বেসমেন্টের অন্ধকার তখনো ভালো করে কাটেনি। কে জানে দিন কী রাত! রাতই হবে। যদিও মাটির তলার ঘর, কিন্তু খুদে একটা জানালা আছে। সেটা এ-বাড়ির বাগানের সঙ্গে সংযুক্ত। সুতরাং একটু হলেও আলো আসে। দেখা যায় কর্নারে একলা দাঁড়িয়ে-থাকা নাসপাতি গাছটা। শুধু একলা নয় দারুণ শীতে সবগুলো পাতা ঝরা ন্যাড়া ন্যাংটা।

সামারে দুটো পাখির বাসা ছিল। কী করে যেন টের পায় বোবা প্রাণীগুলো। স্নোফলের আগেই কোথায় যে পালিয়ে যায়! বাগিচায় ফুল বলতে রেয়ার কালো গোলাপ। মেন গেটের দুপাশে দুটি এভারগ্রিন গাছ। শীতার্ত প্রহরেও ঝকঝকে। তাকালে বেসুরো প্রাণের কোথায় যেন ঝংকার ওঠে। কিন্তু আজকাল বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না জেসমিন। এভারগ্রিনের শাখা-প্রশাখা নেই, কেবলি পাতা। তবু এক একটায় যেন কবেকার কোন স্বপ্ননির্ভর দিন আঠার মতো লেগে আছে। কখন সকাল হবে? দেখা হবে ওদের সঙ্গে?

ভাবনার ভেতর টের পায় বার্গারের প্যাকেট আর দুধের বোতল টিপয়ে নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সিমি। জেসমিন বলল, চলে যাচ্ছিস?

কাছে এল সিমি – উম্। দেখলাম তুই ঘুমাচ্ছিস।

কে বলে? আজকাল ঘুম তো রোজকার সঙ্গী নয়, অতিথি। তবু হয় ভান করে থাকি, নয় জোর করে চোখের পাতা বুঁজে।

ভানটা কার জন্য?

ওই যে একতলায় এস্ছে এক ভাড়াটে বুড়ো-বুড়ি। ওদের বিলাস হচ্ছে সারাক্ষণ এ-ওর খুঁটিনাটি নিয়ে কথাকাটাকাটি করা। বুড়ি সেইসব শোনানোর যোগ্য মানুষ পেয়েছে আমাকে। ওহ্, অতীত, বর্তমান নিয়ে এত্তো কথা বলতে থাকে। আমি হাঁপিয়ে উঠি। অথচ সারাদিন একাকী পড়ে থাকা রুগ্ণ আমি কী খেলাম, ক্লিনিকের সঙ্গে কিছু হলো কি-না, দেশের বাড়ি থেকে কোনো মেসেজ এল কি-না, তার কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই। হ্যাঁরে সিমি, তা মানুষের বয়স বাড়লে কি বেশি বেশি স্বার্থপর হয়ে যায়?

কী জানি, তা আমি উদার বয়স্ক বেশ কয়েকজনকে জানি।

তুই ভাগ্যবতী। আমারটা চিরকাল বিপরীতমুখী।

তোর সঙ্গে অন্যদিনের মতো আজো একমত নই। ভাগ্য মানুষকে গড়ে না। মানুষই সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য যা-ই বলিস তার জন্য দায়ী।

কথা বলতে বলতে কখন কাজে বেরিয়ে গেছে সিমি! তার মানে ঘড়ির কাঁটা নটা পার হয়ে গেছে। আজ কখন সূর্যের মুখ দেখবে এ-শহর কে জানে! বড় রাস্তার শূন্যের পথ দিয়ে ঝমঝম করে পার হয়ে গেল কে জানে কোন বেলার ট্রেন! ভারি চমৎকার লাগে গাড়িটা যখন এ-পথ দিয়ে যায়।

বাড়িটা একেবারে রাস্তার ওপর। ফুটপাথ থেকে গোনাগুনতি সাতটা লোহার সিঁড়ি। সামারে সময় পেলেই ওই সিঁড়ির এককোণে বসে লোকজন দেখত। বিশেষ করে অফিস টাইমে তো রীতিমতো ভিড়। ইস্, তা এত মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা, এত মানুষের মুখ দেখা। একবারও কি এডওয়ার্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হতে নেই? ওর যে চাকরি তা নিউইয়র্কের সব রোড লেন বাইলেনে যাতায়াত করতে হয়। যে মুখ এমনি এমনি কত লোক প্রতিদিন দেখছে, তা গত দুবছরে একবারও তার নজরে এল না।

ভেবে কূল পায়নি কী হতো দেখা হলে! পথ রুখে দাঁড়াত? থু-থু ছিটিয়ে দিত মুখে? অথবা হাত ধরে বলত, আমি এখন বেসমেন্টে থাকি, তা কিন্তু অনেক শান্তির ঘর, দেখে যাও।

আসলে সে ওই জনস্রোতে কাকে খোঁজে? এডওয়ার্ড না পিয়ালকে? পুরনো ঢাকার মীরের জল্লার পিয়াল। একটু ডাকাবুকা টাইপের বলে পাড়ায় মেয়েমহলে বেশ পপুলার। জেসমিন সুন্দরী নয় তবে ঠাঁটঠমকে কথাবার্তায় আকর্ষক। চার ভাইয়ের এক বোন হিসেবে অহংকারীও কিছুটা। বাপ রিটায়ার্ড সেকশন অফিসার। ছেলেরা যেমন তেমন। মেয়েটিকে পড়িয়েছে ইংলিশ মিডিয়ামে। ফ্যাশনে ব্যবহারে একেবারে হাল আমলের মডেল। এমন মেয়ের সঙ্গে পিয়ালের মতো ছেলে আপন গরজে যুক্ত হলো। ওর একটা দামি মোটরসাইকেল আছে। ভার্সিটি থেকে যখন-তখন যেদিকে খুশি কেটে পড়া যেত। পিয়াল বলত, আমরা অন্যদের মতো হবো না। এই যে আমাদের মিলি আর সারোয়ার হুট করে রেজিস্ট্রি বিয়ে – অ, ওরা করেছে হুট করে আমরা করব ঢাকঢোল বাজিয়ে।

ধ্যাৎ, যত্তসব রদ্দি পচাগলা ইমাজিনেশন। আমরা কিছুই করব না। বনানীতে হাইক্লাস একটা দু’রুমের ফ্ল্যাট দেখে এসেছি। কিছুদিন একসঙ্গে থাকব। তারপর ডিসিশন নেব – পিয়ালের আকাশমুখী কণ্ঠস্বরে বাধা দিয়ে জেসমিন বলল, থাম থাম আর এগুসনে। তুই না হয় বাবা-মার শখে বখে-যাওয়া একমাত্র ছেলে, কিন্তু আমি হচ্ছি যৌথ পরিবার, তা-ও প্রাচীন খানদানি ঘরানার মেয়ে। আমার আব্বা হার্টফেল করবেন ওইসব করলে। তার চেয়ে যেমন আছিস তেমনি থাক।

মানে?

ভার্সিটিতে যদ্দিন আছি উড়ে উড়ে বেড়াই। তারপর দেখা যাবে।

জেসমিনের বলার ধারা পছন্দ হয়নি পিয়ালের। কিন্তু আগ-বাড়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়নি। সে একটু নড়চড় হলেই এগিয়ে আসবে পুলক। বিষয়টি ঘাঁটাঘাঁটি না করে হজম করল। সুযোগ বুঝে আবার একদিন বলল, ঠিক আছে ঢাকঢোল বাজিয়েই হবে।

ফুচকার গোলা মুখের কাছে নিয়ে জেসমিন তাকাল – অত তাড়াটা কীসের শুনি? মোটে তো টিনএজ পার করলি। বয়স একুশ।

আজকালকার ছেলেরা বিয়েটা অল্প বয়সেই পছন্দ করছে। চারদিক দেখছিস না? বলতে পারিস পুরনো পোশাকের নতুন ফ্যাশনের মতো। আমার বাবা করেছিলেন ছাব্বিশে, তার বাবা উনিশে, আমরা একুশ শতকের নিউজেনারেশন মাঝামাঝি।

নারে, এত তাড়াতাড়ি আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে তোর গলায় ঝুলতে পারব না। যদি টিকে থাকতে পারিস থাক, নইলে ফোট্।

কী আশ্চর্য! এদ্দিনের সম্পর্ক লেনদেনের কোনো মূল্য নেই?

দ্যাখ, এই বিশ্বায়নের যুগে মূল্যবোধের নড়চড় আছে, স্থবিরতা নেই। তোকে আসলে ওই যে কী আছে না দাদার আমলের সুখে থাকতে ভূতে কিলাবার প্রবাদটা, সেই রোগে ধরেছে।

সেটা যে কী আকারে কাকে ধরবে পিয়ালের বুঝতে সময় লাগল। যেন মহাশূন্য থেকে খবর আসার মতো একটা সংবাদ – ডিভি লটারি পেয়ে জেসমিন স্বপ্নের দেশ আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছে। নাঃ, বাড়ি থেকে আপত্তি ওঠেনি। জেসমিনের থাকবে ওয়ার্ক পারমিট। যেমন চালাক-চতুর মেয়ে ভালো পজিশনে যেতে দেরি হবে না। বাবা-মাকে নিয়ে যাবে।

পিয়াল ভীষণ রেগে গিয়েছিল – আর আমি আধ-খাওয়া আপেলের মতো পড়ে থাকব এখানে?

আরে তুই কি আমার জীবনে বানের পানিতে ভেসে-আসা কেউ? তোকেও নিয়ে যাবো। আমার ওপর আস্থা রাখ।

কথা দিতে পারব না। বেশিদিন খালি পড়ে থাকার কষ্ট আমায় কোথায় নিয়ে যাবে আমি নিজেও জানি না। তবে অপেক্ষা কিছুদিন নিশ্চয় করব। আমার ভালোবাসাটা বুকের ভেতরের, বাইরের নয়।

এমন করে বলছিস যেন পুরো ব্যাপারটা একতরফা ঘটেছিল। ভাবিস না। মন আমারও খারাপ লাগছে।

তবু চোখের স্বপ্ন মোছা যাচ্ছে না। তাইতো?

সত্যি যাচ্ছে না। অমন বিশাল সুন্দর একটা দেশ। পুরোধা একটা দেশ। প্রযুক্তি-নিযুক্তি সব ধরনের ক্ষমতা, ফ্যাশনের চক্র গোটা পৃথিবীতে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে যাবার সুযোগ পাওয়াটাকে সৌভাগ্য মনে করছিরে।

সামারে এসেছিল জেসমিন। কিন্তু লাক ট্রাইয়ের ব্যাপারটা শুরু থেকেই যেন বৈরী ভূমিকা নিয়ে থাকল। শুরুতে এক রুমের ফ্ল্যাটে উঠেছিল তারই মতো ডিভি লটারি পাওয়া নীলুফারের সঙ্গে, যে নিজেকে পরিচয় দেয় লিসা নামে। তার নামটাও ছেঁটে করে দিয়েছিল জেসি। সেই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ব্যাপারটার পর থেকে অনেক পুরুষ যেমন নামের আগে থেকে মোহাম্মদ ছেঁটে দিয়েছে, তেমনি মেয়েরাও নিয়েছে ছোট ছোট বিদেশী নাম। কাজ পাওয়া সুবিধা, মেলামেশা, ভালো চাকরি।

লিসা শুরুতেই একটা পেট্রোল-পাম্পে ঢুকে গেছিল। জেসমিন পেয়েছিল সেলস গার্লের কাজ। সান্ত¦না দিয়েছে শুরুটা যা-ই হোক, ভবিষ্যৎ অবশ্যি উজ্জ্বল। ছোট্ট হলেও যে-শহরটিতে প্রথম এসেছিল সেটা সত্যি ছবির মতো। এত সবুজ, এত ফুল আবার আটলান্টিকের সৈকতও আছে। দূরে একটানা নীল পাহাড়। ঠিক নীল নয় প্রহরে প্রহরে রং বদলায়। প্রতিদিনের সূর্য পাহাড়গুলোকে যেন বেলায় বেলায় পোশাক পালটে দেয়। জনসংখ্যার চেয়ে জমি বেশি। তারচেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা। ছোট হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ এক নগরী। শুরুতে শীতে কাতর হতো, ভাষা বুঝতে অসুবিধা। বাসন-কোসন থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ বিরক্ত ধরাত, কষ্ট লাগাত। কী করে কী করে সব যেন স্বাভাবিক মনে হতে লাগল। যা নয় তা-ই বলে বাবা-মাকে এয়ার লেটার পাঠাত।

সেলসের কাজের কিছু গাফিলতির জন্যে চাকরি গেল। লিসা জুটিয়ে দিল রেস্তোরাঁর ওয়েট্রেসের কাজ। শেষটায় – চাকরির সূত্রে পাওয়া বিশেষ ড্রেস নিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল জেসমিন। বাবা-মাকে কক্ষনো জানাতে পারবে না ঢাকায় সখিনা, মতির মা যা করে এখানে সে তা-ই করছে। লিসা বলল, করতেই হবে এমন নয়। যদ্দিন ভালো লাগে করবি।

নিচু মুখে জেসমিন – ভালো তো একদিনও লাগে না। পেট এত সাংঘাতিক আগে বুঝিনি। তাছাড়া সামনে উইন্টার। গরম পোশাক-টোশাকও কিনতে হবে। যা দাম এখানকার জিনিসপত্রের।

নাঃ, তোর গা থেকে এখনো তৃতীয় বিশ্বের গন্ধ গেল না। এখনো তুই সেই ঘোরের মধ্যেই আছিস, এক ডলার মানে ষাট-বাষট্টি টাকা।

সত্যি তাই। তিন-চার ডলারে নাস্তা করলে মনে হয় দুশো টাকার ওপর খেয়ে ফেললাম। দিনে দিনে এই সংখ্যা আরো বাড়বে।

না, বাড়বে না। মার্কিন সরকার একটা দিকে ভীষণ কড়া।

রুটি-দুধ-পেট্রোলের দাম সব সময়ই প্রায় এক জায়গাতেই থাকে।

তাহলে তো খুবই ভালো। দুধ-পাউরুটি ছাড়া একবেলাও কি চলে! আর পেট্রোল নিয়ে কী-বা মাথাব্যথা? খাবারই জোটে না তো গাড়ি!

আরে বোকা মেয়ে, গাড়ি তুই ছমাসের মধ্যেই কিনতে পারবি।

ডলার বুঝি আকাশ থেকে উড়ে আসবে?

প্রায় তাই। এদেশে গাড়ি কী বাড়ি কিনতে খুব বেশি সময় লাগে না। একবারে একটা অ্যামাউন্ট ধরিয়ে দিতে পারলে গাড়ি-বাড়ি সব তোর।

তাজ্জব? কী করে?

বাকি টাকা কিস্তিতে কিস্তিতে শোধ দিবি। সে-ও এমন অঙ্ক গায়ে-লাগার মতো নয়। কারো তো গোটা জীবন লেগে যায় এই ধার শোধ করতে।

অ্যাঁ, বলিস কী?

বারে, কি মানবিক নিয়ম না? বাড়ি-গাড়ি নিজের হলো অথচ মাসে মাসে যে-টাকাটা দিবি সেটা একদম গায়ে-লাগার মতো নয়। দেখবি খুব শিঘ্রি আমি একটা অস্টিনের মালিক হয়ে যাচ্ছি। এজেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় পাকাপাকি হয়ে এসেছে।

নাঃ, সত্যি তুই সাহসী মেয়ে। এক থোক টাকা – দ্যাখ, ওই ঘোরটা কাটাতে হবে। মানে মগজ থেকে টাকার হিসাব বের করে দিতে হবে। টাকা কীসের? ডলার। ডলারে কামাই করি। ডলারে খাই। এক ডলার মানে এক ডলারই। ষাট-সত্তর টাকা নয়।

লিসা যখন কথা বলে জেসমিন পলক না-ফেলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ও এসেছে প্রায় পাড়া গ্রাম-ঘেঁষা মফস্বল শহর থেকে। ফৌজদারি কোর্টের কেরানির মেয়ে। কিন্তু কী ব্যবহার, কী ঠাঁটবাট, কী গ্রহণ-ক্ষমতায় অল্প সময়ে এমন হয়ে গেছে যেন জন্মেছে এদেশে, বেড়েছে এখানে, এখানকারই কালো আমেরিকান।

সেদিন রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না। হাঁটাহাঁটি করছে। লিসা নাইটক্রিম লাগাচ্ছিল, বলল, কী হলোরে?

বড্ড গরম লাগছে। হিটার কি বাড়িয়ে দিয়েছিস?

না। ব্যাপার কী? গরম লাগার মতো কিছু ঘটেছে বুঝি?

ন্না। মানে এক সাদা ভদ্রলোক সানডেতে তার সঙ্গে লাঞ্চের প্রস্তাব দিয়েছেন। অচেনা নয়, রেস্তোরাঁর পুরনো কাস্টমার।

না করেছিস?

হ্যাঁ-না কিছুই করিনি।

লুফে নে। বোকার মতো কাজ করিসনে।

কিন্তু লাঞ্চের পর যদি লং ড্রাইভে যেতে বলে?

অসুবিধাটা কী? দিব্যি বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসবি। এরা আমাদের দেশের মতো চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে গায়ে হাত দেয় না। যা করে বলেই করে। লাঞ্চ কী, ডিনারে যেতেও আপত্তি করিসনে। আমি তো প্রায়ই এমন প্রস্তাব অ্যালাও করে খাবার-খরচা দিব্যি সেভ করি।

কিন্তু ভাই ছেলেটা বয়সে যুবক। দেখতেও ভালো।

তাতে কী হয়েছে?

না, বলছিলাম কী একটু বয়স্ক হলে –

থাম থাম। তুই একটা রাম গাধা। তোকে তো বলেছি কারো কারো সঙ্গে শুতেও আজকাল আপত্তি করছি না। রাতের লং ড্রাইভে ব্যাপারটা গাড়িতেই মিটে যায়। তো দেখেছি যুবকরা ওই বুড়োগুলোর চেয়ে অনেক ভালো। মানে ভদ্র। বয়স্কগুলো যেন আকালের দেশ থেকে আসে।

লিসা আয়নার ধার থেকে বিছানায় পড়ে কম্বল টেনে নিল। নাক ডাকতেও দেরি হলো না। জেসমিন পায়ে পায়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এক হাতে গাল ধরে ঘুমাচ্ছে লিসা। ইস্, আগের তুলনায় কত মসৃণ হয়েছে লিসার ডানা, হাতের ত্বক। চেহারায় এসেছে ভালো খাবার-দাবারের জেল্লা। কত পুরুষের কেচ্ছা বলে। যাদের সে ভাবে শেয়াল।

কই কোথাও তো খাবলে ছিঁড়ে খাবার চিহ্ন নেই। বরং সব উলটো। ঘুমন্ত লিসার গায়ে যে নাইট ড্রেস সেটা রীতিমতো দামি। দেহে, মন-মানসিকতায় লিসার মতো সে কেন হতে পারে না। দিনে দিনে দাম্ভিক হয়ে-ওঠা লিসা হেয়ার স্টাইল বদলে এসে কী চমৎকার ভঙ্গিতে কাঁধে ঝাঁকানি রেখে বলে, বড্ড জোশে গেল ছুটির দিনটা। আমি তো তাদের সঙ্গেই ঘুরতে যাই, পছন্দ হলে তবে। আজ সারাদিন এক মাঝারি নামের মডেলের সঙ্গে। কালও সী-বিচে আমাদের দেখা হবে। নিশ্চয় কাল ও আমাকে ওই লাইনে আসার জন্যে অফার করবে। না করলে কৌশলে আমিই এগুবো। ওহ্, ভাবতে পারিস মার্কিন মুলুকে বাঙালি মডেল।

কেন পারবো না, এরা হচ্ছে হুজুগে জাত।

ওমা, মেয়ের যে মুখে খই ফুটেছে। কে ফোটাল গো?

তুই ভাই ভুলে যাস, একদা আমি বড়লোকের আদুরে কন্যা ছিলাম। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড চলতি জীবনের বড় সম্পদ। অন্তত এখানে এসে বেশি করে ফিল করছি।

তবেই গেছিস!

লিসার কথায় মনে মনে সেদিন হেসেছিল জেসমিন।

সে তখন বেশি টাকায় দর্জির দোকানে কাজ নিয়েছে। ওই সূত্রে পরিচয় হয়েছে এডওয়ার্ডের সঙ্গে। কোনো একটা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। ভালো মাইনে। দেখতে গড় আমেরিকানদের মতো। ভারি ভদ্র ব্যবহার। এ-শহরে যে সমুদ্র আছে সে জানত। কিন্তু কখনো যাবার সৌভাগ্য হয়নি। দেশে থাকতে কক্সবাজারের সৈকতে সে গেছে। কিন্তু ওটা কি সমুদ্র? এই সাগরের কোনো তুলনা হয় না। কী উত্তাল সফেন বড় বড় ঢেউ। দূরের পাহাড়গুলোর মতো বেলায় বেলায় রং বদলায়। সন্ধ্যা রাতের হাজার আলোর প্রতিফলন নিয়ে মহাগর্জনে তরঙ্গরা যখন তীরের দিকে পাগলের মতো ছুটে আসে অত ভালো লাগার মধ্যেও এডওয়ার্ডের বুকে মুখ লুকায়। যেন ছোট্ট একটা সী-গাল সফেদ ঢেউয়ের শব্দে খেলা করতে করতে হঠাৎ আশ্রয় নিয়েছে তার কোটের পকেটে এমনি আদরে জড়িয়ে রাখে এডওয়ার্ড জেসিকে। কাজ করে দর্জির দোকানে, কিন্তু তখনো এমন লংকোট কিনে উঠতে পারেনি, যা দয়িতের পোশাকের সঙ্গে মাত্রা রক্ষা করতে পারে। সময়টা গরমের হলেও নৈশ সিন্ধু-তট রীতিমতো হিমশীতল। এডওয়ার্ডের বুক যেন সেই সরোবর, মিষ্টি উষ্ণতায় আরামে যে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

রাতে ওর লিফটেই বাড়ি ফেরে। লিসা সিগারেট লাইটারের সংযোগ দিতে দিতে হাসে – এই তো লায়েক হয়ে আসছিস। তো ছোকরা কদ্দিন খেলবে বলে তোর মনে হয়?

হাতে-পায়ে লোশন লাগাতে লাগাতে গর্বের হাসি চমকায় জেসমিনের দুগালে – ও খেলোয়াড় ছেলে নয়।

ভালো ভালো। এ রাজ্যে যত আত্মবিশ্বাসী হবি তত আত্মার উন্নতি হবে… কী হা করে আছিস? আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলছি? না, আসলে বৈজ্ঞানিক। তুই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে। আমি স্কুল পাশ করতেও পারিনি। তুই এসেছিস ডিভিতে, আমি এসেছি ওপি-ওয়ানের লটারিতে। একানব্বুইতে এসেছিলাম। কত বছর! পড়াশোনা হয়নি কিন্তু জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতায় টনটনে শিক্ষিত।

অ্যাশট্রেতে ছাই ঝেড়ে লিসা বলল, ভালো কথা, নতুন যে-চাকরিতে জয়েন করেছি, এই পাড়া, এক রুমের ফ্ল্যাটে আর মানায় না। পুরো ভাড়া ম্যানেজ করতে পারবি, না পার্টনার জোগাড় করে দেবো? একটা কালো মেয়ে আমায় খুব ধরেছে পার্টনারশিপে ঘর খুঁজে দিতে।

বিছানার ওপর জোড় আসনে বসে জেসমিন একটু র্গবি হাসি দিয়ে বলল, আজ রাতেই যে-কথাটা বলব ভেবেছিলাম সেটা কথা-প্রসঙ্গে এসে গেল। এডওয়ার্ড বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, আপাতত ওর ফ্ল্যাটেই উঠে যাবো।

ফ্ল্যাটে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে আংটি-বদলের ব্যাপারটাও কোর্টে চুকে গেছিল। এডওয়ার্ড প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে এসেছিল নিউইয়র্কে। আদর করে বলেছিল, তুমি আমার মিষ্টি বৌ শুধু নও, পয়মন্ত বৌও বটে।

জেসমিন প্রশ্ন করেছিল, তোমরা এসব মানো না-কি?

এটা সুপারস্টিশন নয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে আমি বুঝতে চাই। কোনো কোনো পাথর ভাগ্য বদলায়। মানে যেখানে পাথর এবং মানুষের ত্বকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মিলমিশ খায় সেখানেই ঘটে সাধারণের কাছে মিরাকল ব্যাপারটি। তুমি আমার সেই পাথর যা আমাকে শুভ অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে।

বিষয়টা কি দুজনের জন্য একই খাতে বহমান ছিল? দেশে বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা অনিয়মিত হয়ে এসেছিল। বিয়ের খবর জেনে ভেতরে যা-ই হোক বাইরে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। মা আরো বাড়তি পৃষ্ঠায় প্রকাশ করেছেন একমাত্র মেয়ের সংসারটি কেমন, দেখার বড় সাধ।

জেসমিন বড় মুখে আশ্বাস দিয়েছে, সামনের ক্রিসমাসে বাবা-মা দুজনকেই আনার ব্যবস্থা করবে।

জীবন তো সুখের নয় স্বর্গের। যদিও তার ইচ্ছে ছিল স্রেফ গৃহবধূ থাকবে। এডওয়ার্ডের পছন্দ হয়নি। ভালো একটি কাজ জোগাড় করে দিয়েছিল। জেসমিনও পরে ভেবে দেখেছিল তার স্বামীই ঠিক। সারাটা দিন একা ঘরে থেকে সে কী করত! দিনেমানে কয়েকটা কুকুরের ডাক ছাড়া শব্দ কই? দুবেলা স্কুল বাস যায়, লেটারম্যানের চেহারা দেখা যায় কখনো। সামান্য হল্লা শোনা যায় বিকেলের দিকে যখন কাছাকাছি স্কুল থেকে প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ফেরে।

ঘন ঘন ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা দেখে। কবে আসবে ক্রিসমাস? পরিকল্পনার কথা এডওয়ার্ডকে জানানো হয়নি এখনো। হঠাৎ মনে হলো, এমনও তো হতে পারে স্বামীর প্ল্যান রয়েছে তার শাশুড়িকে আনার। সে শুনেছে ব্যক্তিস্বাধীনতার তুখোড় সমর্থক মার্কিনিরা যৌথ জীবন দূরে থাক পারিবারিক জীবনেও অভ্যস্ত হতে চায় না। মানে বুড়ো বাবা-মা সংসারী ছেলের সঙ্গে নয়। বাস করে যে যার মতো আলাদা। বড়দিনের ছুটিতে কার্ড বিনিময়, উপহার, কারো বা দু’চারদিনের জন্যে বেড়াতে আসা।

এডওয়ার্ড গার্ডেনিং পছন্দ করে। বিশেষ করে অর্কিড। ছুটির সকালে এগুলোকে খুব যত্ন করে দেখাশোনায় সময় দেয়। উবু হয়ে বসা এডওয়ার্ডের কাঁধে একটুক্ষণ গাল ঘষল। ঘুরে একবার চুমুও খেল সোহাগী স্ত্রীকে তার প্রিয়তম স্বামী। জেসমিন আদুরে গলায় বলল, হ্যাঁগো, একটা কথা বলব?

কী আশ্চর্য! আজ কি অফিস আছে যে মেপে মেপে কথা বলা চলবে। বরং কথা আর কথার রাজ্যে আমরা ভেসে যাবো।

বলছিলাম, সেদিন তোমার মামের চিঠি পেলে না?

উম্, লিখেছেন আমার জন্য খুব জমকালো রং আর প্যাটার্ন দিয়ে পুলওভার বুনছেন। ক্রিসমাসের আগেই পার্সেল পেয়ে যাবো।

তিনি নিজে আসবেন না?

গত বছর এসেছিলেন। আমি খুব যত্ন-টত্ন নিতে পারি না। মানে ভালো লাগে না।

এটা কিন্তু ভারি অন্যায়।

হতে পারে। তবে গ্রানির বেলায়ও দেখেছি মার কাছে খুব-একটা আসতেন না। মারও তেমন গরজ দেখিনি। তিনি আমাদের দু-ভাইকে নিয়েই বেশি ব্যস্কত থাকতে পছন্দ করতেন ছুটিছাটায়।

আচ্ছা ধরো এমন যদি হয় – জেসমিন এডওয়ার্ডের খোলা কাঁধের একদিকে গাল ডুবিয়ে দিয়ে কথা শেষ করল, আমার খুব ইচ্ছে বড়দিনের সময়টা আমার বাবা-মা আমাদের সঙ্গে এসে কাটান। মানে – কথা শেষ হবার আগেই ঘুরে বসল এডওয়ার্ড – হোয়াট।

ঢোক গিলল জেসমিন – তারা চায়নি। আমিই তাদের আমন্ত্রণ জানাব।

কই আমার সঙ্গে তো ডিসকাস করোনি।

এই যে করলাম।

ওদিকে আমি তো ঠিক করে রেখেছি পুরো ছুটি ডালাসে কাটাব।

দ্যাখো, তুমিও কিন্তু আমায় কিছু বলোনি।

সারপ্রাইজ দেবো বলে।

দাও। কিন্তু বাবা-মা সঙ্গে যাবেন। এ-দেশটা দেখা তাদের স্বপ্ন। তোমার সম্পর্কেও তাদের চমৎকার ধারণা।

কিন্তু জেসি জানো তো ওইসময় টিকিটের চাহিদা বাড়তি দাম সবই বেশি থাকে। তাই আগে থেকে আমি মাত্র দুটো টিকিটই কেটে রেখেছি। এমন কি হোটেলের রিজারভেশন পর্যন্ত এক সুইটের।

উম্, তাতো দেবেই। তোমরা মার্কিনিরা হচ্ছো ব্যক্তি-ভোগবাদীর চরম সমঝদার। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে শেষ পর্যন্ত কোথায় তোমরা দাঁড়াবে নিজেরাও জানো না।

নাহ্, কথাগুলো মুখে বলেনি জেসমিন। ঢাকায় বাবা-মাকে মিথ্যে লিখেছে তারা ছুটিতে শ্বশুর- শাশুড়ির কাছে কাটাতে যাচ্ছে।

বাবা-মা স্বপ্নভঙ্গের ভেতরও সদয় জবাব পাঠিয়েছেন – সে-ই ভালো। তোদের তো বড় ছুটি বলতে ওই একটাই। আর তারাও বাবা-মা। তোর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হবার এই সুযোগ। আমরা না হয় সামনের বছর আসব।

 জেসমিন লুকিয়ে কেঁদেছে। তার ধারণা পরিবারের জন্যে কান্না অভাববোধ এরা একদম পছন্দ করে না। যথাসময়ে ডালাস বেড়াতে গেছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন। নাহ্, স্বাভাবিক কোথায়? সেই ঘটনার পর থেকে মাঝে একটা দেয়াল টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেটা দিনে দিনে বেড়েছে।

একসময়ে দুজনই সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এডওয়ার্ড বদলি নিয়ে চলে গেছে অন্য সিটিতে। জেসমিন কাজের পর কাজ বদল করেছে। মন টেকেনি কোথাও। দেশে ফেরা যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাবার ইচ্ছাটাকে দমন করেছে। এমন কী বাবার হার্ট বাইপাসের খবর শুনেও পাথরের মতো শক্ত হয়ে থেকেছে। সে জখমি হয়ে যাচ্ছিল পরাজিত ভাবনায়। স্বপ্নের এই দেশে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, আগের মতো আর সেখানে সংযুক্ত হওয়া যায় না। মাঝে সেই অদৃশ্য দেয়াল যা দিনে দিনে বাড়ে, কমে যায় অতিক্রম করার শক্তি।

বাড়ির চিঠিপত্রের জবাবও খুব একটা দেয় না। গ্রোসারি শপের কাজ সেরে এলে নিজেকে মনে হয় নিদারুণ ক্লান্ত। এই ক্লান্তি দূর করতে জীবনে এসেছে আর একজন। খুলনার রুবেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। শুরুতে এটা-সেটা ধরে এখন পুরোদস্তুর ট্যাক্সি ড্রাইভার। রোজগার একটু নয়, খুব ভালো। যদ্দিন সে বন্ধু ছিল জেসমিনের তাকে সহ্য হতো। প্রেম নিবেদন করতেই শুধু প্রেমিক নয় জীবিকাও বদলে নিল। হালের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সিমি যখন বুঝিয়েছে প্রেম, ভালোবাসা, সংসার ছাড়া একটা মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না, ততই তার মনে হয়েছে ওগুলো কাগুজে বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। বেশ আছে একা। স্বাধীন। শুধু নিজের জন্যে নিজের ভাবনা। জীবন তো একটাই, এমনি করে চলে যাবে। পিয়ালের কথা আজকাল বড্ড বেশি মনে পড়ে। আচ্ছা, এ দুনিয়ায় কত আজব আকস্মিক ঘটনা ঘটে। এমন কি হয় না হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাবে পিয়ালের সঙ্গে? হয়ত বিবাহিত। হয়ত একহাতে ধরা দেখবে একটি শিশু। কিছু আমেরিকান মহিলার মতো সে যেমন পৃথুলা হয়ে উঠেছে হয়ত চিনবেও না। তবু একবার দেখা হোক। সেইসব দেশী খাবার আবার তার টেবিলে আসুক যা দেখে একসময় নাক সিটকাত। সেই কোরবানির মাংস দেওয়া পাতলা খিচুড়ি, সর্ষেবাটা, সজনে ডাঁটা আর চাক চাক আলুর চচ্চড়ি। একটু লালচে চালের ভাতের সঙ্গে বেগুন ভর্তা, কচুর লতির নিরামিষ, লাউ দিয়ে শোল মাছ, টক দৈ, ইলশে …

মা কী সুন্দর রান্না করতেন! বড় ভাবি সাজাতেন টেবিল। ডিম গড়নের কাঠের বস্তুটার চারদিকে আটটা চেয়ার। মাস্টার কুর্সির একটায় সে। অন্যটিতে আব্বা। এখন, এদ্দিন তার পরিত্যক্ত আসনে কে বসে?

জেসি, আজ তুমি কেমন আছ?

খুদে জানালার বাইরে রোদের ঝলক। সেই আলোয় জেসমিন রুবেলকে দেখল। হাতে ফুল। প্যাকেটে কিছু খাবার।

ঘুরে শুয়ে জেসমিন বলল, আবার তুমি এসময় কেন এলে? সিমি বলেনি আমি সিক-কলে রয়েছি?

রুবেল চেয়ার টেনে বলল, সিমি বলার আগে আমার মন বলছিল।

কেন সানডে দুপুরটা তোমার সঙ্গে তোমার ফ্ল্যাটে কাটাইনি বলে?

তুমি মার্কিনিদের মতো কথা বোলো না। এখনো আমরা দেহসর্বস্ব মানুষ নই। তুমি আমায় বারবার তাড়িয়েছ। আমি আবার ফিরে এসেছি। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক যদিও টিকিয়েছি শারীরিক স্বাভাবিক লেনদেনের মধ্যে। কিন্তু আমার বুকে শুধু কামনা নেই, ভালোবাসাও রয়েছে। এবং আশা রয়েছে একদিন তুমি ভাবনা-চিন্তায় আবার স্বাভাবিক হবে। তাই তো তোমার খেয়াল তোমাকে দিয়ে যা করায় আমি স্বীকার করে নিই। শুধু সহ্য করতে পারছি না তোমার এই অন্ধকার বেসমেন্টের স্বেচ্ছা-নির্বাসনের ব্যাপারটা।

সইতেই হবে। কেন নয়? এটা ব্যক্তি-স্বাধীনতার দেশ। তুমি এখন যাও। একাই ভালো লাগছে।

যাচ্ছি, তবে তুমি যেটা ব্যক্তি-স্বাধীনতার দেশ বললে আমি বলি মাকড়সার জালের দেশ। যে-জাল কেটে কখনো আমি বেরিয়ে যাবো দেখো।

রুবেল চলে যেতে যেতে শুনল জেসিমন উঁচু গলায় হাসতে হাসতে বলছে, পারবে না। পারবে না।

রুবেলের আনা খাবারের প্যাকেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে আলো জ্বালল। টাকোবেল, হটডগ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। একলা ঘরে কথা বলল জেসমিন – থাক অমনি। অন্ধকারে আরশোলারা এসে খেয়ে যাবে।

সন্ধ্যায় এল লিসা। রাত বারোটার ফ্লাইটে বাংলাদেশ বিমানে দেশে যাচ্ছে দুমাসের জন্য। বলল, কী দিবি বলেছিলি?

দেয়াল-আলমারি থেকে একটা এয়ার ব্যাগ বের করে দিয়ে জেসমিন বলল, ফোন নাম্বার লেখা রয়েছে। ফোন করলেই ওরা কেউ এসে নিয়ে যাবে। তুই আব্বা-আম্মাকে একটা কল দিস। বলিস, আমি এখানে খুব ভালো আছি। যে-কোনো ক্রিসমাসে তাদের এখানে বেড়াতে নিয়ে আসব। খবরদার – এর বেশি একটা কথাও নয়, প্রমিস।

লিসা লম্বা নিশ্বাস লুকিয়ে উচ্চারণ করল, প্রমিস। ৎ

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (মে ২০০৪/ চৈত্র ১৪১০) প্রকাশিত হয়েছিল।