কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও তাঁর লেখার বিষয়-অনুষঙ্গ

আহমেদ মাওলা

জীবন ফুরিয়ে যায়, কথা শেষ হয় না। সরব জীবনকে মৃত্যুই নীরব করে দেয়। কী দুঃসহ সময়ে ডুবে আছি আমরা! এরই মধ্যে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কথা পত্রিকার সম্পাদক কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর (১৯৬৩-২০১৫)। মৃত্যু হঠাৎ যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাঁকে। শহীদুল জহিরের মতোই যেন ফুলের কলি না ফোটার আগেই ঝরে পড়লেন। এরকম অকালপ্রয়াত গোলাপের বিলাপ শুনে স্থির থাকতে পারি না। এই সেদিন ২৬ জানুয়ারি কুমিল্লা রেলস্টেশনে হঠাৎ দেখা আমার সঙ্গে। অন্য বগিতে আমার সিট। তবু আমাকে ডেকে নিলেন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার কম্পার্টম্যান্টে। তারপর দুজন প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জম্পেশ আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম বুঝতে পারিনি। কথা হচ্ছিল তাঁর নিজের লেখালেখি নিয়ে। হৃদমাজার নামে তাঁর সদ্যসমাপ্ত (এখনো অপ্রকাশিত) উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে তিনি উপলব্ধি করেছেন, মানুষের হৃদয়ে রয়েছে এক অলৌকিক মাজার ‘আত্মা’। সেই আত্মার অভিনব সব ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছিলেন আর মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আমি। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রতও করেছি। তবু তাঁর দেশবাড়ি শাহবাগ (২০১৪), ভালোবাসার সনে আলাদা সত্য রচিত হয় (২০১৩) বিষয়ে এবং বাংলাদেশের সমকালীন উপন্যাস ও গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এন্তার তর্কবিতর্ক, ভিন্নমত শুনেছি তাঁর। আমি বললাম, গল্প-উপন্যাসে আপনার ভাষাভঙ্গিতে আমার প্রবল অভিযোগ আছে – যেমন সাধু, চলিত ক্রিয়া  পদের ব্যবহার এবং অহেতুক বাক্যকে পেঁচিয়ে বলার স্বভাব আপনার লেখায় দেখা যায়। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে তিনি নিজের পক্ষে যুক্তি দেখান, উদাহরণ দেন কমলকুমার মজুমদারের। আমি বললাম, কমলকুমার মজুমদারের গদ্য বাংলা সাহিত্যে অনুসৃত গদ্য নয়। কমলকুমার যে-বিষয় জীবনকে তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন সেটি একান্ত কমলকুমারীয় ভঙ্গি, সে-গদ্যকে অনুসরণ করে সমকালীন জীবনকে তুলে  ধরা সম্ভব নয়। সম্ভব কি সম্ভব নয় নিয়ে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বিস্তর যুক্তি দেখালেন। চট্টগ্রাম বটতলী স্টেশনে যখন নামলাম, তখন রাত সাড়ে এগারোটা। কোনখান দিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা চলে গেল বুঝতে পারিনি। সেটা সংস্কৃতি হয়ে যাবে, এত দ্রুত কে তা জানত।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সাহিত্যিক আদর্শ ছিল কমলকুমার মজুমদার। কমলের সব লেখাকেই তিনি খুঁটিয়ে পড়তেন, তাঁর  শৈল্পিক দৃষ্টি, নান্দনিক রুচির কথা বলতেন গভীর আবেগের সঙ্গে। কথা পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যা (২০১৫) ছিল কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা। এছাড়া কমলকুমার নিয়ে তাঁর একক প্রবন্ধগ্রন্থ কমলনামা (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৫) প্রকাশিত হয়েছে এ-বছর। এছাড়া শহীদুল জহির, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা পড়তেন নিমগ্ন হয়ে। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন চিকিৎসক। চাকরি করতেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। কিন্তু ছিলেন সাহিত্য-অন্ত্যপ্রাণ মানুষ। শুধু সাহিত্যকে ভালোবেসে চেম্বার করা বাদ দিলেন, প্রায় প্রতিদিন আড্ডা দিতে আসতেন ‘বাতিঘর’ চেরাগীপাহাড়ে; কিন্তু কোনো সাহিত্য বা কবিতা পাঠের আসরে তাঁকে দেখা যেত প্রথম সারিতে। সদাহাস্যোজ্জ্বল, অমায়িক, সদালাপী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের নির্বিরোধ, নিরহঙ্কারী মুখ আজো চোখে ভাসে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ মৃতের কিংবা রক্তের জগতের আপনাকে স্বাগতম (২০০৫) জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলে বাতিঘরে আমার সঙ্গে দেখা হয়। আমার হাতে বইটি তুলে দিতে গিয়ে লিখেছেন। প্রিয় জন। মুখে সলজ্জ হাসি। প্রথম বইয়ের শিরোনামের মতোই কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। প্রথম গ্রন্থের নামিক গল্পে যুবক তার মায়ের কাছে শুনেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে যে-ঘরে, সেটি এখন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ইনচার্জ, লাইব্রেরিয়ানের দৃষ্টি এড়িয়ে যুবকটি খুঁজতে থাকে সেই কক্ষটি, যেখানে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। ১০৫ নম্বর রুমের সামনে বড়ো একটা চিৎকার শুনতে পায় যুবকটি। শব্দটির উৎপত্তিস্থল ঠাহর করতে পারে না। ‘কাউকে কি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে কেউ!!!’

সেই চিৎকারটি একসময় তামাটে রোদের মতো সর্বাঙ্গে ঝাপ্টা মারে। রক্তে ফোয়ারার ভেতর যুবকটি এক সময় একেবারে জব্দ হয়ে যায়। গল্পের শেষে বোঝা যায়, বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কী সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করে শহিদদের মহান আত্মত্যাগ।

‘কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প’, ‘স্বপ্নবাজি’ কিংবা সর্বশেষ  এ-বছর বইমেলা  থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা ও অন্যান্য গল্পের (জাগৃতি) ‘আমাদের জয়বাংলা’ – গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ছিলেন উত্তর প্রজন্মের লেখক। মুক্তিযুদ্ধ এবং গণমানুষের সাধারণ জীবনই ছিল তাঁর গল্পের বিষয়-অনুষঙ্গ। ‘আমাদের জয়বাংলা’ গল্পটিতে এই স্লোগানটি একাত্তরে ছিল বাঙালির মুক্তির মন্ত্র, সাহসের হাতিয়ার। অনেক বছর পর ‘গণজাগরণমঞ্চে’ এই জয়বাংলা স্লোগানটি আবার ফিরে এলো,  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের প্রসঙ্গে। গল্পে তিনি দেখিয়েছেন ‘জয়বাংলা’ একটা দলের স্লোগান নয়, দেশকে, দেশের মাটিকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে এটাকে দেখতে চান – নবীন প্রজন্মের এই যে চিন্তা, এর মধ্যে একটা অভিনবত্ব আছে। হৃষ্টপুষ্ট নেতাদের চোর-চোর চেহারার মধ্যে তিনি দেখতে চান সামাজিক সত্যকে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়টি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্পে নানাভাবে উঠে এসেছে। তাঁর উপন্যাস দেশবাড়ি শাহবাগ, পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী, হৃদমাজার, যখন তারা যুদ্ধের শিরোনাম দেখেই বোঝা যায় এ-লেখকের মানসপ্রবণাতা ছিল মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা। সামাজিক সংকট, ব্যক্তির বেঁচে থাকার সংগ্রাম, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, শাসক দলের দখলদারিত্ব – এসব হয়ে উঠেছে তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয়। তাঁর দেখার দৃষ্টিতে একটা স্বাতন্ত্র্য আছে, যেটা হয়তো বক্তৃতামঞ্চের বক্তার ভাষণের চেয়ে ভিন্ন।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি কথাসাহিত্যের ওপর বেশ কয়েকটি সমালোচনামূলক কিংবা প্রকরণশৈলী নিয়ে লিখেছেন আলোকদীপ্ত গ্রন্থ। উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু, কথাশিল্পের  জল-হাওয়া, গল্পের গল্প প্রভৃতি। এই গ্রন্থগুলোতে তাঁর যে-অবলোকন, পাঠ-অভিজ্ঞতার পরিচয় আমরা পাই, তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর বিবেচনাগুলো মোটেই প্রথাগত নয়, তার মধ্যে অভিনত্ব আছে, ভিন্ন মতও আছে। সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর এসব মননশীল কাজ সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যের নতুন প্রকাশমাত্রা যোগ করেছে। কথা পত্রিকার এ-পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, তিনি কতটা সিরিয়াস ছিলেন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহীর, শাহাদুজ্জামান, মহীবুল আজীজ প্রমুখের লেখা, সাক্ষাৎকার, বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ, সমকালীন পুরোদেশের মূলধারার          লেখক-পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। বলা যায়, গত ১৫-২০ বছর ধরে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর দুহাতে লিখেছেন, ক্রমাগত লেখার চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। দৈনিক পত্রিকায় জায়গা যখন তৈরি করেছেন, তাঁর কাছ থেকে যখন আমরা শিল্পসফল উপন্যাসের অপেক্ষায় ছিলাম, তখনই তিনি হঠাৎ চলে গেলেন। তাঁর এই প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। অকালপ্রয়াত কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।