‘চাঁদটা কেন বাড়ে কমে…’

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

জোছনারাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভরা চাঁদকে দেখে মুগ্ধ হয়নি এরকম মানুষ

পৃথিবীতে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে, চাঁদ নিয়ে যদি খুব সহজ কয়েকটা প্রশ্নও করা যায়, দেখা যাবে বেশিরভাগ মানুষ মাথা চুলকাতে শুরম্ন করেছেন। বিশ্বাস না করলে এখনই পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে!

আমরা অনেকেই ভাসা-ভাসা জানি যে, পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয় চাঁদের আকর্ষণের জন্যে। চাঁদ যখন পৃথিবীর পানিকে আকর্ষণ করে পানিটা চাঁদের দিকে ফুলে ওঠে, আমরা সেটাকে বলি জোয়ার। পানি ফুলে ওঠার জন্যে পানি যেখান থেকে সরে যায় আমরা সেটাকে বলি ভাটা। আকাশের দিকে তাকালে আমরা দেখি, চাঁদের পৃথিবীটা ঘুরে আসতে মোটামুটি চবিবশ ঘণ্টা সময় লাগে – তাহলে প্রতি চবিবশ ঘণ্টায় একটা জোয়ার এবং একটা ভাটা হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা যারাই সমুদ্রের কাছাকাছি গিয়েছি, তারা সবাই জানি চবিবশ ঘণ্টায় দুটো জোয়ার এবং দুটো ভাটা হয়। কারণটা কী? কিংবা আরো সহজ প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমরা যখনই পূর্ণিমায় পুরো চাঁদটি দেখি তখন সবসময় চাঁদের একটা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠ দেখতে পাই, চাঁদের উলটো পিঠটা কখনো দেখি না। কিন্তু এটা সত্যি কথা যে, পৃথিবী যেরকম তার অক্ষে ঘুরছে (যেটার নাম আহ্নিক গতি), চাঁদ তার অক্ষে ঘুরছে; তাহলে কখনোই ঘুরমত্ম চাঁদের পুরোটুকু কেন দেখি না? কিংবা আরো সোজা প্রশ্ন করতে পারি, চন্দ্রগ্রহণ হয় পূর্ণিমাতে সূর্যগ্রহণ হয় অমাবস্যায় – তার কারণটা কী? কিংবা এর কাছাকাছি একটা প্রশ্ন, অমাবস্যার অদৃশ্য চাঁদ ধীরে-ধীরে বড় হয়ে কেমন করে পূর্ণিমার ভরা চাঁদ হয়, আবার পূর্ণিমার ভরা চাঁদ কেমন করে ছোট হতে-হতে একেবারে অদৃশ্য হয়ে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায়? যারা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে, তাদের এ-লেখাটি পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা জানে না, তারা যদি উত্তরগুলো জেনে নেয় তাহলে পরেরবার চাঁদের দিকে তাকালে তাদের মুগ্ধতা নিশ্চয়ই আরো অনেকগুণ বেড়ে যাবে!

প্রথম যে-বিষয়টা সবার জানতে হবে সেটি হচ্ছে, চাঁদ একটা গোলক এবং সেটা কখনো সরম্ন

হতে-হতে অদৃশ্য হয়ে যায় না। সেটা সবসময়েই গোলকই থাকে। যখন চাঁদের পিছন থেকে সূর্যের আলোটা এসে পড়ে সেটাকে দেখা যায় না, পাশ থেকে আলো পড়লে খানিকটা দেখা যায় আর সামনে থেকে আলো পড়লে পুরোটা দেখা যায়। তাই কোথা থেকে সূর্যের আলোটা আসছে তার ওপর নির্ভর করবে চাঁদটা কত বড় দেখাবে। বিষয়টা মোটামুটি কমনসেন্স, আলাদা করে বলে দেওয়ার হয়তো প্রয়োজন নেই; কিন্তু তারপরও বলে দেওয়া ভালো। কারণ অনেক রাষ্ট্র সেটা কখনো জানে না এবং তারা তাদের জাতীয় পতাকাকে কাসেত্মর মতো সরম্ন চাঁদ এবং তার পেটের মাঝে একটা তারা এঁকে রাখে – পাকিসত্মান হচ্ছে তার উদাহরণ, যেসব রাষ্ট্র একটু বিজ্ঞানমনস্ক তারা চাঁদটাকে গোলক হিসেবেই জানে এবং তারাটা কখনো চাঁদের পেটের ভেতর বসায় না – বাইরে বসায়। তুরস্কের জাতীয় পতাকা হচ্ছে তার উদাহরণ।

পৃথিবী থেকে আমরা কখনো-কখনো পুরো চাঁদকে দেখার সুযোগ পাই, কখনো আংশিক দেখার সুযোগ পাই, কখনো-কখনো একটুও দেখতে পাই না তার কারণ – চাঁদটা স্থির নয়, এটা পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। একটা স্কুলের ছেলে কিংবা মেয়েও হিসাব করে বের করে ফেলতে পারবে যে, চাঁদকে পৃথিবীটা পুরোপুরি ঘুরে আসতে সময় নেবে সাতাশ দিন। পৃথিবীটাও যেহেতু স্থির হয়ে নেই, সেটিও সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে তাই সেটা সরে যায়। এ কারণে চাঁদকে আরো খানিকটা বাড়তি দূরত্ব ঘুরতে হয়, তাই পৃথিবী থেকে আমাদের মনে হয় পুরো পৃথিবী ঘুরে আসতে চাঁদ সময় নেয় সাড়ে ঊনত্রিশ দিন।

পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদটা কেমন করে ঘোরে সেটা ১নং ছবিতে দেখানো হয়েছে। অমাবস্যার সময় চাঁদটা দেখার উপায় নেই। কারণ তখন চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে। তারপরও যদি কেউ চাঁদকে দেখার চেষ্টা করে সেটা করতে হবে দিনের বেলায়! পূর্ণিমার রাতে সূর্যের আলো পড়ে পুরোপুরি আলোকিত চাঁদের পৃষ্ঠটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে এবং সারারাত সেটা দেখা যায়।

ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালে আমরা আরো একটা মজার ব্যাপার দেখতে পাব। শুক্লপক্ষে (সরম্ন চাঁদটা যখন বড় হতে হতে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে যায়) চাঁদের ডান পাশ আলোকিত হয়। আবার কৃষ্ণপক্ষে (যখন পূর্ণিমার চাঁদ ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায়) পৃথিবীপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের মনে হবে, চাঁদের বাঁ-পাশটা আলোকিত হয়ে আছে। অর্থাৎ আমরা যদি নাও জানি তাহলেও আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে ডানদিক না বাঁদিক আলোকিত সেটি দেখে বলে দিতে পারব এটি কী শুক্লপক্ষ নাকি

কৃষ্ণপক্ষ।

১নং ছবিটার দিকে তাকালে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাব, কেন সূর্যগ্রহণ হয় অমাবস্যায় আর চন্দ্রগ্রহণ হয় পূর্ণিমায়। কারণ অমাবস্যার দিনের বেলাতেই একটা চাঁদ সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে এসে সূর্যটাকে আড়াল করে দিতে পারে – অন্য কখনো না। আবার পূর্ণিমার সময়েই শুধুমাত্র পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়ে একটা চন্দ্রগ্রহণ করতে পারে, অন্য কখনো না। সোজা বিষয়গুলো শেষ হয়েছে, এবারে একটু জটিল বিষয়ে যাওয়া যাক। আমরা সব সময়েই শুধু চাঁদের একটা পৃষ্ঠ দেখি, অন্য পৃষ্ঠটি কখনো দেখি না, কারণটা কী? খুবই সহজে বলে দেওয়া যায়, চাঁদটা যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে – এটা সব সময়েই তার একটা পৃষ্ঠে পৃথিবীর দিকে মুখ করে করে রাখে। কাজেই তার অন্য পৃষ্ঠটা দেখার সুযোগ নেই।

কথাটি সত্যি, কিন্তু তখন আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নটি করতে হয় – চাঁদের এরকম ব্যবহার কী একটা কাকতালীয় ঘটনা, নাকি এটাই নিয়ম?

প্রশ্নটার উত্তর জানতে হলে আমাদের অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকাতে হবে এবং যদি সেটা করি তাহলে আমরা আবিষ্কার করব, এটা আসলে কাকতালীয় ঘটনা নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের জগতে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। একটু চিমত্মা করলেই বোঝা যাবে কেন এটি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। চাঁদ যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে তখন সেটি পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বল অনুভব করে, অর্থাৎ চাঁদের বিভিন্ন অংশকে পৃথিবী তার নিজের দিকে টানতে থাকে। নিউটন বলে বেরোচ্ছেন মধ্যাকর্ষণ বল দূরত্বের ওপর নির্ভর করে (দূরত্ব দ্বিগুণ হলে বল চারগুণ কমে যায়) কাজেই চাঁদের যে-অংশ পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে, সে-অংশটিকে পৃথিবী বেশি আকর্ষণ করে এবং পিছনের অংশকে আকর্ষণ করে কম। একই চাঁদের এক অংশকে যদি অন্য অংশের তুলনায় জোরে টেনে ধরে রাখা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে তার ঘুরপাক খেতে সমস্যা হতে থাকে। এক সময় চাঁদ নিজের অক্ষে ঘুরপাক খেত এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের সব অংশই দেখা যেত; কিন্তু পৃথিবীর এই কাছের অংশকে পিছনের অংশ থেকে জোরে টেনে ধরার কারণে এর ঘুরপাক থেমে যেতে শুরম্ন করে এবং ধীরে-ধীরে একেবারেই থেমে গিয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায়! এখন চাঁদের একটা অংশ সবসময় পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে (এবং এর ওপর পৃথিবীর টান বেশি) কাজেই অন্য অংশ সব সময় পিছনে থাকে (তার ওপর পৃথিবীর টান কম) এবং আমরা সেটা কখনো দেখতে পাই না।

এবারে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটাতে আসা থাক। ২নং ছবিতে পৃথিবী এবং চাঁদকে দেখানো হয়েছে। (বোঝানোর জন্যে সব কিছুই একটু বেশি করে অাঁকা হয়েছে, মাপ ঠিক নেই আগে থেকে বলে রাখা হলো।) পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবী যেরকম চাঁদকে আকর্ষণ কওে, চাঁদও ঠিক একইভাবে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। চাঁদের আকর্ষণে আমাদের হাত থেকে কলম বা বই ছুটে চাঁদের দিকে চলে যায় না সত্যি; কিন্তু পৃথিবীর পানি সেটা অনুভব করে গড়িয়ে চাঁদের দিকে হাজির হয়। আমাদের কমনসেন্স বলে, চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীর সমুদ্র মহাসমুদ্রের পানি চাঁদের দিকে হাজির হওয়ার কারণে পৃথিবীর একটি পৃষ্ঠের পানি ফুলে উঠবে এবং অন্য পৃষ্ঠের পানি কমে আসবে। ২নং ছবির ওপরে সেটা দেখানো হয়েছে অর্থাৎ পৃথিবীর এক পৃষ্ঠে হবে যখন জোয়ার, তখন অন্য পৃষ্ঠে হবে ভাটা।

কিন্তু বাসত্মবে সেটি ঘটে না এবং যেটি ঘটে, সেটি নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে। এর কারণটাও বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন। নিচের ছবিটায় পৃথিবীকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। ডানদিকের পানি, মাঝখানের কঠিন পৃথিবী এবং বাঁদিকের পানি। আমরা আগেই বলেছি, মধ্যাকর্ষণ বল দূরত্বের ওপর নির্ভর করে, তাই চাঁদ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তার কাছাকাছি থাকা ডানদিকের পানিকে। তার চাইতে কম বলে আকর্ষণ করে মাঝখানের পৃথিবীকে এবং সবচেয়ে কম বলে আকর্ষণ করে পৃথিবীর বাঁ-পাশের পানিকে। কাজেই চাঁদের সবচেয়ে কাছে চলে যায় চাঁদের পৃষ্ঠের কাছাকাছি পানি – তার চাইতে কম কাছাকাছি যায় কঠিন পৃথিবী এবং তার চাইতেও কম কাছাকাছি যায় আরেকটু দূরে থাকা বাঁ-পাশের পানি। তাই আমরা দেখতে পাই একই সঙ্গে পৃথিবীর দুই পাশে জোয়ার এবং দুই পাশে ভাটা। অর্থাৎ চবিবশ ঘণ্টায় একটি জোয়ার এবং একটি ভাটা না হয়ে পৃথিবীতে আমরা দেখি দুটি জোয়ার এবং দুটি ভাটা!

আমরা পৃথিবীর মানুষ শুধু চাঁদের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হই না – জোয়ার-ভাটাকে ব্যবহার করে নদী আর সমুদ্রে চলাচলও করি। কেউ কী কখনো ভেবে দেখেছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে থেকেও এই চাঁদ কীভাবে আমাদের নৌকাকে জোয়ারের পানিতে তরতর করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়?