কাইয়ুম চৌধুরীর কল্পনাকুশলতা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে নিসর্গ ব্যক্তিগত নিসর্গ, ব্যক্তিগত ঈশ্বরের মতো। এই বোধ তাঁকে বিশ্বস্ত করেছে ব্যক্তিগত নিসর্গের বাস্তবতার কাছে। ব্যক্তিগত নিসর্গের বোধ তাঁকে দর্শনের দিক থেকে তুষ্ট করেছে। এই নিসর্গ একটি জীবন্ত বাস্তবতা, যে-বাস্তবতা তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বারবার ঘুরে ঘুরে এসেছে। জীবনযাপনের যন্ত্রণা, ব্যর্থতা, উদ্বেগ তাঁর ব্যক্তিগত; কিন্তু এই যন্ত্রণা, ব্যর্থতা, উদ্বেগ তিনি সমষ্টির মধ্যেও দেখেছেন। সকলের সঙ্গে তিনি পেরিয়ে এসেছেন পাকিস্তানের কলোনিকাল, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ, সামরিক শাসনের অপমান এবং সাধারণ মানুষের অপরাজেয় জীবনতৃষ্ণা : এসবের সঙ্গে যুক্ততার লড়াই  তাঁকে ব্যক্তিগত নিসর্গের কাছে নিয়ে এসেছে। এই নিসর্গ গভীরতরভা বে বাস্তব তাঁর কাছে। জীবনযাপনের ভয় ও গ্লানি, নৈরাশ্য ও ক্লান্তির মধ্যে তিনি নিসর্গ থেকে উৎসারিত শান্তি ও সম্পদের শক্তি জেনেছেন, নিসর্গ তাঁকে অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি দিয়েছে এবং নিসর্গ হয়ে উঠেছে তাঁর জন্যে এক অনিঃশেষ সম্পদ।

তাঁর ব্যক্তিগত নিসর্গের কাজ থেকে তিনি শিখেছেন আলোকের ভাষা। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিসর্গের শক্তি তিনি অনুভব করেছেন তাঁর কব্জিতে ও চোখে, এই শক্তিগুলো দিয়েছে ক্লান্তি, ব্যর্থতা ও হতাশার ভার। তিনি নিশ্চিত, পৃথিবী কিংবা বাংলাদেশের উদ্ভবের পিছনে একটা কারণ আছে এবং কারণটি হচ্ছে অন্যায় ও কদর্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে মানুষের নিত্য সহচর, নিসর্গ। নিসর্গ ব্যক্তিগত বলার অর্থ এই নয় যে, অনেক অবজেক্টের মধ্যে নিসর্গ একটি অবজেক্ট, তার মধ্যে ঈশ্বরানুভূতি প্রক্ষেপ করা, যেমন রবীন্দ্রনাথ করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে, খুব সম্ভব, নিসর্গ হচ্ছে মানুষের চেতনার সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মহান অংশ। এই সুন্দরতা ও মহানতার অংশটাই তাঁর কাজে জোর পেয়েছে। এটা যে কদর্যতা, নিষ্ঠুরতা, রূঢ়তা বাস্তবে আছে, কিন্তু একজন শিল্পী এই সীমাবদ্ধতার অধীন নন। ব্যক্তিগত নিসর্গের অর্থ : স্ব-চেতনাবোধ ও স্ব-নির্দেশনা। সেজন্যে যথার্থ অর্থে নিসর্গ হচ্ছে ব্যক্তিগত নিসর্গ, নিসর্গ হচেছ জীবন্ত নিসর্গ। নিসর্গের মধ্যে ক্রিয়াশীল অনুভূতি ও ইচ্ছা, মানুষের হৃদয়ের গভীরতম আকুতির প্রতি নিসর্গ সাড়া দেয় থেকে থেকে। এই নিসর্গ, কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে সাড়া দেয়, তাঁর প্রার্থনার কাছে জবাব দেয়।

এই নিসর্গ বাস্তব, পরিবর্তিত বাংলার আবহমান বাস্তব। এই বাস্তবতার নিত্যতা হচেছ বাংলার সাংসৃকতিক প্যাসটোরালিজম। এই প্যাসটোরালিজমের আছে ভবিষ্যতের এক ইমেজ, যে-ইমেজ গ্রামীণ অতীতের এক ধরনের আদর্শায়িত স্মৃতি। এই স্মৃতি একই সঙ্গে গ্রামীণতা এবং বাংলার জীবনের নস্টালজিক মিথ তৈরি করেছে। কাইয়ুমের কাজ প্যাসটোরাল, গ্রামীণ অতীতের এক ধরনের আদর্শায়িত স্মৃতি, একই সঙ্গে গ্রামীণতা ও নস্টালজিক। এই হচ্ছে তাঁর মনোভঙ্গি আধুনিকতার প্রতি। আধুনিকতার সূত্র সকল তাঁর জানা, কিন্তু তিনি অনিচ্ছুক আধুনিকতার জোয়ারে ভেসে যেতেন। তিনি হয়তো মনে করেন, এই আধুনিকতাই হচ্ছে আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনের শক্তি। এখান থেকে উৎসারিত তাঁর কল্পনাকুশলতা। এই কল্পনাকুলশতার শক্তি এসেছে গ্রামীণ জীবন, তাঁর স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার স্থায়িত্ব থেকে। এই স্মৃতিময়তা ও নস্টালজিয়ার বোধ হচ্ছে এই জনসমষ্টির বোধ। বঙ্গীয় শিল্পের মুক্তি এক্ষেত্রে, এ-ধরনের একটা অর্থ কাইয়ুমের মধ্যে ক্রিয়াশীল।

তাঁর কাজে রমণী ও প্রাকৃতিক পৃথিবী পরস্পর-প্রবিষ্ট। আধুনিক শিল্প-আন্দোলন থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন রূপান্তরণের বোধ, কিন্তু তিনি জানেন, এই বোধ বঙ্গীয় রোমান্টিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। শিল্পের ফর্মাল সম্পর্ক আধ্যাত্মিক সত্যে উপনীত হওয়ার মাধ্যম। এই আধ্যাত্মিকতা সেক্যুলার, যা তিনি অর্জন করেছেন জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের কাছ থেকে। এভাবে তিনি বাংলাকে একটা পারস্পেকটিভে অর্জন করতে চেয়েছেন। তিনি আস্তে আস্তে আবিষ্কার করেছেন বঙ্গীয় নিসর্গের প্রেরণা সৃষ্টিকারী দিক।

কাইয়ুম চৌধুরীর কল্পনাকুশলতার জন্যে দরকার সাহিত্যিক সাযুজ্যতা : তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলো সাহিত্য-আক্রান্ত। সাহিত্যপাঠ তাঁকে যেমন বঙ্গীয় অতীতে নিয়ে গেছে, তেমনি সাম্প্রতিক জীবনে নিমজ্জিত করেছে। সেজন্যে কাইয়ুমের ভিশনের যুক্তি বোঝা খুব সম্ভব হয়, সহজ হয় বঙ্গীয় রোমান্টিক ঐতিহ্যের পরিসরে এবং ফর্মের উদ্ভাবনময় শক্তির তাঁর ক্ষান্তিহীন পরিক্রমার মধ্যে। নৈসর্গিক ফর্মের মধ্যে মানুষী ফর্ম যুক্ত করে তিনি মোক্ষে পৌঁছেছেন। এই পৌঁছানো থেকে তৈরি হয়েছে তাঁর ভিশন। মানুষী পরিস্থিতি স্বর্গচ্যুত এবং স্বর্গ হচ্ছে নিসর্গের নান্দনিকতা। এই নান্দনিকতা বাস্তব, সক্রিয় ও প্রেরণা-উদ্দীপক।

তাঁর কাজে, প্রথম থেকেই রোমান্টিকতা অন্তঃশীল, তার কারণ, খুব সম্ভব তার কারণ, চারপাশে নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, কদর্যতা দেখে তিনি প্রথম থেকেই নিজেকে প্রস্ত্তত করেছিলেন বেঁচে থাকার তাগিদে, রোমান্টিকতা গ্রহণ করার জন্যে। তিনি বলতে চেয়েছেন, বাংলার শিল্প-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো, যেসব মানবিক ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন, সেসবই পশ্চিমের আধুনিকতার জোয়ারে ভূতলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আধুনিকতার যে-ধারা তৈরি হয়েছে তা বাংলার জন্যে সত্য নয়। শিল্প, অন্যতম সভ্য কাজ, সেখানে ইতিহাস থেকে স্খলিত হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর এই আশাবাদ, আশার বিপক্ষে আশা কিনা এ-সংশয় থেকেই যায়। দেশজ ঐতিহ্য এবং দেশজ নিসর্গ হুমকির সম্মুখীন, মাটি, পাহাড়, নদী, গাছপালা,  মানুষ-সৃষ্ট বিপর্যয়ের সম্মুখীন, এই বিপন্নতা এ-বিপদ থেকে মুক্তির উপায় ফের নিসর্গের শুদ্ধতায় ফিরে যাওয়া। নান্দনিকতার প্রক্রিয়া নিজের ভেতরে তৈরি করা।