চিত্রশিল্পী মাহমুদুল হক

শিল্পী মাহমুদুল হক, এদেশের একজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এবং প্রিন্টমেকার। গত ১১ই জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নেন। আমি আমার একজন ঘনিষ্ঠজন এবং বন্ধুকে হারাই। ১৯৬৩ সালে আমরা চারুকলায় একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম। মাহমুদের একটা বড় গুণ ছিল, খুব সহজেই যে কাউকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা। যতদিন গেছে আমরা ততই আপন হয়েছি। ১৯৬৩ থেকে ২০২২ একটা বিরাট সময়। চারুকলার শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে চারুকলায় শিক্ষকতার ৪৫ বছর আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি, যার সবই এখন শুধু স্মৃতি। এই স্মৃতি নিয়েই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটবে। আনন্দের-দুঃখের-ভালোবাসার কত স্মৃতি রয়েছে, সেগুলোই শুধু চোখের সামনে ভাসবে।

১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আমরা তখনো চারুকলার ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগের ছাত্র। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, আমাকে আর মাহমুদকে একটা প্রিন্টমেকিং ওয়ার্কশপের জন্যে নির্বাচন করা হয়েছে। পাকিস্তানের (করাচির) আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে এই ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হবে। তিন মাস ধরে এই ওয়ার্কশপ চলবে। বিখ্যাত আমেরিকান প্রিন্টমেকার মাইকেল পন্স-ভি-লিয়ন এই ওয়ার্কশপটি পরিচালনা করবেন। চারুকলার পক্ষ থেকে আমাদের মনোনীত করা হয়েছে। আমাদের কাছে যা ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। করাচিতে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব শিল্পী ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছেন তাঁরা সবাই বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক বড়। পাকিস্তানের নামিদামি সব শিল্পী। মাইকেল পন্স-ভি-লিয়ন একজন মজার মানুষ ছিলেন। তিনটে মাস কাজে-কর্মে-আনন্দে যে কীভাবে কেটে গেল আমরাও বলতে পারবো না। আমাদের সবার কাজ নিয়ে আমেরিকান সেন্টারে একটা প্রদর্শনীও হয়েছিল। প্রদর্শনী দেখতে করাচির অনেক নামী ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন দূতাবাসের লোকজনও এসেছিলেন।

এরপর ১৯৬৮-তে আমরা চারুকলার শিক্ষা শেষ করে বের হলাম। ১৯৬৯-এ মাহমুদ চারুকলায় শিক্ষক হিসেবে আর আমি ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশনে সিনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে চাকরিতে যোগদান করি। এই সময়েই মাহমুদ শিখা ভাবিকে বিয়ে করে। শুক্রাবাদের একটা ছোট্ট বাসায় নতুন সংসারের শুরু। মাহমুদ আর আমার সম্পর্কটা এতোই গভীর এবং আপন ছিল যে, যে-কোনো সময় নির্দ্বিধায় মাহমুদের বাসায় গেছি, সময় নিয়ে ভাবতে হয়নি। এরপর মাহমুদ বাসা পাল্টে হাতিরপুলে চলে আসে। তখন হাতিরপুলে বেশ কয়েকজন শিল্পী থাকতেন। ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্যে আগরতলায় চলে যাই। এরপর বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসেছি। বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে। আগস্ট মাসের শেষের দিকে আমরা চারজন মুক্তিযোদ্ধা বহু অস্ত্রশস্ত্রত্রসহ ঢাকায় আসি। আমরা ঢাকায় ঢোকার কয়েকদিন পরেই ঢাকার বেশ কয়েকটি বাসায় (প্রায় নয়টি) পাকিস্তান আর্মি হামলা চালায়। ভাষাসৈনিক আলতাফ মাহমুদের বাসায় ২৯ তারিখ ভোরে হামলা চালায়। শুধু ওই বাসাই নয়, আশপাশের কয়েকটা বাসার ছেলেদের, আমাকেও নাখালপাড়ার মার্শাল ল’ কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকদিন নির্যাতনের পর যখন ছাড়া পাই আমার দাঁড়াতে, চলতে, ফিরতে খুব কষ্ট হতো। হাতের আঙুলগুলো ভেঙে গিয়েছিল। পুরো হাত ফুলে ঢোল। দু-একদিন পরপর বাসা পাল্টে একেক জায়গায় থাকি। সেই সময় দু-তিনদিন মাহমুদের হাতিরপুলের বাসাতেও থেকেছি।

স্বাধীনতার পর আমি ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশনের চাকরি ছেড়ে চারুকলার প্রিন্টমেকিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। ১৯৮১-তে মাহমুদুল হক জাপান সরকারের ‘মোম্বুশো’ স্কলারশিপ নিয়ে সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। আমি ১৯৮৩-তে একই স্কলারশিপে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই। পরের বছর একসঙ্গেই দেশে ফিরি। প্রায় দেড় বছর আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। জাপানের বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে ঘুরেছি। প্রতিটি কাজে তার সহযোগিতার কথা কোনো দিন ভুলতে পারবো না।

শিল্পী মাহমুদুল হকের জন্ম রামপালের শ্রীফলতলায় ১৯৪৫ সালে। স্ত্রী শিখা মাহমুদ, কন্যা শিমিন ও পুত্র শাহাদাতকে নিয়ে তার সংসার। মাহমুদ আজিমপুর কলোনিতে যখন ওঠে আমি তখন আজিমপুর রোডে থাকি। আজিমপুর রোড থেকে বেরোলেই মাহমুদের বাসা। দিনে-রাতে প্রতিদিন কয়েকবার দেখা হয়।

শিল্পী মাহমুদুল হক শুধু শিক্ষকতাই করেনি। চারুকলা যখন ইনস্টিটিউট ছিল তখন তিন বছর পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্ব পালনসহ এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের প্রধান কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেছে ২০০৬ সালে।

১৯৯৪-৯৫-এ জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৩-এ ইনডাস ভ্যালি স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড আর্কিটেকচার, করাচি, পাকিস্তানে, ১৯৯৮-এ আমেরিকার নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করে। ১৯৮২-তে সুচিউরা সিটির বেস্ট পেইন্টিং অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯২-তে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১০ম জাতীয় চিত্র-প্রদর্শনী, অনারেবল মেনশান পুরস্কার ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৭ সালে এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল পুরস্কার, ১৯৯৪ পারচেজ পুরস্কার ললিতকলা একাডেমি, ইন্ডিয়া, ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় পুরস্কার ১২তম কুয়েত আন্তর্জাতিক বিয়েনাল এবং ২০০৬-এ এস এম সুলতান পদক উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে জাপানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘অর্ডার অব রাইজিং সান’ অর্জন।

এছাড়াও দেশে এবং বিদেশে বহু গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ রয়েছে, যার সংখ্যা পঞ্চাশের ওপর হবে।