বৈশাখ মাসে লাফ দিয়ে খালটা পার হওয়া যায়, হাঁটুপানি। আসলে এটা কথার কথা, ভাটায় বুকপানি হলেও জোয়ারে একটু বেশিই, ঠাঁইহীন। রাখালগুলি যেমন বিল থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় মাথায় লুঙ্গি পেঁচিয়ে গরু নিয়ে সাঁতার দিতে পারে উলঙ্গ মেটে পাছা ডুবিয়ে ভাসিয়ে কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে, তেমন ভেবেছিল সে, জীবনটা এইভাবেই ঠিক পেরিয়ে যাবে ভাবনা ছাড়াই, ডুবিয়ে ভাসিয়ে তোয়াক্কা কি পরোয়া না করেই। লোকে কী ভাবল সব সময় এত ভাবলে চলে! একটা শরীর আছে না তার, লোকে কি জানে! লোকের তো কাজই অন্যকে নিয়ে ভাবা নিজের ছিদ্র ভুলে! আর তার কাজ জীবনটা পেরিয়ে যাওয়া। আসলে তো পেরিয়ে যেতে চায় না, বুঝল এই পূর্ণিমার রাতে হাড়ে হাড়ে। কার্তিকের চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্নার রহস্যময় আলোয়, এই রহস্য জীবনেও ভেদ হয় না কারো, এ-কথা তো ও জানে না, না হলে এই পানিভরা বিলে ছেঁড়া মেঘ উড়ে বেড়ানো এই কার্তিকে, এই চন্দ্রালোকিত রাতে ভাঙা পুলের ওপর দাঁড়িয়ে মৃত্যু প্রকল্প তার সামনে এগোচ্ছে না কেন! মৃত্যু উপকরণ তার শাড়ির আঁচলে বাঁধা আছে না! গলায় ঢেলে শুয়ে পড়বে, পড়ে যাবে ঝুপ, ভাঙা পুলের ফাঁক গলে। জোয়ারে ভেসে যাবে, যেতে যেতে মেঘনা হয়ে সমুদ্রে গিয়েও পড়তে পারে, আহ্ সমুদ্র! শুনেছে তো সব নদী সমুদ্রে মেশে, লবণে।

 এখন কী হচ্ছে! মাঝরাতে ভূতে ধরে, ধরে ডেউয়ায়, স্বপ্নকেও ধরে ডেউয়ায়, এগোবে না, পেছাবে না, শুধু চারদিকে ঘুরপাক খাবে, খেতে খেতে দিশেহারা হয়ে পথ হারাবে, এটাই ডেউয়া। সে কি এখন ডেউয়ার হাতে! ঘোরে কি বেঘোরে, ঝুরঝুরে কাঠের তক্তার ওপর দাঁড়িয়ে!

হারামজাদার চরের ভূগোলটা একটু বলি, লম্বা একটা গ্রাম মাইলখানেক হবে। মাঝখানে ছেঁড়া বা কাটা। মেঘনার শাখা নদীর একটা খাল এসে গ্রামটাকে দু-ফালা করেছে,

পুবকান্দি-পশ্চিমকান্দি। পুবকান্দির মানুষ নিজের ভাগ্য নির্মাণ করেছিল এর ওপর একখানা কাঠের পুল বানিয়ে ষাটের দশকের প্রথম ভাগে, কেননা পশ্চিমকান্দিতে একটা রাইস মিল বসেছে, এখন সত্তরের শেষভাগে পুরনো জীর্ণ পুলখানা পেরোতে হিম্মত লাগে, জায়গায় জায়গায় তক্তা পচে পড়ে গেছে কিংবা পড়ো পড়ো আর তলার যে খুঁটি ক-খানা আছে কাগড়াবগড়া তাদের দিকে তাকালে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে হৃদয়, এই বুড়া বয়সে এই ভার! বৃদ্ধ কি শিশুর কর্ম নয় পারাপার। কিন্তু সে পেরোয়, সহজেই পেরোতে পারে পুরুষলোকের মতো দুই পা সর্বোচ্চ ফাঁক করে আত্মবিশ^াসের সঙ্গে। মনে করেন, আত্মবিশ^াসই এই সব ভাঙা পুল পেরোনোর একমাত্র মন্ত্র। মাঝখানে পুল ভাঙা বিপজ্জনক, তখনো ভাঙা ছিল, এখনো। ভালো পুলটা যে কে কবে দেখেছে জানা নেই। বাচ্চু চেয়ারম্যান যে হাজার টাকা দিয়েছিল ভোটের আগে, সে-ই কেবল জানে পুলটা একদা নতুন ছিল, চকচকে তক্তা ছিল পাটাতনে, শত্রুতা করে কে বা কারা তক্তা খুলে নিয়ে গেছে কি বদলে দিয়েছে, বুঝুন তাহার জনগণের হালহকিকত! যে যাই বলুক, সেসব হাভাতে লোকের কথা কে গোনে! এইসব হাভাতেকে বাঁচাতে দু-চারটা গরু-ছাগল মিলিটারিদের লঞ্চে না পাঠালে কী হতো সেই কালে, তা কি তারা জানে! মূর্খের দল! এসব আলাপ অন্যত্র।

সে থাকে পশ্চিমকান্দি, তার প্রেমিক থাকে পুবকান্দি। প্রেমিক তো বলছি, কিন্তু আসলে তো মামাতো ভাই।

হতদরিদ্র পিতার ঘরে বৈধব্য নিয়ে চলে যাচ্ছিল খানাখন্দের দুটো আনাজ লতাপাতা সিদ্ধ ভাজি কি ঘরের চালের বিস্তর শিম-লাউ আর ওছায় তোলা ছটকা চিংড়িতে। বিল শুকালে কাঁথার মতো বিছিয়ে থাকা ব্রাহ্মী শাকের সঙ্গে কথা, ওরে কথা! অভাগির পুত, তোরেই মরতে হইল, যার শরীর ভরা তীব্র আকাক্সক্ষা আর আদরে লালচ!

দুই

চাঁদটার সঙ্গে এক টুকরা মেঘ লুকোচুরি খেলছে এই জানাতে যে, সব ভালো আসলে সবটাই ভালো না। এত

আদর-সোহাগে মামাতো ভাইয়ের যে বিবাহটা হয়ে গেল আজকে দুপুরে, তিনখানা নৌকা একটা ছোট লঞ্চ, শহর থেকে আসা আত্মীয়স্বজন নিয়ে গিয়ে, তার ভেতরে সামান্য ফাঁকি কি ভেজাল কি সামান্য বিষ আছে না! সে বিষের কী হবে!

বাতাসে কিছু হাওয়া মিশিয়ে ফুলে উঠেছে এখন চরাচর আর ভাসমান জলজ শ্যাওলাদামের গা-ঘেঁষে শাপলাগুলি প্রস্ফুটনে চাঁদ দেয় উসকানি, এলোমেলো বাতাসে সুগন্ধ বিলাতে মাতোয়ারা হাজার হাজার! শাপলাবিলাসী এই নৌকায় কিশোর-তরুণ-যুবতী শহরগ্রাম মিলিয়ে গোটা ছয়-সাত। এমনকি দুপুরে বিয়ে করে আসা জামাই-বউও এক গলুইয়ে মজুত, বয়স্কদের দৃষ্টি এড়িয়ে এরা উঠেছে বটে নৌকায়, কী সাহস!

রাত দ্বিপ্রহর, বাসর বাদ দিয়ে নৌকায় কেন! এমন প্রশ্ন যুবতীরা করতেই পারে, কিন্তু করে না। ধলপ্রহরে জ¦লজ¦ল করে শাপলা সাদা, শাপলা লাল। প্রস্ফুটিত কি বোজা। বর্ষার কালোজলে হলুদ কি গোলাপি পুষ্পরেণু হাওয়ায় ভাসাচ্ছে মিষ্টি সুবাস, শ্যাওলাদামের আঁশটে গন্ধ সরিয়ে শাপলা তোলা চলছে নরম হাতে, মাথার কাছে নেমে আসা মেঘের ছায়াও পড়ছে এক-আধবার। নৌকা বিল ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে শাখা নদী পানে। মাঝে মাঝে লগির হালকা ছলছলাৎ। ছই বিনে নৌকাটা কি চোখে পড়ে মনোয়ারের, দূরে, অনেকটা দূরে পিঁপড়ার মতো! ওহ্ বলা হয়নি, মনোয়ারা যে সে-ই মনোয়ার, যে দাঁড়িয়ে আছে পুলের ওপর, আঁচলে গিঁট দেওয়া শিশি। ডাকনামের এই প্রচলন এই অঞ্চলে, মনোয়ারা হলো মনোয়ার যেমন ফেরদৌসী হয় ফেরদৌস কি আনোয়ারা হয় আনোয়ার; অবাক বটে, মেয়ে মানুষের এসব নাম!

প্রেমিক হাতছাড়া হলেও হাল তো ছাড়েনি মনোয়ার! ছাড়েনি খবরাখবর রাখা! এখন মন দিয়ে বরং বউটাকেই দেখা যাক। বাড়ি তার ছিঁড়ার চর, এসে পড়েছে হারামজাদার চরে। আহা কী সব নাম তাদের! গ্রামের নামগুলি পাল্টানোর দরকার। দাদা পরদাদারা জমি জরিপকারীদের এমনই নাকানিচুবানি দিয়েছিল গ্রামবাসী যে শেষ পর্যন্ত চরের এই নাম দিয়ে প্রতিশোধ তুলেছে জনমের মতো! মনোয়ারের নানি বলেছিল ছিঁড়ার চরের গল্প, জরিপ করতে এসে দেখে ‘খোলাহাঁড়ি থেকে খোঁচায় খোঁচায় ছিঁড়া রুডি বাইর করে, খাইতে মন্দ না, তে নাম হইল ছিঁড়ার চর। আর হারামজাদার চর! জরিপকারী গো দেওয়া পুরস্কার, রাইগ্যা গিয়া লো, এই নাম হয়রানির পরতিশোধ!’

মনোয়ারার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, বন্ধু-সখীদের সন্তান মাথাতোলা। যা হোক, তারপর বিয়ে হলো, শ^শুরবাড়ি গিয়ে দেখে সতীন ঘরে, শাশুড়ি বলে, বাঁজা মাইয়া মানুষ বড়ো বউ, ও থাকা না থাকা একই। তুমি থাক, আমারে বংশ দেও। বংশ দেবে কী করে! স্বামী তো রূপবতী, প্রথম বউয়ের প্রেমে মজে আছে। কাছেই আসে না! বড়ো বউয়ের রূপের কাছে সে দাসি বটে। অন্তর কাঁদে, জীবন বিষময় হয়ে ওঠে। তারপর স্বামীই মারা গেলে দুই বউ বিধবা বেশে শ^শুরের গোলার ধান শেষ করবে! ভাত খেতে খেতে মাছের মাথার মগজ টান দিয়ে মারা যাওয়া নাকি দুর্লভ মৃত্যু নয়, অথচ শাশুড়ি সন্দেহ নিয়ে তাকায় দুই বউয়ের দিকে, মৃত্যুর জন্য নির্দোষ মাছের মাথা দায়ী হয় কেমনে!

মামাতো ভাই শরিফুলের সঙ্গে বিয়ে হলে সমবয়সীই হতো, কথা দু-একবার উঠলেও তা ছিল অসম্ভব। হতে হতে হয় নাই মনে করে মনোয়ার। শরিফুলের মা হাঘরের মেয়ে নেবে না, তদুপরি সমবয়সী, তদুপরি ভয়ংকর জংলি বিধবা মেয়েমানুষ, তদুপরি স্বামীর মৃত্যুর কারণ অমীমাংসিত। আর এমনি ভাগ্য শরিফুলের মায়ের, মাস ছয়েক আগের মারাত্মক রোগে পড়ে মনোয়ারকেই ডেকে আনে দুটো রেঁধে খাওয়াতে, ছাগল-মুরগি-হাঁস দেখে রাখতে। সপ্তাহ না যেতেই মনোয়ার গিন্নি হয়ে উঠেছে, দরোজায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলে, হুক্কাম্মা একটু ভাতের মাড় দেন চুয়া রানমু। ভাত ফোটে পাহালে টগবগ সুঘ্রাণ। কোমরে হাত রাখে দুর্বিনীত মনোয়ার, মাড় নাই গো যাও, আমরাই চুয়া রানমু! তারপর ভাত হতে হতে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে গাছে উঠে আম পেড়ে চুয়া রান্ধে খুব মজার। এই মেয়ে বউ হলে সর্বনাশ, সব চলে যাবে বাপের ঘরে, হাঘরে। শরিফুল এক বাপের এক পুত, নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এসেছিল একবার কি দুইবার, কলেজও চোখে দেখেছে, পড়তে ইচ্ছা করে নাই। বাপ ছিল মাদ্রাসা শিক্ষক, আলেম মানুষ। ঘরে ভাতের অভাব নাই, বরং যে কেউ নুন-কাঁচামরিচ ডলে এক ডেকচি পান্তা খাওয়ায় বাজি ধরলে মায়ের হাঁড়ি উজাড় করে গ্রামবাসী জড়ো করা তার হবি, অবাক হওয়া, অবাক করা ভালোবাসে। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে তরকারি পছন্দ না হলে। কখনো ডেকচি ধরে উঠানে ফেলে হাঁটা দেয় বিলপানে, এমনি স্বেচ্ছাচার। শেষরাতে মারে বালিহাঁস কি বক, কিন্তু খায় না। যখন গ্রামসুদ্ধ লোক অনাহারী কি একাহারী তখনো তার এই কাণ্ড। আলেম  আর কী বলে, ছয়জন মৃত সন্তানের পর সে। সে এসব করবে না তো করবেটা কে! প্রতিবেশীদের তোয়াজে কি উসকানি উচ্চারণ!

– শরিফুল ভাই ভাবিরে ফুল দেও।

পুলের ওপর দাঁড়িয়ে মনোয়ার গলুইয়ে বসা শরিফুলের বউকে দেখে। মুখ ঘুরিয়ে ছায়া পড়া মুখটা কেমন! কিছু বোঝা যায় না। লাজুক না বেলেহাজ। রূপবতী নাকি তার মতো একহারা রূপহীন নারী!

ঠিক মনোয়ার বেলেহাজ, মামি বলেছে। গায়ে কাপড় রাখতেও শিখায় নাই মায়ে! ঢক ভালা হইলে না জানি কি করতি!

– শরিফুল বউরে ফুল দেও। এবার মনোয়ার যেন বলে ওঠে।

– শাপলা একটা দেওয়ার ফুল! শরিফুল দাঁত বের করে বলে। – ও আচ্ছা, ওর দাঁতগুলি একটু উঁচু নাকি তোমার মতো! বউ পছন্দ হয় নাই তোমার!

– ভাঙা পুলে খাড়ায় কী করছ!

– মরণরে জরিপ করি, হারামজাদার মরণ!

– মর!

নৌকা চলে মন্থর, চলতে চলতে ধান ক্ষেতে ঢুকে পড়লে মুহূর্তে চমকে ওঠে সবাই লেজ দাবড়ানো তীব্র আলোড়নে, মবিন চিৎকার করে, ভাইজু বড়ো মাছ নড়ে, নৌকা আগান, ধরুম! শালায় ঢুকছে, বাইরাইতে পারে নাই! 

কার্তিকের বিল বুঝি, ডগা থেকে কেটে নিয়েছে সামান্য ধান। চিটা ভাসে কালো পানিতে। ধানের নাড়া পানিতে ডুবে ভাসে বৈঠার লগির আলোড়নে, হালকা ঢেউয়ের তালে।

আর্তচিৎকার মবিনের বোন বেদানার, খবরদার, মাছ না ডেউয়া, ভূতের কাম। নামলেই ঘেডি ভাইঙা দিব রে ভাই! মাছের ভং ধইরা ক্ষেত লাড়ে।

কিশোর মবিনের জামা খামচে ধরে রাখলে আর নামে কেমনে!  নৌকা নদী পার হয়ে চলে এসেছে কতটা কিছুই টের পায়নি তারা।

– নৌকা ঘুরাও, খোঁজ করা শুরু করবো কিন্তু!

বেদানা আকুতি জানালে কি! কিশোর অনুরোধ করেই চলে বিগলিত গলায়, একটু আগাও ভাই না ভালা, মাছটা ধরি, বড়ো মাছ!

– শিউর এইডাও ডেউয়ার কাম, নৌকা আউলাইছে, এহন আবার ধরছে মাছের ভং!

নৌকা ঘুরায়, বৈঠা বায় কেউ, ঝপাৎ করে লগি পড়ে, কোথা থেকে কোথা যায়, গ্রাম চোখে পড়ে না, ডেউয়াই ধরছে শিউর! এদিকে উতল হাওয়া আর উকুন বাছা আলোয় ভেসে যাচ্ছে জলজ চারপাশ। পথহারা ভয়ে ধুকপুক!

পুলের ওপর থেকে মনোয়ার দেখে নৌকা আরো দূরে চলে যাচ্ছে চাঁদের দিকে মুখ করে। শরিফুলের না বাসর আজকে, তো! সকাল যদি হয়ে যায়! যাউক!

– ও শরিফুল তোমার না আইজ বাসর রাইত, ছিঁড়ার চরের মাইয়ার লগে বাসর!

– তোর এত চিন্তা কিয়ের!

– ডেউয়া ধরছে, বুঝছ না!

– ধরুক, সাতজনরে কিছু করতে পারতো না! তুই চুপ যা!

– নৌকা ছাইড়া সাঁতড়ায় আইয়া পড়ো পুলের নিচে, আমি লাফ দিতাছি।

– দে লাফ, খাল ভরা পানি, সমস্যা নাই।    

– নাই! কেন নাই! তুমি তো সব জানো, কও, কও না!

– আমি জানি না, মায় জানে। আমি তোর ভাই লাগি, মামাতো ভাই!

– তয়!

– তয় তুই মর!

– পুলডা মড়মড় করে! কবে না ভাইঙা পড়ে!

– তুই মর!

– আইজকা হেয় লড়ছে, বিয়ান বেলায় আমার ঘুম ভাঙাইছে লইড়া।

– কে লড়ছে!

– আমাগো হেয়, তোমার আমার হেয়, পাঁচ মাসে পড়ছে!

– ওষুধ না খাইছস! কইলি নষ্ট হইয়া গেছে!

– উহু! খাই নাই, মায়া লাগে!

ডেউয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে তারা একসময় মেঘনায় গিয়ে পড়ে, ঢেউ দেখে ঠাহর হয় বড়ো নদী।

তারপর শেষ রাতে চাঁদ ঢলে পড়লে ডেউয়া ছাড়ে, নতুন বাড়ির টিনের টুয়ায় আলো পড়ে ঝলমলিয়ে ওঠে। মবিন সেই থেকে চুপ ছিল, ডেউয়ার কারবারে তার বেশ ভালোই লেগেছে, কেমন মাছ ধরতে দেও নাই, এইবার বুঝ!

শাখা নদী ছেড়ে নৌকা খালে এসে পড়ে। ভাঙা পুলের নিচে বালু বালু তটে নৌকা ভিড়লে হুড়মুড়িয়ে সবাই নামে।

– মবিন তোর ভাবিরে ঘরে নিয়া যা তো ভাই, আমি একটু আইতেছি।

– চাচি খোঁজ নিলে!

– কইছ পশ্চিমকান্দি গেছি, কাম আছে।

তিন

পুবকান্দির মানুষের আক্কেলখানা দেখ, সকালবেলায় আসছে বউ দেখতে। জানে কিন্তু শরিফুল বাড়িতে নাই, মরা বাড়িতে গেছে। বাকি গল্পটাও তারা জানে খুব ভালোভাবে, একটু বেশিই জানে, পাঁচ মাসের পেটেরটাকে তারা ছয় মাস, সাত মাস, নানান বয়সী বানায়, বেচারা

পৃথিবী-না-দেখা বাচ্চাটা! মনোয়ারের ব্রাহ্মী শাকের ঘণ্টকে কি ক্ষুদিরাকাঁটার শাকে টাকি মাছ দিয়ে ভর্তাকে জগদ্বিখ্যাত করে তোলে কেউ কেউ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার প্রতি কাউকে সদয় হতে দেখা যায় না। তার বেঁচে থাকাটা খুব ঝঞ্ঝাটের হতো, এটাই আসল কথা।

শরিফুল আর কী বলবে, তার বাসর একদিন পেছানো ছাড়া তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, শরিফুলের মা মনে মনে এইটুকু ক্ষতি মেনে আলহাদুলিল্লাহ বলে মনোয়ার অধ্যায় শেষ করে।

শেষ বলে তো কিছু নাই, যেখানে শেষ সেখানেই আবার শুরু। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে এসে একটা কংক্রিটের ব্রিজ আমরা দেখতে পাই, নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান কতটা পয়সা খেল সেসব এখন খুবই গৌণ বটে। আমাদের গল্পের শরিফুল বিবাহিত জীবনের এই বিশটা বছর ভুলেও ওই ভাঙা পুলে ওঠে নাই। পশ্চিমকান্দি যেতে হলে সে একটা নৌকার খোঁজ নিয়েছে পারাপারে। নৌকায় যেতে কি খালে গোসল করতে কখনো মাথা উঁচিয়ে দৃষ্টিসীমায় আনেনি ভাঙা কাঠের পুলটাকে। এমন নয় যে লোকজন পুলটাকে ব্যবহারের অনুপযোগী ভেবে বর্জন করে খাল পার হয়েছে। টুকটাক সারিয়ে সাহসের সঙ্গে কাঠের পুল ব্যবহার করা বর্ষীয়ান লোকজনের মনে মনোয়ার উঁকিটুকি মারে বইকি। তারও বিশ বছর পর, কাঠের পুল থেকে কংক্রিটের ব্রিজ হয়ে-ওঠা ব্রিজটার ওপর দিয়ে অটো চলে মানুষবোঝাই। ফজর নামাজ অন্তে প্রাতঃভ্রমণে ব্রিজের ওপর নাতির আঙুলে হাত রেখে সত্তর ছোঁয়া সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান শরিফুল। জোয়ারের বেলা পানিতে টইটুম্বর খাল, একহারা অসুন্দর এক নারী বয়ে চলে নিরবধি। শরিফুলের কি সেসব মনে রাখলে চলে! জনগণ মনে রাখে এবং এই রকম গুণবান পুরুষলোককেই সমর্থন করে।