গঙ্গা : জাল-জল ও জেলে-জীবনের গৃহস্থালি

মঈন শেখ

বাংলা সাহিত্যের জমিন সরস করেছে নদী। গানে, গল্পে, কবিতা, উপন্যাসে, সবখানে নদীর আধিপত্য সবার আগে। নদীর উপস্থিতি যতটা মনে ততটা মননে। উপমা, উপমান কিংবা সরাসরি নদী আর বাংলা একাকার। তাছাড়া বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নদী যতটা জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, অন্য কোথাও তা হয়তো নেই। আর এ কারণে বাঙালির প্রতিটি ক্ষেত্র অর্থাৎ, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নগর-জনপদ গড়ে উঠতে নদী বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই সংগতভাবেই প্রত্যেক সাহিত্যিকের লেখনীতেও কোনো না কোনোভাবে এসেছে নদীকথন। এর পাড়, বালুচর, জেলে এমনকি বধূর কলসিতে জল তোলার দৃশ্যও বাদ পড়েনি সাহিত্য-বুননে।

বাংলা সাহিত্যে নদী-জীবনকেন্দ্রিক যেসব উপন্যাস প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, সমরেশ বসুর গঙ্গা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতি এবং হুমায়ুন কবীরের নদী ও নারী। অবশ্য ইছামতি নদীপারের জীবনকেন্দ্রিক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য। এখানে তৎকালীন সময়ের নদী আর নদীপারের জীবন একাকার। যতটা সামাজিক ততটা রাজনৈতিক। নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে বহুল পঠিত ও প্রচারিত উপন্যাস হলো পদ্মানদীর মাঝি। পঠিতের চাইতে বেশি প্রচারিত হলো তিতাস একটি নদীর নাম। এখানে তিতাসই মুখ্য। প্রধান চরিত্রও বটে। এরপর আসে গঙ্গা উপন্যাসের নাম। অথচ বোদ্ধা পাঠক মহলে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত গঙ্গা। নদীর পটভূমি বা নদীকেন্দ্রিক বাসিন্দাদের নিয়ে যতগুলো উপন্যাস রচিত হয়েছে তাতে গঙ্গার আসন সবার ওপরে। অবশ্য এর গুরুত্ব যতটা না কাহিনিতে তার অধিক পটভূমিতে। কাহিনি হয়তো অতটা জমাট বাঁধতে পারেনি। তবে এর আখ্যান যাদের জীবন নিয়ে নির্মিত, তা ফাঁকফোকরহীন। এত নিখুঁত, নিটোল আর জলের সঙ্গে মানুষের এমন গভীর সংগ্রাম অন্য কোনো নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে দেখা যায় না। অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত খানিকটা এরকম। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে তাঁর লেখনী থেকে এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করা হয়তো সমীচীন হবে। কারণ এখানে আছে গঙ্গার পাশাপাশি আরো দুটি উপন্যাসের তুলনা। তিনি বলেছেন –

জলের সঙ্গে মানুষের এই সংগ্রাম, এই মধুর প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র পাই না আমরা অন্য কোনো নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে, অন্তত এমনি করে। তিতাসকে অবলম্বন করেও মানুষ হিসেবে হয়তো বেঁচে ওঠা যায় অন্তত তার প্রমাণ, কিন্তু সেই কল্পবীজ এ উপন্যাসে শাখায়িত হতে পারেনি। হোসেন মিয়া ময়নামতীর দ্বীপে পদ্মার প্রতিস্পর্ধী এক জনবসতি গড়ে তুলতে চেয়েছে, কিন্তু তার সে প্রয়াসও রহস্যময় থেকে গিয়েছে। কিন্তু গঙ্গার বুকে মালো পরিবারের মাছমারা ছেলে সমুদ্রের স্বপ্ন এমনভাবে লালন করেছে মনের মধ্যে, প্রতিহত করা যায়নি তাকে। গঙ্গাকে এভাবে পেরিয়ে যেতে পারে বলেই গঙ্গা এই জাতীয় উপন্যাসগুলির মধ্যে স্বতন্ত্র। (গঙ্গা : একটি সমীক্ষণ, মৌসুমী প্রকাশ, আগস্ট ২০১১-এর ভূমিকা)

আলোচনার শুরুতে এমন উদ্ধৃতি দিলাম এই জন্য যে, পাঠকের সহজ হবে গঙ্গাকে স্বতন্ত্র ভাবতে। বুঝতে সমর্থ হবেন, সমরেশ বসু জনজীবনের শিল্পী হিসেবে কতটা সার্থক। যদিও গঙ্গা উপন্যাস রচনার আগেই সমরেশ বসু আমাদের কাছে জনজীবনের কথাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যেমন উত্তরবঙ্গ (১৯৫১), নয়নপুরের মাটি (১৯৫২) এবং পরের দু-বছরে প্রকাশিত বি টি রোডের ধারে ও শ্রীমতী কাফে এই খেতাবের জন্য যথেষ্ট ছিল। দেশ, সমকাল, মাটির মানুষের সজীব ও উষ্ণ ছোঁয়ায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিল এই চারটি উপন্যাস। আর ১৯৫৫ সালে শারদীয় পত্রিকায় গঙ্গা প্রকাশিত হলে হইচই পড়ে যায় সাহিত্যপাড়ায়। প্রমথ সেনগুপ্ত ‘অমৃতসন্ধানীর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য’ শিরোনামে এক স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘গঙ্গা, সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসমালার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় রচনা।’ জনপ্রিয়তার কারণ হতে পারে, এত কাছে থেকে দেখা নদী-জীবনের রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত রূপময়তা। আর সমরেশ বসু বলেই হয়তো তা এত করে সম্ভব হয়েছে। কারণ জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর মেলামেশা অনেক দিনের; ‘আদাব’ গল্পে আমরা যার চিহ্ন দেখেছি অনেক আগেই। তিনি কতটা সাধারণ জীবনের কাছাকাছি ছিলেন তা স্পষ্ট করা যেতে পারে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের লেখনী দিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘সমরেশ বসুর জীবন নিয়ে আর বেশি কী বলার আছে? মাত্র বাইশ বছর বয়সে ‘আদাব’ গল্প লিখে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে এত অসাধারণ একটা গল্প একজন বস্তিবাসী, আধা-শ্রমিক মানুষের হাত দিয়ে কী করে বেরোলো কে জানে! দুই সম্প্রদায় সম্পর্কেই কী নির্মোহ, কিন্তু সহানুভূতিতে দ্রব মনোভাব।’ (সমরেশ বসু : ‘জীবনযুক্ত মুক্তপুরুষ’; সমরেশ স্মৃতি; ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ)। এই যে ‘বস্তিবাসী আর আধা-শ্রমিক’, এটিই সমরেশ বসুর লেখক জীবনের বাস্তবতার বাস্তবতা। সাধারণ মানুষের জীবনের খুব কাছাকাছি যাওয়ার বাস্তবতা। সমরেশ বসু যা লিখেছেন তা কাছে থেকেই লিখেছেন। ছায়া দেখে নয়, কায়া দেখে। গঙ্গার পটভূমি রচনার পেছনেও তাই রয়েছে আরেক পটভূমি। আতাপুরে থাকার সময়ে মালোপাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে লেখক মাছ ধরতে যেতেন। কখনো বর্ষার পুরো মৌসুম ধীবর বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরেছেন গঙ্গায়। তিনি দেখেছেন তাদের হাসি-কান্না, ক্ষোভ, অভিমান, টানাপড়েন, ধার-দেনা, সুদ আর তা পরিশোধের নির্মম বাস্তবতা। তিনি দেখেছেন জাল, জল ও জেলে-জীবনের গৃহস্থালি। আর আমরা পেয়েছি গঙ্গা। সমরেশ বসু গঙ্গা উপন্যাসের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন জেলেপাড়ার সেসব বন্ধুর ঋণ। তিনি যাদের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের কয়েকজনের নাম হলো – ‘আতাপুরের মালোপাড়ার কার্তিক দাস, পরেশ দাস এবং হালিশহরের নিমাই অধিকারী ও তাঁর পিতা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। এঁদের সঙ্গে অনেক দিন ও রাত্রি আমার কেটেছে গঙ্গার বুকে। এঁদের সাহায্য ছাড়া ‘গঙ্গা’ রচনা সম্ভব ছিল না।’ লেখকের এই সরল স্বীকার আর ঋণ আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় রচকের দায়বদ্ধতার প্রতি। লেখকসত্তায় কত বেশি সৎ থাকলে একজন লেখক তাঁর কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করবার জন্য এতটা শ্রম দিতে পারেন, তা আমাদের কাছে বিস্ময়। সমরেশ বসুর গঙ্গা-ক্ষেত্র প্রস্ত্ততির অনেকটাই উন্মোচন করেছেন হালিশহরের রামপ্রসাদ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক নিমাই চাঁদ অধিকারী। তিনি সমরেশ বসু : স্মরণ সমীক্ষণ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল – ‘সমরেশ দার গঙ্গা ও আমরা’। এখানে তিনি আলোচনা করেছেন, লেখক কীভাবে গঙ্গা-মাল্য নির্মাণের মণিমুক্তা সংগ্রহ করেছেন। কীভাবে হাজারো প্রশ্নবাণে চার-পাঁচ বছর ধরে জর্জরিত করেছেন তাঁদের। সমরেশ বসু একটা সত্যও উদ্ঘাটন করেছেন বটে; যা স্পষ্ট হয় নিমাই চাঁদের কথায় – ‘মাছধরাদের একটা নিজস্ব ভাষা (Technical words) আছে, আমি তা খেয়াল করিনি।… পেশার সাথে ভাষার এত মিল সমরেশদার প্রশ্ন করার আগে পর্যন্ত, সত্যি কথা বলতে কী, বুঝিনি। ‘গঙ্গা’ বইয়ে সেই সব শব্দের কিছু প্রতিফলন হয়েছে।’ হয়তো সেই কারণেই, পদ্মানদীর মাঝি ও গঙ্গার পটভূমি এক হলেও চরিত্র-চিত্রণ, ভাষা, কথোপকথন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মোটকথা সবকিছু উপস্থাপনার গুণে উপন্যাস দুটির অবস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে যোজন যোজন দূরে। গঙ্গা উপন্যাসের সার্থকতা এখানেই। সার্থক সমরেশ বসু। আসলে একজন মহৎ শিল্পী যখন বিশেষ কিছু রচনার জন্য একটি জনপদ বা একটি সম্প্রদায়কে বেছে নেন, তখন তিনি তার আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। পার্ল এস বাক গুড আর্থ (THE GOOD EARTH) রচনার পূর্বে দীর্ঘদিন চীনে গিয়ে বাস করেন। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলেও ধর্মপ্রচারক বাবা-মায়ের সুবাদে বাকের শৈশব ও কৈশোরের সতেরো বছর কাটে চীনে। ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে তাঁর প্রথম ভাষা হয় চীনা ভাষা। মাঝের কিছু সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটালেও পরবর্তী সময়ে আবার ফিরে আসেন চীনে। সিংকিয়াংয়ের চীনা পরিবেশে থেকেই তিনি নিবিড় হয়ে ওঠেন চীনের সনাতন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, প্রচলিত জীবনধারা আর হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা ভরা ঘাত-প্রতিঘাতের পারিবারিক জীবনের সঙ্গে। বাক চৈনিক সমাজের এই জীবনপ্রবাহকে শিল্পীমনের গভীর ব্যঞ্জনা, অভিজ্ঞতা আর কল্পনার ছোঁয়ায় মূর্ত করে তোলেন গুড আর্থে। মাটি যাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাদেরই একজনের জীবন-প্রবাহের আবর্তনে নির্মিত গুড আর্থ। সঙ্গে আছে আরো ঘটনাপ্রবাহ ও আরো মানুষের সমাগম। নগণ্য চাষি ওলাঙ লাঙ এই আবর্তের মধ্যিখানে সর্বসহা। করুণাময়ী মৃত্তিকা আর ওলাঙ লাঙের মাঝখানে সবসময় ছিল বহু বাধা – বন্যা, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব। মোটকথা পূর্বপ্রস্ত্ততি আর বিশেষ লক্ষ্য ছাড়া এই মহৎ সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়। আর সম্ভব হয়েছে বলেই জয় করেছেন পুলিট্জার আর নোবেল পুরস্কার। জয় করেছেন বিশ্ব। পার্ল এস বাকের গুড আর্থকে টানলাম কারণ, একই মানদন্ডে গঙ্গা অনেকখানি যে পিছিয়ে আছে, তা নয়। পিছিয়ে রাখবার ক্ষেত্রের দায়ভার আমরাও (বিশেষ করে আলোচক-সমালোচক, অনুবাদকও) অনেকাংশে এড়িয়ে যেতে পারি না।

সমরেশ বসু রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত কারিগর। তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো মূলত সমাজের নিচের মানুষদের নিয়ে রচিত। গল্পগুলোর আখ্যানজুড়ে রয়েছে সেই মানুষদের টিকে থাকার সংগ্রাম। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – ‘বিষের ঝাড়’, ‘পার’, ‘রং’, ‘ছেঁড়া তমসুক’, ‘পসারিণী’সহ আরো অনেক। এই ধারায় গঙ্গা হলো একটি মহীরুহ। গঙ্গা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়গুলো সবার আগে আসে, তা হলো এর পটভূমি,  চরিত্রগুলোর স্বাভাবিক বিচরণ, ঘটনার উপস্থাপন আর বাস্তবতার উপযোগিতায় ভাষার প্রয়োগ।

গঙ্গার পটভূমি একটাই, জল-জাল-জেলে। গঙ্গা উপন্যাসের চরিত্রগুলো সামনে অতটা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়নি। পদ্মানদীর মাঝিতে যতটা উজ্জ্বল হয়ে আছে কুবের, মালা, সেতলবাবু কিংবা কপিলা। এদিক থেকে বলা চলে সমরেশ বসুর মূল বিষয় চরিত্র চিত্রণ নয়, মূল বিষয় জেলেজীবন। জেলেজীবনের সংগ্রাম চিত্রণ করতে যা যা প্রয়োজন, তা করেছেন। চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাই। এখানে মোটা দাগে যারা রয়েছে: সাইদার নিবারণ, নিবারণের ছোট ভাই পাঁচু ও ছেলে বিলাস, বশীর, সয়ারাম, পাচী (ছায়া), রসিক, দুলাল; অপরদিকে অমর্তের বউ, দামিনী, হিমি, হিমির সখী আতর, মহাজন ব্রজেন ঠাকুর প্রমুখ। আপাতদৃষ্টিতে এই উপন্যাসের    নায়ক-নায়িকা হলো বিলাস ও হিমি। কিন্তু সব চরিত্র যার ছায়া অবলম্বনে, তিনি হলো নিবারণ। সেদিক থেকে নিবারণ হলো কেন্দ্রীয় চরিত্র। নিবারণের সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তার ছেলে বিলাসের মধ্যে। নিবারণকে আমরা হারিয়েছি উপন্যাসের প্রথম ভাগেই। বৃহদার্থে হয়েছে শহিদ। ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থেকে করেছে জীবন সংগ্রাম। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেনি কখনো। এখানে নিবারণের প্রতিপক্ষ মহাজন, তার রক্তচক্ষু, কখনো নিঠুর গঙ্গা, সমুদ্র ও তার মীন। তাইতো বাটা মাছের চক তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ভাটার টানে, যেখানে চলছিল ঢেউয়ের মাতন।

গঙ্গা উপন্যাসের মূল বাস্তবতা হলো বহির্বাস্তবতা। সবকিছুই দৃশ্যত আর চিরায়ত। গঙ্গা বা সমুদ্রের জেলে মানেই ঋণী; ঋণের প্রতিনিধি। ঋণের বোঝায় নিমজ্জিত হতে হতেই তা শোধের চেষ্টা করতে হয় মরণপণ। ঘরে দেনা বাইরে দেনা। তাদের রাগ করতে নেই, অভিমান করতে নেই। ‘মাছমারারা মানুষের পরে রাগ করে না। যার পরে করে, তাকে দেখা যায় না এ সোমসারে।’ তাদের বিধাতা জেলে নৌকায় থাকে না; থাকে মহাজনের চোখ রাঙানিতে। জেলে-জীবনের বড় বাস্তবতা টিকে থাকা। তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে জানে না; পারে না। ‘সে যদি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে, জানবে সেটা ন্যায্য। সে কখনো নিজেকে ফাঁকি দেয় না। মহাজন হুতোশের উপর হুতোশ চাপায় শুধু।’ এই উপন্যাসের   অন্তর্বাস্তবতা যা আছে, তা হলো, জেলে-মনের নয়, জেলে-জীবনের।

শহর নিকটের রেললাইনের সৌন্দর্য নাকি বস্তি। বস্তি না থাকলে তা বেমানান ঠেকে। ঠিক জেলেজীবনের বীভৎস সৌন্দর্য হলো অভাব। ধারদেনায় তাদের অস্তিত্বও নিজের অজান্তে বন্ধকি হয়ে যায় মহাজনের কাছে। মীনের জীবন জলে, আর জেলের জীবনও জলে অর্থাৎ মীনে। আর এই জীবন বাঁধা থাকে এক অদৃশ্য সুতায় মহাজনের লাটাইয়ে। সে ইচ্ছা করলে টান দেয়, আবার ইচ্ছা করলে ঢিল দেয়। জেলেপাড়ায় অভাব আছে মহামারি হয়ে। অথচ কত শান্ত ও নীরব। মরণ দেবতা হানা দেয় ঘরে ঘরে। তার ভয়ংকর সংহার মূর্তি সবকিছু ভেঙে ফেলতে চায়। ভাঙতে চায় জেলে-জীবনের গেরস্থালি। সমরেশ বসুর ভাষায় –

বাপ-ছেলেয় মারামারি করছে, বউ-সোয়ামি ছাড়াছাড়ি করছে। এই না মাছমারার জীবন! এক কোটালে বাঁচে, আর এক কোটালে মরে। মাছের প্রাণের চেয়েও তার আয়ু টলোমলো।

এর পরেই আবার বলেছেন –

ঘা যখন হয়, তখন তাড়াতাড়ি হয়। দেখতে দেখতে দগদগিয়ে ওঠে। সময় লাগে শুকোতে। এখন কারুর শুকোবার ভাবনা নেই। জ্বালা জুড়োয় কেমন করে, সেই ভাবনা।

এই হলো প্রকৃত আর নিঠুর বাস্তবতা। এখানে প্রতিরোধ নেই, যা কিছু আছে তা প্রতিকার। ভবিষ্যৎ নেই, আছে শুধু বর্তমান। কঠোর বর্তমানের মোকাবিলা করতে করতেই ঝাপসা হয় অতীত। হারিয়ে ফেলে প্রতিবাদের ভাষা। যত অভিমান তার নিজের প্রতি। তার জন্মের প্রতি। কখনো কখনো ভাগ্য আর বিধাতা গুলিয়ে ফেলে। ধীবরজীবনের বিবেক বলে ওঠে –  ‘বড়ো লাঞ্ছনা গো মা। কাকে অভিশাপ দেব আমরা, ঠাহর পাচ্ছি নে। চিনি শুধু তোকে। সাংলোর সলি দিয়ে মারব নাকি তোকে।’ অবশেষে তারা দাঁড়ায় গঙ্গার মুখোমুখি। যেন অধিকার আদায়ের মৌনমিছিল। এখানে গঙ্গা মা, আর সবাই নিরুপায় সন্তান। শুরু হয় নলেন টানা। পাতা বেদিতে হত্যে দিয়ে পড়ে তারা। এই নলেন টানা অর্থাৎ আমরণ অনশন তারা ভাঙবে না, যতদিন না মা তাদের কিছু দেন। সবাই গোল হয়ে বসে হরিধ্বনি দেয়, জোয়ারের বেলা এলে নামগান করে, ধূপ পোড়ায়। চিল্লিয়ে বলে – ‘মা.. মা গো’। আবার বেদির সামনে মুখ ঘষে গ্যাঁজলা তোলে মাকে ডাকতে ডাকতে। অথচ ‘গঙ্গা চলে দুর্বোধ্য হেসে, কুলুকুলু করে।’ এখানে জেলেদের কান্না যেন কান্না নয়, উপোসী চিলের চিৎকার। আবার কখনো তারা পূজা করে ঢ্যালাপ্যালার।

জেলেদের বোধ সহজ-সরল। তারা প্রতারণা জানে না। তারা সারাক্ষণ যুদ্ধ করে জীবনের জন্য। টিকে থাকবার জন্য। এ-জীবন যে বাঁচিয়ে রাখে, সে তাদের কাছে প্রাণের ঠাকুর। মাছমারা মালোরা মানে, মাছের দেবতার নাম খোকাঠাকুর। দেবতার আকার তারা দেখেনি। নিজের হাতে মারা মাছের উতোল চোখে দেখতে পায় তাকে। তারা মাছের গোল চোখকে ভাবে খোকাঠাকুর। দেবতা ভেবে পূজা করে। কারণ তারা জানে, যখন জল দেয় তখন ডাঙাও দেয়। ধার পাওয়া যায়। ধার শোধ করা যায়। ধৃত মীনচক্ষুতে মহাজনের আশীর্বাদ যেন ঝিলমিল করে ওঠে। মাছ ধরার মৌসুমে যখন জাল ভরে মাছ উঠে আসে, তখন সুদিন ফিরে আসে জেলেপল্লীতে। অন্তত খেতে পায় পেটপুরে। খাবারে আসে বিলাস। গঙ্গা উপন্যাসে জেলেদের সুদিনের খাদ্যবিলাসের বর্ণনা এসেছে এভাবে – ‘মাছমারারা এখন ভালো খায়, একটু পিঁয়াজ কাঁচা লঙ্কাও আসে। ডেঙো ডাঁটার সঙ্গে দু-চারটে গোল আলুর শখের খাওয়াও দেখা যায়।’ এই হলো তাদের খাদ্যবিলাস। মাছমারার খাদ্য-উৎসব। তাহলে আকালের দিন তাদের কেমন, তা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। তাদের সুখ ঘাসের ডগায় জমা শিশিরের মতো। ঝলকানি বেশিক্ষণ থাকে না। প্রকৃত অর্থে তাদের তুষ্টির দিন বলে কিছু নেই এ-সংসারে। মাছ মেরে চলে তাদের জীবন। অর্থাৎ মাছের মরণেই তাদের জীবনের আশ। তারপরেও সাইদারের সাফ কথা –

প্রাণ নিয়ে কারুর সঙ্গে টানাটানি করে লাভ নেই। তুমি মাছমারা। মাছ তোমাকে সাক্ষাৎ মারে না। কিন্তু মাছেরই ঝাঁকে, তারই চলাচলের পথে, গহিন আশ্রয়ে ওঁৎ পেতে থাকে তোমার মরণ। যতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখবার, সে বাঁচিয়ে রাখবে তোমাকে। লীলা শেষ হলে সে আসবে অন্য মূর্তি ধরে।

এখানে সুদিন আর দুর্দিন চলে পাশাপাশি। চলে জীবন আর মরণও। এখানে মাছ পেলেও বিপদ না পেলেও বিপদ। দাম নামিয়ে আনে মহাজনেরা। একশ থেকে আশি, আশি থেকে পঞ্চাশ; এভাবে। মাছ পচে গন্ধ ওঠে আকাশে। অনেক সময় মাটিচাপা দিতে হয়। সুদিন হয়ে আসা তাদের সুখপাখি ইলিশ। বিধাতার এ এক প্রকাশ্য বিদ্রূপ।

এই উপন্যাসে সমরেশ বসুর বড়গুণ পাঠককে জেলেপাড়ার বাসিন্দা করে তুলবার ক্ষমতা। জেলেপাড়ার ভাষা, বিশেষ শব্দ, এমনকি উচ্চারণেও বিরক্তি নেই পাঠকের। যেন কতদিনের যোগসূত্র জেলেদের সঙ্গে, জেলেপাড়ার সঙ্গে আমাদের। তাদের সঙ্গে গলাগলি করে এসেই যেন পড়তে বসেছি এই উপন্যাস। গঙ্গা পড়তে পড়তে কখন যেন মনের মধ্যে বেজে ওঠে, আমার পূর্বপুরুষ কি জেলে ছিল? যদিও নৃ-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অমনটাই ইঙ্গিত করে। কারণ, অনেক নৃতাত্ত্বিক মনে করেন, পশুচারিক মানুষ নয় – মৎস্যজীবী মানুষই প্রথম আরম্ভ করে কৃষিকাজ। মানুষ যেখানে মাছ ধরার ভালো সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই গড়েছে স্থায়ী জনপদ। পরে এসব স্থায়ী জনপদে প্রথম আরম্ভ হতে পেরেছে কৃষিকাজ। আর বাংলাদেশের বহু অঞ্চল গঠিত হয়েছে নদীবাহিত পলিমাটি জমে। ইতিহাস বলে, এসব জায়গায় প্রথম উপনিবিষ্ট হয়েছিল মৎস্যজীবী মানুষ। হয়তো এই সূত্রতার জেরে গঙ্গার মাঝপথে যাবার আগেই আমরা বুঝতে পারি – সাংলোজাল, খুঁটলি, গড়ান, বাঁধাছাদি জাল, চলন্তাজল, মুকড়াজল, জলেঙ্গাজল, জোয়ার-ভাটা আর মরাকটাল ভরাকটালে জেলেদের মাছ মারার পদ্ধতি সম্পর্কে। জেলেপাড়ার একান্ত নিজস্ব শব্দগুলো সমরেশ বসু তাঁর শিল্পরঙে ডুবিয়ে ভদ্র সমাজের ভাষা করেছেন; করতে পেরেছেন। তাই হয়তো আমরা সহজেই বুঝতে পারি কঞ্চি কখন সলি হয়। আর এসব বুঝতে পারি সমরেশ বসুর উপস্থাপন কৌশলের কারণে। অনেকগুলোর মধ্যে থেকে একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে :

নৌকা কর পুব-পশ্চিমে আড় পাথালি। ভেসে যাও পাথালি নৌকা নিয়ে ভাটার টানে। যে আসার, সে আসবে উজান ঠেলে তোমার জালে। পড়বে এসে হাঁ-মুখে। খবর পাবে কেমন করে? জালে ঠিক মাঝখানে বাঁধা আছে সরু সুতো। তাকে বলে খুঁটলি। সেই খুঁটলি জড়ানো তোমার আঙুলে, যে আঙুলে তোমার সমস্ত মন বসে আছে। জলে তোমার ছোট চাকুন্দে মাকুন্দে পড়লেও, খবর আসবে তোমার খুঁটনিতে। যেমনি খবর পেলে, অমনি ওকোড় মারো কাছি ধরে। যত জোরে পারো। সাংলোর হাঁ বুজে যাবে কাপটি খেয়ে। দেরি নয়, টেনে তোলা। ঢিল দিলে হাঁ খুলে যেতে পারে। ওকোড় মারা হলো কাছির টান। আর এই সাংলো ফেলে পাথালি নৌকা ভেসে যাওয়াকে বলে গড়ান মারা।

ঠিক এভাবে অনেক জায়গা জুড়েই রয়েছে জেলেপল্লীর অনেক বিষয়ের প্রস্তাবনা। যা থেকে পাঠক ক্রমশ ঢুকে পড়তে পারে  জেলে-জীবনের গভীর থেকে গভীরদেশে। পাঠক আনমনে মাথায় বাঁধে গামছা, খুঁটলিটাও কখনো জড়িয়ে ফেলে আঙুলে।

জেলেপাড়ায় একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, মাথা নোয়ানো কিংবা স্নেহ-ভালোবাসা দুই পরতে সাজানো। একপাশ যতটা নিখাদ, অন্যপাশে ততটাই দায়সারা। শোষক শ্রেণিদের কাছে মাথা নোয়াতে হয়; এটাই নিয়ম। বেদান্তের অধিক। যতই তোমার তেলে তোমাকে ভাজুক। তোমার জীবন যতটা না বাঁধা বিধাতার কাছে, তার অধিক মহাজনের কাছে। জাল দড়ি নিজের বলতে কিছু নেই। তোমার জাল কোনো না কোনোভাবে বাঁধা পড়ে তাদের কাছে। যতই এ জালের খুঁটলি জড়ানো থাকুক তোমার কব্জিতে। অনেক ক্ষেত্রে বাঁধা পড়ে ঘরের বউ, সেয়ানা মেয়ে। নিদেনের দিনে মহাজন বলে ওঠে – ‘তোমার বাড়িতে যাব হে। দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলব। বউয়ের শরীরে কাপড়চোপড় আছে তো। শুনেছি, মেয়েটি তোমার ডাগর হয়েছে।’ মহাজনের সাফ কথা, জলে মাছ না থাকুক, ঘরে মেয়েমানুষ আছে তো। তুমি গুড্ডি, আর বিধাতা এর নাটাই বড় সম্মানের সাথে বেঁধে দিয়েছে মহাজনের হাতে। যত খুশি খেলো, যত খুশি নাটাই টানো, খ্যাঁচ মারো। সে অধিকার নিজেই দিয়েছে বিধাতা। ধীবর জীবন তা জানে; আর মানেও মনেপ্রাণে। এ-শ্রদ্ধায় যতই থাকুক বিতৃষ্ণা; তবে তা মনে মনে। অপরপক্ষে, প্রকৃত সম্মানীয়র প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা বড় খাদহীন। শ্রদ্ধার মানুষটি তাদের কাছে হয়ে ওঠে দেবতা। অলীক দেবতার বিপরীতে যেন প্রাণের ঠাকুর। চলমান সংসারের প্রতিটি কাজেই থাকে তার উপস্থিতি। এখানে পাঁচুর কথা বলা যেতে পারে। পাঁচু তার জেলে-জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে দেখতে পায় তার ভাই নিবারণের উপস্থিতি। নিবারণের ছেলে বিলাসকে গালি দেওয়ার সময়ও তাকে সাবধান থাকতে দেখা যায়। যেন এখানেও বড় ভাইয়ের অসম্মান না হয়।

বিলাসকে গালাগাল দেবার ওইটি পাঁচুর ধরন। কোনোকিছুর ‘পো’ গাল দেয় না কখনো। শোরের পো কিংবা গাড়লের বাচ্ছা, ওসব বলবে না। তাতে যে নিবারণকে গালাগালি দেওয়া হয়। গুণীন, সাইদার, গুরু নিবারণ। তাকে গালাগাল দিতে পারবে না প্রাণ গেলেও। গাড়লের নাতি, না হয় শোরের ভাইপো বলবে।

সমরেশ বসু গঙ্গা উপন্যাস রচনা করেছেন শুধু রচক হয়েই নন, তিনি এর বাইরেরও একজন ছিলেন এখানে। কখনো তিনি সুদখোর মহাজন, কখনো  সুদ-ঘানিতে পিষ্ট জেলে। কখনো সাইদাররূপী বাছারি নাওয়ের মাঝি। কখনো মাছের বাজারে ফড়িয়া। তিনি আছেন জোয়ারে, ভাটাতে; আছেন মরাকটালে কিংবা ভরাকটালে। তিনি ভালো করে জানেন, জলেঙ্গা জলের প্রস্তাবনা কীসের ইঙ্গিত। আর এই সবকিছুতে এক হতে পেরেছেন বলেই তিনি বিশাল ক্যানভাসে অাঁকতে পেরেছেন জেলে-জীবনের এমন নিখুঁত ছবি। এক হতে পেরেছেন বলেই হয়তো, কেন জানি মনে হয়, গঙ্গা বুনোনের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে অাঁশটে গন্ধের ভুরভুরি। উপন্যাসটি পাঠের শেষে একে বুকে ঠেকালে অাঁশটে গন্ধের অনুভূতি কোথায় যেন মৃদু আঘাত করে। এ এক বড় সাফল্য সমরেশ বসুর। দু-একটি উপমার কথা এখানে বলা যেতে পারে।

টকটকে লাল শাড়ি পরেছে একখানি। তাজা ইলিশ-কাটা গাঢ় রক্তের মতো লাল। জামা গায়ে দেয়নি।…(হিমির শাড়ি)

বাছাড়ি নৌকা যেন বড়শিতে গাঁথা মাছ। ছিটকে টেনে চলে যেতে চায়।

রূপখানি তো আছে। তার উপরে কালিন্দী আর রাইমঙ্গলের মোহনার হ্যাঁকা লেগেছে শরীরে। (হিমির যৌবন)

… নাকখানি বেশ উঁচু ছিল। চোখ দুটি তেমন বড়ো নয়। কিন্তু ধার ছিল খুব। মস্ত অাঁশবঁটিখানির সামনে মানাত তাকে। আঁশবঁটির ধার যত দেখতে ইচ্ছে করে তত ভয় হয়। দামিনী ছিল বাজারের তেমনি মেয়েমানুষ। সেও একখানি অাঁশবঁটি, এর (বলাগড়ের নৌকা) পেট মোটা, মাঝখানটি চওড়া। জায়গা বেশি, মাছ ধরবে বেশি খোলে। যদি তুমি মাছ পাও। দেখলে তোমার মনে হবে, এর চাল-চলন যেন একটু কেমন। আড়তদার কিংবা মহাজনের বউয়ের মতো, ভালোমন্দ খেয়ে, গায়ে গতরে ফেঁপে-ফুলে, হেলেদুলে চলা।

এ পেটের লজ্জা নেই, বেহায়া জিভ। জাল ফেলে, দুই গড়ান দিলে, পেটে দানা চায়। জালে কিছু পড়ুক বা না পড়ুক দানা চায় পেট। নুন না ফেলে তখন মুখের ভাত নোনা লাগে চোখের জলে। হাত ওঠে না, পেটের জ্বালায় ওঠে চির। (জেলেদের চিরায়ত অভাব)

ওপরের কথাগুলো প্রতীক কিংবা উপমা, যেভাবেই আসুক না কেন, এখানে আঁশটে গন্ধ স্পষ্ট। আর এগুলো গঙ্গা উপন্যাসে ঘটেছে বলেই হয়তো তা এত মহিমান্বিত। এই সার্থকতা বাংলা সাহিত্যের কোনো বিষয়ভিত্তিক উপন্যাসে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

এজরা পাউন্ড কবিতাকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছিলেন। উপাদান ব্যবহারের দিক থেকে একটি ছবিতে যে-কৌশল ব্যবহৃত হয়, কবিতাতেও তা করা সম্ভব কি না তার পরীক্ষা শুধু এজরা পাউন্ডই করেননি, করেছেন তাঁর সমসাময়িক আরো অনেকে। যেমন ছবিতে ব্যবহৃত প্রতিটি রং আমাদের চোখে এক এক করে ধরা পড়ে না, সমগ্র ছবিটি একটি অর্থ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের চোখে। তেমনি কবিতার উপাদান শব্দ বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে একটি রূপ বা প্রতীক নির্মাণ করে গঠন করে কাব্য-প্রতিমা। ঠিক তেমনিভাবে জেলেপাড়ার বিশেষ শব্দ, ভাষা বা বিষয়গুলো গঙ্গাতে ব্যবহৃত হয়ে বিশেষ সুষমা লাভ করেছে। জেলেপাড়ার একান্ত নিজস্ব শব্দকে সমরেশ বসু তাঁর শিল্প-রজকে ডুবিয়ে ভদ্র সমাজের ভাষা করেছেন। উচ্চ সাহিত্যেরও। এর ভাষা অতটা কাব্যময় না হলেও (অনেকের মতে) কাব্যমূল্য রয়েছে। এ কাব্য জেলেপাড়ার, গঙ্গার বুকের। জেলে-জেলেনি, ফড়ে-ফড়েনি কিংবা জাল-জল, নৌকা-দড়ার মহাকাব্য। একটি ছবিতে প্রতিটি রং আলাদা আলাদা মর্যাদা পায় না, সামগ্রিক অর্থই ধরা পড়ে আমাদের চোখে। গঙ্গার বিশেষত্ব হলো – এর প্রতিটি রং ভিন্ন ভিন্নভাবে যতটা তাৎপর্যপূর্ণ, ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ এর সামগ্রিকতায়। তাই এখানে কাব্যমূল্য আর গদ্যমূল্য ভিন্নভাবে বিচার্য নয়। হয়তো সমার্থকও।

রূপ-বর্ণনায় সমরেশ বসু অনন্য ও একক। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যে যদি রূপের যোগ্য পুরোহিত হন, তবে সমরেশ বসু রূপের যোগ্য কারিগর। কারিগর এ-কারণে যে, যদি বঙ্কিমচন্দ্র নরম মাটিতে নির্মিত প্রতিমার রূপ বর্ণনা করে থাকেন, তবে সমরেশ বসু পাথর খোদাই করে আগে ভাস্কর্য গড়েছেন, অতঃপর প্রশংসা করেছেন তার রূপের। এ-রূপ সৃষ্টি একান্ত নিজের এবং তার প্রশংসা বা বর্ণনাও নিজের। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা যেমনটি ভাবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মধুসূদনের বেলায়। গঙ্গায় রূপ-বর্ণনা হয়েছে অমর্তের বউ, নিবারণ, বিলাস, দামিনী, হিমির। এখানে শুধু রূপ-বর্ণনাই হয়নি। এই বর্ণনার ভেতর দিয়ে সমরেশ বসু যেন খন্ড খন্ড করে নির্মাণ করেছেন প্রতিটি চরিত্র। নির্মাণ না বলে পূর্ণতা বলা যেতে পারে। কারণ, উপন্যাস জুড়ে যখন চরিত্রগুলোর পূর্ণতা আসতে কিছুটা খানতি ছিল (লেখকের দৃষ্টিতে হয়তো), তখনই এই রূপ-বর্ণনা। এ শুধু রূপ নয়, ফুটে উঠেছে ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের দৃঢ়তা। যেমন দামিনীর পড়ন্ত যৌবনকে তুলনা করা হয়েছে আশ্বিনের নদীর  সঙ্গে। –

তখন অবশ্য দামিনী আশ্বিনের গঙ্গা। দেহের স্রোতে নাবারেরই ঢল। শুকোবে শিগগিরই। কিন্তু সেই তো শেষ টান। ওইখানে পড়লে, পুরুষের উঠে আসা বড় দুষ্কর। কেননা ওটা ছেউটি মেয়ের শুধু পীরিতের ঝাঁঝ নয়। সংসারের সব ঘাট অঘাট দেখা হৃদয় বড়ো গহন। তাতে জল বেশি। ঘূর্ণিও আছে।

সমরেশ বসুর অভিনবত্ব এখানে যে, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রূপ ফুটিয়ে তোলেন। হোক সে পোঁটাপড়ি কিংবা নাকবোঁচা কিংবা রং কাকের অধিক। সে শরীরেই এক এক করে অলংকার পরিয়ে বুক ফুলিয়ে বলবেন, এই তো আমার সুন্দর। যেমন হিমিকে সুন্দরী করে তুলবার জন্য লেখকের কত আয়োজন :

গায়ে জামা নেই। একখানি শাড়ি পরে এসেছে। গাঢ় নীল দক্ষিণের সমুদ্রের মতো। তার ওপরে ছড়ানো সাদা রঙের ফুল। যেন সোনার মতো সোনা খড়কে মাছ ছিটিয়ে দিয়েছে। গায়ের রঙটি কটা কটা। খোলা চুল বাঁধা আছে আলগা করে। চোখ-মুখ একরকম। দেখে মনে হয় বটে, একটু যেন ভাবগম্ভীর মেয়ে। গড়নটি একটু ছিপছিপে। হাতে গলায় নাকে কানে সোনাও আছে। সাতরকম মিলিয়ে দেখতে ভালোই। বয়স কত আর। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেপুলে হয়নি আজো। গড়ন-পিটনে একটু ছেউটি ছেউটি। অর্থাৎ শরীরখানি অকূল হয়নি, কূলের মুখে এসে থমকে আছে। বর্ষা এলে ভাসবে অকূল পাথারে। আন্দাজে বলা যায় বাইশ-চবিবশ হবে। কিন্তু সিঁদুরের দাগ নেই কপালে সিঁথেয়। এ কি বেওয়া না আইবুড়ো বোঝবার জো নেই।

হিমিকে যোগ্য আসনে বসালেন লেখক। বলতে গেলে দায় সারলেন। এখন যা দায় পাঠকের। লেখক খেলবেন হিমিকে নিয়ে। আর ওপাশে পাঠক। এতক্ষণে যা হলো, তা মাঠ তৈরি করা। ভাস্কর্য খোদাই করলেন, সাজালেন। আবার কোনো দিকে না তাকিয়েই বলে বসলেন, বাহ চমৎকার! এ এক দুঃসাহস। পাঠক এখন ডুবো হিমির রূপে।

আবার নিবারণ মালোর কালোতে আলো জ্বালিয়েছেন পরিপাটি করে। নিখুঁত বলাতে কালোকে কালো অর্থাৎ কুৎসিত মনে হয়নি। মনে হয়েছে কৃষ্ণ ঠাকুর। অভাব একটি বাঁশরি। বলেছেন –

কালো কুচকুচে রঙ, পেটানো শরীর। নেহাইয়ের মতো শক্ত। যেন নিম কাঠের কালো রঙমাখা চকচকে মূর্তি। নাকটি ছোট। চোখ দুটি ঈষৎ গোল। ভ্রু কুঁচকে মুখ তুলে তাকালে মনে হয়, কেউটে সাপ যেন ফণা ধরে আছে। ভেড়ার লোমের মতো কালো কোঁচকানো চুল। যেন জাতসাপের ডিম-ফোটা শলুই কিলবিল করছে মাথায়। হাসলে পরে চোখ ঢেকে যায়। বনে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকলে রঙে রঙ মিশে যায়। গাব-আঠা মাখানো নৌকার কাঁড়ারে শুয়ে থাকলে, টের পাওয়া যায় না। এমন কালো।

এ যেন কালোর এক মহিমাকীর্তন। মহিমান্বিত হয়েছে নিবারণ ও তার ছেলে বিলাসের রূপ। আর সমরেশ বসু বলেই হয়তো এক কৃষ্ণ-পাথরের চাঁইকে ছেনিয়ে ছেনিয়ে গড়েছেন এই কৃষ্ণমূর্তি। শিরীষ না ঘষেও কত উজ্জ্বল কত মসৃণ। আর একজনের কথা এখানে না বললেই নয়। গাম্বিলতলার পাঁচী। গামলী পাঁচী। এ পাঁচী একজন পরোক্ষ চরিত্র। এখানে এর কোনো প্রত্যক্ষ উপস্থিতি নেই। তাও আবার এক চিলতে শোনা কথা। বিলাসের বন্ধু সয়ারামের মাধ্যমে এ পাঁচী আসে পরোক্ষভাবে। তারপরও পাঠকমনে এ পাঁচী বড় প্রত্যক্ষ। পাঠক তাকে দ্যাখেনি কখনো। তার ইঙ্গিত ইশারা কিছুই নয়। তবুও। শুধু শুনেছে তার বাড়ন্ত যৌবনের ধুকপুকানির কথা। লেখক আসলে দেখিয়েছেন তার শিল্পসৌন্দর্য। পাঠক ডুবেছে তাতে। অনেক সময় জীবন্ত চরিত্রের আগে আগে হাঁটে এই পাঁচী। সয়ারাম জানে পাঁচীর আসল কথা, আসল রূপ। তাই বিলাস যখন পাঁচীকে ‘বড় একফোঁটা মেয়ে’ বলে তাচ্ছিল্য করে, তখন চটে যায় সয়ারাম। খেঁকিয়ে বলে – ‘পাঁচী যদি একফোঁটা মেয়ে, তবে গাঁয়ের মধ্যে ডাগর আছে কে আর। বাইরে বাইরে বয়স তেরো। ওদিকে ঘরের মধ্যে চোরাবান এসে যে পনেরো পার হতে চলল, সে খবর কে রাখে।’ লেখক পরে লোভ সামলাতে পারেননি গামলী পাঁচীকে খোলাসা করা থেকে। তিনি নিজেই দাঁড়িয়েছেন সয়ারামের পাশে। পাঁচীকে বলেছেন এভাবে –

গতরে বল, গতরেও বাড়বাড়ন্ত কম নয় গামলী পাঁচীর। বর্ষার জোয়ার আসেনি। টান মরশুমের জোয়ারে, ছেয়ালো ছেয়ালো ভাবখানি বেশ হয়েছে। নাকখানি একটু বোঁচা। তা, মেয়েমানুষের বেশি তোলা নাকও ভালো নয়। চোখ দুটি ডাগর। শুধু ডাগর নয়, চোখ দুটিতে কিছু কথা আছে। সব চোখে কথা পাওয়া যায় না, চোখের মতো চোখ হলে কী সব কথা যেন থাকে।

হোক সে গামলী পাঁচী। লেখক তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে, মেয়ে পাঠক হলে তো অবশ্যই পাঁচীর নাক পড়বার সময় নিজের নাকে হাত বুলিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করবেন। বোঁচা হলেও বলবেন, না ঠিক আছে। এ যৌবনের আবেশ পাঠককে শিহরিত না করে পারে না।

গঙ্গা উপন্যাসে স্পষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে সবার আগে আসে বিলাসের নাম। বিলাস চিন্তায় ও মননে একদম আধুনিক। সে জানে, যা করবার নিজেকেই করতে হয়; বিধাতা নয়। পাঁজিপাতিতে বিশ্বাস নেই তার। জেলেরা পাঁজি দেখেই নৌকা ভাসায়। আন্দাজ করতে সুবিধে হয়, মৌসুমের মাছ আর মরণের। কিন্তু বিলাস বলে অন্য কথা। – ‘যা আসবে, তা আমার জালে আসবে। পাঁজি লিখলেও আসবে, না লিখলেও আসবে। ও সবই তোমার জলের মর্জি।’ এই স্বাধীনচেতা ভালো লাগে না কাকা পাঁচুর। ঝগড়া হয় দুজনে। বিলাসকে নিয়ে একটা অহংকার আছে পাঁচুর মনে; কিন্তু একান্ত গোপনে। সে বিশ্বাস করে, জেলে-জন্মে উদ্ধত থাকতে নেই। লুকিয়ে রাখতে হয়, সত্য আর প্রতিবাদের ভাষাকে। কিন্তু বিলাস অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদী। মাথা গুঁজে সহ্য করার লোক সে নয়। পশ্চিমপারের মাছমারারা বাঁধাছাঁদি জাল পাতলে বাধে গন্ডগোল। কারণ বাঁধাছাঁদি জাল পাতলে অন্যপারের জেলেরা মাছ পায় না। সাংলো হোক আর  টানাছাঁদিই হোক, কোনো জালেই কাজ হবে না। এর প্রতিবাদ করতে পারেনি কেউ। সবাই হাপিত্যেশ করলেও বিলাস হুংকার দিয়ে ওঠে। বিলাস হয় সবার সাহস। ঝাঁপিয়ে পড়াতে বিলাস ছিল সবার নেতৃত্বে। পশ্চিমপারের পালোয়ান রসিককে একাই কুপোকাত করেছিল বিলাস। আবার পরে দেখি, এই গন্ডগোল মীমাংসার জন্য এগিয়ে আসে ওপর পাড়ার নেতারা। নেতারা সবখানে। গঙ্গাতেও। তারা দুপক্ষের লোক। কেননা, ভোট দুপক্ষেরই আছে। ভোটের রাজনীতিতে অন্ত্যজশ্রেণিও সমান মূল্যবান। সেদিন নেতাদের মুখের ওপর যা দু-এক কথা বলেছিল, তা ওই বিলাসই।

বিলাস বাস্তববাদী, পরিশ্রমী এবং একাধারে প্রেমিকও। সে ভালোবাসে হিমিকে। ডেকেছে মহারানী বলে। সব অবসাদ দূর হয়েছে হিমির দিকে চেয়ে। হিমিও আপন করে পেতে চেয়েছে বিলাসকে। কিন্তু শেষ হয়েও হয়নি শেষ। বিলাস যতই প্রেমিক হোক না কেন, সে শেষ পর্যন্ত জেলে। তার জীবনের খুঁটলি জড়ানো জালে, জলে আর নৌকায়। বিলাস শেষ পর্যন্ত মানে, জেলেদের প্রেম করতে নেই, তাকে পরিণতি দিতে নেই। অথচ তার অভিভাবক পাঁচুও বিয়েতে মত দিয়েছিল শেষে। যে হিমি উদগ্রীব ছিল সারাক্ষণ, বিলাসকে কাছে পেতে। অথচ কাছে পেয়েও সেই হিমিই ইচ্ছা-মৃত্যু ঘটাল তার প্রেমের। নিজ হাতে লবণ দিয়েছে প্রেমজোঁকের মুখে। হিমি জেনে গেছে, বিলাসকে পেয়ে বসেছে সমুদ্র। সে সাইদার উপাধি পেতে চায়। হিমি আরো জেনে গেছে, যে মায়া বিলাসকে বদ্ধ করে, দগ্ধ করে, সে প্রেম বিলাসের জন্য মিথ্যা। বিলাস আজ অদৃষ্টকে ছাপিয়ে অকূলের আহবান আত্মস্থ করার স্বপন দ্যাখে। অন্যপক্ষে বিলাস সেই হিমির কাছেই পেয়েছে শান্তি, সমুদ্রের স্বাদ আর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। তাই সে বলেছে – ‘এই তেঁতলে বিলাসকে তুমি যা দিয়েছ, তা আর কেউ কাড়তে পারবে না। সে যে মহারাণীর দান গো, মহারাণীর দান। আমার প্রাণ জুড়িয়েছ তুমি, জুড়িয়েছ বলেই আমি সমুদ্রে যাব।’ এই হলো প্রকৃত বিলাস। জেলে বিলাস। মাঝে যা কিছু যেন খেলাচ্ছলের ঘটনা। যতই বলি মুক্তির স্বাদ বিলাসকে এনে দিয়েছে হিমি। কিন্তু মুক্তি তো তার মনে; তার রক্তে। কারণ পূর্বেই তার কাকা পাঁচুকে বলা কথায় আমরা পেয়েছি এমন আভাস। হিমির প্রসঙ্গ এলে বিলাসের সাফ কথা – ‘ভগবতীর মেয়ে এলেও সমুদ্রে যাব খুড়ো, গঙ্গায় আমার মন মানছে না আর।’ আসলে এখানে জেলেপাড়ার প্রতিনিধিত্ব নিজেই তুলে নিয়েছেন সমরেশ বসু। ভোলেননি যে, তিনি রচনা করছেন জেলে-জীবনের উপাখ্যান। বঙ্কিম রোহিনীকে (কৃষ্ণকান্তের উইল) মারলেন নীতির দোহাইয়ে। শরৎ অচলাকে (গৃহদাহ) মারলেন আপন খেলায়। মানিক কুসুমকে (পুতুলনাচের ইতিকথা) ডোবালেন সামাজিক অসমে। আর সমরেশ বসু হিমি-বিলাসের প্রেমকে মারলেন জেলে-জীবনের অমোঘ নিয়মে। সমরেশ বসু এখানে নিজেও জেলেপাড়ার যোগ্য বাসিন্দা। আসলে গঙ্গা উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র পেড়ে পেড়ে বলার জোরালো কিছু নেই। কারণ, প্রতিটি চরিত্রই এখানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। অপ্রধান চরিত্রও প্রধান থেকে খুব একটা দূরে থাকে না। যেমন সয়ারাম না থাকলে বিলাস মিথ্যা, দামিনী না থাকলে হিমি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় সত্য হলো, এখানে প্রধান চরিত্র নির্মিত হয়েছে জাল, জল, নৌকা, মহাজন, ফড়ে-ফড়েনি অর্থাৎ জেলে-জীবনের কাঁচামালে। আর একটু বাড়িয়ে বললে বলা হবে, এখনে প্রধান চরিত্র ‘গঙ্গা’ (গঙ্গা উপন্যাস) নিজেই।

গঙ্গা উপন্যাসে সকল চরিত্রই এক অমোঘ নিয়মে বাঁধা। হাসিকান্নার দেবতা নিজেই রচনা করেছেন জেলে-সমাজের অলিখিত সংবিধান। আর এটি জেলেদের হাতে তুলে দিয়ে সেই দেবতার বসত এখন মহাজনপাড়ায়। এই সংবিধান তাদের সারা জীবনের পুঁজি। তাইতো দামিনী ও হিমি যতই কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে না উঠতে পারুক; তারপরও তারা ফড়েনির বাইরে যেতে পারেনি। এখানে ফড়েনি জীবনের একটি কথা না বললেই নয়। সমরেশ বসু ফড়েনি আতরের বেলায় বলেছেন – ‘আতর সধবা নয়, বিধবা নয়, শুধু ফড়েনি।’ ফড়েনি জীবনের জন্য এর চাইতে বিধ্বংসী কথা আর কী বা হতে পারে? এই বাক্যের ধ্বনি যেখানেই পৌঁছাবে, সেখানেই কম্পিত হবে মানবচিন্তা, মানব-বিবেক। আর এ-কারণেই বলতে ইচ্ছা করে, সমরেশ বসু জেলে চরিত্রেরও যোগ্য আর নিখুঁত কারিগর। যোগ্য আর জাত জেলেও বটে। অন্যদিকে পাঁচুর হাত ঘায়ে খসে পড়ার জোগাড়, তবু বসে থাকতে নেই। কারণ, জেলে সংবিধানে তা নেই। হাতে গাব লাগাও, ধরো খুঁটলি, দেও গড়ান। আবার এও ঠিক, জেলেপাড়ায় যতই শোকের ছায়া পড়ুক, গলা ছেড়ে কাঁদতে নেই। কারণ কোনো ধারাতে তা পড়ে না। তাছাড়া সংবিধান বলেছে, কাঁদলে সমুদ্রে ভাসন্ত খসমের অমঙ্গল হবে। তাইতো বিনিদ্র রাতে বউ নিশ্বাস নেওয়া-ছাড়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক হয়, যেন তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস না আবার হয়ে যায়। আমরা নিবারণ মালোর পরিবারের এক রাতের কথা বলতে পারি :

বউ তার ঘুমন্ত সন্তান বুকে নিয়ে জাগে ঘরে। অন্ধকারে দু চোখ মেলে সেও ভেসে বেড়ায় ঘরের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে। এ বিধির বিধান নয়। বিধি দেয় রাত আর ঘুম। এই ঘরনী জাগে পোড়া প্রাণের বিধানে।

নদীতে পুবে শাওটার ঝড় বয়। বউ একা ঘরে শুয়ে বুকে চাপে দীর্ঘশ্বাস। অমন নিঃশ্বাস ফেললে অকল্যাণ হয়। নিঃশ্বাস চেপে সে শুধু প্রহর গোনে।

নিজের শ্বাস একটু লম্বা করেও ফেলবার অধিকার নেই জেলে-বউয়ের। এর চেয়ে রূঢ় বাস্তবতা আর কী-ই বা হতে পারে। এই অলিখিত দলিলের সারকথা – জেলে আর মহাজনের মধ্যে যেন কোনোভাবেই তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি না ঘটে। তাই দেখি ঝড়বৃষ্টির রাতে মাছমারার বউ অন্ধকার ঘর থেকে আঁচলের ঢাকা দেয়। এতে স্বামীর গা ভেজা বন্ধ হয় না। এটা সে জানে। তবু মনের সান্ত্বনা। তাছাড়া এও ভালো করে জানে, এ-জীবন মাছ মারার নিয়মের জালে জড়ানো। জেলে-পরিবারের কঠোর বাস্তবতা এখানে স্পষ্ট। ‘তুমি মাছমারার বউ, তুমি জাগো বার মাস’। আনসিজনে রাত জেগে জাল বুনো কিংবা কখনো হাঁটুতে মাথা গুঁজে ভাবো – রাত পোহলে কী ফোটাবো আগুনে; কী বেড়ে দেব সামনে। আর মৌসুমে জেগে থাকো, জলে ভাসা সকল অনিষ্টের কথা ভেবে ভেবে। বর্ষা রাতের ঝিঁঝি পোকা তার মনেও ডাকে। এ-ডাকের একটাই অর্থ, কোথায় ভাসছে ঘরের মানুষ।

আগেই বলেছি, গঙ্গার কাব্যিকতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে গঙ্গা উপন্যাসে যে অনেক কাব্য-উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তা অনিস্বীকার্য। কারণ, একজন কবিমনস্ক ব্যক্তি যদি গঙ্গা পাঠ করতে করতে লিখে থাকেন –

মানব জীবন সে তো

গঙ্গায় ভাসন্ত বাছাড়ির নাও।

ফুটো থাকলেই টানতে থাকে তলানিতে

আবার –

মানব  জীবন সে তো

বর্ষার জোয়ার ভাটা

জলেঙ্গার জল।

দু দন্ড জোয়ার তো চার দন্ড ভাটা

চার দন্ড সুখ তো আট দন্ড দুঃখ।

তবে অবাক হবার কিছু নেই। এমন অনেক অনেক কবিতা লেখা যেতে পারে গঙ্গা পাঠান্তে।

সমরেশ বসু গঙ্গা উপন্যাসে স্পষ্ট উদ্দেশ্যবাদী। অনেকটা বস্ত্তবাদীও।  তিনি উদ্দেশ্য নিয়েই গঙ্গাতে নাও ভাসিয়েছেন। আর তাই জেলে বাস্তবতার বাইরে যেতে চাননি। এখানে ডাকাতি, রাজনীতি, মারামারি কিংবা মেয়েপাড়ায় যাওয়া বলি আর শহরের আলোকচ্ছটাই বলি না কেন, সবকিছুই আবর্ত হয়েছে জেলে-জীবনের বাস্তবতার নিরিখে। শব্দ, ভাষা, গালাগাল, এমনকি নারীর রূপেও কোথায় যেন একটা আঁশটে গন্ধের ছোঁয়া। লেখক যখন বুঝতে পারেন, তাঁর নিরেট বাস্তবতার বুনোটে পাঠক ধাক্কা খেতে পারে, ঠিক তখনই নিজে হলুদ পোশাক পরে উপস্থিত হয়েছেন বিবেকের ভূমিকায়। এবার পাঠক মনোযোগী শ্রোতা, যাত্রা প্যান্ডেলে। বিবেক দরাজ গলায় আলগা করছেন ভাষা কিংবা কাহিনির জটিলতা। মাছ মারার পদ্ধতি, সুদ, মহাজন কিংবা মনোবিকারই হোক, যেখানে বিবেকের দরকার সেখানেই এসেছেন তিনি। তবে আরোপিতভাবে নয়, যা এসেছে তা আপন গতিতে; গঙ্গার আবহে। অবশ্য এই গতি আর আবহ তৈরি, লেখকের কম বড় কৃতিত্ব নয়। আসলে সমরেশ বসু সমস্ত অলিগলি হাতড়ে উদ্ধার করেছেন ‘গঙ্গা-সম্পদ’। উপভোগ করেছেন সেই জগৎকে, সেই জ্বালাকে। পাঠককেও করতে চেয়েছেন তাঁর সহচরী। করেছেনও। আর এই বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছেন বলেই হয়তো অবলীলায় বলতে পেরেছেন – এই শব্দ, ভাষা, উপমা, নিয়ম-নীতি, পূজা-অর্চনার কথা।

সমরেশ বসুর অন্তর্দৃষ্টি এতটাই প্রখর যে, খানাখন্দের শেষ পর্যন্ত তিনি দেখতে পেতেন। দেখাতে খামতি রাখেননি কোনোদিনই। তবে তাঁর দেখার চোখ ছিল কাঁড়ার চেয়ে আকাঁড়ার দিকেই বেশি। যার প্রমাণ গঙ্গার অধিক আর কিছু হতে পারে না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন –

সমরেশ বসু ছিলেন এমন এক গোত্রের লেখক, যিনি তাঁর জীবন আর সাহিত্যের মধ্যে কোনো ভেদ রাখেননি। তিনি ছিলেন পুরোপুরি সৎ। সাহিত্যের ব্যাপারে কোনো ফাঁকি ছিল না। অজস্র চরিত্র তিনি দেখেছিলেন। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডার তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। করেছিলেন বলেই তাঁর সমস্ত রচনাই ছিল একটির থেকে আরেকটি পৃথক।

একই লেখায় তিনি আরো বলেছেন –

শুধু গল্পের জন্য নয়, সমরেশ বসুর উপন্যাস যাঁরা ফর্ম, প্লট কনস্ট্রাকশন, টাইম ল্যাপসের কায়দা বোঝার জন্য সচেতনভাবে পড়বেন, তাঁরাই ধরতে পারবেন তাঁর মুনশিয়ানা। উপলব্ধি করতে পারবেন কত বড় মাপের লেখক ছিলেন তিনি। কত ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন, ভাষা নিয়ে, ডায়ালেক্ট নিয়ে, স্টাইল নিয়ে, ফর্ম নিয়ে। (‘অদ্বিতীয়’; সমরেশ স্মৃতি)

গঙ্গা কোনো ঢাউস উপন্যাস নয়। পুরো উপন্যাস রচিত হয়েছে মূলত এক মৌসুমের মাছমারার ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। যদিও এর আগের মৌসুমের কথা আছে ভিন্নভাবে, যে-মৌসুমে নিবারণ সাইদর মরেছিল সমুদ্রে। তারপরেও গঙ্গার ঘটনা, কাহিনি, চরিত্র সব মিলিয়ে এর ব্যাপকতা এতই বেশি ছিল যে, এই উপন্যাস গায়ে-গতরে হতে পারত বর্তমানের পাঁচগুণ। কিন্তু হয়নি। কারণ, সমরেশ বসু জানতেন, নিজেকে কতটা দিতে হয়, আর কতটা ধরে রাখতে হয়। আর তাই তো অজস্র দেখার মাঝ থেকে ক্রিম তুলে আনেন সহসাই। একবাক্যে অনেক কথা বলার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ছিল বলেই তিনি অমর্ত্যের বউয়ের পুরো যৌবনকে একবাক্যে বলতে পেরেছেন – ‘রাইমঙ্গলের জোয়ার এসেছে’। আবার হিমি হাজার মরীচিকা পাড়ি দিয়ে যখন বিলাসের বুকে মাথা গুঁজে একপশলা বৃষ্টির দেখা পেল, তখন লেখকের ছোট্ট কথা – ‘আগনা ছুঁল ডাঙা’। যে-কথা বোঝাতে একটা বড় প্রস্তাবনা দরকার, সেখানে লেখক তিনটি শব্দকে যথেষ্ট মনে করেছেন। তাই বিশ্লেষকদের সঙ্গে আমাদেরও বলতে ইচ্ছা করে, গঙ্গা একটা বিশ্বনন্দিত ইংরেজি ছবির মতো। সময় দেড় ঘণ্টা। তবু মনে হবে, কতক্ষণ ধরেই না দেখছি। কত কাহিনি, কত ঘটনা, অথচ একটার সঙ্গে আরেকটার বড় পরম্পরা। তাই শুধু পটভূমিই নয়, এর ফর্ম, স্টাইল, ভাষা, কথোপকথন, সমাজচিত্র সবকিছু মিলেই সমরেশ বসুর গঙ্গা, অন্যান্য নদী-জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা রাখে। বাংলা সাহিত্যে জাল, জল ও জেলে জীবনের এই গৃহস্থালি আমাদের অহংকারী করে তোলে নির্দ্বিধায়। অন্যদিকে গঙ্গার শৈল্পিক সৌন্দর্য, স্বতন্ত্র বুনন আর কঠিন সংযমে আমরা বিস্মিতও বটে।