সন্দেহ নেই একজন সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে একজন লেখকের সম্পর্ক খুব নিবিড়, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পেশাদারিও। সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে রূপ নেয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়। সম্পাদক আবুল হাসনাত অর্থাৎ প্রিয় হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ছিল মধুর। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পত্র-যোগাযোগ ঘটেছে। হাসনাতভাইয়ের প্রয়াণে এই চিঠিপত্রগুলোর মাধ্যমে তাঁকে যেন আবার নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ হাতে এলো। সেই চিঠিপত্রের ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে পাই একজন দক্ষ সম্পাদক, একজন লেখক, একজন অতিমানবিক হৃদয়ের মানুষ এবং একজন সজ্জন মানুষকে।
সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার পত্র-যোগাযোগের সূত্রপাত ঘটে নিউইয়র্কে বসবাসরত কবি শহীদ কাদরীর সুবাদে। প্রাথমিক পর্যায়ে যোগাযোগের মূল সূত্র কবি শহীদ কাদরী হলেও পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে আমার চমৎকার একটি সখ্য গড়ে উঠেছিল। কখনো চিঠিপত্র কখনো ফোনালাপ কখনো নিউইয়র্কের কোনো আড্ডায় আমাদের নিত্যই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবের আদান-প্রদান ঘটেছে। সেই লেনেদেনের ফলে আমাদের পরস্পরের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সেইসঙ্গে জন্ম নিয়েছিল এক ধরনের অধিকারবোধও। যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে লেখক এবং সম্পাদক আবুল হাসনাতকে চেনেন তাঁরা কবুল করবেন যে, মানুষটি ছিলেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিপাট ভদ্রলোক। কারো সাতে পাঁচে তিনি নেই। খুব কম কথা বলতেন কিন্তু যা বলতে চাইতেন তা অকপটে বলে দিতে পারতেন। তিনি তাঁর আদর্শ থেকে কখনোই এক পা নড়েননি। এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ২০০৭ সালে এবং তা খুব কাকতালীয়ভাবে। আমার সঙ্গে তখন নিউইয়র্কে কবি শহীদ কাদরীর বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে সেই সময়টা ছিল তখন আড্ডা, কবিতা আর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাটাকাটি আর মাখামাখির সময়। একদিন হঠাৎ মনে হলো শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলে কেমন হয়! ভাবনাটা মাথায় আসতেই ‘শহীদ কাদরী ও তাঁর কবিতা’ এই নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলি। তখন নিউইয়র্কে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের খোরাক আর ইন্ধন জোগাত বাংলাদেশ থেকে আসা সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম এবং কলকাতা থেকে আসা দেশ। নিউইয়র্কের এই তামাটে মাটিতে তখন এই দুটো পত্রিকা আমাদের সাহিত্যে নিমজ্জিত তৃষিত আত্মাকে সবসময় জিইয়ে রেখেছিল। একদিন কোনো কিছু না ভেবেই লেখাটি ই-মেইলে পাঠিয়ে দিই কালি ও কলম সম্পাদক বরাবর। তারপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। এক সন্ধ্যায় সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছ থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত চিঠির উত্তর এলো। খুব অল্প কয়েকটা লাইন। কিন্তু সেই অল্প কয়েকটি শব্দে আমি কল্পনায় দেখতে পেয়েছিলাম আপাদমস্তক এক সম্পাদকের মুখ। আবুল হাসনাত লিখলেন,
সুজনেষু,
আশা করি কুশলে আছেন। শহীদ কাদরীকে নিয়ে আপনার প্রবন্ধটি পেয়েছি। লেখাটি ভালো লেগেছে। লেখাটি খুবই ছোট। সে জন্যে মেকআপ করা যাচ্ছে না। ওঁর কবিতা সম্পর্কে আরো দু-পৃষ্ঠা যদি সংযোজন করেন কিংবা লেখাটি দীর্ঘ করেন খুবই ভালো হয়। সিরিয়াস মাসিক পত্রিকায় এত ছোট লেখা ছাপা বেশ কষ্টকর। এ ব্যাপারে জানাবেন। তিনি আমার প্রিয় মানুষ ও কবি।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা
হাসনাত
(আগস্ট ১৯, ২০০৭; ভোর ৩.১৯)
সেই থেকে শুরু। কালি ও কলমে শহীদ কাদরীর নতুন কবিতা, তাঁর সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধসহ নানা বিষয় নিয়ে নিত্যই কালি ও কলমের দরজায় টোকা দিই। সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর কালি ও কলমের দরজাটি সবসময়ই আমার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এ যেন নতুন এক জীবনের সূচনা! আবুল হাসনাত ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন কবি শহীদ কাদরীর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর কবিতার ভক্ত। তিনি শহীদ কাদরীকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। কবি শহীদ কাদরীও আবুল হাসনাত বলতে পাগল ছিলেন। কবি শহীদ কাদরীর সূত্র ধরে এভাবেই শুরু হলো লেখক এবং সম্পাদক আবুল হাসনাত ও তাঁর কালি ও কলমের সঙ্গে পথ চলা।
কবি শহীদ কাদরী তখন নিউইয়র্কে অসুস্থ জীবন যাপন করছেন। তখন তাঁর দুটো কিডনি বিকল এবং সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে হতো। যে-কবি একসময় ঢাকার রাস্তায় রাত-বিরেতে বোহেমিয়ানের মতো ঘুরে বেড়াতেন, আড্ডা দিতেন, সেই কবি হুইল চেয়ারে ছিলেন খুবই বেমানান। হাসনাতভাই শহীদ কাদরীর এই অসুস্থতার খবরে মুষড়ে পড়তেন। তাঁর একটি চিঠি তুলে ধরছি।
আদনান,
আশা করি কুশলে আছেন। আজ অফিসে এসে আপনার মেইল পেয়ে জানতে পারলাম শহীদ কাদরী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন কেমন আছেন তিনি? খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছি। আমরা ভালো নেই। তিনটি ক্ষীণকায় কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তিনি আধুনিক কবিতার যে জগৎ নির্মাণ করেছেন আমরা তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। ভালো থাকবেন। আর আমাদের কল্যাণ আর মঙ্গল কামনা করবেন।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা
হাসনাত
(সেপ্টেম্বর ২, ২০০৭; ভোর ১২.৫২)
যে-কোনো উচ্চমান সাহিত্য সম্পাদকের কাজের ধারা মোটামুটি একই রকম। তাঁরা সারাক্ষণ তাঁদের জহুরি চোখ দিয়ে একটি ভালো লেখার খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। সম্পাদক আবুল হাসনাতও এর ব্যতিক্রম নন। কবি শহীদ কাদরী তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। লেখালেখির বিষয়ে শহীদ কাদরী ছিলেন অলস। বাংলাদেশের বাইরে থাকার কারণে কবি শহীদ কাদরী বাংলা কবিতা থেকে অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে বসে কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত ঠিক জানতেন শহীদ কাদরীর কাছ থেকে আরো কিছু নতুন কবিতা আদায় করে নেওয়া সম্ভব। এদিকে নিউইয়র্কে খুব ঘটা করে কবি শহীদ কাদরীর জন্মদিন পালন করা হলো। সেই নিয়ে একটি লেখাও আমি পাঠিয়ে দিলাম কালি ও কলমে। কিছুদিন পরই আবুল হাসনাতের চিঠির উত্তর এলো।
সুজনেষু,
আপনার মেইল পেয়ে খুব ভালো লাগলো। ওঁর জন্মদিন ছিল বলে লেখাটি পরের সংখ্যায় দিতে আগ্রহী। যত দ্রুত সম্ভব সংযোজন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে পাঠিয়ে দেবেন। শহীদ কাদরীকে আমি বাংলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি বলে মান্য করি। কিন্তু কেন তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসন এ আমার কাছে এক রহস্য। তাঁর যে-কোনো কবিতাই উল্লেখ করার মতো একটি ঘটনা। জন্মদিন উপলক্ষে ওঁর নতুন একটি কবিতা পাওয়া কি সম্ভব? দেখবেন। আমি বছর দুয়েক আগে ওঁর খাতায় কয়েকটি খসড়া কবিতা দেখেছিলাম।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা
হাসনাত
(এপ্রিল ২০, ২০০৮; ভোর ১.২৩)
সম্পাদক আবুল হাসনাত সম্পর্কে আমার আগেই জানা ছিল। দৈনিক সংবাদের জনপ্রিয় সাহিত্য পাতা ‘সাহিত্য সাময়িকী’ তাঁর দক্ষ হাত দিয়েই তৈরি। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রতি অন্যরকম এক শ্রদ্ধাবোধ আত্মায় সবসময় লালন করেছি। এদিকে কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গেও তখন আমার বেশ একটা সখ্যবন্ধন তৈরি হয়েছে। আবুল হাসনাত তখন তাঁর কালি ও কলমের জন্যে শহীদ কাদরীর নতুন কোনো কবিতা খুঁজছেন। কে না চায় বাংলা থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত কবি শহীদ কাদরীর নতুন একটি কবিতা? কিন্তু কাদরীর কাছ থেকে নতুন কবিতা পাওয়া রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করার মতোই ঘটনা। আবুল হাসনাত হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। হাল ছেড়ে দিইনি আমি কিংবা কবিপত্নী নীরা কাদরীও। কিছুদিন পরই হাসনাতভাইয়ের চিঠি।
আদনান,
আশা করি কুশলে আছেন। শহীদভাই এতদিনে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন বোধ করি। ওঁর একটি কবিতা পেলে কালি ও কলমের কবিতা সংখ্যাটি সমৃদ্ধ হবে। নীরা ভাবিকে বলবেন খুব আশা করে আছি। ওঁকে সাহায্য করতে বলবেন। প্রয়োজনবোধে শহীদভাইয়ের সামনে বসে আপনি যদি লিখে নেন তাহলে খুব ভালো হবে।
প্রীতি
হাসনাত
(জুলাই ১৩, ২০০৮; ভোর ১.৫)
কবি শহীদ কাদরী নিজেই কবিতা লিখেছেন খুব অল্প। আবার কবিতা লিখতে তাঁর আলস্যও ছিল পাহাড়সম। সেই খবর আমরা সবাই জানি। তার ওপর কবিতার ভাষা আর শব্দের ওপর তিনি ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই কবির আত্মা থেকে নতুন কবিতা আদায় করা এত সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু যেহেতু সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং কবি শহীদ কাদরীর সম্পর্কটা ছিল আন্তরিক তাই কাজটি সম্পাদন করা আবার খুব কঠিন কিছু হলো না। শহীদ কাদরীপত্নী নীরা কাদরীর সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের উপর্যুপরি চাপের মুখে শহীদ কাদরী নতুন একটি কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কাছ থেকে একেবারে নতুন একটি কবিতা আমরা পেয়ে গেলাম। এ যে নতুন এক আবিষ্কার! কবিতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসনাতভাইকে সুসংবাদটি দেওয়া হলো। উত্তরে তিনি লিখলেন,
আদনান,
আশা করি কুশলে আছেন। আমরা ভালো। সেদিন আপনার ফোন পেয়ে খুব ভালো লাগলো। শহীদভাইয়ের কবিতাটি ই-মেইল করে পাঠিয়ে দিবেন। কারুর হাতে পাঠানোর দরকার নেই। শহীদভাইয়ের সঙ্গে কথা বলব। বাংলাদেশের সময় কখন ও কত নম্বরে কল করলে পাবো জানাবেন।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা
হাসনাত
(নভেম্বর ২০, ২০০৮; ভোর ১.০৫)
কথামতো কবিতাটি পাঠিয়ে দিলাম হাসনাতভাইয়ের ই-মেইলে। ই-মেইল পেয়েই হাসনাতভাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক খুশি। কারণ কবি শহীদ কাদরীর কাছ থেকে কবিতা আদায় করা এত সহজ ছিল না। তিনি দ্রুত চিঠির উত্তর দিলেন।
আদনান,
শহীদ কাদরীর কবিতাটি পেয়েছি। ডিসেম্বর সংখ্যায় দিতে চাই। আরো একটি কবিতা কি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার জন্যে জোগাড় করে দিবেন? শহীদভাইকে বলবেন দারুণ হয়েছে কবিতাটি। তাঁকে ও ভাবিকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাবেন। সঙ্গে প্রুফ পাঠালাম। দেখে দিবেন।
হাসনাত
শ্রাবণ তোমার
শরীরে লেখেছে গল্প
– তার স্বাদ ভুলি নাই।
শত্রুসেনার সতর্ক চোখ এড়িয়ে
তুমি এসেছিলে
তিনটে রাস্তা পেরিয়ে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
– ভুলি নাই
সময়টা ছিল যুদ্ধের
কারফিউ চতুর্দিকে
বোকা, হাবা, অবুঝদের
দলে মিশে গিয়ে আমরা
জ্ঞানী বুদ্ধের
বাণীর বদলে বন্দুক
নিয়েছি নির্দ্বিধায়
– ভুলি নাই।
ক্রন্দন আর কল্লোল-ভরা
এল স্বাধীনতা, শান্তি
এল যুদ্ধশেষের কান্তি
তখন তোমাকে
বলিনি কি ‘অপ্সরা’
সম্বল শুধু
তোমার মুখের কান্তি
কিন্তু তবুও দাওনি ত তুমি ধরা
– ভুলি নাই।
(নভেম্বর ২৩, ২০০৮; ভোর ১.৪০)
হাসনাতভাই নতুন কবিতা পাওয়ার পর শহীদ কাদরীর ওপর তাঁর অধিকার আরো বেড়ে যায়। অবাক হয়ে লক্ষ করি, কবি শহীদ কাদরীও যেন কালি ও কলমে নতুন কবিতা লেখার জন্যে আবার নড়েচড়ে বসলেন। সত্যি বলতে এ ছিল কবি শহীদ কাদরীর নতুন এক কাব্যজীবনের উত্থান! শুধু হাসনাতভাইয়ের চাপের মুখে কবি শহীদ কাদরী কালি ও কলমের জন্যে পাঁচ-ছয়টি নতুন কবিতা লিখেছিলেন। নতুন সব কবিতাই তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও গ্রন্থে সংকলিত আছে।
কবি রফিক আজাদ তখন নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছেন। কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে তাঁর দু-একবার দেখা হয়েছে, কবিতা নিয়ে তুমুল আড্ডা হয়েছে এবং সে-আড্ডায় আমিও ছিলাম। বাংলাদেশে বসে আবুল হাসনাত সে-খবরটিও রাখতেন। তিনি জানেন রফিক আজাদ যেখানেই থাকুন না কেন কবিতা তাঁর চাই। এই তো প্রকৃত সম্পাদকের রূপ! একজন সম্পাদকের এমন ঈগলচোখ থাকবে এই তো স্বাভাবিক! তিনি ত্বরিত চিঠিতে জানালেন,
আদনান,
আপনার ই-মেইল পেয়ে খুব ভালো লাগলো। শহীদভাইয়ের শরীর নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। রফিক আজাদ আপনাদের সঙ্গে আছে বলে মনে হলো। ওঁকে বলবেন জরুরিভাবে কবিতা সংখ্যার জন্যে কবিতা দিতে। সম্ভব হলে ই-মেইলে পাঠিয়ে দিবেন।
বইটি কি কারো হাতে পাঠাতে পেরেছিলেন? ঝন্টু কেমন আছেন? তিনি ড্রয়িংটি আমার বোনকে দিতে পেরেছিলেন?
শুভেচ্ছা
হাসনাত।
(জুলাই ৯, ২০০৮; ভোর ১.০৫ )
কিন্তু কবি রফিক আজাদকে তখন নিউইয়র্কে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কবি রফিক আজাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করতে একটু দেরি হচ্ছিল। সম্পাদক আবুল হাসনাত হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। পরদিন আবার ই-মেইল করলেন।
আদনান,
রফিক আজাদের কাছ থেকে ছোট হলেও একটি কবিতা সংগ্রহ করে অবশ্যই পাঠাবেন। সম্ভব হলে ফোন করবেন।
শুভেচ্ছা
হাসনাত
(জুলাই ১০, ২০০৮; সকাল ২.০৫)
বলার অপেক্ষা রাখে না, রফিক আজাদ আমেরিকায় বসেই দুটো কবিতা কালি ও কলমের জন্যে পাঠিয়েছিলেন।
আগেই উল্লেখ করেছি একজন লেখকের সঙ্গে একজন সম্পাদকের সম্পর্ক আত্মার আত্মীয়ের মতো। কালি ও কলমে নিয়মিত লেখালেখির সুবাদে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। এক চিঠিতে তিনি জানালেন, সিমন দ্য বভোয়ারের ওপর একটি লেখা দ্রুত পাঠানো যায় কি না। কারণ গোটা বিশ্বে তখন চলছে সিমনের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন। আমি সিমন দ্য বভোয়ারের ওপর একটি লেখা দ্রুত পাঠালাম। তিনি আমার লেখা পেয়ে খুব খুশি হয়ে একটি চিঠি লিখলেন। বুঝতে পারলাম সিমন তাঁর প্রিয় একজন মানুষ।
আদনান,
আশা করি কুশলে আছেন। ইন্টারনেটে সার্চ করে এ দুটো বই সংগ্রহ করলে খুবই উপকৃত হব। পুরনো ও পঠিত বই হলে ভালো।
আপনারা কেমন আছেন? কাজ নিয়ে কি খুব ব্যস্ত হয়ে গেছেন? বইদুটো যদি পাওয়া যায় দ্রুত জানাবেন। বইদুটো খুব জরুরি দরকার। বেশি টাকা হলে দরকার নেই।
আপনার লেখাটি পরের সংখ্যায় যাবে।
Bair, Deirdre. Simone de beauvoir. A biogrphy.New York. Summit Books, 1990
Bauer, Nancy, Simone de Beauvoir, philosophy and feminism. New York, Columbia University Press. 2001
প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
হাসনাত
(মে ২৬, ২০০৮; ভোর ৪.৩২)
লক্ষ করুন। আবুল হাসনাত তাঁর চিঠিতে এক জায়গায় লিখলেন, ‘বেশি টাকা হলে দরকার নেই’। তাঁর আবদার মেটাতে অন্য কেউ যাতে কোনোভাবে কোনো ঝামেলায় না পড়েন সেই বিষয়েও ছিল তাঁর কড়া দৃষ্টি।
সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর সব লেখক-বন্ধুর সঙ্গে সুন্দর একটি সম্পর্ক রাখতেন। কোন লেখাটি কবে যাবে এবং কোনো কারণে যদি সেটি নাও যায় সেটিও তিনি লেখককে জানাতে ভুলতেন না। আমার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হতো। পাশাপাশি কোনো ভালো লেখা হলে তিনি ছোট করে বলেও দিতেন ‘অন্য কোথাও দিবেন না’। একজন সম্পাদক একজন লেখকের প্রতি কতটুকু ভালোবাসার দাবি থাকলে এমনভাবে বলতে পারেন? নিচের চিঠিটি দেখুন।
আদনান,
আশা করি কুশলে আছেন। চলতি সংখ্যা গল্পসংখ্যা। তাই মান্টোর লেখাটি পরের সংখ্যায় দেওয়ার চেষ্টা করব। অন্য কোথাও দিবেন না।
হাসনাত।
(মে ১২, ২০১৯; সকাল ১২.২২)
একজন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদককে ঘিরে গড়ে ওঠে একটি সাহিত্য-আন্দোলন, তৈরি হয় একটি বিদ্বোৎসমাজ এবং নির্মিত হয় একটি কাল। পয়েট্রি পত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরো, কবিতা পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু, পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষসহ অনেকের মতো কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতও ছিলেন ঠিক তেমন একজন দক্ষ সম্পাদক। তিনি একটি কালকে নির্মাণ করে গেছেন। তাঁর সম্পাদনা পেশাদারিত্ব প্রশ্নাতীত। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য।
ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের মাধ্যমেও একজন পেশাদার সম্পাদক এবং পাশাপাশি একজন সজ্জন আবুল হাসনাতের চেহারাটি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.