মাহমুদুল হক : তাঁর বিমূর্ত শিল্পভুবন

বাংলাদেশের সমকালীন বিমূর্ত শিল্পকলার অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি শিল্পী মাহমুদুল হক ষাটের দশকের শেষার্ধে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তাঁর চিত্রকলায় যেমন সমকালীন বৈশিষ্ট্যকে সার্থকভাবে ধারণ করেছেন, তেমনি যুগপৎ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্কর একটি শিল্পভুবন নির্মাণেও সমর্থ হয়েছেন।

মাহমুদুল হক পেইন্টিং এবং ছাপচিত্র – উভয় মাধ্যমে বিমূর্তরীতিকে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ তেলরঙের ছবিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছেন নিপুণভাবে। এক্ষেত্রে রং, রেখা এবং কিছু কিছু ফর্ম তুলে এনেছেন তিনি বাংলার নিসর্গ থেকে। নিসর্গকে ব্যবহার করেছেন রূপকল্প তৈরিতে। সেসব কাজ থেকে মনে হয়, মাহমুদুল হক নিসর্গাশ্রয়ী শিল্পী। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর পেইন্টিংয়ে ওপর থেকে প্রত্যক্ষ করা ক্ষেতখামার, সামনাসামনি দৃশ্যমান গ্রাম, বৃক্ষের পরিপূর্ণ আকার-আকৃতি আধাবিমূর্ত ফর্মে উপস্থাপিত। অনেকে এসব চিত্রকর্মে ফর্ম কিংবা রং দুটোকেই সহজ ও সংক্ষেপ করার প্রবণতা লক্ষ করেছেন। এসব চিত্রকর্মে তিনি মূলত ব্যবহার করেন হালকা নীল, হালকা বেগুনি, হলুদ ও সাদায় মেশানো আভা, থাকে মেরুন-নীল-সবুজের কারুকাজ। চমৎকার এক রোমান্টিক আবহে রঙের এসব কারুকাজে, সমন্বয়ে তাঁর নিসর্গাশ্রয়ী চিত্রকর্মগুলো দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে।

মাহমুদুল হকের বড় পরিচয় তিনি একজন সার্থক ছাপচিত্রকর। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮২ থেকে ’৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাপানে ছাপচিত্রে উচ্চশিক্ষা নেন এবং সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনাও করেছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ছাপচিত্রকর মাইকেল পন্স-দ্য-লিঁয় এবং জাপানের শিরাকিতা শিইউকির কাছে ছাপচিত্রের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চয়ই তাঁর ছাপচিত্রে দক্ষতা অর্জন ও সাফল্য লাভের পেছনে ভূমিকা  রেখেছে। ছাপাই কাজের বেশকিছু শক্ত ও দুর্লভ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন মাহমুদুল হক। বিষয়টি নিয়ে তিনি উল্লে­খযোগ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। এই মাধ্যমে তিনি সাদা-কালো রং নিয়ে কাজ করেছেন। জাপানে ছাপচিত্রের ওপর ডিগ্রি নেওয়ার সময় এবং পরবর্তীকালেও তিনি এ-ধরনের বহু কাজ করেছেন। কারো কারো বিশ্বাস, তাঁর চিত্রকর্মে পরিস্ফুটিত সূক্ষ্ম বুনন, বিন্যাস এবং একই রকম সূক্ষ্ম রেখার ব্যবহার জাপানের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। তাঁর ছাপচিত্রে বিন্যস্ত রঙের অতল খুঁড়ে উপস্থাপিত অবয়ব ও অর্ধ বা প্রায় অবয়বগুলো বিশেষ দক্ষতার পরিচয়বাহী।

এটি মাহমুদুল হকের একটি উল্লে­খযোগ্য দিক যে, তাঁর কিছু চিত্রকর্মে জ্যামিতিক রেখার মধ্যে ফিগার আসে; কিন্তু রঙের ঔজ্জ্বল্য নেই। এই অনুজ্জ্বল দশার মধ্যে রেখা ও ফিগার এক আশ্চর্য সমন্বয় ও সুষমা তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘জানালা’ শীর্ষক ছাপচিত্রটির কথা উল্লেখ করা যায় (হাশেম খান-রচিত চারুকলাপাঠ গ্রন্থে প্রকাশিত)। ছাপচিত্রটিতে সাদা-কালোর জানালা ঘিরে সাদা-কালোয় প্রকৃতি – আবার ছবিটি জুড়ে যেনবা ফিকে হলুদ আলো।

মাহমুদুল হক অধিকাংশ বিমূর্ত রীতির ছবিতে পাথরের ফর্মকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেছেন তাঁর ছাপাই কাজের কম্পোজিশন। এটিও তাঁর একটি বিশেষ উল্লে­খযোগ্য দিক। পশ্চাৎভাগে সম্পূর্ণ কালো দেখিয়ে সাদা বা কালোরই হালকা কোনো ছায়ার মাধ্যমে ছবির কম্পোজিশন হয়েছে। পাথরের সঙ্গে পাথর কিংবা এর পাশে, তার নিচেও পাথর। এভাবেই শিল্পীর ব্যালান্স তৈরির প্রয়াস। এসব ছবিতে তিনি যেমন সাফল্য দেখিয়েছেন, তেমনি তা দৃষ্টিনন্দনও হয়ে উঠেছে।

তিনি কিছু উল্লে­খযোগ্য কাজ করেছেন ভাস্কর্যধর্মী ফর্মকে ব্যবহার করে। প্রায় তিনশো বছরের প্রচীন এই মাধ্যমটিতে যে এখনো কাজ হচ্ছে এবং  আধুনিক ফর্মের চমৎকার শিল্প সৃষ্টি সম্ভব, তার উজ্জ্বল উদাহরণ মাহমুদুল হকের এসব ছবি। টোনালিটির এক বিস্ময়কর পরিবেশ রচনা করে মাধ্যমটির সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছেন তিনি।

মাহমুদুল হক তাঁর অনেক ছাপচিত্রে শুধু সাদা-কালোয় বিস্ময়কর আবেদন তৈরি করেছেন। মাধ্যমটি অত্যন্ত টেকনিক্যাল হওয়ায় এর সঙ্গে বাস্তব পরিচয় নেই এমন কারো পক্ষে এই মাধ্যমে তাঁর সাফল্য নির্ণয় প্রায় অসম্ভব। তবে তাঁর সাদা-কালোর ছাপাই চিত্রের আবেদন যে গভীর, তার প্রমাণ, এ নিয়ে অনেক শিল্প-সমালোচকই প্রশংসা করেছেন এবং তা বহু আগে থেকেই (যেমন নজরুল ইসলাম, দৈনিক সংবাদ, ২২ আষাঢ় ১৩৯৫)। উদাহরণস্বরূপ তাঁর একটি ছোটমাপের ছাপচিত্র ‘ঝড়’ (৫৬ নম্বর চিত্র)-এর কথা উল্লে­­খ করা যায়। এর ৫৩ নম্বর প্রিন্টটিও অত্যন্ত চমৎকার।

মাহমুদুল হকের আঁকা তিনটি উল্লে­খযোগ্য বিমূর্ত ছবি Horizan, Imege of a wall, Blue and Black। দেয়ালকে উপজীব্য বা পটভূমি করে অনেকে অনেক ছবি এঁকেছেন; কিন্তু মাহমুদুল হকের আঁকা Image of a wall স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। তিনি দেয়ালকে এখানে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। এখানে হাজার বছরের ইতিহাস উজ্জ্বল ও সতেজ বর্ণের মধ্য দিয়ে কালোর হালকা টানে চিত্রিত। তাতে সংঘর্ষ, স্থিতাবস্থা, জীবন-বাঁকের পদচিহ্ন মেলে। Horizon-এ মনে হয় শিল্পী প্রথাগত ভারসাম্য আঁকার পক্ষপাতী নন। এর কোথাও কোথাও সুস্থিরতার ছাপ দেখা গেলেও গতির বিষয়টি মনে বিশেষ ছাপ ফেলে। Blue and Black–এ দেখা যায় সবুজ, সাদাসহ অনেক রঙের মিশেলে বর্ণের সমৃদ্ধি ও সমন্বয়। এভাবে মাহমুদুল হক রঙের যে-নিপুণ লীলা দেখান তা অনন্য এবং বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবিদার।

আমরা তাঁর সবুজ বর্ণে পাই নিসর্গের অপার সৌন্দর্য, অসীম নীলে পাই আকাশ। যে-আকাশ আসলে জীবনেরই অনিবার্য অংশ। তেমনি সাদায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ফেনা বা পর্বত শিখরের বরফও জীবনের সৌন্দর্য পিপাসার গন্তব্য। এভাবে মূর্ততা থেকে দূরে বলে মাহমুদুল হক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নন। বস্তুত তা জীবনেরই জয়গানে মুখর। এসব ছবির মধ্যে অনেক ছবিই তাঁর বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারার। ‘বৃষ্টি-২’ যার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এর নিবিড়, নিমগ্ন গতি মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

অনেকে মাহমুদুল হককে প্রধানত বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারার একজন শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাশ্চাত্য শিল্পকলার প্রধান ধারা হয়ে ওঠে বিমূর্ত প্রকাশবাদ। তার বিশেষ প্রভাব পড়ে এশীয় চিত্রকলায়ও। বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এই প্রভাববলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারায় অজস্র সার্থক শিল্প সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল বাসেত, দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রমুখ অগ্রগণ্য ও বিশেষ উল্লে­খের দাবিদার। পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারায় দক্ষতা ও সাফল্য দেখান, তাঁদের অন্যতম প্রতিনিধি মাহমুদুল হক। অগ্রজ শিল্পীদের অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তা-চেতনার জগৎকে নিশ্চয়ই সমৃদ্ধ করেছে, পাশাপাশি তিনি তাঁর পেইন্টিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ নিয়েছেন বিশ্বখ্যাত শিল্পী ফ্রাঞ্জ ক্লাইন, মার্ক রথকো, আর্শিল গোর্কি, ফিলিপ গাস্টন, ক্ল্যাফোর্ড স্টিল, পল ক্লি’র রীতি থেকে। তবে তিনি সুকৌশলে সেসব শিল্পীর প্রভাবমুক্ত একটি স্বতন্ত্র শিল্পভুবন নির্মাণ করেন।

মাহমুদুল হকের বিমূর্ত প্রকাশবাদী রীতির যেসব ছবি শিল্প-সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় তার মধ্যে ‘বৃষ্টি-২’, ‘গোধূলি’, ‘অনেক বৃষ্টির পরে’ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ঝড়ো হাওয়ায় আন্দোলিত দিগন্ত আর বৃষ্টিস্নাত নিসর্গ থেকে যেন তিনি চিত্রকল্প ধার করে ব্যবহার করেন সুকৌশলে; অর্ধবিমূর্ত যুগপৎ ইঙ্গিতময় অবয়ব এক্ষেত্রে তিনি অর্থময় করেন অভিজ্ঞতার পুঁজি দিয়ে। তাঁর ‘গোধূলি’ একটি বড় আয়তনের পেইন্টিং। ছবিটিতে তিনি চমৎকার এক নৈসর্গিক আবহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন। এখানে নিসর্গ থেকেই শিল্পী তুলে এনেছেন রং, রেখা আর ফর্ম। গোধূলির ধূলিধূসর পরিবেশ এখানে মূর্ত। কম্পোজিশনের ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য ছবিটিতে আছে উল্লম্ব ও আনুভূমিক রঙের লম্বাটে বা আয়তাকার জমিন। সবমিলিয়ে শিল্পীর এক সার্থক সৃষ্টি এটি। তাঁর একই ঘরানার ‘অনেক বৃষ্টির পরে’ ছবিটি আরো বেশি বিমূর্ত। এর টেক্সচারও সুনির্মিত। তার ঘন মিশ্র সবুজ রং আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ প্রাণ ছুঁয়ে যায়। ছবিটির শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় এটি আরো বেশি আবেগ দিয়ে, দরদ দিয়ে আঁকা। উল্লিখিত এসব বৈশিষ্ট্যের বিকাশের মধ্য দিয়ে মাহমুদুল হক হয়ে ওঠেন একজন সম্পন্ন বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী বা অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী।

মাহমুদুল হকের চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর যেসব শিল্পকর্মের কথা বিশেষভাবে আসে সেগুলো হচ্ছে : ‘একাকিত্ব’ (তেলরং, ৫৬´৭১ সেমি, ২০০১); ‘লাল ও কালো’ (অ্যাক্রিলিক, ৫৬´৭১), ‘জানালা-১’ (তেলরং, ৭৫´১৫০), ‘জানালা-২’ (তেলরং, ৭৫´১৫০), ‘তিন মহিলা’ (তেলরং, ৬১´৭৩), ‘সাদা ও নীলের মাঝে’ (তেলরং, ৭৩´৬১), ‘বিমূর্ত চিন্তা’ (তেলরং, ৯০´৯০), ‘কালো ও খয়েরি’ (তেলরং, ৭৫´১৫০), ‘বিস্তৃতি’ (অ্যাক্রিলিক, ৪৫দ্ধ৬১), ‘সবুজ ও কালো’ (অ্যাক্রিলিক, ৪৫´৬২), ‘ফটক’ (তেলরং, ৭৩´৯২), ‘নীল দিগন্ত’ (তেলরং, ৮২´৮২), ‘স্মৃতি’ (তেলরং, ৭২´৯২), ‘স্বপ্ন’ (তেলরং, ৬১´৭৩), ‘হলুদ পাহাড়’ (অ্যাক্রিলিক, ৪৮´৬৩), ‘লাল, নীল ও কালো’ (তেলরং, ৪৫´৩৭)। তাঁর এসব চিত্রকর্ম থেকে বোঝা যায়, তিনি কেমন মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন রঙের উচ্চকিত উদ্ভাস। রং নিয়ে তাঁর এই দক্ষ অথচ স্বতঃস্ফূর্ত খেলায় চমৎকার সব আকৃতি ও অবয়ব বের হয়ে আসে। রঙের এই কারুকাজে ক্যানভাসের ওপর নির্মিত হয় মনোগ্রাহী গভীর দৃশ্যের অলংকরণ। নানা রঙের আশ্চর্য খেলায় আলো ও আঁধারের পরিমিত ব্যবহার এখানে এক অদ্ভুত লিরিক্যাল দ্যোতনা সৃষ্টি করে। তাঁর এই রং ও আলো-আঁধারী লীলায় কোথাও সৃষ্টি হয়েছে স্ফটিক স্বচ্ছতা, সূক্ষ্ম অথচ কমনীয় মাধুর্য, কোথাও তার বিপরীতে পুরু, বলিষ্ঠ দাগের প্রত্যয়, মনোগ্রাহী গভীর দৃশ্যের অলংকরণ। তিনি বলিষ্ঠতা, শক্তিমত্তা এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে নীল ও সবুজের কারুকাজ করেছেন। লাল, গৈরিক, হলুদের বিচিত্র আদলও দক্ষতার সঙ্গে উঠে এসেছে তাঁর তুলিতে। মাহমুদুল হক বিশ্বাস করতেন, একজন শিল্পীর কাছে বস্তুগত বাস্তবতা এবং বাস্তবতার ধারণা বা অনুভব সমানভাবেই বাস্তব। যেখানে বস্তুগত বাস্তবতা ব্যর্থ, সেই সত্যের স্তর ছোঁয়া সম্ভব বাস্তবতার অনুভব দিয়ে।

এখন এমন একটি প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, মাহমুদুল হকের শৈল্পিক সাফল্য কোথায়? ছাপচিত্রের বিমূর্ত আঙ্গিকে, নাকি তেলরঙের বিমূর্ত প্রকাশবাদিতায়? কারো কারো মতে, দ্বিতীয়টিতেই। কারণ তাঁর পুরস্কার, স্বীকৃতি মূলত তেলরঙের বিমূর্ত প্রকাশবাদিতায়। এটা ঠিক পুরস্কার, স্বীকৃতির কারণে তাঁর তেলরঙের বিষয়টি পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে; কিন্তু ছাপচিত্রেও তিনি অনন্য সাফল্যের দাবিদার।

মাহমুদুল হকের জন্ম ১৯৪৫ সালে খুলনায়। ১৯৬৮ সালে তিনি বাংলাদেশ চারুকলা কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে স্নাতক হন। এরপর এই ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন দীর্ঘ সময় এবং পর্যায়ক্রমে ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে নিয়োজিত হন। ১৯৮২ থেকে ’৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাপানে ছাপচিত্রে উচ্চশিক্ষা নেন এবং সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। শিল্পী মাহমুদুল হক দেশে-বিদেশে অনেক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন এবং ৩০টিরও বেশি একক প্রদর্শনী করেছেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক বিরল পুরস্কারে তিনি ভূষিত। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে একাধারে তিনবার (ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, যথাক্রমে ১৯৯৩, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে) অর্জন করেছেন সম্মাননা পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ চিত্রকলা পুরস্কার, সুচিউরা সিটি, জাপান-১৯৮২; বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার-১৯৯২, ১০ম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী, বাংলাদেশ-১৯৯২, পারচেজ পুরস্কার, ললিতকলা একাডেমি, ভারত-১৯৯৪, দ্বিতীয় পুরস্কার, ১২তম কুয়েত আন্তর্জাতিক বিয়েনাল-১৯৯৬ প্রভৃতি দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি লাভ করেছেন। সম্মান : অতিথি অধ্যাপক, সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান, ১৯৯৪-৯৫; নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৮; সিটি পেইন্টার অব ওয়ালট্রপ সিটি, জার্মানি-২০০০। জাতীয় আর্ট গ্যালারি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট এবং দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে তাঁর সংগ্রহ স্থান পেয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির বহুমুখী ধারায় যোগসূত্র নির্মাণে, দেশি-বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে যোগাযোগ ও বিনিময় প্রসারে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাহমুদুল হক দীর্ঘসময় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রয়াত এই মহৎ শিল্পীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।।