চিত্রপটে চিরকালের বনলতা

কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে বাঙালি চিনেছে তাঁকে। চোখের দেখায় নয় – কবিতার পঙ্ক্তিতে মননের ভেতরে গেঁথে যাওয়া চিরকালের এক তরুণী – বনলতা সেন। তিনি কোথায় আছেন বা ছিলেন সে নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলোচনা আছে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাবজাত অনুসন্ধিৎসু মনের ভেতর তাঁর অস্তিত্ব বিরাজমান। কবির কল্পনার সীমানা পেরিয়ে তিনি বিস্তৃত হয়েছেন শিল্পের পরিসরে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মতো বাঙালি মানসের চিরকালের প্রেমিকা হয়ে উঠেছেন বনলতা।

বঙ্গললনার সেই স্নিগ্ধ রূপময়তার প্রতীক হয়ে-ওঠা বনলতাকে রেখাচিত্রে বোধকরি প্রথম তুলে এনেছিলেন শিল্পী সত্যজিৎ রায় কলকাতার সিগনেট প্রেস-প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেনের প্রচ্ছদচিত্র দিয়ে। কলমের ঋজুরেখার অলংকারে প্রাচ্যনারীর সাবলীল সৌন্দর্যকে কবি-কল্পিত বিবরণের সঙ্গে শিল্পীর স্বকীয়তার অনুরণনে অনবদ্য রূপে তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ। পরে বনলতাকে চোখের সামনে তুলে আনার প্রয়াস একেবারে কম হয়নি। তবে সিরিজ-চিত্রে ধারাবাহিকভাবে দর্শকদের সামনে তাঁকে নিয়ে এলেন শিল্পী অধ্যাপক সুশান্ত কুমার অধিকারী।

ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গ্যালারিতে গত ৯ জুলাই সোমবার থেকে ১৫ জুলাই ২০১৮ রোববার পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ-প্রদর্শনীতে শিল্পীর  ৩৭টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এগুলো গত চার বছরে আঁকা। জলরং, মিশ্রমাধ্যম ও টেম্পেরা মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন শিল্পী। তাঁর এই প্রথম একক চিত্র-প্রদর্শনীর শিরোনাম – ‘বনলতা’। এর পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের আরো কিছু নারীচরিত্র চলে এসেছে শিল্পীর চিত্রপটে। তারা হলেন – রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, কেটি, কৃষ্ণকলি, নজরুলের নার্গিস, জীবনানন্দের সুরঞ্জনা, শ্যামলী ইত্যাদি।

বঙ্গললনার রূপমাধুর্যে মজেননি এমন শিল্পী এদেশে পাওয়া যাবে না। আমাদের গুরুশিল্পী জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের চিত্রপটে গ্রামীণ বাঙালি নারীর লাবণ্যময় উপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করি। জয়নুলের নারী কর্মব্যস্ত ও সৌন্দর্যচর্চায় কান্তিময়। কামরুলের ললনা রূপবতী ও দেহজ-সৌন্দর্যে কমনীয়। সুশান্তের নারীরা এই দুয়ের মাঝামাঝি দর্শনীয় ও নন্দিত। শিল্পীর বর্ণপ্রয়োগেও আমাদের দেহজ শ্যামলতা। তিনি প্রাচ্যনারীর অবয়বের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মোনালিসাকে তুলে এনে নারীর শাশ্বত সৌন্দর্যকে অনুভবের প্রয়াস পেয়েছেন।

কাগজের বুকে ওয়াশ, টেম্পেরা ও গ্লাস পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে শিল্পী সুশান্ত বনলতাকে এঁকেছেন এবং বাঙালি মানসের এই নায়িকাকে কখনো চিরকালীন, কখনো সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। চলনবিলের ধারে একা বনলতা, গাছের পাশে দূরদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে কারো অপেক্ষা করা, গ্রন্থাগারে বসে থাকা, নাটোরে ফেরা, অনুষ্ঠানে গান করা – এসব ছবির বিষয় চিরকালীন। অন্যদিকে সমকালীন জীবন ও বিষয় উঠে এসেছে শিল্পীর নানা চিত্রকর্মে। যেমন – রেনেসাঁসের শিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর গড়া ভাস্কর্য দাভিদকে অনুশীলন করছেন বনলতাসহ একদল শিল্পশিক্ষার্থী। আরেকটি কাজে সপুত্র বনলতাকে দেখা গেল জাপানের এক চিত্রশালায় সেদেশের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকর্ম অবলোকনরত। কম্পিউটারের পর্দায় অন্তর্জালের মাধ্যমে পিকাসোর আঁকা নারীচিত্র খুঁজে দেখায় মনোযোগী বনলতা যেন একালের শিক্ষিত নারীর অবয়ব। চিত্রাপাড়ের মোনালিসা কিংবা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে দর্শনার্থীদের ভেতরেও কি বনলতার অনুসন্ধিৎসু অবয়ব!

জীবনানন্দ দাশের বনলতা চিরকালের। সুশান্ত সেই শাশ্বত রূপের বনলতাকে সেই বৃত্তে আবদ্ধ না রেখে তাঁকে তাঁর নিজের সময়ের সঙ্গে তুলনা করে – চরিত্রটিকে সর্বকালের মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর আদর্শরূপে দর্শকদের সামনে সযতেœ নিয়ে এসেছেন। সুশান্তর বনলতা জীবনানন্দের কল্পিত বনলতা হয়েও রূপে তিনি যেন বতিচেল্লির ভেনাস, রহস্যময়তায় ভিঞ্চির মোনালিসা, চারিত্রিক দৃঢ়তায় রামায়ণের সীতা, ধীশক্তিতে কালিদাসের শকুন্তলা, দৃষ্টির গভীরতায় রবীন্দ্রনাথের     কৃষ্ণকলি, প্রেমে নজরুলের নার্গিস।

অবনীন্দ্রনাথ ওয়াশ টেকনিকে বেঙ্গল স্কুলের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর ছাত্র নন্দলাল বিশ্বভারতীর কলাভবনে গিয়ে ওয়াশ টেকনিকের পাশাপাশি ওপেক রঙেও ছবি এঁকে প্রাচ্যশিল্পকে ঋদ্ধ করেছেন। শিল্পী সুশান্ত অধিকারী-প্রচলিত জলরঙের পদ্ধতি পরিহার করে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বতন্ত্র এক চিত্রগঠন পদ্ধতি উদ্ঘাটন করেছেন, যেটি গুরু অবনীন্দ্রনাথ ও শিষ্য নন্দলালের সৃজনের অনুষঙ্গের নবরূপ বলে দর্শকের মনে হবে।

বনলতা জীবনানন্দের প্রেম। এর স্বাক্ষ শিল্পী রেখেছেন তাঁর একটি চিত্রকর্মে। বনলতা এখানে শিল্পের শিক্ষার্থী, তাঁর হাতে ধরা স্কেচ খাতায় জীবনানন্দের প্রতিকৃতি। পরক্ষণেই আমরা আরেকটি ছবিতে আবিষ্কার করি, শিল্পী স্বয়ং বনলতার প্রেমিকরূপে ধরা দিয়েছেন। প্রেম সব কালে সব যুগে বিরাজমান। সময়ের নিরিখে শুধু বদলে যায় পাত্রপাত্রী। মানুষ মরণশীল বটে, প্রেম বেঁচে থাকে সর্বদা। সেই প্রেম নিয়েই শিল্পী তাকিয়েছেন বনলতার দিকে। শিল্পীর হাত ধরে ভালোবাসার দৃষ্টিতে কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে দর্শককেও তাকাতে হয়েছে তাঁর সৃজিত বনলতা ও অন্যান্য চরিত্রের দিকে। ফলে শিল্পী সুশান্ত অধিকারীর সৃজনভাবনার সঙ্গে শিল্পের দর্শক ও বোদ্ধাদের দৃষ্টি আর মননের মেলবন্ধন ঘটেছে এ-প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এখানেই শিল্পীর এ-আয়োজনের সার্থকতা।