কাজলা দিদি

স্বপন কথাটা মাঝেমধ্যেই বলে। বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত বলে না সাধারণত। আমাদের তো কখনো মনে পড়ে না। ওর পড়ে।  বেশি পড়ে শুকনোর সময়। শীতকালে খালপাড়ের দিকে মুখ-করা বাড়ির পুব-দক্ষিণ কোনার ঘরখানার ভেতরে কি বারান্দায় বসে থাকলে স্বপনের মনে পড়ে। তখন একটানা বলে চলে সে। চোখ থাকে খালপাড়ের দিকে। তবে সবচেয়ে বেশি বলে দুপুরের খাওয়ার পরে যখন ঘরে তিষ্ঠোনো দায়, বাইরে চৈত্রের উদাসী হাওয়া কুলকুল করে বয়, তখন বারান্দায় একখানা হোগলা বেতির চাঁচে গা এলিয়ে দিয়ে। শুরুতে সে বলে, আজকাল আর বিজলিদি কল চাপে না!

হ্যাঁ, খাল সমান্তরাল রাস্তার পরে যে চাপকল ছিল, বিজলিদি সেটা চাপত গভীর রাতে। ঢকঢক করে জল খেত কলে মুখ লাগিয়ে। সে-শব্দও নাকি শোনা যেত। শুনেছি কি শুনিনি মনে নেই। স্বপন সে-কথা বলে। স্বপন, অসিত আর বিমল তখন ধানের কারবারি। বিমল গোড়াখালের। অসিত খুড়তুতো ভাই। তারা আশপাশের দু-চার গ্রাম থেকে ধান কিনে আনে নৌকায় করে। শুকনোর সময়েও এই খাল তখন জলে ভরা। পঁয়ত্রিশ- চল্লিশমণি এক-একখানা নৌকা অনায়াসে গোড়াখাল হয়ে কচুয়ার বড় খালে পড়তে পারত। গেরস্তরা ধানভরে হাটে নিত কুড়িমণি নৌকায়। এখন শীতের সময় পানসি কি টাবুরেই ঢুকবে না। মাইল-দুই পুবে বলেশ্বর শুকিয়েছে। শুকিয়েছে কী, প্রায় পগারে পরিণত হয়েছে। বিজলিদির কথা বলে, এই ভূমিকাটুকু দেওয়া স্বপনের জন্য জরুরি।

তখন তাকে আরো কিছু কথা জানাতে হয়। অসিত ভারতে চলে গেছে। বিমল এ-ব্যবসায় নেই। গ্রামেই থাকে না। স্বপনও আর ধানের কারবার করে না। গেরস্তরা আজকাল খোরাকির বাইরে ধান গোলায় রাখে না। মাঠ থেকেই ধান বিক্রি হয়ে যায়। কেউ উঠানে আনলেও সারাবছরের খোরাক রেখে বাকিটা বিক্রি করে দেয়। সবারই ছেলেমেয়ে কমবেশি স্কুল-কলেজে যায়। তারা অমন মোটা চালের ভাত খেতে চায় না। কেউ কেউ বাজার থেকে চাল কেনে। অনেকে ধানিজমি কমিয়ে ফেলেছে। সেখানে মাছের ঘের। কেউ অন্য শস্যের কৃষি করে। তাতে লাভ বেশি। যেমন, স্বপন বাড়ির সীমানার পরের দশ কাঠা জমিতে মাছের ঘের করেছে। অন্যদিকের দশ কাঠায় করেছে কলার ক্ষেত। শুধু জমি উঁচু করতে একবারই যা খরচ।

বিজলিদির কথা বলার সময়ে নিজের জীবনের এই পরিবর্তনের কথাও সে বলে। কেননা, খালপাড়ে এখন যে ডিপ টিউবওয়েল ওটা বেশিদিন বসানো হয়নি। আজকাল কেউ আর চাপকল বলে না। বলে টিউবওয়েল। ওই ডিপ টিউবওয়েলটা এখন যেখানে, এর থেকে আরেকটু পুবে রাস্তার পাশে ছিল সেই চাপকলটা। একবার আর্সেনিক পরীক্ষা করতে সরকারি লোক এসে সেটার গায়ে লাল রং মাখিয়ে দেয়। সে অনেকদিন আগের কথা। তখনো ধানের কারবারে স্বপন আছে, সঙ্গে বিমল। অসিত সবে ওপারে গেছে। চাপকলে লাল রং মাখিয়ে দেওয়ায় বাড়ির লোকজন আর ওই জল খেত না। তখন তারা খাওয়ার জল আনত বিমলদের বাড়ি থেকে। অবশ্য না-জেনে খেত
পথিকরা কেউ। বাড়ির লোকজন দেখলে মানা করত। লোক বুঝে জল দিত। অথবা বলত, সামনে গোড়াখালে আর একটা আছে, সেটার গায়ে সবুজ রং, জল খাওয়া যাবে। পথিক আরেকটু সামনে এগোয় সেই সবুজ রঙের কলের আশায়। অবশ্য আর পোয়া মাইল হাঁটলেই কাউন্সিলের রাস্তা। সেখানে পরপর দুটো চাপকল ছিল। ছিল কেন, এখনো আছে। কাউন্সিলের সামনেরটার জল কী মিষ্টি! অথচ ওদিকের খালের জল লোনা। ইউনিয়নের পুবজুড়ে বলেশ্বর শুকানোর পর ওই খালে ভৈরবের জল ঢোকে। লোনাজলের খালের পাশের চাপকলের জল কেন যেন মিষ্টি হয়!

সেই সময়ে কিছুদিন বিজলিদির জল খাওয়া বন্ধ ছিল। ফলে তখন বেড়েছিল তার উৎপাত। সরকার ওই কলের জল খেতে মানা করেছে, আর্সেনিক আছে। আর্সেনিক তো বিষ। ওই জল খেলে হাতে-পায়ে কালো দাগ হয়, চুলকানি হয়, গুটি ওঠে। বাড়ির লোকজন তো ভয়ে অস্থির। এতদিন খেয়েছে, কিছু যদি হয়! নতুন কল বসানোর আগে বিমলদের বাড়িই ভরসা। ভাগ্য ভালো ওই কলটার জলে কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু দুটো কলের পাইপ সমান লম্বা। এ হলো ভগবানের লীলা। পাশাপাশি মাত্র তিন বাড়ি পরে দুটো কল, পাইপও সমান, অথচ একটার জলে বিষ, অন্যটা ভালো। ওদিকে বিজলিদি তো অন্য বাড়ির কলের জল খাবে না। সরকারি লোকজন যখন কল পরীক্ষ করেছে, তখন ছিল বর্ষাকাল। খালে ভর্তি টলমল জল। বাড়ির পেছনের ছোট পুকুরের জল ভালো, সে-জলে রান্নাবাড়া হয়। তাই মনে হয় তখন বিজলিদি কোনো সমস্যা করেনি। যেই জল কমেছে, পেছনের পাশের পুকুরের জল একদম তলানিতে, খালের জলে লোনা ঢুকতে শুরু করেছে, অপরিষ্কারও, তখনই শুরু হলো তার দাপট!

এ সব কথাই আমাদের জানা। এও জানি, এরপর স্বপন কী বলবে। নৌকায় শুয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পেত, দক্ষিণের বাগানের গাছের ডাল ভাঙার শব্দ। মটমট করে গাছের ডাল ভাঙছে। ঝড় নেই, বাতাস নেই; কিন্তু সকালবেলা দেখা গেল একটা আমড়াগাছের ডাল ভাঙা। তা আমড়ার ডাল খুব নরম, হয়তো এমনিতেই ভেঙে গেছে। কিন্তু স্বপন তো জেগে। বিমল ঘুমন্ত। অথবা বিমল সেদিন বাড়িতে ঘুমিয়েছে। স্বপন ঘুমিয়েছে খালে বাঁধা নৌকার ওপরে। নৌকায় ধান রেখে বাড়ির ভেতরেও আসা যাবে না। চোরের অভাব নেই। মাঠ থেকেই তখন ধান কেটে নিয়ে যেত। এখনকার মতো না। এখন কেউ ধান নেয় না। মাঠের ধান মাঠেই থাকে। কাটতে একটু দেরি হলে কোনো সমস্যা নেই। চোররা এখন আর অন্ধকারে ধান কাটার মতো কাজ করে না। তাদের কত বড় বড় কাজ। ফলে গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনেও সে নৌকায়ই থাকে। বিমল হয়তো আরো রাতে আসবে। একবার বাড়ির ভেতরের দিকে টর্চ মারে। তারপর ঘুমোতে চেষ্টা করে। টের পায় কলটা এক-দুবার চাপার শব্দ। কেউ জল খাবে; কিন্তু খেল না। কলের হাতলটা জোরে উঁচু করে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। স্বপন শোনে আর বোঝে, বিজলিদিও বোঝে এ-জল খাওয়া যাবে না।

অথচ যখন ওই কলটায় লাল রং দেয়নি সরকারি লোক, তখন প্রতিবছর সে ধানের নৌকায় শুয়ে টের পেত, ঢকঢক করে জল খাচ্ছে কেউ। অসিতকেও শুনিয়েছে। শুনেছে বিমলও। তবে অসিত আর বিমলের তো শোয়ামাত্র ঘুম। স্বপনের ঘুম আসত না। মনে হতো, কতদিন ধরে শুনছে, কতবার শুনেছে সেই ছোটবেলার কথা। যখন থেকে বিজলিদি এই সময়ে কলে জল খেতে আসত। সে না হয় এই কয়েক বছর ধানের কারবারে নেমেছে, এর আগেও, যখন এই খালপাড়ের দিকে এই ঘর তোলেনি সে, বাড়ির পেছনদিকের ঘরে থাকত, তখনো তো কোনো কোনোদিন রাতে শুনত কল চাপার শব্দ। তার বাবা বলত, বড়দা বলত। বলত বউদিরা কেউ, ওই যে বিজলি কল চাপে, জল খায়।

সেও তো কত দিন আগের কথা। স্বপন তখন খুব ছোট না, তবে এখনকার হিসাবে ছোটই। মনে আছে, হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ছেড়েছে জিয়াউর রহমানের সবুজ বিপ্লবের, সে প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে সেবার। সেই পরীক্ষার পরপর বিজলিদির বাবা, সেই জ্ঞাতি কাকা দেশ ছেড়ে চলে যায়। কাকা যাওয়ার আগে বিজলিদি জল খেতে আসত না। তখন নাকি তাদের রান্নাঘরে ঢুকে কলসি থেকে ঢেলে জল খেত রাতের বেলা। হাঁড়ি উলটে দেখত। ভাত না থাকলে ঢাকনাটা একইভাবে রেখে দিত। ঝোল-তরকারি থাকলে তা খেত। আবার কোনোদিন ভাত-তরকারি খাওয়ার পর থালা একেবারে লেপাপোঁছা। এমনভাবে খেত যে কেউ কিছু খেয়েছে সে-থালায়, দেখে মনে হতো না। বুঝত বিজলিদির মা। কাকিমা প্রথম কয়েকদিন কাউকে কিছু বলেনি। তারপর একদিন পরীক্ষ করার জন্য রাতে একটু বেশি ভাত আর মাছের মাথা রেখে দিয়েছিল। সকালে দেখে, ভাত-তরকারি সব খেয়েছে, মাছের মাথাটাও খেয়েছে, ঘরে কিছু নেই। মাথার কাঁটাগুলো পেছনের পগারের পাশে এক জায়গায় রাখা। ওটা যে ছুড়ে পগারে ফেলতে হবে তা মনে হয় বিজলিদির খেয়াল ছিল না। সেদিন কাকিমা বুঝেছে, বিজলি রাতে এসে ভাত খেয়ে যায়। তবে একদিন ভালো করে পেটপুরে খেলে তারপর কয়েকদিন আসত না।

কাকিমা সে-কথা কাকাকে বললে, সে কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল। এ মেয়ের নামে শ্রাদ্ধের অন্নদান হয়নি, তার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়। কাকার তখন ভীষণ অভাব। শ্রাদ্ধের অন্নদানের টাকা হাতে নেই। অন্যরা শুনলে যদি সবাই মিলে চারটে চাল-ডালের ব্যবস্থা করে। তাও তো সে চায় না। ওদিকে মাথার ওপর বাড়ছে বিজলিদির পরের দুই বোন। তাদের বিয়ে দিতে হবে। যদি পাত্রপক্ষের কানে এমন কথা যায়, তাহলে এই মেয়ে দুটোরই-বা কী হবে। এসব ভেবে নিশ্চয়ই কাকা কাকিমাকে চুপ করে যেতে বলেছিল।

কিন্তু এমন শরিকি বাড়িতে এমন ঘটনা তো বেশিদিন চাপা থাকে না। এক কান থেকে অন্য কানে যায়। আগের দিন কাকিমার বোন-ভগ্নিপতি আর তাদের ছেলেমেয়েদের আসার কথা ছিল। সেমতো কাকা বাজারও করেছিল। কিন্তু ভীষণ বৃষ্টিতে তাদের নৌকা সন্ধ্যারাতে তালেশ্বরের পরে আর আসতে পারেনি। সেখানেই নৌকায় তারা রাত কাটায়। কাকা হাট থেকে এনেছিল দুপদের মাছ। ইলিশ আর মেইড। তখন বড় বড় মেইড মাছ পাওয়া যেত ভাসার হাটখোলায়। রাতের বেলা কাকিমা প্রত্যেক ঘরে সেই রান্না মাছ দেয়; কিন্তু ভাতগুলো দেয়নি। সেগুলো জল দিয়ে রেখেছিল পান্তা খাবে বলে। বড়দার ছেলে অনি তখন ছোট, সন্ধ্যারাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বউদি ওর জন্য মাছ রেখে দেয়; কিন্তু ভাত আর থাকেনি। মেইড মাছ জেঠামশাইর খুব পছন্দ। একটানে অন্যদিনের চেয়ে দেড় থালা ভাত বেশি খেয়ে সে সামনের বারান্দায় মাইকেলের আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায় বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। বউদি তো ভেবেছে ঘরে ভাত থাকবে, কিন্তু ছিল না। পরে ভেবেছে, অনি উঠে সকালে খেতে চাইলে কাকিমার কাছ থেকে এনে দেবে পান্তা। দাদু-নাতির এই এক গুণ, দুজনেই মেইড মাছ খুব ভালো খায়। সকালবেলা বউদি কাকিমার কাছে ভাত চাইতে গেলে শোনে ভাত নেই। বউদিই আগের সন্ধ্যায় ও-ঘরের হাঁড়িতে চাল চড়িয়েছে দশজনের। এত ভাত গেল কোথায়! সে কাকিমাকে বলে, কী কন, ও খুড়িমা, এত ভাত খা’ল কিডা? কাকিমা শুধু নাকি বিড়বিড় করেছিল, ওই যে হাঁড়ির তলায় মুঠখানেক আছে। বউদি তার মুখের দিকে তাকাতেই কাকিমা অস্ফুট বলে, বিজলি খাইয়ে গেছে!

এই থেকে বাড়ির সবাই জানে, বিজলিদি রাতে ভাত-মাছ-তরকারি খেয়ে যায়। যদিও অন্য কোনো ঘরের হাঁড়ি-কড়াইয়ে কখনো হাত দেয়নি। কিন্তু তাতে কী? এই খবর বাড়ি থেকে গ্রামময় চাউর হওয়ার পরপর কাকা দেশ ছেড়ে চলে যায়। এমন হঠাৎ যে বিজলিদিও যেন কিছু না জানতে পারে। কিন্তু সে তো সব জানবেই। কদিন তার কী মন খারাপ। তখন বৃষ্টিবাদলার দিন বলেই হয়তো টের পাওয়া যায়নি। তবে তখন কয়েকদিন কোনো কোনো রান্নাঘরের সরা বা ঢাকনা উলটানোর শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে; কিন্তু কোনো খাবার সে মুখে দেয়নি।

সম্ভবত মায়ের হাতের রান্না খুব পছন্দ ছিল বিজলিদির। অথবা একটু চেখে দেখেছে আঙুলের আগায় লাগিয়ে তারপর
সে-রান্না পছন্দ না-হওয়ায় খায়নি। বড় বউদি তো রান্নাঘরে ঝোলের ফোঁটা দেখেছে। ওই কাকিমা রান্নাও করত খুব ভালো। মনে হয়, তার মায়ের রান্না ছাড়া অন্য কোনো রান্না সে খেতে চাইত না। এর পেছনেও একটা কারণ আছে। বিজলি দক্ষিণের বাগানে যাওয়ার আগে সেই সারাটা দুপুর কাকিমাকে বলেছিল, ও মা, মাছের ঝোলটা যা হয়েছে! কতদিন তোমার হাতে এমন মাছের ঝোল খাইনি!

সে-সময় অবশ্য কেউ খাল থেকে বিজলিদির জল খাওয়ার শব্দ শোনেনি। কিন্তু রাত হলে মনে হতো সামনের খালপাড় ধরে দক্ষিণে যে-বাগান, সেটা ভারি নিশ্চুপ। বৃষ্টিবাদলার দিনে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শোনা যাবে, তা-ই স্বাভাবিক। বৃষ্টি আসে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে। তখন বাগানের গাছে গাছে খুব শব্দ হয়। নারকেল-সুপারির মাথা একটার সঙ্গে অন্যটা জড়াজড়ি করে। কিন্তু ওই দক্ষিণের বাগান বাতাস আর বৃষ্টির সময়েও কেমন যেন নিশ্চুপ। বাবা বলত, ব্রজ চলে যাওয়ার পরে মেয়েটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গেছে। অবশ্য এসবই অনুমান। কেননা, তখনো তো রাতের বেলা কল চাপার শব্দ শোনেনি কেউ। শুনেছে এর কিছুদিন পরে, যখন ব্রজকাকার চিঠি আসে। তারা মুর্শিদাবাদ। ভালো আছে। সব গুছিয়ে উঠেছে। আর ফিরবে না।

এই চিঠিও যেন পড়েছিল বিজলিদি। তার মা-বাবা ও বোনেরা আর ফিরবে না। তাদের জমিজমা কিছু যা ছিল বাবা তা বেচে টাকা হুন্ডি করে পাঠায়। ভিটটা কিনে নেয় বড়দা। ব্রজকাকার আপন ছোটভাই বক্রেশ্বর খুড়ো তাদের চিঠিতে লেখে, তোমরা চলে যাওয়ার পর বিজলি আজকাল আর আসে না!

কিন্তু আসে না বললেই তো হবে না। বিজলিদির পক্ষে তো সেই মুর্শিদাবাদ যাওয়া সম্ভব নয়। মনে হয় বাড়ির পেছনের দিকেও যেত না। সে সামনের দিকেই থাকত। এখান থেকে দক্ষিণের বাগানটা কাছে। বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে নেমে যাওয়া যায়। চাইলে সামনের রাস্তা ধরে কিছু দূরে এগিয়ে মণ্ডলবাড়ির পগারগুলো বাঁয়ে রেখেও যাওয়া যায় ওই বাগানে। চাপকলটাও বাগানের ঠিক উত্তরে।

তাই মনে হয়, সরকারের লোক চাপকলটায় লাল রং লাগিয়ে দিয়ে গেলে কয়েকদিন সে কলের হাতটা ধরে আচ্ছাসে নাড়িয়েছে। তারপর খাল থেকে জল খেয়ে চলে গেছে নিজের জায়গায়। কিন্তু খালের জল নিচে নেমে এলে, সেবার শীতের পরপর সবার মনে হলো, কলটা বদল করা দরকার।

সামনে কিছু দূরে বিমলদের বাড়ির সামনের কলটা ভালো। উলটোদিকে আগাখালে আর বটগাছতলা দিয়ে ঢোকার সময় আছে দুটো কল। তবু বাবা ঠিক করে, নতুন কল বসাবে বাড়ির পেছনের দিকে যে-ছোট পুকুর তার গায়ে। তাই ভালো। রান্নাঘরগুলোরও কাছে হবে। তাছাড়া ওদিকটা নিচু। হয়তো পাইপ বেশি লাগবে না। কম পাইপেই ভালো জল পাওয়া যাবে। বিমলদের বাড়ির দিকটা একটু নিচু বলেই সেটার গায়ে লাল রং দেয়নি সরকারি লোক। জেঠামশাইরও তাতে মত ছিল। কিন্তু কলের জায়গা ঠিক হওয়ার পরই দেখা গেল, প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরপর সামনের লাল রং-মাখানো কলের হাতলটা কেউ জোরে জোরে তুলছে আর ফেলছে। কার্তিক মাস। ধান উঠতে আর মাসখানেক বাকি। খালেও জল ভালোই। দুয়োর পাতলে প্রচুর কইমাছ ধরা পড়ে। তার মনে খালে যে-জল, বিজলিদির জল খাওয়ায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তাহলে ওই হাতল ধরে পেটায় কেন?

প্রথমে সবাই মনে করেছে, এমনি হয়তো। এটা বিজলির কাজ নয়। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। গত বছর শুকনোর সময়ে সে প্রতি রাতে জল খেয়েছে কল টিপে। তারপর বর্ষাকালে সরকারি লোক এসে কলটায় রং মাখিয়ে দিলো, তখন আর কলের কাছে আসত না সে। এখন তো তার কলে জল খাওয়ার সময় নয়। জেঠামশাইর কেন যেন মনে হলো, নতুন কল বাড়ির পেছনে লাগানোর সিদ্ধান্ত হওয়ায় বিজলি খেপেছে। বাড়ির পেছনে সে আসবে না। আসলে এতদিন সব রান্নাঘরে রোজই আসত। একদিন হয়তো এসেছিল, তরকারি তার পছন্দ হয়নি তাই আর আসেনি। ওদের ঘর ছিল উত্তরের পোতায়, দক্ষিণমুখী। সেটা বাড়ির বাইরের দিকে। কলতলার ঠিক উলটো পাশে শখানেক হাত বাদে। খাল বরাবর রাস্তা ধরে মল্লিকবাড়ির দিকে হেঁটে তারপর টুক করে সে নিজেদের রান্নাঘরে ঢুকতে পারত। সেই ঘরের পোতা ব্রজকাকা যাওয়ার পরে ভেঙে সেখানে গোয়ালঘর বানিয়েছে বক্রখুড়ো। আর ওই জায়গা বাবদ জেঠামশাইয়ের ঘরের কোনায় বক্রখুড়ো জমি দিয়েছে বড়দাকে।

বয়স্ক মানুষের বুদ্ধি বেশি। অভিজ্ঞতাও। নইলে জেঠামশাই ছাড়া আর কেউ এটা বুঝল না যে, বাড়ির পেছনে কল বসানোর সিদ্ধান্ত হওয়ায় বিজলিদির এমন প্রতিবাদ। তাই জেঠামশাইয়ের কথায় আবার আগের জায়গায়ই কল বসানোর সিদ্ধান্ত হলো। আগের পাইপ জং ধরেছে। আগে তুলতে হবে। মিস্ত্রিরা দেখবে এর ভেতরে কতগুলো পাইপ আবার ব্যবহার করা যাবে। সরকারি লোক ডিপ টিউবওয়েলের যে-মাপ বলেছে সেসব বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুদিন কাটল। হয়তো বাড়ির লোকজন ভেবেছিল, পেছনে একটা কল লাগালেই হলো। সেটা পরীক্ষা করতে আপাতত সরকারি লোক আসবে না। যদি আসেও, সবার কেন যেন মনে হয়েছিল, ওই জায়গায় কল বসালে জলে আর্সেনিক থাকবে না। কিন্তু বাড়ির ভাইয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল, ডিপ টিউবওয়েলই বসানো হবে। তাহলে আর আর্সেনিকের ঝামেলা থাকবে না।

মিস্ত্রিদের ভেতরে বয়স্ক একজন বলে গেছে, ডিপ হবে কি হবে না সেটা অন্য কথা, কতটুকু পর্যন্ত গভীর করলে আর্সেনিক আসবে না তা সে জানে। তখন সেমতো সিদ্ধান্ত হয়, মিস্ত্রিরা তাদের হিসাবমতো যে-কল বসিয়ে দিয়ে যাবে, তাতেই কাজ হবে। তারা বিভিন্ন বাড়ি কল লাগিয়ে এত ঝানু যে, বাড়ির লোকজনও সে-কথা মেনে নেয়।

সেমতো কল নতুন করে বসানো হয়। কলতলা নতুন করে ঠিক করা হয় না। তারপর ধীরে ধীরে যখন খালের জল শুকোয় আর ধানের কারবারের জন্য নৌকায় ঘুমানোর দিন আসে, তখন রাতে জল খেতে আসে বিজলিদি। তার আগে থেকেই সব ঠান্ডা। দক্ষিণের বাগানে একটা গাছের ডালও ভাঙে না রাতে। বাড়ির পেছনে কল বসানোর সিদ্ধান্ত হলে তো সে মেগনিশ কি মেহগনি গাছের ডালও ভাঙতে শুরু করছিল। মেগনিশের বড় ডালের মাথায় যে গুচ্ছ ডাল তা সহজে ভাঙা যায়, তাই ভেঙে নিচে ফেলেছে। মেহগনির ডাল খুব শক্ত, সেগুলো শুধু ভেঙেছে, খুলে নিচে ফেলতে পারেনি। আম বা কাঁঠাল বা অন্যান্য গাছের ডাল সে ভাঙেনি। সুপারি আর নারকেলের তো ডাল নেই বলতে গেলে। যা আছে তা ড্যাগা বা বাইল; সেগুলো ভাঙেনি বা ছেঁড়েনি।

যাক, নতুন কল বসলে প্রতিদিন বিজলিদি জল খায়। নৌকায় বসে সে-শব্দ শোনা যায়। তখন স্বপন ঘাড় তুলে দক্ষিণের বাগানে তাকায়। আকাশে চাঁদ থাকলে তা কতটা ঢলেছে তা বোঝার চেষ্টা করে। দেখে, বাগানের পশ্চিম কোনায় বাঁশঝাড়ের মাথায় চাঁদটা বসে আছে। রেডিওতে নিশুতি শুরু হলে স্বপন তাই শুনতে শুনতে ঘুমাতে চেষ্টা করে।

একদিন ‘দুঃখ আমার, আ-মা-র বাসর রাতের পালংক’ গানটা শুরু হওয়ার আগে একবারই মাত্র কল চাপার শব্দ। গানটা শুরু হওয়ার পর আর কোনো শব্দ নেই। কিন্তু গানটা শেষ হওয়ামাত্র কয়েকবার কল চেপে ঢকঢক করে জল খেয়ে তারপরও বেশ কিছুক্ষণ চাপতেই থাকে, চাপতেই থাকে। নতুন গান বাজে। তবু কল চাপা বন্ধ হয় না। সেদিনই সবচেয়ে বেশিক্ষণ কল চেপেছে বিজলিদি।

স্বপন একসময় চুপ করে। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। সবাই জানে অথবা জানে না, এরপর সে কী বলবে। আগেই জানা, বিজলিদির কোথায় বিয়ে হয়েছিল। কেন বাপেরবাড়ি এসে আর যায়নি। কেন আত্মহত্যা করেছিল।

কিন্তু বিজলিদি কেন সেদিন আর কল চাপেনি, সে-কথা জানা থাকলেও স্বপনের মতো কেউ তো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয়। বাড়ির অন্যরা জানত মেয়েটা ঘুরে বেড়ায়। জানত, বাপ ওইভাবে হুট করে চলে যাওয়ায় ওর রাগ হয়েছিল। জানত, ওর মতো আরো যারা আত্মহত্যা করেছে আশপাশের বাড়ির, তারা অমন নিশুতি রাতে কল চেপে জল না-খেলেও কেউ সাদা শাড়ি পরে বাগানে ঘোরে দিনের বেলায়, কেউ মন্দিরের সীমানায় বসে বাঁশি বাজায় মাঝরাতে, কেউ হঠাৎ বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে পথ চিনিয়ে দেয়। বর্ষার সময় ওই রাস্তা থাকে কাদায় তলানো। বড় রাস্তা থেকে গ্রামের রাস্তায় নেমে বোঝা যায় না পথ কোন দিকে গেছে। কতজন পাশের ছোট খালে পড়েছে। কিন্তু কেউ কেউ দেখেছে সামনে হোগলার ঝোপের গোড়ায় আলো। সেই সোজা নেমে এসেছে। রাস্তা ধরে এগোতেই হোগলার ঝোপে আর কোনো আলো নেই।

নতুন কল বসানোর পর বিজলির আচরণ সবচেয়ে কাছে থেকে জানত স্বপন। মুর্শিদাবাদ থেকে ব্রজকাকা চিঠি লিখেছে বক্রখুড়োর কাছে, বিজলির নামে এতদিন দুটো লবণ-ভাত খাইয়েছে কয়েকজনকে। ওর এক বোনপোকে নিয়ে সে গয়ায়ও গেছে। বিস্তারিত কিছু লেখেনি এ-বিষয়ে। শুধু এই দুটো কথা। তারপর থেকে আর কল চাপেনি বিজলিদি। বাড়িতে চিঠি এলে তাও হয়তো পড়ত।

আর কয়েক বছর আগে সেই গোলক জামগাছটা মরে গেছে!

বলেশ্বরের একদম কূলে সরকারি পুকুরপাড়ে বৈরাগীবাড়িতে বিয়ে হয়েছিল বিজলিদির। বরকে পছন্দ হয়নি তার। হয়তো তাই সত্যি। বিয়ের পর একবারই শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। আর যায়নি। যাবে না। পাঠানো যায়নি। এর বাইরে আর কোনো গল্প নেই। এটুকুই। সেই যে বাপেরবাড়ি এলো, কেউ আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে পারেনি। এ নিয়ে কতকিছু। বয়স কম থাকায় সব জানাও যেত না। তবে বোঝা যেত।

এই যে সামনে দক্ষিণের বাগান। ভেতরের দিকে ছিল সেই গোলক জামগাছটা। সেই গাছে। দুপুরের পরে।

কিন্তু বিজলিদিকে কেউ কখনো সাদা শাড়ি পরে বাগানে ঘুরতে দেখেনি।

এসব স্বপনই কিছুদিন পর হঠাৎই বলে। বলেই চুপ করে যায়। আজো তার বোঝা হয়নি, কেন রেডিওতে নিশুতি অনুষ্ঠানে ওই গানটা শুরু হলেই কল চাপা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারপর শেষ হলে আবার সে কল চেপে অত জল খেয়েছিল। এ-কথাটা সে আজই বলল।

আরো বলল, ওই নৌকায় শুয়ে পড়লে ওই দক্ষিণের বাগানের রাস্তা ঘেঁষে পশ্চিম কোনার বাঁশঝাড়ের মাথায় চাঁদ উঠলে সে চেয়ে থাকত, যদি বিজলিদিকে দেখা যায়। অমাবস্যার রাতে তো দেখার সুযোগ ছিল না। শুক্লপক্ষেই দেখতে চাইত শুধু। কিন্তু কোনোদিন সে ওখানে ভয় দেখাতেও আসেনি। কারো কোনো অনিষ্ট করেনি।

তারপর বেশ কয়েক বছর পরে তাঁর ছেলেটা যখন কাজলা দিদি কবিতাটা পড়ত, তখন আর ধানের কারবারে স্বপন নেই। বিজলিদিও কল চাপে না। কিন্তু তার মনে হতো, ওই কবিতার কাজলা দিদি বিজলিদি। যদিও ওই বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠলে, সমস্ত ভয় জয় করে, নিশুতি শোনার সময়ে বিজলিদি কল চাপামাত্রই সে নৌকা থেকে কলের কাছে টর্চের আলো ফেলেছে। কিন্তু সে দেখতে পায়নি কিছুই। কলের হাতল উঠছে-নামছে, জল পড়ছে।

আসলে কী, যে যা-ই বলুক, বিজলিদি এখন কল না-চাপলেও তাকে ভোলা যাবে না। অন্তত সমবয়েসিরা কেউ ভুলতে পারব না। সে আমাদের কাছে কাজলা দিদি হয়ে গেছে।