বাংলা কাব্য-রূপান্তর : অসীম  সাহা

পঞ্চম পর্ব

নবম সর্গ

গীত

রাগ : রামকিরী ॥ তাল : যতি

অভিসারে হরি গেছে তোমার ঐ ঘরে।

এরচেয়ে কিসে সুখ, বলো সখি ওরে ॥

মাধবে করো না মান, হে অভিমানিনী!

তাল-ফল হতে এ যে অতি গুরুভার।

স্তন দুটি খুব বেশি সরস তোমার ॥

যতো কথা বলি, তাও মানো তুমি আধা।

হরি কী রুচির, তা কি জানো না গো রাধা।

ত্যাগ করার বাসনা – দাও তুমি বাধা ॥

কেন তুমি বিষাদিত, বলো ওগো নারী।

কেন তুমি কেঁদে কেঁদে মুখ করো ভারী।

যুবতী সখিরা হেসে যায় তাড়াতাড়ি ॥

শোনো মোর কথা শোনো তুমি একবার।

দূর করো মন থেকে যতো আছে ভার।

রবে না বিরহব্যথা কিছুতেই আর ॥

হরিকে আসতে দাও সাজসজ্জা করে।

শোনো তার মধুবাণী মনপ্রাণ ভরে।

কেন গো আকুল হও ত্যাগ করে ওরে ॥

                   জয়দেব বিরচিত লেখা।

                   শ্রীহরিকে রসময় দেখা

                   রসিকজনের হোক শেখা ॥

প্রিয়জনে কঠোরতা, উদাসীনে প্রীতি।

অনুরাগে বিমুখতা কেন তবে অতি ॥

বিপরীত আচরণ করো বলে দ্বন্দ্বে;

চন্দনও বিষ হয়, সূর্যতাপ চন্দে ॥

প্রেমে যন্ত্রণা হয়, তাপ হয় তুষারে।

নিজদোষে রাধা তোর আজ এ-দশা রে ॥

কৃষ্ণপায়ে মাথা নত করে প্রিয় ইন্দ্র;

মুকুটের মণি তার,

শোভা পায় যেন হার;

ভ্রমর সেখানে এসে পায় অরবিন্দ ॥

মন্দাকিনীর জলে কুমির খেলা করে।

গোবিন্দের পায়ে আমি বন্দি শ্রদ্ধাভরে ॥

দশম সর্গ

তাহার অন্তরে সেই রাধিকা সুন্দরী।

স্নিগ্ধ আবেশ তার, হৃদয়ে বেশ ধরি ॥

দীর্ঘশ্বাসে মুখ তার হয়েছে মলিন।

কৃষ্ণকে দেখতে মন হয়ে আসে ক্ষীণ ॥

তীব্র কামে অতিশয় পেয়ে সে যন্ত্রণা।

মনে মনে চিন্তা করে, হয় যে ভাবনা ॥

বারবার নিজ সখি পাঠালো সে-হরি।

শুনলো না রাধা-কথা অহংকার করি’ ॥

তাহাতে কৃষ্ণের মনে হলো খুব দুখ্।

গুণ নাই, ভেবে কৃষ্ণ হইলো বিমুখ ॥

এবার কী করি আমি, মনে চিন্তা লয়ে।

সখিমুখে চেয়ে থাকে, সে লজ্জিত হয়ে ॥

হঠাৎ রাধাকে দেখে কৃষ্ণ পেলো সুখ।

রাধার তো রাগ নেই – দেখে স্নিগ্ধ মুখ ॥

রাধার মনের ভাব অনুমান করে।

কালো মুখ করে এলো রাধা-কাছে সরে ॥

কাছে এসে কৃষ্ণ খুব আহ্লাদিত স্বরে।

মনের সকল কথা বলে রাধাতরে ॥

গীত

রাগ :  দেশবরাড়ী ॥ তাল : অষ্টক

          শোনো গো সুশীল প্রিয়, ত্যাগ করো মান।

          কামের আগুনে খুব পুড়ে যায় যতো ধূপ

                   দেহ চায় শুধু মধুপান ॥

          প্রিয়, যদি কিছু বলো  আলোকিত দাঁতগুলো

                   দূর করে অন্ধকার-ভয়।

          ওই ওষ্ঠসুধা হতে তোমার মুখ আলোতে

                    লোভী করে এই চক্ষুদ্বয় ॥

          আমার তো নাই রোষ       তবু যদি ধরো দোষ

                   ঘা দাও চোখের মাঝখানে।

          বেঁধে দুই হাত পাশে         আঘাতে আঘাত নাশে

                   কামবাণ যায় অন্যস্থানে ॥

          তুমি সেই জীবধন তুমি মোর আভরণ

                   তুমি রত্ন এ-ভুবনমাঝে।

          তুমি যেন প্রাণসম দুঃখ ঘুচাও মম

                   যা আমার এ-হৃদয়ে বাজে ॥

          সুনীল পদ্মের আভা তোমার চোখের শোভা

                    কেন তুমি লালপদ্ম হও।

          যদি এই কৃষ্ণ-অঙ্গ কামভাবে করে রঙ্গ

                   তবে তার শাস্তি তুমি লও ॥

          স্তনের ওপর কার  কম্পমান মণিহার

                   তাতে কার মন রাঙা হয়।

          তোমার জঘন থেকে     সব সখি একে একে

                   কামের ঘোষণা দিক – জয় ॥        

          স্থলপদ্মের সে-দল হয় অতিসুশীতল

                   রতিকাজে খুব শান্তি পায়।

          হৃদয়রঞ্জন মোর    সুন্দর দুই পা তোর

                   রঙ্গ করে বলে না রাধায়।

          তোর কচি পা দুখানি    কামবিষে জয় আনি

                   ভস্মসম দেহ রাখে শিরে।

          জ্বলছে বুকের ক্ষত কামুক সূর্যের মতো

                   শান্তি যদি তাতে নামে ধীরে ॥

          সঠিক বিচার ছাড়া দুঃখে করো দিশেহারা

                   বিচার করে রবে রে আফশোস।

          কবি জয়দেব বলে অভিমানী ভিন্ন ছলে

                   কৃষ্ণের ধরো না আর দোষ ॥

          প্রিয়াকে বলেন কৃষ্ণচন্দ্র পুনরায়।

          শান্ত হয়ে কেন ফের রাগ না ফুরায় ॥

          তুমি ভাবো, আমি করি অন্যজনে রতি।

          সে-শঙ্কা মন থেকে সরাও দ্রুত অতি ॥

          তোমার দারুণ স্তন, দারুণ জঘন।

          তাতেই আমার মন হয় যে চেতন ॥

          শুধু আছে কামদেব আমার অন্তরে।

          চুপে চুপে চলে গেছে হৃদয়ের ঘরে ॥

          কৃষ্ণ ছাড়া জেনো, কারো নেই কোনো গতি।

          এসেছে দুয়ারে, তার চিহ্ন আছে অতি ॥

          আমার কথায় যদি না করো বিশ্বাস।

          তবে তুমি দণ্ড দাও, যতোটুকু আশ ॥

          শোনো প্রিয়া, মোর প্রতি থাকে যদি ক্রোধ।

          দয়া করে দূর করো মনের বিরোধ ॥

          দাঁত দিয়ে করো তুমি নির্দয় দংশন।

          এর পরে দুই হাতে দাও হে বাঁধন ॥

          তোর দৃঢ় স্তন, তুই করিয়া পীড়ন।

          বারবার তোর ক্রোধ র্ক সংবরণ ॥

          অতিদুষ্ট কামদেব চণ্ডাল সমান।

          কালরূপে চোখে বিদ্ধ করে পঞ্চবাণ ॥

          সে-বাণে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ যেন না যায়।

          ক্রোধত্যাগে বের করে রাধা সে-উপায় ॥

          এমন কাণ্ডে মোর চঞ্চল হয় প্রাণ।

          তুমি এসে দুঃখ থেকে দাও পরিত্রাণ ॥

          তুমি যদি রাগ করো আরো একবার।

          তোমার যুগল ভুরু বাঁকাবে না আর ॥

          কালসাপ ভুরু দেখি অতি ভয়ংকর।

          যুবা আমি, মোহগ্রস্ত হই নিরন্তর ॥

          সেই সর্পভয় দূর করার যে যন্ত্র।

          তোমার ওষ্ঠের সুধা একমাত্র মন্ত্র ॥

          শোনো হে সুন্দরী, বলি তোমারে সে-কথা।

          চুপ করে দিয়ে মন, কেন দেহে ব্যথা ॥

          হেসে হেসে প্রিয় কথা বলো গো আমায়।

          আমার যন্ত্রণা যেন দূর হয়ে যায় ॥

          আমাকে তৃপ্ত করো মধুর কথা বলে।

          কৃপাদৃষ্টি দাও, যেন কষ্ট যায় চলে ॥

          বিমুখ হয়েছো কেন তুমি মোর প্রতি।

          আমাকে ছেড়ো না প্রিয়া, সুখী করো অতি ॥

          প্রিয়া আমি তোমার সামনে উপস্থিত।

          এ-ভক্তকে ত্যাগ করা হবে অনুচিত ॥

          যদি তুমি ত্যাগ করো ভক্তকে তোমার।

          তোমার মতো বোকা হবে না কেউ আর ॥

          বিস্মিত হয়ে রাধা দেখি আমি তোমায়।

          সকল বলবো আমি বিস্তৃত কথায় ॥

          পঞ্চশরের মতো কী করে কামবাণ।

          তোমার ঐ মুখে বিধি, করলো নির্মাণ ॥

          বান্ধুলির ফুল যেন তোমার অধর।

          মৌলফুলসম গান স্নিগ্ধ নিরন্তর ॥

          পদ্মফুলের মতো চোখ দুটি তোমার।

          কামবাণে বিশ্বজয় করে বারবার ॥

          আবেশ-জড়ানো তোর ও দুটি নয়ন।

          চাঁদের মতন মুখ, দেখে ভরে মন ॥

          তোমার চলার গতি খুব যে নরম।

          তোমার রতির খেলা অতি মনোরম ॥

          তোমার ঊরুর মতো এরকম ঊরু।

          চিত্রিত সুন্দর খুব, স্নিগ্ধ দুই ভুরু ॥

          শোনো প্রিয়া, কৃশ হয়ে তোমার কী বল।

          তোমার শরীরে আছে যুবতী সকল ॥

          খুবই আশ্চর্য কথা, সত্যিই কী চিত্র।

          পৃথিবীতে এসে পেলি দারুণ বিচিত্র ॥ (চলবে)