খসড়াজীবন

ইমতিয়ার শামীম

পুকুরের পাড়ে সজনে গাছওয়ালা দালানের পাশে টিনশেডের ঘরটায় সাজেদা যখন মেঝের ওপর বিছানা পাততে থাকে, একটা রিকশা তখন টুংটাং বেল বাজিয়ে নর্থ রোডের দিক থেকে এসে ছুটতে ছুটতে চলে যায় হাতিরপুলের দিকে। পুরানা খবরের কাগজ মাপতে মাপতে বেলের শব্দে কান তুললেও চিপা দোকানটার মধ্যে থেকে লোকটার আর চোখে পড়ে না সে রিকশার পেছনে অাঁকা নদীঘেঁষা মেঠোপথের ধারে দাঁড়ানো দু-একটা নারকেল গাছ, খড়ের পালা আর ছনের ঘরের পাশে ধান ঝাড়তে বসা একলা মেয়ের উদাস পেইন্টিং। তবু ফসিল হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে সজনে গাছের কয়েকটা পাতা ঝরে পড়ে দেয়ালের পাশে জমানো ময়লার মধ্যে। মাজেদা এ-সময় কোনোদিনই ফেরে না, আর ফিরলেও রিকশায় ফেরে না। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে বাসস্ট্যান্ডে নেমে রেবেকাদের সঙ্গে হেঁটে আসে সে। এই কথা জানা আছে সাজেদার, বছর দেড়েক হয় সে আর মাজেদা একসঙ্গে আছে, এই কথা না জানার তাই কোনো কারণ নাই, তারপরও সাজেদার মনে হয় যে, রিকশাটা বোধহয় দরোজার সামনেই থেমেছে, রিকশার বেল বাজিয়ে মাজেদা তাকেই ডাক পাঠাচ্ছে। প্রতিদিনই এ-সময় সে বিছানা পাতে, প্রতিদিনই তখন দরোজার সামনে একটা রিকশার টুংটাং বেল বাজতে থাকে আর সেই বেল কানে এলে প্রতিদিনই মনে হয় তার, মাজেদা বোধহয় ফিরে এলো কাজ থেকে। কিন্তু বাস্তবে রিকশাটা কোনোদিনই দরোজার সামনে দাঁড়ায় না, একটা ইঁদুর ভয় পেয়ে অথবা দুর্ঘটনা এড়াতে প্যাডেলের কাছাকাছি লাফ দিয়ে উঠলে রিকশাওয়ালা ভয় পেয়ে যায়, রিকশার গতি শ্লথ হয়ে পড়ে, রিকশাওয়ালা ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে ওঠে ভয়ার্ত রাগমেশানো স্বরে। সবকিছু

ঠিকঠাক বুঝে নিতে সে পাতাকাটা চোখ মেলে দেখে নেয় চারপাশ। যদিও তারপরও তার চোখে পড়ে না কত যে খাল আর ডোবা ছিল এখানে, একদিন প্রতিদিন হাতি তার শুঁড়ে-শুঁড়ে আকাশের শূন্যে কতশত ছবি এঁকেছে জলের রঙে সেই খালডোবায়, একদিন কী মত্ত আনন্দে একটি পুঁটিমাছ পানির মধ্যে থেকে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে ফিরে গিয়েও কারো কাছে বলতে পারেনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার রোমহর্ষক স্মৃতি। এখন খালডোবা লোপাট হয়ে যাওয়া এই পুকুরের পাড়ে টিলা কেটে বানানো পথের আস্বাদ, খানিকটা ঢাল বেয়ে ওঠানামা করার আস্বাদ। পায়ের গতি শ্লথ হয়ে আসে তাই চলতে গেলে, ধীর হয়ে আসে রিকশার চলার গতি। পথের পাশের ডেরা থেকে উঠে আসা ইঁদুর ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে চলে গেলে প্যাডেলে রাখা পা থেমে যায় তাই। তখন রিকশাওয়ালা নেমে পড়ে রিকশা থেকে, ঢালু রাস্তা দিয়ে সেটিকে ধীরে ধীরে টানতে থাকে। প্রতিদিনই সে লাফিয়ে ওঠা ইঁদুরের স্পর্শ থেকে বাঁচার আনন্দে এইভাবে রিকশা থেকে নেমে পড়ে, ধীরে ধীরে রিকশাটিকে টানতে থাকে সেই ঢালু রাস্তা দিয়ে। ওদিকে প্রতিদিনই সাজেদা দরোজার দিকে এগোতে গিয়েও ফিরে আসে ‘কুত্তার বাচ্চা’ গালি শুনে। তারপর অজান্তেই তাকিয়ে থাকে মোবাইল ফোনের দিকে।

প্রতিদিনই এরকম হয় – অথবা কোনোদিনই হয় না – অথবা কোনোদিন হতেও পারে; বৃত্তাকার বাঁধ দিয়ে ঘেরা খুন হয়ে যেতে থাকা এই মহানগরে সবই সম্ভব, কেননা সময় এখানে ধোঁয়া জ্বালায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চূর্ণ দিয়ে। আর সেই ধোঁয়া কুয়াশা ঢেকে রাখে সাজেদা ও মাজেদাকে। কিন্তু আপাতত সাজেদা বিছানায় এসে বসে। কোনো একদিন এই মেঝেতে সিমেন্টের প্রলেপ পড়েছিল, আর এখন খানিকটা হাঁটলেই বালির আস্তরণ উঠে আসে ইটের শরীর থেকে, ঝাড়ুও দিতে হয় আস্তে ও সাবধানে, হারিকেনের মিটমিটে আলোয় পলেস্তারা ওঠা দেয়ালটাকে বীভৎস লাগে। তবু সাজেদার ভালো লাগে। বাসা যদি এরকম, জল যদি পাওয়া যায় কেবল সেই শেষ রাতের বেলা, আর তাতেও থাকে রাজ্যের ময়লা, ভাড়াও তবে কমই লাগে। অনেক বছর আগে এটি হয়তো ছিল খান্দানি বড়লোক বাড়িওয়ালার গাড়ির গ্যারেজ – আর সেটা এমনই গ্যারেজ, যেখানে গাড়ির পাশে শুয়েও থাকা যাবে গাড়ির প্রেমে পড়ে। তারপর একদিন সেই গ্যারেজটা গ্যারেজ থাকে না আর। গ্যারেজের সঙ্গে আরও দুটো টিনের ছাদ জুড়ে বাথরুম আর রান্নাঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয় কাউকে। কিংবা গ্যারেজ-ট্যারেজ নয়, দারোয়ানই একসময় থাকতো এখানটায়। যাই থাকুক, যেই থাকুক, তাতে কিছু সাজেদার আসে-যায় না – বিছানায় সে হাঁটুভাঙা ‘দ’ হয়ে দুচোখ বুজে টানটান শুয়ে থাকে। তারপর আবারো উঠে বসে, আবারো কান পাতে, কিন্তু মাজেদার ফিরে আসার কোনো আলামত মেলে না। মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, একেবারে সাদা হয়ে গেছে, হয়তো ব্যাটারির চার্জ নেই, হয়তো নেটওয়ার্ক নেই, হয়তো মারাই গেছে। তারপরও সে অবিরাম চেষ্টা করতে থাকে রিং করার, আহ্, কেউ যদি ধরে! কাউকে যদি সে জানাতে পারে, এইখানে সে শুয়ে আছে হৃদয়ে অথবা শরীরে পৃথিবীর সব ভার নিয়ে। কিছুতেই তাই উঠতে পারছে না, অন্ধকার সরাতে পারছে না, – কেবল স্তম্ভিত বাতাসকে স্পর্শ করতে চাইছে স্তম্ভিত মূক হৃদয় দিয়ে। কিন্তু না, অন্তত জিয়াদকে পাওয়া দরকার – জিয়াদকে বলা দরকার, এইখানে সে এখনো বেঁচে আছে পৃথিবীর সব ভার নিয়ে। সাজেদা উঠে গিয়ে বয়ামের মধ্যে থেকে ম্যাড়ম্যাড়ানো ৪-৫ ভাঁজ দেওয়া একটা কাগজ বের করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাম্বার টিপতে গিয়েও চিন্তা করে। তাইফে এখন কয়টা বাজে? প্রতিদিনই তার এই হিসাব করতে হয়। মাস দুয়েক না কি তারও বেশি পেরিয়ে গেছে, মোবাইলটার মনিটর তার একেবারে ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে; কল আসে, কিন্তু নাম বা নাম্বার কোনোটাই ওঠে না। কথা বলা যায়, কথা শোনা যায় – কিন্তু কনট্যাক্ট লিস্ট দেখা যায় না, তবে ডিজিট ঠিকমতো চাপ দিয়ে কল করা যায়। এইভাবে কয়েকদিন জিয়াদকে সে ফোন করেছে, জিয়াদ ফোনও ধরেছে। আর এ-কথা সে-কথায় এটাও তার বলা হয়ে গেছে, মোবাইল সেটটা নষ্ট হয়ে গেছে, নতুন একটা সেট কেনা দরকার। শুনে জিয়াদ তাকে বলেছে, চিন্তা করিও না, আমি আমার লগে লয়ে আসবোনে। আমি তো তাড়াতাড়িই আসপো – আকামার ঝামেলাডা পার হলিই আসবো।

আকামা পাওয়ার ঝামেলা কবে শেষ হবে? নাকি এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে? কিন্তু শেষ হয়ে গেলে তো জিয়াদের ফিরে আসার কথা। সাজেদা বেশ খানিকটা নিশ্চিন্তি নিয়ে আজকে পাওয়া বেতনের টাকা আবারো গোনে। চার হাজার একশ তেপান্ন টাকা। বেতন দেওয়ার সময় কেউ খুচরা টাকা নিতে চায় না। পকেট অথবা ব্যাগভর্তি টাকাপয়সা নিয়ে চলাফেরা করার নানা ঝামেলা। কিন্তু সাজেদা খুচরা টাকাই নেয় – টাকাপয়সা সে ভালো করে চেনে না, জাল টাকা নেওয়ার ভয় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কোথাও সে শুনেছে, ছোটখাটো টাকা জাল হয় না, দশ টাকা জাল করে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার চেয়ে একবারে পাঁচশো কিংবা এক হাজার টাকার জাল নোট চালিয়ে দেওয়া অনেক সোজা। সে তাই খুচরা একশ কিংবা পঞ্চাশ টাকাই নেয়, তাতে জাল টাকার হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। এক হাজার টাকার চারটা নোট নেওয়ার বদলে চল্লিশটা একশ টাকার নোট নিলে কত বেশিই বা ফুলে উঠবে তার হাতের ছোট্ট পার্সটা যে, সেটি ছিনিয়ে নিতে ছুটে আসবে ছিনতাইকারীরা! সে পাঁচশো টাকা সরিয়ে রাখতে গিয়েও এক হাজার টাকা গুনে গুনে আলাদা করে। না, মাজেদা নিশ্চয়ই এ-মাসেও পারবে না টাকা দিতে। মাকে পুরো টাকা পাঠাতে হবে তাকেই। তবে এবার আর আগেরবারের মতো মোবাইলে করে পাঠাতে যাবে না। মোবাইলে পাঠালে বেহুদাই ২০-৩০ টাকা চলে যায়। তার চেয়ে পোস্ট অফিসই ভালো, মানিঅর্ডার করাই ভালো, অন্তত কয়েকটা টাকা তো বাঁচবে! আগে কাঁঠালবাগান বাজারে ঢোকার মুখে একটা পোস্ট অফিস ছিল, কিন্তু এখন তা উঠে গেছে – তার মানে তাকে যেতে হবে নিউমার্কেটের দিকে। মাজেদার নিশ্চয়ই সময় হবে না। এত রাতে এসে দিনের বেলা ঘুম থেকে উঠেই পোস্ট অফিসে যাওয়া ভালো দেখায় না। তার চেয়ে সে-ই না হয় দুপুরে কোনো এক ফাঁকে কাউকে দিয়ে টাকাটা মানিঅর্ডার করে দেবে। আজ মাজেদা কাজ থেকে ফিরলে তবু না হয় জেনে নেবে, পারবে কি-না পোস্ট অফিসে যেতে। মাজেদার দিতে না পারা পাঁচশো টাকা না-হয় সে নিজেই দেবে; কিন্তু কাউকে না কাউকে তো পোস্ট অফিসে গিয়ে সেটা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে!

সাজেদা মাজেদার জন্যে অপেক্ষা করে আর টাকা পাঠানোর ছক অাঁকে। ছক অাঁকে জিয়াদের কাছ থেকে কী কী শুনতে হবে। কিন্তু জিয়াদকে ফোনে আর পাওয়াই যাচ্ছে না! আকামা পাওয়ার ঝামেলা তাহলে শেষ হয় নাই! ফোন কিনে দেবে বলার দিন থেকে তার সঙ্গে জিয়াদের আর কথা হয় না। কথা বলার চেষ্টা করলেও না। সাজেদার ফোন ধরে না জিয়াদ, কল করলে কেটে দিয়ে রিং করে নতুন করে – এই ঘটনায় এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে মিসড কলই দেয় সে। কিন্তু এখন আর মিসড কল দিয়েও কাজ হয় না। অতএব কয় সপ্তাহ হয় সে সরাসরি কলই করছে। কিন্তু কেউই তার ফোন ধরেনি  কেউই তার সঙ্গে কথা বলেনি এবং তারপর কতদিন হয়ে গেল, কেউই এখন আর ফোন ধরে না। মনে হয় ফোনটা বিরান মরুভূমিতে বালির ভেতর পড়ে আছে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে আর জিয়াদকে আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে বিষণ্ণ বালিঝড়। খুব বেশি কথাবার্তা তো হয় না তাদের, কী খাইছো, কাম থেইক্যা ফিরলা কহন আর বাড়ির খবর কী, ঠিক আছে, ঘুমাও – এর বেশি কোনো কথা তারা আর খুঁজে পায় না। কিন্তু ওইটুকু কথাবার্তাও বন্ধ কমাস থেকে। তার না হয় মোবাইলে গোলমাল, জিয়াদেরও কি তাই? না কি জিয়াদ কোনো ঝামেলায় পড়েছে? মোবাইল সেটটা নিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে ভাবে সাজেদা, এইটা তো একেবারেই গেছে, আজ মাজেদা ফিরলে ওর মোবাইল থেকেই না-হয় একবার কল করে দেখবে! কিন্তু মাজেদা ফিরতে ফিরতে রাত ৩টা। নাকি তারও বেশি? নাকি সাজেদা নিজেই এখনো কাজে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে কত রাত হবে, কত রাতে মাজেদার সঙ্গে তার দেখা হবে, সেসবের ঠিকঠাক নাই। সেলাইকল চালাতে চালাতে হঠাৎ কিসের শব্দে দুলে ওঠে সে, মুহূর্তের জন্যে দেখতে পায় আলোর এক তীব্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তারপরই মনে হয় অজস্র আর্তচিৎকারের কালো চাদর ঢেকে দিচ্ছে তাকে অন্ধকার গহবরের মধ্যে। সে হারিয়ে যাচ্ছে, কোনখানে তাও জানা নেই, এ তো চৈত্রসংক্রান্তির মেলা নয় যে, হারাতে হারাতে জানার ইচ্ছে হবে কোনখানে হারিয়ে যাচ্ছে সে! জ্ঞান না থাকলে এসব জানার প্রয়োজন পড়ে না। নাকি একটু একটু করে জ্ঞান তার ফিরে আসছে আর অন্ধকার হাতড়ে উঠতে যেতেই লোহার একটা রডে খোঁচা লেগে জেগে ওঠা আর্তচিৎকার তাকে আকুল করে তুলছে পৃথিবীর জন্যে! এটা কি তাহলে কবর? তেমন কবর যেখানে নিজের গায়ে জড়ানো সাদা কাফনের কাপড়ও লুপ্ত হয়ে যায়! অন্ধকার হাতড়াতেই একটা মৃত লাশের অস্তিত্ব আবারো আর্তচিৎকারের জন্ম দিচ্ছে তার কণ্ঠনালিজুড়ে। তার কণ্ঠনালিতে, নাকি মাজেদার কণ্ঠনালিতে? আর আর্তচিৎকারের মধ্যে দিয়ে আবারো আশা জাগছে, ভয়ে ভয়ে আশা জাগছে, কাঁদতে কাঁদতে আশা জাগছে, অসহায় আশা জাগছে, নিশ্চয়ই বাঁচতে পারবে সে। বাঁচবে! মাজেদা তাহলে বাঁচতে পারবে! কিন্তু এভাবে সে ভাবছে কেন, একটু পরেই মাজেদা ফিরে আসবে, রাত ৩টায় তার শিফট শেষ হয়। তারা দুই বোন একই সঙ্গে থাকে একই সুখদুঃখ নিয়ে, বেতন পেলে সে আর মাজেদা আড়াইশো আড়াইশো করে মোট পাঁচশো টাকার সুখদুঃখ ভাগাভাগি করে গ্রামে থাকা মায়ের জন্যে। ঠিক আছে, মাজেদা না হয় আরো কয়েকদিন পরেই টাকা দেবে – কিন্তু দেবে তো! মাকে টাকাটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু তার শিফট খুব ভোরবেলাতে, সকাল ৮টার আগেই ঢুকতে হয় কারখানাতে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামে; আর মাজেদার শিফট বেলা ২টায়, ফিরতে ফিরতে রাত ৩টা বাজে। কিন্তু মাজেদা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত থাকে, এখনো ও এই শহরের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি, এখনো রাস্তার ধারে বড়লোকদের বাসার লনে ফুলগাছ দেখলে থমকে দাঁড়ায়। কী করে ওকে বলা যায়, সকালে উঠে পোস্টঅফিসে গিয়ে টাকা পাঠাতে! নাহ্, সে-ই বরং একটা ব্যবস্থা করবে –  রূপুকে ঠিকানা বললে ও নিশ্চয়ই টাকাটা পাঠিয়ে দিতে পারবে। দুপুরের শিফট হলে সে-ই পারত, কিন্তু দুপুরের শিফটে সে ফিরে আসতে আসতে আরও একমাস। অথবা তার আগেও হতে পারে, ম্যানেজারের ইচ্ছে হলে যে-কোনোদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজের পর আরো চার ঘণ্টা ওভারটাইম করার এ রুটিন পালটে যেতে পারে, তাকেও দুপুর নাগাদ দৌড়াতে হতে পারে – অথবা সন্ধ্যার বদলে ফিরতে হতে পারে মাজেদার মতোই রাত ৩টায়। সেসব না হয় ভবিষ্যতের ব্যাপার; কিন্তু আজ যখন সে রাত ৩টায় ঘুমজড়ানো চোখে দুয়ার খুলে দেবে, তাইফে তখন কয়টা বাজবে? রাত ১২টা নাকি? নাকি ১টা? তখন নিশ্চয়ই কথা বলা যায়। আগেও তো এই সময়ে দু-একবার বোধহয় কথা হয়েছে তাদের। আর ফোন করার পর, খুব বেশি কথা তো হয় না, কিন্তু তারপরও যদি সে প্রশ্ন করে, জিয়াদ আবার কবে দেশে ফিরবে, সেটা কি উচিত হবে? বছর আড়াই হয় জিয়াদ দেশে আসে না, মানে আসা হয় না, একবার দেশে আসা মানেই কয়েক লাখ টাকার ধাক্কা সওয়া। এত টাকা খরচ করে এইভাবে মাসখানেকের জন্যে দেশে আসার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে আবার যখন তাইফেই ফিরে যেতে হবে তাকে, বিশেষ করে তার পক্ষে যখন বউকে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। এই নিয়ে কথা উঠলেই জিয়াদের মন খারাপ হয়ে যায়, মুখ খারাপ করতে করতে বলে বসে সে, মুসলমানদের দেশ কি আর খ্রিষ্টানদের ইউরোপ-আমেরিকার মতো নাপাক জায়গা যে বউ নিয়ে যাওয়া যাবে? কিংবা ১২-১৩ বছর কোনোমতে পার করে দিলেই সিটিজেন করে নেবে। অত নালি আধা সের না – কাজকর্ম করতে দেয়, এই তো কত। আবার বউকে নেওয়া!!! মুসলমান আর মুসলমান ভাই-ভাই হতে পারে, তাই বলে দেশের সিটিজেন হতে দিতে হবে? ভাইয়ে ভাইয়েও তো অবস্থার কম-বেশি হয়, হাতের পাঁচ আঙুল তো এক হয় না – সৌদি আরব কি আর আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো অসতী জায়গা যে চাইলেই সেখানে যাওয়া যাবে, তাও আবার এক মহিলা হয়ে? জিয়াদ তাই সাজেদাকে সৌদি আরবে নিয়ে যেতে পারে না, চিরস্থায়ী হতে পারে না – উলটো তাকেই সৌদি আরব থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে হয় গাঁটের পয়সা খরচ করে। তাকে ফিরতে হয় হিসাব করে, যেতে হয় হিসাব করে। এত টাকা খরচ করে খালি খালি বউয়ের সঙ্গে মাসখানেক কাটানোর জন্যে দেশে যাওয়ার কথা সে আর চিন্তাও করে না, বরং কেউ দেশে যাওয়ার কথা তুললেই তার চান্দি জ্বলে, রক্তমাংস জল করা এত টাকা বিমানভাড়া দিয়ে কী দরকার তার দেশে যাওয়ার!?

সত্যিই তো, দেশে আর না এলেও চলে জিয়াদের। একসময় আসা হয় নাই টাকা-পয়সার সমস্যাতে, এখন শুধু টাকা-পয়সার মায়া না, কাজের চাপও আছে। দোকান দিয়েছে সে, অন্তত দেশের মানুষজন সেরকমই জানে। আর কথাটা একদম মিথ্যাও না। দোকান নেওয়ার রিয়াল সে-ই দিয়েছে, দোকানের মালপত্রও সে-ই তুলেছে, এমনকি কর্মচারীদের বেতনপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচও  সে-ই করে থাকে – যদিও দলিল করতে হয়েছে এক আরব-ব্যাটার নামে। বাইরের দেশের কাউকেই সম্পত্তির মালিক বানাতে রাজি না ওরা। মুসলমান হয়েছো তো কী – চাইলেই কি আর মালিক হওয়া যায়? একটা নিয়ম আছে না? মিসকিনের দেশের মানুষ জিয়াদ, মিসকিন কেন মালিক হবে? দোকান থেকে যা লাভ হয় তার ৩০ ভাগও ওই আরব-ব্যাটাকে দিয়ে দিতে হয়, এই দুঃখ সে কোথায় রাখে! একটু কড়া কথা বললেই পুলিশ ডেকে নামিয়ে দেবে দোকান থেকে, দলিল তো ওই আরব-ব্যাটারই নামে! এরকম ঘটনা ঘটিয়ে পরে মাফ চেয়ে, বাপ-বাপ ডেকে পার পেতে হয়েছে – এরকম অনেক দেখেছে জিয়াদ নিজের চোখে। তাই দোকানের কথা বলতে গিয়ে তার ভালো লাগে, আবার খারাপও লাগে, চান্দি গরম হয়ে ওঠে, এহ্, এর চেয়ে যদি সে ইউরোপে যেতে পারত! জিয়াদ যখন এসব বলে সাজেদা তখন তার মাথায় হাত বুলায়, হাতের স্পর্শে প্রশান্তি নামায়, ঝিরিঝিরি কামনা নামায়, আর কামনার সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আগ-অবধি জিয়াদ তার আক্ষেপের কথা বলে চলে। ওই দেশে তো তাকে কেউ পোছে না, শুধু তাকে কেন, তাদের কাউকেই না – এত বড় শহর, কিন্তু তাদের পরিধি কত সীমিত, জগৎ কত সীমিত। সেজন্যেই দেশে ফেরে সে। সচ্ছলতার যে বাগান তৈরি করেছে সে, সেই বাগানের খানিকটা নিয়ে আসে পকেটে করে – পকেটটা খালি করে ফিরে যাবে বলে। ধূসর চোখে নিজের গ্রামকে দেখতে থাকে, যে-গ্রামে তার আর ফেরা হবে না। কিন্তু কোনো মানুষের দিকে তাকায় না ভালো করে, যেন এ-গ্রাম তার একেবারেই অচেনা, অজানা, অদেখা। না তাকালেও মনে মনে মাপতে থাকে আশপাশের সবার দৃষ্টিতে। ওই তো আড়চোখে তাকে দেখে নিতে নিতে রুইমাছের দরদাম করছে স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে। সম্মানী মানুষের ছেলে, আর নিজের সম্মানও তো একেবারে কম না তার –  চাকরি করছে একটা সরকারি অফিসে। অথচ অবস্থা কী, একটা মাছের দাম পাঁচ টাকা কমানোর জন্যে সেই লোক কি না কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘ্যানঘ্যান করছে। দেখেও না দেখার ভান করে দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ নিয়ে জিয়াদ সেখানে যায়, সরাসরি মাছওয়ালার দিকে তাকায়। আর মাছওয়ালা তার ৩২টা দাঁত বের করে ‘আসেন মিয়াভাই, আসেন, নদীর তাজা মাছ মিয়া ভাই’ বলতে না বলতেই সে কোনো কথা না বলে ব্যাগটা এগিয়ে দেয়। মাছওয়ালা তার গামছায় হাত মোছা বাদ দিয়ে ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলে, কাইটা দিমু? জিয়াদ একমুহূর্ত চিন্তা করে, মাছ কেটে নিলে তো কেউ বুঝতেই পারবে না সে মাছ কিনেছে! এমনিতেই এই ব্যাগ, এই তার দুচোখের বিষ – কাউকে দেখানো যায় না কিছু, আগে যে-কলার ফেতরা কিংবা মাছের কানকোয় ঢুকিয়ে দিতো, সেটাই তো ভালো ছিল! তার বদলে এখন এইসব ব্যাগ-ট্যাগ, তার ওপর কাটা মাছ –  না, না, কাটার দরকার নাই, কয় ট্যাকা, কও? তারপর পাঁচ টাকা কম দামে কেনার জন্যে যে-মাছটাকে ১০-১৫ মিনিট ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিল হেডমাস্টারের ছেলে, ঠিক সেটিই তার চোখের সামনে বিক্রি হয়ে যায় দ্বিগুণ দামে। দেখে তার হাত-পায়ে টাসকি লেগে যায়, তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চক্ষুলজ্জা সামলানোও হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই জিয়াদ তার দিকে সরাসরি তাকায়, আপনে নিতে চাইছিলেন না হি? এই তপা – দিয়া দে, ওনার ব্যাগে তুল্যা দে।

হেডমাস্টারের ছেলে, নামটা যেন কী, একবার তাকে লজেন্সের খোসায় ইট ভরে খেতে দিয়েছিল, একবার তাকে কুস্তিতেও হারিয়ে দিয়েছিল, তবে একবার সে ইঁদুররাজার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছিল ওর প্যান্টের মধ্যে, চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে গিয়ে ওকে তাই নামতে হয়েছিল ডোবার জলে, কিন্তু তারপরও জিয়াদ ওর নাম ভুলে গেছে, শুধু ক্ষতগুলো মনে আছে। আর ওরও নিশ্চয় আছে! তাছাড়া ভদ্রতা দেখানোর জন্যে হলেও টাকা বের করে দামটা দিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করা – তাও তো সম্ভব না, অত টাকাই তো নাই তার পকেটে। সে তাই দ্রুত বলে, না-না – দরকার নাই, দরকার নাই –

না, না, – এই তপা তুল্যা দে। জিয়াদ ব্যাগটা প্রায় জোর করে টেনে নেয় ওর কাছ থেকে। তারপর বিচিত্র এক হাসি দিয়ে সেটা মাছওয়ালাকে দেয়। এরকম ঘটনা সে প্রায়ই ঘটায়। বছরের পর বছর আরব-ব্যাটাদের চটকানি খেলেও দেশে ফিরে এইভাবে দু-চারজনকে বববর বানিয়ে দিতে পেরে ভালো লাগে তার। ভালো লাগে সেইসব আবার উঁচুগলায় গল্প করে সাজেদাকে শোনাতে। আর সাজেদা চুপচাপ শোনে। শুনতে শুনতে সে অশান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় এইভাবে একদিন তাকেও জিয়াদ অপমান করবে, আরব-ব্যাটাদের কাছে চটকানি খাওয়ার গ্লানি মুছবে তার চোখে-মুখে।

নাহ্, জিয়াদ এবার এলে আটকে ফেলতে হবে – ছেলেপেলে নিতে হবে। পোলাপান না হলে পুরুষ মানুষের শেকড় গজায় না, পিছুটান আসে না। মেয়েমানুষ তো পুরুষের পিছুটান না, মেয়েমানুষ হলো পুরুষের সামনের টান – এক মেয়ে পিছে পড়তেই আরেক মেয়ে দূরের আকাশ হয়ে ভেসে ওঠে তার সামনে। পেছন ভুলে দূর আকাশের দিকে পুরুষ পায়ে পায়ে এগোতে থাকে – যতক্ষণ না সে নারীর আস্বাদ মেলে। কিন্তু সন্তান তার পিছুটান হয়ে জেগে থাকে, বিত্ত-বৈভবের ভবিষ্যৎ প্রতিপালক হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। সেই প্রতিপালককে ছায়া দিতে পুরুষ তাই বারবার পিছু ফেরে। নাকি সাজেদা ভুল ভাবছে! লবণগুলো ভিজে-ভিজে উঠেছে পলিথিনের প্যাকেটের মধ্যে – হরলিক্সের ফাঁকা বয়ামে সেগুলো সে ঢালতে থাকে। মিনমিন করে জিয়াদ যেভাবে তার সঙ্গে লটকে পড়েছিল, তা থেকে তার তো ওরকমই মনে হয়। সে কি আর তেমন সুন্দরী, নাকি কারখানায় কাজ করা মেয়েদের বেতন বেশি? আবার এমনও তো না, যারা আরব-কুয়েত যায় গার্মেন্টসের মেয়ে ছাড়া তাদের কোনো পাত্রী জোটে না। এক অর্থে তো তার বয়স ২২ পেরিয়েই গেছে, রিকশাওয়ালা হোক আর যাই হোক, একটা স্বামী আছে তার। শরীর থেকে ঘাম ঝরে তার আর বাড়ি ফিরেই ভাত খায় আগে। অথচ জিয়াদ গুনগুনিয়ে ধাঁধা জিজ্ঞেস করে, ‘হাতুড় বাটাল বাইশখান, চোরে নিলো তিনখান, তা হলে থাকে আর কয়খান?’ শুনে সাজেদা হাসতে হাসতে রমনা পার্কের ঘাসে মিশে যায় প্রায়। রমনা, – এই একটা জায়গাই তো আছে তাদের মতো মানুষদের এরকম প্রাণ খুলে হাসবার জন্যে, আর কোনখানেই বা যেতে পারে তারা! সেই রমনার সবটুকু সবুজ এখন জ্বলজ্বল করছে সাজেদার কালো চোখে, আমি কইল গেরাম থেক্যাই আইছি। এইসব আমার জানা আছে। সেদিনই তাদের বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল – কারখানার ছুটির সেদিনটিতে, জাদুঘরে ঘুরে ছিল। সাজেদাকে নাকি জিয়াদের মনে হয়েছিল জাদুঘরের বক্ষোদ্যত প্রাচীনকালের নারীদেবী, যার অরব চোখের দিকে চেয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ জিয়াদের হাতে অত সময় নাই, মাত্র মাসখানেকের জন্যে সে তাইফ থেকে বাড়ি ফিরেছে। আরব এমিরেটস, গালফ জাতীয় বিমানগুলো থামলেই এয়ারপোর্টের বাইরে সাড়া পড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি সাড়া পড়ে বাংলাদেশ বিমান থামার পরে। যেন পৃথিবীর তাবৎ যাত্রী এই একটা এয়ারলাইন্সেই যাতায়াত করে, তারা এদেশে আসছে স্যুটকেসভর্তি কত কিছু নিয়ে। তাদের সেই যে-কোনো একটা স্যুটকেস চালান করে দিতে পারলেই নিশ্চিত থাকা যায় সপ্তাহখানেক। টানা চার বছর বাইরে কাটিয়ে সেদিন দেশে ফিরে আসছে জিয়াদ – এই চার বছরে কত কিছু বদলে গেছে, বিমানবন্দরে আরো কত ভিড় বেড়েছে, ফুলগাছ বেড়েছে, দীঘল দেহের গাছ কমেছে আর প্রস্রাবের গন্ধও একটু কমেছে বোধহয়। যাওয়ার সময় জানা ছিল না কী হবে বিদেশে গেলে, এখন জানা নেই বাইরে থেকে আসার পরে কী ঘটবে – বক্কারভাই শুধু বলে দিয়েছে, খবরদার স্যুটকেস কারো কাছে দিবি না।

স্যুটকেস জিয়াদ কারো কাছে দেয় নাই। কিন্তু তারপরও ঝামেলা হলো। অবশ্য এয়ারপোর্টের ভেতরে না – বাইরে বেরিয়ে এলে। এখন কোনখানে যাবে সে? চেনাজানা দু-চারজন আছে অবশ্য এই শহরে, তাদের বাড়িঘরে গিয়ে দু-একবেলা থাকলেও সমস্যা নেই, কিন্তু বিমানবন্দরে তাকে তারা নিতে আসবে কোন দুঃখে? গ্রাম থেকেই বা আসবে কে? তার বড় দুই ভাই পুরোপুরি কামলা মানুষ, বিশ্ব এজতেমায় তাদের ঢাকা শহরে আনা সম্ভব, আনা সম্ভব বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখাতে, কিন্তু ভাইকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বিমানবন্দরে তারা কখনো আসবে না। সঙ্গী যে কয়জন ছিল, এয়ারপোর্টে নামতে না নামতেই তারা তাদের আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর সে আস্তে আস্তে তার দুইখানা স্যুটকেস, একখানা ব্যাগ নিয়ে এগোতে শুরু করল পথের দিকে – বেবিস্কুটার নেবে, কল্যাণপুরের মেসে যাবে – যেখানে রবিরা থাকে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ফুটপাত দিয়ে মোড়ে এসেছে – তারপরই ঘটনাটা ঘটল। দুজন কালো ট্যাক্সিক্যাবওয়ালা তাকে নিয়ে ‘কই যাবেন, আসেন, আসেন’ বলে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিলো। তখন কোন স্যুটকেস বাদ দিয়ে সে কোনটা রাখে? কোনটাকে আটকায়? ‘না, না, যামু না…’ বলতে বলতে একবার একটাকে, আরেকবার অন্যটাকে টান দিয়ে কাছে টানে সে, কিন্তু ততক্ষণে আরেকটা আবার ক্যাবওয়ালা প্রায় দখল করে নেয়। সে উঠুক বা না উঠুক, স্যুটকেসগুলো ক্যাবে তোলার আগ্রহই বেশি তাদের। স্যুটকেস টানতে টানতে তারা বলে চলে, আসেন, আসেন ভাই, আপনেই পয়লা খ্যাপ, কম রাখুমনে – আসেন, আসেন…। সেই কম যে কত কম হবে, তা তাদের টানের জোর থেকেই জিয়াদ বুঝতে থাকে। আরো বুঝতে থাকে, স্যুটকেস দুটো যদি দুই ক্যাবে ওঠে, তাহলে অন্তত একটার আর হদিস থাকবে না।

গার্মেন্টসের মেয়েরা তখন সাতসকালের নিস্তব্ধতা সরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে কারখানার দিকে। তাদের বেশিরভাগই থাকে কারখানার কাছাকাছি বস্তিগুলোয়, যাতে রিকশা বা বাসভাড়া বেঁচে যায়, পা চালিয়েই কাজে যাওয়া যায়। সাজেদারাও সেই দলের মানুষ, হেঁটে হেঁটে কারখানাতে যায়। তবে তাদের মধ্যে মুন্নীর মায়াদয়া একটু বেশি। টানাহেঁচড়া দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং চড়া গলায় বলে, স্যুটকেইস ধইরা টান পারতাছেন – ছিনতাই কইরবার চান নাহি?

হে, আপা, দ্যাহেন না, টানাটানি শুরু কইরছে – কইতেছি যামু না, যামু না, হ্যারপরও – জিয়াদ ধড়ে প্রাণ ফিরে পায়। ছেলে হোক মেয়ে হোক, অন্তত একজন ঘটনাটা নজরে নিয়েছে, এটাই অনেক চার বছর পর ঢাকায় ফেরা জিয়াদের কাছে।

যাইবেন না তো দুইডা স্যুটকেস নিয়া বাইর হইছেন ক্যান? ঢাকা শহর ভালো জায়গা না, জানা নাই আপনের? – মুন্নী উলটো জিয়াদকেই ঝাড়ি মারে – কোনখানে যাইবেন? এই যে ভাই, ছাড়েন তো আপনেরা –

অতএব সাজেদাদের চার-পাঁচ মিনিট সময় নষ্ট হয়। মুন্নী বেবিস্কুটার ডেকে দরদাম মিটিয়ে তুলে দেয় স্যুটকেসওয়ালা বিদেশফেরতা জিয়াদকে। তারা কারখানায় ঢোকে। কারখানার গেট বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। বাইরের পৃথিবীতে কী হয়, তা তাদের আর জানা হয় না। এমনকি বাইরে এলেও না। বাইরে থেকে বাসায় ফিরে সে বারেকের জন্য রান্না করে। বারেক কেবল ঘামে, ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফেরে আর বাড়ি ফিরেই ভাতের থালা টান মেরে নিয়ে বসে পড়ে। তাছাড়া তখন তো মাজেদা গ্রামেই থাকে। অথবা, ঢাকাতেই কি ছিল মাজেদা? আর সে ছিল গ্রামে, শহর থেকে দূরের গ্রামে। মা-বাবার সঙ্গে, কয়েকটা ঘাসফুলের সঙ্গে, কয়েকটা প্রজাপতির সঙ্গে। কিন্তু প্রজাপতি সব গুটিপোকা হয়ে যায়, ঘাসফুল এলোমেলো হয়ে যায় আর তার মাজেদাকে মনে পড়ে। তার মাজেদার কাছে চলে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে, ভাতঘ্রাণ নাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে, কচুশাকের পিঠালু খেয়ে ঘরের ডোয়ায় ঠেস দিয়ে তেঁতুলগাছের ভূতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে জাগে। এই তো, এইটুকুই – আর কিছু তো নয়। কিন্তু তারপরও বারেকের সঙ্গে তার ঠিক মেলে না, ভেতর-বাইরের এ-জগৎ এত ক্ষুদ্র, তারপরও সে-জগতেও সে আলাদা হয়ে পড়তে থাকে। আর মুন্নী একদিন তার ঘরে এসে বারেকের সামনেই তাকে চড়থাপ্পড় মারতে থাকে। একদিন মানে ‘হাতুড় বাটাল বাইশখান/ চোরে নিলো তিনখানের’ সেইদিন রাত ১১টায়। শান্ত-সুবোধ মুন্নী, জামাইয়ের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে – সাজেদা তাকে দোষ দিতে পারে না। কিন্তু তারই বা দোষ কোথায়? কী দোষ আকালেও যদি সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নতুন করে? সে তো জানতোই, জিয়াদের সঙ্গে মুন্নী মেলামেশা করছে – জিয়াদ পাত্রী দেখা বাদ দিয়েছে, কিন্তু তারপরও কোন ভূত যে চড়ে বসেছিল তার ঘাড়ের ওপর! বিমানবন্দর থেকে কল্যাণপুর হয়ে গ্রামে যাওয়ার আগেই জিয়াদ মোবাইল ফোন কিনেছিল আর ফোন করেছিল মুন্নীর কাছে – বেবিস্কুটারে চড়ার আগে যে নাম্বার সে লিখে নিয়েছিল বলপেন দিয়ে একটা ম্যাচবক্সের ওপরে। খালি নিজের নাম্বারই না – সাজেদার নাম্বারও; মুন্নীর মোবাইল তো বন্ধও থাকতে পারে! কতজনের কত মোবাইল নাম্বার এখন আশপাশে গড়াগড়ি খায়, গাঁটের পয়সা খরচ করে কে আর বেহুদা কথাবার্তা বলে – জিয়াদকে মোবাইল নাম্বার লিখে নিতে দেখে এরকমই ভেবেছিল সে। অথবা সেরকমও ভাবেনি। মাথা তার ঘুরছিল। জীবন তার ধূসর হচ্ছে তখন, গ্রামে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে বারেককে ঘরে তোলার পরের মাসেই। বারেক খালি ঘামে, ঘরে এসেই ভাতের থালা টান মেরে নিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। আর ভাত না পেলে তার চুল ধরে টান মেরে শরীরটাকে হাতের নাগালে নিয়ে পেটাতে থাকে। এভাবেই একদিন মৃত্যু আসবে, জানা ছিল তার। এভাবেই মেয়েরা মরে, জানা ছিল তার। মার খেতে খেতেই একদিন তার মতো মেয়েদের পেটে সন্তান আসে, তারপরও তারা মার খেয়ে চলে, তারপরও তাদের ছেলেমেয়ে বড় হয়, অথবা তারা বড় হওয়ার আগেই মার খেতে খেতে তার মতো মেয়েরা মরে যায় টুপ করে – জন্ম নেওয়া মানে তো আসলে একটা চক্রবৃদ্ধি সুদ-আসলের খাতা খুলে বসা – এমন এক খাতা যে একবার খুললে হিসাব রাখারও কোনো দায় থাকে না, আপন নিয়মেই চক্রবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। মুন্নীর চড়থাপ্পড়ে সে ব্যথা পায়নি, তবে মুন্নীর ক্ষতিপূরণ করতে বারেক একটুও দেরি করে নাই। যত না চড়থাপ্পড় দিয়েছিল, তারও বেশি তারস্বরে মুন্নী যা যা বলেছিল বারেক তা মনে গেঁথে নিয়েছিল এবং মুনণী চলে যাওয়ার আগেই চুলের মুঠি ধরে কব্জা করে নিয়েছিল তাকে। মুখে কোনো গালি দেয় নাই বারেক, একটা কথাও বের করে নাই পেটের মধ্যে থেকে। অবশ্য বরাবরই তাই করে সে মারার সময়, চুপচাপ, যেন সাদামাটা কোনো ঘটনা ঘটাচ্ছে, একটা কাপড় কেচে বউয়ের কষ্ট কমাচ্ছে, কাপড়ের মধ্যে কী আছে সেটা নিয়ে তার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই – তবু শান্তশিষ্ট মুন্নী তাকে তারস্বরে উৎসাহ দিচ্ছিল, মারেন, আপনে অক মাইরা ফ্যালান। খানকি মাগি, ভাতার আছে না তোর? হেরপরও নাং খুঁজিস? খাউজানি থামে না? ভাতার তর খাউজানি থামায় না? হেরপরও নাং খুঁজিস?

তারপর মুন্নীর সঙ্গে সাজেদার আর দেখা হয় না। জানে না, মুন্নী এখনো প্রতি মাসে বাড়ি যায় কি-না আর নিয়ে আসে কি-না তেঁতুলের নতুন আচার। জানে না, শহরে আসার পরও কয়েকদিন তার চোখদুটো বাড়ির জন্যে দুশ্চিন্তায় ফোলা ফোলা থাকে কি-না আর সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যে সে কাজের ফাঁকেও লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে ফোন করে কি-না। বারেকের না, বস্তির ঘরটা তারই ভাড়া করা – তারপরও তখন সেখানে সে আর থাকে কী করে! আর এখানে না থাকলে এখানকার কারখানায়ই বা কাজ করবে কেমন করে! অথচ মাসের ১৪ দিন পেরিয়ে গেছে, আগের মাসের বেতন পেয়েছে মাস শুরু হওয়ার ১১ দিনের মাথায়। চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে কোনো লাভ নেই, তাতে বরং পুরো মাস খাটতে হবে, কিন্তু বেতন আর পাওয়া যাবে না পরের মাসে। এয়ারপোর্টের দিক থেকে সে চলে এসেছিল শ্যামলীর দিকে। আর শুনেছিল কয়দিন পরে, মুন্নী এখন তার – না, তার তো না, – বারেকের ঘরে থাকে। প্রেমিককে হারানোর শোধ নিচ্ছে, অথবা শূন্যতা তার পছন্দ নয় আগের মতোই। মাস তিনেক বেতন আটকে থাকুক কিংবা দুই বেলা খাওয়া না থাকুক, শূন্যতা অসহ্য মুন্নীর। সাজেদা জানে, বারেকের সঙ্গে থাকতে শুরু করলেও মুন্নী ঠিকই দেখা হলে তার সঙ্গে কথা বলবে, একসঙ্গে এককাপ চা খেতে চাইবে আর উচ্চস্বরে বলবে, ‘দুনিয়াডা কী সুন্দর রে সাজেদা!’

সুনদর লাগে, এই দুনিয়াকে মুন্নীর কাছে কত সুন্দর লাগে! দুনিয়ায় কত কী ঘটছে জানা নেই সাজেদার, কিন্তু তার নিজের কিংবা পরিচিত দু-চারজনের কত কী ঘটছে তার ছিটেফোঁটা অন্তত জানা তো আছে – তাহলে কী করে সে মেনে নেয় মুন্নীর কথাকে! অথচ পরিচিত হওয়ার দিন থেকেই সাজেদা মুন্নীর কাছ থেকে শুনে আসছে, পৃথিবীটা নাকি কত সুন্দর! সুন্দর দুনিয়ার কীইবা দেখেছে মুন্নী – ছিল তো সেই উত্তরের পঞ্চগড়ের কোন দুনিয়াছাড়া গ্রামে, শ্যালোভ্যানে করে পাকা রাস্তায় উঠে টাউনে গিয়ে তারপর ঢাকায় আসতে দেড় দিন লাগত তখন, এখন নাকি যমুনায় ব্রিজ হয়েছে, গাড়িঘোড়া বেড়েছে – এখন হয়তো একদিনেই পারে। বস্তির এইসব ঘরকেই যার সুন্দর লাগে, কী হতচ্ছাড়া ঘরেই না সে থাকত তাহলে সেই দুনিয়াছাড়া গ্রামে! কিন্তু সাজেদা অল্প হলেও জানে, পৃথিবীর সৌন্দর্য আসলে কোথায় – মানুষ কত সুন্দরভাবে থাকে সেইসব জায়গায়। বালি উঠতে থাকা এই ঘরটাকে সুন্দর করে রাখতে সে হিমশিম খায় আর যতবারই ঘরটাকে পরিষ্কার করতে যায়, ততবারই মায়ের ওপর রেগে যায় মনে মনে, কেন যে মা তাকে সেই বছরসাতেক বয়সে ভার্সিটির এক টিচারের বাসায় কাজে লাগিয়েছিল! টিচারদের বাসায় আলাদা সার্ভেন্টরুম আছে – কিন্তু সেটা টিচারের ছেলেমেয়ে কিংবা আত্মীয়স্বজনই দখল করে রাখে বারো মাস, আর তাই কাজের মানুষকে থাকতে হয় রান্নাঘর না-হয় স্টোররুমের মেঝের ওপর। কিন্তু তারপরও কী যে আরাম সেসব বাসায়। পানি তোলার আর পানিভর্তি বালতি টানাটানি করার কষ্ট নেই, ঘর মোছায়ও কত শান্তি! তাকে থাকতে হতো রান্নাঘরের মেঝের ওপর; কিন্তু সেই মেঝেও কত সুন্দর ছিল এই মেঝের চেয়ে! অথচ মুন্নী পৃথিবীর সবখানেই সৌন্দর্য দেখে, বারেকের কাছ থেকেও নিশ্চয়ই সে তা খুঁজে পেয়েছে! যেমন সেও হয়তো পেয়েছিল, কিন্তু দিনে দিনে সে-সৌন্দর্য বারেকই হয়তো হারিয়ে ফেলেছে, হয়তো ঘষে-ঘষে তুলে ফেলেছে। বারেকের সঙ্গে তার কি আর দেখা হবে! কিংবা মুন্নীর সঙ্গে! আর কিইবা দরকার দেখা হওয়ার! এই তো ভালো আছে সে, এইভাবে মাজেদার সঙ্গে! আর জিয়াদের সঙ্গে থাকা – তা আর কয়দিনের! দেখতে দেখতে উড়ে গিয়েছিল ৭টা নাকি ১০টা দিন।

এইবার জিয়াদ এলে আটকে ফেলতে হবে। এবং একটা উপায়ই আছে আটকে ফেলার – ছেলেপেলে নিতে হবে। বয়স বাড়ছে তার, জিয়াদেরও তো বাড়ছে। দূরে থাকতে হয়, না হয় দূরেই থাকুক –  তাই বলে ছেলেমেয়ে থাকবে না! কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেছে, জিয়াদকে আর মোবাইলে পাওয়া যায় না। ওদিকে মাজেদাকেও না। ঘরে ফিরেই মাজেদা বাথরুমে গিয়েছিল। আর ওর দেরি হচ্ছে দেখে সাজেদা নিজেই মোবাইলটা বের করেছিল ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে। তারপর ভাঁজে-ভাঁজে মলিন হয়ে যাওয়া কাগজটা দেখতে দেখতে নাম্বার পুশ করেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, নাম্বারটা তো দেখা যাচ্ছে ফোনে সেভ করাই আছে! তা সেটা থাকতেই পারে, হয়তো সাজেদাই তাকে কোনো একসময় নাম্বারটা দিয়েছিল সেভ করে রাখতে, হয়তো জিয়াদকে বলেছিল তার মোবাইলের নেটওয়ার্কে ঝামেলা থাকলে মাজেদার মোবাইলে রিং করতে। অথবা মাজেদা নিজেই যদি সেভ করে থাকে, তাতেই বা দোষ কোথায়? কিন্তু চান্দু নামে রাখবে কেন? ‘ও রে আমার চান্দু, ও রে আমার চান্দু’ – সাজেদার মনে হয় ঘোরলাগা সেই সাত না কি দশদিন ফিরে এসেছে, জিয়াদের আদরে আদরে সে উজাড় হয়ে যাচ্ছে, বিরান হয়ে যাচ্ছে, পোড়োজমি হয়ে যাচ্ছে, উন্মূল হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু আবার ফিরে আসছে ঝিরিঝিরি বর্ষার মৌসুম, ফিরে আসছে সবুজ-শ্যামল, ফিরে আসছে রৌদ্রের উজ্জ্বলতা, ফিরে আসছে মৃত্তিকার অন্ধকারে আকাল নিংড়ে আনা জল। সেই কি চান্দু জিয়াদের, নাকি জিয়াদও চান্দু কোনো এক দুর্বল মুহূর্তের তীব্র আকুলতায়! নাকি সব কিছু পালটে গেছে? আর তাই সে আর চান্দু নয় জিয়াদের কাছে, জিয়াদও সেই কবে থেকে আর চান্দু বলে ডাকে না তাকে! দুর্বোধ্য এক অস্বস্তি নিয়ে, বিবর্ণতা নিয়ে নিজের অজান্তেই সে রিং করে বসেছিল, আর দুই-একবার রিং হতে না হতেই সেটি কেটে গিয়েছিল ঠিক দুমাস আগের দিনগুলোর মতো। তখন আবারো কি একটু আলো, একটু আশা ফুটে উঠেছিল তার মনের কোনোখানে? ফোন আর কাগজটা হাতে নিয়ে সে আবারো মিলিয়ে দেখছিল, নাম্বারটা ঠিক আছে কি-না – আর ঠিকই যদি থাকে, তাহলে কেটে গেল কেন। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠেছিল – চানদু, চান্দু ফোন করেছে! আবারও সেই দুর্বোধ্য অস্বস্তি ও বিবর্ণতা ভিড় করেছিল, তবু সে ফোন ধরেছিল আর শুনতে পেয়েছিল, কী গো সোনা, তুমি না কইলা বাসায় ঢুইকতেছো? আবার কল কইরছো সোনা – কোনখান থিক্যা?

সাজেদা উত্তর দেয় না, মোবাইলটা কানের কাছে নিয়ে বসেই থাকে। এই কণ্ঠস্বর তার কত চেনা, কিন্তু সে এখন তার সঙ্গে নয়, কথা বলছে অন্য কারো সঙ্গে। হয়তো মাজেদার সঙ্গে, হয়তো অন্য কারো সঙ্গে; কিন্তু যার সঙ্গেই হোক না কেন, যা বলছে তা তো আর তার সঙ্গে নয় – যদিও তার জানা আছে কী বলে সে, কেমন করে বলে। সে আস্তে করে মোবাইলটা কান থেকে হাতের তালুতে নিয়ে লাইন কেটে দেয়। একটা টিকটিকি নিঃশব্দে চলে যায় মাথার ছাদ বরাবর। কিন্তু তাতে কোনো কিছু যায়-আসে না। সাজেদা চুপচাপ বসেই থাকে। হয়তো আরো একটি রিকশা নর্থ রোড থেকে হাতিরপুলের দিকে চলে যায়, একটা ইঁদুর প্যাডেলের দিকে লাফিয়ে ওঠে বিদ্যুৎ চলে গেলে আর ভয় পেয়ে রিকশাওয়ালা চিৎকার করে গালি দেয়, কুত্তার বাচ্চা…। কিন্তু সে চুপচাপ বসে থাকে। চোখ তুলে দেখতেও ইচ্ছে করে না বাথরুম থেকে বেরোনো ভয়ার্ত নিষ্প্রভ মাজেদাকে তাকিয়ে দেখতে। এবং কী আশ্চর্য, গালি দিতেও একদম মন চায় না। এখন, এখান থেকে সে বেরিয়ে যেতে পারে এবং বেরিয়ে যাওয়াই উচিত ঠিক সেইদিনের মতো, বারেকের কাছ থেকে চলে আসার দিনের মতো, বারেক আর মুন্নীর সামনে দিয়ে বিধ্বস্ত সেই রৌদ্রের ঢেউয়ের মতো। চলে তো সে যেতেই পারে, কিন্তু মাজেদা একা-একা থাকবে কেমন করে! সে তাই বসে থাকে চুপচাপ। আজ যেন কী রান্না করা হয়েছিল, মুলার শাকের সঙ্গে ইচা মাছ বোধহয়। ঠিক ছোটবেলায় ডোবা থেকে তিনকোনা জাল দিয়ে তুলে আনা ইচা মাছ। অনেকদিন পর সেরকম ইচা মাছ সে পেয়েছিল পুকুরপাড়ের রাস্তার পাশে বসা মাছবাজারে। সে কি মাজেদাকে খেয়ে নিতে বলবে? বর্ষার পানি সরে বেরিয়ে আসা কাদার মতো থকথকে দ্বিধা তাকে স্থবির করে রাখে। মনে হয় অন্ধকার নেমে এলে তারা দুজনেই রক্ষা পাবে, বেঁচে যাবে – কিন্তু মরার লোডশেডিং অন্য সময় যখন-তখন হলেও এখন এত প্রার্থনার পরও হয় না! টিমটিমিয়ে বিদ্যুৎবাতিটা জ্বলতে থাকে, মুখ ঘুরিয়ে ভয়ার্ত নিষ্প্রভ মাজেদা মাদুরেপাতা বিছানায় শুয়ে পড়ে। আজ আর কারো খাওয়া হলো না, মুলোর শাক দিয়ে রান্না করা ইচা মাছ আর খাওয়া হলো না। তবু সে মাজেদাকে কিছু বলে না এবং অতর্কিতে উঠে দাঁড়িয়ে লাইট অফ করে দেয় অন্ধকারে ডুবে যাবে বলে। তখন কী এক স্বস্তি, প্রবল স্বস্তি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে  অতলান্তে; তাকে অথবা মাজেদাকে, অথবা তাদের দুজনকেই। তবু মনে হয় না বেঁচে থাকার মতো সামান্য আস্বাদ লেগে আছে সেই স্বস্তির সঙ্গে। অন্ধকার উগড়ে দিচ্ছে বীভৎস গরম, ঝুরঝুরে বালি মেঝের গা থেকে ঝরে পড়ছে। মেঝের গা থেকেই তো! না কি ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে এখনো তার গায়ের ওপর! কবে থেকে তার দম কেবলই বন্ধ হয়ে আসছে। আর মাঝেমধ্যে ঘরঘরে কিসের আওয়াজ লুপ্ত করে ফেলছে সবটুকু অনুভূতিকে। বোধহয় কেউ দেয়াল ফুটো করছে! একটা ইট খসে পড়ল কোথা থেকে ঠিক তার পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপরে। বিবর্ণ আতঙ্ক নিয়ে চিৎকার দিতে দিতে সে খোঁজার চেষ্টা করে মানুষের সামান্য কথা, টুকরো কথা। এইভাবে সে এখানে কতদিন হলো বসে আছে ফুল হাতে জিয়াদ আসবে বলে। জিয়াদ, নাকি বারেক? কিছুই আর মনে পড়ে না। পা জোড়া কিছুতেই নড়াতে পারে না সে। অথচ কী আশ্চর্য, সকালেও তো সে ভালোভাবেই হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড থেকে কারখানায় এসেছিল। এখন মনে হচ্ছে, তার পা দুটোকে প্রচন্ড ভারি কিছু চেপে ধরেছে। ভ্যাপসা পচা গন্ধ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। কাল সে দুহাতে প্রস্রাব ধরে গলা ভিজিয়েছিল, কিন্তু প্রতিদিন প্রস্রাব হবে কেন যদি সে একটু পানিও না খেতে পারে? আহ্, কবে যেন মুলাশাক দিয়ে ইচা মাছ রান্না করা হয়েছিল, আর এখন একটু পানিও নেই কোনোখানে। নাকি পানি খেয়েছিল, কিন্তু কোয়ালিটি ইন্সপেক্টরের গালিগালাজ শুনতে শুনতে শুধু শুধু গলা তার শুকিয়ে আসছে! সে তার সেলাইকলটিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আবারও কোনো লোহার রডে খোঁচা লেগে কঁকিয়ে ওঠে। বোধহয় তার পায়ের মাংসে পচন ধরছে আজ; আর শুধু পায়ে নয়, বোধহয় মুখেও পচন ধরছে এখন। কিন্তু আজ সকালেও তো অবস্থা এরকম ছিল না! আজ অথবা গতকাল, অথবা তারও আগে একদিন – নাকি আরও আগের কথা সেসব! মাল তাড়াতাড়ি সাপ্লাই দিতে হবে, শিপিং করতে হবে, কাজের প্রচন্ড তাড়া ছিল তাই। কিন্তু তবু সে ভেতরে ঢুকতে চায়নি একটু আগেই বিল্ডিংটা কেঁপে উঠেছিল জানতে পেরে। কিন্তু কী ভয়ানক গালিগালাজ শুরু করল গার্মেন্টসের ম্যানেজারটা – বাববা রে বাবা, মুখে আনা যায় না। কথা বলেই পেট বাধিয়ে দেবে, এমন অবস্থা! অতএব সে কাজে গিয়েছিল বন্দি এক রাজকন্যার মতো – যে কার্পেটের গায়ে সুইসুতো দিয়ে লিখেছিল নিজের বন্দিত্বের গল্প। মা-ই তো শুনিয়েছিল তাকে ওই গল্প? কী যেন সেই গল্প! চোখ বুজে গল্পটি সে মনে করার চেষ্টা করে – এক ছিল রাজকন্যা, কিন্তু একদিন বেড়াতে বেরোনোর পর তাকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল সওদাগরে। বন্দি রাজকন্যা সওদাগরকে বলেছিল, আমি তো ঘরেই বসে থাকি, আমাকে কিছু সুতো এনে দাও, আমি খুব ভালো কার্পেট বুনতে পারি। তারপর যেন কী! এবার ঈদে মার কাছে থেকে আবারো শুনতে হবে। আর মাকে কালই টাকা পাঠাতে হবে। এ মাসেও মাজেদা টাকা দিতে পারবে না। না কি সাজেদা? কে যেন চলে গেছে তার ঘর থেকে? সে যেন কে?! সাজেদা? নাকি মাজেদা? নাকি মুন্নী?

সে নিজেকে আর খুঁজে পায় না ধসেপড়া ভবনের তলদেশে। নামহীন হয়ে যায়, অভিন্ন হয়ে যায়, অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায়। শুধু একটা ইঁদুর এসে ঠক করে পচনধরা তার পায়ে ঠক করে কামড় বসালে ক্ষীণ হয়ে আসা চিৎকার তুলে জানিয়ে দেয়, পৃথিবীটা কত সুন্দর!