মেঘে মেঘে আকাশের নীল সমুদ্র ঢাকা পড়েছে। ঝাপসা অন্ধকারে প্রায় তলিয়ে গেল পৃথিবী। ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে, সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস – না, ঝড় নয়, শোঁ-শোঁ বেগে প্রবল বাতাস। ভিজে কম্বলের মতো ভারি আকাশ মাথার ওপর চেপে বসেছিল। এখন বৃষ্টির সরল ধারায় মেঘ গলে গলে আছড়ে পড়ছে আর প্রবল বাতাসে বৃষ্টির ফিন্কি ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে ফিনফিনে পাতলা চাদর – দিশেহারা উন্মাদিনীর আঁচলের মতো। বৃষ্টির ছাঁট চাবুকের মতো সাঁই-সাঁই করে পিটিয়ে দিচ্ছে জানালার কাচ। এমন বৃষ্টির সময়, আমার মনে হয়, কেউ কাজ করে না, যে যার মতো বৃষ্টির আনন্দ দেখে। এই যেমন আমি জানালার কাচে নাক লাগিয়ে পাশের মাঠের ওপর বৃষ্টির তুলকালাম ছুটোছুটি দেখছি। মাঠের কোণে কদমগাছটির পাতাগুলো উলটোপালটা লুটোপুটি খাচ্ছে আর সাদা পিংপং বলের মতো অজস্র কদমফুল হাত নেড়ে নেড়ে কাকে যে অভিনন্দন জানাচ্ছে কে জানে! হয়তো বৃষ্টিকে, মেঘকে, বা হতে পারে ধরিত্রীকে।

এই বিষম বৃষ্টির সময় হঠাৎ করে দেখি এক দঙ্গল বস্তির ছেলে – কিশোর ও বালক – লুঙ্গিটাকে মালকোঁচা মেরে দৌড়োদৌড়ি করে মাঠটায় খেলতে বা ভিজতে এসেছে। এটা খেলার একটা নিদারুণ সময় বটে, এ শুধু কিশোর-কিশোরী আর বালক-বালিকারাই জানে, বড়রা এ-খবর ভুলেছে। তাদের হুড়োহুড়ি, এলোমেলো খেলার মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটা ছন্দ এসে যায়। তবু সে যে কি হইহুল্লোড় চলতে লাগল! আমার মনে হলো বৃষ্টির এই রাজসিক বৈভবকেও  তারা হার মানিয়েছে, সারা মাঠ এখন তাদের দখলে। আমার দৃষ্টিও এখন বৃষ্টি থেকে সরে গিয়ে তাদের ওপরেই। তাদের সারা গা বেয়ে বৃষ্টিধারা গড়িয়ে যাচ্ছে ঝরনার স্রোতের মতো, চুলগুলো কপালে, কানের ওপরে লেপটে বসে গেছে – তারা ভিজছে, ছুটছে, হুটোপাটি করছে, চিৎকার করছে – আনন্দ-কলরোলে আকাশকেও নাচিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে কে বলবে ওরা অপুষ্টিতে ভোগে, কে বলবে ওরা তিনবেলা পেটভরে খেতে পর্যন্ত পায় না! শুধু মেঘ, বৃষ্টি আর মাতাল বাতাস তাদেরকে এখন আনন্দের এমন একটা জগতে ছুড়ে দিয়েছে যেখানে সমাজের কোনো উপেক্ষাই যেন তাদের নাগাল পায় না। কিন্তু আশ্চর্য! এরই মধ্যে দুটি ছেলে পাশের পুকুরে ছিপ ফেলে নিবিষ্ট মনে ফাতনার দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর কোনোকিছুর দিকে তাদের মন আছে বলে মনে হয় না। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তাদের শরীর ধুয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদেরকে দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে এবং তার মধ্যে তারা ভিজছে – তারা যেন বাহ্যজ্ঞানরহিত দুটি প্রস্তর-মূর্তি, যেন তারা নির্মল আকাশের নিচে মিষ্টি রোদের মধ্যে সোহাগ-অবগাহন করছে। মাঠের ছেলেগুলো মশগুল তাদের খেলায় – নর্তনে-কুর্দনে আকাশকেও মাতিয়ে দিয়েছে।

মাঠের মুথো ঘাসগুলো পানিতে কাদায় ল্যাপটা-লেপটি হয়েও জবুথবু হয় না, আকাশের সঞ্জীবনী ধারায় তারাও মেতে উঠেছে পায়ে পায়ে, বৃষ্টিতে গা ধুয়ে ধুয়ে বারবার তারাও সবুজতর হয়ে উঠছে।

ছেলেগুলো ছুটোছুটির মধ্যে দল বাঁধছে, দল ভাঙছে, আবার বাঁধছে আবার ভাঙছে – ছড়িয়েও পড়ছে বারবার। হঠাৎ করে এরই মধ্যে একটি বড়সড় সোনাব্যাং লাফ দিয়ে ওদের সামনে পড়ে। ওদের মধ্যে লম্বায় যে-ছেলেটা বড় সে ফুটবলে লাথি দেওয়ার মতো ব্যাংটাকে একটা লাথি কষাল। দূরে ছিটকে ব্যাংটা ছপাৎ করে একটি শব্দ তোলে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলো তাকে ধাওয়া করে। পরক্ষণেই ব্যাংটা ওদের পায়ে পায়ে ফিরতে থাকে। তুমুল কোলাহল ওঠে, বালকের দল এখন ভয়ানক নিষ্ঠুর এবং নির্মম। তারা মুখে হিসহিস শব্দ করে, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারে এবং কিছুতেই ব্যাংটাকে রেহাই দেয় না। একবার ছাড়া পেয়ে ব্যাংটা একটা লাফ দিলো। কিন্তু চোখের পলকেই আবার সে তাদের পায়ে ধরা পড়ে। নির্মম উল্লাসে এক পা থেকে আরেক পায়ে তারা তাকে লোফালুফি করতে লাগল। একসময় হাত-পা ছড়িয়ে ব্যাংটা লটাস করে আরেক পায়ে পড়লে বোঝা গেল যে তার প্রাণবিয়োগ ঘটেছে। তখনো তারা তাকে পায়ে পায়ে ফেরায়।

এখন বৃষ্টির প্রকোপ একটু কমেছে। আকাশের কোল খালি হয়ে আসছে। তুমুল শক্তিক্ষয়ের পর আকাশ ধীরে ধীরে হালকা এবং প্রশান্ত হয়ে আসছে, তবু বৃষ্টি এখনো নীল ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বিছিয়ে রেখেছে আকাশ ও ধরিত্রীতে। বড় ছেলেটি এখন মৃত ব্যাংটাকে বাঁ-হাত দিয়ে ওপরে তুলে ধরে। কুয়াশামাখা বৃষ্টির আড়ালে ছেলেটাকে তখন ছায়াবাজির মতো দেখাচ্ছিল। সে ব্যাংটাকে ওভাবে ধরে স্থির হয়ে ভিজছিল। তার চোখের মধ্যে ঝুলন্ত মৃত ব্যাঙের ছবিটা কীসের মতো দেখাচ্ছিল জানি না। আমি বিস্মিত, দেখছিলাম তাকে। সে ব্যাংটার দুই পা দুই হাতে ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে ফেড়ে ফেলল। তার ডান হাতে ব্যাংটার পেছনের রান ছিঁড়ে এলো, সে সেটাকে তুলে ধরল আরো উঁচু করে তারপর হাত নামিয়ে এনে নিজের মুখের মধ্যে গুঁজে দিল। সে এখন আকাশের দিকে মুখ করে চিবুতে থাকে। আমি জানালায় শিউরে উঠি। নিশ্চয়ই কাঁচা মাংস চিবোনোর কচকচ শব্দ হচ্ছিল। আমি দূর থেকে কাচের আড়ালে তা শুনতে পাই না। বাঁ-হাতে তখনো ব্যাংটার বাকি অংশ ঝুলছে। মুখের মাংসটা সম্পূর্ণ গিলে ফেলার পর বাঁ-হাতে ধরা ছিন্ন ব্যাংটাকে সে আবার তার চোখের সামনে আগের মতো তুলে ধরল এবং খুঁটে খুঁটে নাড়িভুঁড়ি ডান হাত দিয়ে টেনে টেনে ফেলে দিল, ব্যাংটার কালো ছায়া সমস্ত মাঠটিকে দুলিয়ে দুলিয়ে দুলতে লাগল এবং তারপর সমস্ত ব্যাংটাই সে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলল। তার খাওয়া দেখে আমার একবারও মনে হলো না যে, সে একটা অস্বাভাবিক বা অমানবিক বা অরুচিকর বা হিংস্র কোনো কাজ করছে। সমস্ত ব্যাপারটা এবং তার খাওয়াটা সে খুব নির্বিকারভাবে সমাধা করল – তাকে দেখে মনে হলো সে যেন বেশ মিষ্টি একটা ডাঁশা পেয়ারা খেয়ে আরামে, প্রশান্তিতে তৃপ্ত। বাকি ছেলেগুলো অবাক এবং ভীত চোখে তার কাণ্ড-কারখানা দেখছিল। তাদেরও কারুর মুখ কিন্তু ঘৃণায় বা বিবমিষায় একবারও কোঁচকাল না, ভয়ে বা ঘৃণায় কেউ মুখ ফিরিয়ে নিল না। তারা শুধু অবাক চোখে তাদের সঙ্গীটাকে দেখতে থাকল। খাওয়া শেষ হলে ছেলেটা বাঁ-হাতের উলটো পিঠ দিয়ে তার ঠোঁট মুছে ফেলল। তাকে খুব শান্ত এবং ধীরস্থির দেখাচ্ছিল। এরপর সে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর সঙ্গীদের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘খাইয়া ফালাইলাম।’ আবার সে মধুর করে হাসল, তারপর সঙ্গীদের পেছনে রেখে সে ধীর এবং নির্বিকার পায়ে মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠল, হাঁটতে থাকল সদর রাস্তার একেবারে মাঝখান দিয়ে। কে বলবে এখুনি সে একটা কাঁচা ব্যাং খেয়েছে!

এদিকে পুকুরের কিনারায় ছিপওয়ালা ছেলেদুটি বড়শিতে গাঁথা মাছটিকে ডাঙায় তোলার জন্য এখন প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। জলের নিমগ্ন মীন কি মানুষের সঙ্গে পারে? বড়শিতে গাঁথা মাছ, তাকে ডাঙায় উঠতেই হবে – এখন বা একটু পরে।

এখন সময়টা কী? দুপুর, বিকেল না সন্ধ্যা-পূর্ব গোধূলি? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে জ্বলে উঠল পৃথিবী। রোদ উঠেছে।

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যায় (জানুয়ারি ২০০৫/ মাঘ ১৪১১) প্রকাশিত হয়েছে।