তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

আবুল হাসনাত সাহেবের আকস্মিক প্রয়াণ অতি শোকাবহ শূন্যতা।

তাঁকে যতখানি চেনার সৌভাগ্য হয়েছে তার সবটাই কালি ও কলম পত্রিকা সূত্রে। বাংলা সাহিত্য বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ হাসনাত সাহেব তাঁর সূক্ষ্ম সুন্দর রুচি এবং শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে আপন গভীরতার চিরস্বাক্ষর রেখেছেন এই পত্রিকাটিতে।

প্রথমবার, বেশ কয়েক বছর আগে, পত্রিকাটি কলকাতার পাঠকের হাতে যখন পৌঁছয়, তাঁরা তৃপ্ত হয়েছিলেন। অনেকেই ছিলেন কালি ও কলমের নিয়মিত গ্রাহক। এই মুগ্ধতা আজ পর্যন্ত এতটুকু হ্রাস পায়নি। আবুল হাসনাত নিজ দায়িত্বে পত্রিকার মান ও মর্যাদা দুই-ই উচ্চ রাখতে সমর্থ ছিলেন।

পত্রিকা সম্পাদন ও প্রকাশ এক দলবদ্ধ প্রয়াস; কিন্তু এ নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না যে, দলের সাফল্য ও গৌরবের কাণ্ডারি তাঁর নেতৃত্ব। দেশ হোক বা ক্রিকেট দল, পত্রিকা সম্পাদনা হোক বা নাটক মঞ্চস্থ করা, দলের মূল ধ্বজাধারীর প্রতি সকল দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়।

সাহিত্য বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এবং সম্পাদনায় পারদর্শিতার বাইরেকার যিনি নিখাদ বাঙালি, তাঁর সেই অস্তিত্বও ছিল শিল্পসুষমাময়। তাঁর আচরণে, বচনে, ভাষণ ও সম্বোধনে সদাই একজন সুরুচিসম্পন্ন, বিনীত, হাস্যময় ও শান্ত ব্যক্তিত্ব অবস্থান করত। তাঁর সঙ্গে আমার বেশি কথালাপ ফোনে। ভৌগোলিক সীমানার অর্থহীন ও নিরবয়ব শাসন আর যাই পারুক, অন্তরের সৌন্দর্য যার আয়ত্তে, তাঁকে হৃদয়ে-মনে পরাভূত করতে পারে না। হাসনাত সাহেবের সেই হৃদয় আমি প্রথম আলাপে অনুভব করতে পেরেছিলাম। সে ছিল এক আশ্চর্য সন্ধ্যা। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি এলেন কলকাতার বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ফ্লুরিসে। পার্ক স্ট্রিটের এই প্রিয় রেস্তোরাঁ আমার, গুণী ব্যক্তিবর্গের সেখানে নিত্য আনাগোনা। হাসনাত সাহেব সেখানে পদার্পণ করলেন। চা খেতে খেতে নানাবিধ মনোগ্রাহী আলোচনা চলতে লাগল। অধিকাংশ পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চা নিয়ে। কালি ও কলমে অনিয়মিতভাবে আমি লিখেছি ততদিনে, তিনি বললেন, উপন্যাস লিখতে। আমি সে-অনুরোধ শিরোধার্য করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই তামিল করতে পেরেছি তা নয়। তিনি আমার সেই দীর্ঘসূত্রতা বারংবার ক্ষমা করেছেন।

সেই সন্ধ্যায় আমি স্বোচ্ছ্বাসে তাঁকে বলেছিলাম আমার সেই ঢাকা পরগনাস্থ গ্রামের কথা, আমাদের পরিবারে যাকে সম্বোধন করা হতো ‘দেশের বাড়ি’ বলে। ঠাকুমা ও দিদিমা, উভয় তরফেই কত না গল্প শুনেছি সেখানকার। কথার ভেতর দিয়ে তাঁরা আমার মনের ভেতরে দেশ সম্পর্কে প্রগাঢ় আবেগ ও অনুভূতি নিবিড় করে দিয়েছেন। তাই বাংলাদেশের কোনো যোগসূত্র পেলেই আমি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি, নিরুচ্চার আত্মীয়তা সূত্র তৈরি হয় মনে। আমি বুঝি, মানুষ মাঝে মাঝে একাধিক দেশানুভূতি বয়ে নিয়ে চলে, তার ঝুলিতে লুকানো থাকে বহুতর মাটির পুঁটলি।

আমাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সাক্ষাতেও বড় আনন্দ পেয়েছি আমি। সেই আনন্দ আমার চিরকালের। তাঁর প্রয়াণে আমার যে-বেদনা, তাও সহজে যাওয়ার নয়। তাঁর পরিচিত সকলেই এ-কথাই বলবেন অনুমান করি।

জীবনেই হোক, বা প্রয়াণে, শ্রদ্ধার সম্পর্ক অমর। আবুল হাসনাত মহাশয়ের প্রতি আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি।