গল্পে ভিনদেশি জীবন

মুহাম্মদ আশফাক

 

গল্প – ছোটগল্প বা বড়গল্প, স্বদেশি বা বিদেশি – যা-ই হোক না কেন, ছোট ছোট প্লটে জীবনের ছবি, সময়কে ধরে রাখে। বিস্মৃত পরিসরে নয়, স্বল্প বয়ানে জীবনছবি আঁকাই গল্পকারের কাজ। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে আধুনিক গল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – সবার হাতে প্রাণ পেয়েছে সাহিত্যের এই ধারা। সেই ধারারই বিশিষ্ট পরিব্রাজক সুব্রত বড়ুয়া। প্রসিদ্ধ এ-গল্পকারের পথচলার শুরু ষাটের দশকে। গল্প ছাড়াও কবিতা, উপন্যাস, বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ-সাহিত্যে তাঁর অবাধ গতায়াত। তবে গল্পকার হিসেবেই তিনি অধিক সমাদৃত। পেয়েছেন একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা ও পুরস্কার।

সুব্রত বড়ুয়ার লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে জীবন, সমাজ, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ। তাঁর অনুবাদকৃত এগারোটি বিদেশি গল্পের সংকলন এগারোটি বিদেশি গল্প, বেরিয়েছে ২০১৮ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে। বইটিতে স্থান পাওয়া এগারোটি গল্পের মধ্যে নয়টি গল্প নিয়ে এর আগে ২০১০ সালে বেরিয়েছিল সাদা দুধে কালো মাছি শিরোনামে আরেকটি বই, প্রকাশক ছিল ঝিঙেফুল। এবার আরো দুটি গল্প যোগ করে মোট এগারোটি গল্পের এ-সংকলন প্রকাশ করেছে পড়ুয়া।

গল্প যে-দেশেরই হোক না কেন, তা সবসময়ই সে-দেশের গল্পকারের সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ও জীবনপ্রণালির ছবি। সুব্রত বড়ুয়া অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স লা গু্যমা, জেমস ন’গুগাই, আমাদো ভি হারনানডের্জ, নাগীব মাহফুজ, জোসে অগাস্টিন রামিরেজ, আবেলার্দো ক্যাস্টিলেস্না, মারিয়াম নাদ্রাথ আহমেদ, আম্বাই (সি. এস. লক্ষ্মী), উইলিয়াম ফকনার ও আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে। এগারোটি গল্পই ভিন্ন দেশের, ভিন্ন স্বাদের।

প্রথম গল্পটিতে দেখা যায়, সমত্মানের আবদার রাখতে গিয়ে একটু কফির জন্য পথের পাশের একটি ক্যাফেতে গিয়েছিলেন এক মা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতিতে তখন – এখনো অবস্থার খুব বেশি পার্থক্য পরিলক্ষেত হয় না – কালো-সাদার বিভেদ প্রকট। চাইলেই সাদাদের কাছে ঘেঁষতে পারে না কালোরা। অথচ দেশটা তো কালোদেরই। সেই ক্যাফেতে কফি তো পেলেনই না উলটো তিরস্কারে ভৎর্সনায় জর্জরিত হলেন মহিলাটি। কিন্তু কত আর সহ্য করবেন, প্রতিবাদ করলেন, শুধু মুখে নয় হাতের ফ্লাস্ক দিয়ে আঘাত করলেন ক্যাফের সাদা কুৎসিত মনের নারীটির মুখে। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। সাদা মানুষদের সরকারের পুলিশ ধরে নিয়ে গেল সেই কালো মাকে। ‘কফি’ – আলেক্স লা গু্যমা এভাবেই বর্ণনা করেছেন সাদা-কালোর বিভেদ তাঁর গল্পে। সাদাদের শোষণ আর রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের শিকার আলেক্স অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সময়কার সামাজিক বঞ্চনা-যন্ত্রণার ছবি। সেই ছবি বাংলা ভাষায় এঁকেছেন সুব্রত বড়ুয়া। সহজ-সাবলীল বাক্যবন্ধে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আলেক্স তথা আফ্রিকার কালোদের মনোযন্ত্রণা।

জেমস ন’গুগাই কেনিয়ান সাহিত্যিক। তাঁর গল্পেও আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি হতাশার কথা উঠে এসেছে। ন’গুগাইয়ের গল্প ‘ফেরা’র অনুবাদে সুব্রত বড়ুয়া সচেষ্ট ছিলেন সেই না-পাওয়ার বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে। এ-গল্পের নায়ক দীর্ঘদিন জেল খেটে ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী নেই। অথচ মাত্র দু-সপ্তাহ সংসার করার পরই সরকারি বাহিনী নিয়ে যায় তাকে। গল্পের নায়ক ভেবেছিল, তার স্ত্রী অপেক্ষা করবে। কিন্তু দারিদ্র্য আর চাহিদার কাছে হার মানে ভালোবাসা। লোকটি ফিরে এসে পায় স্ত্রীশূন্য ঘর। ভেঙে পড়া হৃদয়ে লোকটি যখন দিশেহারা তখন মায়ের স্নেহের পরশ তাকে সান্তবনা জোগায়। ঘরে ফেরে সে। ন’গুগাই তাঁর গল্পে সময়কে যেমন ধরেছেন, তেমনি মানুষের সম্পর্কগুলো কাটাছেঁড়া করেছেন সূক্ষ্মভাবে। সেই সম্পর্কের রসায়ন সুব্রত বড়ুয়ার অনুবাদে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

বেশ ভালোই ছিল কৃষক বান্দোংয়ের দিনগুলো। একদিন সে দেখতে পেল তার বাড়ির পাশে শুরু হয়েছে বিশাল নির্মাণকাজ। জানতে পারল ব্যবসায়ী আর সরকারি অফিসারদের জন্য বিলাসবহুল আবাস নির্মিত হবে সেখানে। সবকিছুই ভালোভাবে নিয়েছিল বান্দোং। কিন্তু একসময় বুঝল তার কোনো ভালো হচ্ছে না বা হবেও না, উলটো কপালে শনি ঝুলছে। ওই বিলাসবহুল আবাসিকের পাশে তাকে ভাবা হচ্ছে – সাদা দুধে কালো মাছি, অর্থাৎ অনাহূত। অথচ এটা বান্দোংয়ের ভূমি – তার বাপ-দাদার ভূমি। কিন্তু ক্ষমতা আর অর্থের কাছে যে বড় অসহায় সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বান্দোং শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদকেই করে তার শেষ হাতিয়ার। ফিলিপাইনের কথাসাহিত্যিক আমাদো ভি হারনানডের্জের গল্পে এভাবেই উঠে এসেছে নগরায়ণ আর অর্থের দাপটে মানুষের ভূমিহীনে পরিণত হওয়ার কথা। ‘সাদা দুধে কালো মাছি’ শিরোনামে এ-গল্পে সুব্রত বড়ুয়া প্রায় একই সমান্তরালে যেন তুলে ধরেছেন এদেশের নগরায়ণের কালো দিকটিও। আসলে ম্যানিলা হোক কিংবা ঢাকা, যুগে যুগে এভাবেই নগর গ্রাস করেছে গ্রাম, ভূমি, কৃষকের ভাগ্য।

মিশরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক নাগিব মাহফুজের গল্প ‘জাবালাবি’। এক অদ্ভুত চরিত্রের নাম জাবালাবি। একজন সুফি, দরবেশ, কী সিদ্ধ পুরুষ তিনি। তাঁর ছোঁয়াতেই মঙ্গল – এমন ধারণা মনে পুষে নিরন্তর তাঁকে খুঁজে চলা। একসময় যদিও তাঁর সন্ধান মেলে কিন্তু আবারো তিনি হারিয়ে যান। বড় রূপক এ-গল্প। এ যেন সেই পরশপাথর যার খোঁজে জীবন কেটে যায়, কিন্তু কখন যে সে ধরা দিয়েছিল তা আর জানা হয় না। মানুষের মনের জটিল এ বাসনার গল্প ‘জাবালাবি’কে বাংলা রূপান্তরে অত্যন্ত সাবধানী ছিলেন সুব্রত বড়ুয়া। তাঁর শব্দচয়ন এবং বাক্যবিন্যাসে তেমনটাই প্রতিভাত হয়। গল্প কোথায় যে মোড় ঘুরবে তা বুঝতে পাঠককে আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতে হয় শেষ পর্যন্ত।

রুশ কথাসাহিত্যিক ইভান বুনিনের প্রেম-বিরহের গল্পকে ‘রৌদ্রদাহ’ নামে ভাষান্তর করেছেন সুব্রত বড়ুয়া। পথচলতি হঠাৎ ভালোবাসার হাওয়ায় পালকের মতো উড়ে যাওয়া মন নিয়ে এক সেনা অফিসারের গল্প এটি। তবে সে হাওয়া বেশিক্ষণ থাকেনি, থেমে গেছে। তখন ব্যথায় জর্জরিত মন নিয়ে ফিরে চলে সে অফিসার। জানে কখনো আর দেখা হবে না ক্ষণিকের প্রিয়তমার সঙ্গে। কিন্তু যে-প্রেমের আগুন তার হৃদয়ে জ্বলেছে তা প্রতিনিয়ত পুড়িয়ে যাবে তাকে – তা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে গল্পের বয়ানে।

এক অবাধ্য কিশোরীর গল্প ‘শোক’। মেক্সিকোর সাহিত্যিক জোসে অগাস্টিন রামিরেজের গল্প। ধনী পরিবারের মা-হারা কিশোরী, যার সাবালক হয়ে ওঠা পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তার খালা। সেই কিশোরীর মনের ভাষা, অহেতুক জেদ, সব বুঝেও না বোঝার ভান করা – এসব বিষয় অত্যন্ত গভীরভাবে বাংলা ভাষায় বর্ণনা করেছেন সুব্রত বড়ুয়া। এ-গল্পে পাঠক প্রথমত বিরক্তই হবেন নায়িকার ওপর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিশোরীমনের যন্ত্রণা-আকাঙক্ষাগুলো যখন প্রকাশিত হতে থাকে, তখন পাঠক-হৃদয়ে তার প্রতি জমা হয় সহানুভূতি, ভালোবাসা।

‘আর্নেস্টোর মা’ – সমত্মানের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার গল্প। আর্জেন্টিনার আবেলার্দো ক্যাস্টিলেস্না এ-গল্পে এমন একটি মা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যিনি গণিকা। তাঁর ছেলের বন্ধুদের কাছেও তিনি একসময় আরাধ্য হয়ে ওঠেন, যদিও তারা ছোটবেলা থেকেই তাঁর আদর-স্নেহ পেয়ে এসেছে। সেই নারী যখন শহরের প্রামেত্ম এক পানশালায় গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত তখন হঠাৎ করেই তার ছেলের বন্ধুরা যায় সেখানে। তারা তখন মাত্র তারুণ্যের কোঠায় পা রেখেছে। তাদের উদ্দেশ্য বন্ধু আর্নেস্টোর মাকে শয্যায় পাওয়া। কিন্তু যখন তারা তার মুখোমুখি হয়, তাদের সব চিমত্মাভাবনা যেন স্থবির হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওই নারী তাদের দেখে অন্য কিছু নয়, তার সমত্মানের কোনো বিপদ হলো কি-না সে-চিমত্মায় অস্থির হয়ে ওঠেন। বড় অদ্ভুত এ-গল্প – গল্প যত এগিয়েছে, বেশ রগরগে একটা সমাপ্তি মনে এলেও হঠাৎ করেই যেন অ্যাবাউট টার্ন। উত্তেজনা নয়, মায়ের স্নেহের পরশমাখা আশঙ্কায় আর্দ্র হয়ে ওঠে পাঠকের মন। মা তো মা-ই সে যা-ই হোক, আর যা-ই করুক না কেন।

বইটির সর্বশেষ গল্প আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফ্রান্সিস ম্যাকোম্বারের সংক্ষিপ্ত সুখী জীবন’। একজন বিত্তশালী ব্যক্তির জীবনালেখ্য, যেখানে জড়িয়ে আছে তার স্ত্রী ও একজন ভাড়াটে শিকারি। ব্যক্তিটি বিত্তবান হলেও তার স্ত্রীর চোখে কাপুরুষ। আবার তার বহুগামী স্ত্রী চাইলেও তার স্বামীকে ছাড়তে পারছে না, কারণ সমাজে টিকে থাকতে হলে স্বামীই তার ভরসা। বেশ জটিল এ-দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে ঢুকে পড়ে এক ভাড়াটে শিকারি। গল্পের বর্ণনায় ফুটে ওঠে শিকারি এবং ওই নারীর দৈহিক সম্পর্কের আভাস। স্বামী সব বুঝতে পেরে তার কাপুরুষত্ব ঝেড়ে ফেলতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তাতে সে কিঞ্চিৎ সফল হলেও স্ত্রীর হাতে ইতি ঘটে তার জীবনের। আর এ-ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে ওই ভাড়াটে শিকারি। সুব্রত বড়ুয়া অত্যন্ত মুন্শিয়ানার সঙ্গে এ-গল্পের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে উঠে এসেছে অরণ্যরানী আফ্রিকার বর্ণনাও।

বইটিতে আরো আছে মালদ্বীপের মারিয়াম নাদ্রাথ আহমেদের ‘নোংরা সম্মিলন’, তামিল ভাষার নারীবাদী লেখক আম্বাইয়ের ‘কাঠবিড়াল’ এবং আমেরিকান কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনারের ‘পুরোনো লোকজন’ গল্প তিনটি। ঝরঝরে অনুবাদে প্রতিটি গল্পই পাঠকের মনে স্থান করে নেবে নিঃসন্দেহে।

গ্রন্থটির ভূমিকায় সুব্রত বড়ুয়াবলেছেন, ‘… গল্পগুলোর অনুবাদকর্ম আমি সম্পাদন করেছি বিভিন্ন সময়ে, প্রধানত কয়েকজন সুহৃদের অনুরোধ ও তাগিদে।’ তারপরও গ্রন্থপাঠে এটা স্পষ্ট, শুধু অনুরোধ রক্ষা নয়, মনের তাগিদও ছিল এসব গল্প অনুবাদে। সুব্রত বড়ুয়ার এ-প্রয়াস অব্যাহত থাকুক – সে-কামনাই করছি। কারণ এদেশে ভালো অনুবাদ-সাহিত্যের ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।

সবশেষে একটি বিষয় না বলে পারা যাচ্ছে না, ফণ্টচ্যুতিজনিত কারণে মাঝে মাঝে কিছুটা ধাক্কা খেতে হয় গ্রন্থটি পাঠে।