ঝিঁঝি পোকার জীবন

নলিনী বেরা
আচমকা আমাদের বাবা ধুলোপায়ে কোত্থেকে প্রায় দৌড়–তে দৌড়–তে এসে মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করে বলে বসলেন, ‘এখানে আর একদণ্ডও থাকাটা নিরাপদ নয়, আঁকাড়া বিপদ চারধার থেকে ধেয়ে আসছে ধাঁইধাঁই করে! সবকিছু ছেড়েছুড়ে এক্ষুনি পালাতে হবে। কই, ডাক তোর মাকে!’ জানি, বাবার মা অন্তপ্রাণ, তাই বলে আমি ও আমার বোন নাকফুঁড়িও তাঁর কাছে কম নই। কখনো পিঁপড়ের ডিম বা ‘কুরকুট্ পটম্’, ডিমওয়ালা ‘ডিমাল-কাঁকড়া’, কী খঙ্গা-বঙ্গা ধরে আনলে ঘরের কাছে এসে প্রায় রাস্তা থেকেই বাবা হাঁক পাড়তেন, ‘কই রে নাকফুঁড়রি! কই রে নীলুয়া!’ ডাক শুনে আমরাও ঘর থেকে দৌড়ে বেরোতাম। কখনো-কখনো খলুইভর্তি করে নিয়ে আসেন লাল-লাল চোখ-না-ফোটা কাঁড়াল-কোঁড়ল ‘চুটিয়া’ বা ইঁদুরের বাচ্চা। অবশ্য আমাদের থেকেও চোখ-না-ফোটা কাঁড়াল-কোঁড়ল চুটিয়ার বাচ্চা আমাদের মায়ের খুব প্রিয়। কাঁচাই কচমচিয়ে চিবিয়ে খেতে তিনি যে কী ভালোই না বাসেন! তাঁর মুখের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে আর আমরা হি-হি করে হাসছি, মাও হাসছেন, আহা! সে কী তাঁর মাকালীর মতো হাসি! সেই মাকে এখন খুঁজতে বেরিয়েছি। মা কোথায় আর যাবেন যা দিনকাল – এই বড়জোর বাঁধগোড়ার জলে গেড়ি-গুগ্লি, শুশনি, কী ঘোড়াকানা শাক তুলছেন!
আঁকাড়া বিপদের আঁচ আমরা ছোটরাও একটু-একটু করে টের পাচ্ছিলাম। কেননা, দিনে-দুপুরে অযথা জমির আলে-আবডালে হঠাৎ হঠাৎ ঢিস্-ঢিস্ করে ধুলো উড়ছিল, রাতে-বিরাতে জঙ্গলে গাছের ডাল ভেঙে পড়ছিল মট্মট্ করে! অকালে ভুস্ভুস্ করে ‘খত্-খানা’ থেকে বেরিয়ে আসছিল ফিসফিনে ডানাওয়ালা শালুইপোকা। বর্ষার শালুইপোকা ‘বালি-খলা’য় মুচমুচে ভেজে খেতেও ভারি সুস্বাদু! কিন্তু অসময়ের পোকামাকড় তিতকুটে লাগছে, আমরা মুখে পুড়েই ছিঃ থুঃ করে ফেলে দিচ্ছি। দূরের পিচরাস্তায় জঙ্গল ভেদ করে ছোটদের যাওয়াও এখন মানা, অচেনা কারা যেন সেখানে অষ্টপ্রহর হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে! সন্ধ্যা হতে না হতেই টিপিক্-টিপিক্ ‘বাঘ-যুগ্নী’ পোকার সঙ্গে জ্বলে উঠছে ঘনঘন সত্যিকারের টিপা-লাইট, দু-ব্যাটারি তিন-ব্যাটারি এমনকি পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ। বেড়ে গেছে ‘রিঁ রিঁ-আঁ’ পোকার ডাকও। রাত যত বাড়ে, বাড়তে থাকে রিঁ-রিঁ-আঁ পোকার একটানা ভয়ংকর রিঁ-রিঁ আওয়াজ। থেকে-থেকে ভদ্ভদিয়ে গাছ থেকে, টাঁড়-টিকর থেকে উড়ে উঠছে কয়ের-কপ্তি টিয়া-হরিয়ালের ঝাঁক। ঘরেদোরে       রাস্তায়-ঘাটে টাটকা-টাটকি মরে পড়ে থাকছে ‘বাগাডুলু’ ‘পড়নি’ কেঁচো-কেন্নো-ক্যাঁক লাশ ‘ঘরঘুন্নি’!
অথচ বেশ তো, ভালোই তো চলছিল সম্বৎসর! বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের রুখা-শুখা দিনগুলোয় ঝাঁটি কুড়োতে পাতা ছিঁড়তে জঙ্গলে যাওয়া, এর-তার গায়ে ঢলতে ঢলতে হল্লা করে যাওয়া। একা নয়, দঙ্গলে যাওয়া। জষ্টিমাস খরার মাস, জাম-জামরুলের কাল। ঢুঁড়লে আলু-তুঙা নানাবিধ ফলমূলও পাওয়া যায়। তাছাড়া শিকার, ধামসা-মাদল-চেরপেটি বাজিয়ে ‘টিলিঙ-ডুবুল্-ডুবুল্’ – কাঁড়াল-কোঁড়ল পাখির ছানা, ঝিকর, খেড়িয়া, বরহা, ঢ্যাম্ না-গোই-গোধি শিকার করতে যাওয়া। এসময় কতরকম ফলপাকুড় – পিয়াল ভুড়রু, আম জাম বেল, কচ্ড়া-কুসুম – খাও রে! ছড়াও রে! আষাঢ়ে ঝম্ঝমিয়ে বৃষ্টি নামলেই অজস্র ‘ছাতু’ – সরু-বালি বড়-বালি কুড়্কুড়িয়া কাড়্হান ঝালুয়া হলদে-ভণ্ডা সাদা-ভণ্ডা শালপোঙড়া পোয়াল। পরাং-তমাল কুবাই নদীতে আষাঢ়-শ্রাবণে ‘ঝোপ’ এলে শোল-বোয়াল পুঁটি-দাঁড়িকিনি চ্যাঙ-গোড়–ই খঙ্গা-বঙ্গা-কাঁকড়ার অভাব হয় না। ধানপাকা ধান কাটার মরশুমে ক্ষেতভর্তি তো ধানের ‘টুঙ’! আর আছে ধানক্ষেতের আলের গাঢ়্হায় ইঁদুর ও ইঁদুরধান। আমি আর আমার বোন ‘খুঁজে খুঁজে নারি যে পায় আহারি’ করে খুঁজতে থাকি। ধানের টুঙ আর  আমার বাবা আমার মা খন্তা দিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে গর্তের মুখে ধোঁয়া দেন, ধোঁয়ায় ‘থকো বকো’ হয়ে বেরিয়ে আসে জোড়া ইঁদুর। জোড়া ইঁদুর ধরা পড়লে অতঃপর খন্তা দিয়েই খান-খান করা হয় জমির আল। উদ্ধার করা হয় ইঁদুরধান, আর মায়ের অতিপ্রিয় সেই লাল লাল চোখ-না-ফোটা কাঁড়াল-কোঁড়ল ‘চুটিয়া’ বা ইঁদুরছানা! ফাগুন-চোত্ তো মধুর মাস, মহুল গাছে-গাছে মধু, লাটাপাটার খাঁজে খাঁজে মধুর চাক! ‘মহুল’ অর্থাৎ মহুয়া কুড়োনোর ধুম লেগে যায় তল্লাট কে তল্লাট। পোহাতারা উঠল কী উঠল না তাই দেখতে ঘর-বাহির করতে না-ঘুমিয়ে রাত ভোর করে দেন আমাদের মা-কাকি-ঝিউড়ি-বউড়িরা। রাত থাকতে আগেভাগে না গেলে সে ‘মহুল’ কুড়িয়ে সাফা করে দেবে চোর-চুরনিরা! আখের ক্ষেত আর আমাদের কোথায়! মহুলের রস জ্বাল দিয়েই তো আমাদের গুড় করা, গুড় খাওয়া। বনকাল্লা বন-কুঁদরী বন-কাঁকড়ো চেঁকা-ঘলঘসি-নাহাঙা-সরন্তি-শুশনি – জঙ্গলে শাকপাতা আনাজপাতি তো আছেই, আর আছে চোত্-বোশেখের ‘কেঁদ্পাকা’, কেঁদুগাছের ফল। যতখুশি খাওরে দাওরে, বাকিটা ঝুড়িতে করে ‘খালা’ ‘খালা’ বেচতে যাওয়া কাম্হার-কুম্হার-হাটুয়াদের পাড়ায়। মা-কাকিরা যান ঝুড়িতে আঁচলচাপা দিয়ে,  খদ্দের দেখতে চাইলেই একটুখানি আঁচল সরিয়ে দেখান – শালপাতার খালায় গণ্ডা গণ্ডা করে সাজানো হলদে রঙের গোল গোল পাকা কেঁদ্ ফল! ফল তো নয়, যেন অমৃত! বিনিময়ে চাল তো নয়, খুদ। নচেৎ দু-চার গণ্ডা পয়সা। ওই ঢের। তবু তো মন্দের ভালো এসব ছিল। ছিল, ছিল। এমন সব ছেড়েছুড়ে কে জানে কোথায় পালাতে হবে!
সত্যি-সত্যি বাঁধগোড়ার জলে ঘোড়াকানা শাক তুলছিলেন মা। ঘোড়ার কানের মতো লম্বা-লম্বা শাক, নীল রঙের ফুল। তার ওপর হেথা-হোথা বক বসে আছে দু-চাট্টা, যেনবা ফুটে আছে সাদা রঙের ফুল, বকফুল। কাছে গিয়ে মাকে বললাম, ‘মা! বাবা বলল আর একদণ্ডও এখানে থাকাটা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়, সব ছেড়েছুড়ে এক্ষুনি পালাতে হবে।’ মায়ের যেন সবকিছুই জানা ছিল, একটাও কথা না বলে এতক্ষণের তোলা কোঁচড়ের সব শাক জলেই ফেলে দিয়ে ঘরের দিকে দৌড়–লেন। আর এসময়ই ঝিট্কার জঙ্গলে অজানা-অচেনা ভয়ংকর আওয়াজে ডানা ভদভদিয়ে একসঙ্গে উড়ে উঠল অজস্র টিয়া-হরিয়াল-চড়ই-চটি। আমরা দৌড়ানোর গতি বাড়িয়ে দিলাম।

দুই
হাতে আর একমুহূর্তও সময় নেই, বাবা তাড়া দিচ্ছেন, আমরা যাহোক তাহোক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কীইবা ছিল আমাদের! ওই তো একটা পাতার ‘কুঁড়িয়া’ মাটির ‘তুঁবাঘর’। মায়ের মাথায় একটা গাঁটরি, হাতে একটা মাটির কলসি। কীই জানি কী আছে কলসিতে। শীতের মরশুমে ইঁদুর ধরার প্রাক্কালে দেখেছি ওই কলসিটারই মুখে খড় গুঁজে ভেতরে ঘুঁটের আগুন জ্বেলে ইঁদুরের গর্তের মুখে ধোঁয়া দিতে। খড়ের ডাঁটি বেয়ে গাবানো উসুম-উসুম ধোঁয়া দিকভ্রান্ত না হয়ে সোজা চলে যায় গর্ত বরাবর ইঁদুরের বাসায়। হয়তো ভবিষ্যৎ ইঁদুর-শিকারের লক্ষ্যেই ধোঁয়া দিতে মা ওটা সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। বাবার কাঁধে বস্তা, হাতে খন্তা – চোয়ালের হাড় উঁচিয়ে আগে আগে হেঁটে চলেছেন। তারপরে মা, মায়ের পেছনে বোন, বোনের পেছনে আমি। বোনের মাথায় ‘রোল’ করে বাঁধা ছেঁড়াফাটা একটা             খেজুরপাতার চাটাই। এ যাত্রায় চাটাইটা নিতে বারণ করেছিলাম, বোন শোনেনি। সে নাকি খোলা ‘মেঘপাতালে’র নিচে রাতের বেলা ওই চাটাই পেতে শুলেই কত নতুন-নতুন তারা দেখতে পায় – ‘সাতভায়া’ ‘দধি-ভারিয়া’ ‘কালপুরষা’! আমার হাতেও ‘টুইলা’ ও ‘সাতনলা’। ‘টুইলা’ হলো বাজানোর আর ‘সাতনলা’ হলো পাখি ধরার যন্তর। এক-এক করে সাতটা নল, সবার শেষে সরু তীরের ফলাগোঁজা ‘নল’। মগডালে বসে থাকে কপ্তি কী গোব্রা চড়ই, কী ক্যারকেটা, হয়তো বসে থেকে ঝিমোয়। তখনই লতাপাতা ডাল-আবডালের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সন্তর্পণে চালিয়ে দিতে হয় ‘সাতনলা’। পাখি টেরও পায় না আচম্বিতে সে কখন সাতনলার ফলায় বেঁধা হয়ে যায়! পাকা ফলের মতো থুপ্ করে মাটিতে পড়ে যায় নচেৎ ফলায় গাঁথা হয়ে ডানা ঝাপটায়। এমন এমন যে অস্ত্র, তাকেই বা ফেলে যাই কী করে? হ্যাঁ, প্রিয় ‘টুইলা’র সঙ্গে ‘সাতনলা’টাও নিলাম। ঘর ছাড়ার আগে আমাদের ঘরে                   ‘কাঁটা-দুয়ারী’ করতে এতো বিপদের মধ্যেও বাবা কিন্তু ভুললেন না। কোত্থেকে ‘ভাবুর’ কাঁটাডাল এনে দুয়ারের মুখ কাঁটা দিয়ে আটকে দিলেন, যাতে করে ‘ঝাঁটিয়া কুদ্রা’ ‘গিয়ান’ ‘গোমুহা’ ‘কালপুরষা’ অপদেবতার ছায়া না পড়ে ঘরে! ঘরছাড়ার আগে আমার ও বোনের কান কামড়ে কী একটা ছাল কোমরে গুঁজে দিয়ে বাবা বললেন, ‘এবার নির্ভয়ে চল!’
আমরা চলতে শুরু করলাম। শুধু কী আমরা? আমাদের গ্রামের ঘর-ঘর। ওই তো হাঁসুদের পরিবার, বড়ভদ্র-ছোটভদ্রদের লোকজন, বস্তা কাঁধে কালীপদ-বধিরাম, গাঁটরি মাথায় হারানির মা কালমণি, বেজু কাঁদরুর বাপ শরাবন। কারোর মুখে কোনো রা নেই, কেউ কাউকে জিজ্ঞাসাও করছে না, ‘কোথায় যাচ্ছ গো?’ জিজ্ঞাসা করলেও সঠিক উত্তর দিচ্ছে না, যাচ্ছে উত্তরে তো বলছে দক্ষিণে। কে জানে কী আছে কার মনে! দুপা যাওয়ার পরেই অস্থির হয়ে উঠল বোন নাকফুঁড়ি। উসখুস করছে – সে তার দামি জিনিস ফেলে এসেছে। ‘কী জিনিস রে? কী জিনিস?’ ‘আরশি-কাঁকই’। মা বললেন, ‘কোথায় রেখেছিলি?’ ‘ভুগড়ার খাঁজে।’ বাবা বললেন, ‘আগে বাঁচ্ তারপর আরশি-কাঁকই!’ বাবার কথা শুনে ভারি কষ্ট হলো। বেশ বুঝতে পারছি বোন নাকফুঁড়ি ফনফনিয়ে বাড়ছে, তার এখন আয়নায় মুখ দেখা দরকার। বাবাকে বললামও, ‘যাই একছুট্টে নিয়ে আসি?’ বাবা কড়া নিষেধ করলেন, ‘না, ঘরে কাঁটা-দুয়ারী হয়ে গেছে, আর এখন যেতে নেই!’
গ্রামের মানুষজন নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকদূরের নিরাপদ গ্রামের আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়ি চলে যাচ্ছে। যাদের আছে তারা তো একটা দিশা নিয়ে আশায় বুক বেঁধেই যাচ্ছে, যাদের কেউ কোথাও নেই, দিশাহারা, তারাও পালাচ্ছে। যেমন আমরা। এর-তার মুখে কত গ্রামের নামই তো শুনি – গিধিঘাটা, দলদলি, কেন্দাপাড়া, ভুলাভেদা, চিল্কিগড়, কেঁদুয়াসোল, শুগনিবাসা, সাতবাঁকুড়া, ধানসোল, বাবুইবাসা, গাড়রা, বেলাসোল, কাদাসোল, কলাইমুড়ি, কিয়াবনি, পিংবনি, অমুক-তমুক। যতদূর জানি, এসব গ্রামে আমাদের তিনকুলের কেউ জানাচেনা আত্মীয়-কুটুম্ব একজনাও নেই। আশপাশের গ্রামে মায়ের বাপের বাড়ির, বাপের বাপের বাড়িরও সব মরেহেজে সাফা! বড় রাস্তার দিকে কিছুদূর এসে বোন নাকফুঁড়ি আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ বাদে আমিও জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি বাবা?’ বাবা এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘যেদিকে দুচোখ যায়।’
ঝাঁটিজঙ্গলের ভিতর দিয়ে সুঁড়িপথ, দুধারে লহ-লহ করছে আঁটারিগাছের ডগ্। আমি আর বোন ডগ্ ছিঁড়ে মুখে পুরছি, চিবোচ্ছি। ঢোঁক গিলছি। কষা কষা অম্লমধুর স্বাদ। মুখের ভিতরটা জলে ভরে যাচ্ছে। এতক্ষণে মা যেন বুকের ভিতর থেকে কথা বলে উঠলেন, ‘যেখানে মেঘপাতালে দেখবি গোল হয়ে চিল ঘুরছে, ঘুরছে তো ঘুরছে, সেখানে জানবি জলের জন্য চিল কুঁয়া খুঁড়ছে। আমরা সেই দিশমেই যাচ্ছি রে ধন! মায়ের কথামতো তারপর থেকেই আমরা দুভাইবোন মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। আকাশও যেন সুনসান, চিল তো চিল একটা ঢেপ্চু পাখিরও দেখা নেই – যে কিনা অনবরত ‘ভু-উ-চু-ঙ্’ ‘ভু-উ-চু-ঙ’ করে মাকুর ফিতার মতো এ-মাথা সে-মাথা উড়ে-ঘুরে বেড়ায়।
বড় রাস্তা এসে গেল। খাকি পোশাকের পুলিশ সব হাতে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। দেখামাত্রই আমরা খানিকটা পিছু হটে লাটাপাটায় লুকিয়ে পড়লাম। আমাদের মা কিন্তু অকুতোভয়, বাবার হাত টেনে ধরে বললেন, ‘র্ডপেল্কার মতন এখন লুকালে চলবে? মাথা সোজা রেখেই হাঁটো!’ বাবার ভয় যদি আনসাট্কা সন্দেহ করে জিহলখানায় পুরে দেয় পুলিশ? পুলিশ আমাদের সত্যি-সত্যিই থামিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ উত্তর না দিয়ে খালি চোখ পিট্পিট্ করছেন বাবা, কথা আটকে গেছে! মা এগিয়ে এসে বললেন, ‘কোথায় আর যাব? ঘরে যাচ্ছি।’ ‘কোথায় গিয়েছিলে?’ মায়ের চটজলদি উত্তর, ‘কুটুমবাড়ি।’ ‘কী আছে পুঁটলিতে?’ ‘কলসিতে?’ তর সইছিল না পুলিশদের, পোঁটলা-পুঁটলি নিজেরাই খুলে ফেলল। কলসিটা কিছুতেই হাতছাড়া করছেন না মা, ভিতরের জিনিস মুঠোয় এনে দেখাচ্ছেন, আমরাও উঁকি মেরে দেখছি, কী জিনিস দেখি! শুকনো মহুল আর ছালছাড়া তেঁতুলবীচি। এতক্ষণে বুঝলাম কেন যক্ষের ধনের মতো কলসিটা আগলে রেখেছেন মা – ওই তো আমাদের পেটের ভাত! মহুল আর তেঁতুলবীচি সেদ্ধ! গরম জলে ফুটে ফুলেফেঁপে একাকার হয়ে যায় শুকনো মহুল, আর ছালছাড়া পোড়া তেঁতুলবীচি। তখন কোনটা মহুল কোনটা তেঁতুলবীচি চেনাই দায়! আমার মা জানেন বেছে-বেছে সেদ্ধ তেঁতুলবীচি খেতে আমি কতটা ভালোবাসি। পুলিশ কিন্তু ওই একমুঠোতে সন্তুষ্ট হলো না, ‘উসিসে নেহি হো গা, বিলকুল লোটা দো’, পুরোটাই ঢালতে হলো। পেটের অন্ন অতটা হেলাফেলার নাকি! রাস্তার বালি-কাঁকরে মা কিছুতেই ঢালতে রাজি হলেন না। বোনের ছেঁড়া চাটাই পেতে তবে ঢাললেন। সব দেখেশুনে পুলিশ আমাদের ছেড়ে দিলো। আর আমরাও মায়ের কথামতো ‘কুটুমবাড়ি’ ছেড়ে ‘ঘরের দিকে’ যেতে থাকলাম।

তিন
বাবার মুখে কোনো কথা নেই, মাও চুপ। আমরা অনবরত হেঁটে চলেছি। হেঁটে চলেছি, হেঁটে চলেছি। খালি যা আমি আর নাকফুঁড়ি মাঝেমধ্যেই পথের দুধারের লতাপাতা ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছি, কখনো ঢোঁক গিলছি, কখনো ছিঃ থুঃ করে ফেলে দিচ্ছি। আমরাও চুপচাপ, কথা তেমন বলছি না। আসলে কথা বলার ইচ্ছাটাই যেন মিইয়ে আসছে ধীরে-ধীরে। এভাবে আরো কতদূর যেতে হবে – সে হয়তো বাবা জানেন, কিন্তু বাবার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল সেটুকুও বাবার জানা নেই। এসময় ‘কচ্ড়া’ ‘কুসুমে’র দিন – অথচ ধারেকাছে কোথাও একটা কচ্ড়া কী কুসুমগাছ দেখা যাচ্ছে না, জিভে জল এসে যাচ্ছিল। অগত্যা মাকে বললাম, ‘চাট্টি তেঁতুল ‘মুজি’ দাও না মা, খাই!’ মা দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘চ কোথাও একটু বসি!’ একটা চল্লাগাছের তলায় আমরা বসে পড়লাম, বাবা বিরক্ত হলেন, তবু আমাদের দেখাদেখি বেজার মুখ করে বসেও পড়লেন। চল্লাগাছ ওই তো আরেকটা – এতো যখন চল্লাগাছ কাছেপিঠে নির্ঘাত গা-গঞ্জ আছে। বেছে-বেছে ভাজা ছালছাড়ানো তেঁতুলবীচি চিবোতে-চিবোতে বাবাকে বললামও। বাবা যেন খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছিস, এদিকটায় কাদাসোল বাঁদরিসোল কলাইমুড়ি বাবুইবাসা চাঁপাসোল’ বলে বাবাও তেঁতুলের বীচিসহ একমুঠো কাঁচা মহুল চিবিয়ে খেলেন। আমরা ফের টঙস্ টঙস্ করে হাঁটতে লাগলাম।
গাঁ-গেরাম তো আছে কিন্তু লোকজন কোথায়? একটা লোকও তো নেই! ঘরের দরজা-জানলা হাট করে খোলা, চৌকাঠের পাল্লা যেন এখনো র্ঠি র্ঠি করে নড়ছে, যেন এইমাত্রই ‘গিরিহা’ ঘর ছেড়ে হুটহাট বেরিয়েছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে। চোখে পড়ল দু-চাট্টা মুরগি ঢিঁ-ঢিঁ করে চরে বেড়াচ্ছে, কয়েকটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল, আমাদের দেখে আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল, তবে আমাদের কাছে দৌড়ে এলো না, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই ল্যাজ নাড়ছে। কোথাও গরু ডাকল – হাম্বা! একটা নয় আরো কয়েকটা। বাবা বললেন, ‘সব ছেড়েছুড়ে পালিয়েছে! গেরামটা মাহাত মহাজনদের। কত দিতে এসেছি গাড়ির ‘আরা’ ‘ধুরিকাঠ’ লাঙলের বোঁটা, ‘ইশ’ -।’ গ্রামের মাথায় একটা পাতকুয়া, ঘড়রিতে এখনো লাগানো দড়ি-বালতি। বোন নাকফুঁড়ি আর আমি দৌড়ে গেলাম – যদি একটু জল পাওয়া যায়! বাবা হাঁকড়ে উঠলেন, ‘খবরদার!’ আমরা হাত গুটিয়ে ফিরে এলাম। বাবা কেন যে নিষেধ করলেন বুঝতে পারছি না। অথচ তেঁতুলের বীচি চিবিয়ে টাকরা শুকিয়ে যাচ্ছিল। মা বললেন, ‘হাঁটতে থাক, সামনে কত নদীনালা সায়র বাঁধগোড়া পাবি।’ সত্যি সত্যি আমরা একটা নদী পেলাম। মরা-হাজা হাড়-জিড়জিড়ে নদী, এখানে জল তো সেখানে চাপড়া চাপড়া ঘাস-পাথর। আঁজলা ভরে জল খেলাম। ‘কী নাম?’ বাবা বললেন, ‘জঙ্গলের ভিতর বাস অত নদীনালার নাম কী আর জানি? শুনেছি ‘টাঙ্গাই’ কী ‘তমাল-টমাল’ হবে।’ বোন আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, আরো কদ্দুর যেতে হবে?’ উত্তর দিতে না দিতেই কাছেপিঠে কোথাও ভয়ংকর একটা শব্দ হলো, জঙ্গলের ভিতরে কী ওধারে আগুনের হল্কা উঠল। আমরা দৌড়াতে থাকলাম – রিটপিটে দৌড় – দৌড় দৌড় –
দৌড়–তে দৌড়–তে মা এক জায়গায় থুপ করে আচমকা বসে পড়ে বললেন, ‘কার খাই না ধারি যে অমন পড়ি-কি-মরি দৌড়াব?’ বোন আর আমি বুঝতে পারলাম – মা আর পারছেন না। বাবাও ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে ফেললেন, ‘আর তো সামান্যই।’ আমরাও জেনে উল্লসিত হলাম, যাক আর ক-পা হাঁটলেই আমরা তাহলে ভয়ের মুলুক পেরিয়ে যাব! ফের টঙ্গস্-টঙ্গস্ করে হাঁটা। একই তো আবহাওয়া গাছপালা রাস্তাঘাট বাবুই ঘাসের চাষ। বেলা প্রায় হেলে পড়েছে। তফাতের মধ্যে এই যা – এখানে ডুব্কা-ডুঙরিতে গরু চরছে, গরুর গলায় ‘র্ঠকা’ বাজছে, ঠ-র-ক্! ঠ-র-ক্!! লোকজনের এখনো দেখা নেই। গরু-রাখালরাই বা কোথায়!
দেখতে দেখতে একটা লোক সাঁক্ করে সাইকেল চালিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল, তার সাইকেল ক্যারিয়ারে গাদা-গুচ্ছের ডুমুর গাছের পাতা, বোধহয় ছাগলের জন্য। লোকটা ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে গেল কিন্তু একটাও কথা বলল না। তাহলে অবশেষে একটা গ্রামে আসা গেল সে-গ্রামে অন্তত একটা মানুষ আছে, তার কতক ছাগল আছে! একটা নয়, অনেক মানুষেরই দেখা মিলল, আমাদের বাবাও তাঁর দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়ি খুঁজে পেলেন। আমি আর বোন পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে যেন বললাম, ও, যাক তাহলে আমাদেরও আত্মীয়কুটুম্ব আছে! বাবার সম্পর্কে মাসতুতো ভাই মোটামুটি দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়া মানুষ, সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে কেঁদুপাতা ও বাবুইদড়ির কারবার করেন, সাইকেলের ক্যারিয়ারে এখনো বাঁধা বাবুইদড়ির বান্ডিলই তার প্রমাণ। গলায় জোর আছে তবু যেন কথা বলছেন বাবার সঙ্গে ফিসফিস করে। মা আর বোন ততক্ষণে  ঝিউড়ি-বউড়িদের সঙ্গে ঘরের ভিতর, একলা আমি দু-পা এদিক-সেদিক হেঁটে গ্রামটা ঘুরে দেখছি। তেঁতুলতলায় এক ন্যাড়ামুণ্ডি আমারই বয়সী ছেলে এসে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার নাম দামু, তোর?’ আমিও নাম বললাম। ‘আমাদের গেরামের নাম চিচুড়গেড়িয়া, তোদের?’ গ্রামেরও নাম বললাম। ‘তোর কোন পার্টি? আমরা -।’
দৌড়ে ফিরে এলাম কোনো উত্তর না দিয়ে। বাবাকে বললাম, বাবার মাসতুতো ভাইকেও। তিনি তেঁতুলতলায় দ্রুত ঘুরে এসে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও দামু, হাবাগোবা, আধপাগলা – কিন্তুক ভালো ‘আলি’ খেলে – যা না দুদান খেলে আয়!’ ‘আলি’ তার মানে কাকের নানা রঙের গুলি, গুলি দিয়ে আঙুলের টিপ-পরীক্ষা। কত খেলেছি! তা বলে কাচের গুলি নয়, ভেলাফলের কালো কালো বীচি। এখন এই চারধার আঁধার করে আসা ঝুঁজকো বেলায় আর ‘আলি’ খেলতে মন গেল না। এতদিন মাঝেমধ্যে ‘র্কুথি-সিজা’ খেয়েছি, কিন্তু কুরথির ডাল! আজ আমাদের কুটুমবাড়িতে র্কুথির ডাল দিয়ে শুক্না-ভাত খাচ্ছি। দু-এক গ্রাস খেয়েছি কী খাইনি, দরজায় দমাদ্দম লাথি পড়ল, কে বা কারা বাবার মাসতুতো ভাইয়ের বাড়িটাই ভেঙে দিচ্ছিল, আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল চালে – দাউ দাউ! খাওয়া ফেলে কোনো মতে গাঁটরি-গুঁটরি নিয়ে আমরা ফের উদ্বাস্তু হলাম, দৌড়–লাম। শুধু কি আমরা? বাবার দূরসম্পর্কের মাসতুতো ভাইয়ের বাড়ির লোকজনরাও! দৌড়–তে দৌড়–তে দলছুট হয়ে গেলাম আমরা। তাঁরা তো যাবেন তাঁদের আত্মীয়বাড়ি, দূরদূরান্তের কোনো এক নির্দিষ্ট গ্রামে কিংবা টাউনে। আমাদের আর কোনো আত্মীয়টুকুম্ব নেই, যাওয়ার জায়গাও নেই, বাবা ফের মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করে বললেন, ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগরের জলও শুকায়। যেদিকে দুচোখ যায় দৌড়া!’ আমরা ঝাঁ-ঝাঁ রাতে সাপখোপ পোকামাকড় মাড়িয়ে দৌড়াতে লাগলাম। আমাদের পদে পদে আশঙ্কা হচ্ছিল, মা না থুপ্ করে বসে পড়ে বলে বসেন, ‘কার খাই না ধারি যে অমন পড়ি-কি-মরি দৌড়াব!’ আসরে আমরা র্কুথর ডাল-ভাত এক-দু গ্রাস মুখে পুরলেও মা যে এক খাবলও মুখে দেননি! পুরুষদের খাওয়া শেষ হলে তবেই না মেয়েদের খাওয়া শুরু হয়!
পেছনে দাউ-দাউ আগুন, মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ, আমরা ঠিক করতে পারছি না যে-পথে গিয়েছিলাম সে-পথেই ফিরে আসছি কী! আমার কেবলই মনে হচ্ছিল হাবাগোবা আধপাগলা দামু কি আঙুল উঁচিয়ে সেই তাদেরও জিজ্ঞাসা করছে – ‘তোমরা কোন পার্টি?’ যাওয়ার রাস্তায় ফিরে আসা আর তো নিরাপদ নয়, বাবা বললেন, ‘ন্নাহ্, আমরা কাঁটাপাহাড়ি-সিজুয়ার দিকেই যাচ্ছি।’ কোথায় সিজুয়া, কোথায় কাঁটাপাহাড়ি আমার ঠিক জানা নেই। বোন নাকফুঁড়িও অস্থির হয়ে বলে উঠল, ‘আর পারছি না বাবা, কাঁটাপাহাড়ি ঝেঁটপাহাড়ি থাক, ওই জঙ্গলে চল-অ! আমার গাদা ঘুম পাচ্ছে!’ অগত্যা আমরা বাকি রাতটুকু কাটাতে জঙ্গলে ঢুকলাম। জঙ্গল, জঙ্গল। গাছপালার আড়ালে একটা ‘টিকরোল’ ভুঁই দেখে আমরা  আস্তানা গাড়লাম। মাথার ওপর গাছপালহার ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তারাভরা ‘মেঘপাতাল’, এক-দু টুকরো ভাসমান ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ! রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা ডাকছে, ডাকছে মানে! যেন তার          বুক-পেট ফাটিয়ে ডাকছে। কোত্থেকে দু-চাট্টা ধরে এনে মাটিতে গুঁজে দিলো নাকফুঁড়ি। আদ্ধেক মাটিতে, আদ্ধেক উপরে, তার মধ্যেও  শুঁড় নেড়ে নেড়ে বিরামহীন ডেকে চলেছে ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ – রিঁ-ই-ই-ই! রিঁ-ই-ই-ই!! নাকফুঁড়ি ঘোষণা করল, ‘আজ থাক, কাল তোদের বিয়ে দেবো।’ তারপর সে তার ছেঁড়া চাটাই পেতে শুয়ে আকাশের তারা আবিষ্কারে মেতে উঠল – ‘একটা তারা দুটা তারা কোন্ তারাটা আরা ঝারা। আন্ দেখি গ কাঁড়বাঁশটা বিঁধে দিব ভুরভুরাটা।’ বাবা খন্তা-হাতে চারপাশটা ভালো করে দেখে এলেন। র্সর্স করে শুকনো মড়মড়ে পাতার ওপর বুকে ভর দিয়ে চলে যাচ্ছে রাতের ‘লতা’, হুপ্হুপ্ করে মাঝে মধ্যেই ডেকে উঠছে বন্য নিশাচরের দল, বনমোরগ ‘বাঙ্’ দিচ্ছে দূরে কোথাও, ‘ট্র্যাঁ’ ‘ট্র্যাঁ’ করে পাখি ভদ্কালো গাছের মগডালে, মা কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন! এবার নাকফুঁড়িও ঘুমিয়ে পড়ল। বাবা আর আমি জেগে, থেকে-থেকে খন্তার খুপ্খুপ্ আওয়াজ পাচ্ছি। একসময় সে-আওয়াজও থেমে গেল, বাবা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমিও। ভোরের দিকে মায়ের আর্তচিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে দেখি খন্তা-হাতে বাবা লাটাপাটা ভেঙে দৌড়–তে দৌড়–তে গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছেন। এক মুহূর্তও দেরি না করে আমিও বাবার পিছু-পিছু দৌড়–তে শুরু করলাম।

চার
আমাদের পরিবারের আমরা চারজন একসঙ্গে ঘর ছেড়েছিলাম, এখন আমরা তিনজন। গতকাল রাতে কে বা কারা এসে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গেছে বোন নাকফুঁড়িকে। তন্নতন্ন করে সারা জঙ্গল ঢুঁড়েও আমরা তাকে খুঁজে পেলাম না। তার ফেলে যাওয়া খেজুরপাতার ছেঁড়া চাটাইটা জঙ্গলেই পড়ে থাকল, কেউ আর তার ওপর শুয়ে তারাভরা রাতে মেঘপাতালে ‘কাল্পুরষা’ ‘দধিভারিয়া’ ‘সাতভায়া’র মতো নতুন-নতুন তারা খুঁজবে না। ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকাগুলো আদ্ধেক মাটিতেই পোঁতা থাকল, পোঁতাই থাকল, তাদের ঘটা করে বিয়ে দিতে নাকফুঁড়ি নামের কেউ আর থাকল না। দুপুর গড়িয়ে ‘আড়বেলা’ পর্যন্ত আমরা সেখানেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম – যদি সে ফিরে আসে, যদি আসে। বাবার চোখদুটো খোসা ছাড়া পাকা কুসুম ফলের মতো লাল, একটাও কথা বলছেন না। মা থেকে-থেকে কঁকিয়ে কেঁদে উঠছেন। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল বোন যেন এসেই বলবে, ‘আরো কদ্দুর যেতে হবে বাবা?’ সব মায়া কাটিয়ে আমরা ফের রওনা দিলাম পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে। কোথায় এসেছিলাম, এখন কোন দিকে যেতে হবে – তা জানা নেই, আর তার যেন দরকারও নেই। বাবা এগিয়ে চলেছেন, মা হাঁটতে পারছেন না, মাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছি।
হাঁটছি, হাঁটছি। টাঁড়-টিকর বন-বাদাড় পেরিয়ে। দুয়েকটা গ্রাম যে চোখে পড়ছে না তা নয়, পড়ছে, তবে জনমানুষশূন্য, খাঁ-খাঁ। মাটির ‘ভুগড়া’, কোনটায় বা ‘পলিথিন-শিট’ চাপা দেওয়া। দরজা হাট করে খোলা, নচেৎ ‘ঝিঁজ্রি দেওয়া। যে কেউ দরজা না ভেঙে ঢুকতে পারে ভিতরে। ভিতরে ঢুকে চুরিচামারি করার লোকও যেন আর অবশিষ্ট নেই। বাড়ির মাচানে ‘ভুয়াঙ’ লাউ ফলেছে, কুঁদরি-মাচায় কুঁদরি পেকে লাল হয়ে ঝরে পড়ছে, কাঁচা কুঁদরি তুলে ‘ভাতে-সেদ্ধ’ বা তরকারি করে কে আর খাবে! পাতকুয়ার ঘররিতে লটকানো দড়ি-বালতি পড়ে আছে যেমনকার তেমন। দেখেই মনে পড়ে গেল বোন নাকফুঁড়ির কথা, ছুটে জল খেতে যাওয়া আর বাবার নিষেধের কথা। সেবার নিষেধ মেনে ফিরে এলেও এবার যেন জেদি মোরগের মতো ঝুঁটি ফুলিয়ে দৌড়ে গেলাম, বোনও যেন সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়–চ্ছে। কুয়ায় বালতি ধাপিয়ে জল তুলে জলও খেলাম। বাবাও নিষেধ করলেন না, তার যেন আর কিছুতেই কিছু যায়-আসে না।
একটা খাল পড়ল। খালপাড়ে ডুরকা-ডুংরিতে গরু-মোষ চরছে, কিন্তু ভাঙা ছাতা-লাঠিধারী সচরাচর দেখা যায় এমন কোনো গরুবাগাল কাড়া বাগালকে দেখা গেল না। আমরা খাল পেরিয়ে মোরাম রাস্তায় উঠে এলাম। ডাইনে যাবেন না বাঁয়ে যাবেন ঠিক করতে না পেরে বাবা খানিক থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আড়বেলা’র অবস্থান দেখে ডানদিকেই হাঁটতে লাগলেন। হাঁটছি, হাঁটছি। কখনো মনে হচ্ছে সামনের দিক থেকে কেউ আসছে, কখনো মনে হচ্ছে কেউ পিছন-পিছন আসছে! দুধারে জঙ্গল, তবে জঙ্গল খুব গাঢ় নয়, রাস্তার ধারে ধারে দু-দশটা বড়-বড় গাছ, তার তলায় তলায় আঁটারি-চুরচু-পড়াশের ঝাঁটিজঙ্গল। কিছুদূর এগিয়ে দেখা গেল রাস্তা কাটা। বাবা ফের মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন, ‘এই যা!’ আসলে ধন্ধে পড়ে গেছেন তিনি – কোনদিকে কারা? এগোলে ভালো, না পিছোলে ভালো? আমাদের জড়িয়ে ধরে বাবা সামনের দিকেই হাঁটতে লাগলেন। হাঁটছি, হাঁটছি। রাস্তার ওপর একটা আস্ত গাছের গুঁড়ি ফেলা। রাস্তার তে-মাথা কি চৌমাথার মোড়ে মাঝেমাঝেই দেখা যায় ধানের তুষসহ হাঁড়িভাঙা, ডিমের খোসা, সিঁদুর ঢিপ। তার মানে কেউ ‘তুক্-গুণ’ ‘ছাড়ান’ ‘নিমছা’ করেছে। রাস্তা পার হতে গিয়ে আমরা মোড়টা না ডিঙিয়ে খানিকটা ঘুরপথে হেঁটে যাই। বাবাও তাই করলেন। গাছের গুঁড়িটা না ডিঙিয়ে আমরা ঘুরপথে হেঁটে ফের রাস্তায় উঠলাম। এখন নাক বরাবর হাঁটা। হাঁটছি, হাঁটছি। কখনো মনে হচ্ছে আশপাশে কেউ নেই, সুনসান সুনসান। পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল কে বা কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে, হাঁটছে-চলছে, লাটাপাটা তো নড়ছে সড়্সড়্ করে! কে জানে ‘খেড়িয়া’ না ‘বরহা’! বাবা এই সময়টায় ফের মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে যেন সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করে বললেন, ‘চোখ-কান খোলা রেখে হাঁটো!’ আমি চারধারটা চনমন করে দেখতে দেখতে হাঁটছি, মায়ের অতো দেখাদেখি নেই, বললেন, ‘ছাড়্ ত! ধর্মের রাস্তায় হাঁটছি – ডর কি!’ মায়ের ডরভয় নেই, সদ্য সন্তানহারা জননীর কাছে ডরভয়ের চেয়ে শোকই তো বড়। মা এখনো মাঝেমাঝেই কঁকিয়ে কেঁদে উঠছেন।
বেলা আড় হয়ে ঢলে পড়লেও হঠাৎ যেন নিভু-নিভু চারধারটা জ্বলে উঠল দপ্ করে। তার মানে জঙ্গল শেষ হলো। জঙ্গল শেষ হতেই দেখা গেল বেশ কিছু লোকজন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় এক-দুমাইল তফাতে! হাতে তাঁদের কাঁড়-কাঁড় বাঁশ টাঙ্গি-বল্লম তাবলা বুঢ়িয়া। মুখে চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে কীসব বলে চলেছেন! বাবা থমকে দাঁড়ালেন, ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘পিছনটা একবার দ্যাক্ রে নীলুয়া!’ দেখলাম হাতে বন্দুক তাক্ করে খাকি আর তার ওপর ছাপ্কা ছাপ্কা রঙের পোশাকপরা কাতারে কাতারে পুলিশ! এর মধ্যেই কোথাও একটা ভয়ংকর আওয়াজ হলো, একসঙ্গে কত যে গোলা পায়রা ডানা ফটফটিয়ে উড়ে উঠল! একটা, তারপর আরো একটা আওয়াজ, কানফাটা! আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি থমকে। বাবা বোধহয় তড়পে উঠলেন রাগে, তাঁর চোখদুটো লাল, আরো লাল হয়ে উঠল। তারপর খন্তা-হাতে কেন যে হঠাৎ দৌড়ে গেলেন সামনের দিকে এখনো বুঝতে পারছি না! একমুহূর্তও গেল না, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বাবা। মা আর আমি দৌড়ে গেলাম বাবার কাছে, তাঁর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছাড়ি-পাছাড়ি কাঁদছি। আমাদের প্রায় গায়ের ওপর দিয়েই ডাইনে-বাঁয়ে গুলি চালাতে চালাতে দৌড়ে গেল খাকি আর ছাপকা ছাপকা পোশাকপরা লোকগুলো। মাটির কলসি ভেঙে রাস্তাময় ছড়িয়ে পড়ল শুকনো মহুল আর ছালছাড়ানো তেঁতুলবীচি। তার ওপর ভারি বুটের ছাপ্পা লাগল।
এখন ওই তো বাবার দেহ, একটা ইস্কুলঘরের সামনে বেঞ্চিতে শোয়ানো। তাঁর কাছে যাওয়ার আর আমাদের অধিকার নেই। মাঝে মাঝেই মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করার আর আমাদের কেউ থাকল না। বাবা এখন পুরোপুরি ওদের সম্পত্তি। ‘ফটো-খিঁচা’ মেশিনে কত ছবি উঠছে বাবার! আমরা বড় গরিব ছিলাম, গরিব হয়ে গেলাম আরো। এর মধ্যেই পুলিশ এসে আমার হাফ-পেন্টুলের পকেট হাতড়েছে দু-দুবার। তল্লাশি করে দু-দুটো শুঁড়-জড়ানো লোহার মতো শক্ত ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকা পেয়েছে। কে জানে কালরাতে কখন পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে নাকফুঁড়ি! ‘টুইলা’ আর ‘সাতনলা’ তো ছুড়ে ফেলে এসেছি সেই ‘বহিন-খাকি’র জঙ্গলে! একসঙ্গে ঘর ছেড়ে ছিলাম আমরা চারজন। বাবাও চলে গেলেন, বোনও। মুখে গাঁজলা তুলে জ্ঞান হারিয়েছেন মাও। এতক্ষণে মরে গেছেন কী বেঁচে আছেন – জানি না।

পাঁচ
মা পড়ে আছেন রাস্তায়, ঠিক রাস্তায় নয়, রাস্তার একধারে। আমিই টেনে এনেছি এদিকে, পাছে রাস্তায় হঠাৎ-হঠাৎ আসা গাড়িঘোড়া -! কাঠের ‘ধুরি’অলা লোহার ‘মুখপাতা’-বসানো দু-চাকার গরুর গাড়ি তো নয়, বনের ভিতর পিচ-রাস্তার ওপর দিয়ে গিড়গিড় করে আসতে আসতে গাড়োয়ান ঘুমিয়ে থাকলেও অবলা জীবদুটি রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখলে তক্ষুনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়বে! আর এখন যা অবস্থা এসব অঞ্চলে গরুর গাড়ি আসাটাই ঝকমারি, কখন কোথায় ফেঁসে যাবে কীভাবে! যা আসছে সব মিলিটারি গাড়ি বুম্বুম্ করে। এই তো একটু আগে গেল একটা, এখন আরেকটা। এমনভাবে হুঁকরে আসছিল, যেন তালজ্ঞান ভুলে চড়ে বসবে মায়ের ওপর! আমি উপুড়, হয়ে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলাম মাকে। এই আমার মা, মুখে এখন বুজ্কুড়ির মতো গাঁজলা উঠছে ফেনা-ফেনা। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বসে আছি আমি, মাঝে মাঝে হাতের আঙুল বুলিয়ে গাঁজলা মুছে দিচ্ছি আর বুকের ওপর কান চেপে শুনছি – ধুকপুকানিটা আছে কিনা। আছে, আছে। কেঁদ্ কি কুরকুট নিয়ে হাটে গিয়েছেন, জিনিস বেচে কিনে এনেছেন চাল-নুন, সেইসঙ্গে মিষ্টি পান একটা। পান চিবোতে-চিবোতে ঠোঁট লাল করে ফেলেছেন, কোত্থেকে দৌড়–তে-দৌড়–তে এসে মায়ের দুহাঁটু জড়িয়ে ধরে আমরা দু-ভাইবোন আব্দার ধরেছি, ‘দাও না গো মা পান, ঠোঁট লাল করি।’ মা মুখ থেকে চিবোনো পান জিভের ডগায় নিয়ে একবার আমার মুখের সামনে, একবার বোনের মুখের সামনে ধরে লোভ দেখাতেন, ধরতে যেই আমরা হাত বাড়াতাম, অমনি মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিতেন সুড়–ৎ করে। আসলে প্রথম-প্রথম কৌতুক করতেন মা, অবশেষে চর্বিত পান ভাগ করে দিতেন আমাদের মধ্যে। তবে ওই যখন লাল লাল চোখ-না-ফোটা কাঁড়াল-কোঁড়ল ইঁদুরের বাচ্চা কচ্মচিয়ে চিবিয়ে খেতেন, ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত রক্ত, তখন চর্বিত ভগ্নাংশ চাওয়া তো দূরঅস্ত, আমরা দূরে-দূরেই থাকতাম আর বলতাম, ‘তুমি কি গো মা!’ তাতেও মায়ের হিন্দোল নেই, ওই শুধু হি-হি মাকালীর হাসি! আমাদের জঙ্গলে আলু-তুঙার অভাব নেই, অবিকল পানপাতার মতো পাতাঅলা একধরনের আলু আছে, যার নাম ‘পানআলু’। হয়তো আলুগাছের পাতা দেখতে পানের মতোই, তাই পানআলু। সেই পানআলুর পাতা চুন-খয়ের সহকারে আমি আর বোন কতদিন চিবিয়ে দেখেছি – কোথায় পান আর কোথায় পানআলুর পাতা! ছিঃ থুঃ! লাল তো হলোই না, উলটে গোটা মুখ বিস্বাদে ভরে গিয়েছিল। আমাদের কিত্তি দেখে মায়ের সেদিন সেকি মুচকি-মুচকি হাসি আর গান –
আলুপতর কি পান হেইব।
পর দেশরে কি মন রহিব ॥
ঠোঁটের কষ বেয়ে চর্বিত পানের লাল রস নয়, লাল-লাল  চোখ-না- ফোটা ‘চুটিয়া’র রক্তও না, মায়ের মুখ দিয়ে এখন সাদা-সাদা বুজ্কুড়ির মতো গাঁজলা উঠছে। ঢুঁড়লে এই জঙ্গলেও কী আর পানআলুর দেখা মিলবে না? মিললেও চুন-খয়ের মিশিয়ে তার পাতা চিবোনোর আর দোসরা পাওয়া যাবে না। একা-একা চিবোলেও কে আর তাই দেখে মুচকি হেসে গেয়ে উঠবে ‘আলুপতর কি পান হেইব!’ না, না! আলুর পাতা কখনো পানপাতা হবে না, বিদেশও কখনো স্বদেশ হবে না, মন ‘রহা-রহি’ তো পরের কথা! রাস্তায় একটা লোক নেই, সুনসান। অথচ একটু আগে – ওই তো, ওই যেখানে শুঁড়ে শুঁড়ে জড়াজড়ি করে আছে আঁটারি লতা, রাস্তার দুধারে নেমে গিয়েছে মোরাম রাস্তা, হেলা-বটগাছের তলায় একটা জনশূন্য ভাঙা গুমটি – সেখানেই টাঙ্গি-বল্লম কাঁড়-কাঁড়বাঁশ তাব্লা-বুঢ়িয়া নিয়ে কাতারে কাতারে লোক রাস্তা ঘিরে ধরে দাঁড়িয়েছিল! ফুটফাট ফুটুস-ফাটাস কীসব শব্দ হলো, জাঁতাকলে পড়ে বেঘোরে একটা লোক মরল, আর মুহূর্তে সব ভোঁ-ভাঁ, নিমেষে হাওয়া!
লোক অবশ্য আছে অদূরে ইস্কুল ঘরের আনাচে-কানাচে, ওই যেখানে কাঠের বেঞ্চিতে শোয়ানো রয়েছে বাবার দেহ। তবে ঝলকে ঝলকে ফটো তোলা মেশিন তাক করে ফটো-খিঁচা মানুষগুলো আর নেই, বেলা থাকতে-থাকতে যে যার মতো সরে পড়েছে। বেলাও পড়ে আসছে, বেলা এখন ঝিরিঝিরি। কখন খসে যাবে টুঙ করে! নিঃসাড় হয়ে আসছে বন-জঙ্গল, বড়-বড় গাছ, গাছতলার ঝোপঝাড়, লাটাপাটা। থেকে থেকে ওই যা দুটো-একটা ‘পাথ’ ডাক দিয়ে যাচ্ছে ঘরে-ফেরানি। ডাক শুনলেই বোঝা যায় – সন্ধে হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের বাঁধগোড়ার জলে হিলহিলে হাওয়া যখন বিলি কাটে, জলের কিনারে দুয়েকটা কুচো বক কী কাদাখোঁচা জলপিপি কী কয়ের-কপত্তি যখন একপায়ে দাঁড়িয়ে এক পা তুলে গলা ফুলিয়ে গলার সাদা অংশ কাঁপিয়ে ‘ক-এ-ক-ক’ ‘ক-এ-ক-ক’ করে ডাক দেয়, তখন বুঝি বইকি সন্ধ্যার আর বিশেষ দেরি নেই।
আজ আবার সন্ধ্যা নামবে, রিঁ-রিঁ করে বিরামহীন ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকা ডাকবে, রাত গাঢ় হবে, গেল রাতের মতো বোন নাকফুঁড়ি আজ তো আর ঘুমের জন্য বায়না ধরবে না, ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকা ধরে এনে মাটিতে গুঁথে রেখে পরের দিন প্রত্যুষে কেউ আর বিবাহের উদ্যোগ করবে না, বাবা ঘুমন্ত, মাও তো ঘুমিয়েই আছেন। আজ আবার খাবার জুটবে না। এতোদিনের সঞ্চয় যা মা আঁকড়ে রেখেছিলেন ওই মাটির কলসিতে, ভাজা ও খোসা-ছাড়ানো তেঁতুল-‘মুজি’ আর শুকনো মহুল দানা, তাও তো ভেঙে ছত্রখান, এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাস্তায়! তার ওপর কত যে গামবুট, মোটরগাড়ি গেল এলো! আরো কত আসবে যাবে! কত যে সরকারি সিলমোহরের ছাপ্পা পড়বে! সে যা হয় হোক, এখন কোথাও একটু জল পেলে হয়। মাথায়-চোখে-মুখে জলের ছিটা দিলে তবে যদি মায়ের জ্ঞান ফিরে! জলের আশায় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি – ধারেকাছে কোথাও কী একটা বাঁধগোড়া নেই? জল ছিল্ছিল্ পুকুর? গহম বাঁধ, রিলিফ বাঁধ? কিংবা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ভিতর দিয়ে, কেঁদ্ কুসুমের গাছতলা দিয়ে, জইড়তলা-বঢ়তলা পেরিয়ে বহন্তি কোনো খাল? মরা-হাজা কোনো নালা? জঙ্গলে পাতা ছিঁড়তে ঝাঁটি কুড়োতে গিয়ে ঠা-ঠা রৌদ্রে গলা ‘শঁসালে’ জল না পাই, আমরা আঁটারির ‘ডগ্’ শালের ‘ডগাল্’ চিবোই। এখন আমি না হয় – কিন্তু মা! অথচ এই মানুষটাই আমাদের তেষ্টা পেলে অথবা জলের কথা উঠলে বলতেন, ‘যেখানে মেঘপাতালে দেখবি গোল হয়ে চিল ঘুরছে, ঘুরছে তো ঘুরছে, সেখানে জানবি জলের জন্য চিল কুঁয়া খুঁড়ছে, সেখানে গেলে জল পাবিই পাবি!’ মায়ের কথামতো বড়বড় গাছের মাথার ফাঁকফোকর দিয়ে মেঘপাতালের দিকে চোখ তুলে দেখছি – যদি র্ঘুর্ঘু ঘুরন্তি চিলের ঘুরে ঘুরে কুঁয়া খোঁড়ার খুঁজে পাই হাল-হদিস। কিন্তু হায়! বেলা আড় হয়ে যে অস্তাচলে ঢলে পড়ছে মায়ের কোলে, এখন আর চিল কোথায়! সব তো কুঁয়া খুঁড়তে-খুঁড়তে থকে গিয়ে নেমে পড়েছে খাল-বিল-নদীধারের বট-পাকুড়ে!
ইস্কুলবাড়ি যখন, ধারেকাছে কোথাও একটা-দুটো গ্রাম আছেই আছে। গ্রামে মানুষজন না থাকে না-ই থাক, কুয়ো তো আছে, আছে কুয়োয় ধাসাবার দড়ি-বাল্টিন -। বাবার আর বাধা কোথায়! আয় নাকফুঁড়ি আয়! মাকে ফেলে রেখেই যাব ভাবছি জল আনতে, জল আনার পাত্র না পাই গলায় জড়ানো গামছাটাই ভিজিয়ে চব্চবে করে আনব। উঠে দাঁড়ালাম – তাহলে যাই? যাচ্ছি! পরক্ষণেই মনে হলো, না, ন্না! আমার অনুপস্থিতিতে কেউ বা কারা যদি এসে ফের তুলে নিয়ে যায় মাকে? তখন? তারবেলা? ছেড়ে যেতেও ভয়, ছেড়ে যেতেও মায়া! অথচ একটু জল না হলে যে –
একটা ‘গ্যাজর’, তার মানে লাল তেলতেলে বিছা, ওই তো রাস্তার ওপার থেকে ছুটে আসছে এপারে, ঠিক মায়ের দিকেই! অঙ্গভঙ্গি সাপের মতোই, মাঝেমাঝে ফণা তোলার মতো সামনের শুঁড় দুটি তুলছে। হাতে অস্ত্রও নেই যে গ্যাজরটাকে মেরে ফেলব, বাপের হাতের ‘খন্তা’ও তো বাজেয়াপ্ত! অগত্যা গ্যাজরের যাত্রাপথ থেকে মাকে বগলদাবা করে কিছুটা সরিয়ে আনলাম। গ্যাজর র্সর্স করে চলে যাচ্ছে তার মতো। গ্যাজরের জায়গায় এবার একটা সাপও তো আসতে পারে? হ্যাঁ, আসতে পারে বইকি। আঙ্কুড়া-বাঙ্কুড়া ‘লতা’ – সবাই তো জঙ্গলের জীব। যদিও জঙ্গল ছাড়িয়ে আমরা এখন জঙ্গলের শেষ মাথায়, তবু তাদের বিচরণে বাধা কোথায়! সাপ-নিধনের লাঠি বানাতে ডকাগাছের একটা আস্ত ডালকে ভেঙে ফেললাম মড়মড় করে। আর এ সময়ই দূরে-অদূরে কতকগুলো কুকুর ডেকে উঠল একসঙ্গে!
ইস্কুলঘরের সামনে টহলদারি মিলিটারি পুলিশ শূন্যে গুলি ছুড়ল। একজন তো দৌড়ে এলো আমাদের কাছে! আবার কী হাফ- পেন্টুলের পকেটে, অস্থানে-কুস্থানে তারা হাতড়াতে শুরু করবে? তার আগেই আমি আমার হাফ-পেন্টুলের ‘পাকিটে’ হাত রাখলাম। বোন নাকফুঁড়ির গুঁজে দেওয়া ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকা দুটি আছে তো ঠিক! ফেলেই দিয়েছিল পুলিশটা পকেট হাতড়ে আমি আবার কুড়িয়ে জড়ো করে গামছার সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছি। কী শক্ত পোকা দুটির শিংজোড়া! একদম যেন লোহার তার! ‘কৌন হো তুম?’ লম্বা বন্ধুক-হাতে পুলিশ লোকটা জিজ্ঞাসা করল। ভাবলাম বলি, ‘ওই যে ইস্কুলঘরের সামনে বেঞ্চিতে শুয়ে, যাঁর এতক্ষণ ছবি তোলা হচ্ছিল ফটাফট্, যাঁকে তোমরা হয়তো বুদ্ধি করেই বলে বেড়াচ্ছ বেওয়ারিশ ‘লাশ’ – ওই আমার বাবা। আর গুলি খেয়ে লোকটা মারা গেলে তাঁর মৃত্যুতে সেই থেকে অজ্ঞান হয়ে মুখে গাঁজলা তুলে পড়ে আছেন যে – তিনিই আমার মা।’ কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। কারণ মায়ের মুখেই শুনেছি – ‘সবু পরব ত আসে ভালা ঘুরি-ন-ঘুরি যে বাবু হো, মানুষ মরলে নাহি আওয়ে।’ কিংবা – ‘আংটি-ভাঙা পিতল-ভাঙা  সবই জুড়া যায়, মানুষ মরিলে দিদি নাই গ’ জুড়া যায়।’ এ বছরের পূজা-পরব পরের বছর ঠিকই ঘুরে আসে, কিন্তু মানুষ একবার মরে গেলে সে আর ফিরে আসে না। ভাঙা আংটি ভাঙা পিতল-কাঁসা সবই মেরামতি করা যায়। তাবলে মরা-মানুষকে মেরামতি করে ফের বাঁচিয়ে তোলা যায় না। ইস্কুলের সামনে বেঞ্চিতে বরাবরের জন্য যে শুয়ে আছে, তাকে তো আর জাগানো যাবে না, সে আর ‘বাবা’ নয়, সে এখন মড়া, মুর্দা। কাঁহাতক তাকে ‘বাবা’ পরিচয় দিয়ে হুটমুট উটকো বিপদে পড়া! তাই চুপ থাকলাম। ‘হিঁয়া ক্যায়া করতা?’ দেখতেই তো পাচ্ছ, ফের চুপ। মিলিটারি লোকটা নিচু হয়ে মাকে ঘাঁটাঘাঁটি করে বলল, ‘বিমারি হ্যায় ক্যায়া?’ তাও চুপ। তার ভাষা হয়তো বুঝতে পারছি না বলে অন্য কাউকে ডেকে আনতে চলে যাচ্ছিল সে। আর থাকতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠে বললাম, ‘মায়ের জন্য একটু জল দাও না গো!’ এবারে আমার ভাষা ও-ই হয়তো বুঝল না, পা ছাড়িয়ে চলে গেল সদম্ভে। একটু বাদে এলো আরেকজন।
একটু বাদেই কী আর, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। রিঁ-রিঁ-আঁ পোকাও ডাকতে শুরু করেছে। পাশের জঙ্গলে মাঝেমাঝেই পাখ-পাখালি ‘ভদ্কাচ্ছে’। তাহলে, গতরাতের মতো আরেকটা রাত আসছে! মায়ের অবস্থা যে-কে-সেই। অদূরে ইস্কুলঘরের সামনে কাঠের বেঞ্চিতে শোয়া বাবার অবস্থানও যেমনকার তেমন। ‘আচ্ছা ভালা’ কী করবে ওরা বাবার রোগা-প্যাটকা দেহটা নিয়ে? পয়সা খরচা করে পোড়াবে? না, ‘গাড়হা’ করে পুঁতে দেবে মাটিতে? র্ধু! অত কী আর করবে! হয়তো রাতের অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দেবে জঙ্গলে। শিয়াল-শকুনে টানাটানি করে খাবে, কে আর দেখছে! কে কার বাবা, কে কার স্বামী – বেওয়ারিশ মড়া ছাড়া বা কী! একসঙ্গে অনেকগুলো ‘হ্যাজাক’-ধরানো হলো ইস্কুলঘরে। মিলিটারি পুলিশদের একজনা তো এ-লাইট সে-লাইটের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে খালি ‘বাসাত্’ দিচ্ছে! এখান থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ইস্কুলঘরের ভিতর টেবিলের চারধারে বসে ওরা কীসব খাচ্ছে। দেখাদেখি ক্ষিদে পেল আমারও। সে তো পাবেই, সেই কবে কুরথিডালের তরকারি দিয়ে একমুঠ্ ভাত খাওয়া! তাও তো আধ-খাওয়া! মা এখন ক্ষুধা-তেষ্টার বাইরে, আমি তার বুকের ওপর ফের কান পেতে শুনছি – ধুক্পুকানিটা আছে কিনা। ‘ধুক্পুক্-ধুক্পুক্’ – আছে! ‘ধুক্পুক্ ধুক্ পুক্’ – আছে, আছে!! আমি পরম নিশ্চিন্তে মায়ের পাশটিতে শুয়ে এখন ভাবছি – সেই আমাদের গ্রামের উত্তরে মাঝুডুবকার জঙ্গলের ভিতরে ঝাঁটি-বুদা কেটে তৈরি করা ডাহি জমিনে সেবার কুরসির বীজ বুনেছিল যুথিষ্ঠির কুমহার, সবুজ শুঁড় তোলা কুরসি-লতিতে ক্ষেত ভরে গিয়েছিল কানায় কানায়, এমনকি ক্ষেতের চারধারে আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে-চলতে কুরসিলতির শুঁড় এসে দুপায়ে জড়িয়ে যায়। অগত্যা পায়ে মাড়িয়ে দুমড়াতে-মুচড়াতেই যেতে হয়, কারণ ওই তো আমাদের গ্রামে যাবার একমাত্র রাস্তা! ক্ষয়ক্ষতির বহর দেখে আমাকে ডেকে ঝানুচাষি যুধিষ্ঠিরই বলেছিল, ‘বাবু রে, পাহারা দে! তোকে দু-মাণ কুরথির ডাল খাওয়াব!’ রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে কড়া পাহারাও দিয়েছিলাম আমি, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে ওস্তাদ যুধিষ্ঠিরও দু-মাণ কুরথির ডাল দিয়েছিল মাকে। দু-মান অর্থাৎ দু-কুনকে বা দুটোপা। ক্ষেতের কাঁচা ফলও খেয়েছিলাম খুব – দুধ-ভরে-আসা কাঁচা কুরসিরও যে কী স্বাদে! ক্ষুধা-তেষ্টা দুই-ই একসঙ্গে মিটে যায়।
কুরথিডালের দুধ-ভরে-আসা কাঁচা দানা শস্যে এখন ক্ষুধা ও তেষ্টা মেটানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বন্ধুকের বাঁটের গুঁতো খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল চট করে। মায়ের বুকের কাছে উবু হয়ে বসে দুহাঁটুতে থুঁত্নি গুঁজে জুলুজুলু চোখে চেয়ে থাকলাম পুলিশটির দিকে। আমার ও মায়ের শরীরে টর্চের আলো ফেলে হিন্দিতে নয় আমাদের ভাষাতেই বলল, ‘ওঠ!’ আমি বলামাত্র উঠে দাঁড়ালাম। লোকটাও তৎক্ষণাৎ আমার হাফ-পেন্টুলের পকেটে হাতড়ে বের করে আনল সেই গামছার সুতোয় বাঁধা ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকার বান্ডিলটা, জিজ্ঞাসা করল, ‘এসব কী?’ বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, ‘রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা।’ পুলিশটা গর্জন করে উঠল, ‘হোয়াট? রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা – তার মানে?’   শহর-বাজারের মানুষ, হয়তো রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা চেনে না – এখন কী করে তাকে ‘রিঁ-রিঁ-আঁ’ পোকার মানে বোঝাব ভাবছি। কোনো কিছু বিষাক্ত পোকা ভেবে তার আগেই জিনিসটা মাটিতে ফেলে দিয়েছিল লোকটা। অবশ্য খুব দূরেও নয়, আমার পায়ের কাছেই। জ্বলন্ত টিপা-লাইটের আলোয় চট্জলদি কুড়িয়ে এনে ফের পকেটে পুরলাম। আর কী আশ্চর্য, এসময়ই কিনা গাব্গুবিগাছের ঝোপঝাড়ে একসঙ্গে হাজারটা রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা পোঁদ ফেরে ডেকে উঠল  রিঁ-ই-ই-ই রিঁ-ই-ই-ই করে! উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, ‘বাবু গ –  ওই-ওই ডাকছে পোঁদ ফেড়ে রিঁ-রিঁ-আঁ পোকা! আনব ধরে মিলিয়ে দেখবেন।’ ফের গর্জন করে উঠল লোকটা, ‘চো-ও-প! ও তো ঝিঁঝিঁ পোকা।’ মাথা নামিয়ে দুহাতের আঙুল মটকাতে-মটকাতে বললাম, ‘তাহলে তাই, আমরা ত বলি -।’ পুলিশটা বলল, ‘ফের পকেটে পুরলি যে? এ দিয়ে কী করবি?’ বললাম, ‘ওষুধ।’ ‘কার?’ মাকে দেখিয়ে বললাম, ‘আমার মায়ের।’ মায়ের কথায় একটু যেন নরম হলো লোকটা। জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে তোর মায়ের? কই, ডাক তোর মাকে!’ ‘কই, ডাক তোর মাকে’ ‘কই, ডাক তোর মাকে’ – মুহূর্তে ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল মাথাটা! ঠিক একদিন আগে এই রকমই একটা কথায় আমরা ঘর ছেড়েছিলাম। আমাদের বাবা ধুলোপায়ে কোত্থেকে প্রায় দৌড়–তে দৌড়–তে এসে মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত করে বলে বসেছিলেন, ‘এখানে আর একদণ্ডও থাকাটা নিরাপদ নয়, আঁকাড়া বিপদ চারধার থেকে ধেয়ে আসছে ধাঁই-ধাঁই করে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে এক্ষুনি পালাতে হবে। কই, ডাক তোর মাকে!’ বললাম, ‘মায়ের হুঁশ নেই! ডাকলেও আর উঠছে না!’ শশব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়ে মায়ের নাড়ি দেখল লোকটা। আঁতকে উঠে বলল, ‘আরে তাই তো!’ ততক্ষণে আরো চার-পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ – চারদিকেই বন্ধুক তাক করে মহড়া দিতে দিতে আমাদের কাছে এসে গেল। তাদের মধ্যে একজন বলল, ‘মতলব, উহাপেঁ জো মুর্দা আদমি, ইহলোক উসিকা লেড়কা অউর জেনানা আছে।’ কে জানে কী বলল! আমি তো ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কায় ও মায়ের সেই – ‘সবু পরব ভালো ঘুরি ঘুরি আওয়ে মানুষ মরলে নাহি আওয়ে’ – গানের ধুয়ো ধরে মাথা নাড়লাম, না না। বাঙালি পুলিশটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তবে আসছিল কোত্থেকে? যাচ্ছিলই বা কোথায়?’ এখানেও সেই মায়ের বুলি, গিয়েছিলাম কুটুমবাড়ি যাচ্ছি নিজেদের বাড়ি। কিন্তু নিজেদের বাড়ি বলে কোন গ্রামের নাম করব? তেমন নিরাপদ গ্রাম-নামও তো আমার জানা নেই! চটজলদি মুখে এসে গেল বাবার মাসতুতো ভাইয়ের গ্রাম-নামটা। বললাম, ‘যাচ্ছি চিচুড়গোড়িয়া।’ সঙ্গে সঙ্গে একাধিক গলায় আওয়াজ উঠল, ‘উরি ব্বাস! খতরনাক জায়গা! উধর আভি আভি মৎ যা না!’ তখনো আমাদের ফেলে রেখেই চলে গেল পুলিশগুলো।
ফের ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মা তো ঘুমোচ্ছেনই। আসলে না-ঘুমিয়ে আমাদেরই বা আর উপায় কী! অবশেষে, রাত তখন কত হবে কে জানে, বেদম আওয়াজ করে একটা গাড়ি এসে থামল। মাকে ওরা ধরাধরি করে গাড়িতে তুললও। মায়ের পিছু-পিছু গিয়ে গাড়ির ভিতরে উঁকি মেরে দেখছি – বাবাও সাদা কাপড়ে দড়িতে বাঁধাছাদা হয়ে শুয়ে রয়েছেন, মাকেও রাখা হলো পাশাপাশি বাইরে মাটিতে পা রেখে তখনো আমি দাঁড়িয়ে, গাড়ি ছেড়ে দিলো হুট বলতে! চলন্ত গাড়ির পিছনে কাঁদতে-কাঁদতে পড়ি-কি-মরি দৌড়–চ্ছি, আর পুলিশবাবারা হাসছে হো-হো করে! ভুখা-পেটে প্রায় আধ ক্রোশটাক দৌড়েছি, গাড়িটা থামল। ডালা খুলে আমাকেও তুলল। ও, তাহলে এতক্ষণ -! ধাতস্থ হয়ে দেখলাম – না, সব কাঠ-কাঠ মুখ, কেউ একটা কথাও বলছে না! বাবার ঢাকা মায়ের আ-ঢাকা মুখ দেখে যাচ্ছি, দেখতে-দেখতে ভাবছি – এরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ‘জিহলখানা’য়? ‘জিহলখানা’ বা জেলখানাকে বাবার বড্ড ভয় ছিল, মা কিন্তু অকুতোভয়। একসময় তেড়িয়া হয়ে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, ‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? জিহলখানায়?’ কাঠ-কাঠ গুরুগম্ভীর মুখগুলি হেসে ফেলে উত্তর দিলো, ‘না, হাসপাতালখানায়।’