হাসনাত সাহেব – নীরব অথচ বাঙ্ময়

এই লেখা যখন লিখছি, আবুল হাসনাত সাহেবের সেই নীরব অথচ বাঙ্ময় মুখটি মনে পড়ছে।

এই মুখই তো আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল সিলেটে, যখন যোগ দিতে গিয়েছিলাম কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলনে। সাল ২০১৭। ওই উৎসবের আর একটি নাম ছিল বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছিলাম,তাদের রাখা হয়েছিল হোটেল রোজ ভিউতে।

হোটেলের লবিতে হাসনাত সাহেব চুপচাপ বসে ছিলেন, পাঁচজনের একজন হয়ে। আমরা পৌঁছতেই উনি এগিয়ে এসে আদাব জানিয়ে অতিথিদের থাকবার ব্যবস্থা পরিচালনা করতে শুরু করলেন। ওঁর নিপুণ ব্যবস্থাপনায় সবকিছু দ্রুত মিটে গেল। তার আগে ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে একাধিকবার। এইবার মুখোমুখি আলাপ। টেলিফোনে যে-ধারণা হয়েছিল ওঁর সম্বন্ধে, মুখোমুখিতে দেখলাম তেমন কিছু প্রভেদ নেই। তেমনই শান্ত, মিতভাষী, প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক সম্পাদক।

কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেদের সৃজনকে শমীবৃক্ষে গোপন রেখে, সম্পাদকের বেশে (ছদ্মবেশে?) অন্যের প্রতিভাকে লালন করে থাকেন, নতুন অঙ্কুরের সন্ধান পেলেই তাকে রোদ-জল-হাওয়ার সেচনে মহীরুহ করে তোলার কর্মে লেগে পড়েন। কিন্তু কোনো একদিন, যখন কোনো জরুরি অবস্থায় প্রকাশিত হয় শমীবৃক্ষের সেই লুকোনো সঞ্চয়, অবাক হয়ে যেতে হয় এইসব আয়ুধের বৈচিত্র্যে এবং বিশালত্বে।

এমনই অবাক হয়েছিলাম যেদিন জেনেছি কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত আদতে কবি এবং সাংবাদিক। আবার তিনি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লেখেন। যার সূত্রপাত ষাটের দশকে। ষাটের সচেতন কবিদের মতোই তাঁর কবিতাতেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সংগ্রামের জলছবি! ষাটের অনেক কবির মতোই তাঁর কবিতার চরণে অনুচ্চার রোমান্টিকতা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রাপ্তির উদ্বেলতা, অপ্রাপ্তির বিধুরতাও তাঁর কাব্যে নিবিড়। তাঁর সাহিত্যকৃতি হেলাফেলার নয়। কাব্যগ্রন্থ চারটি জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল এবং নির্বাচিত কবিতা। প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা দুই সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর অন্যান্য এবং জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন অন্যান্য। শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত গ্রন্থ লিখেছেন সাতটি ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুর, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা, জসীমউদ্দীন, চার্লি চ্যাপলিন এবং সূর্য সেন। আত্মজীবনীমূলক রচনাতেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। দুটি বই মনে রাখবার মতো প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য এবং হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে কত যে বই!

১৯৮২ সালে টুকু সমুদ্রের গল্পের জন্য পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। ২০১৪ সালে পেয়েছেন আর একটি উল্লেখযোগ্য সম্মান বাংলা একাডেমির ফেলো। প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য পেয়েছে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২০।

বাংলাদেশের নামি দৈনিক পত্রিকা সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী প্রায় সিকি শতক ধরে সম্পাদনা করেছেন। বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের কোষগ্রন্থ হয়ে উঠেছিল এই সাময়িকী। পাওয়া যেত হালফিলের সাহিত্যের নানান খবর, পরিচয় ঘটত নতুন লেখকদের সঙ্গে। নতুন লেখক খুঁজে এনে তাকে দিয়ে লেখানোর অলিখিত দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাসনাত সাহেব। এই ধারাই উনি বজায় রেখেছিলেন কালি ও কলম এবং চিত্রকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক শিল্প ও শিল্পী সম্পাদনা করতে এসেও। শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামানের আহ্বানে কালি ও কলমে আমি গল্প লিখেছি একাধিক। হাসনাত সাহেব আমায় দিয়ে কালি ও কলমে লিখিয়েছিলেন নভেলা শেষ বিকেলের আলো। এই তো গত বছরেই লিখেছিলাম, ষষ্ঠদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়, ফাল্গুন ১৪২৫। এই তো সেদিনের কথা। ভাবতেই পারছি না উনি নেই! যথারীতি এবারও লেখা দিতে দেরি করলাম। এই লেখা যখন লিখছি, উনি নেই, কিন্তু ওঁর সেই নীরব অথচ বাঙ্ময় মুখাবয়ব চোখে ভাসছে। কানে বাজছে সস্নেহ তিরস্কার দেরি করলে যে যথাসময়ে কাগজ বের করতে অসুবিধা হয়, এইটা তো মনে রাখতে হবে, তাই না? আমাকে এমন কথা কথা বলার মানুষ আর কেউ রইল না। হাসনাত সাহেব, আমার শ্রদ্ধা জানবেন।