সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আবুল হাসনাত নেই, এটা কেমন করে মেনে নিই? খুব যে ঘন ঘন দেখা হতো তা তো নয়, কিন্তু ছিলেন তিনি ওই যে বলে আলো-বাতাসের মতো-থাকা সেই ভাবেই। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেরই অংশ হয়ে। করোনায় আমার আপন ভাইদের একজন চলে গেছে, সে আমার ভাই নয় কেবল ছিল নিকটতম বন্ধুও; তার মৃত্যুর মতোই আবুল হাসনাতের মৃত্যু আমাকে আঘাত করেছে। এসব আঘাত সহ্য করা কঠিন। তবে আবুল হাসনাতের মৃত্যুর আঘাতটা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগতও।
হাসনাতকে আমি জানি প্রধানত সম্পাদক হিসেবে। সেভাবেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। মফিদুল হকের সঙ্গে একত্রযোগে হাসনাতরা একটি পত্রিকা বের করেছিলেন, গণসাহিত্য নামে। দেশ স্বাধীন হবার পরপরই। পত্রিকার জন্য একটা লেখা চেয়েছিলেন। লেখাটির শিরোনাম আজ আর মনে নেই, কিন্তু হাসনাতকে মনে আছে। তারপরে নানা ভাবে দেখা হয়েছে, জানাজানি হয়েছে।
গণসাহিত্য পত্রিকায় আমার লেখা শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ নামের ছোট একটি বইয়ের সমালোচনা বের হয়েছিল, লিখেছিলেন প্রয়াত আবদুল হালিম। বেশ বড় করেই লিখেছিলেন। পরে সেটা বই হিসেবেও বের হয়েছে। হাসনাত মনে হয়েছিল একটু বিব্রত, কারণ সমালোচনাটি বেশ কড়াই ছিল। আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছিলাম; ওই সমালোচনার ফলে আমার বক্তব্যকে আরো যুক্তিসংগত করবার সুযোগ ঘটেছিল, এবং বইয়ের পরবর্তী সংস্করণটি তাতে উন্নত হয়েছিল। তাছাড়া শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ উভয়েরই মূল্যায়নের প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছিল। মনে মনে আমি লেখককে ধন্যবাদ দিয়েছি, সম্পাদকদের তো অবশ্যই।
পরে হাসনাতের সঙ্গে নৈকট্য বেড়েছে, প্রধানত দৈনিক সংবাদের কারণে। হাসনাত তো ওই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। আমি নিয়মিত তাঁর পাতাটি পড়তাম, মাঝে মধ্যে লিখেছিও। আমার মনে পড়তো আরেকজনের কথা, তিনি আহসান হাবীব। আহসান হাবীব দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতেন, পরে যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তানে। একই রকমের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে আমি দুজনকেই দেখেছি এবং জেনেছি। তাঁদের মধ্যে বড় মিলটা ছিল ওই সম্পাদনার ব্যাপারটাতেই। আহসান হাবীবের মতোই আবুল হাসনাত লেখার প্রথম লাইন পড়েই বুঝে ফেলতেন ভেতরে কী আছে। তারপর সবটা পড়ে নিশ্চিত হতেন যে যা ভেবেছিলেন তাই ঠিক, এবং সঠিকভাবে রচনাটির মূল্যায়ন করতেন। এঁরা নতুন লেখকদের উৎসাহিত করেছেন। লেখকদের লেখা সংশোধন করে দিয়েছেন। পত্রিকার সমস্ত পাতা জুড়ে থাকতো তাঁদের নীরব ও প্রসন্ন উপস্থিতি।
আহসান হাবীব কবি ছিলেন। হাসনাতও কবিতা লিখতেন। কিন্তু নিজের আসল নামে সেটা ছাপতেন না; নাম নিয়েছিলেন মাহমুদ আল জামান। সংবাদের পাতাতে তিনি নিজের কবিতা যে ছাপবেন এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করতেন আমাদের এই সম্পাদক-বন্ধুটি। এক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ছিল তাঁর সংযম।
হাসনাতের সঙ্গে আমার নিজের একটা মিল দেখি, সেটা সম্পাদনার ওই আগ্রহে। আমারও টান ছিল সম্পাদনায়, এখনো আছে। আবুল হাসনাতের প্রজন্মে তাঁর মতো সাহিত্য সম্পাদক আমি কম দেখেছি। সংবাদ ছেড়ে হাসনাত যখন কালি ও কলমে যোগ দিলেন তখন সংবাদের জন্য সেটা যে ক্ষতির কারণ হয়েছিল তা সব চেয়ে বেশি বুঝেছিলেন পত্রিকার সম্পাদক আহমেদুল কবির নিজে। হাসনাতের মুখেই শুনেছি, পদত্যাগপত্রটি উপস্থিত করলে প্রথমে তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। হাসনাতেরও নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে সম্পর্কটিতে ছেদ ঘটাতে। কিন্তু এটা অনিবার্য ছিল যে, হাসনাত আরো বড় একটা কর্মস্থলে যাবেন। দৈনিকের সাপ্তাহিক পাতা নয়, পুরো একটা পত্রিকাই সম্পাদনা করবেন। হাসনাত তো কালি ও কলমে শুধু যোগ দেননি, পত্রিকাটিকে গড়েও তোলেন। শুরু থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে এটি কেবল নতুনই হবে না, হবে বিশিষ্টও। ঠিক তা-ই হয়েছে। কালি ও কলম অন্য কোনো পত্রিকার মতো নয়, এবং বাংলাদেশে এ-রকমের পত্রিকা খুব কমই বের হয়েছে। পত্রিকা ক্রমাগত উন্নত হয়ে উঠেছে।
সম্পাদক হিসেবে হাসনাত তাঁর মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন। সেইসঙ্গে দিয়েছেন শ্রম। হাসনাতকে কাজের বাইরে দেখা কঠিন ছিল, আমি নিজে তো কখনোই দেখিনি। যখন কাজ করছেন না, সাংস্কৃতিক বা সামাজিকভাবে মিলিত হয়েছেন তখনো মনে হতো কাজের মধ্যেই আছেন, কাজ নিয়ে ভাবছেন, কোন কাজটি শেষ হয়নি সে নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন। দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান ছিল অসামান্য; এবং দুটোই ছিল স্ব-আরোপিত।
আর ছিল রুচি। হাসনাতের ভেতরে যে একজন শিল্পী ছিলেন সর্বক্ষণ কর্মরত, সেটা আমরা বেশ বুঝতাম। তাঁর পত্রিকা সম্পাদনাতে ধরা পড়তো। দেখা যেত তাঁর আচার-আচরণ, চলাফেরা ও কথাবার্তায়। ভদ্রলোকরা যে সব সময়ে ও সব ব্যাপারে ভদ্র হবেন এমন নিশ্চয়তা থাকে না; হাসনাতের ভদ্রতাটা ছিল সহজাত ও অপরিত্যাজ্য। তাঁর সর্বদা-নীরব বিনয়ে নম্রতা থাকতো অবশ্যই, কিন্তু ভেতরে শক্ত মেরুদণ্ডও থাকতো উপস্থিত। জানা ছিল আমাদের যে ইনি নম্র কিন্তু মোটেই আপসপন্থী নন।
হাসনাতের নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এটা শৈল্পিক আবার রাজনৈতিকও। আসলে কখনোই তিনি রাজনীতির বাইরে ছিলেন না। এটা অনিবার্য ছিল যে একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাবেন, এবং কলকাতায় থাকার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন। ফিরে এসেও তাঁর কাজের কোনো বিরাম ছিল না; সে-কাজ কেবল যে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ছিল তা নয়, ছিল রাজনৈতিকও। সাংগঠনিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে পরে আর যুক্ত থাকেননি এটা সত্য, কিন্তু মতাদর্শিকভাবে কখনোই রাজনীতির বাইরে ছিলেন না। থাকা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।
হাসনাতের প্রসঙ্গে মনে পড়ে ‘মুক্তধারা’র চিত্তরঞ্জন সাহাকে। চিত্তবাবুর ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা; তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশের, পত্রিকার নাম সাহিত্যপত্র। আবুল হাসনাতের সম্পাদনা দক্ষতা ও মেধা সম্পর্কে তিনি জানতেন। নিজের পত্রিকার সঙ্গে তিনি আবুল হাসনাতকেও যুক্ত করেছিলেন। সম্পাদনা পরিষদের সদস্যদের নাম ছাপা হতো না, সভাপতি হিসেবে শুধু আমার নামটা থাকতো; পরিষদের বৈঠকগুলো আমাদের বাসাতেই বসতো; সেইসব বৈঠকে হাসনাতের উপস্থিতি ও মতামতগুলো হতো খুবই উপকারী। হাসনাত কথা বলতেন কম, কিন্তু যা বলতেন তার পেছনে চিন্তা থাকতো।
ওই কম-কথা-বলাটা হাসনাতের বৈশিষ্ট্য ছিল। কেউ কেউ মনে করতো এ তাঁর উন্নাসিকতা। কিন্তু আসলে ওটি ছিল তার স্বভাব। প্রগলভ বা অতিউৎসাহী হতে আমরা কখনো দেখিনি তাঁকে। অথচ ওই সংযমের ভেতরেই কঠিন ছিল অঙ্গীকার। তাঁর তো সময় ছিল না সময় নষ্ট করবার, অঙ্গীকার ছিল কাজের প্রতি, মতাদর্শের প্রতি। আমার মনে হয়নি হাসনাত বিরক্ত হতে, অথবা রাগ করতে পারেন। অথচ অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল ছিলেন তো তিনি। যে-দুটি গুণ বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখা কবিতায়।
সেবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যে-সাহিত্য সম্মেলনটি হয় সিলেটে, তার মূল দায়িত্বটা ছিল হাসনাতেরই। দেখলাম কত তাঁর কাজ, কত বিচিত্রধরনের দায়িত্ব; কিন্তু কেমনভাবে বিরক্তি বা রাগ প্রকাশ না করে শান্তভাবে প্রায় নিঃশব্দে সমস্ত কিছু সামাল দিচ্ছেন। শেষ দেখা গত বছর, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে। দেখে মনে হলো কিছুটা যেন ক্লান্ত, যেমনটা আগে কখনো মনে হয়নি। টেলিফোনে তারপরে কথা হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু কথাবার্তায় অসুখের কোনো ছাপ পড়েছে মনে হয়নি। তবে ভেতরে যে অসুখ ছিল শেষমেশ তো তা ধরা পড়েছে।
আবুল হাসনাতের কাছে আমি বহুভাবে ঋণী। তাঁর খুব আগ্রহ ছিল শেক্সপিয়রের ওপর আমি একটি বই লিখি। ওই নাট্যকারের নারী চরিত্রদের আমার একটি বই আছে; নায়কদের নিয়ে, এবং শেক্সপিয়রের সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তার ওপরে লিখে একটা পূর্ণাঙ্গ বই তৈরি করবো এবং সেটা তিনি বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশ করবেন এমন কথা বলেছেন; স্মরণও করিয়ে দিয়েছেন আমাকে আমার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে, এবং লেখা যে হয়ে ওঠেনি তা নিয়ে আমার ভেতরে একটা অপরাধবোধও কাজ করতো। কিন্তু সকল বোধকে ছাপিয়ে এলো একেবারেই অপ্রত্যাশিত তাঁর অকাল প্রস্থানের খবর শোনার অপরিমেয় দুঃখ।
হাসনাতের কাছে আমার একটি বড় রকমের ঋণ আছে; তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে সেটি বিশেষভাবে মনে পড়ছে। ঘটনাটি হলো দৈনিক সংবাদে গাছপাথর ছদ্মনামে ‘সময় বহিয়া যায়’ নাম দিয়ে আমার একটি কলাম লেখা। এটি কখনোই সম্ভব হতো না যদি না আবুল হাসনাতের উদ্যোগ থাকতো পেছনে। যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনা তিনিই করে দিয়েছিলেন। এবং আমি আনন্দের সঙ্গে একটানা চোদ্দো বছর ওই কলাম লিখেছি, শুধু দু-সপ্তাহ লেখা হয়নি আমার স্ত্রীর অকাল প্রয়াণের কারণে। লেখা এক সময়ে থামাতে হয়েছে। কিন্তু হাসনাতের ইচ্ছা ছিল আমি যেন থামিয়ে না দিই। আমার থেমে-যাবার কয়েক বছর পরে হাসনাত একদিন এসেছিলেন আমার বাসায়, এটা বলতে যে তাঁরা মতামত জরিপ করে দেখেছেন যে পাঠকরা চায় সংবাদ আবার আগের মতো হোক, এবং সে-জন্য আবারো আমার লেখা দরকার। কিন্তু আমার পক্ষে লেখা আর সম্ভব হয়নি। সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখার একটা সময় ছিল, আমার জন্য সে-সময়টা ততদিনে পার হয়ে গেছে, আমি টের পেয়েছি।
আমরা অনেকেই তো তাঁর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম। পাঠক হিসেবে, লেখক হিসেবে। আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ইতিহাসে হাসনাত থাকবেন। আমরা অনেকটা যে এগিয়েছি তা নয়, কিন্তু যতটা এগিয়েছি তার পেছনে নীরবে অনেকে ছিলেন, ছিলেন আবুল হাসনাতও। তাঁকে ভোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। আবুল হাসনাতের স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রইলো।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.