জীবনের গল্পকারের জীবনগল্প

পিয়াস মজিদ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক নিজেকে মেলে ধরেছেন গল্পে-উপন্যাসে-ব্যক্তিগত রচনায়-ভাবনাশীল প্রাবন্ধিক গদ্যে। শ্রোতার আসরে তাঁর মৌখিক কথকতার রৌদ্রও তীব্র উষ্ণতা-সঞ্চারী এখনো। তাঁকে নিয়ে বইপত্রের সংখ্যাও সামান্য নয় – আবু জাফর, জাহানারা নওশিন, মহীবুল আজিজ, সুশান্ত মজুমদার, সুশীল সাহা, সরিফা সলোয়া ডিনা, চন্দন আনোয়ার, হারুন পাশাসহ অনেকেই দুই বাংলাতেই তাঁকে নিয়ে একক বই ও সম্পাদিত সংকলন রচনা ও প্রকাশ করেছেন। হায়াৎ মামুদের সম্পাদনায় উন্মোচিত হাসান শিরোনামে মহার্ঘ্য সাক্ষাৎকার সংকলনও প্রকাশ পেয়েছে, বেরিয়েছে বিভিন্ন ছোটকাগজের বেশকিছু হাসান আজিজুল হক সংখ্যাও। তাঁর কয়েক খ–র আত্মজীবনীতেও নিজ জীবনের গল্প বয়ান করেছেন তিনি, তবু জীবনের গল্পের কী শেষ আছে কোনো! বিশেষত যে-জীবন হাসান আজিজুল হকের মতো জীবনশিল্পীর, সে-সম্পর্কে সাধারণ কৌতূহল নিবৃত্তিতে নতুন নতুন গবেষণাকর্ম বিশেষ সহায়ক আমাদের।

 

দুই

হাসান আজিজুল হকের জীবনের আশি বসন্ত পূর্তির প্রাক্কালে মোহাম্মদ আবদুল মজিদের সম্পাদনায় সেন্টার ফর বাংলাদেশ কালচারের পক্ষে মনু ইসলাম প্রকাশ করলেন হাসান আজিজুল হক : অতল জীবনে ডুব শীর্ষক এই সম্মাননাগ্রন্থ। একই সংগঠন এক যুগ আগে ২০০৫-এ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল তাঁকে। এবারো সম্মাননা-স্মারক প্রকাশ উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজন করা হয় প্রকাশনা উৎসব ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মজিদের ‘প্রসঙ্গ কথা’র উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক :

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, নিরীক্ষাধর্মী ভাবদর্শনের গল্পকার, রাঢ় বাংলা থেকে সমতল ও ভাটি বাংলার মাটি ও মানুষের জীবনের চালচিত্র নিয়ে গবেষক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজচিন্তক, সংস্কৃতিতাত্ত্বিক হাসান আজিজুল হক আমাদের মগ্ন-চৈতন্যের চিত্রকর, সময় ও সমাজের, চিমত্মা ও চেতনার রূপকার, অনুপম আদর্শে ভাস্বর এক আলোকোজ্জ্বল প্রতিভা শিক্ষাবিদ। তিনি বাঙালি, বাঙালির সমাজ দর্শন নিয়ে চিমত্মা-চর্চা করেন আবার সেই ভাবনার সূত্রকে
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণে তাঁর রচনায়, মূলত কথাসাহিত্যে, ব্যবহারিকভাবে বাঙ্ময় করে তোলেন। … একজন প্রবাদপুরুষের জীবদ্দশাতেই তাঁর মূল্যায়ন উপস্থাপনের, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের গঠনমূলক উদ্যোগে ‘সেন্টার ফর বাংলাদেশ কালচার’-এর একটি বিনম্র নিবেদন।

উদ্যোক্তাদের এই প্রয়াস অভিনন্দনযোগ্য।

হাসান আজিজুল হকের জীবন ও কর্ম বিষয়ে ছাবিবশটি গদ্য, একটি সাক্ষাৎকার, একগুচ্ছ পত্র, জীবনপঞ্জি, আলোকচিত্রগুচ্ছ এবং তাঁর একাত্তরের স্মৃতিভাষ্য মিলে এই গ্রন্থের অবয়ব। অগ্রজ, সতীর্থ ও অনুজদের মধ্যে আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, রশীদ করীম, যতীন সরকার, সনৎকুমার সাহা, গোলাম মুরশিদ, জাহানারা নওশিন, হায়াৎ সাইফ, মফিদুল হক, আলী আহমদ, সুশান্ত মজুমদার, মশিউল আলম, ইজাজ হোসেন, মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, আবদুস সামাদ ফারুক, খায়রুল আলম সবুজ, ফারুক মঈনউদ্দীন, মোহিত কামাল, সাধন ঘোষ, চন্দন আনোয়ার, পিয়াস মজিদ, মোজাফ্ফর হোসেন, হামীম কামরুল হক, রীআ মাহমুদ, সৈয়দ কামরুল হাসানের রচনা স্থান পেয়েছে আলোচ্য সংকলনে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বকৃত নোমান গৃহীত সাক্ষাৎকার এবং মিজানুর রহমানকে প্রেরিত হাসান আজিজুল হকের পত্রত্রয়।

স্মৃতি ও মূল্যায়নের মিশেল পাওয়া যায় সংকলনভুক্ত রচনাবলিতে। নিকট ও দূরের দেখা মানুষটির যে প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয় তা পাঠককে উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে আরো বিশদ করে জানতে। আনিসুজ্জামান যেমন বলেন :

হাসান আজিজুল হকের বন্ধুত্ব মহামূল্যবান। ফুলতলায় হোক, রাজশাহীতে হোক, ঢাকায় হোক – অনেক দিন পর দেখা হলেও মনে হয়েছে কালকের পর আজ আবার শুরু করছি কথাবার্তা। আড্ডা জমাতে হলে যা লাগে – গল্পকারের পর্যবেক্ষণশক্তি দিয়ে কারো চরিত্রের উদ্ঘাটন, অভিনেতার শিল্প দিয়ে কারো ভাবভঙ্গির অনুকরণ, আন্তরিক প্রশংসা কারো, কারো অকপট নিন্দা – কিছুই বাদ যায় না সেসবের। প্রীতির পরশ পাই তার মধ্যে, পাই জ্ঞানের ছোঁয়া, পাই হিতৈষীর উদ্বেগ, পাই বন্ধুর পরামর্শ। শেষ পর্যন্ত সব কথা এক জায়গায় গিয়ে ঠেকে; কী হবে এই হতভাগ্য দেশটার! (পৃ ১০-১১)

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বর্ণনা করেন প্রামেত্ম বসে কেন্দ্রশাসনের অনুপম সত্য :

তিনি রাজধানীমুখী নন। রাজধানীকেই বরং নিয়ে যেতে চান রাজশাহীতে। রাজশাহী তাঁর কর্মক্ষিত্র, কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়েই সেখানে ছিলেন, কর্মজীবন শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র ঢাকায় ছুটতে হবে, এমন কোনো অস্থিরতা তাঁর মধ্যে ছিল না। না-থাকায় ঢাকার ক্ষতি হয়েছে, লাভ হয়েছে রাজশাহীর।
(পৃ ১১-১২)

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ভুবনের প্রয়াত দুই কৃতীজন ওয়াহিদুল হক এবং রশীদ করীমের ভাবনা-উদ্রেকী গদ্যে ঋদ্ধ এই সংকলন। ওয়াহিদুল হক তাঁর বাগ্মিতার উৎস সন্ধান করেন। বিপিন পাল, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তরুণ সান্যালের বাগ্মিতার কথা মনে রেখেও তিনি বলতে চান :

হাসান তাদের চাইতেও ভালো বলেন। যারা শোনে তারা সকলে যেন কয়েক নিমেষের মধ্যে তার হাতের মুঠোর ভিতরে চলে যায়। না, হাসানের এই ক্ষমতা কোনো ধরনের মায়াবী পারফরম্যান্স নয়। তিনি মঞ্চ-কথাকে, সমাসটা বোধহয় ঠিক হলো না, দক্ষতার পর্যায় থেকে শিল্পে নিয়ে গেছেন, এমন কোনো কথা নয়। তার মূল শক্তি মূল জাদু ওইখানে যে, তিনি কখনোই বক্তৃতা করেন না। প্রাসঙ্গিক কথা ছাড়া কোনো বিষয়ে তাকে মঞ্চ থেকে বলতে দেখিনি এবং যাই বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতার প্রাসঙ্গিকতম কথাগুলোকে তা যেন এক ঐশী-ক্ষমতায় কেবল গাঁথেন না, গোলা বানিয়ে কামান দাগানো কিংবা হৃদয় গহনের তীব্রতম বেদনার বোধে রূপান্তর করেন। আমি বিশ্বাস করি, হাসান শুধু কথা দিয়ে আমার মতো প্রচ্ছন্নতাপ্রিয় নির্বিরোধী সহস্র লোককে দেশের তাবৎ খোয়াব নামের বিলাসঘর ভাঙতে ছোটাতে পারেন।       (পৃ ১৩-১৪)

রশীদ করীম নিজ উদাহরণে ব্যাখ্যা করেন হাসান আজিজুল হকের ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের জায়গা-জমিন। নিসর্গের প্রতিতুলনায় জীবন ও মৃত্যুর উপস্থাপন যে কতটা কুশলী করতলে সম্পন্ন করেছেন এই গল্পে হাসান তা ব্যাখ্যা করে এমন সিদ্ধামেত্ম পৌঁছেন তিনি, একটি মানবচরিত্রের সবগুলো বৈশিষ্ট্য তিনি, লক্ষ্য করেন – প্রকৃতিরও তাই এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যকে তিনি মানবজীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন।

যতীন সরকার আলো ফেলেন তাঁর মার্কসীয় সারবত্তায়, যা কোনো উপরিতলার প্রসাধন হিসেবে ধরা দেয় না তাঁর কাছে, বরং মননের অচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে আছে তাঁর মসিত্মষ্কে ও সৃষ্টিবিশ্বে –

হাসান আজিজুল হককে কেউ মার্কসবাদী লেখক বা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচয় দেন না, নিজেও তিনি এমন আত্মবিজ্ঞাপন প্রচার করেন না। এর কোনো প্রয়োজন নেই। মার্কসবাদ হাসানের গায়ের আলখেল্লা নয়, তাঁর মননের অস্থিমজ্জা।

(পৃ ৩২)

 

‘কাছের হাসান দূরের হাসান’ লেখায় সনৎকুমার সাহা একান্ত ব্যক্তিক অবয়বের হাসানকে দেখান, যিনি বিরূপ বিশ্বেও সদা খুলে রাখেন তাঁর উদার দরজা –

জানান না দিয়েও সটান ঢুকে পড়া যায়, কখনো তিনি বিরূপ হন না। কারো বেলাতেই না। মনে হয় যেন তিনিই আছেন অপেক্ষা করে। যদিও অনাহূতই বেশি। তিনি অবশ্য তা বুঝতে দেন না। যেন এদের জন্যই অপেক্ষা। তাঁর কাছে এসে কেউ বিরস বদনে ফিরে যায়, এমন কখনো দেখিনি।

(পৃ ৯০)

গোলাম মুরশিদের লেখায় কাছের বন্ধুর অবলোকনে ধরা পড়ে দূর-দিগমত্মাভিসারী মনোমানচিত্র। অনুচ্চ কণ্ঠে কিন্তু দৃঢ় অবিচল মেরুদ– যিনি আদর্শিক শুদ্ধতা বজায় রাখেন তাঁর সম্পর্কেই এমন উক্তি যথাযথ মনে হয় :

কট্টরবাদীরা যমদূতের মতো তাঁর চোখের সামনে যখন ধারালো তরবারি নাচাতে থাকে, তিনি অকম্পিতভাবে শিরদাঁড়া খাড়া রেখে তার মোকাবিলা করেন। অন্য যারা অনুরূপ হুমকির সম্মুখীন, তিনি তাদেরও সাহসের দৃষ্টান্ত দেখান।

(পৃ ১০৪)

জাহানারা নওশিন শুধু হাসান-সহোদরাই নন হাসান আজিজুল হক-গবেষকও বটে। এই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই ছোটগল্পে হাসান আজিজুল হকের জীবনসাধনা। তাঁর লেখায় আমরা পাই হাসানের শৈশব-কৈশোরের অমল-ধবল দৃশ্যের দেখা। তাঁর প্রবল পাঠতৃষ্ণার সূত্রমুখ যে গ্রামগহিনেই বোনা – সে সন্ধান মেলে একই শৈশব-কৈশোরের অংশী জাহানারার চুম্বকবাক্যে :

সেই অজপাড়াগাঁয়ে বসে আমরা কি যে পড়িনি সেইটাই ভাববার বিষয়।         (পৃ ১০৭)

হায়াৎ সাইফ ‘হাসান আজিজুল হক : ধ্রম্নপদ ও মৃত্তিকা’ প্রবন্ধে আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন এবং পাতালে হাসপাতালে গ্রন্থ তিনটির নিবিড় বিশেস্নষণ করেছেন। নিজ নিজ প্রবন্ধে তাঁর সমগ্র গল্পবিশ্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন ইজাজ হোসেন ও মশিউল আলমও। মশিউলের মিথকথায় স্পষ্ট হয় বাংলা গল্পে হাসানের দীর্ঘ ও স্থায়ী প্রভাবের বিষয়টি :

প্রায় একশ বছরের পথ অতিক্রম করে বাংলা ছোটগল্প আজ কী চেহারা পেয়েছে, তা দেখতে চাইলে অবশ্যই হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলোর দিকে তাকাতে হবে।

(পৃ ১৯৩)

‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পকে কেন্দ্র করে আর তাঁর একাত্তর স্মৃতিকে মিলিয়ে নাতিদীর্ঘ রচনায় প্রাবন্ধিক-গবেষক এবং হাসান আজিজুল হকের অধিকাংশ গল্পগ্রন্থের প্রকাশক মফিদুল হকের উদ্ঘাটন :

অল্প বাতাসে দুলে-ওঠা কলাপাতা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়; নিষ্ঠুর হত্যার শিকার নাম-পরিচয়বিহীন নারী নদীস্রোতে ভাসছে উপুড় হয়ে, পুরুষ ভাসছে চিৎ হয়ে, কখনো দেখা যায় বুক, কখনো-বা পিঠ। মিথকথনে অনন্য দক্ষতা হাসান আজিজুল হকের, তবে বর্ণনার বাহ্যিক সেই সংযমে পৌঁছতে অনেক কান্না অন্তরে ধারণ করতে হয় তাঁকে, পরমভাবে অনুভব করতে হয় মানুষের সুখ-দুঃখ বেদনা। হু হু ফোঁপানি শোনা যায় গল্পের শেষে, ক্ষোভ দুঃখ ক্রোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, বিলাপ ও ধিক্কার অনুরণন তোলে শেষ বাক্যে : ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?’ (পৃ ১৭১)

ফারুক মঈনউদ্দীন হাসানের একাত্তর স্মৃতিকথা নিয়ে, মোজাফ্ফর হোসেন স্মৃতিগদ্য নিয়ে, আবদুস সামাদ ফারুক আগুনপাখি এবং পিয়াস মজিদ সাবিত্রী উপাখ্যান উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। মুক্তগদ্যে হাসান-স্মৃতি ও ভাবনা বিধৃত করেছেন সুশান্ত মজুমদার, তাঁর অন্যতম অনুবাদক আলী আহমদ, খায়রুল আলম সবুজ, মোহিত কামাল, হামীম কামরুল হক, সৈয়দ কামরুল হাসান এবং সংকলনের সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।

রাজশাহীর সন্দীপন গোষ্ঠী এবং গণসাংস্কৃতিক পরিসরে হাসান আজিজুল হককে ব্যাখ্যা করেন রীআ মাহমুদ ‘তিনি আমাদের অভয়ারণ্য’ বলে; তাঁর লেখায় আমরা পাই রবীন্দ্র কবিতার পাঠাভিনেতা হাসান আজিজুল হক সম্পর্কিত দুর্লভ তথ্য। চন্দন আনোয়ার তাঁর সাহিত্যের অনিবার্য প্রবণতাগুলো অ্যাকাডেমিক রীতিতে শনাক্ত করেছেন ‘বিষয়-ঐশ্বর্যে অনন্য হাসান’ নামের রচনায়। তাঁর খুলনা-জীবন ভাস্বর হয়েছে সাধন ঘোষের ‘স্মৃতিগদ্যে’।

স্বকৃত নোমানের নেওয়া সাক্ষাৎকারের শেষাংশে পরিস্ফুট অসামান্য জীবনশিল্পী হাসান আজিজুল হক, যিনি বলেন তিনি ব্যক্তিজীবন নিয়ে তৃপ্ত কিন্তু লেখক হিসেবে অতৃপ্ত। এই অতৃপ্তিই তো তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে নিত্যনতুন সৃষ্টির দিকে, মানবকাঙিক্ষত অমৃতের সন্ধানে। মিজানুর রহমানকে লেখা হাসান আজিজুল হকের তিনটি চিঠি তাঁকে চেনায় পত্রপরিসরে; একজন সংবেদী মানুষ হিসেবে যে-কোনো আহবানে যিনি সাড়াশীল।

জীবনপঞ্জিতে ১৯৩৮-২০১৮ – এই আশি বছরের উজানমুখী জীবনের কালানুক্রমিক তথ্য বিন্যস্ত হয়েছে আর আলোকচিত্র-পর্বে বিশেষ করে তরুণদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় নৈকট্যের সত্য অনন্যরূপে উদ্ভাসিত।

তবে হাসানের অনন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা; যা বাংলা স্মৃতি কিংবা যুদ্ধসাহিত্যের অনন্য নিদর্শন, তাকে পাঠকের পাঠস্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনায় পরিশিষ্টে সংযুক্ত না করে কেন গ্রন্থের মধ্যভাগে তাঁকে নিয়ে লেখার সঙ্গে বিন্যস্ত করা হলো – তা বোধগম্য নয়। তবে যেখানেই সংযুক্ত হোক, এই স্মৃতিভাষ্যের এমন অভিজ্ঞান আমাদের ফিরে ফিরে নিয়ে চলে অমোঘ একাত্তরের দিকে :

আমার জানা ছিল না যে পানিতে ভাসিয়ে দিলে পুরুষের লাশ চিৎ হয়ে ভাসে, আর নারীর লাশ ভাসে উপুড় হয়ে। এই জ্ঞান আমি পাই ’৭১ সালের মার্চ মাসের একবারে শেষে।

 

তিন

হাসান আজিজুল হক : অতল জীবনে ডুব প্রবেশিকার কাজ করবে সেই হাসান আজিজুল হককে জানতে-বুঝতে যিনি মানুষের অতলে ডুব দিয়ে জীবনদর্শনের দুর্লভ মণিমাণিক্য কুড়িয়ে আনেন কথাশিল্পের ভাষা ও অনুভব-জালে। ভাটার বিরুদ্ধে আশি বছরের যে উজান-জীবন পরাস্ত মানুষের অপরাজেয় আখ্যান রচনা করে চলেছে – সেই হাসান আজিজুল হকের অতল, অকথিত কিছু দিকের উন্মোচক হিসেবে এই বই পাঠককে প্রিয় সঙ্গ দেবে নিশ্চিত।