ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ পাঠক্রমের রাজনীতি : জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ

বঙ্গভূমিতে উচ্চতর শিক্ষার সূচনা মূলত উনিশ শতকের মাঝামাঝি। উনিশ শতকে কলকাতাসহ কয়েকটি বড় শহরে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ স্থাপন এবং শতকের মাঝামাঝি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরপ্রতিষ্ঠা (১৮৫৭) বঙ্গে জ্ঞান   চর্চাকে এক নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণ করে। শুধু বঙ্গ নয়, আফগানিস্তান থেকে বার্মা পর্যন্ত সমস্ত উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের কর্তা ছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভারত বর্ষে তথা বঙ্গে একটি দেশীয় মধ্যবিত্ত-সমাজ সৃষ্টির চেষ্টা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। লর্ড মেকলের ভাষ্যে এর মাধ্যমে তারা ভারতীয় রক্ত-মাংসে রশরীরে ইংরেজ-ভাবনার মানুষ তৈরি করতে চেয়েছিল। দীর্ঘ সময় তারা এর সুফলও পেয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি-সমাজই উরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির মোহে একটু বেশিমাত্রাতেই আবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। কবি ঈশ্বরগুপ্ত একেই ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, নিজ দেশের ঠাকুর ছেড়ে বিদেশি কুকুরের স্তব চলছে।

তবে দ্রুতই এর একটি বিপরীত স্রোত গড়ে ওঠে। ইউরোপের স্বদেশবোধ, মানবমর্যাদা ও স্বাধিকারের চেতনা ভারতীয় শিক্ষিত সমাজে প্রসারিত হয়। স্বদেশপ্রেম তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয় জাতীয়তাবোধ ও দেশীয় ঐতিহ্যের দিকে। স্বাধীন ভারতবর্ষের চেতনা এরই ধারাবাহিক পরিণতি।

উনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় স্বাধীনতা চেতনার বিকাশধারার মূলকেন্দ্র ছিল বঙ্গ। বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) মাধ্যমে একে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস এ-প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গ-রদ হয় মাত্র সাত বছরের মাথায়। এতে বঙ্গের মুসলমানদের একটা বড় অংশ অসন্তুষ্ট হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। বঙ্গভঙ্গ-রদের দশকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা ছিল তাই royal compensation। কয়েক বছরের চেষ্টায় ১৯২১ সালে শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পাঠক্রমে যে বিবর্তন, তার প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য সন্ধান তাই অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

যে-বারোটি বিভাগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে ‘সংস্কৃত ও বাংলাবিভাগ’ তার একটি। সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে তিন বছরের অনার্স পর্যায়ে দুটি ধারায় পাঠদান করা হতো- (১) সংস্কৃত-বিদ্যা (Sanskritic Studies) এবং সংস্কৃত-বাংলা (Sanskrit-Bengali)। এই দ্বিতীয় ধারাতেই মূলত বাংলাবিদ্যার চর্চা। এই দুটি ধারায় পাঠদানেরও একটি পটভূমি ছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কার্যত একটি সংস্কৃত বিভাগ ও একটি সংস্কৃত-বাংলা বিভাগ প্রস্তাব করেছিল। দুটি ধারায় সংস্কৃত ও বাংলাশিক্ষাদান এরই একটি আপস।

১৯২১ সালে প্রণীত বাংলা পাঠক্রমের আটটি পত্রের মধ্যে পাঁচটি ছিল সংস্কৃত; বাকি তিনটি ছিল অবিমিশ্র বাংলার। এগুলো হচ্ছে History of Bengali Literature (৫ম পত্র); Old Bengali Poetry (৬ষ্ঠ পত্র) এবং Bengali Literature from 1850 to the Present (৭ম পত্র)। সংস্কৃত-বাংলার এই মিশ্রণের মধ্যে সংস্কৃতের প্রতি ঝোঁকটা সে-সময়ের উচ্চশিক্ষার পাঠক্রমের প্রভাবেই ঘটেছিল। তবে এর মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাবেরও পরিচয় আছে। মনে রাখতে হবে, ওই দশকেই ভারতবর্ষজুড়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। বঙ্গেও এই দাঙ্গা বীভৎস রূপ নিয়েছিল তার মধ্যেও সংস্কৃত-বাংলার অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা মনে রেখেছিলেন পাঠক্রম-প্রণেতারা।

মাত্র তিনটি পত্রের মধ্যে বাংলা পাঠক্রম তৈরি করতে গিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চমক সৃষ্টি করেছিল। মুহম্মদ শহীদুল্লা হ্শুরু থেকেই (১৯২১) চর্যাপদকে Old Bengali Poetry-র অন্তর্ভুক্ত করেন। অনেক পরে (১৯৬৩) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন (ভাষা সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০) :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর থেকে প্রাচীন বাংলা পঠন-পাঠন আরম্ভ হয়। তখন আমি এই বিভাগের একমাত্র বাংলার শিক্ষক ছিলাম। অন্য শিক্ষক গণসংস্কৃত পড়াতেন। সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মহাশয় আমার উপর বাংলা পাঠ্যবিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের তালিকা প্রস্তুতের ভার দেন।

আমি বাংলা অনার্স শ্রেণীর জন্য প্রাচীন বাংলা পাঠ্য বিষয় নির্দেশ করি আর তার জন্য- ‘বৌদ্ধগান’ পাঠ্য স্থির করি। শাস্ত্রী মহাশয় আমার প্রস্তাব শুনে বললেন- এ পড়াবে কে?

আমি বললাম, ‘আজ্ঞে, আমি পড়াব।’

তিনি বললেন, ‘তুমি পড়াতে পারবে?’

আমি বললাম, ‘আপনার আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয়ই আমি পারবো।’

তাতে তিনি খুশী হয়ে বললেন, ‘বাহ, বেশ।’

স্পষ্টত, তখন পর্যন্ত বাংলাভাষী অঞ্চলের প্রধান উচ্চশিক্ষা পীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্যাপদ পাঠ্য হয়নি। ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় লেখা-হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই দাবি কলকাতার পণ্ডিতরা তখনো স্বীকার করেননি। চর্যাপদ ছিল বৌদ্ধ ঐতিহ্যের। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবও হয়তো অবচেতন মনে কিছুটা কাজ করেছে। পরে এর অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বর্তমানে বাংলাভাষী অঞ্চলের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্যাপদের যে পাঠ ও চর্চা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অগ্রপথিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত-বাংলা পাঠক্রমের Old Bengali Poetry পত্রে চর্যাপদ ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ-সম্পাদিত শেখ ফয়জুল্লার গোরক্ষ বিজয় পাঠ্য ছিল। এ-সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনডিয়ান ভার্নাকুলারস’-এর বাংলার এম এ পর্যায়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যে পাঠ্যছিল (১৯২০) ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব সাহিত্যেরও পর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রাচীন যুগ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, দীনেশচন্দ্রসেন-সম্পাদিত বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, ময়নামতীর গান এবং মুকুন্দ রামের চণ্ডীমঙ্গল। এই দুই পাঠক্রমের তুলনা করলে স্পষ্টই ঢাকার পাঠক্রম ছিল অনেক উদারপন্থী, নইলে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ পাঠ্য হতো না। অন্যদিকে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবভাবনার রাধা কৃষ্ণের চেয়ে দেশীয় রাধা-কৃষ্ণের কাহিনি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ঢাকার পাঠক্রমে গুরুত্ব লাভ করেছিল। নাথ সাহিত্য অবশ্য উভয় বিশ্ববিদ্যালয়েইপাঠ্যছিল-ঢাকায় গোরক্ষ বিজয়, কলকাতায় ময়নামতীর গান। আমরা আগেও উল্লেখ করেছি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ-রদের ফলে পদ্মা-যমুনার পূর্বতীরবর্তী বাঙালি মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে। তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা ‘বিভক্ত করে শাসনকরো’ নীতিতে এসব কার্যকলাপ পরিচালনা করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে এর শিক্ষক সমাজ ও পাঠক্রমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। এ-প্রসঙ্গে সাঈদ-উর-রহমানের নিম্নোক্ত মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য (সাহিত্যপত্রিকা, ৩৮ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা) –

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষাবিভাগের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় দাবি করা হয়েছে যে, তাদের পাঠক্রমের আদর্শেই ঢাকারটি প্রণীত হয়েছিল। সেটা এই অর্থে সত্য যে, প্রথম যুগের দুজন শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে ঢাকায় যোগ দিয়েছিলেন; এবং কলিকাতার সিলেবাসের সীমাবদ্ধতা মনে রেখে ঢাকার সিলেবাস পূর্ণাঙ্গ ও প্রাগ্রসর করায় আগ্রহী ছিলেন।

১৯২৮ সালে সিলেবাসের পরিবর্তন কালে সংস্কৃতের চেয়ে বাংলার কোর্স বাড়ানো হয়। রামায়ণবাদ পড়ে; যুক্ত হয় মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, মানিক গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গল ও সতীশচন্দ্ররায়-সম্পাদিত অপ্রকাশিত পদরত্নাবলী।

১৯৩৭ সালে সংস্কৃত বিভাগ থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগে প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাঠদানের সুযোগ আরো বাড়ে। পুরনো পাঠগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈষ্ণব পদাবলী, শূন্যপুরাণ, ঘনরামের ধর্মমঙ্গল ও কালিকামঙ্গল। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাবিভাগের পাঠক্রমে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল।

চরম সাম্প্রদায়িক হানাহানির মধ্যে ১৯৪৭ সালে ঘটে ভারত ও বঙ্গবিভাগ। তবে বাংলার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে যে সেই সময় থেকেই সচেতন ছিলেন, তার প্রমাণ ১৯৪৮-৪৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েবাংলায়ও উত্তর  লেখার বিধান চালু হয়। স্মর্তব্যযে, এই পর্বেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন তখনই বেগবান হচ্ছিল এবং বাংলার প্রবীণতম শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এতে সামনের সারিতে ছিলেন। অন্যদিকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিতপাঠগুলোবর্জনের জন্য চাপ আসে নব্য-উৎসাহী মুসলমান লেখকদের দিক থেকে। এ প্রসঙ্গে সাঈদ-উর-রহমানলিখছেন (পূর্বোক্ত) :

পাঠ্যবিষয়ে আরো পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে চাপ আসছিল। আন্তরিকভাবেওঅনেকেপরিবর্তনকামনাকরতেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করারমতো। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন লেকচারার আবুল ফজল ড. মুহম্মদশহীদুল্লাহ্কে (তিনি তখন পুনরায় বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন) ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখে অনুরোধকরেছিলেনমুসলমানদেরআবেগ, ধারণা ও রুচিকে আহত করে যেসব রচনাসেগুলিকে পরিহারকরেমুসলমান লেখকদের রচনাপাঠ্যতালিকা ভুক্ত করার জন্য। ‘তাহলেই পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে রচিত হবে সংগতি আরমুসলমানদের নিজস্ব সাংস্কৃতিকচেতনাপাবেকিছুটাতৃপ্তি।’ চিঠি লেখার পরও কোনোসুফল না হওয়ায়তিনিঅধ্যাপকসিরাজুলইসলাম ছদ্মনামে জিন্দেগী পত্রিকায় সেই বক্তব্য সংবলিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি অনূদিত হয়ে মুদ্রিত হয় করাচী থেকে প্রকাশিত ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মুখপাত্র দি ডন পত্রিকায় এবং কড়া সমালোচনামূলকপ্রবন্ধও লেখা হয় এর সমর্থনে। আবুল ফজল বলেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় এরপর কিছু রদবদল শুরু হলো। আপত্তিকর লেখাগুলো ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত হলো আর স্থান দেয়া হলো কায়কোবাদ, নজরুল ইসলাম, শাহাদতহোসেন ও জসীমউদ্দীনকে।’ ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে The syllabuses are being adjusted to the new set up.

কিন্তু ১৯৫০-৫১ সালেরপাঠক্রমবিবেচনাকরলেদেখাযায়যে, চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী ও চণ্ডীমঙ্গল এর অন্তর্ভুক্তরয়েছে। মধ্যযুগের নতুন পাঠের মধ্যে যুক্ত হয়েছে আলাওলের পদ্মাবতী ও সৈয়দ হামজার মধুমালতী। শেষোক্ত গ্রন্থদুটি মুসলমানলেখক-রচিতহলেওতাছিলসাম্প্রদায়িকবিদ্বেষেরঊর্ধ্বে।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি ‘তাহজীব-তমুদ্দুনে’র চাপ বাংলা পাঠক্রমে নতুন সংকট সৃষ্টি করে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর কলকাতা থেকে বই আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষাথেকে ‘হিন্দুয়ানি’ দূর করা। কিন্তু মুহম্মদ আবদুল হাইর নেতৃত্বে বাংলা বিভাগ মধ্যযুগের কাব্য পড়ানো অব্যাহত রাখার জন্য এক সাহসী কৌশল অবলম্বন করে। গ্রন্থগুলো ঢাকায় বাংলা বিভাগের শিক্ষকরা নতুন করেসম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পড়ানো হয় বড়ুচণ্ডীদাসের কাব্য, ‘বৈষ্ণবপদাবলী’ মধ্যযুগেরগীতিকবিতা, ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কালকেতু উপাখ্যান ও ‘অন্নদামঙ্গল’ মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান-এর মোড়কে। উল্লেখ্য, চর্যাগীতিকা বৌদ্ধঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বৌদ্ধ প্রধান চিনের মৈত্রীর ফলে এর নাম বদলাতে হয়নি। এভাবে বাংলা বিভাগে মধ্যযুগের কাব্যপাঠ অব্যাহত থাকে যেগুলিকেতৎকালীনশাসকচক্র ‘হিন্দুয়ানি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এটাকে বাঙালির সাংস্কৃতিকপ্রতিরোধের একটা বড় প্রচেষ্টা বললে ভুল হবে না। জানা যায় যে, এ-পর্বে বাংলা বিভাগে ‘হিন্দুয়ানি’ পাঠ বন্ধ করারজন্য সে-সময়ে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান বিভাগীয় প্রধান মুহম্মদ আবদুলহাইকেগভর্নর হাউজে ডেকে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তাঁকে রবীন্দ্রসংগীত লেখার জন্যব লেছিলেন বলেওশোনাযায়। প্রসঙ্গত, এ-সময়ে বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এর প্রতিবাদে বাংলাবিভাগের শিক্ষকরাই সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন। বিভাগের পাঠক্রমেরবীন্দ্রনাথকেওবাদদেওয়ারকথাওবলছিলেনকেউকেউ। কিন্তুরবীন্দ্র পাঠ তাতে হ্রাসপায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত বাংলাবিভাগ বাংলাদেশনামকস্বাধীন-সার্বভৌমরাষ্ট্রনির্মাণেজাতীয়তাবাদী-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেনে তৃত্ব দিয়েছে। উচ্চকণ্ঠ রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা অপ্রাসঙ্গিক পদ-পদবিরমোহে আবিষ্ট না হয়েও আপসহীনভাবে বাঙালির চিরায়ত সাহিত্য এবং একইসঙ্গে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পতাকাকেসমুন্নতরেখেছে। ভারত-বিভাগপূর্বকালে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে সংস্কৃতের প্রবল প্রভাবের মধ্যেও পাঠক্রমে বাংলার চিরায়ত পাঠগুলোকে স্থান দিয়েছিল বাংলা বিভাগ। আবার পুরো পাকিস্তান-পর্বে সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঠগুলো বর্জন করতে অস্বীকার করেছে। ষাটের দশকে রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জনের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের নেতৃত্বে। বাংলাবিভাগের পাঠক্রমেও এর প্রকাশছিল প্রত্যক্ষ। আমাদের জাতীয়তাবাদী বিকাশে এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবদান তাইস্মরণীয় হয়ে থাকবে।