একজন অদৃশ্য সম্পাদক

সদ্য প্রয়াত আবুল হাসনাতের সঙ্গে দুবার মাত্র কথা হয়েছে আমার। কোনোবারের কথা লেখালেখি-সংক্রান্ত নয়। ২০০৭ সালে আমি যখন প্রথমবার বাংলাদেশে যাই তখন ফরিদপুর থেকে ওঁকে একদিন ঢাকায় কালি ও কলম দফতরে টেলিফোন করি। তার আগে পত্রিকাটিতে আমার কয়েকটি ছোটগল্প ছাপা হয়েছে। সবই কলকাতা থেকে পাঠানো। হাসনাতদার সঙ্গে কথায় কথায় সেদিন ওঁর পূর্বপরিচিত, একদা বরিশালের কমিউনিস্ট নেতা আমার মামা নলিনী দাশের কথা ওঠে। ব্রিটিশ আমলে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে স্বাধীন দেশে পাকিস্তানি কারাগার নলিনী দাশ সবই ভোগ করেছেন। ১৯৫০ সালে পরিবারের সবাই ভারতে চলে গেলেও তিনি একা বরিশালের দক্ষিণে ভোলায় রয়ে যান। হাসনাতদার সঙ্গে টেলিফোন বার্তালাপে সেদিন মূলত হাসনাতদাই কথা বলেন। আমি শ্রোতা হয়ে থাকি। 

দ্বিতীয়বার আবুল হাসনাতের সঙ্গে যেটুকু কথা সেটুকু হয় সাক্ষাতে। ২০১৬ সালে কালি ও কলম ঢাকার পাশাপাশি কলকাতা থেকেও প্রকাশিত হতে শুরু করে। ‘কলামন্দির’ প্রেক্ষাগৃহে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটির পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা শুরু হয়। সেদিনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে গল্পকার নীহারুল ইসলাম ও আমাকে সুশীল সাহা হাসনাতদার সঙ্গে দেখা করান। সেদিন চাক্ষুষ আলাপের বাইরে কথা এগোনোর তেমন সুযোগ ছিল না। মঞ্চে সংক্ষিপ্ত সূচনা অনুষ্ঠানের পর আমরা বরং সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান ও তেজেন্দ্রনারায়ণের সরোদ বাজনায়।

এর বাইরে সম্পাদক আবুল হাসনাত আমার কাছে অনেকটাই অজ্ঞাত, অজানা। এবং ধারণা হয়, আরো অনেক কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক, যাঁরা পত্রিকাটিতে মাঝে মাঝে লিখেছেন, তাঁদেরও অনেকের কাছে সম্পাদক আবুল হাসনাত একজন দূরবর্তী মানুষ। সম্পাদক ও লেখকের যোগাযোগ ও মেলবন্ধন যে-কোনো পত্রিকার পক্ষে দরকারি। এক ছাড়া অপরের কাজ চলে না। কিন্তু সম্পাদক ও লেখকের দূরবর্তিতাও পত্রিকার জন্য জরুরি একটি বিষয়। এবং পত্রিকার জন্য এই দূরত্ব অবিচ্ছেদ্য ও স্বাস্থ্যকর।

ব্যক্তি আবুল হাসনাতকে ফলে আমি যতটুকু জানি তা দিয়ে ওঁর প্রয়াণে গুছিয়ে একটি অবিচুয়ারি লেখা বাস্তবতা অনুসারী নয়। বরং তাঁকে আমি চিনেছি তাঁর-সম্পাদিত পত্রিকার মাধ্যমে, আবুল হাসনাত ২০০৪ সাল থেকে মাসের পর মাস যে নির্দিষ্ট কর্মটি করে গেছেন, সেই কাজই আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সূত্র গভীরতর করেছে। এছাড়া রয়েছে তাঁর সঙ্গে আমার ও আমাদের সম্পাদক-লেখক মিথজীবিতা, এবং সে মিথজীবিতা বা সিমবায়োসিস নৈর্ব্যক্তিক ও গভীর। 

কালি ও কলম পত্রিকার যাত্রা শুরুতে পত্রিকাটি নিয়মিত কলকাতায় পাওয়া যেত না। ফলে ধারাবাহিকভাবে পত্রিকাটি রাখার কোনো সুযোগ ছিল না। ঢাকায় প্রকাশ ঘটে যাওয়ার প্রায় এক মাস পর নির্দিষ্টসংখ্যক কপি আসত কলকাতার ‘নয়া উদ্যোগ’ প্রকাশনীর কাছে, সেখান থেকে ‘পাতিরাম’ ও আরো দু-একটি স্টলে কাগজ পৌঁছত। কিন্তু প্রথমদিকের সংখ্যাগুলি যাঁদের হাতে পৌঁছেছিল বা যাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁদের তখনই মনে হয়েছিল বঙ্গ ভাষায় উৎকৃষ্ট একটি সাহিত্য-সংস্কৃতির কাগজ অতঃপর প্রকাশিত হয়ে এসেছে। ছাপাই, কাগজ বা প্রোডাকশনের কথা বলব না, আজ পর্যন্ত তার মান একই রকম, কিন্তু কালি ও কলম বিষয়ের যে বহুধাব্যাপ্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল তা বাঙালিকে আর একবার ষাট, সত্তর বা আশির দশক পর্যন্ত সাগরময় ঘোষ-সম্পাদিত দেশ পত্রিকার কথা মনে করাল, যেখানে একটি পত্রিকা একটি ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পেরেছিল।

আবুল হাসনাত-সম্পাদিত ও বিচক্ষণ সম্পাদকমণ্ডলী দ্বারা নিরীক্ষিত কালি ও কলম তার জন্মলগ্নেই অখণ্ড বাঙালি ও বাংলাভাষীর সাংস্কৃতিক মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। তাই পশ্চিমবঙ্গে আমরা যারা অনিয়মিতভাবে পত্রিকা পেতাম তাদের উদ্বেলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকত আক্ষেপ। উদ্বেলনের কারণ সহজেই অনুমেয়; খেদের কারণ এই যে, হকারভাই বাহিত হয়ে মাসের নির্দিষ্ট সময়ে পত্রিকাটি দুয়ারে এসে মুখ দেখাবে, বহু তদ্বির বহু হাঁটাহাঁটিতেও জেলা বা ছোট শহরে, এমনকি কলকাতাতেও আমরা এটি করে ফেলতে পারিনি।

ফলে ২০১৬ সালে যখন কালি ও কলম বাংলাদেশের পাশাপাশি কলকাতা থেকেও নিয়মিত প্রকাশ পাবে জানা গেল, তখন সেটি এপার বাংলার পাঠক ও লেখকের কাছে অতীব আনন্দের খবর হয়ে উঠেছিল। পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, সম্পাদকমণ্ডলীর প্রায় সকল সদস্য, যাঁদের বেশিরভাগকে আমরা ততদিন পর্যন্ত ছাপা নামেই শুধু দেখেছি, তাঁদের বর্ণময় উপস্থিতি সেদিন ‘কলামন্দির’ মঞ্চকে উজ্জ্বল করে রেখেছিল। আগেই বলেছি, ওইদিনই অনুষ্ঠান শুরুর আগে হাসনাতদার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ ও সংক্ষিপ্ত আলাপ হয়। সেদিনের মঞ্চে হাসনাতদাকে দেখে মনে হয়েছে খানিকটা যেন চাপা স্বভাবের মানুষ। পরে অন্যদের লেখাপত্র থেকে জানছি, ব্যক্তি ও সম্পাদক হিসেবে তিনি নিজের মধ্যে খানিক নিভৃত আড়ালই তৈরি করে রাখতেন।

পাঠকের সঙ্গে তো বটেই, লেখকের সঙ্গেও সম্পাদকের এই যে আড়াল, সাহিত্যের সম্মান রক্ষার জন্য বরাবরই তা দরকারি হয়ে দেখা দিয়েছে। একদা প্রখ্যাত পত্রিকা কবিতার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর নাকতলার বাড়িতে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে কবিদের আড্ডা জমত ঠিকই, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বা জ্যোতির্ময় দত্তর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী আমার নাই বা হল পারে যাওয়া থেকে জানা যায় বু.ব.-র স্বভাবের ভেতরেও ছিল সেই আড়াল, সম্পাদনার ব্যক্তিত্বের দেয়াল, অতিপরিচিত লেখকরাও সেই দেয়ালটিকে অতিক্রম করে যেতে পারতেন না। আবুল হাসনাতের স্বভাবের মধ্যে ছিল নৈর্ব্যক্তিক আড়াল, ফলে প্রত্যাশী লেখক কখনো খুশি বা কখনো মনঃক্ষুণ্ন হতেন, কিন্তু পত্রিকা প্রকাশটি বেশ সুচারুরূপে এগিয়ে যেতে পেরেছে। কালি ও কলম পত্রিকার গত আঠারো বছরের বিভিন্ন সংখ্যা পর্যালোচনা করলে বা বিভিন্ন বিভাগের লেখকসূচি দেখলে বোঝা যায় সেখানে কোনো নামই অতিরিক্ত পৌনঃপুনিকতা পায়নি, বিভিন্ন সময়ে নতুন কিছু নাম উঠে এসেছে এবং অপেক্ষাকৃত অজানা নামের লেখকদের হাত থেকে পাঠকরা স্বাদু ও মূল্যবান লেখা পেয়ে গেছেন।

প্রসঙ্গত, সম্পাদনা নিয়ে একটি নিবন্ধে সুস্নাত চৌধুরী সম্প্রতি যা লিখেছেন তা খানিক বিষয়ান্তর হলেও একজন অদৃশ্য সম্পাদক বা তাঁর নৈর্ব্যক্তিক সম্পাদনা বিষয়টির সঙ্গে নিবন্ধের অংশ সাযুজ্যপূর্ণও বটে। সুস্নাত চৌধুরী যদিও অনেকাংশে লিটল ম্যাগাজিনের কথা বলেছেন কিন্তু স্মরণযোগ্য সিরিয়াস কাজের যেসব সাহিত্য পত্রিকা, তাদের সম্পর্কেও বিষয়টি খাটবে বলেই মনে হয়। সুস্নাত চৌধুরী লিখেছেন, ‘সম্পাদনার ইংরাজি প্রতিশব্দ কী? এডিটিং। ভালো সম্পাদনার তর্জমা? ওসিডি। অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার। ভালো সম্পাদক মাত্রেই খুঁতখুঁতে হবেন। সূচিবায়ুগ্রস্ত, শুচিবায়ুগ্রস্তও। লেখকের হাড়-মাস তিনি কালি করে দেবেন। মুদ্রণকর্মীরা তাঁকে প্রকাশ্যে গাল পাড়বেন ও আড়ালে সমীহ করবেন, ভালোবাসবেন। ভালো সম্পাদনা মানে মোটেই শনিবার বিকেলে আকাদেমি আর রবিবার সকালে উল্টোডাঙার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা নয়। ঠিক যেমন, ভালো লেখক মানেই সেলিব্রিটির পাশে দাঁড়িয়ে ওয়ান্টেড-ঢঙে বুকের কাছে বই ধরে ফোটো তুলে তা ইনস্টায় সাঁটানো নয়। এগুলি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হতে পারে, কিন্তু যথাযথ সম্পাদনার সঙ্গে এই খেলো সংস্কৃতির যোগ কমই।

‘লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের সব থেকে বড় পুঁজি মর্যাদাবোধ। অকৃত্রিম স্পর্ধা। রেলা। এবং একই সঙ্গে সন্দেহ-প্রবণতা। কখনো কখনো নিজের প্রতি অবিশ্বাসও। এই চোরা অবিশ্বাসই তাকে ফাঁপা ওভার-কনফিডেন্সের হাত থেকে বাঁচাবে। যাবতীয় সহজ শব্দের বানানের মতো সে নিজেকেও যাচাই করে নেবে। ভেতরে ভেতরে চ্যালেঞ্জ করবে। …

আগেই বলেছি, আবুল হাসনাত ছিলেন অনেকের কাছে একজন অদৃশ্য সম্পাদক। যাঁর নীরব নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় বিচিত্র বিষয়ের বিভিন্ন ভালো লেখা কালি ও কলমে প্রকাশ পেয়েছে। কখনো কখনো আমরা তাঁর কলকাতায় আসার খবর পেয়েছি। কিন্তু সেসব সময় সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যথাযথ সময়ে লেখা পাঠানোর জন্য আহ্বান এসে হাজির হয়েছে ঠিকই। আসলে, যোগ্য সম্পাদক অচেনা তো বটেই, অনেক সময়ই বিশ্বাসীদের ঈশ্বরের মতো অপরিজ্ঞাত। আড়াল থেকেই তাঁর কর্ম সম্পাদিত হয়।