আবুল হাসনাত : বিপ্রতীপ নির্জনতার কবি

তখন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে কবিতা ছাপা ছিল সম্মানের। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাস। সংবাদে কবিতা দেওয়ার জন্য আমি আর কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন পুরনো ঢাকার সংবাদ অফিসে গেলাম। হাসনাতভাইয়ের কাছে গেছি শুনতেই অভ্যর্থনায় বসা লোকটি হাসনাতভাইকে ইন্টারকমে জানালেন আমাদের কথা। হাসনাতভাই নেমে এলেন দোতলা থেকে। বেশি কথা বললেন না। সংকোচে কবিতাটা তাঁর হাতে দিলাম। তিনি দেখবেন বলে ওপরে চলে গেলেন। পরের সপ্তাহে ছাপা হলো কবিতাটি। স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো  নাটক দেখে কবিতাটা লিখেছিলাম। পরদিন বাংলা একাডেমির গেট দিয়ে ঢুকতেই খ্যাতিমান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে দেখা। সালাম দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি রেজাউদ্দিন স্টালিন? আমি সবিনয়ে বললাম, ‘জি।’ তিনি বললেন, ‘সংবাদে আপনার কবিতাটা ভালো হয়েছে।’ আমি দারুণ প্রীত হলাম আর কবিতাটা ছাপার জন্য হাসনাতভাইকে ধন্যবাদ দিলাম। তারপর বহুভাবে বহু জায়গায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি নম্রভাবে স্বভাবসুলভ ভাববিনিময় করেছেন। এত সজ্জন সাহিত্যমানুষ আমি কম দেখেছি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, ভাষা আন্দোলনের কবিতা সম্পাদনার সময় ফোনে কবিতা নিয়েছিলেন। কালি ও কলমকে তিনি একটি প্রথম শ্রেণির সাহিত্যের কাগজ করে তুলেছিলেন। ভারত, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের সাহিত্যজন সমাদৃত হয়েছেন এই কাগজে। অনেক পরে জেনেছিলাম, তিনি কবিতা লেখেন মাহমুদ আল জামান নামে।

মাঝে-মাঝে তাঁর লেখা পড়ে ভালো লাগলে ফোন করতাম। তিনি খুশি হতেন। তাঁর মৃত্যুর এক মাস আগে দৈনিক সমকালের ‘কালের খেয়া’তে তাঁর দারুণ একটি কবিতা পড়ে ফোনে জানালাম। তিনি প্রায় দু-মিনিট আমার সঙ্গে কথা বললেন। আর কোনোদিন এত সময় কথা হয়নি। সবকিছুতে তিনি ছিলেন শান্ত ও ধৈর্যশীল। যখন যে-পত্রিকায় তিনি হাত দিয়েছেন সে-পত্রিকা হয়েছে আমাদের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাগজ। বাংলাভাষার প্রধান কবিগণ তাঁকে বেশ সম্মান করতেন। হুমায়ুন আজাদের মতো লোককেও দেখেছি তাঁর প্রশংসা করতে।

একবার এক বিজয় দিবস সংখ্যায় আমার কবিতা ত্রিদিব দস্তিদারের নামে সংবাদ সাময়িকীতে ছাপা হয়ে গেল। তখন সেই তারুণ্যে অনেক ক্ষোভ। সায়ীদ আতিকুল্লাহ ভাইকে নালিশ দিলাম। পরের সংখ্যায় কবিতাটি আবার আমার নামে ছেপে দিলেন। তারপর অনেকদিন সংবাদ সাময়িকীতে কবিতা দিইনি। অনেকদিন পর হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা ক্লাবে দেখা। তিনি খুব আস্তে করে বললেন, ‘লেখা পাঠাবেন।’ কবি আহসান হাবীবের পর এমন দায়িত্বশীল সম্পাদক কজন আছেন। শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখের সঙ্গে তাঁর অকৃত্রিম সখ্য ছিল। তরুণদের প্রতিও তাঁর অগাধ সমর্থন। মাহমুদ আল জামানের (আবুল হাসনাত) অনেক কবিতা প্রাণভরে পড়েছি। ভালো লাগলে জানিয়েছি। কবিতা পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছি। ভালো লাগলে ছাপবেন। বিশ্বাস ছিল। এখন একটা শূন্যতা তৈরি হলো। আমরা এই সময়ে হারিয়েছি অনেক কৃতী মানুষকে। কিন্তু হাসনাতভাইকে হারানোর ক্ষতি আমাদের সাহিত্যকে মুচড়ে দেয়। এখন কার কাছে কবিতা দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অপেক্ষা করব। হাসনাতভাইয়ের যে-কবিতা পড়ে একদিন প্রশংসা করেছিলাম সেই কবিতার কয়েক লাইন :

একদিন জন্মান্ধ লোকটি শোকস্তব্ধ শহরে

নারীর জন্য দৈন্য দুঃখ শোক নিয়ে

অপরাজিতার মতো নীল হয়ে বেঁচেছিলো

আকাশ গঙ্গায় খাণ্ডবদাহনে

কবিতার শিরোনাম ‘ঠিক ঠিক পৌঁছে যাবো’। শামসুর রাহমানকে নিবেদিত কবিতা। হাসনাতভাইয়ের প্রিয় কবি শামসুর রাহমান যেখানে ঠিক ঠিক পৌঁছে গেছেন হাসনাতভাইও সেখানে আছেন বিশ্বাস হয়। জীবনানন্দীয় নির্জনতাপ্রিয় কবি মাহমুদ আল জামান মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিলেন কি? তা না হলে কি অবলীলায় লিখলেন একটি মৃত্যুর মতো কবিতা : ‘একটি গাছের ভেতর অন্য একটি গাছ/ একটি গাছের ভেতর অন্য একটি দৃশ্যে/ আমার শব্দের সঙ্গীরা এখন ভীষণ একা/ দুটি মানুষ এখন একটি মানুষের মধ্যে খুন হয়ে/ ছুটে চলেছে হেমন্তের মাঠে।’ এই হেমন্ত জীবনানন্দীয় হেমন্ত নয়। এখানে এক অসীম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ছুটে চলেছে রক্তের ধারা। সবকিছুর মধ্যে বিপ্রতীপতা। সবকিছুই রক্তে ভেজা। তার মধ্যে একটি মৃত্যুর কথা কবিকে ভাবিয়েছে। সে কি কবির  নিজেরই মৃত্যু। এ-প্রশ্নের মীমাংসা দুরূহ। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের সাহিত্যের সুরুচিপূর্ণ ইতিহাসে। হোর্হে লুইস বোর্হেস যেমন বলেন, ‘মানুষ বাঁচে তার বন্ধুদের স্মৃতিতে।’ আবুল হাসনাত কিংবা মাহমুদ আল জামান বাঁচবেন পাঠকের হৃদয়ে আর বন্ধুদের স্মৃতিতে। এজরা পাউন্ড যেমন ভালোবাসা বোঝাতে তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি চিরদিনের জন্য এমন কি তারপরেও।’ আমি এর সঙ্গে হাসনাতভাইয়ের জন্য এক অসীমতা যোগ করব : হাসনাতভাই আমরা আপনাকে ভালোবাসি চিরদিনের জন্য, এমনকি তারপরেও।