চির জাগরূক হাসনাতভাই

আবুল হাসনাত। মাহমুদ আল জামান। দুই নাম। এক ব্যক্তি। প্রথমটাতেই অবশ্য তাঁকে বেশি চিনি, তবে পুরো নামে ততটা নয়, যতটা ‘হাসনাতভাই’ হিসেবে, বয়সে তিনি আমার প্রায় সিকি শতাব্দী বড় হলেও। নাকি বলব ‘চিনতাম’? না, সেকথা বলতে পারব না, অতীতকাল ব্যবহার করতে পারব না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক সৌভিক রেজার এক বাক্যের শেল ‘হাসনাতভাই চলে গেলেন’ সেদিন যখন মেসেঞ্জারে নজরে পড়েছিল, মনের ভেতর তারস্বরে কে যেন বলে উঠেছিল, ‘অসম্ভব, এ অসম্ভব।’ মানুষ মরণশীল, সবকিছুই নশ্বর। কিন্তু কেন যেন হাসনাতভাইও যে তাই, দুম করে চলে যেতে পারেন, এটা কেন যেন আমি কখনো ভাবিনি। কেন যেন। আমার মাথাতেই কোনোদিন এ-কথা আসেনি যে, তিনি একদিন ধরাধাম ছেড়ে চলে যাবেন।

আর তাই, তাঁকে ‘চিনতাম’, একথা বলা সম্ভব নয়। সবসময় বলব তাঁকে ‘চিনি’। যদিও, সেই ক্লিশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে অনেকে বলবেন, কাউকে চেনা কি অত সহজ?

তা নয় জানি, কিন্তু তাঁকে চিনি আমি আমার মতো করে, আমার সঙ্গে তাঁর যেভাবে পরিচয়, যৎকিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, কিছুটা ভীতি, তাঁর সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া বেশিক্ষণ বাক্যালাপ করা যায় না, এই সামান্য অনুযোগ এসবের একটা বিমিশ্র দশা নিয়ে।

পরিচয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে, ভীরু ভীরু পায়ে যখন পল্টনে সংবাদ অফিসে তাঁর কাছে লেখা দিয়ে আসতাম। তবে প্রথম কবে তাঁকে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, কিভাবে কার কাছ থেকে তাঁর নাম জেনেছি তা প্রতারক স্মৃতির কাছ থেকে কিছুতেই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। আমার অনূদিত লাতিন আমেরিকান ছোটগল্প, ইউনেস্কো কুরিয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত গ্রিক সুরস্রষ্টা (যিনি কাজানজাকিসের বিখ্যাত উপন্যাস জোরবা দ্য গ্রিক অবলম্বনে তৈরি একই নামের চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালকও বটে) মিকিস থিওদোরাকিসের সাক্ষাৎকারসহ আরো কিছু লেখা তাঁর হাত দিয়েই সংবাদের পাঠকনন্দিত সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। তখনই তাঁর সেই ওপরে গম্ভীর, মিতভাষী, আপাতনীরস আর নিচে আন্তরিক ও স্নেহার্দ্র রূপটির সঙ্গে পরিচয়, যা তিনি সংবাদ ছেড়ে কালি ও কলম পত্রিকায় যাওয়ার পরেও অক্ষুণ্ন ছিল। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করা কালি ও কলম সপ্তদশ বর্ষ, নবম-দশম সংখ্যা, কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১৪২৭, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২০ এ-সংখ্যাটি সম্ভবত আবুল হাসনাত-সম্পাদিত সর্বশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়।

যদিও তাঁর জীবনের শেষের বেশ কিছু বছর যোগাযোগটা বেশ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল, কিন্তু তাঁর কথা বা নাম মনে পড়লেই একটা প্রশান্তির, একটা ভরসার, একটা ঐকান্তিকতাপূর্ণ ভাবাবেশ মনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

‘হাসনাতভাই’ই যে ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায় নামের এখন বিস্মৃতপ্রায় বইটির লেখক এবং অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত  সাহিত্যিক মাহমুদ আল জামান সে-কথা জানা হয়েছে অনেক পরে। এই একটি পুরস্কারই তিনি পেয়েছিলেন ৭৫ বছরের দীর্ঘ জীবনে, অথচ সাহিত্যের নানান শাখায় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল। আর প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর অন্যান্যজয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ইত্যাদি। ২০২০-এর বইমেলায় জার্নিম্যান-প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথামূলক হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে বইটিও অনবদ্য।

ছায়ানটের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন, সেই ১৯৬৬ সাল থেকে, তবে শুধু যুক্ত থাকা বললে কম বলা হবে, তিনি ছিলেন ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সহ-সভাপতি এবং ছায়ানটের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সক্রিয় সদস্য।

আবার, সৌভিক রেজার কথা উদ্ধৃত করে বলতে হয় : ‘তাঁর তারুণ্যের ও যৌবনের দিনগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন ও সিপিবি-র রাজনীতির প্রতি আনুগত্য জানিয়ে প্রবল নিষ্ঠা আর সক্রিয়তার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন আবুল হাসনাত। অথচ তাঁর মৃত্যুতে এই দুই সংগঠন থেকে কোনো শোকবার্তা জানানো কিংবা শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করা হলো না।’

হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে পড়ে শাহেদ ইমরান নামে জনৈক পাঠকের মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য :

 পুরো বইটা পড়ে অবাক হয়েছি। এই নিপাট ভদ্রলোক সারাজীবন, শুধু ঠকে গেছেন। কখনো তাঁর প্রাণপ্রিয় দল/সংগঠন, সংগঠনের সতীর্থদের কাছে, কখন চাকুরীক্ষেত্রে। তারপরও বুকের ভেতর রাখা নিজের আদর্শকে কখনো হারতে দেননি। এরকম মানুষ ছিলেন বলেই আজো বাংলাদেশ এত্ত সুন্দর। জাগতিক নানান হিসাব-নিকাশের  নিক্তিতে, পদ-পদবির বাজারে হয়তো হাসনাতভাই ‘ঠকেছেন’, কিন্তু মানুষের মনের কোণে ছায়াঘেরা পরম প্রশান্তির যে-নিবিড় কোণটি আছে সেখানে তাঁর অবস্থান চির অম্লান, চির জাগরূক হয়ে থাকবে। সেটাই তাঁর বড় অর্জন, বড় জয়।