কুহেলিকা

দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত শীত এসেছে। বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়ছে। তীব্র, কনকনে ঠান্ডা। সঙ্গে অস্বস্তিকর কুয়াশা। এমন আবহাওয়ায় হাঁসের মাংস আমার খুব প্রিয়। আমি জানি, একমাত্র হাঁস-ই তার যাবতীয় উষ্ণতা বাঁচিয়ে রাখে নিজের শরীরের পালকের নিচে। সেই পালক উপড়ে আমি উষ্ণতা খুঁজি আমাদের কৈশোরবেলা থেকে।

এ-কারণেই ছেলেবেলায় গ্রামে থাকতে আমি হাঁস পুষতাম। নিয়ামত ডিমবালার কাছ থেকে হাঁসের ডিম কিনে বাড়ির কুর্চিলাগা মুরগির পেটের তলায় মাসখানেক রাখলেই সেই ডিম ফুটে বেরিয়ে আসত কচি-কচি হাঁসের ছানা। আহা! কী যে আনন্দ হতো আমার। গ্রামের যতগুলো পুকুর ছিল, প্রায় সবগুলো থেকেই গুগলি তুলে আনতাম। ইট দিয়ে থেঁতলে তা ওদের খাওয়াতাম। তারপর আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের যে-পুকুরটি, ‘কণ্টলনানীর পুষ্করিণী’ নামে যার পরিচিতি, তার জলে ছেড়ে আসতাম। ওই পুকুরেই ওরা সারাদিন চরে বেড়াত। আর ঠিক সন্ধ্যের আগে ‘চই-চই’ ডাক দিয়ে ওদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতাম।

আমার এই হাঁস পালনপর্ব শুরু হতো সাধারণত বর্ষাকালে। তারপর শরৎ পেরিয়ে, হেমন্ত পেরিয়ে শীত আসতে আসতে হাঁসগুলো যখন বেশ নধর হয়ে উঠত, তখন সপ্তাহে অন্তত একটা হাঁস জবাই করে আমার মাংস খাওয়ার চলছিল শীতকালজুড়ে, যাতে শীতকালে আমি কাবু না হয়ে পড়ি।

কিন্তু গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর আমার আর সাধের হাঁস পালন সম্ভব হয়নি। অগত্যা আমি হাট থেকে হাঁস কেনা রপ্ত করেছিলাম। চলছিল বেশ ভালোই। বছরদুই পর হঠাৎ শুনি, আজকাল নাকি হাট ব্যাপারটা আর আগের মতো নেই। তার বদলে নানা ধরনের বাজার বসছে। বিগবাজার, মেগাবাজার, মেট্রোবাজার, শপিংমল। যদিও এইসব বাজারে হাঁস পাওয়া যায় না। এমনকি দেশি মুরগিও পাওয়া যায় না। শুধু পোল্ট্রি চিকেন পাওয়া যায়। আর পোল্ট্রি চিকেন ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের নয়। সত্যি-মিথ্যা জানি না, সেই কবে কণ্টলনানীর মুখে শুনেছিলাম, শকুনের ক্রসে নাকি পোল্ট্রি চিকেনের জন্ম! তাছাড়া এমনিতেই পোল্ট্রি চিকেনের পালক উপড়ে থাকে। তাহলে সে কোথায় উষ্ণতা বাঁচিয়ে রাখবে যে আমাকে দেবে?

এই কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার বছরদুই পর আমি খুব মুশকিলে পড়ি। শেষ পর্যন্ত আমাকে উদ্ধার করেন ফকিরপাড়ার দানুচাচা। মানুষটা পেশায় কসাই ছিলেন। প্রতি জুমাবার ভোর ভোর গরু জবাই করে সকালবেলা আমাদের মহল্লায় মাংস বিক্রি করতে আসতেন। তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘চাছা – হামি জানি আপনি গরুর গোস্ত পসন্দ করেন না। হাঁসের গোস্ত নাকি আপনার খুব পসন্দের। তা হামি একজনাকে জানি। হাবাসপুরে তার বাড়ি। নাম লতিব। সে আজহো ঝাঁকা বাঁধা সাইকেল লিয়ে সারারাইত গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে হাঁস-মুরগি খরিদ করে বেড়ায়। আর ভোরবেলা এসে বিক্রি করে যায় হযরতের হাঁস-মুরগির আড়তে।’

দানুচাচার কথামতো আমি একদিন গিয়েছিলাম হযরতভাইয়ের হাঁস-মুরগির আড়তে। বাজারের মধ্যেই সেটা। সেখানে লতিবের খোঁজ পেয়েছিলাম। তবে লতিবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তারও কিছুদিন পর। প্রথম দেখায় লতিবকে আমার ভীষণ ভালো লেগে গেছিল। এককথায় দারুণ ছেলে ওই লতিব। একেবারে চনমনে। যেমন কথায়, তেমনি কাজে। সপ্তাহে সপ্তাহে সে এমন এমনসব হাঁস এনে আমাকে খাওয়াতে শুরু করে যে, হাঁসের তারিফ করব না তার, সেটাই আমার কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, সেই থেকে ওই লতিব প্রতিবছর শীতকালজুড়ে সপ্তাহে একটা করে হাঁস এনে খাইয়েছে আমাকে।

এদিকে শীত দেরিতে আসায় আমি লতিবের খোঁজ করিনি। মনে হচ্ছিল, এবার বুঝি শীত আসবেই না। পৃথিবীর নাকি ক্লাইমেট চেঞ্জ হচ্ছে! হয়তো হচ্ছে। এই তো গেল হেমন্তে প্রায় এক সপ্তাহজুড়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ‘বুলবুল’ যেভাবে আমাদের গাঙ্গেয়-বঙ্গে টানা বৃষ্টি ঝরিয়ে গেল, মনে হলো যেন বর্ষাকাল। পুজোর মতো বড় উৎসবটাও বেনাহক মাঠে মারা গেল।

তবু শীত যখন এলো তাহলে লতিব কই? লতিবের যে কোনো পাত্তা পাচ্ছি না। এদিকে শীত বেশ জমে উঠেছে। বাজারে মৌসুমি সবজির ছড়াছড়ি। কপি, টমেটো, মটরশুঁটি, পালং শাক, বীট, গাজর, শিম, বিম, ধনেপাতা, ক্যাপ্সিকাম। এতো কিছুতেও আমার ঠান্ডার ভয় কাটছে না। আমি উষ্ণতা চাইছি। কেন জানি মনে হচ্ছে, এই ঠান্ডায় আমি জমে যাব। আমি মরে যাব।

না, আমি জমতে চাই না – আমি মরতেও চাই না। অতএব আমার হাঁসের মাংস চাই-ই চাই। সে যেমন করেই হোক। যেখান থেকেই হোক।

তাই একরকম বাধ্য হয়ে এক ছুটির দিন সকালবেলা আমি হযরতভাইয়ের হাঁস-মুরগির আড়তে যাই। কিন্তু গিয়ে খুব অবাক হই। দেখি, ওটা আর আড়ত নেই, রীতিমতো একটা শপিংমলে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশাল কাচের পাল্লা দেওয়া দরজা। দরজায় দারোয়ান দাঁড়িয়ে। পাল্লা খুলে দিচ্ছে, লাগাচ্ছে। আর ভেতরটা একেবারে ঝাঁ-তকতকে। দারোয়ানের মতো একই রকম পোশাক পরা সব অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় আলমারিতে সাজানো রয়েছে নানা ধরনের সব পণ্য। এমনকি আনাজপাতি-শাকসবজি পর্যন্ত সাজিয়ে রাখা আছে ফাইবারের কনটেইনারে। ইলেকট্রিকের রোশনায় সব ঝলমল করছে। বেশি বেশি তাজা দেখাচ্ছে। তাই বুঝি এমন কনকনে শীতের সকালেও সেখানে ক্রেতার ভিড় কম নেই। যদিও জায়গাটা আশ্চর্য রকমের নিরুত্তাপ! কোনো রকম চিৎকার-চেঁচামচি কিংবা হই-হট্টগোল নেই। মানুষগুলো যেন সব যন্ত্রচালিত। জায়গায় জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেরাই সংগ্রহ করছে ট্রলিতে করে। তারপর ক্যাশ-কাউন্টারে নিয়ে গিয়ে দাম মিটিয়ে প্যাক করে নিয়ে যাচ্ছে আপন আপন সংসারে।

তাহলে এই এমন জায়গায় আমি লতিবের খোঁজ পাব কী করে? হযরতভাইকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু হযরতভাই কোথায়? তাকে যে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আগে আড়তে একটা গতি ছিল, ক্যাশবাক্স সামনে নিয়ে হযরতভাই গদিতে বসত। সেই জায়গায় এখন ক্যাশ-কাউন্টার হয়েছে। কাচঘেরা ছোট ঘর একটা। তার ভেতরে টেবিল, গদিওয়ালা চেয়ার। বেশ ছিমছাম। সেখানে বসে আছে অন্য একজন। অল্পবয়সী একটি ছেলে। তার কাছে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, হযরতভাই কোথায়? তাকে যে দেখছি না!

ছেলেটি উত্তর করল, তিনি নেই। কুয়াশা হয়ে গেছেন।

হযরতভাই কুয়াশা হয়ে গেছে! কখন? কীভাবে?

আমার এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সময় নেই ছেলেটির, ক্যাশ সামলাতে এতোই ব্যস্ত সে। তাছাড়া আগে যেখানে শুধু দেশি হাঁস-মুরগি আর ডিম ক্রয়-বিক্রয় হতো এখন সেখানে আরো অনেক কিছু ক্রয় নয়, শুধু বিক্রয় হচ্ছে। যদিও কোথাও একটিও  দেশি হাঁস বা মুরগি নেই। তবে হাঁস-মুরগির মাংস আছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা, ক্যানবন্দি। কিন্তু আমি জানি ক্যানবন্দি মাংসের শীত তাড়ানোর কোনো ক্ষমতা নেই। শীত তাড়াতে যে-উষ্ণতা দরকার তা আছে একমাত্র দেশি হাঁস-মুরগির পালকের নিচে। অবশ্য দেশি মুরগি তো সেই কবেই বার্ড ফ্লু আতঙ্কে সরকারি নির্দেশে নিধন করা হয়েছিল। তার জায়গায় এসেছে পোল্ট্রি চিকেন। পোল্ট্রি চিকেন আমার পছন্দ নয়। আমি জানি পোল্ট্রি চিকেনের জন্ম শকুনের ক্রসে। আমার কণ্টলনানী বলতেন।

বলতে গেলে প্রায় নাচার হয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় নির্জন রাস্তা ধরে আমি কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ শুনতে পাই পেছন থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে।

ফিরে দেখি জীতেন মাস্টারকে। জীতেন মাস্টার আমার বাল্যবন্ধু। তা বলে আমার মতো কোনো স্কুলে মাস্টারি করে না। সে হযরতভাইয়ের আড়তের কর্মচারী। তবু আমরা তাকে ‘মাস্টার’ বলি এই কারণে যে, কারো কোনো সমস্যার কথা শুনলে তৎক্ষণাৎ সে পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করে না। তা বাস্তবোচিত হোক, আর না-ই হোক।

সেই জিতেন মাস্টার এখন আমাকে ডাকছে কেন? সে কি বুঝতে পেরেছে যে, আমি সমস্যায় পড়েছি! হ্যাঁ, শুধু সমস্যায় পড়েছি বললে ভুল বলা হবে বরং বলা যাই, সমস্যার গাড্ডায় পড়ে রয়েছি। তাও যে সে সমস্যা নয়, একেবারে রাম সমস্যা। আমি যদি এখন আমার সেই সমস্যার কথা তাকে বলি, সে বলবে – হাঁস কিনবি তো লতিবের কী দরকার? চল, আমি তোকে হাঁস কিনে দিচ্ছি মাহীনগরের হাট থেকে।

মাহীনগর কোথায় আমি জানি না। স্বভাবতই সেটা যদি এখন তাকে জিজ্ঞেস করি, আমি নিশ্চিত সে আমাকে মাহীনগর নিয়ে গিয়েই ছাড়বে।

না, এই কনকনে ঠান্ডায় আমি মাহিনগর যেতে চাই না। তাই সিদ্ধান্ত নিই, আমি আমার সমস্যার কথা তাকে কিছুতেই বলব না।

আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, জীতেন মাস্টার নিজেই এগিয়ে এলো আমার কাছে। আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, বন্ধু, ভুলেই গেলি যে একেবারে!

সত্যিই ভুলে ছিলাম। লতিবকে পেয়ে ক-বছর যে এদিকে আসিনি তার হিসাব নেই। তবু বললাম, ভুলব কেন? মনে আছিস ঠিকই, শুধু দেখা করার সময় হয় না।

– তা আজ কী করে সময় পেলি?

– আর বলিস না। যা ঠান্ডা! হাঁসের খোঁজে এসেছিলাম।

যাঃ! বলব না বলব না ভেবেও শেষ পর্যন্ত বলে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে জিভ উলটোলাম। কিন্তু অপরদিক থেকে তেমন কোনো উৎসাহভরা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। বরং জীতেন মাস্টারকে কেমন হতাশ দেখাল। হতাশ হয়েই সে বলল, হাঁস! এখানে কোথায় হাঁস পাবি? আজকাল গাঁঘরেও কি আর হাঁস পাওয়া যায়? দিন দিন সব কুয়াশা হয়ে যাচ্ছে।

তার মানে! গাঁঘরে হাঁস পাওয়া যাচ্ছে না! জীতেন মাস্টার বলছে কি?

আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছিলাম। আর গাঁঘরের কথা ভাবছিলাম। তা দেখে সে জিজ্ঞেস করল, অমন করে কী দেখছিস?

বললাম, তোকে।

জীতেন মাস্টার বলল, আমাকে দেখার কী আছে? আমি যেমনকার তেমনি আছি। তবে দেশ-দুনিয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তা দেখে আমার কিছু ভালো লাগছে না।

জীতেন মাস্টার ঠিক কী বলতে চাইছে, বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি দেশ-দুনিয়া বদলে যাচ্ছে? যদি বদলায় তাহলে কীভাবে বদলাচ্ছে?

থাকতে না পেরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দেশ-দুনিয়ার কী বদলাতে দেখলি তুই?

জীতেন মাস্টার ঘুরিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আজকাল তুই কি আর গাঁঘরে যাস না?

আমি বললাম, আমার সময় কোথায় যে গাঁঘরে যাব?

জীতেন মাস্টার বলল, সময় করে একবার ঘুরে আয় তাহলে ঠিক টের পেয়ে যাবি। আর হ্যাঁ, তুই লতিবের খোঁজে এখানে এসেছিস তো! তাহলে শুনে রাখ, শুধু এখানে কেন, দুনিয়ার কোথাও আর লতিবকে খুঁজে পাবি না।

– কেন খুঁজে পাব না? কী হয়েছে লতিবের?

– কিছু না। যে দেশে হাঁস-মুরগি কুয়াশা হয়ে যায়, সেই দেশে লতিবের মতো মানুষকে খুঁজে পাবি কী করে? লতিবেরাও সব কুয়াশা হয়ে গেছে।

একথা বলে নিমেষেই জীতেন মাস্টার নিজেও হঠাৎ কুয়াশা হয়ে যায়। আমি তাকে আর খুঁজে পাই না। আমার কেমন ভয় করে। মনে হয় – দেশি হাঁস-মুরগি, লতিব, কিংবা সদ্য হারিয়ে যাওয়া জীতেন মাস্টারের মতো আমিও হয়তো এক্ষুনি কুয়াশা হয়ে যাব, একটু পর আর কেউ আমার খোঁজ পাবে না। সবাই চোখে ঝাপসা দেখবে। আর বলবে, সব কুহেলিকা!

সত্যিই কি? আমি ঠিক জানি না।