বাংলা নাটকের বঙ্গবালা : শাঁওলী মিত্র

বাবার মতোই। অবিকল নিঃশব্দে চলে গেলেন আরেক নারী শাঁওলী মিত্র। ইচ্ছাপত্র করে জানালেন, একান্ত গোপনে যেন হয় তাঁর শেষযাত্রা। থাকে না যেন কোনো অনুগামী। স্পর্শ করতে পারে না যেন তাঁর শেষযাত্রাকে কোনো মিডিয়ার আলো। তাঁর পিতা প্রবাদপ্রতিম অভিনেতাও ঠিক তাই করেছিলেন। সত্যিই তো কয়েকজন অনুমোদিত অতিব্যক্তিগত ছাড়া স্পর্শ করতে পারেননি তাঁর শেষযাত্রাকে। শুধু মৃত্যু নয়, দাহকার্য সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পর জেনেছিল মিডিয়া ও মানুষ। এই মিডিয়া-হাইকের যুগে যখন কোনো কিছুই আর ব্যক্তিগত নয়, তখনো এটাও যে-সম্ভব তা দেখিয়ে দিলেন পিতা ও কন্যা। নিজের শেষ ইচ্ছাপত্রে লেখেন, ‘আমার একান্ত ইচ্ছে, আমার পিতাকে অনুসরণ করেই, মৃত্যুর পরে যতো দ্রুত সম্ভব আমার সৎকার সম্পন্ন করা হয়। ঐ শরীরটিকে প্রদর্শন করায় আমার নিতান্ত সংকোচ।’ ফুলভারেও আপত্তি ছিল তাঁর। সেলিব্রিটির শেষযাত্রা নয়, চেয়েছেন সাধারণ মানুষের মতো তাঁর শেষপ্রস্থান। কোনো অভিমান ছিল কী? শম্ভু মিত্রের ছিল। নিজের জন্যে নয়, নাট্যপ্রেমী মানুষের জন্যে জাতীয় মঞ্চ পাননি। এই চাওয়াটা তো শিশির ভাদুড়ীর মধ্যেও ছিল। তিনিও তো পাননি। ধীরে ধীরে নিজেকে নির্বাসনে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন স্ব-ইচ্ছায়। শেষের দিকে শাঁওলী তো সেই পথেই এগোচ্ছিলেন। মা তৃপ্তি মিত্র কিন্তু সাড়ম্বরেই শেষযাত্রা করেছেন। শাঁওলীর লেখাতেই সে-কথা পাই, কীভাবে মাকে গড়িয়াহাটের বাবার বাড়ি থেকে ‘বহুরূপী’র নাসিরুদ্দিন রোডের আদি বাড়িতে নিয়ে এসে সাজিয়ে শেষযাত্রায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁর লেখাতেই উঠে এসেছে সেই সময়, ‘গরদের শাড়ি পরিয়ে কাচের গাড়ি করে মাকে বাবার কাছ থেকে নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে নিয়ে এলাম। মা ফিরতে চেয়েছিল। বহু মানুষের ভিড় সেখানে। আত্মীয়, বন্ধু, থিয়েটারের কর্মী, পরিচালক, সাংবাদিক, রেডিও, টেলিভিশন, কত লোক – কত কত লোক।’ শাঁওলীর ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত ছবি। শাঁওলী নিজেই নির্মাণ করে গেছেন এই ছবি। নীরবতা আর নির্জনতা। কেউ কোথাও নেই। হাতগুনতি দু-তিনটি মানুষ। শাঁওলীর শেষযাত্রা। সিরিটি শ্মশান। শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের শেষকৃত্য এখানেই। নাসিরুদ্দিন রোডের সেই বাড়ি। যেখানে তিনি জন্ম থেকে বড় হয়েছেন। থিয়েটারের পরিবেশের মধ্যে। বাবা-মা দুজনেই জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে থিয়েটারের সঙ্গে। থিয়েটারের জন্যে সবকিছু হারাতে পারেন; কিন্তু কোনো কিছুর জন্যে থিয়েটারকে হারাতে রাজি নন। কন্যাসন্তানকেও জড়িয়ে নিতে চান থিয়েটারের সঙ্গে। বাবা-মায়ের চোখে সেই স্বপ্নই। জন্ম থেকেই রুগ্ণ ছিলেন শাঁওলী। সেই রুগ্ণতাকে কোনো পাত্তা দেননি। ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারকে ভালোবাসতে শিখেছেন। বাবা-মা প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব। রোজই বাড়িতে থিয়েটারের নানা মানুষ, নানা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। এসব যখন ঘটছে তখন তিনি নিতান্তই ছোট। যখন খানিক বড় হয়েছেন তখন প্রযোজনা থেকে সরে এসেছেন শম্ভু মিত্র। বাবার সঙ্গে অভিনয় করার খুব একটা সুযোগ পাননি বললেই চলে। একই মঞ্চে খুবই কাছাকাছি পেয়েছিলেন ফিৎস বেনেফিৎসের পরিচালনায় রেপারটরি থিয়েটারে গ্যালিলিওতে। শম্ভু মিত্র গ্যালিলিও, শাঁওলী তাঁর কন্যা ভার্জিনিয়া। একই সমাপতন সম্পর্কও থিয়েটারে। পরিণত বয়সে এসে বাবার অভিনয়ক্ষমতাকে মুগ্ধ হয়ে আবিষ্কার করেন শাঁওলী। অভিনয়ের কী অসীম ক্ষমতা! আরেকবার শাঁওলীর মধ্যে উপলব্ধি আসে। বেনফিৎসকে তিনি আগেই চিনতেন। ব্যাঙ্গালোরে ব্রেখটের ‘থ্রি পেনি অপেরা’র বেনিফিৎসের ওয়ার্কশপে ছিলেন শাঁওলী। গ্যালিলিও কলকাতায় হইচই ফেলে দিয়েছিল। নাটক নিয়েই পড়াশোনা। নাটক নিয়েই তাঁর জীবনে সব। লোকনাট্য নিয়েও করেছেন গবেষণা। তার জন্যে ঘুরে বেরিয়েছেন ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে। নাটকের জন্যে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন ভারত তথা বাংলার লোকনাট্যের আদি উৎসকে। নিজে যখন পরিচালক হয়ে উঠেছেন তখন প্রয়োগ করেছেন স্বোপার্জিত সেইসব অভিজ্ঞতাকে। বিশ্বাস রেখেছেন পারিবারিক সূত্রে পাওয়া বাঙালিয়ানার ওপর। শম্ভু মিত্রের চেয়ে বড় বাঙালি আর কে-ই বা আছে আমাদের জীবনে।  সেই বাঙালিয়ানার মধ্যেই তো বড় হওয়া শাঁওলীর।  

একটা কথা মনে পড়ছে। আবার যখন নাটকে ফিরে আসতে চাইছেন শাঁওলী। নিজের দল করেছেন ‘পঞ্চম বৈদিক’। বলেছিলেন, পাকাপাকি একটা নিজস্ব হল না থাকলে নিয়মিত নাটক করা যায় না। তাই নেওয়া অরবিন্দ ভবনের হলটা। সেখানেই নিয়মিত নাটক। নাটক শুরু হওয়ার সময় যে-তিনটি বেল বাজে, তার পরিবর্তে সেখানে বাজত মন্দিরের ঘণ্টা। ধবধবে সাদা কাপড়-পাঞ্জাবি পরে সারা প্রেক্ষাগৃহ ঘুরে ঘরে সেই ঘণ্টা বাজাত একদল মানুষ। নাটক শুরু হওয়ার আগে এক উপাসনার পরিবেশ তৈরি হতো। তবে এটাও ঠিক, নাটকের ক্ষেত্রে তিনি কখনোই বাঙালি ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে থাকতেন না। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই তো অনুবাদ করেন আইনেস্কোর রাইনেসোরাস নাটকটি। সেটি প্রযোজনাও হয়েছিল।

মাত্র আট বছর বয়সে মঞ্চে। বহুরূপীর ডাকঘর। অমল চরিত্রে। অমলই ডাকঘরের মেরুদণ্ড। তা মঞ্চে ধরে রাখছে আট বছরের এক বালিকা। সে যেন এক ম্যাজিক ছিল। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন। এক জায়গায় বসে-শুয়ে অভিনয়। অভিনয় বিজ্ঞানে অত্যন্ত কঠিন এক পারফরম্যান্স। কী অনায়াসে দিনের পর দিন শাঁওলীর অমল মুগ্ধ করে রাখত দর্শকদের। শেষদিন অমলের স্মৃতি সঙ্গে ছিল শাঁওলীর। তিনি লিখেছেন, ‘অমল আমার শৈশবের পরিচিত শিশু। কিন্তু অমলকে আমি এখনও ভুলতে পারি না। ঘুরে ফিরেই অমল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, কথা বলে। সে আমার বন্ধু। আমি বড় হয়ে গিয়েছি কিন্তু সে – সে তো শৈশবেই থেমে আছে। সে কবি, সে শিল্পী। সে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এক সত্তা। সেই অমলের সঙ্গে আমার -বন্ধুত্ব আমার বছর আষ্টেক বয়সে।’

ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ থাকতেন তিনি। মঞ্চে ডাকঘর করার পর রেডিওতে ডাকঘর। সে আরেক অভিজ্ঞতা। শাঁওলীর মুখে শোনা। সেই প্রথম তাঁর মূল ডাকঘর পড়া। অভিনয়ের ক্ষেত্রে তো বটেই, এবার মূল ডাকঘর পড়ে অমলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। শাঁওলী মিত্রের কথায়, ‘পৃথিবীকে জানার, প্রকৃতিকে বোঝার যে আনন্দ তা আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় অমলই। যা আমি সারা জীবন বহন করে চলেছি।’ কথা যে কত বড় সত্যি শাঁওলীকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন। অমলের এই অভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি নিয়েই তিনি অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন।

কেন অভিনয় করেন? সোজাসাপটা এই প্রশ্ন শুনতে হয়েছে তাঁকে। একটা সহজ উত্তর তাঁর কাছে ছিল – ‘থিয়েটার পরিবারের মেয়ে আমি, অভিনয় ছাড়া আর কী করব। সেইজন্যেই তো অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার ক্ষেত্রেও নাটককেই বেছে নিয়েছি।’ এতো সরল উত্তর ; কিন্তু শাঁওলী নিজে মনে করেন, তাঁর মধ্যে আজীবন লালিত হচ্ছে এক অমল, যে তাঁকে বিশ্বকে জানার তাগিদেই ক্রমশ জড়িয়ে নিচ্ছে নাটকের মধ্যে, থিয়েটারের মধ্যে।

সারাজীবন ধরে ভারতীয় নাট্যকলার নানা আঙ্গিক খুঁজে বেড়িয়েছেন। শুধু খোঁজেননি প্রয়োগও করেছেন। কেন এই উৎস খোঁজার তাগিদ। শাঁওলীর ভাষাতেই বলা যাক, ‘আমরা জানি আমাদের দেশের যে গ্রামীণ সভ্যতা তার মধ্যে যে

সংস্কৃতি লুকিয়ে আছে তা তার আপন জোরেই অত্যন্ত অভিজাত। ভারতবর্ষের অনেক জায়গাতেই এই ধরনের মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে। এই কথা মনে করে এই সমস্ত ক্ষেত্রে শিকড় খোঁজার ইচ্ছে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, থিয়েটারের কাজ করতে গেলে হয়তো এরই মধ্যে আমি আমার কাঠামো তৈরি করার রসদ খুঁজে পাব।’

১৯৮২ সালে বেশ কয়েক বছর বিরতির পর তিনি যখন আবার নাটকের জগতে ফিরে এলেন, তখন তো তিনি পুরোপুরি কাজে লাগালেন ভারতীয় লোকনাট্যের ধারার সঙ্গে আমাদের বাংলার কথকতাকে। যেখান থেকেই নির্মাণ হলো নাথবতী অনাথবৎ, পরবর্তী সময়ে কথা অমৃত সমান, যা বাংলা নাট্যভাবনায় নিয়ে এলো অন্য এক বিস্তার। অবলুপ্ত এক ধারাকে আধুনিকীকরণ করলেন শাঁওলী মিত্র, যা আমাদের নাট্যভাবনায় রীতিমতো আলোড়ন তুলল। বাংলার আপামর দর্শক সাগ্রহে গ্রহণ করল শাঁওলীর এই নবধারার নাট্যভাবনাকে। 

ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে বর্ণনাত্মক লোকনাট্যের ধারা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন শাঁওলী। নানা প্রান্তিক গ্রামেও গেছেন, আবার তেজান বাঈয়ের  মতো মানুষের সঙ্গে আলোচনায় মেতেছেন। আলোচনা হয়েছে পান্ডোয়ানির বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে।  সবমিলিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন অনন্য এক অভিজ্ঞতার। এই পান্ডোয়ানি নাটক করেই তো তেজান বাঈ বিখ্যাত। পান্ডোয়ানি মহাভারতের গল্প বলে। একদিন ধরে নয়, অনেকদিন ধরে। মহাভারতকে গ্রামীণ ভাবনায় উপস্থাপনই পান্ডোয়ানি। এখান থেকেও উৎসাহ পেয়েছেন শাঁওলী, নাথবতী অনাথবৎ করার।  তেজান বাঈয়ের গ্রামের বাড়িতে গেছেন যেমন, তেমনি আবার মহারাষ্ট্রের গোন্দের কথকতাকেও মিশিয়েছেন তিনি এই নাটকে। সর্বোপরি অবশ্যই রয়ে গেছে বাংলার কথকতার হারিয়ে যাওয়া আঙ্গিক। শেষ অবধি অবশ্য নাথবতী অনাথবৎ মৌলিকভাবেই পুনর্নির্মিত, যার সম্প্রসারণ কথা অমৃতসমান। এই দুই নাটক নির্মাণে শাঁওলীর বয়ান দেখা যাক, একটা কথা বলি – ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এবং ‘কথা অমৃতসমান’ এই দুটো পালাতেই এই আঙ্গিক গ্রহণ করবার ফলে অনেকগুলো ব্যাপার, বা বলতে পারি – স্তর, একই সঙ্গে মঞ্চে ঘটানো গেছে, যা অন্য আঙ্গিকে এত সহজে সম্ভব হত না। যেমন অতীতের এক কাহিনী বর্ণনা করার পরই কথক তার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারে, মন্তব্য করতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, ব্যাখ্যা করতে পারে, টিপ্পনিও কাটতে পারে। তেমনিই আবার কথক স্পষ্ট দেখতে পারে অতীত ঘটনা, শুনতে পেতে পারে দুর্যোধন-পুরোচনের কথোপকথন, দু-তিনটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বর্ণনা – কেবল কথা দিয়েই যার ছবি তৈরী করা যায় … ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কেমন মনে হয় যে, এসব করতে পারার ফলে বিষয়ের গুরুত্বটা তার প্রাপ্য স্থান পায়, এখানে যার খুব প্রয়োজন ছিল। বিষয়ের জন্যই এই আঙ্গিক নির্বাচন। আঙ্গিকের জন্য বিষয় নয়। যাঁরা কাজ করেন তাঁরা সবাই একথা নিশ্চয়ই গভীরভাবে অনুভব করেন।

বর্ণনাত্মক থিয়েটারের সুবিধা কী কী – এ-সম্পর্কে একটা লেখা আমাকে লিখতে হয়েছিল একটা গবেষণাপত্র হিসেবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এ-সম্পর্কে বিশদ লেখা আমার উচিত নয়, বরং কোনো মনোযোগী দর্শক যদি ভালোবেসে এ-সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন কোনোদিন, তাহলে বুঝতে পারব, আমি যা যা ভেবেছি, যা যা ভেবে কাজটি করেছি, তা সত্যিই দর্শকের কাছে পৌঁছেছে কি না। যদি এই আঙ্গিককে ব্যবহার করে সত্যি কোনো কাজ হয়ে থাকে, তাহলে তার মূল্যায়ন করবেন দর্শক। তাঁদের যদি ভালো লাগে, নাড়া দেয়, তো সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। নইলে কেন কী করেছি, কীভাবে করেছি এসব ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো লাভ নেই। যা করেছি, যতটুকু করেছি, তাতে যদি দর্শকের ভালো লেগে থাকে, প্রশ্ন জেগে থাকে, তবেই ধন্য মানব। হ্যাঁ, কথক বোধ করেছে লোকে জানতে চায়। তাকে যে বারবার উত্তর দিতে হয়। আর তখন সে ভীষণ কৃতজ্ঞ হয় জীবনের প্রতি। অনেককে সে দেখেছে যাদের জানার আগ্রহ প্রবল। তারা তাদের নিজেদের বোধ দিয়ে অনুভব করতে চায় এই পৃথিবীর সমস্যা, মানুষের দুঃখ, অসহায়তা। আর কথক ভেবেছে – হ্যাঁ, এখনো মানুষ আছে এমন, যারা মানুষকে ভালোবাসে। মানুষকে ভালোবাসে বলেই এই নগ্ন, ভয়াবহ ধ্বংসলীলায় তারা বিচলিত হয়, তাদের বুকের মধ্যে কষ্ট হয়। চতুর্দিকের অপমান, গ্লানি, অবিশ্বাস, প্রতারণা – এসবের মধ্যেও কথক এবং আমরা ওইটুকু বিশ্বাস আঁকড়ে থাকতে চাই। ভাবতে চাই, না আছে, এখনো কেউ কেউ আছে যারা ভালোবাসতে চায়। মরতে মরতেও যদি ওটুকু বিশ্বাস আঁকড়ে থাকা যায়, এই পতনোন্মুখ সমাজে, এই চতুর্দিকের অবক্ষয়ের মধ্যে – আর কিই বা চাইতে পারি আমরা?

এই ভাবনা ও চিন্তা থেকেই নির্মিত এই দুটি নাটক, যা নাট্যমঞ্চে শাঁওলীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করে। নাটকটি আর শুধু নাটক থাকে না, এক দর্শন হয়ে ওঠে। বিষয় ও আঙ্গিক উভয় পরিপ্রেক্ষিতেই, হয়ে ওঠে সমসাময়িকও।

১৯৭১ সালে রাজা নাটকে সুরঙ্গনা। মা তৃপ্তি মিত্র হলেন সুদর্শনা। রাজা স্বয়ং শম্ভু মিত্র। বিরাট চ্যালেঞ্জ শাঁওলীর সামনে। কেননা এই ভূমিকায় শাঁওলীকে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল শম্ভু মিত্রের। ওইটুুকু মেয়ে সুরঙ্গনার মতো জটিল চরিত্র করে উঠতে পারবে কি? এটাই সংশয় শম্ভু মিত্রের। কিন্তু তৃপ্তি মিত্র খুব নিশ্চিত – শাঁওলী পারবে। মুম্বাইতে রাজার অভিনয়ে প্রথম সুরঙ্গনা শাঁওলী। অভিনয়শেষে সাধারণ দর্শক থেকে মিডিয়া সকলেই সুরঙ্গনা শাঁওলীর অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এরপর থেকে ১৯৭৮ সাল অবধি যতবার রাজা অভিনীত হয়েছে, সেখানে শাঁওলীই। তিনি নিজেও বলেন, ‘সুরঙ্গনা আমার খুব কাছের চরিত্র। ওই যে জেদ অন্ধকারকে ভাঙার চেষ্টা, এটাই আমাকে সুরঙ্গনার সঙ্গে একাত্ম করে তোলে। আমাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেয়। সুরঙ্গনা আমার পরম প্রাপ্তি।’

ঘরে বাইরেতে বিমলা করতেন তিনি। ঘরে বাইরেকে কী চোখে দেখেন শাঁওলী? তিনি মনে করতেন, ‘ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক তীব্রভাবে অহরহ প্রকাশ পায় ‘ঘরে বাইরে’তে। আর সে সমাজ ক্ষুদ্র অর্থের সমাজ নয় – জীবন – ব্যাপক অর্থে। চারিদিকে আগুন তছনছ করা সমাজ যেখানে দাঁড়িয়ে মৃতপ্রায় নিখিলেশকে উপলব্ধি করতে পারছে বিমলা। এটাই বিমলা চরিত্রের কেন্দ্র। যেখানে বিমলা নিশ্চল। সময়ের সাক্ষী। বিমলা আমার কাছে এইরকমই। আর এই সূত্র ধরেই আমি প্রতি অভিনয়ে বিমলাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা চালিয়েছি।’

শাঁওলী নিজের প্রযোজনা-পরিচালনায় পুতুলখেলা করেছেন। করেছেন আরো অনেক নাটক। যেমন বিতত বিতংস। রেডিও নাটক, আবৃত্তি, আরো কত শৈল্পিক কাণ্ডকারখানায় জড়িয়েছেন। অন্তে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমির চেয়ারপারসনের দায়িত্বে ছিলেন।

শাঁওলী একটিমাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তর্ক গপ্পো। আর ওই একটি ছবিই বাংলা ছবির ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। এই চরিত্রে শাঁওলীর কোনো বিকল্প ছিল না। এ-কথা বলেছেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক।

শাঁওলীর জন্ম ১৯৪৮-এ। যখন দেশভাগ, দাঙ্গা, মন্বন্তর, উদাস্তুস্রোত, সেই সময়ের মধ্যে জন্মেচ্ছেন শাঁওলী। গণনাট্যের বিকাশ ও ভেঙে যাওয়া দেখেছেন। তিনি  ‘বঙ্গবালা’ই। আর সেই চরিত্রেই তাঁকে যেন নিয়ে আসেন ঋত্বিক। এক মাতৃরূপী শক্তি, যিনি শিল্পের প্রলয়নাচন নাচতে জানেন। সমস্ত অসুস্থতাকে কাটিয়ে উঠে তিনি শিল্পের দেবী হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু ঋত্বিক ঘটকের বঙ্গবালা নন, তিনি আমাদের বাংলা নাট্যজগতের

বঙ্গবালা। ছবি : ইন্টারনেট