তাহেরা খানমের বেলা অবেলার রঙরাগিণী

বাংলাদেশে নারীদের চিত্রকলাচর্চা শুরুর পথটি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সাতচল্লিশে ভারতভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে, বিশেষত ধর্মের ওজর তুলে, নারীদের গৃহকোণে বন্দি রাখার একটা প্রবল প্রবণতা ছিল। সে-সময় যাঁরা সমাজের এই অর্গল ভাঙার পথ দেখিয়েছিলেন তাঁদের একজন তাহেরা খানম।

সমাজের অন্ধ রীতিনীতি ও প্রথাবিরোধী এই শিল্পীর জন্ম ১৯৩৬ সালে বরিশালে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রচলিত শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে, তৎকালীন গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টসে, যে প্রথম পাঁচজন বাঙালি নারী ভর্তি হয়েছিলেন তাঁদের একজন তিনি। এসময় তাঁর সঙ্গে আরো ভর্তি হয়েছিলেন রওশন আরা, হাসিনা আলি, জুবেইদা আখতার খাতুন ও সয়িদা ময়ীনা এহসান। পরবর্তীকালে সয়িদা ময়ীনা এহসান ছাড়া বাকিরা সবাই পাঁচ বছরের শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করেন।

তাহেরা খানম সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ। নারীর প্রতি পঞ্চাশের দশকের বৈরী দৃষ্টিভঙ্গিতে দমে যাননি তিনি। ঝোঁক ছিল শিল্পচর্চার প্রতি এবং সে লক্ষ্যে তিনি চারুকলায় পাঠও গ্রহণ করেছেন সমাজের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও ছিলেন উৎসুক অংশগ্রহণকারী। শিখেছিলেন সেতারও। তবে শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছেন চিত্রকলাতে। ক্যানভাসে রং-রেখায় খুঁজে পেয়েছিলেন যাপিত জীবনের বোধ, আবেগ ও প্রশ্নের সন্ধান।

স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৬১ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। এরপরই যেন কিছুটা অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন তাহেরা খানম। নিজের কাজের চেয়ে স্বামীর চিত্রকলাচর্চা যেন নির্বিঘ্ন ও গতিশীল হয় সেদিকেই বেশি মনোযোগ ছিল তাঁর। সেজন্য নতুন সংসারের সব দায়িত্ব নির্দ্বিধায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তবে থেমে থাকেনি তাহেরা খানমের তুলি। সরব নয়, নীরবে তিনি চালিয়ে গেছেন তাঁর চিত্রকলাচর্চা, তৈরি করেছেন নিজস্ব চিত্রভাষা, শৈলী। বেশকিছু একক ও যৌথ চিত্র-প্রদর্শনীতে তিনি দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজের ভাবনাচিত্র।

নিভৃতচারী এই চিত্রশিল্পী প্রয়াত হয়েছেন গত ৩১ অক্টোবর, ২০২১-এ। তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছে কালি ও কলম পরিবার।

‘তাহেরা খানমের বেলা অবেলার রঙরাগিণী’ শীর্ষক লেখাটি ২০১৫ সালে লিখেছিলেন কালি ও কলমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবুল হাসনাত। সে-বছর ৫ জুন বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজিত হয়েছিল শিল্পীর একক চিত্র-প্রদর্শনী। সেই প্রদর্শনীর প্রকাশনায় লেখাটি পত্রস্থ হয়েছিল। কালি ও কলমের পাঠকদের কাছে শিল্পী তাহেরা খানমকে তুলে ধরার জন্য লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হলো। আবুল হাসনাতও অনন্তের পথে প্রস্থান করেন ১ নভেম্বর ২০২০ সালে। তাঁকেও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। – সম্পাদক

তাহেরা খানমের বেলা অবেলার রঙরাগিণী

আর্ট ইনস্টিটিউটের তৃতীয় আবর্তনের শিক্ষার্থী তাহেরা খানম। তিনি যখন শিক্ষার্থী তখন প্রথার শাসন ছিল চিত্রবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে, প্রতিকূলতা ছিল নানা ধরনের। আর স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুকূল ছিল না। আচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রযত্নে এই শিক্ষালয়ে তাহেরা খানমের চিত্রচর্চা শুরু হয়েছিল। এই বিদ্যায়তনে প্রথম ও দ্বিতীয় আবর্তনে কোনো ছাত্রী শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী থাকলেও প্রতিকূল কারণে ভর্তি হননি।

তৃতীয় আবর্তনে তাহেরাসহ আরো পাঁচজন এই প্রথা ভাঙায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তৎকালে পঞ্চাশের দশকে এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী পদক্ষেপ। সেজন্যে অনেক গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। অন্যদিকে চিত্রচর্চার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চিত্রবিদ্যা চর্চার জন্য প্রতিবেশ গড়ে তুলতে হয়েছে। তাহেরা খানমসহ এই পাঁচজন সেজন্যে প্রণম্য। আজকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার যে মাধুর্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌন্দর্য এবং প্রাণময়তায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তা সেকালে অকল্পনীয় ছিল।

তাহেরা খানমের কাজে আমরা প্রত্যক্ষ করি অতলজলের আহ্বান। তিনি যখন ছবি নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনীর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তখন তা হয়ে ওঠে আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ। গুলশানের মঞ্জু আর্ট গ্যালারিতে, বাংলাদেশের চিত্রকলার ৫০ বছরপূর্তি প্রদর্শনীতে এবং বেঙ্গল গ্যালারিতে কয়েকটি যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর কয়েকটি হৃদয়গ্রাহী কাজ দীর্ঘদিন আমাদের মনে গেঁথে ছিল। এছাড়া বেঙ্গল-আয়োজিত কয়েকটি আর্ট ক্যাম্পে তিনি পরম যত্নে যে চিত্র-রচনা করেছিলেন তা সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। স্বতন্ত্র চিত্রশৈলী ও নির্মাণ কুশলতা এই ছবিগুলোতে ধরা পড়েছিল। ষাটের দশকজুড়ে তিনি জলরং, তেলরং এবং চারকোলে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন বিভিন্ন মাধ্যমের সংমিশ্রণে। তখন প্রচ্ছন্ন রেখেছেন নিজেকে। তাঁর সৃজনকে আড়ালে রাখা তাঁর স্বভাবধর্ম হয়ে উঠেছিল। তাঁর যে এত আগ্রহসঞ্চারী চিত্র আছে এবং বিষয়ে ও উদ্ভাবনী কৌশলের জন্য এই নির্মাণ ও সৃষ্টিগুচ্ছ যে মূল্যবান এ প্রত্যক্ষণের পর তা প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে। এ নিয়ে তাঁর কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না। বরং শিল্পীর বিনয়ে সদা তিনি আড়ালেই থাকতে চেয়েছেন।

বেঙ্গল গ্যালারির সুবীর চৌধুরীর একান্ত আগ্রহেই নীরবতা ভেঙে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা তাঁর। প্রয়াত সুবীর চৌধুরীর আগ্রহে তিনি এই প্রদর্শনী করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। সুবীর আজ নেই। সেজন্যে তাঁর হৃদয়বেদনার অন্ত নেই। সুবীরকে তিনি কথা দিয়েছিলেন একক প্রদর্শনী করবেন। সুবীরের প্রতি সম্মানবোধ থেকেই তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। 

প্রথমদিকের কাজে তিনি অ্যাকাডেমিক বৃত্তে আবদ্ধ থেকেছেন। পরবর্তীকালে এই বৃত্ত ভেঙে কাজ করেছেন। ১৯৬১ সালে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর নতুন সংসারের ঝক্কি ছিল; এতদিন যে-ধারায় জীবন চলে এসেছিল তাতে কিছুদিনের জন্যে হলেও ছেদ পড়েছিল। সে-সময়ে অর্থনৈতিক টানাপড়েনে শিল্পীজীবন। উদার মনে সহায়তা করেছেন কাইয়ুমকে। জীবন সংগ্রামের দায় নিজের স্কন্ধে বহন করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর সৃষ্টির গভীরতা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল। কাইয়ুমের কাজে, তাঁর সৃষ্টিকুশলতায়, তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। এ-সময় কাইয়ুমের বন্ধুর বৃত্ত বৃহৎ। নানা কাজে মেতে আছেন তিনি। বইয়ের প্রচ্ছদ, প্রকাশনা, নির্মল চলচ্চিত্রের নির্মাণ নিয়ে ভাবনা, ছবি আঁকা, নিত্য পরীক্ষা – সবকিছুতে তাহেরার উৎসাহ কাইয়ুমকে এগিয়ে নিয়েছে আর সংসারের সেই দায় বহন করতে গিয়ে নিজের সৃষ্টির উদ্যান থেকেও সরে এসেছিলেন। যদিও এ ছিল সাময়িক ছেদ; কিন্তু চিত্রবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে যে মনন ও সৃজনকে ধমনিতে ধারণ করে ছিলেন, তা তাঁকে সর্বদা প্রাণিত করেছে চিত্র-সৃষ্টিতে। সেজন্যে আমরা দেখতে পাই, প্রথমদিকের কাজে মননধর্মিতা, সারল্য বা লোক-ঐতিহ্যের অনুরাগের যে-ছাপ স্পষ্ট হচ্ছিল, তা তাঁকে পরবর্তীকালে আরো বলীয়ান করে তুলেছে চিত্র রচনায় ও সৃজনে। কিছুদিন বিরতির পর তিনি যখন সৃজনে নিজেকে ব্যাপৃত করলেন, দেখা গেল তাঁর সৃজনে উৎকর্ষের ছাপ।

তাহেরা খানমের জন্ম ফরিদপুরে, ১৯৩৬ সালে। পৈতৃক নিবাস বরিশালে। বরিশালে অবশ্য তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়নি। পিতার চাকরিসূত্রে কিছুটা সময় কেটেছে কলকাতায়, তারপর ঢাকায়। স্কুলশিক্ষা সমাপনের পর আর্টস্কুলে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। ঢাকা আর্টস্কুলের প্রথম মেয়েদের ব্যাচ। এই ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন পাঁচজন মেয়ে। প্রথাশাসিত পূর্ববঙ্গে মেয়েদের চিত্রচর্চার পথ খুব সহজ ও মসৃণ ছিল না। জ্যেষ্ঠভ্রাতার উৎসাহে এবং পিতার একান্ত আগ্রহাতিশয্যে আর্টস্কুলে ভর্তি হলেন তাহেরা। পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা তাহেরার সেই চুয়ান্ন সালেই ভিন্ন রুচি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই তিনি পারিবারিক উৎসাহে সেতার শিখেছিলেন ওস্তাদ খাদেম হোসেন খানের কাছে। সেতার শেখার মধ্যে নিষ্ঠা ছিল; অচিরেই সিদ্ধি অর্জন করলেন। ওস্তাদ খাদেম হোসেনের সঙ্গে সেতার বাদনে অংশ নিলেন ’৫৪ সালে নিউ পিকচার্স হাউসে। কিছুদিন পরে ওয়াইজঘাটে বাফার দুটি অনুষ্ঠানে, বাফার একটি অনুষ্ঠানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উপস্থিত ছিলেন – এ তিনটি অনুষ্ঠানই ছিল পঞ্চাশের দশকে ঢাকার নিস্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক আবহে বড় ঘটনা।

আর্টস্কুলে ছবি আঁকার পাঠ নিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, খাজা শফিক আহমেদ, হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ কিবরিয়া ও আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে। স্কুলের শিক্ষকরা পরম মমতায় ও স্নেহে হাতেকলমে শিক্ষা দিয়েছেন; বিশেষত আচার্য জয়নুল আবেদিনের উৎসাহে ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে স্কেচ করতে যেতেন বুড়িগঙ্গায়, রমনার রেসকোর্স ময়দানে, জনবিরল মতিঝিলে, বুড়ো শিবের মন্দিরের পাদদেশে, আজকে যেখানে টিএসসি। সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পী নিতুন কুন্ডুকে। শিক্ষক ও সতীর্থদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পেলে মেয়েদের চিত্রচর্চার পরিবেশ গড়ে উঠত না। প্রথাগত শিক্ষায় আর্টস্কুলে নিজেকে তৈরি করার ফাঁকে নিজের একটি স্বতন্ত্র শৈলী গড়নের চেষ্টা তাঁর ছিল। এই প্রয়াসে তিনি শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছেন অকৃপণ।

পঞ্চাশের দশকের এই সময়টা (’৫৪-৫৯) নানা দিক থেকে পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আবহে তাৎপর্যসঞ্চারী। তাহেরা খানম খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন এই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ। আর্টস্কুলের পুষ্টি ও বৃদ্ধি, চুয়ান্নর নির্বাচন, সাহিত্য সম্মেলন, সাধারণ মানুষের বেঁচে ওঠার আর্তি ও বেদনা তাঁর মননে এক আবেগের জন্ম দিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যায়ে তিনি যখন পাশ করে বের হয়েছেন, তখন তিনি সৃষ্টিতে তন্ময়, কিছুটা অন্তর্মুখী। ছোট ক্যানভাস ও ছোট জলরঙে বেশ সিদ্ধহস্ত। এমনকি তাঁর বেশ কয়েকটি স্টিল লাইফ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন প্রধানত জলরঙে, চারকোলে, প্যাস্টেলে ও মিশ্র মাধ্যমে এবং আজো তাঁর প্রধান চিত্রমাধ্যম জলরং। ছাত্রজীবনের পর তেলরঙে আর হাত দেননি। বিয়ের পরে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এই মাধ্যমের প্রতি তাঁকে বিমুখ করে তোলে। দুজনের জন্য প্রয়োজনমতো রং আর ক্যানভাস সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ছিল। নিসর্গের নিহিত সৌন্দর্য এবং অন্তর্লোকের মর্মবেদনা, আনন্দ, বিষাদ তাহেরার ছবিতে উঠে এসেছে। তাঁর কাজে দৃশ্যমান অবয়বগুলো সরলীকৃত হয়েছে। এই সাফল্যের মধ্যে দৃশ্যমান সত্যকেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন। কয়েকটি কাজে পল ক্লী এবং অঁরি মাতিস রেখা ও ফর্মের দিক দিয়ে প্রভাব ফেললেও তাঁর ছবির চরিত্রকে ক্ষুণ্ন করেনি, বরং উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশের দশকের ঢাকাকে তিনি দেখেছেন, দেখেছেন ঢাকার পরিবর্তন। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীতে রূপান্তর, তার মানুষজন, সব দেখেছেন গভীর মমতার সঙ্গে। দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ, যা তাঁর কাজেও কমবেশি প্রতিফলিত। তিনি যে নিয়মিত কাজ করেছেন এবং এই কাজগুলো যে শিল্পিত পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানে উপেক্ষণীয় নয়, কিছুটা মগ্নচৈতন্যজাত সরলরেখা থেকে উদ্ভূত তাঁর এক চেনাজগৎ, এই চিত্রগুচ্ছে তা দেদীপ্যমান।

দুই

বেঙ্গল শিল্পালয়-আয়োজিত ‘বেলা অবেলার রঙরাগিণী’ প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজ কিছুদিন আগে করা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর সৃজনে যে-চরিত্র সৃষ্টি হয়েছিল, তিনি প্রসারিত এক চেতনায় তাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। এবং এই চেতনায় কত ধরনের না তিনি কাজ করেছেন। বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর সকল কাজই অ্যাক্রিলিকে করা। তাঁর পটে যেমন ফুল, পাখি উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি আরো গভীরতায় আমরা প্রত্যক্ষ করি মানবজীবনের নানা অনুষঙ্গ। তাহেরা খানমের এ প্রত্যক্ষণ গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। আমরা এই চিত্রগুচ্ছে দীপিত বোধ করি। গভীর বোধ নিয়ে তিনি মানুষের মর্মযাতনা ও বেদনাকে উপস্থাপিত করেছেন। যদিও কিছু সৃষ্টিতে পরাবাস্তবতার যে-আভাস আছে তাতে মগ্ন চৈতন্যগুণও প্রধান হয়ে ওঠে। আত্মপ্রতিকৃতি কিংবা তাঁর তুলিতে কাইয়ুম চৌধুরী প্রতিকৃতি অর্থময় ও ব্যঞ্জনাময়। বিধৃত হয়েছে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিস্বরূপ।

এছাড়া বেশ কয়েকটি ছবি সরল ও ছন্দোময়, জীবনপ্রবাহের নানা অনুষঙ্গে রহস্যময়ও। এ আবরণ ভেদ করে আমরা যখন এর গভীরে প্রবেশ করি, জীবনের বহুকৌণিক দিক তখন দেখতে পাই। তাহেরা খানমের নির্মাণ ও সৃষ্টি এখানেই অনন্য হয়ে ওঠে। এছাড়া শিল্পীর লোক-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভাবনার প্রকাশ আছে তাঁর সাম্প্রতিক করা কয়েকটি কাজে। এ এক অনুভবশীলতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।