ওদের চার-পাঁচখানা কাপড়ের দোকান। বনেদি একান্নবর্তী পরিবার।

সুজাতার মা বলেছিলেন, ‘পারবে না। ওই পরিবেশে ওর পক্ষে …। আমাদের আদরে বড় হওয়া মেয়ে, পারবে না। তার ওপর ওদের নানা সংস্কার আছে, জাতে মিলছে না। নানান কথা হবে সর্বক্ষণ। ওখানে বিয়ে করতে বারণ করো তুমি।’

স্বাভাবিক বুদ্ধির কথা। শোনেনি কেউ। ও তো তখন যে-কোনো মূল্যে অরুণাভকে চায়। বাবা শুধু বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আস্থা রাখি ভবিতব্যে। সব ঠিকঠাক হবে।’

হয়নি। সেদিন সন্ধ্যায় রুমেলা নিজের স্বামীকে কাজের মেয়ের সঙ্গে লিপ্ত অবস্থায় ধরে ফেলে বাড়ি মাথায় করছিল। বাড়ির সম্মান যায় যায়। তাই তাকেই যেতে হলো চিলেকোঠায়।

নিজের শাশুড়ির কাছে তখন সব কথা বলত সুজাতা। সিঁড়ি-ফেরত ও ছুটেছিল তাঁর কাছেই অভিযোগ জানাতে।

তিনি বলেছিলেন, ‘সন্ধে উতরে যাবে। যাও আগে সন্ধে দিয়ে এসো। পরে শুনছি সব।’

চিলেকোঠার ঘর থেকে তখনো ভেসে আসছে কান্না। সুজাতা বলেছিল, ‘আমি এখন সন্ধে দিতে পারব না। এক্ষুনি রুমেলার কাছে যাব।’

আবার সে ছুটেছিল সিঁড়ির দিকে। বন্ধ দরজায় ধাক্কা মেরেছিল বারবার। পেছন থেকে শাশুড়ির চাপা গলার ডাক শুনেও অগ্রাহ্য করেছিল। উনি ডাকছিলেন, ‘সুজাতা, সুজাতা, শোনো।’ ও সাড়া দেয়নি।

রুমেলার বাপের বাড়ি ছিল শিলংয়ে। বিয়ের সময় মা ছিল না ওর। বাবাও বেশ অসুস্থ ছিলেন। মেয়ের কাছে আসা-যাওয়ার সুযোগ না থাকায় সেন বাড়ির লম্বা হাত আরো লম্বা হচ্ছিল। রুমেলা মারধর খেয়ে, মাঝেমধ্যে চিলেকোঠায় বন্দি হয়ে, কেমন যেন পালটে যাচ্ছিল দিনদিন। হাসি নেই, রাগ নেই।

ঠিক তার পরেই দ্বিতীয় অপরাধটা করে ও। টিকিট কেটে রুমেলাকে তুলে দিয়ে আসে গৌহাটির ট্রেনে। সঙ্গে পাঠিয়েছিল নিজের বাপের বাড়ির আশ্রিত, একান্ত অনুগত গোকূলকে। সুজাতা বুঝেছিল, কিছু একটা করতে হবে। না হলে মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না।

এখানে চারপাশে পাহাড়, খোলা জমি, বড়-বড় গাছ। সন্ধে হলে ঠান্ডাটা বেশ টের পাওয়া যায়। ফ্লাস্কে রেখে যাওয়া ইমলির চা, সেঁকা বাদামের সঙ্গে বেশ লাগে তখন।

পাহাড় ডিঙিয়ে অন্ধকার নামে ঝুপঝুপ করে। নিজের ঘরে বই খুলে বসে ও। ঠিক আটটায় ডিনার। একগ্লাস গরম দুধ ফ্লাস্কে রেখে যায় ইমলি। ডিনারের পর লিখতে বসে সুজাতা। কখনো বা পেনসিল স্কেচ করে। চারপাশের প্রকৃতি উঠে আসে ডায়েরির সাদা পাতায়। এ-দক্ষতা ওর স্কুলের সময় থেকেই আছে। বন্ধুদের মুখ স্কেচে ফুটিয়ে উপহার দিত।

সেদিন চেষ্টা করছিল আবার। ও বাড়ির কাজের মেয়ে সবিতা, দারোয়ান রামদুলাল, পুরোহিত মশাইয়ের পাশ ফেরানো মুখ আর টিকিসমেত মাথা, সব এলো এক এক করে। রুমেলার আহ্লাদি চাহনি ও আঁকল অবহেলায়। কিন্তু বার তিনেকের চেষ্টাতেও অরুণাভের ছবি এলো না। আঁক কাটে আর কাগজ ছিঁড়ে গোল্লা পাকায়। শেষে হাল ছেড়ে ও বাড়ির বাদবাকি সদস্যকে সাদা পাতায় ফোটানোর অনেক চেষ্টা করল। নাক হয় তো চোখ হয় না, গলা হয় তো চুলের কায়দা আসে না। কিছুক্ষণ পরে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। কাঁহাতক পাতা নষ্ট করা যায়।

শেষে সব ছেড়েছুড়ে ইমলির একটা স্কেচ করল। ইমলি আর ওর ভেড়া, ভেড়ার গলার শব্দকরা ঘণ্টি, পেছনের লম্বা লম্বা গাছ আর ঘাসজমি, সটান উঠে এলো ওর ডায়েরির সাদা পাতায়। মোবাইলে ছবি তুলে রেখে ইমলিকে ছবিটা দিয়ে দিয়েছে ও। মেয়েটা খুব খুশি হয়েছে। বলেছে, ওকে একদিন আপেলের আচার বানিয়ে খাওয়াবে।

এই পাহাড়তলিতে সবকিছুই আছে, তবে একটু দূরে দূরে। শুধু মানুষ নেই তেমন। বেশ কিছুটা দূরত্বে বাজার, সেখানেই চায়ের দোকান। এখানকার নিরিবিলি আবহাওয়াতেও মাঝেমাঝে ঢুকে পড়ে পুরনো দূষিত হাওয়া।

মাথার মধ্যে চাপ তৈরি করে। বাবা চলে গিয়েছেন ওর বিয়ের ঠিক পরে পরেই হার্ট ফেল করে। তখন ও ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে বিবাদে, রুমেলাকে নিয়ে নানা প্রতিবাদে। কিছু কিছু কথা বাবারও কানে গিয়েছিল হয়তো। আশাভঙ্গের বেদনা সইতে পারেননি। মা বড়দার কাছে আছে এখন। সুজাতার কথা মাকেও সবটা বলা হয়নি।

রুমেলাকে ওরা ওই ঘরেই আটকে রেখেছিল, টানা তিনদিন। সুজাতা প্রতিবাদ করেছিল। বারবার অনুরোধও করেছে। বলেছে, ‘ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। এভাবে ওকে আটকে রাখতে পারো না তোমরা। আমি থানায় রিপোর্ট করব।’ কোনো কাজ হয়নি। ওর ওপর নজরদারি বেড়েছিল শুধু।

তারপর মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো ওরা। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল রুমেলা। একপাশে চুপ করে বসে থাকত। সেদিন বুঝেছিল সুজাতা, শ^শুরবাড়ির কথায় চাকরি ছেড়ে ও খুব ভুল করেছে। হলোই বা প্রাইভেট স্কুলের কম মাইনের চাকরি। তবু তো নিত্যদিন বাইরের আকাশ ছুঁয়ে থাকা। ওই কাজটার সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে থাকা বাইরের আলো-বাতাস, ছোট ছোট একান্ত আমোদ-আহ্লাদ, হাতের ফাঁক গলে কখন যেন হারিয়ে গিয়েছে। আর ফিরে আসবে না। 

ঘুম থেকে উঠে অবধি গাঢ় কুয়াশার চাদরে সবকিছু ঢাকা দেখছে সুজাতা। সূর্য ওঠেনি। ঝিমঝিমে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। একটা গোলাপি ছাতা মাথায় দিয়ে ফ্লাস্কে করে ইমলি চা দিয়ে গিয়েছে। সেই চা এখনো পড়ে আছে।

সকাল থেকে ওর মন ভালো নেই। ক্যালেন্ডারে ১৪ই আগস্ট তারিখটা দেখে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। ছোড়দার ফোন ধরতে গিয়েই ঘুম ভাঙল।

ছোড়দা ফোনে সুর করে গাইছিল, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, খুকুমণি।’

মাঝেমাঝে ওর গুলিয়ে যায়, ওকি খুকুমণি? না সুজাতা?

গোলমাল ছিলই, তবু সংসারে যেমন হয়। বিয়ে হয়েছিল এপ্রিল মাসে। ঠিক চার মাস পরেই নতুন বউ সুজাতার জন্মদিন। বাইরের উঠোনে বাহারি প্যান্ডেল করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন। সব ব্যবস্থাই করেছিল ওর বর অরুণাভ। হাসিখুশি ঝলমলে সন্ধ্যার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুঃখটাকে সুজাতা চিনতে পারেনি তখনো। যদিও রুমেলার প্রতিবাদ, বরের সঙ্গে গলা তুলে চেঁচামেচি, সকাল থেকেই কানে আসছে একটু একটু। চিলেকোঠার ঘটনাও তার এক-দু মাস আগেই ঘটে গিয়েছে।

সেদিন সন্ধ্যায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল রুমেলা। ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল হয়তো। সবার অসতর্কতার সুযোগে নিজের ঘরেই খাটের ওপর টুল পাতছিল। সিলিং ফ্যানের ভরসায় অন্য পৃথিবীতে পাড়ি দেবে ভেবেছিল। জন্মদিনে শাশুড়ির দেওয়া বেনারসি পরে, অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত রুমেলাকে ডাকতে গিয়েছিল ও। গিয়ে বন্ধ দরজা দেখে প্রমাদ গুনেছিল। কিভাবে কী করেছিল সবটা আর গুছিয়ে ভাবতে পারে না। শুধু মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের সামনে গোটা পরিবারের অভিনয়ের কথা। যাতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শামিল হতে হয়েছিল ওকে।

অরুণাভ শাসিয়েছিল, যদিও নরম গলায়,অনুনয়ের সুরে।

‘প্লিজ সুজাতা, শুধু আজকের দিনটা চুপচাপ থাকো। বাইরের লোকের সামনে সিন ক্রিয়েট করো না। রুমেলাকে নার্সিং হোমে পাঠানো হয়েছে। ও সুস্থ হয়ে যাবে। সেন বাড়ির সম্মানের কথা একটু মাথায় রাখো।’

এক-একটা মানুষের এক-এক রকমের ভাবনা, এক-এক রকমের জেদ।

রুমেলাকে কতবার বলেছে ও, ‘তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানা, তোমার বাবার ফোন নাম্বার দাও। আমি যোগাযোগ করব। আমি ফোন করব তোমার বাবাকে। জানাব সব কথা।’

চুপ করে থাকত। কখনো কখনো বলেছে, ‘মা নেই। বাবার শরীর ভালো না। এরা আমাকে পাঠায় না। মিছিমিছি এসব খবর দিয়ে …। না না কোনোভাবেই বাবাকে ব্যস্ত করব না আমি।’

তবু একদিন সেন বাড়ির ঠিকানা লেখার জাবদা ডায়েরি থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করেছিল ও। রুমেলার বাড়ির পুরনো কাজের লোক বলেছিল, ‘বাবু শয্যাশায়ী। কিছু বলার হলে আমাকে বলুন।’

ও-কথা বাড়ায়নি আর। দোকানে যাওয়ার নাম করে রুমেলাকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। গৌহাটির ট্রেনে তুলে দিয়ে জানিয়েছিল ওর বাবার অসুস্থতার কথা। গোকূল সঙ্গে গিয়ে শিলংয়ের বাড়িতে দিয়ে আসে ওকে।

রুমেলা কাঁদছিল। কিছু টাকা হাতে দিয়ে ও বলেছিল, ‘এসবটাই করেছি আমার রোজগারের টাকায়। সেন বাড়ির পয়সা নেই এর মধ্যে। তুমি নিজের জন্য বাঁচতে শেখো রুমেলা। না হলে আমার মনে হবে তুমি নেহাতই একটা সাধারণ মেয়ে, পরের দয়ায় বাঁচতে ভালোবাসো।’

যুদ্ধটা তখনই শুরু হয়। প্রথম দিন কাউকে কিছু না বলে মজা দেখেছিল সুজাতা। বাড়ির বউয়ের অন্তর্ধানের খবরটা যথেষ্ট মুখরোচক। বিশেষ করে যদি তার পূর্ব ইতিহাস কিছু থাকে, খিচুড়ি পাকতে সময় লাগে না। কাজের লোকেদের মুখ বন্ধ করাও সোজা কথা না।

কিন্তু ও যখন নিজের মুখে সবটা জানাল, স্বীকার করল এ-ব্যাপারে ওর নিজস্ব কৃতকর্মের বৃত্তান্ত, একটা অদ্ভুত শীতলতা নেমেছিল সেন বাড়িতে।

অরুণাভ কথা বলেনি দুদিন। তারপর বলেছিল, ‘কি করে পারলে? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার কথা মনে হলো না তোমার?’

ও বলেছিল, ‘পারলাম। কাজটা ঠিক মনে হলো তাই কাউকে না জিজ্ঞেস করেই করতে পারলাম। আমার বাবা বলতেন, কোনো কাজ তোমার ঠিক মনে হলে কাউকে কিছু না বলেই করবে। আমি সেটাই করেছি।’

বাড়িসুদ্ধ লোক বয়কট করেছিল ওকে। অথচ ও যে বাপের বাড়ি ফিরে যাবে সে-রাস্তাও বন্ধ। মোবাইল নিয়ে নিয়েছিলেন শাশুড়ি। একদিন একফাঁকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ও। সেদিন ওকে টানতে টানতে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে যায় ওরা। সারাদিন সেখানেই বন্ধ হয়ে থাকা, কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলতে না পারা, এসবই ছিল শাস্তির অঙ্গ। এমনকি অরুণাভও আসত না ঘরে। একদিন ধৈর্য হারিয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে ভয়ংকর আওয়াজ তুলেছিল সুজাতা। দরজা খুলে রঞ্জন ওর হাতদুটো পিঠের দিকে বেঁধে দিয়ে যায়। টানা একদিন ওভাবেই বসে থাকতে হয়েছিল ওকে। সাধারণভাবে মনে হয়, যাকে নিয়ে অসুবিধে, সে চলে গেলেই তো ভালো। সেক্ষেত্রে ও বাপের বাড়ি চলে গেলে সব সমস্যাই মেটে। পরে ও বুঝেছিল, ঘটনাটা তা নয়। ওরা রইল কী রইল না তার থেকেও বড় ব্যাপার হলো সেন বাড়ির প্রেস্টিজ, যা ওদের চলে যাওয়াতে নষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে চিলেকোঠাই উপযুক্ত সমাধান। 

ছাদের ঘর। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কাজের লোকেরাও কেউ আসত না ওদিকে। শাশুড়ি খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রেখে চলে যেতেন। প্রথম প্রথম কিছুদিন না খেয়ে ছিল ও। তারপরে ওর মনে পড়ে রুমেলার কথা। ও তো রুমেলা হতে পারে না। ওকে বাঁচতেই হবে। খারাপ মানুষদের জন্য ও মরবে কেন?

সপ্তাখানেক বাদেই ফোন না পেয়ে ছোড়দা এসেছিল একবার। আষাঢ়ে গল্প শুনে বাইরের ঘর থেকেই চলে গিয়েছিল সে। সপ্তা তিনেক ওভাবেই কাটে। হয়তো রুমেলা কিংবা গোকূল, কে যে কথা বলেছিল ছোড়দার সঙ্গে, কিছুই জানা হয়নি ওর। পরে আবার সঙ্গে লোকজন নিয়ে সেই ছোড়দাই আসে। সেদিনের আবছা আবছা স্মৃতি আছে ওর। ছোড়দার কিছু কিছু কথা, অরুণাভের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা,  তুমুল চেঁচামেচি। সবশেষে ওর হাত ধরে ছোড়দার গাড়িতে তোলা।

চিলেকোঠায় তোলার আগে ওরা বলেছিল, ও ক্ষমা চাইলে ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ও চায়নি। বাড়ি ফেরার পর ছোড়দার কথামতো মামলা করতেও রাজি হয়নি।

চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়েও বেশ কিছুদিন ও আচ্ছন্ন ছিল। নার্সিং হোমে রাখতে হয়েছিল ওকে। সে-সময় থানা পুলিশের ঝঞ্ঝাট হলে ওকে সুস্থ করার চেষ্টাটা অত সহজে করা যেত কি? তবে মামলা না করার পেছনে ওর অন্য একটা যুক্তি ছিল। আসলে অরুণাভকে চিনতে না পারার জন্য নিজেকেই দায়ী করেছিল সুজাতা। মামলা করে ও কাকে শাস্তি দেবে?

মাঝেমাঝে পুরনো দিনের ওইসব কথা ওর মাথায় ঘোরেফেরে। তখনই কালো মেঘের মতো অন্ধকার নেমে আসে। আধখানা ঘুমের বড়ি খেয়ে ও বিছানায় গড়িয়ে যায়।

ডাক্তারবাবুর সঙ্গে টেলিকনফারেন্স হয়। ছোড়দাই ব্যবস্থা করে। উনি বারবার বলেন, ‘লিখুন আপনি। মনের সব কথা খুলে লিখুন। আমি পড়ব। আমি দেখব। কিন্তু ভাববেন না। ভাবনা এলে লিখবেন। পড়বেন। কথা বলবেন কারো সঙ্গে।’

কদিন হলো ইমলি আসছে না। কটেজ মালিকের ছেলে এসে রেখে যাচ্ছে সবকিছু। তবু ইমলির মুখ দেখার জন্য ছটফট‌ করছে ও।  

সকালে মালিকের ছেলে চা দিতে এসে জানিয়ে গেল, ইমলির শাদি। তাই ওকে নানির বাড়ি পাঠানো হয়েছে।

‘মোটে বারো-তেরো বছর বয়স, ওর শাদি কে দিচ্ছে? কার সঙ্গে হচ্ছে?’

ছেলেটি বলল, শাদি হচ্ছে মালিক দাদুর ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে। ছেলের বয়স বত্রিশ। চায়ের দোকান চালায়।

বত্রিশের সঙ্গে বারো-তেরো বছরের ইমলির বিয়ে? সারাদিন ধরে ছট‌ফট‌ করছিল সুজাতা। এ বিয়ে হলে মেয়েটা কী ভালো থাকবে?

কদিন ধরেই অসুবিধের মধ্যে আছে ও। মালিকের ছেলে ইমলির মতো নয়। সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না। ফ্লাস্কের চা ঠান্ডা হয়ে যায়। বললেই ওর বাঁধা উত্তর, ‘শাদিকে কাম-কাজমে দের হো গয়ি।’

আগামীকাল ইমলির বিয়ে। সকালেই হবে। ওকে নেমন্তন্ন করে গিয়েছে কটেজ মালিকের বউ। যাবে কি না ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। গভীর রাতে কাচের জানালায় ঠক‌ঠক‌ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। ঝাপসা কাচে ইমলির মুখ।

দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলে দিলো সুজাতা। ‘তুই? কাল তোর শাদি না?’

‘হাঁ তো। লেকিন জবরদস্তি ইয়ে শাদি হম্‌ নেহি করেঙ্গে।’

‘জবরদস্তি?’

‘হাঁ তো।’ দুটো হাত ছড়িয়ে দেখায় ইমলি। হাতে দড়ির দাগ। ‘নানি কো কুছ পতা নেহি। ইয়ে লোগ জবরদস্তি …। আপ জলদি লিজিয়ে। সবলোগ আভি শো রহে হ্যায়। মুঝে জলদি ইধারসে আপকে সাথ ভাগনা হ্যায়।’

‘কোথায় যাবি ইমলি? পুলিশচৌকি?’ তৈরি হতে হতে বলে ও।

‘কভি নেহি। গাঁওমে, নানিকে পাস। উধার বহুত সারে আদমি হ্যায়। দেখ লেঙ্গে ইনলোগো কো।’

আর কিছু ভাবেনি ও। রাতের নির্জন অন্ধকারে ইমলির হাত ধরে চলেছে। মেয়েটা নানিকে পড়ালেখা জেনানা দেখাবে। যে ওর হয়ে কথা বলবে। ঢালু পাহাড়ি রাস্তা। পা হড়কালে ইমলির হাত ধরে সামলে নিতে হচ্ছে। বাইরে ঠান্ডা আছে। নিজে একটা চাদর গায়ে দিয়েছে সুজাতা। ইমলির গায়ে ও জড়িয়ে দিয়েছে ওই কাঁথাটা।

উজ্জ্বল কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে বেশ লাগছিল ইমলিকে। ওই কাঁথায় ময়ূরপঙ্খি নাওয়ে একটি মেয়ে বসে আছে। তার চুলের রং নীল।