নতুনকে আহ্বানের মন্ত্র : সম্পাদক আবুল হাসনাত

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৯’-এর অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে পত্রিকা-সম্পাদক আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘ষোলো বছর ধরে বিরতিহীনভাবে প্রতি মাসে কালি ও কলম প্রকাশিত হয়ে আসছে, যা যে-কোনো বাংলা সাহিত্য পত্রিকার জন্য একটি বিরল ঘটনা। … বাংলাদেশের যে-কোনো সংকটকালে এদেশের যুবসম্প্রদায় ও তরুণ লেখকরাই অগ্রণী হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিদ্রোহ ও অনুভবশীলতা নতুন পথ নির্মাণ করে। এই বোধকে বিবেচনায় নিয়েই কালি ও কলম হয়ে উঠেছে তরুণদেরও পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ লেখকরাও এই পত্রিকায় মর্যাদার সঙ্গে উপস্থিত।’

আমরা গভীর বেদনায় জানতে পারলাম, এমন বোধ-প্রত্যয়ী মানুষটি অতিসম্প্রতি অকস্মাৎ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। পত্রিকার আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার মুখে। ইতোপূর্বে অতিমারীর আক্রমণে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আনিসুজ্জামান গত হয়েছেন। পরপর এ-ধরনের অভিঘাত পত্রিকাজীবনের নিরবচ্ছিন্নতায় ব্যাঘাত ঘটায়। বিশেষত কালি ও কলমের মতো চেতনদীক্ষিত পত্রিকায়।

আবুল হাসনাত ভাবনায় আজন্ম যে-পতাকাটি বহন করেছেন, একদিকে যেমন তা আন্তর্জাতিকতা, সাম্যবাদ, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন, অন্যদিকে বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিকতা ও সমস্ত ইতিবাচক উত্তরাধিকার। যে-উত্তরাধিকারের রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বাধীন বাংলাদেশ।

কালি ও কলম ঢাকা নামক নির্দিষ্ট শহর থেকে প্রকাশিত হলেও, কলকাতা-গুয়াহাটি-আগরতলা-প্যারিস-লন্ডনে থাকা আধুনিক বিশ্বের অগ্রবর্তী চিন্তার সাহিত্যপ্রেমী সকল বাঙালি পাঠকের কাছে আপন পত্রিকা। উপন্যাস, গল্প, কাব্যের গভীর রসসিঞ্চন থেকে নাটক, ভ্রমণ, প্রতিবেদন, বিদেশি সাহিত্য, শিল্পসংবাদের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক একটি মস্ত চেতনার ছোঁয়া প্রতিটি সংখ্যাই আমাদের উপহার দেয়।

প্রযুক্তিদমিত, নিওলিবারাল পৃথিবীতে মানুষের ভাবনাচিন্তা ও চেতনার শক্তিকে যখন একমুখীন নিষ্ক্রিয় একটি অতলে গুঁজে রাখার প্রচেষ্টা চলছে, কালি ও কলমের প্রতিটি সংখ্যায় খোরাক হিসেবে প্রসারিত ভাবনার একটি মিথস্ক্রিয়া পাঠকের মননে শক্তির সঞ্চার করে। চিন্তার একটি অদৃশ্য পুষ্টি যেন ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আঠারো বছর ধরে নিয়মিত এ-কাগজের নির্বাচন ও পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বহাল রাখার কাজে প্রকাশক ও সম্পাদকমণ্ডলীর ভূমিকার পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাতের স্মৃতিতে নিছক কুর্নিশ জানানো যথেষ্ট হবে না জানি।

তিনি দীর্ঘকাল দৈনিক সংবাদের সাহিত্য শাখায় নিরলস শ্রমের মধ্য দিয়ে যে-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, কালি ও কলম যে সেসবেরই পরিণত ছাপ। প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবি-গল্পকার থেকে প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিতদের এমন মেলবন্ধন ঘটানো, মস্তিষ্কের কম্পিউটারে অসীমান্তিক একটি গুণগত খোঁজ, অতীতের ইতিবাচক উজ্জ্বল উদ্ধার-এর প্রয়াস আবুল হাসনাতকে সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বরণীয় করে তুলেছে। তাঁর এই অসময়ে চলে যাওয়া আমাদের ব্যথিত করছে। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ব্যক্তিপরিচয় ঘটেনি। যখনি আমন্ত্রণ পেয়েছি লিখবার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। আমার তরফে নীরবে তাঁর প্রতি সম্ভ্রম গড়ে  উঠেছিল। আবুল হাসনাত প্রমাণ করে দিয়েছেন যথাযথ সম্পাদনার কাজটি নিছক সংযোজনার দায়িত্ব নয়, দেশ-কাল ভেদে জাতির সাংস্কৃতিক শরীরে রক্ত সঞ্চালনের জটিল একটি ভূমিকা পালন। আবুল হাসনাত তা দৃষ্টান্ত রেখে পালন করে গেছেন। নিছক সম্পাদনার ভূমিকাতেই নয়, ওপার বাংলার একজন বিশিষ্ট সৃজনশীল লেখক ছিলেন আবুল হাসনাত। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল।