দেবকুমার ঠাকুরকে লোকে বলে দেবু ঠাকুর। গেল বর্ষায় সেই দেবু ঠাকুরের সঙ্গে রতনপুর গ্রামটিও খুন হয়ে গেল। খুনের রাতে গ্রামের লোকজন একত্র হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। চারদিককার বাড়ি থেকে ডিঙিনাও, কোষানাও, হারিকেন, কুপিবাতি আর টর্চলাইট নিয়ে লোকজন ছুটে এসেছিল। গাছপালা-ঝোপজঙ্গল-বাঁশঝাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠাকুরবাড়ি কিছুটা আলোকিত হয়েছিল। সেই আলোয় দেখা গেল বড় ঘরের দরজায় পড়ে আছেন ঠাকুর। গলা বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘাড়ের পাশে লেগে আছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে জায়গাটা। গলার কাছটায় রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। রক্তের গন্ধ তীব্র হচ্ছে।

ঘরটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। পুবমুখী ঘর, তিনখানা কামরা। প্রথমটাকে ডিসপেনসারি বলা ভালো। ঠাকুরের বসার কামরাও ওটাই। দক্ষিণ দিককার জানলার সঙ্গে একটা চৌকি পাতা। চৌকিতে তোষকের ওপর গরমকালে শীতলপাটি বিছানো থাকে। শীতকালে থাকে চাদর। পশ্চিম দিকে মাথার পাশে হাতলঅলা কাঠের পুরনো একখানা চেয়ার। পাশে সারধরা তিনটা ওষুধের আলমারি। উত্তর দিকেও দুটো আলমারি। তারপর ঠাকুরের শোবার কামরা। সেই কামরা ও তার পিছনের কামরাটি লোহা কাঠের তক্তা দিয়ে পাটাতন করা। এত মজবুত পাটাতন, হাঁটাচলার সময় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হয় না। পাটাতন করা কামরায় উঠতে হয় চার ধাপ কাঠের সিঁড়ি ভেঙে।

ঠাকুরের শোবার কামরায় তেঁতুল রঙের পুরনো পালঙ্ক আছে, আরাম কেদারা আছে। উঁচু একটা টেবিলে গ্রামোফোন আর রেকর্ডের বাক্স, পিনের বাক্স রাখা। ভারী পাল্লার বড় একটা আলমারি আছে। আলনা আর লোহার একটা সিন্দুক আছে। পশ্চিম দিকে আপারে ওঠার সিঁড়ি। আপার মানে মাথার ওপর কাঠের পাটাতন করা দোতলাই। শুধু ঝুলবারান্দা নেই বলে দোতলা বলা যাবে না। তৃতীয় কামরাটা ঠাকুরের বইয়ের জন্য। বেশ কয়েকটা আলমারিভরা বই আর বই। পত্রপত্রিকাও আছে বিস্তর। একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার। যেন এক বিরাট শিক্ষিত পণ্ডিত মানুষের ঘর। অথচ ঠাকুর ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছেন রতনপুর হাইস্কুলে। হলে কী হবে! ঠাকুর বাংলা তো ভালো লিখতে পারেনই, ইংরেজিটাও লিখতে-পড়তে পারেন খুব ভালো। তিনি যখন মগ্ন হয়ে বইপত্র পড়েন তখন আর তাঁকে ডাক্তার মনে হয় না। মনে হয়, স্কুলের হেডমাস্টার মশায় আর নয়তো কলেজের অধ্যাপক।

বীরেন চৌধুরী ঠাকুরের ঘরেই ছিলেন। দরজা খোলা ছিল। আততায়ীদের দেখে দৌড় দিয়েছিলেন তিনি। উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার আগেই গরু জবাই করার ছুরিতে জবাই করা হয়েছে তাঁকে। চৌধুরী একটু মোটাতাজা আর ঠাকুর

রোগা-পাতলা। তবে দেব ঠাকুর অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী। দুধের সরের মতো গায়ের রং। লম্বা শরীরে এক বিন্দু মেদ নেই। খাড়া নাক, মাথাভর্তি চুল। চেহারা দেবদূতের মতো। এই গ্রামে তাঁর মতো সুন্দর পুরুষ আর নেই। তিনি হাসলে অন্ধকারে ফুটে উঠত আলোর রেখা। কথা বললে মনে হতো আবেগ, মায়া আর মমতা বৃষ্টির মতো ঝড়ছে।

সেই মানুষ খুন হয়ে গেলেন গত বর্ষার রাতে।

হাজাম বাড়ির ছেলে বদরু ছিল তাঁর ‘গোমস্তা’। এই অঞ্চলে চাকরকে বলে ‘গোমস্তা’। হাজামরা অচ্ছুত আর ঠাকুর ব্রাহ্মণ। কুলীন ব্রাহ্মণের গোমস্তা অচ্ছুত হাজাম, এই ঘটনা বিরল। ধর্ম ব্যাপারটাকে ঠাকুর কখনো বড় করে দেখতেন না। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার। তবে নামযশ, প্রতিপত্তি বিশাল। দশ গ্রামে তাঁর নাম। সব রকমের চিকিৎসা জানেন। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, আয়ুর্বেদীয়, এমনকি জাদুটোনা, টোটকা। দেবু ঠাকুর এক বিচিত্র মানুষ। তাঁর সাহসের তুলনা ছিল না। বদরুকে নিয়ে একা চল্লি­শ-পঞ্চাশ কানি বাড়িটায় থাকতেন। বাড়ির পুবের অংশ ঠাকুরদের। পশ্চিমের অংশ চৌধুরীদের। সেই বাড়িরও সবাই ঠাকুরদের মতো দেশ ছেড়েছে সাতচল্লি­শে। শুধু বীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী ছিলেন আসা-যাওয়ার মধ্যে। কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গের কালনায় ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে, কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানের এই বাড়িতে। দেশের প্রতি মায়ায় না অন্য উদ্দেশ্যে মানুষ দুটো এখানে পড়ে ছিলেন ভগবান ছাড়া কেউ তা জানে না। দেশের মায়ার চেয়ে ধন-সম্পত্তির মায়া হয়তো বেশি। জমি এমন জিনিস, যত দিন যাবে দাম শুধু বাড়বেই। একদিন এই বাড়ি আর বাড়ির লাগোয়া চাষের জমি, বিলের দিককার জমি সবই সোনা হয়ে যাবে।

ঠাকুর কি সেই আশায় পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গেলেন?

ঠাকুরকে তাঁর শত্রুরাও লোভী বলবে না। টাকা-পয়সার লোভ তাঁর আছে বলে মনে হয় না। বিনা পয়সায় রোগী দেখেন বিস্তর। গ্রামের যুবক ছেলেদের নাটক-ফাংশন, ফুটবল, ধরাছি খেলার সব খরচ একাই বহন করেন। পহেলা বৈশাখে ‘গলুইয়া’ মিলে কালিরখিলের মাঠে, তালুকদার বাড়ির মাঠে, কুসুমপুরের চন্দ্রেরবাড়ির মাঠে। ঘুড্ডির কাটাকুটি খেলা হয়। গরুর দৌড় হয়। বর্ষাকালে হয় নৌকাবাইচ। ভাগ্যকূলের টলটল ঠাকুরের বাইচের নৌকা ভালো টাকা খরচা করে আনান ঠাকুর। সোনার মেডেল দেন যারা ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হয় তাদের। সাঁতার প্রতিযোগিতা, গ্রামের স্পোর্টসেও ঠাকুরই করছেন সব। যাত্রা, পালাগান, কৃষ্ণলীলা, কোথায় নেই ঠাকুর! টাকা যায় শুধুই তাঁর গাঁট থেকে।

নবান্ন উৎসবটা এই এলাকায় ‘খোদাই শিরনি’। সেখানেও আছেন ঠাকুর। গলুইয়ার দিন রসগোল্লা, লালমোহন, আমৃত্তি আনিয়ে রাখেন হাঁড়ি হাঁড়ি। পোলাপান যারাই আসছে বাড়িতে, পেট পুড়ে খাওয়াচ্ছেন তাদের। গলুইয়ায় যাওয়ার জন্য একটা করে কাঁচা টাকা দিচ্ছেন। টাকার লোভে সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরাও আসে ঠাকুরের কাছে।

বাড়ি ভর্তি আমগাছ, জামগাছ, কলার ঝাড়। পেঁপে, লিচু, সফেদা আছে, বরই-পেয়ারা আছে। কাঁঠাল, নারকেল, বেল, তেঁতুল আছে। বছরভর কোনো না কোনো ফল জমে আছে রান্নাঘরের মাটির মেঝেতে। গ্রামের লোকদের তো খাওয়াচ্ছেনই দূর-দূরান্তের রোগীরা এলে তাদেরও খাওয়ান। এত হাত খোলা দয়ালু মানুষ! শারীরিক সৌন্দর্য যেমন, মনের ভিতরটাও তেমন।

এই মানুষ খুন হবেন কেন? কারা খুন করবে তাঁকে?

বীরেন চৌধুরী ছিলেন ঠাকুরের ঠিক উলটো। কৃপণের চূড়ান্ত। বিক্রমপুর অঞ্চলে বলে ‘কিরপিন’। চৌধুরীটা ছিলেন মহা কিরপিন আর লোভী আর অহঙ্কারী। মানুষকে মানুষ মনে করতেন না। গাছের একটা শুকনো পাতাও কেউ কুড়িয়ে নিতে পারত না তাঁর চোখের সামনে থেকে। গভীর ধর্মবিশ্বাসে শরীর-মন দুটোই ভর্তি। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় মুসলমানদের খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। গ্রামে প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই এমন মুসলমানদের দিকে তাকাতেন খুবই বিরক্ত হয়ে। অন্যদিকে নিম্নশ্রেণির হিন্দু, কামার-কুমার-ঋষি-মুচিদেরও আলাদা কদর তাঁর কাছে। দূরসম্পর্কের একটা বুড়ি ছিল বাড়িতে। সরস্বতী নাম। কোনো রকমে ন্যূব্জ ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে সংসারকর্ম চালিয়ে যেত। রান্নাবান্না ধোয়া-পাকলার কাজ করত। থাকত চৌধুরীর ঘরে।

চৌধুরীকে লোকে বলে ‘চদরি’। বাড়িটাকে বলে ‘চদরি বাড়ি’। অতীতকালে হয়তো দালানকোঠা ছিল বাড়িতে। পঞ্চাশ ষাট সালের দিকে একটা দেবে যাওয়া অতি জীর্ণ টিনের ঘর ছাড়া আর কিছু ছিল না। সেই ঘরের ভিতর দিনেরবেলায়ও আলো ঢোকে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন। জানলার পাশে চদরির খাট ছিল। চদরি সেই খাটে আধশোয়া হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। আসলে বাড়ি পাহারা দিতেন। কাউকে দেখা গেলেই হই হই করে উঠতেন। ‘কেডা রে? কেডা?’

পোলাপান বা বুড়া মানুষ, নারী বা পুরুষ যে-ই যায় সে তার পরিচয় দেবে। তার পরও চদরি গলা নামান না।

চেনা-পরিচিতজনকেও ধমকের গলায় বলেন, ‘বাড়ির ওপরে দিয়াই তোমগ আসা-যাওয়া করন লাগব? নামা দিয়াও তো রাস্তা আছে! ওই রাস্তায় যাও না ক্যা?’

সাতচল্লি­শের আগে চদরিকে লোকে ভয় পেত। এলাকার হিন্দু-মুসলমান সবাই। পাকিস্তান হওয়ার পর সেই দাপট চদরির কমেছে। মুসলমানরা তেমন পাত্তা দিতে চায় না। বিশেষ করে যুবক পোলাপান। তারা ঘাড় ত্যাঁড়া করে জবাব দেয়। ‘বাড়ির উপরে দিয়া গেলে কী হইছে? বাড়ি খাইয়া হালাইছিনি? বেশি ভ্যাকর ভ্যাকর করবেন না।’

চদরি ক্ষেপে উঠতে গিয়েও ওঠেন না। সেই দিন এখন আর নাই। পূর্ববঙ্গ এখন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেছে। হিন্দু রাজত্ব নাই। মুসলমান রাজত্ব চলছে। বেশি কথা বললে কাইজ্জাকিত্তন লেগে যাবে। অপমান-অপদস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। এখন মুসলমানরা আর আগের মতো মান্যগণ্য করে না। করবেও না বোঝা যায়। আগের দিন নাই।

চদরি নিজেই তারপর থেমে যান। কথা বলেন না।

সরস্বতী মারা গেল জলে ডুবে। ঠাকুর চদরি দুই বাড়ির মাঝখানে গোল একটা পুকুর। চারপাশ থেকে ঝোপজঙ্গল এসে নেমেছে পুকুরে। বেতঝোপ, টোসখোলা আর ছিটকির ঝোপ। বাঁশঝাড় হেলে পড়েছে পুকুরের ওপর। হিজল-বউন্না জড়াজড়ি করে আছে। জলেও উদ্ভিদের আকাল নাই। শুধু চদরির অংশে পুকুরের একটুখানি জায়গা ফাঁকা। পরিষ্কার। ধোয়া-পাকলা আর চদরির স্নানের ব্যবস্থা। এই জায়গাটায় পড়ে গিয়েছিল বুড়ি। আর উঠতে পারেনি। চদরি ছিলেন বাড়ি পাহারায় ব্যস্ত। ঠাকুর গেছেন রোগী দেখতে। বিকেলে বুড়ির লাশ ভেসে উঠল।

তারপর থেকে ঠাকুর আর চদরির তিনবেলার রান্না চদরিই করেন। ভোরবেলা উঠে ঠাকুরের ঘরে চলে আসেন। আগে ঠাকুরের কম্পাউন্ডার ছিল দক্ষিণ পাড়ার প্রিয়নাথ। সে থাকত ঠাকুরের রান্নাঘরে। কম্পাউন্ডারির ফাঁকে ফাঁকে ঠাকুরের রান্নাবান্না করে দিত। অনেকটা রাত জেগে হামানদিস্তায় বয়রা, শুকনা আমলকী, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, তেজপাতা, শুকনা নিম আর তুলসীপাতা মিলিয়ে ‘ফাকি’ মানে গুঁড়া করত। ঘৃতকুমারির রস, অন্যান্য চেনা-অচেনা লতাপাতার রস বানিয়ে শিশিতে ভরে রাখত। ওসব আয়ুর্বেদীয় ওষুধ। পাঁচখানা ওষুধের আলমারি ঘরে। একটায় থাকে ওইসব শিশি-বোতল। সাধনা ঔষধালয়ের সারিবাদি শালসা, চ্যাবনপ্রাস এইসব কিনে আনা হতো দিঘলী বাজার থেকে। পাইকারি দরে আনা হতো হোমিওপ্যাথি এলোপ্যাথি। একেক রকম ওষুধ একেক আলমারিতে। রাতের বেলা বা নির্জন দুপুরে, যখন বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে তখন হয়তো খেয়েদেয়ে ঠাকুর শুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন, আর রান্নাঘরে বসে প্রিয়নাথ হামানদিস্তা চালাচ্ছে। হাওয়ায় ভাসছে মনোরম গন্ধ। ফাল্গুন চৈত্রমাসের ঠা-ঠা রোদ পড়ে আছে উঠোনে। হাওয়া নেই। গাছপালার ছায়া পড়েছে খোলা চত্বরে। পাখি ডাকছে, বুনোফুলের গন্ধ এসে ওইসব ঔষধির সঙ্গে ফাকি হচ্ছে প্রিয়নাথের হামানদিস্তায়। সেই একটানা ছন্দময় শব্দে বই বুকের কাছে রেখে ঠাকুর হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন তাঁর কামরায়। পৈতাটা গলার একপাশে লুটিয়ে আছে।

প্রিয়নাথটা ছিল পাতিশিয়ালের মতো। ঠাকুরের আয়ুর্বেদীয় হোমিওপ্যাথি-এলোপ্যাথি ওষুধের অনেকটাই চিনে ফেলেছিল। জ্বরে কোন ট্যাবলেট, মিকচারটা বানিয়ে দিতে হবে কী কী জিনিস দিয়ে, কাগজ কেটে শিশির গায়ে দাগচিহ্ন দিতে হবে কেমন করে এসব টুকটাক জিনিস শিখেছিল। ওই জ্ঞান পুঁজি করে দেবকুমার ঠাকুরকে সে ছেড়ে গেল। বলল, পৈতৃক সম্পত্তি কিছু বিক্রি করে বাজারে মুদি-মনোহারির দোকান দেবে। স্বাধীন ব্যবসা। অন্যের কাজ আর করবে না।

তার পরও ঠাকুর তাকে ছাড়তে চাননি। মাহিনা কিছু বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। প্রিয়নাথ আছে চতুর চিন্তায়। কোনো প্রলোভনই তাকে কাবু করতে পারল না। দেবু হাতুড়ে ডাক্তার। বই পড়ে পড়ে ডাক্তারি বিদ্যা শিখেছেন। আর প্রিয়নাথ শিখেছে ঠাকুরকে দেখে দেখে। হাত ভালোই পেকেছে তার। ঠাকুর পারলে সে পারবে না কেন?

ঠাকুর তাকে ছাড়তে বাধ্য হলেন।

কিছুদিন পর দেখা গেল কিসের প্রিয়নাথের মুদি-মনোহারির দোকান? সে পুরনো একখানা সাইকেল কিনেছে, একটা স্টেথিসকোপ আর ডাক্তারি ব্যাগ কিনেছে। এই গ্রাম সেই গ্রামে সস্তায় কিছু রোগী জোগাড় করেছে। গলায় স্টেথিসকোপ মালার মতো ঝুলিয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে গ্রামান্তরে যায়।

ঠাকুর খবর পেয়ে হাসলেন। ‘মরণ আইছে বজ্জাতটার। পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে।’

দুজন ডাক্তার দুই তিনটা কারণে এই অঞ্চলে বড় নাম কামিয়েছিলেন। রতনপুরের দেবু ঠাকুর আর সীতারামপুরের নিবারণ দত্ত। নিবারণ ডাক্তার কলেরার চিকিৎসাটা বড় ভালো করতেন আর প্রসবের কাজে তাঁর জুড়ি ছিল না। দেবু ছিলেন বসন্ত রোগের চিকিৎসায় অতুলনীয়। তাঁর হাতে বসন্ত রোগী মরতো না। গুটি বসন্ত নির্বংশ হতো।

প্রিয়নাথ ধরেছিল নিবারণের পথ।

নিবারণ ডাক্তার ঝুল পকেটঅলা হাফহাতা শার্ট পরতেন। ধুতি তো আছেই। ছিল একটা পুরনো সাইকেল। ওই সাইকেল নিয়ে রোগী দেখতে যেতেন।

প্রিয়নাথ ডাক্তারি শুরুর পর প্রসবের কাজ পাচ্ছিল না। অতি গরিব মানুষরাও তাকে ওই কাজে ডাকত না। কারণ তার বয়স কম। হাতও কাঁচা। ওই নিবারণকেই ডাকত। হাতে-পায়ে ধরে টাকা-পয়সা যতটা কমিয়ে দেওয়া যায় দিত। নিবারণ বা দেবু দুজনেই দয়ালু। টাকা-পয়সার লালচ তাঁদের ছিল না। মানুষ বাঁচানোই ছিল জীবনের ব্রত।

তারপরও একটা বাজে ঘটনা ঘটল নিবারণ ডাক্তারের জীবনে। কোরহাটির ওদিককার এক মধ্যবিত্ত বাড়িতে গিয়েছিলেন প্রসব করাতে। শিশুটিকে বাঁচাতে পারেননি। অপুষ্ট শিশু। পরিবারের প্রথম শিশু আসছে। জন্মের পর কাঁদলো ঠিকই তারপর চিরতরে গেল। বাড়ির লোকজন খুবই ক্ষিপ্ত হলো। বউটির প্রসব বেদনা উঠেছিল সকালের দিকে। তিনি গিয়ে পৌঁছেছেন দুপুরের মুখে মুখে। বিকেল পর্যন্ত একটানা চেষ্টা করে প্রসব করালেন। শিশুটিকে বাঁচাতে পারলেন না। বাড়ির লোকজন চড়াও হলো তাঁর ওপর। চরম অপমান-অপদস্ত করল। চড়-থাপ্পড় মারল। এত দুঃখ পেলেন মানুষটা! অপমানিত মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেই সন্ধ্যায় সাইকেলটা বাড়িতে রেখে একটা সুটকেসে জামাকাপড় আর টাকা-পয়সা যা ছিল পকেটে নিয়ে হেঁটে গেলেন দিঘলী। ভোররাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দের স্টিমার আসে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেই স্টিমার চড়ে বসলেন। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন ধরে সোজা শিয়ালদা স্টেশন। সাতচল্লিশের পরে পরিবার চলে গিয়েছিল বেশিরভাগ বিক্রমপুরের হিন্দুদের মতো পশ্চিমবঙ্গের কালনায়। সেখানে কোনো রকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। সীতারামপুরের বিশাল পাকাবাড়ি, বাঁধানো ঘাটলার পুকুর, ধানী জমি বিস্তর, সব পড়ে রইল। সঙ্গে রইলেন বড়ভাই হরিচরণ। হরিচরণ চিরকুমার। অতি কালো, অতি মোটা শরীর। পুকুরে নেমে ‘চান’ করতে পারতেন না শরীরের কারণে। ঘাটলায় বসে, পিতলের একটা কলস ভরে জল ঢালতেন মাথায়। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময় লোকজন সেই দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত আর হাসাহাসি করতো।

নিবারণ চলে গেলেন, হরিচরণ রয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে বাড়িঘর জায়গা-সম্পত্তির বন্দোবস্ত করে তিনিও একদিন স্টিমারে চড়লেন। জন্মভূমি ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে হলো মানুষের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ মানুষ দুটোকে।

হরিচরণও মানুষ ভালোবাসতেন। তিনি প্রকৃত অর্থে ছোটভাই নিবারণের কম্পান্ডারি করতেন। বাজারে পাটাতন করা ডিসপেনসারি ছিল তাঁদের। নিবারণ ‘কলে’ গেলে হরিচরণ চালাতেন দোকান। গরিব-গুরবাদের বিনা পয়সায় ওষুধ দিয়ে দিতেন। পথ্য কেনার পয়সাও দিতেন কখনো কখনো।

নিবারণ চলে যাওয়ায় প্রিয়নাথ ভাবল, এবার তার পসার বাড়বে। প্রসবের কাজও পাবে। তার আগে এলাকায় দেখা দিলো গুটি বসন্ত। রোগী দেখতে গিয়ে প্রিয়নাথ নিজেই বাধিয়ে বসল সেই রোগ। এমন ওঠা উঠল গুটি, প্রিয়নাথকে আর চেনাই যায় না।

এখন দেবু ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু দেবু মহাক্ষিপ্ত প্রিয়নাথের ওপর। মানুষটা এমনিতে খুবই হৃদয়বান, দয়ালু। তবে যেমন দয়ালু তেমন রাগী। একবার রেগে গেলে সেই রাগ সহজে ভাঙে না। তারপরও প্রিয়নাথের বুড়ি কুঁজো মা লাঠি ভর দিয়ে এলো ঠাকুরের কাছে। বিকেলের দিকে ঠাকুরবাড়িতে গ্রামের ময়মুরুব্বি আর ঠাকুরের সমবয়সী হিন্দু-মুসলমান সবাই আসে আড্ডা দিতে, চা খেতে। ঠাকুর সেই আড্ডার মধ্যমণি হয়ে বিক্রমপুরের অতীত দিনের নানা গল্প-কাহিনি-ঘটনা বলেন। মহাভারত, রামায়ণ থেকে নানান গল্প-কাহিনি বলেন। তাঁর বলার ভঙ্গি চমৎকার। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। তেমন গল্পে মাশগুল ছিলেন। সেদিনের আড্ডা জমেছিল উঠোনে। প্রিয়নাথের বুড়িমা এসে দাঁড়াল অদূরে। তাকে দেখেই গল্প থামিয়ে ঠাকুর বললেন, ‘কী, তোমার পোলার বসন্ত উটছে?’

বুড়ি মাথা নাড়ল। ‘হ। আপনে হোনলেন কার কাছে?’

‘কেউর কাছে হুনি নাই। আমার কাছে খবর আসে অন্যপথে। সেই পথ তোমরা বুঝবা না। তয় কথাটা তো সত্য, নাকি? বেদম গুটি উঠছে না?’

‘হ কর্তা। বেদম ওঠা উটছে। চিনন যায় না। চোক্ষের  ভিতরেও উটছে।’

‘অরে বাঁচান যাইবো না। কাইল এই টাইমে মারা যাইবো। তুমি বাড়িত যাও। ঘরে গঙ্গাজল থাকলে পোলার মুখে দেও গিয়া।’

সত্যি সত্যি পরদিন বিকেলে মারা গেল প্রিয়নাথ। গ্রামে গ্রামে রটে গেল ঠাকুর যে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন সেই কথা। কে কখন মারা যাবে সেই কথাও বলতে পারেন ঠাকুর? তিনায় তো মানুষ না! দেবতা! নাকি অন্য কোনো জাদু আছে মানুষটার? আগাম জানতে পারেন সবকিছু! মানুষের মৃত্যুর কথা ভগবান ছাড়া কেউ বলতে পারেন না। দেবু ঠাকুর বললেন কেমন করে?

এই ঘটনায় ঠাকুরের কদর আরো বেড়ে গেল। লোকে ভাবল তাঁর সঙ্গে অলৌকিক জগতের যোগাযোগ আছে। সে মানুষ, না মানুষের রূপ ধরা অন্যকিছু তাই বা কে জানে!

আর একটা বিষয় নিয়েও লোকজন তখন থেকে নতুন করে ভাবতে লাগল। এত বড় একটা বাড়িতে একলা পড়ে থাকেন ঠাকুর, চদরি থাকে তার ঘরে, ঘরে নগদ টাকা-পয়সাও থাকে, কই চোর-ডাকাত কেউ তো কখনো আসে না এই বাড়িতে! এলাকার বিখ্যাত ডাকাত বাজপুরের কালু, বিরাট নামকরা চোর সীতারামপুরের মুকসেদ, কই তারা তো কখনো ঠাকুরের বাড়িতে আসে না! বাড়ি বন্ধের মন্ত্র জানেন ঠাকুর? শরীর বন্ধের মন্ত্র জানে? এজন্য তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারে না কেউ?

তা হলে সেই মানুষ খুন হন কেমন করে?

এই প্রশ্ন ঘটনার রাত থেকেই মানুষের মনে। আজ এক বছর পর, মধ্য আষাঢ়ের রোদে ভাজা ভাজা হওয়া দিনে, ওফাজদ্দি সারেঙের গরুগুলোর জন্য বিলে দল আর আড়ালি ঘাস কাটতে এসে প্রশ্নটা নতুন করে মনে এলো বদরুর। সে আনমনা হলো।

আষাঢ় মাসের আজকের দিনটা রোদেলা। আকাশে টুকরো-টাকরা মেঘ কাকের মতো ওড়াউড়ি করে ঠিকই, রোদ একটু ঢাকা পরে ঠিকই, তবে বৃষ্টিটা হচ্ছে না। যদিও আষাঢ় মাইস্যা বৃষ্টির কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। এই এলো, এই গেলো। ‘নাওয়ের আগা ভিজে তো পাছা ভিজে না।’

প্রিয়নাথ কাজ ছেড়ে যাওয়ার পর কিছুদিন চদরি ছাড়া কেউ ছিল না ঠাকুরের সঙ্গে। খরালিকাল অর্থাৎ গ্রীষ্মের ঠাঠাপোড়া রোদে ঠাকুর ছাতা মাথায়, ব্যাগ হাতে, গলায় স্টেথিসকোপ ঝুলিয়ে রোগী দেখতে যান। চদরি তাঁর ঘরবাড়ি ফেলে ঠাকুরের রান্না করেন। আমের দিন। গ্রামের পোলাপান সারাদিন থাকে আম চুরির তালে। তাদের ঠেকানো কঠিন। ঠাকুর অবশ্য বলে দিয়েছেন, ‘আরে খাউক! পোলাপানে কয়টা আম আর খাইব।’ চদরি মানতে নারাজ। রান্না করতে করতেও মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরোন। আমচোর কাউকে দেখলে বিকট গলায় হাঁক দিয়ে ওঠেন। ‘কেডা রে? ওই কেডা …’

এই অবস্থায় একদিন একটা মুসলমান বাচ্চা ছেলে, সারেঙবাড়ির মিলু এসে লবণ চাইল। তাকে পাঠিয়েছে গ্রামের কয়েকজন ডাকবুকো যুবক। তারা দুপুরের দিকে রোজই ঠাকুরবাড়িতে আসে। কাঁচা আম পেড়ে কাঁসুন্দি মাখিয়ে খায়। ঠাকুর চদরি দুজনেই তা জানেন। ওদের সঙ্গে লাগতে যান না। চদরি এর একটা বিহিত চাইছিলেন। ঠাকুরকে বলেও ছিলেন, ‘কাঁচা আমগুলি খাইয়া শ্যাষ করতাছে। ব্যবস্থা নেও দেবু।’

ঠাকুর হেসে বললেন, ‘ব্যবস্থা আমি নিতে পারি। আমে হাত দেওন তো দূরের কথা, বাড়িতেই উঠতে পারব না। বাড়ির দিকে আসলেই ঠ্যাং কাঁপতে আরম্ভ করব। আতুড় লুলা হইয়া যাইবো। ওইটা আমি পারি। দুই চাইরটা আমের জন্য ওইটা করুম না। খাউক ছেমড়ারা।’

ওই ছেমড়ারাই মিলুকে পাঠিয়েছিল লবণ চাওয়ার জন্য। তারা লবণ আনতে ভুলে গিয়েছিল। মিলু রান্নাঘরের দরজায় এসে বলল, ‘ইট্টু নুন দেন।’

সর্বনাশ! ব্রাহ্মণের রান্নাঘরে ঢুকেছে মুসলমানের ছাও?

চদরি তেড়ে উঠে মারতে গেলেন মিলুকে। ছেলেটি ব্যাপারটার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। হতভম্ব হয়ে একটু দাঁড়াল। তারপর চদরির তেড়ে মারতে আসা দেখে দৌড়ে পালাল। তখন শুরু হলো চদরির গালাগাল।

দুপুরের পর ঠাকুর ফিরে এসে হাসলেন। ‘আগের ভাত তরকারি না হালাইলেও পারতা, বীরেন। খালি খালি কষ্ট করলা।’

চদরি অবাক। ‘তুমি জানলা কেমনে?’

ঠাকুর কথা বললেন না। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

চদরি যা বোঝার বুঝলেন। বললেন, ‘মুছলমানের হাতে তুমি খাইতে পারো দেবু, আমি পারি না। রান্ধনঘরে আইয়া নুন চাইছে ছেমড়া। তার পরও হেই ভাত তরকারি খামু? এইটা হয় না।’

‘ছেমড়া ঘরে ঢোকে নাই, বীরেন। দুয়ারে খাড়াইছিল।’

‘হেই খবরও আছে তোমার কাছে? কে কইলো এইসব?’

‘বাড়ি পাহারায় যাগো রাইখা যাই তারা জানায়। যাও, ভাত বাড়ো গিয়া। খিদা লাগছে।’

তার কয়েকদিন পরই বদরুকে রাখলেন ঠাকুর। মাস মাহিনা পনেরো টাকা। দুই ‘ওক্তের’ অর্থাৎ বেলার ভাত বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবে। সকালে শুধু মুড়ি-মিঠাই পাবে নাশতা হিসেবে।

থাকবে ঠাকুরের রান্ধনঘরে। খরালিকালে ঠাকুরের ব্যাগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে রোগীবাড়ি যাবে। বাইষ্যাকালে ঠাকুরের কেরায়া নৌকা অর্থাৎ ছইঅলা নৌকা বেয়ে যাবে। ঠাকুর তাকে বয়রা, হরীতকী, আমলকী ওসবের ফাকি করার কাজেও লাগাবেন।

শুনে চদরির মাথায় বাড়ির পুরনো জামগাছ দুটো একসঙ্গে ভেঙে পড়ল। ‘করছ কী দেবু? গোমস্তা রাকলা মুছলমান? তাও হাজাম?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘আমি হিন্দু-মুছলমান বুঝি না। মানুষ বুঝি। হাজামরাও মানুষ।’

এইভাবে বদরু এসে ঢুকেছিল দেবু ঠাকুরের বাড়িতে।

২. বদরু হাজামের বয়ান

আল্লার কসম, আমি কিছু জানতাম না। যুদি আমি উদিস পাইতাম, কোনো রকমে উদিস পাইতাম তয় ঠাকুর দাদারে কেঐ মারতে পারতো না। হয় তারে আমি বেবাক কথা কইয়া দিতাম, নাইলে তারে কোনওহানে হামলাইয়া থুইতাম। আর যুদি খুনি শালাগ সামনে পরতাম তয় আমারে মারণ লাগতো আগে তার বাদে দাদার শইল্লে হাত দিতে পারতো। দাদার লগে আমিও খুন হইয়া যাইতাম। তাতে আমার কোনো দুঃখ থাকতো না।

খোদার কসম, আমি কিছু জানতাম না। কিছু আন্তাজও করি নাই। কেমনে করুম? দাদার এত ক্ষেমতা! তার শইল্লে হাত দিব কে? যে হাত দিতে আইবো তার আর হাত থাকবোনি? জান থাকবো?  দাদারে যারা পাহারা দিয়া রাখে, দাদারে যারা দেইখা-শুইনা রাখে, দাদার সামনে তারা কেঐরে আইতে দিব? দাদারে খুন করা তো দূরের কথা, এইডা যারা চিন্তা করবো তারাই তো গলা দিয়া রক্ত উইঠা মরবো। নাইলে আতুড়-লুলা হইয়া যাইবো। যেই হাত দিয়া দাদারে মারতে চাইবো হেই হাত দিয়া কামকাইজ কইরা খাইতো পারবো না। জিন্দেগির তরে লুলা হইয়া যাইবো।

আমি তেরো বচ্ছর দাদার লগে কাম করছি। এক মিহি আছিলাম তার গোমস্তা, আরেক মিহি কম্পাউন্ডার। দাদায় আমারে বেবাক কিছু হিগাইছিল। টাইম লাগছে হিগাইতে। আস্তে আস্তে, দিনে দিনে হিগাইছে। আমিও হিগছি। কোন লতাপাতার রস কিরমির অষইদ, কোন কোন জিনিসের ফাকি এক লগে কইরা, তার লগে মধু মিশাইয়া পেট বেদনার অষইদ, বাতের অষইদ, বুক ধরফরানির অষইদ বানাইতে হয়, দাদায় আমারে বেবাক হিগাইছে। মিচকার বানানোর জিনিস চিনাইছে। কোন পাউটারের লগে কোন পাউটার মিশাইয়া লাল হইলদা কউচ্চা মিচকার বানাইতে হইব, আমি বেবাকই জানি। পিয়নাথ যা যা হিগছিল হেই হগল বেবাকই আমি হিগছি। তয় পিয়নাথ লেখাপড়া জানতো। কেলাস সেভেন তরি পড়ছে। আমি তো আর তা না। আমি তো স্বরে অ স্বরে আ-ই জানি না। নাম সই করতে পারি না। আমার হইল লউংয়ের ছাপ। দাদার ভাষায় ‘ক অক্ষর গো মাংস।’

এই গরুডারেই দাদায় মানুষ বানাইছিল। তেরোডা বচ্ছর দাদার লগে আছিলাম। কত কিছু হিগছি তার কাছ থিকা! কত কিছু জানছি, দেখছি! গেল বচ্ছর আছিল পাষট্টি সাল। বাইষ্যাকালে তিনায় আর চদরি মোশাই খুন হইয়া গেলেন। আইজ এক বচ্ছর। এই এতডি দিনে একটা মিনিটের লেইগাও দাদারে আমি ভুলতে পারি নাই। এমুন মানুষও দুনিয়াতে হয়! দেখতে যেমুন রাজরাজার লাহান, সাহস তেমুন। আর সাহস হইব না ক্যা? তিনায় তো একলা আছিলেন না! তার লগে আছিল সাতজন। তারা হারা বাড়ি ঘুইরা বেড়াইতো। মাঝে মাঝে বইতো রান্ধনঘরের পিছে যে জোড়া জামগাছ দুইখান আছে, সেই গাছে। মাঝে মাঝে জামতলায় এক লগে হইতো। তেরো বচ্ছরে কতবার আমি তাগো দেখছি! জোছনা রাইতে উডানে খাড়াইয়া দাদায় তাগো লগে কথা কইতেন। তয় বেশিক্ষুণের লেইগা না। দুয়েক মিনিট। চোক্ষের নিমিষে তারা আইতো, চোক্ষের নিমিষে চইলা যাইতো। এই আছে, এই নাই। সাতজন। রান্ধনঘরের ফুর্দ্রি দিয়া আমি এক রাইতে গইন্না দেকছি। কইলে কেঐ বিশ^াস করবো না, তারা সাতজন অবিকল দাদার লাহান। এক রকম লাম্বা, এক রকম শইল্লের রং। মাথার চুল নাক মুখ, চক্ষু সব এক রকম। দাদারে লইয়া তারা আষ্টজন। এক মানুষ এক না! আষ্টজন! আষ্টজন দেবু ঠাকুর। তারা যে জামগাছে বহে, জামতলায় এক লগে হয়, হেইডাও আমি উদিস পাইতাম। নিশি রাইতে তারা চলাচল করতো, হাকিহুকি কইরা কথা কইতো, রান্ধনঘরে হুইয়া হুইয়া আমি বেবাক হোনতাম। তয় ডরাইতাম না। আবার তাগো সামনেও যাই নাই কোনওদিন। গেলে যুদি নিজের কোনও ক্ষতি হয়? যুদি আতুর-লুলা হইয়া যাই? গরিব হাজাম ঘরের পোলা। তিরিশের লাহান বয়েস। বিয়া করি নাই। আতুড়-লুলা হইয়া পইরা থাকলে দেখবো কে?

দাদায় বুজছিলেন, আমি তিনাগো দেখছি, উদিস পাইছি দাদারে লইয়া আষ্টজন ঠাকুর আছে বাড়িতে। চদরি মোশাই তো জানেনই। তিনায় মইরা গেলেও এই হগল কেঐরে কইবেন না। আমার বয়েস কম। গল্পবাজ মানুষ। কথায় কথায় কেঐরে কইয়া দেই কি না!

দাদায় আমারে সাবধান করছিলেন। ‘বদরু, তুই আমার লগে থাকচ। অনেক কিছুই জানছস এই বাড়ির। কিছু দেখছস, কিছু উদিস পাইছস। খবরদার, এই হগল কেঐরে কইচ না। কইলে বিরাট ক্ষতি হইব তর। জানে বাচপি না। আতুর-লুলা হবি, উইট্টা খাড়াইতে পারবি না। জানডা যাইবো। আমিও তরে বাঁচাইতে পারুম না। এর লেইগা সাবধান রে, বদরু। সাবধান।’

আমি সাবধান হইয়া গেছিলাম। কত কিছু দেখছি দাদার, কত কিছু জানি, হেই হগল য্যান দেইক্কাও দেখি নাই, জাইন্নাও জানি নাই। গল্পবাজ বদরু এই একখান জায়গায় চুপ। একদোম চুপ। য্যান ঠাকুরের লগে গেরামে গেরামে রোগী দেখতে যাওন আর বাইষ্যাকালে নৌকা বাওন ছাড়া তার কোনো কাম নাই। হেয় অন্য কিছু জানেই না।

তেরো বচ্ছরে কত ঘটনা দাদার লগে। কত রাইত দিনের কথা, খরালি বাইষ্যার কথা। শীতের বিয়ানবেলা, কালবৈশাখির ঝড়ের রাইত, ঠাঠাপোড়া রইদের দোফর, ফাল্গুন মাসের বৈকাল বেলাখান, হায় রে আমার সুখের দিন! দশদিন ধইরা বিষ্টি পড়তাছে তো পড়তেই আছে। থামনের নামগন্দ নাই। কাউয়ার মতন ভিজতে ভিজতে দাদারে লইয়া রতনপুর বাজারে গেছি, চাইরমিহির গেরামে গেছি। কত চিনা পরিচিত মানুষ! কত বাড়ির রুগী! দাদায় যে বাইত্তে যায় হেই বাড়িডাই য্যান হেয় যাওনের আগে আন্ধার আছিল। দাদায় গেলেন আর বাড়িডা য্যান রইদে ভইরা গেল। আন্ধাইরা রাইতে গেছেন পশব করাইতে, হেই বাড়িতে য্যান জোছনা উটল। আলো, আলো। তিনায় য্যান আলোর মানুষ।

কী খাতির মাইনষে যে করতো দাদারে! পুরুষ পোলাগো এক চেহারা, মাইয়ালোকের আরেক। দাদারে দেখলেই বাড়ির মাইয়ালোকগুনি য্যান পাগল হইয়া যাইতো। খালি উক্কি দিয়া দাদারে দেখে আর হাকিহুকি করে, গঙ্গের কাটালের লাহান আওজ কইরা হাসে। যুবতী মাইয়াডির কেমুন জানি ছটফটানি শুরু হয়। জোয়াইরা দিনে গেরামে যহন নতুন পানি ঢোকে, দেশ গেরামের মাইনষে যহন পেনিজাল আর হাতজাল দিয়া জোয়াইরা মাছ ধরে, মাছগুনি ধরা পড়নের পর যেমুন ছটফট করে, যুবতী মাইয়াডির অবস্থা হেমুন। কী থুইয়া কী করবো, বুজতে পারে না। দাদার সামনে আইলে বাতাসে গাছের পাতা যেমুন কাঁপে ওমতে কাঁপতে থাকে। বারো-তেরো বচ্ছরের মাইয়া থেইকা আঠোরো-  বিশ-বাইশ, বিয়া হইয়া গেছে, কুলে পোলাপান আছে, হেমুন বউডিরও একই দশা।

কী জানি আছিল মানুষটার! নাইলে মাইয়ারা এমুন পাগল হইব ক্যা তিনার লেইগা? তেরো বচ্ছরে আমি তো আর কম দেখলাম না! তার আগে না জানি কী হইছে! পিয়নাথ হেই হগল জানতো। চদরি মোশাই তো জানতেনই। আমিই
চাইর-পাঁচখান ঘটনা জানি। এক-দুই ঘণ্টার লেইগা গেরামের এই বাড়ির যুবতী মাইয়া, অল্পবয়সী বউ আইয়া দিন-দোফরে আমার চোক্ষের সামনে দাদার ঘরের দুয়ার লাগাইছে। আমি দেইখাও দেখি নাই। দূর গেরামের মাইয়ারাও আইছে। সকাল সকাল আইছে, দোফরে নাইলে বিয়ালে চইলা গেছে। আইছে কেমুন জানি বেদিশা হইয়া, যাওনের সমায় মুখখান টলটল করছে। হাসিমাখা মুখ, চেহারা ঝলমল ঝলমল করতাছে। য্যান বিরাট সুখ লইয়া ফিরত যাইতাছে। তয় কেঐর কোনওদিন প্যাট হইছে, এমুন কথা হুনি নাই। দাদার তো কেরামতির শ্যাষ নাই। কেমনে কী করতেন তিনায়ই জানতেন।

একবার একটা মাইয়া আইয়া সতরোদিন দাদার ঘরে আছিল। কুসুমপুরের বড়বাড়ির মাইয়া। দেকতে যা সোন্দর! অমুন মাইয়া আমি ইহজিন্দেগিতে দেখি নাই। গায়ের রং সোনার লাহান। সোনার বরণ কন্যা। নাম কিরণ। নামের মতনই মাইয়া। কিরণ যেখানে খাড়াইতো হেই জায়গা আলোয় ভইরা যায়। হাইটা গেলে আলো, বইয়া থাকলে আলো, ঘুমাইলে আলো। এমুন সোন্দর মাইয়া হয়!  দুর্গাপূজার সমায়, সরস্বতী পূজার সময় ঋষিপাড়ার চাইর রাস্তার মোখে যে পূজামণ্ডপটা আছে, হেই মণ্ডপে যে মূর্তিডি থাকে, কিরণ য্যান সেই মূর্তি। কোন মূর্তির কারিকর য্যান বেবাক দরদ দিয়া, যত্ন দিয়া বহুতদিন ধইরা তারে বানাইছে। ভালো উচা-লাম্বা মাইয়া। পাতলাপোতলা গরন। চক্ষু দুইখান বাছুরের লাহান ডাগর, কপাল থিকা শুরু হইছে মাথার চুল। মেগের লাহান কালাচুল। ওই যে দাদায় থেটারে মাইক লইয়া গান দেয়, ‘তাহার চেয়ে অধিক কালো তোমার মাথার কেশ’ ওই রকম কেশ কইন্যার। নাকখান ছোট্ট, খাড়া। ঠোঁট দুইখান পাতলা। এমুন কইরা চাইয়া থাকতো দাদার মিহি! আহা রে, ভারি মায়া লাগতো। আঠেরো-উন্নিশ বচ্ছর বয়স। এমুন পাগল হইছিল দাদার লেইগা, হেই কথা কইয়া শ্যাষ করা যাইবো না। কবে কেমতে দাদার বাইত্তে আইছিল, আমি উদিশই পাই নাই। আথকা তারে দেইখা হালাইলাম। দেইখা চক্ষু সার্থক হইল।

দোফরে রুগি দেইখা ফিরছি দাদার লগে। চইত মাস। বিরাট গরম পড়ছে। তয় ঠাকুর বাইত্তে গরম নাই। গাছ ভরা বাইত্তে গরম কম লাগে। দাদায় খাইতে বইছেন, আমি কী জানি কী কামে দাদার ঘরে গেছি। দাদার কামড়ার উত্তর-পশ্চিম কোনায় আপারে ওডনের সিঁড়ি। লগের কামরায় আলমারি ভরা বই। ইট্টু সমায় পাইলেই তিনায় বই পড়েন। বয়েস কত হইছে কে জানে! পঞ্চাশ-ষাইট বচ্ছর হইব মনে হয়। তয় বুঝা যায় না। মনে হয় আমগো বয়সী। তিরিশ-বত্রিশ। বই পড়তে চশমা লাগে না। দুইখান চশমা আছে। লাগাইতে দেহি না তেমুন। ক্বচিত কোনোদিন লাগান। কোনো বিয়াসাদিতে গেলে, খাৎনার অনুষ্ঠানে গেলে, থেটার, যাত্রাপালায় গেলে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির লগে ঘিয়া রংয়ের একখান শাল ভাঁজ কইরা কান্ধে ফালাইবেন। চশমা লাগাইবেন চোক্ষে, পায়ে কালা পামসু, জমিদারের লাহান তখন লাগে দাদারে। হাইটা গেলে মনে হয় চাইর মিহি থিকা য্যান বাইদ্য বাজতাছে। রাজা যায়, বাইদ্য বাজাও। গাছপালা মাটঘাট, চকের ফসল আর ঘাস, ঝোপজঙ্গল, আসমানের পাখি আর হাওয়া বাতাস, বেবাকতের রাজা য্যান যাইতাছেন। তারা বাইদ্য বাজায়। রাজা যায়, বাইদ্য বাজাও। 

দাদার ঘরের আপার হইল দোতলার লাহান। লাহান কী, দোতালাই। খালি ঝুল বারিন্দা নাই, আর বেবাকই আছে। আপারে জিনিসপত্র ম্যালা। কাঠের সিন্দুক আছে। চামড়ার সোটকেস আছে। আরও বহুত জিনিস। আমি হেদিন সিঁড়ি দিয়া আপারের মুখে গিয়া খাড়াইছি। বেখেয়ালে চাইছি। হায় হায়, ওইডা কে হুইয়া রইছে আপারের পাডাতনে? সিড়ির মিহি পাও, মুখখান কাইত কইরা ঘোমাইতাছে। কউচ্চা একখান শাড়ি পিন্দনে। বেভোর ঘোমে কইন্যা। এক পলক দেইক্কাই চিনলাম তারে। কুসুমপুরের বড়বাড়ির মাইয়া কিরণ। সে এই বাইত্তে আইলো কুনসুম? আমি দিহি উদিস পাইলাম না? দিনে আইছে, না রাইতে? আইজই আইছে, না দুয়েকদিন আগে? তার আলোয় আবছা আন্ধাইরা আপারখান আলোয় ভইরা গেছে। য্যান পুন্নিমা রাইত হইছে দিনেরবেলা। চান্দের আলোয় ফকফক করতাছে ঠাকুরের আপার। পুন্নিমা রাইতখান আর আসমানের চান্দ পুরাডা য্যান আইসা ঢোকছে দেবু ঠাকুরের আপারে। না না, দোতালায়। নাকি ঠাকুরই তারে জাদুমন্ত্র দিয়া এই বাইত্তে আনছেন? তিনায়ই ঘুম পারাইয়া রাকছেন। ওই যে রূপকথার গল্প হোনতাম সিথানে আর পৈথানে জাদুর কাঠি দিয়া রাজকন্যারে ঘুম পারাইয়া রাখে, কিরণরে কি সেইভাবে ঘুম পাড়াইয়া রাকছেন দাদায়?

আমার মাথাডা ঘুইরা যায়। আপারে আর উটলাম না। নাইমা আইসা উডানের কোনায় খাড়াইছি। দাদার খাওয়া হইলে বাইত্তে যামু ভাত খাইতে। চদরি মোশাই দ্যাশে নাই। কইলকাত্তা গেছেন বউ-পোলাপানের কাছে। বাইত্তে দাদায় আর আমি। আমি থাকি রান্ধনঘরে। চদরি মোশাই না থাকলে পয়লা পয়লা দাদায় নিজেই নিজের রান্ধনবাড়ন করতেন। বাওন জাত। মোছলমানের হাতের রান্ধন খাইবেন না। তার উপরে আমি আবার হাজামবাড়ির পোলা। হাজাম। বদরু হাজাম। পিতা, হাজাম জমসেদ আলী। সাং, রতনপুর, পোস্ট, রতনপুর, থানা লৌহজং, মহকুমা মুন্সিগঞ্জ, জিলা, ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান।

দাদায় একদিন কয়, ‘ওই বদরু, রুগি দেইক্কা বাইত্তে আইয়া আমি আর রানতেবাড়তে পারুম না। তুই রানবি। আমি দুই চাইর দিন তরে দেহাইয়া দিমু, কেমনে কী রানবি!’

হুইন্না আমি বেদিশা হইয়া গেলাম। দাদায় এইডা কয় কী? তিনায় খাইবেন আমার হাতের রান্ধন? চদরি মোশাই জানলে? আর তিনায় বাইত্তে আইলে তো জাইন্নাই যাইবেন যে আমি রানছি আর দাদায় খাইছেন!

দাদায় কইলেন, ‘তুই যা চিন্তা করচ হেইডা আমি জানি। বীরেন আইলে কী হইব? আরে ব্যাটা, বীরেন আইলে সে রানবো। তর সমিস্যা কী?

বোজলাম। দাদায় হিন্দু-মোছলমান মানেন না। কত মোছলমান রুগির বাইত্তে গিয়া থাকেন রাইত্রে। হেই বাড়ির ভাত-পানি খান। ফল কাইট্টা দেয় বাড়ির মাইয়াছেইলায়, চা বানাইয়া দেয়, দুদ গরম কইরা দেয়, বেবাকই তো খান দাদায়। তয় আর আমার অসুবিদা কী?

তিন-চাইর দিনের মইদ্যে রান্দনবাড়ন হিক্ষা হালাইছিলাম। ঘোষের বাড়ি থিকা আড়াই সের কইরা দুদ দিয়া যায়।

দিনে-রাইত্রে মিলাইয়া ঐ দুদ খান দাদায়। আমি গরম কইরা দেই। বাজার থিকা ইলসা মাচ কিন্না আনি দাদার লেইগা। পুকইর থিকা ঝাঁকিজাল দিয়া সাচরা মাছ ধইরা আনি।

কই-সিং-মাগুর ধইরা আনি। রান্ধনও খারাপ হয় না। দাদায় সাদ কইরাই খায়।

হেইদিনও বাইত্তে আইয়াই রানছি আমি। দাদায় গেছেন চান করতে। তিনায় খাইতে বইছেন আর আমি গেছি তার ঘরে। আপারে উটতে গিয়া দেকলাম কিরণরে। নাইম্মা আহনের অনেক পরে দাদার খাওন শ্যাষ হইল। পিতলের লোডার পানি দিয়া হাত-মুখ ধুইতে ধুইতে আমারে কইলেন, ‘আমি জানি এই ফাঁকে কিরণরে তুই দেকছস। খবরদার বদরু, কেঐ য্যান না জানে!’

‘না না দাদা, জানবো না। জান গ্যালেও কেঐরে আমি কমু না।’

‘কইলে আমার কিচ্ছু হইব না। মরবি তুই।’

হুইন্না আমি হাইস্যা দিলাম। ‘হেইডা আপনে কইরেন। তয় দাদা একখান কথা জিগাই?’

‘বুজছি। তুই জিগাবি, আমি জানলাম কেমনে যে তুই কিরণরে দেকছস? আপারে ঘুমাইতাছে। কউচ্চা শাড়ি পিন্দনে। দক্ষিণে মাথা, পাও উত্তরে? তুই তার ঘোমাইয়া থাকা মুকখান দেখছস।’

‘হ দাদা।’

‘আমি তো একজন না রে বেডা। আমি হইলাম আষ্টজন। এহেকজন এহেকখানে থাকি। কেঐ ভাত খায়, কেঐ রুগি দেকতে যায়, কেঐ আড্ডা দেয়। তুই যে আপারের গলা তরি উটলি, আরে ব্যাটা ওহেনে তো আমি তর লগে খাড়াইয়া আছিলাম।’

দাদার কথা হুইন্না আমার শইল্লের বেবাক পশম খাড়াইয়া গেল।

দাদায় কয় ‘আমি যে আষ্টজন, হেইডা তরে আমি এক রাইতে দেহামুনে। সামনের পুন্নিমা রাইতে।’

হ দেকলাম। চৈতালি পুন্নিমা রাইতে আষ্টজন ঠাকুররে আমি এক লগে দেকলাম। এক্কেরে নিজের চোক্ষে দেকলাম।

চইত মাসের ফকফইক্কা জোছনা রাইত। পুন্নিমা। চৈতালি পুন্নিমা। দাদায় আমারে কইলেন, ‘আইজ রাইত্রে তরে দেখামুনে, বদরু। আমি তরে ডাক দিমু না, কিছুই করুম না। তর এমতেই ঘোম ভাইঙ্গা যাইবো। খবরদার দুয়ার কইলাম খুলিচ না। দুয়ারে ফুদ্রি আছে, ঐ ফুদ্রি দিয়া দেখবি।’

আমি দেকলাম। সত্যঐ দেকলাম।

হারাদিন খাটাখাটনি যায়। রাইতে দাদার রান্ধনঘরের চকিডায় হোয়নের লগে লগে ঘোমাইয়া যাই। হেই রাইত্রে সহাজে ঘোম আইলো না। জাইগা রইলাম অনেকক্ষুণ। কুনসুম দেহুম, কুনসুম? সময় আর কাডে না। বাড়ির কোন গাছে বইয়া দিন মনে কইরা আথকা ডাক দেয় কাউয়ায়। দেবদারু গাছটার আগায় কোরল পাখির বাসা। এই পাখিডা রাইতের পহর জানায়। সনধা রাইতে, দোফইরা রাইত আর বিয়াইন্না রাইতে বাগ দেয়। হেই রাইত্রে কোরল পাখিডা দুইবার বাগ দিছে। তাও আমার ঘোম আহে না। তার বাদে কুনসুম যে ঘোমাইয়া গেলাম, উদিস পাইলাম না।

আথকা ঘোমডা ভাঙ্গলো। মনে হইল উডানে কারা য্যান হাকিহুকি করে, চলাফিরা করে। আরে, বাকি সাতজন তো আইছে!

টিনের ঘরের বেড়ার ফাঁকফোঁক দিয়া জোছনা আইয়া ঢোকছে ঘরে। কাঠের দুয়ারডার ফুদ্রিফাদ্রি দিয়াও ঢোকছে। চকি থিকা নাইম্মা, কোনো আওজ যাতে না হয় হেইভাবে গিয়া ফুদ্রি দিয়া বাইরে চাইছি। চাইয়া টাশকি লাইগা গেল।

ঠাকুরের ঘরের দুয়ার খোলা। তিনায় খাড়াইয়া রইছেন ডিসপেনছারির দুয়ারের ছেমায় আর তারা সাতজন তিনার সামনে। কেঐ এইমিহি চায়, কেঐ ঐমিহি চায়। রান্ধনঘরের মিহিও ঘুইরা-ফিরা চাইলো সাতজনেই। আমি গইন্না দেকলাম তিনারে লইয়া আষ্টজন ঠাকুর। সাদা ধুতি আর গেঞ্জি পরা। বেবাকতের গলায়ই পাইতা।

এক-দেড় মিনিটের মতন দেকলাম। তার বাদে আথকা দেহি সাতজনের একজনও নাই। খালি দাদায় ঘরের ছেমায় খাড়াইয়া রইছেন। তিনার গলাও আমি হোনলাম। ‘যা দেহনের দেইখা হালাইছিস বদরু। অহন ঘোমা। তয় সাবধান। যা কইছি মনে রাখিচ। নাইলে মরবি।’

আমি ঘরের ভিতরে থিকা কোনও আওজ দিলাম না। চুপচাপ চকিতে গিয়া হুইয়া পরলাম। বাকি রাইত ঘোমই হইল না।

বিয়ানে দেহি দাদায় আমার মিহি চাইয়া হাসে। আমি চা বানাইয়া দিছি। বড় একখান চীনা মাডির মগে চা খান আর মিটমিট হাসেন। ‘খবর কী রে বদরু?’

আমি কোনও কথা কই না।

দাদায় কন, ‘এই সাতজনরে লইয়া আমি আষ্টজন। এক টাইমেই আষ্টজন আষ্ট জাগায় থাকতে পারি। আবার দরকার পড়লে এক জাগায় হইতে পারি। এর লেইগা তুই দেহচ, আমি ঘরদুয়ার খোলা রাইখা এইমিহি ওইমিহি চইলা যাই। চোর ডাকাইত আমার বাড়ির মিহি চাইয়াও দেহে না। কুত্তা বিলাইও আমার বাইত্তে আহে না। খোলা দুয়ার দিয়া কাউয়াও রান্ধনঘরে ঢোকে না। পাকিস্তান ইনডিয়া হওনের পর বাড়িঘর হালাইয়া দ্যাশ গেরামের বেবাক হিন্দু ইনডিয়ায় চইলা গেল। যাওনের আগে কত ঘটনা ঘটলো দ্যাশে। চিনা পরিচিত মোছলমানারাই শতরু হইয়া গেল। দলে দলে হিন্দু দ্যাশ ছাইড়া লঞ্চ ইষ্টিমারে চড়ল, নৌকায় পদ্মাপাড়ি দিল। পথে কত বিপদ। সোনাদানা টেকা পয়সা লুটপাট হইল। আহা রে! এক লগে গলাগলি কইরা থাকা দুই ভাইয়ের লাহান হিন্দু-মোছলমান চোখের নিমিষে শতরু হইয়া গেল। শতরু হইল ধর্মের নামে। পাকিস্তান মোছলমানের দ্যাশ, ইনডিয়া হইল হিন্দুগো দ্যাশ। যে যার দ্যাশে চইলা  যাইব। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু থাকতে পারবো না, ইনডিয়ায় থাকতে পারবো না মোছলমান। ওইটাই হইল দ্যাশভাগ। বেবাক কথা কইলে তুই বুজবি না। হের লেইগা দ্যাশভাগ লইয়া বেবাক কথা তরে কইলাম না। এক কথায় বইলা দেই, এতকিছুর পরও বেবাক হিন্দু দ্যাশ ছাইড়া যায় নাই। আবার ইনডিয়ার বেবাক মোছলমানও ইনডিয়া ছাইড়া আহে নাই। রইয়া গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যেই হিন্দুরা রইয়া গেছে তারা কইলাম আমার লাহান একলা না। তাগো আত্মীয় স্বজন আছে, জ্ঞাতি গুষ্টি আছে। আমি তো একলা মানুষ এই দ্যাশে। খালি দূর সম্পর্কের এক বইন আছে চানপুরে। তয় আমি একলা রইয়া গেলাম কোন শক্তিতে? একলা মানুষের এত সাহস হয় কেমনে?’

আমি মাথা লাইরা কইলাম, ‘সাহসের কারণডা আমি বুজছি দাদা। আপনে একলা না। আর আপনের বিরাট শকতি।’

দাদায় চায়ে চুমুক দিলেন, ‘হ এইডাই কারণ। তুই আমার লগে থাকচ, এর লেইগা তরে পরমান দেহাইলাম। দ্যাশ গেরামে আমার যে এত দাম, এত খাতির, আমি যে পাশ না কইরাও বিরাট ডাক্তার, কোন রুগি কুনসুম মরবো আর কোনডা বাচপো কইতে পারি, এই শক্তিতেই। আমার শইল্লে কেঐ ফুলের টোকা দেওন তো দূরের কথা, সামনে পিছে একখান গাইলও দিতে পারবো না। দিলেই মরবো। আমার শক্তি বিরাট। পুরাডা কেঐরে দেহাই না। শক্তি না থাকলে কবে গেরামের মোছলমানরা আমার গলা কাইট্টা এই বাড়ি দখল করতো!’

ইট্টু থাইমা দাদায় কইলেন, ‘আমি বই পইড়া জানছি, পিরথিবীতে একজন মানুষের লাহান হুবাহু আরও সাতজন মানুষ আছে। পিরথিবীর কোন কোন দ্যাশে, কোন কোণায়, কোন গেরামে যে আছে, হেইডা কেঐ জানে না। তয় আছে। আমার লাহান আছে, তর লাহান আছে। তয় কেঐর লগে কেঐর কোনওদিন দেখা হয় না। খালি আমার লগে হইছে। আমি তাগো সাতজনরেঐ এই বাইত্তে লইয়া আইছি। সাতজন সাত ভাষায় কথা কইতো। আমি তাগো আমার ভাষা শিগাইছি। তাগো এহেকজনের শক্তি বিরাট। যা মন চাইবো হেইডাই করতে পারবো। তুই মনে করচ তারা জামগাছে থাকে? আরে না ব্যাডা। তারা দিন রাইত এই বাড়ির সাত জাগায় থাকে। কোনও কোনও টাইমে জামগাছের ডাইলে বইয়া আর জামতলায় খাড়াইয়া কথাবার্তা কয়। হেইডাই তুই হোনচ।’

দাদায় চায়ে চুমুক দিলেন। আমরা চা খাইলে ফুরুক ফুরুক আওজ হয়। দাদায় খাইলে হয় না। চায়ে চুমুক দিয়া কইলেন, ‘হোন ব্যাডা, আরেকখান কথা তরে কইয়া রাখি। মানুষ তো একদিন মরবঐ। আমিও মরুম। তয় আমি মরণের পর ওই সাতজনের একজন কইলাম ফিরত আইবো।’

হুইনা আমি আথকাইয়া উটলাম। ‘কন কি দাদা? আপনের লাহান আরেকজন ফিরত আইবো?’

দাদায় হাসেন। ‘হ বেডা। আমিই ফিরত আমু। এই বাড়িতেই আমু। এই চেহারায়, আমি এখন যেমুন আছি ঠিক এমুনঐ ফিরত আমু। ডাক্তার শ্রী দেবকুমার ঠাকুর মইরাও ফিরত আইবো। তাও একবার না। একজন আইবো, হেয় মরবো তারবাদে আরেকজন আইবো। এইভাবে সাতবার।’

দাদায় আবার চায়ে চুমুক দিলেন। ‘আমি যেদিন মরুম তার এক বচ্ছর বাদে ঠিক ওই দিনে সাতজনের একজন আমি ফিরত আমু। সে মারা গেলে আরেকজন আইবো। এইভাবে আমারে লইয়া মোট আষ্টজন। তুই যুদি বাইচা থাকচ তয় তুই দেখবি আমার কথাঐ সত্য। ওই ঘটনাই ঘটবো।’

আমি অবাক হইয়া দাদার কথা হোনলাম। হুইনা কেমুন জানি ডর কইরা উটল। মইরা গিয়াও ফিরত আইবো দাদায়? এইডা কেমনে হয়? এমুন কথা তো জন্মেও হুনি নাই!

আইজ দোফরে বিলে গরুর ঘাস কাটতে কাটতে এই হগল কথা আমার মনে হইল। এত ক্ষেমতা আছিলো যেই মানুষটার তিনার গলা কাটা গেল কেমনে? তিনায় খুন হইলেন কেমনে? কার কাছে এই জবাব পামু?

ওফাজদ্দি সারেঙের গরু হইল ছয়ডা। চাইরখান গাই আর দুইখান হইল বাছুর। বাইষ্যাকালে গাই-বাছুড়ের বাড়ির বাইরে যাওনের উপায় নাই। হারাদিন হারারাইত আথালে বানদা থাকে। দ্যাশ-গেরামে জোয়াইরা পানি ঢোকনের কয়দিন বাদেই, যখন চকমাঠ বেবাক ডুইব্বা যায়, দিনরাইত খালি বিষ্টি আর বিষ্টি, তখন থিকা যে গরুডি আথালে বানদা পড়ে, পাঁচ-ছয়মাস আথালেই কাডে। আর গরুর খাওন তো বিরাট! হারাদিনই খায়। মুখের সামনে দল আড়ালি, বড় বড় কচুড়ির ডাউ¹া রাকতেই হয়। আমি নাওয়ের ভরা ভইরা গরুর ঘাসই কাডি।

আইজও হেই কামই করতাছি। ঘাস কাটতে কাটতে দাদার কথা চিন্তা করতাছি। কুনসুম যে নাওয়ের ভরা ভইরা গেছে ঘাসে, উদিসই পাই নাই। এই এক ভরা ঘাস লইয়া অহন সারেঙবাড়ি যামু। বৈকালে বাড়ির কাছাকাছি চকে নাইলে কোনও পুকইরে গিয়া কচুড়ি কাইট্টা আনুম। কচুড়ি লইয়া বাইত্তে গিয়া জাবনা দিমু। খৈল ভূষির লগে ভাতের ফ্যান মিলাইয়া খাইতে দিমু গরুডিরে। আজাইর হইতে হইতে কালিসন্ধ্যা।

এইডা কোনও জীবন হইল? আহা রে, কী সোন্দর জীবনডা আছিল আমার! দাদার বাইত্তে কাম। রাজা-বাদশার লাহান জীবন। কোন শালায় যে দাদার গলাডা কাটল? দাদারে আর চদরি মোশাইরে তো খালি খুন করল না। তাগো লগে আমারেও খুন করলো। আমার আরামের জীবনডা নষ্ট হইয়া গেল। সুখের দিন চইলা গেল জীবন থিকা। দাদার বাইত্তে যা মনে চাইতো খাইতে পারতাম, যেহেনে মন চাইতো যাইতে পারতাম। রূপবানের গান হোনতে যাইতাম শীতের রাইতে।

জারিগান-পালাগান হোনতে যাইতাম। যাত্রা-থেটার দেকতে যাইতাম। দাদায় তো না করতোই না, একটা-দুইডা টেকাও দিত। ‘যা আমোদ ফুরতি কইরা আয়, বদরু।’

নৌকাবাইচ দেকতে যাইতাম বাইষ্যাকালে। ঝুলনযাত্রা দেকতে যাইতাম গোয়ালিমান্দ্রা, রথেরমেলা দেখতে যাইতাম ছিন্নগর। রসোগোল্ল­া খাইয়া পেট ফুলাইয়া হালাইতাম। আহা রে, কই গেল গা হেই দিন!

ঘাস কাডন শ্যাষ কইরা লইছি। খোঁচ দেওনের আগে আসমানের মিহি চাইয়া দেহি কালা হইয়া গেছে। বিষ্টি নামবো। আমার একখান গান মনে হইল। ‘আষাঢ় মাইষ্যা বিষ্টি রে, ঝমঝমাইয়া পড়ে রে বন্ধু আমার রইল বৈদেশ গিয়া, রইল বৈদেশ গিয়া।’

এই গানডাও দাদায় কী সোন্দর কইরা গাইতেন! তিনার কলের গানডা আর রেকটগুণি হোওনের কামড়ায় থাকতো। ম্যাগ বিষ্টির দিনে রুগি দেকতে না গেলে দাদায় কলের গান বাজাইতেন। কত গান। কাননবালার গান ‘আমি বনফুল গো’ আমার খুব ভালো লাগত। ছায়গল না কী নামের একজন গায়ক, শচীন দেববর্মণ আব্বাসউদ্দিন, কত গায়ক-গায়িকা। আবার এখনকার দিনের গায়ক-গায়িকার রেকটও আছিল। হ্যামন্ত, সনধা, গীতা দত্ত, লতা, রফি, তালাত মাহামুদ, শ্যামল মিত্র, মান্না দে। দাদায় আমারে বেবাক গায়ক-গায়িকার নাম হিগাইছিল। গান হুইন্না আমি কইয়া দিতে পারতাম, গানডা গায় কে?

কোনও কোনওদিন এত মনে হয় দাদার কথা! জীবনের কত গোপন কথা তিনায় আমারে বলছেন। যা বলছেন তার প্রমাণও আমি চাক্ষুস পাইছি। দাদায় বাইরে থিকা আছিলেন এক মানুষ, ভিতরে আরেক মানুষ। আমি ভিতরের মানুষটারেও দেখছি।

আইজ তিনার কথা খুব মনে পড়তাছে। নাওয়ের ডরা ভর্তি ঘাস। অহন সারেঙ বাইত্তে গিয়া ঘাস নামামু। তারবাদে নাইয়া ধুইয়া ভাতপানি খাইয়া আবার যামু চকে পুকুইরে কচুড়ি কাটতে। কচুড়ি বাইত্তে নামাইয়া গরুর জাবনা দেওন, আজাইর নাই। জীবনডা ছাড়খাড় হইয়া গেল। দাদায় বাইচ্চা থাকলে এতদিনে বিয়াশাদি কইরা হালাইতাম। পোলাপানও হইয়া যাইতো। কত স্বপ্ন দেখছি একখান বউয়ের। বউ মনে হয় জিন্দেগিতে আর পামু না। পোলা মাইয়ার বাপ হইতে পারুম না। দ্যাশ গেরামের মাইনষে কয় না, ‘জীবনে আছে কী? খালি প্যাটটা আর চ্যাটটা।’ আমার খালি প্যাটটাই আছে। চ্যাটটা থাইক্কাও নাই। মুতনের কাম ছাড়া ঐডা দিয়া আর কিছুই করতে পারলাম না।

লগগির খোঁচ দিয়া সারেঙবাড়ির মিহি যাইতে যাইতে মনে হইল ঠাকুর বাড়ির ওই মিহি দিয়া ইট্টু ঘুইরা যাই। এক বাইষ্যা গিয়া আরেক বাইষ্যা আইছে। চোক্কের নিমিষে য্যান একটা বচ্ছর কাইট্টা গেল। তহন মনে হইল, দাদায় যে একদিন চা খাইতে খাইতে কইছিল তিনায় মইরা গেলে এক বচ্ছর বাদে সাতজনের একজন ফিরত আইবেন! এইডা হয়নি? মানুষ মইরা গেলে ফিরত আহে এমুন কথা তো হইজিন্দিগিতে হুনি নাই। যাই ঠাকুর বাড়ির মিহি দিয়া ইট্টু ঘুইরা যাই।

তহন এক মিনিটের লেইগা বিষ্টিডা আইল। আষাঢ় মাইষ্যা বিষ্টি। সত্যঐ নৌকার আগা ভিজে তো পাছা ভিজে না। এই আইলো বিষ্টি, এই চইলা গেল। আমি লগগি খোঁচ দিয়া দিয়া ঠাকুর বাড়ির মিহি যাই।

আইজকার দিনডাও গত এক বচ্ছরের লাহান। ঠাকুর খুন হওনের কয়দিন পর থিকা দ্যাশ গেরামের বেবাকতেই উদিস পাইলো, ঠাকুরের লগে গ্রামডাই খুন হইয়া গেছে। কোনওখানে কোনও আওজ নাই। কুলের শিশু বাচ্চাডাও মনে হয় কান্দে না। কোনও আওজ নাই। পোলাপানে চিল্লাচিল্লি করে না। কোনও আওজ নাই। মাইনসে মনে হয় কথাও কয় না। আওজ নাই। গিরস্তের গরু ভুলেও হামবা হামবা করে না। বরকি ভ্যাবায় না। বিয়ান্নারাইতে মোরগে বাগ দেয় না। ঠাকুরবাড়ির দেবদারু গাছের কোরলডা বাগ দেওনা ছাইড়া দিছে। পাকপাখালি ডাকে না। কাউয়া কা কা করে না। ফুলের গন্দ মনে হয় চইলা গেছে। আসমানে ম্যাগ ডাকে না, খাড়াজিলিক দেয় না। আন্ধার রাইতে তারা মনে হয় আগের থিকা কম দেখা যায় আসমানে। জোচনা রাইতে আগের লাহান জোচনা মনে হয় ওডে না। হিয়াল ডাক দেয় না, কুত্তা খেউক্কায় না। কোনও আওজই নাই। ঠাকুরের লগে বেবাকই য্যান খুন হইয়া গেছে। পুরা একখান গেরামেরই য্যান গলা কাইট্টা হালাইছে খুনিরা। মাডার হইয়া গেছে রতনপুর গেরামখান।

লগগি খোঁচ দিতে দিতে ঠাকুরবাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোনার বাঁশঝাড়ের ওইমিহি আইছি। আইয়া আমার টাসকি লাইগা গেল। বাঁশঝাড়ের লগে কয়েকখান আমগাছ আছে। দিনের বেলা জাগাডা আন্ধার আন্ধার। ওহেনে কেডা খাড়াইয়া রইছে? কেডা ওইডা? ঠাকুরের লাহান উচা লামবা মানুষটা! সাদা ধূতি আর হাফহাতা গেঞ্জি পরা। গলার পৈতাখান দূর থিকাও দেখা যায়। কেডা ওইডা? কেডা?

লগে লগে আমার কইলজাডা ফাল দিয়া ওডে। দাদায় যে কইছিলেন এক বচ্ছর বাদে আরেকজন দেবু ঠাকুর ফিরত আইবো! গত আষাঢ়েই তো তিনায় খুন হইলেন! আইজ এক বচ্ছর। তয় কি তিনার কথা সত্য? আরেকজন ঠাকুর ফিরত আইছেন?

আমি আরেকটু আউগগাইয়া যাই। হ, আমি তো মিছা দেহি নাই? তিনায় খাড়াইয়া রইছেন। ওই একঐ মানুষ। একঐ চেহারা সুরৎ, উচা লামবা। আমি কাছাকাছি যাইতেই দেহি, আমার মিহি চাইয়া ফিক কইরা ইট্টু হাসলেন। তার বাদে উডানের মিহি চইলা গেলেন। হাটা চলায়ও দেবু ঠাকুর। এক মানুষঐ। কোনও ফারাক নাই।

আমার টাসকি লাইগা গেল। লগগির খোঁচ দিতে ভুইল্লা গেলাম। নাও ভিরামুনি ঠাকুর বাইত্তে? নাইম্মা দেহুম? সত্যঐ আমি তিনারে দেকলাম, নাকি আমার চোক্কের ভুল? আবার ইট্টু ডরও করে। এক বচ্ছরে ঠাকুরের বাইত্তে গেরামের মানুষজন কেঐ যায় না। একলা তো দূরের কথা, দল বাইন্দাও যায় নাই। বাড়ির ফল পাকঐর গাছে গাছে পাইক্কা থাকে, তলে পইড়া পচছে। কেঐ ঐমিহি ভুলেও যায় নাই। বাড়ির ঘরদুয়ার অমতেই রইছে। দারোগা পুলিশরা তালা দিয়া রাইক্কা গেছে। শিয়াল ইন্দুর, বেজি খাডাস, সাপ ব্যাং পাখপাখালি কিচ্ছু যায় না। এমুন কারবার কইরা থুইয়া গেছেন দাদায়।

আমি অহন কী করুম? বুকের মইদ্যে কইলজাডা ব্যাঙ্গের মতন ফাল পারে। গেরামের মাইনষেরে চিল্লাইয়া ডাক পারুমনি? ‘ও মিয়ারা, কে কোনহানে আছেন? আউলান! ঠাকুর মরেন নাই। তিনায় ফিরত আইছেন। আইসা দেহেন আপনেরা।’

আমার করণ লাগল না কিছুই। পরদিন থিকাই গেরামে রটতে লাগল দেবু ঠাকুর ফিরত আইছে। ঐ বাড়ির এইমিহি ওইমিহি দিয়া নৌকা বাইয়া যাওনের সমায় মাইনষে ঠাকুররে দেকছে। তিনায় হাঁটাচলা করেন। ঘরের দুয়ার খোলা। রাইত্রে কোরলে এক বচ্ছর বাদে বাগ দিলো। পাখপাখালি ডাকাডাকি শুরু করল। কাউয়ার কা কা, গরুর হামবা, কুত্তার খেউক্কানি, বরকির ভ্যাবানি, পোলাপানের চিল্লাচিল্লি, হিয়ালের হুক্কাহুয়া, বাতাসে কদম ফুলের গন্ধ, বেবাক কিছু য্যান এক বচ্ছর ধইরা ঘুমাইয়া আছিল। আইজ জাইগা উটছে।

এমুন কী হইতে পারে?

হইছে যে বিশ্বাস না কইরাও তো উপায় নাই! বেবাকতে দেখতাছে!

আমার বুকের ভিতরে কইলজাডা ব্যাঙ্গের লাহান ফাল পারে। কেঐরে কিছু কইতে পারি না। আমার মনে পড়ে সেই রাইতটার কথা। দাদায় আর চদরি মোশাই খুন হইলেন। আমি ওই লাশ দুইখান দেকলাম পয়লা। একজন ঘরের দুয়ারে পইরা রইছেন, গলা কাডা। আরেকজন উডানে, গলা কাডা। গলা কাডা মানুষ ফিরত আইছেন? আমার মাথার ভিতরে ঘন আন্ধাইরা রাইত হইয়া যায়। চোক্ষে আমি খালি আন্ধার দেখি। আন্ধার। (চলবে)