জ্যোতিভূষণ চাকী

অনির্বাণ রায়
আমার মামাবাড়ির উলটোদিকে থাকতেন শিল্পী সীতেশ রায়। যামিনী রায়ের ধরনে ছবি অাঁকতেন। ইশ্কুলে ছুটিতে মামাবাড়ি এলে সময়-সুযোগ পেলেই চলে যাই সীতেশ রায়ের ঘরে। একদিন তাঁর টেবিলে দেখলাম একখানা ছড়ার বই। ছড়া পিদ্দিম জ্বলে। লেখক জ্যোতিভূষণ চাকী। ছবি সীতেশ রায়। এই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয়। সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর পরে। এক প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করি তখন। একদিন সংস্থার পক্ষ থেকে যেতে হয়েছিল জ্যোতিভূষণ চাকীর নিবাস, ৮১ কাঁকুলিয়া রোডে। তিনতলার পশ্চিমমুখো চওড়া বারান্দার কাঠের টেবিলের সামনেকার চেয়ারে সমাসীন। দুপাশে ছাত্রের দল। তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে প্রস্থান। এরও অনেককাল পরে আবার একদিন যেতে হলো তাঁর কাছে। একটা উর্দু অনুবাদ তিনি পরীক্ষা করে মতামত দিতে রাজি কি না সেটা জানার জন্য। অমিয় চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত পত্রাণু মিনি ম্যাগাজিনের সৌজন্যে জানতাম জ্যোতিভূষণ চাকী একাধিক ভারতীয় ভাষা জানেন। পাঞ্জাবি, ওড়িয়া, নেপালি, হিন্দি, আরবি, ফার্সির সঙ্গে জানতেন উর্দু আর স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান, এসপেরান্তো ইত্যাদি অনেক ভাষা। শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়। সেদিন অনুবাদ পরীক্ষকের সম্মতি আদায় করে আনন্দচিত্তে ফিরে গিয়েছিলাম কর্মস্থলে। আর তারপর, বারেবারেই যেতে হয়েছে তাঁর দুয়ারে। কখনো তিনি বলেছেন দেখা করতে। কখনো গিয়েছি নিজের প্রয়োজনে। সুখ-দুঃখের কথা নিবেদন করে শান্তি পেতে। কখনো বিমুখ হইনি।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলা থাক। ডুব দিই জ্যোতিভূষণ চাকীর জীবনবৃত্তান্তে।
অহিভূষণ জ্যোৎস্নাময়ীর জ্যেষ্ঠ সন্তান জ্যোতিভূষণের জন্ম অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরে ১৯২৫ সালে। দিনাজপুরে মামাবাড়িতে শৈশব-কৈশোর কেটেছিল। ‘দু’বছর বয়স থেকেই। তাই মাকে আমার ভালো মনেই পড়ে না। শুনেছি আমার নাকি বাঁচারই কোনো আশা ছিল না জন্মলগ্নে। তাই যাঁর চেষ্টায় আমার পুনর্জন্ম সেই দিদিমার কোলেই মা আমাকে সমর্পণ করেছিলেন। ডাকতে শিখে দিদু বলেছি দিদিমাকে। তিনি আমার নাম দিয়েছিলেন ‘পরান’। সত্যি আমি তাঁর প্রাণের মতোই ছিলাম।’ এই দিদিমাই প্রথম তাঁকে ঝিনুকে করে চা খাওয়ান। দিদিমার কণ্ঠে শুনতেন সংস্কৃত গীতাপাঠের ধ্বনি। শোনাতেন রামায়ণ-মহাভারতের গল্প। রামায়ণের গল্পই বেশি। দাদামশাই ছিলেন জজকোর্টের টাইপিস্ট। দাদু শোনাতেন রূপকথা। মামাদের ভেতর কেউ ছিলেন ব্যায়ামবিদ। কেউ শিখতেন নাচ-গান। কেউ ছিলেন ভালো খেলোয়াড়। আর এক মামা ছিলেন সাহিত্যে উৎসাহী। তাঁর সৌজন্যে বাড়িতে আসত ছোটদের পত্রিকা। কিশলয়, মাসপয়লা, শিশুসাথী।
দিনাজপুরে শুরু হয়েছিল ইশ্কুলজীবন। এখানকার জেলা স্কুল থেকে পাস দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। মামাবাড়ি ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল খুবই। যে-বাড়িতে বেড়ে উঠেছিলেন, আগামীদিনের মনের অনেকখানি তৈরি হয়েছিল, সে-বাড়ি ছেড়ে মন তো কাঁদবেই।
‘মনের মধ্যে কিছু কিছু অাঁচড় পড়ে, কোনো কোনোটায় একটু রক্ত বেরোয়… তা ছাড়া এই যে পরিবেশটা, এই অচেতন সব জিনিস এদের সঙ্গেও কি আমার নিবিড় সম্বন্ধ গড়ে ওঠেনি? তাই ওদের কাছেও বিদায় নিয়ে যাই।
আমি যাচ্ছি, ও আমগাছ লিচুগাছ, আমি যাচ্ছি, ও লাইটপোস্ট, আমি যাচ্ছি। বাতাবিতলা, আমি যাচ্ছি। বড়োকোঠা, মেজোকোঠা, সেজোকোঠা, কুঠুরি! আমি যাচ্ছি। যেন এরা অস্ফুটভাবে বলেও উঠল, বালাই ষাট, যাচ্ছি বলতে নেই, বল ‘আসছি’। তা-ই বলছি – আমি আসছি। আমি আসছি। তোমরা ভালো থেকো। আমি আসবই, আবার দেখা হবে। তোমরা আমাকে ভুলো না।’
পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলেন। ইন্টারমিডিয়েটের পর সায়েন্স পড়ার সাধ ছিল। অধ্যাপক অমিয়নাথ চক্রবর্তীর ইচ্ছায় পড়তে হলো আর্টস। সংস্কৃতে অনার্স। কলেজের অন্য অধ্যাপকদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সাহিত্য-সংগীতচর্চার দৌলতে কলেজে ছেলেদের সংস্কৃতি পরিচালনার ভার নিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে কলেজ সোশ্যালে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাদুকর পিসি সরকারকে। তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব পড়েছিল তরুণ জ্যোতিভূষণের ওপর। সেই সুযোগে জ্যোতিভূষণ দেখতে পেয়েছিলেন এক দুর্লভ ম্যাজিক। শোনা যাক তাঁর কলমের মুখে।
কলেজের অতিথিকক্ষে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। তত্ত্বাবধানের ভার পড়ল আমার উপর। ভোরবেলা অতিথিকক্ষের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। অত ভোরে হয়তো ওঁকে বিরক্তই করা হবে। কিন্তু চোখে পড়ল উনি উঠে পড়েছেন। মৃদু কণ্ঠে আবৃত্তি করছিলেন – আজি এ প্রভাতে রবির কর। আমি সাহস করে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু কী বলি প্রথমে? একটা তো কিছু বলতেই হবে। বললাম, ‘আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েন বোঝাই গেল আপনার আবৃত্তি শুনে।’ বললেন, ‘শুধু পড়া নয়, মুখস্থ করি।’ এই বলে ‘সঞ্চয়িতা’টা তুলে ধরলেন। বলতে লাগলেন, ‘হয় কী জানো, আমি ঠিক মুখস্থ করি না, কিন্তু পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায়।’
– সকলের তো তা হয় না। এও একটা ম্যাজিকের মতো! …
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরকে অভ্যাস করে অনেক কিছু আয়ত্ত করতে হয়।
– তা সত্যি, মুখস্থটাও অমনি হয় না।
– ঠিক বলেছ, তুমি আমাকে যে-কোনো কবিতার একটা পঙ্ক্তি বললেই আমি পরেরটা বলতে পারব। দেখোই না পরীক্ষা করে।
আমার কৌতূহল হলো। আমি ভাবলাম গদ্য কবিতা থেকে ধরি –
আমাদের যে দিন গেছে একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।
তিনি বললেন, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।
এই আলাপচারিতায় জাদুকর পিসি সরকার জ্যোতিভূষণের স্বাক্ষরসংগ্রহের খাতায় লিখে দিয়েছিলেন একটা আশ্চর্য কথা : Keep your mind open like the window of a lodging house with a notice board written thereon ‘room to let’. এইরকম এক কলেজ সোশ্যালে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গাওয়া ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’ গানটি শুনে রীতিমতো বিস্ময়াহত হয়েছিলেন জ্যোতিভূষণ। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে ছিল তাঁর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। তাতে সমৃদ্ধ হয়েছিল, অবশ্য পরবর্তীকালে, বাংলা সংগীতজগৎ। অসাধারণ গীতিকার ছিলেন জ্যোতিভূষণ। কেবল প্রচারের অভাবে সেগুলি রয়ে গেল সংগীতপ্রিয় মানুষজনের থেকে অনেকটাই দূরে।
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কর্মজীবন শুরু হলো গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। বাংলার শিক্ষক। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শিক্ষকতা করে গিয়েছিলেন জ্যোতিভূষণ। কুড়ি বছর বয়সে বিবাহ হলো ষোলো বছরের প্রকৃতি দেবীর সঙ্গে।
দুবছর পড়িয়েছিলেন গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। এখানে পড়াতে পড়াতে এক ঘটনায় শুরু হলো উর্দু শেখা। হয়েছিল কী, একদিন রসগোল্লা কিনতে বেরিয়েছেন। এক ঠেলাওয়ালার সঙ্গে দেখা। জ্যোতিভূষণকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে সে বলে তাতে কী লেখা আছে পড়ে দিতে। লেখা উর্দুতে। জ্যোতিভূষণ জানেন না। কথাটা বলতে ঠেলাওয়ালার মৃদু তিরস্কার। ‘ক্যা, আপ পড়েলিখে তো হোঙ্গে।’ কথাটা মনে লাগল। থাকল পড়ে রসগোল্লা কেনা। জ্যোতিভূষণ সোজা চলে গেলেন কিতাবপট্টি। কিনলেন উর্দু কি পহেলি কিতাব। সেদিন সারারাত চলল উর্দু শেখার বই পড়া। এই সূত্রে আলাপ হলো মুইনউদ্দিন দরদাঈয়ের সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে জ্যোতিভূষণ বাংলা-উর্দু অভিধান সংকলনে হাত লাগিয়েছিলেন।
গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশন থেকে তিনি পেয়েছিলেন অনেক কিছু, বিশেষ করে মানুষের ভালোবাসা। ক্রমে রাজনৈতিক ডামাডোলে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতিতে চিড় ধরল। পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠল। আর সেই অস্থিরতা জ্যোতিভূষণদের এনে ফেলল সীমান্ত পার করিয়ে কলকাতার বুকে।
সব ফেলে চলে আসতে হয়েছিল, তবে উদ্বাস্ত্ত হিসেবে কোনো ক্যাম্পে যেতে হয়নি। অনুজ প্রীতিভূষণ চাকরিসূত্রে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন শ্যামানন্দ রোডে। সেখানে উঠলেন সাত ভাইবোন, দিদিমা আর প্রকৃতি দেবীকে নিয়ে। জ্যোতিভূষণের পিতৃদেব তখনো রয়ে গেছেন পাবনায়। শুরু হলো কঠিন জীবনসংগ্রাম। পড়াশোনা আর গান শেখানো ছিল উপার্জনের উপায়। পেলেন নানা মানুষের সহায়তা। হলো নানারকম অভিজ্ঞতা। দিন চলে যায়। কোনো স্কুলে কাজ পেলে ভালো হয়। এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষক নৃপতিবাবুর সৌজন্যে দেখা করলেন কবিশেখর কালিদাস রায়ের সঙ্গে। তাঁর লেখা চিঠি সম্বল করে দেখা করেন এখানে-ওখানে। শেষকালে পড়ানোর চাকরি হলো মডার্ন স্কুলে। পড়ানোর পাশাপাশি স্কুলের ছেলেদের গান, অভিনয় ইত্যাদি শেখাতে হতো। স্কুল ম্যাগাজিন পরিচালনার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে এসে পড়েছিল। স্কুলের প্রিন্সিপাল মনোরঞ্জনবাবুর বিলেতফেরত পুত্রের চিঠি থেকে Dr. কথাটা বাদ দেওয়ার অপরাধে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন। ঘটনাচক্রে এর সাতদিন পরেই জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে ডাক পেলেন ইন্টারভিউ দেওয়ার। স্কুল-প্রেসিডেন্ট রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র) ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইন্টারভিউ নিলেন। উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন সসম্মানে। এখানেই পেয়েছিলেন সহকর্মীরূপে শিল্পী শ্যামল দত্তরায়কে। আর তাঁর ছাত্রদের ভেতর অনেকেই পরবর্তী জীবনে খ্যাতিমান এবং সুপ্রতিষ্ঠ হয়েছিলেন।
পাবনার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্ররা পূর্বেই চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে জ্যোতিভূষণের যোগাযোগ হলো। সেইসূত্রে পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ হলেন কলকাতার সংস্কৃতিজগতের বহু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে : বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, জর্জ বিশ্বাস। নিয়মিত যান ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। সেখানে থাকেন বুদ্ধদেব বসু। দেখা হয় অজিত দত্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ গুণীজনের সঙ্গে। বাংলা ছন্দের পর্ব-পর্বাঙ্গবাদের সঙ্গে ইংরেজি ছন্দের তুলনার কথা মাথায় ঘুরছিল জ্যোতিভূষণের। বুদ্ধদেব বসু আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখলেন।
যুক্ত হলেন প্রসূন বসুদের আগামী পত্রিকার সঙ্গে। ছোটদের এই মাসিক পত্রিকার উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক। আলোচনা বসত সেই বিখ্যাত ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রিটে। সবার আগে আসতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
ছোটদের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন। নাম ‘কল্লোল’। সংস্থার জন্য সংগীতালেখ্য লিখতেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছিল। সে হলো বিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার কথা। ছোটদের নিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান করতেন সেখানে। ‘মল্লার’ নামে সংগীত-বাদ্য-নৃত্য শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
পাবনা থেকে কলকাতায় আসার পর প্রথম আশ্রয় নিয়েছিলেন শ্যামানন্দ রোডের অপরিসর ঘরে। এরপর তালতলা লেন – বেলতলা – সুইন হো লেন হয়ে শেষে থিতু হলেন ৮১ নং কাঁকুলিয়া রোডে। এই বাড়ির সঙ্গে বহু মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত মানুষ এসেছেন এই বাড়িতে। সেই বাড়ির কথা জ্যোতিভূষণের নিজের কলমে :
খবর পাওয়া গেল কাঁকুলিয়া রোডে একটা নতুন বাড়ি হচ্ছে। খোকাদের বাড়ির সামনে।… ওদের বাড়ির সামনে তেতলা বাড়ির খবর খোকাই দিল। কিন্তু আমাদের হয়ে সুপারিশ করবে কে? খোকা তো আমাদের সপক্ষে যথেষ্ট সওয়াল-জবাব করছে। একজন নামকরা মানুষ যদি রেকমেন্ড করেন তাহলেই আমরা বাড়িটা পাব ভাড়াটে হিসেবে। মুখার্জিদের বাড়ি। শুনলাম সুভাষ মুখার্জি এঁদের আত্মীয়। সুভাষ মুখার্জি এ-কথাটা অনুমোদন করলেন। আমরা কসবা থেকে চলে এলাম ৮১ নং কাঁকুলিয়া রোডে।
এই বাড়িতে বহুকাল ছিলেন। এই বাড়িতেই হারিয়েছেন প্রিয়জনদের। এই বাড়ি থেকেই অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি হয়েছিলেন পিজি হাসপাতালে। ফিরে এসেছিলেন ২৭ মার্চ ২০০৮। তবে সে-শরীরে প্রাণ ছিল না।
শিক্ষকতা ছাড়াও জ্যোতিভূষণ নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বেতারকেন্দ্রের অনুমোদিত গীতিকার ১৯৬৫-তে আকাশবাণী-আয়োজিত সর্বভারতীয় দেশাত্মবোধক সংগীত রচনা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে তাঁর বহু শিক্ষামূলক কথিকা-গল্প-সংগীতালেখ্য ও নাটক প্রচারিত হয়েছে। কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল। তাঁর রচিত শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান ও তথ্যচিত্র নিয়মিত প্রচারিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক-আয়োজিত জাতীয় সংহতি শিবির পরিকল্পনায় প্রথমে পাঞ্জাব পরে কাশ্মিরে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করেন। কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারে ছোটদের জন্য পুরনো ইতিহাসের ওপর স্লাইড সহযোগে ভাষণ দিয়েছেন।
মল্লার-প্রযোজিত জ্যোতিভূষণ-রচিত বিশ্বনৃত্য, রাজকবি, ভারতের নৃত্যধারা, খেলনাবুড়ো, ছড়ার দেশে চলো ইত্যাদি নৃত্যনাট্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। অবনীন্দ্রনাথ এবং সুকুমার রায়ের রচনা নানা আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস, মহীশূর-প্রযোজিত তথ্যচিত্র বাংলা নাম এবং কাজী নজরুল ইসলামে বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার দেন। তাঁর শেষতম কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে ধরা আছে জ্যোতিভূষণের ভিডিও সাক্ষাৎকার।
পেয়েছেন নানা পুরস্কার, সম্মান। সমতট সম্মান (১৯৮৬), ভারত ভাষাভূষণ (১৯৯৬), বিদ্যাসাগর পুরস্কার (২০০৩), প্রমথনাথ বিশী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৮), সাম্মানিক ডি.লিট (২০০৬, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়), অনুবাদ পুরস্কার (২০০৬, সাহিত্য অকাদেমি)।
অজস্র বিষয় নিয়ে কত পত্রপত্রিকার জন্য তিনি কলম ধরেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। সব জড়ো করলে কয়েক খন্ড বই হয়ে যাবে অনায়াসে। কেউ আবার তাঁর পান্ডুলিপি নিয়ে গিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেননি, ফিরিয়েও দেননি পান্ডুলিপিটি। সেটির বিষয়? বই-বিষয়ক উদ্ধৃতি। নানান রকম পরিকল্পনা মাথায় ফুটত টগবগ করে। একবার শুরু করেছিলেন অনুবাদকদের অভিধান। কাজ শুরুও হয়েছিল। শেষ হয়নি। তাঁর সঙ্গে কথা বললে নতুন প্রাণশক্তি পাওয়া যেত। আর কী অসাধারণ ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। একবার একজন ভদ্রলোক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন নৌকো ছাড়ার আগে মাঝিরা পাঁচ পিরের উদ্দেশে প্রণাম জানায়। এই পাঁচ পির কারা। নানা অভিধান হাঁটকে হার মেনে শেষকালে শরণাপন্ন হই জ্যোতিভূষণ চাকীর। প্রশ্ন শেষ হতে-না-হতেই তিনি বলে ওঠেন : লিখে নাও – বদর, সোনাগাজি, দেওয়ানগাজি, সালামৎ, সিকান্দার। আমার মুখে বাক্য সরে না।
আর যেদিন বাংলা আকাদেমি-প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনীগ্রন্থটি শঙ্খ ঘোষকে দেওয়ার আগে (তাঁকেই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন) অভিধান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, একসময় পাঁচশো অভিধান সংগ্রহ করেছিলেন। সেই সংগ্রহ দিয়ে প্রদর্শনীও করেছিলেন। আছে সেই অভিধান-সংগ্রহ? না। স্ত্রীর অসুখের চিকিৎসায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুনে আমার বুক ভেঙে কান্না এসেছিল। একবার জানতেও পারিনি। আসলে জানাতে চাননি। পারতাম কি তাঁর সমব্যথী হতে! হওয়া যায়!
অথচ কী সহজ-সরল রসিক মানুষ ছিলেন এই জ্যোতিভূষণ। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। অভিধান সংক্রান্ত একটা কাজে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছি আমার এক মাস্টারমশাইকে। কথাবার্তা শেষে রওনা দেব। জ্যোতিবাবু বললেন, যে-অভিধানটা নিয়ে কাজ তার একটা কপি দিতে পারলে ভালো হতো। অভিধানটা তাঁর কাছে নেই। বিকেলে একটি ছেলের হাতে পাঠিয়ে দেবেন।
বিকেলবেলা। ঘর থেকে পথে বেরিয়েছি কী একটা কাজে। দেখি জ্যোতিবাবু আসছেন। সস্ত্রীক। জ্যোতিবাবুর কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। তা থেকে বেরিয়ে এলো একটা অভিধান। আমি তো অবাক। ‘আপনি যে বললেন, একটা ছেলের হাতে পাঠিয়ে দেবেন!’ ‘আমিই তো সেই ছেলেটা।’ জ্যোতিবাবুর সহাস্য উত্তর।

জ্যোতিভূষণ : নানাজনের চোখে
বিশিষ্ট বাঙালি পন্ডিত শ্রীযুক্ত জ্যোতিভূষণ চাকী মহাশয় বয়সে আমার কনিষ্ঠ, কিন্তু আমি তাঁহাকে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা করি। তাঁহার পান্ডিত্য আজ সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু তাঁহার চারিত্রিক মাধুর্য একালে বিরল। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে সুনীতিবাবুই ছিলেন আমাদের হাইকোর্ট। তাঁর প্রয়াণের পর জ্যোতিভূষণ চাকী মহোদয় সেই স্থান লইয়াছেন। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্ এই কথাটির মর্ম তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিয়া বুঝিতে পারি।
– রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত
পন্ডিত অনেক হয়তো আছেন। কিন্তু প্রকৃত নিরভিমান, রসে টইটম্বুর অথচ তত্ত্বজ্ঞ পন্ডিত খুবই কম পাওয়া যায়। আমার ধারণা, রসশাস্ত্রে যতগুলো রসের বিবরণ আছে, তার সবকটির নির্যাস নিঙড়ে জ্যোতিমশাইয়ের আজীবনলালিত ভাবটি বোধহয় তৈরি করেছিলেন তিনি নিজেই এবং তাঁর মধ্যে শান্ত রসটির প্রাধান্য ছিল। সেই শান্ত রসটিকে মশাই স্থাপনা করেছিলেন আবার দুই ভাবের চাকার উপর, তা হল সখ্য আর মধুর বা প্রণয়, যার ফলে তাঁর জীবনরথটি শত বন্ধুরতার মধ্যেও গড় গড় করে এগিয়ে চলেছে।
– মিহির সেনগুপ্ত

বেশ কয়েকটি নৃত্যনাট্য লিখেছিলেন। সূচিত্রা মিত্র থেকে শুরু করে অনেকে গান করেছেন তাঁর সঙ্গে। ‘জয়পরাজয়’ গল্পটিতে নাট্যরূপ দিয়ে ‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’, গাওয়াচ্ছেন জর্জ বিশ্বাসকে দিয়ে। জর্জদা তাঁকে ‘ভূষণ’ বলে ডাকতেন। একদিন মহড়ার সময় জ্যোতিভূষণবাবুর মুখ দেখে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, বললেন, ‘তাল ছাইড়া গাইমু, এই তো?’ নৃত্যনাট্যে তাল ছাড়া অবিস্মরণীয় ‘দিবস রজনী’ গেয়েছিলেন জর্জ বিশ্বাস। ‘বিশ্বনৃত্য’ বলে কাহিনি-নিরপেক্ষ নৃত্যনাট্য উপস্থাপন করেছিলেন জ্যোতিভূষণ। স্টেটসম্যান লিখেছিল, সেটা এক আনন্দের অভিব্যক্তি।
আমরা এক বিদগ্ধ ও রসিক জ্যোতিভূষণকে চিনি, নানা ভাষা ও সাহিত্যের স্নায়ুশিরায় যাঁর বিচরণ। কিন্তু ছাত্রদের কানে সু-মন্তর দেওয়া জ্যোতিভূষণকে বৃহত্তর সারস্বত সমাজ কতটুকু চিনেছে জানি না। সংগীতমুখর, সংগীতমুগ্ধ জ্যোতিভূষণের খবর মূর্খতার মিথ্যা-স্বর্গের অধিবাসীরা বিশেষ কেউ রাখে না।
¬- চিন্ময় গুহ
আমরা সহোদর তিনভাই এবং আমাদের এক জেঠতুতো ভাই গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পার্ক সার্কাসের মডার্ন স্কুলে পড়তাম।… স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে খুব ধীরে ধীরে অন্য একটি জগতের খোঁজ পেলাম। কবিতা লেখা, ছবি অাঁকা, আবৃত্তি করা কিংবা নাটকে অভিনয় করা, এসব আয়োজনের ভোজবাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ এসে আমাকে একেবারে প্লাবিত করে ফেলল।… এই যে ভোজবাড়ির কথা বলেছি তার প্রধান আয়োজক ছিলেন আমাদের শিক্ষক জ্যোতিভূষণ চাকী, আমাদের চাকী স্যার।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম যে, আমাদের স্কুলে এমন একজন শিক্ষক আছেন যিনি আসলে বাংলা ভাষার শিক্ষক কিন্তু পন্ডিতমশাই না এলে তিনিই সংস্কৃত পড়ান এবং মৌলবি স্যার না এলে উর্দু-আরবি তিনিই পড়ান। তারপরে যখন কিছুটা অন্তত হিন্দি পড়ানো বাধ্যতামূলক হলো তখন যে শিক্ষক পড়াতে ক্লাসে এলেন তিনি আর কে হবেন, সেই বহুভাষাবিদ জ্যোতিভূষণ চাকী।
একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন যদি তিনি তেমন চান। শিক্ষক জ্যোতিভূষণ চাকী সেই সময় চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য যখন আমাদের তৈরি করতেন, আমার কাছে সেই সময়টার স্মৃতি এখনো আনন্দময় স্বপ্নের মতো। গান, আবৃত্তি, গীতি-আলেখ্য এবং স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য কবিতা লেখা – এসবের প্রাথমিক পাঠ তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। সেই প্রাথমিক পাঠ এতো গভীর হৃদয়স্পর্শী যে, এখন পর্যন্ত সেই রুচি, সেই মুগ্ধতা, সেই বিস্ময় অটুট আছে।
– অভিজিৎ সেন

ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজকর্ম করেন তাঁরা ভাষাব্যবসায়ীদের দুটো ভাগে ভাগ করেন। একটা হলো, ভাষাবিদ, ইংরেজিতে যাকে বলে practical linguist; আর একটি ভাগ হলো ভাষাতাত্ত্বিক (শুধু linguist) – যাঁরা ভাষা কীভাবে কাজ করে, ভাষার নির্মাণের নীতিগুলো কী কী, ভাষার সামাজিক উপযোগিতা ও ব্যবহার – এসব নিয়ে যাঁরা ভাবেন। প্রায়ই এমন দেখা যায় যাঁরা ভাষাবিদ তাঁরা ভাষাতাত্ত্বিক হন না, মূলত অনুবাদক ও দোভাষী হিসেবে তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে ভাষাতাত্ত্বিক বহু ভাষা না-ও জানতে পারেন…।
কিন্তু জ্যোতিদা এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তিনি যেমন অনেক ভাষা জানেন, তেমনই ভাষার অন্ধিসন্ধি কানাগলিও তাঁর কাছে আদৌ অন্ধকার নয়। ভাষার প্রসাদের সমস্ত কথাই তাঁর পরিক্রমার ক্ষেত্র। তাঁর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ আমাকে বুঝিয়েছে যে, তিনি একাধারে ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিক; সেদিক থেকে তিনি একেবারেই অন্যরকম।
– পবিত্র সরকার

তিনি প্রস্ত্তত করে দিয়েছেন ‘কর্মাঙ্গন সংস্কৃতি’র প্রয়োগযোগ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিক্ষণ ব্যবস্থার ম্যানুয়ালে। মূল্যবোধ ও তার ঠিক ঠিক প্রয়োগ খুব বড়ো সফলতা আনতে পারে কাজেকর্মে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিতে, প্রযুক্তি-সংস্কৃতির সফলতায়। হাতে-কলমে, বড়ো মাপের এমন কাজটি, জ্যোতিভূষণবাবু করে দিয়েছেন, যা থেকে বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠান ভ্যালু ম্যানেজমেন্টের শিক্ষণপদ্ধতি প্রস্ত্তত করতে পেরেছেন। এই কাজে বহুদিন ধরে তাঁর সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। শিখেছি প্রায় প্রতিক্ষণেই। আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, কথকঠাকুরের মতন বাক্যবিন্যাস, সঙ্গে সঙ্গে চলেছে পুঁথিলিপির মতন লিপিশিল্পের বিন্যাস।…
আর মনে আসে জ্যোতিভূষণবাবুর ভালোবাসা লিপিতে সাজানো পোস্টকার্ড। কালিতে হয়তো-বা চার-পাঁচ লাইন। কিন্তু মনে হলো হাজার হাজার বছরের ভারত যেন ডেকে উঠল।
– অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

To/ Sri Jyoti Bhusan Chaki/ The Silent Buddha/ in/ The field of Ideological Studies/ As a/ Token of Admiration and Respect – উৎসর্গপত্র : Kushan Studies : New Perspectives by Bratindranath Mukherjee/ Firma KLM (P) Ltd/ 2004

জ্যোতিভূষণ চাকী : গ্রন্থপঞ্জি
ঢ্যাম কুড়্ কুড়, সুমুদ্রণ (অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর সঙ্গে), কবিতা।
মরসুমী, চিনকো, ১৯৬০, সাহিত্য সংকলন।
পায়ে পায়ে এতদূর, চিনকো, ১৯৬০, সাধারণজ্ঞান।
নতুন পাতা, চিনকো, ১৯৬১, সাহিত্য সংকলন।
পার্বণী, চিনকো, ১৯৬২, সাহিত্য সংকলন।
ছড়া পিদ্দিম জ্বলে, বুক স্ট্যান্ড, ১৯৬৯।
আমার ছবি তোমার ছড়া, বুক স্ট্যান্ড, ১৯৭৩, সম্পাদিত।
ছোটদের নাট্যসম্ভার, প্রথম খন্ড, সমবায় প্রকাশনী, ১৯৭৯ (সমীর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদনা)।
গোস্বামী তুলসীদাস-বিরচিত রামচরিতমানস ও দোঁহাবলী। সম্পাদনা ও ভাষান্তর, তিন খন্ড। নবপত্র প্রকাশন, ১৯৮০।
সোনাঝুরি, নিওপ্রিন্ট, ১৯৮৩ (চতুর্থ মুদ্রণ), ছড়া।
প্রেম, শ্রুতি প্রকাশনী, ১৯৮৬, অনুবাদ।
চাণক্য চিন্তামণি, নবোদয় প্রকাশন, ১৯৮৮, অনুবাদ।
শব্দ যখন গল্প বলে, বেস্ট বুকস, ১৯৯১, ভাষা।
দুই বাংলার ছেলেভুলোনো ছড়া, মডেল পাবলিশিং হাউস, ১৯৯২।
কৃষণচন্দরর, জীলানি বানু, সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৯৪, অনুবাদ।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, আনন্দবাজার পত্রিকা ব্যবহারবিধি। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৬।
ছড়ার আঙিনায়, উদ্ভাস, ২০০১, ছড়া ও গদ্যের সংকলন।
বাগর্থ কৌতুকী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০২, ভাষা, শব্দ।
শুদ্ধ লেখো ভালো লেখো, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., ২০০২।
সেরা রূপকথার গল্প, সরোজ পাবলিকেশন্স, ২০০৩, সম্পাদিত।
গালিব : নির্বাচিত কবিতা, সাহিত্য অকাদেমি, ২০০৪ (শঙখ ঘোষের সঙ্গে) সম্পাদিত।
কৈফি আজমির কবিতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৪, অনুবাদ।
আচার ব্যবহার, জীবনের সাফল্যের সোপান, বেস্ট বুক্স, ২০০৪, সমাজবিধি।
নাট্যে কথামৃত, দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৪।
হল্লা-হাসি-মজা, সরোজ পাবলিকেশন্স, ২০০৪, প্রবীর জানার সঙ্গে সম্পাদিত।
আকাশভরা পাখি, বলরাজ কোমল, সাহিত্য অকাদেমি, ২০০৬, অনুবাদ।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৬, জীবনী।
প্রাচীন ভারতে পরিবেশচেতনা, অসীমা প্রকাশনী, ২০০৬, পরিবেশ।
টগবগিয়ে নতুন দেশে, দোয়েল, ২০০৬, রূপকথা।
এক ঝাঁক গল্প/ আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত, চিরায়ত কাহিনী, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮, অনুবাদ।
টুকরো গল্পের বৈঠক, একবিংশ, ২০০৬, গল্প।
একটি কিশোরের স্বপণ, বি.বি. কুন্ডু গ্র্যান্ডসন্স, ২০০৬, জীবনী।
কোন্ ঠাকুর অবিন ঠাকুর, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৬, জীবনী।
খাপ খোলা তলোয়ার, ওরিয়েন্টাল বুক কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৬, জীবনী।
বই তো পড়, টই পড় কি?, পুনশ্চ।?, ইতিহাস।
শিশু-কিশোর রচনাসংগ্রহ ১, ২, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। ২০১০, ২০১১।
অজস্র পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে জ্যোতিভূষণ চাকী-রচিত (এখনো অসংকলিত) প্রবন্ধ-গ্রন্থসমালোচনা। এখানে তারই নির্বাচিত উল্লেখ।

দেশ
গালিব : জীবন ও কাব্য, ২৯ নভেম্বর ১৯৯৭।
অন্তরতম সু-চেতনার শব্দ, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮।
লেখক যখন পাঠক, ১৮ জুন ২০০২।
সংস্কৃত সাহিত্য ও রতিরাগ প্রসঙ্গে, ২০ মার্চ ১৯৯৯।
আমাদের প্রত্যাশা কতটা পূর্ণ করে রবীন্দ্রনাথের গদ্য, ১ মে ১৯৯৯।
প্রাচীন সাহিত্যে সূর্যগ্রহণের ছায়া, ৭ আগস্ট ১৯৯৯।

দিশা সাহিত্য
যে মাটিতে শিউরে ওঠে ঘাস, জানুয়ারি ১৯৯৯।
ভুবনডাঙ্গার মাঠে, জুলাই ১৯৯৯।
মন চলো যাই ভ্রমণে, সেপ্টেম্বর ১৯৯৯।
বেদমন্ত্রে বৃষ্টিপ্রার্থনা, আগস্ট ২০০১।
মাতৃ-উপাসনার উৎস সন্ধানে, শারদীয় ১৪০৭ (২০০০)।
শিবদুর্গার অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, উৎসব সংখ্যা, ১৪০৮ (২০০১)।
নৌকা-বাইচ, শারদীয় ১৪১০ (২০০৩)।

অভিধান : নানা অঙ্গনে’, কোরক। মে-আগস্ট ২০০১।
‘কবির ও কবীন্দ্রের দুটি ‘গীতাঞ্জলি’, গণশক্তি, শারদ সংখ্যা ২০০৭।
‘আনো অমৃতবাণী’, পশ্চিমবঙ্গ, রবীন্দ্রসংখ্যা, ২০০২।
‘ণত্ব-ষত্বের আঙিনায়’, শব্দবার্তা, অক্টোবর ১৯৯৮।

লিট্ল্ ম্যাগাজিন : ‘উৎস ও প্রসঙ্গ’, সাহিত্য কহন, জানুয়ারি ১৯৯৫।
‘নটরাজ মূর্তি’, নবকল্লোল, কার্তিক, ১৪০৫।
‘বিষ ও অমৃত’, ফিরে দেখা, জুন ২০০০।
‘শব্দের আঙিনায় ছোটোদের দোসর’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কথা ও সাহিত্য। সম্পাদনা শঙ্খ ঘোষ, সৌরীন ভট্টাচার্য, অমিয় দেব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব বিশ্বাস। ১৯৯৮।
‘ৎ’-রঙ্গ। ইতিহাস সাহিত্য সংস্কৃতি। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্বর্ধনা গ্রন্থ, সম্পাদনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যসৌরভ জানা, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৮।
বৌদ্ধ মিশ্রসংস্কৃত (বিদ্যাবদান অবলম্বনে)। ভারত ও ভারততত্ত্ব/ অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। অধ্যাপক সুকুমারী ভট্টাচার্য সম্মাননা গ্রন্থ। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৪।

গ্রন্থ সমালোচনা
কবির অভীষ্ট, দেশ, ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৭।১
পদ্মের মাধুর্য হৃদয়ের স্পর্শ, দেশ, ২ অক্টোবর ২০০৭।২
স-য়ে সমকালীন, দেশ, ১৭ মার্চ ২০০৬।৩
অনেক কথা অল্প কথার ইন্দ্রজালে, দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ।৪
অনন্য প্রজাতির বই, বইয়ের দেশ, জানুয়ারি, ২০০৫।৫
যন্ত্রে যখন কথার ফুল ফোটে, বইয়ের দেশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৬।৬
স্ল্যাংগুয়েজ, বইয়ের দেশ, এপ্রিল-জুন ২০০৬।৭
অদ্বিতীয় ছড়ার মেলা, বইয়ের দেশ, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৭।৮
বেদের ভাষ্য বেদের ছন্দ, বাংলা বই, এপ্রিল ২০০১।৯
বাংলা শব্দের একটি উৎস, বাংলা বই, ফেব্রুয়ারি ২০০৪।১০
গীতবিতানের জগৎ, বাংলা বই, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।১১
উচ্চজাতের বই, তবে জাতি নির্ণয় সুকঠিন, দিশা সাহিত্য, এপ্রিল ২০০১।১২

১. কবির অভিপ্রায়, শঙ্খ ঘোষ।
২. প্রবন্ধ সংগ্রহ, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত।
৩. সমকালীন : নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড, আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত।
৪. গালিবের গজল থেকে, আবু সয়ীদ আইয়ুব।
৫. অলীক সংলাপ, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত।
৬. উনিশ শতকে ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা (১৮৪৮-১৯০০), মুনতাসীর মামুন।
৭. বাংলা স্ল্যাং : সমীক্ষা ও অভিধান, অভ্র বসু।
৮. ছড়াসমগ্র ১, ২, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
৯. বেদের ভাষা ও ছন্দ, গৌরী ধর্মপাল।
১০. মিশর থেকে আসা বাংলা শব্দ, ড. লীনি শ্রীনিবাসন।
১১. গীতবিতানের জগৎ, সুভাষ চৌধুরী।
১২. সাপলুডো অথবা ঘরবাড়ি, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

জ্যোতিভূষণ চাকী : রচিত গান

এক
বিমল আকাশ সুধা ঝরানো
নব আলোকের হাসি ছড়ানো
সুধা ঝরানো।
নব আলোকের রাখী পরানো
সুধা ঝরানো।
আজ কেহ নহে দূরে
বাঁধা আছি একই সুরে
হৃদয়ে হৃদয়ে রাখী পরানো
সুধা ঝরানো।
আজ শুধু বারে বারে
গান যাবে স্মৃতিদ্বারে
শারদ স্বপন মায়া ভরানো
সুধা ঝরানো\

দুই
ছন্দে ছন্দে ভরা আমাদের বসুন্ধরা, আহা \
সকল হৃদয় জুড়ে এ-ছন্দে এই সুরে
উঠুক মিলিত গান ছন্দে আকুল-করা, আহা \
কাজ আছে মেলা যে কাজ সে তো খেলা যে
হাত ওঠে হাত পড়ে সবই তো ছন্দে গড়া \
মাটি জল ফুল পাখি সুরে সুরে মাখামাখি
মন নাচে প্রাণ নাচে ছন্দে আকুল-করা, আহা \
তিন
মাটির কোলে জন্ম নিলাম
মাটি মোদের মা। নম নম!
মাটির চেয়ে খাঁটি জিনিস
কোথাও পাইলাম না। নম নম!
মাটি মোদের প্রাণ। জয় জয়!
মাটি মোদের মান। জয় জয়!
মাটি মোদের গান। জয় জয়!
মাটি মোদের চোখের মণি।
মাটি মোদের আশার খনি।
ঘরে ঘরে মঙ্গল হয়ে মাটি মোদের মা \

চার
এসো ধান কাটি অাঁটি অাঁটি
ধান কাটি।
এ-ধান কিষানের জীবনের জিয়নকাঠি।
এ-ধান কিষানির কানে কানে রূপকথাটি\
ধান নয় তো প্রাণ রে
ওরে সোহাগের বান্ রে।
আয় আয় যায় বেলা যায়
আয়রে কাটি ধান \

পাঁচ
লোহালক্কড় ঝক্ঝক্কর
ঠন্ ঠনা ঠন্ বন্ বনা বন্ বন্ বন্
ঘোরে চাকা চক্ চক্ চক্কর
মেশিনে মেশিনে গান
ঝনন ঝনন ঝন্ ঝন্ ঝন্
অঙ্গে অঙ্গে ঐ নৃত্যছন্দে জাগে কম্পন্
ঝনন ঝনন ঝন্ ঝন্ ঝন্।
চিৎকার শীৎকার ঝঙ্কার টঙ্কার
গর্জন হুঙ্কার উঠছে
লৌহের দন্ডের ঘর্ষণে ঘর্ষণে
উদ্দাম স্ফুলিঙ্গ ছুটছে।
কঠিন লোহার বুকে অলঙ্ঘ্য বিদ্যুৎ
অদ্ভুত তরঙ্গ তুলছে,
নৃত্যে-বাদ্যে-গানে
যন্ত্রের তানে তানে
রুদ্ধ দুয়ারগুলো খুলছে।
যন্ত্রের একতানে আমরা মিলেছি আর
মিলিয়েছি আমাদের পেশিতে পেশিতে জাগা স্পন্দন
আনন্দে গড়ি মোরা নূতনকে
নূতনের আহবানে সাড়া দিই সারাক্ষণ \

ছয়
তোমাকে দেবার কিছু নেই
দিয়েছি তো সব
দিতে চাই শুধু ভাষাহীন এক অনুভব।
হৃদয় উজাড় করে দিয়ে
স্বপ্ন দু’হাত ভরে নিয়ে
কথারা হয়েছে নীরব।
গানের ওপারে আছে গান
আজ শুনি তারি আহবান।
সে গান তারার বুকে বাজে
দোলা লাগে নন্দন মাঝে
পারিজাত ঢালে সৌরভ।
অ‘ভূত’পূর্ব বর্ণবিপর্যয়
জ্যোতিভূষণ চাকী
সে আমার জীবনের পুরাকালের কথা। তখন কলকাতায় ভাগ্যান্বেষী আমি। চাকরির খোঁজে তালতলা থেকে ঠনঠনে চষে ফেলি, ফলং শূন্যম্। অথচ মনে তার নিত্য ইত্যাদি। হঠাৎ একদিন একটা কাজের গন্ধ পেয়ে ছুটে গেলাম হাওড়ার শ্রীরাম ঢ্যাং রোডে। সাক্ষাৎ হলো বিরূপাক্ষবাবুর সঙ্গে :
– কী করা হয়?
– আজ্ঞে চাকরি খোঁজাটাই একমাত্র কাজ।
সাক্ষাৎকারটা প্রলম্বিত হয়েছিল। বিদ্যেবুদ্ধির পরীক্ষাও দিতে হলো। শেষ পর্যন্ত অন্তরাল নামে একটা কাগজের আমূল সম্পাদকের পদে বহাল হলাম। মূল সম্পাদক বিরূপাক্ষ গুপ্ত। আর আমি হলাম আমূল সম্পাদক। তার মানে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ – লেখা সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন জোগাড় করা, প্রুফ দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন পটুয়াটোলার একটি সংকীর্ণ গলির হাফ-দোতলায় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি ঘনিষ্ঠ জীর্ণ কক্ষে অধিষ্ঠিত হলাম। একটা টেবিল – দুটো টুল, এদিকে আর ওদিকে, মানে সামনাসামনি। আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। তাই ‘অন্তরাল’কে মাঝে মাঝে অন্তরালে যেতে দিচ্ছি না। এখন প্রতি মাসেই বেরোয়। সার্কুলেশন একটু একটু করে বাড়ছে। দুটি ফিচার চলছিল, যা পাঠকেরা নিচ্ছিল (এখনকার ভাষায় খাচ্ছিল ভালো)। আমার হাত দিয়ে পাঁচ-ছটা সংখ্যা বেরোল। নালিশ আসছিল ছাপার ভুল বড্ড বেশি। তিনবার-চারবার করে তো প্রুফ দেখছি, তবু ভুল ঠেকানো যাচ্ছে না, কী যে করি। ঠিক আছে, সামনের সংখ্যাটাকে নির্ভুল করবই।
গত সংখ্যায় একটা বর্ণবিপর্যয় হয়েছিল – ‘শিবরাম’ হয়েছিল ‘শিরবাম’। এবার কোনো বিপর্যয়ই হতে দেব না। বাড়ি ফিরতে রাত হয় হোক, আজই প্রিন্ট-অর্ডার দেবার আগে বার দুই প্রুফ দেখব। গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। আলো খুবই ক্ষীণ। পঁচিশ পাওয়ারের বাল্বটা প্রায় মুমূর্ষু। ফ্যান নাকি একদা ছিল, এখন নেই। সিধু এখনো চা-টা দিয়ে গেল না। রোজ তো এই সময়েই দিয়ে যায়। হয়তো কোনো দোকানি তাকে কোনো কাজে পাঠিয়েছে। সিধু তো গলির সকলের কাছেই সিদ্ধ পুরুষ। ক্রমশ চা-এর কথা ভুলে গেলাম। চোখ বিঁধিয়ে প্রুফ দেখছি, প্রত্যেকটা শব্দকে আক্রমণ করছি। কোনোদিকে হুঁশ নেই। একটা বানানে সন্দেহ হওয়ায় অভিধানটা দেখব ভাবছি। কোথায় যে চাপা পড়ল কাগজপত্রে। সামনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি একজন টেবিলের ওদিকে টুলে বসে আছেন। আশ্চর্য, আমি লক্ষই করিনি। কাঠের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটু ক্যাঁচকোঁচ শব্দও হয়, তাও শুনিনি। যাগ্গে ভদ্রতা রক্ষা করি। মুখে একটু হাসি এনে বললাম, আপনি কতক্ষণ? ভদ্রলোক নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, হিসেব করে দেখিনি। কারণ আপনাদের সময়ের হিসেব আমার সঙ্গে ঠিক মেলে না। সে যাক, খুব মন দিয়ে প্রুফ দেখছিলেন, তাই ডিস্টার্ব করিনি।
– হ্যাঁ ঠিকই, আমি একটু absorbed-ই ছিলাম। আমি খুবই লজ্জিত। আপনাকে লক্ষই করিনি।
ভদ্রলোক কেমন একটু জোরের সঙ্গে বললেন, আমি লক্ষণীয় নই মোটেই, বরং বলতে পারেন সম্পূর্ণ অলক্ষণীয়। বলেই নিজের রসিকতায় নিজেই উচ্চহাস্য করে উঠলেন।
আমি সবিনয়ে বললাম, না না, সে কী কথা। আমরা কাগজের লোক, লেখায় যাঁদের আগ্রহ তাঁরা সকলেই আমাদের লক্ষণীয়। ভদ্রলোক কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের লেখকেরা আপনাদের লক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু আমি বর্তমানেরও নই ভবিষ্যতেরও নই।
– আপনি নিজে লেখেন না?
– আজ্ঞে না, লিখিটিখি না, তবে লেখা-টেখা নিয়েই আমার কাজ!
আমি বিরক্তি চেপে না রাখতে পেরে বলি – এসব হেঁয়ালি শোনার সময় আমার নেই। আমি ভেবে পাচ্ছি না, আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন?
– শুধু আপনার কাছে আসব কেন? অনেকের কাছেই যাই, যাঁরা মানে আপনার মতো সম্পাদক-টম্পাদক, কিংবা প্রুফ রিডার-টিডার।
আমি অধৈর্য হয়ে পড়ি : কিন্তু কেন যান তাঁদের কাছে?
– আমার বেজায় হাসি পায় তাঁদের দেখে।
এ-কথা বলেই ভদ্রলোক হাসির হুল্লোড় তুললেন।
– হাসি? হাসি পায় কেন?
– তাঁদের প্রচেষ্টাটা অনেক সময়ই হাস্যকর হয়ে ওঠে বলে।
– আপনি ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠছেন। আপনি মোটেই সোজা মানুষ নন।
– ঠিক ধরেছেন মশাই, আমি একটু বাঁকাই বটে।
– আপনার মতলবটা কী?
– অতি সহজ। লেখাটেখা ভন্ডুল করাটাই আমার মতলব।
– তার মানে?
– ‘নর্মদা’কে আমিই ‘নর্দমা’ করে তুলি, তাতেই আমার আনন্দ। আর, আপনার ‘শিবরাম’কে আমি ‘শিরবাম’ করেছিলাম – হেঃ হেঃ।
– আপনি কি –
– হ্যাঁ এবার ঠিক ধরেছেন বলেই মনে হচ্ছে। আমি ছাপাখানার ভূত। বড় লেটে বুঝলেন স্যার, অনেক ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, ধরতে পারেননি। কেমন এডিটর আপনি?
এই বলে তিনি একবার মিলিয়ে গিয়েই আবার দেখা দিলেন, আবার মিলিয়ে যেতে লাগলেন। আমি আর্তকণ্ঠে ডাকলাম – সিধু!
সিধু আমার গায়ে ধাক্কা দিলো। আমি ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম। সিধু বলল, এই যে বাবু আপনার চা। আপনি ঘুমায়ে ঘুমায়ে স্বপ্ন দেখতেছিলেন বাবু। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম – তুই কি সত্যিই সিধু।
সিদু একগাল হেসে বলল – কী যে কন বাবু!

দেশ, ১ এপ্রিল ২০০০। 